শাশ্বতী নন্দীর গল্প : বৃষ্টির গন্ধ

শ্রীকে আজ সাত সাতটা ক্লাস নিতে হল স্কুলে। এইচ এম ডেকে বলে দিয়েছেন, ম্যাথস্‌ আর জিওগ্রাফির টিচার ছুটিতে, অতএব তোমাকেই ম্যানেজ করতে হবে শ্রী। কথাটা বলেই উনি সুন্দর করে হাসলেন। ভদ্রমহিলার এই গুনটা আছে। কখনও রাগেন না। আসলে বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই রাগকে ট্যাঁকে গুজতে জানে। 
টিচাররা অনেক সময়ই স্টাফ রুমে তুমুল ঝড় তোলে। তাদের ঘাড়ে অহেতুক ক্লাসের বোঝা চাপানো হচ্ছে। ম্যাথসের মিরা সেনগুপ্তর চলে যাওয়ার পর সিটটা খালিই রেখে দেওয়া হয়েছে। এইচ এমের সেই একই কথা, সুটেবল্‌ রিপ্লেসমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। অতএব চালাও সাবস্টিটিউট দিয়ে। 

ওদিকে গীতালি মেটারনিটি লিভে যাওয়ার পর ওর হিস্ট্রি স পুষ্পিতাকে দেওয়া হল। সে বেচারি কেঁদে ককিয়ে একশা। ফিজিক্যাল সাইন্সে র টিচার হিস্ট্রি পড়াবে ! ওর মুখের ভাঁজ দেখে এইচ এমের মুখে তখনও অমায়িক হাসি, আরে, হিস্ট্রি তো গল্পের মতো। সো ইজি। ম্যানেজ করতে পারবে না ? ঘরে ছেলেকে পড়াও তো। 

পুষ্পিতা কিছু বলতে গিয়েছিল বোধহয়। কিন্তু সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ও স্ট্যাচু। সি সি টি ভি ক্যামেরা ফিট করা। সঙ্গে সঙ্গে হাঁ মুখটা ও জোর করে চিপে বন্ধ করে ফেলেছে। আর একটু হলেই কেস খেয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস... এইচ এম তখনও তাকিয়ে ওর দিকে, কী হল পুষ্পিতা ? স্পিক আউট সামথিং। হিস্ট্রি নিয়ে এত ভয় ? কিছুদিনের জন্য চালিয়ে দিতে পারবে না ? 

ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ও স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো ঘাড় নাড়তে থাকে, নো প্রবলেম বড়দি, নো প্রবলেম। কেন পারব না, নিশ্চয়ই পারব। হিস্ট্রি তো। সো ইজি। হি, হি, হি। 

সবাই তাকিয়ে দেখছে পুষ্পিতাকে। বিদিশা দাঁত চিপে বলল, কেমন পালটি খেয়ে গেল দেখলে। গদ্দার কোথাকার। কিসসু হবে না এখানে। টিচারদের মধ্যে ইউনিটিই নেই। 

ইদানিং ফ্লাওয়ার ল্যান্ডের টিচারদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একটাও ফ্রি পিরিয়ড পাচ্ছে না তারা। দুদিন অন্তর ক্লাস টেস্ট, ইউনিট টেস্ট। সেগুলোর প্রশ্ন পত্র তৈরি করা, রাজ্যের খাতা দেখা। মাসে একটা পেরেন্টস টিচার মিটিং, তার আগে ছাত্র ছাত্রীদের অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করা। টিচারদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বিদিশা একদিন ওর পনি টেল ঝাঁকিয়ে বলল, হরিবল্‌। এর একটা বিহিত চাই। দিনের পর দিন এই রকম হারকিউলিসের বোঝা টানা অসম্ভব। 

স্কুলের কৃষ্ণকলি, বিদিশাদের গলাই সবাইকে ছাপিয়ে যায় সব সময়। শ্রী নবাগতা। দু মাস মাত্র চাকরির বয়স। চুপচাপ সব লক্ষ করা ছাড়া এখন আর কোনও কাজ নেই। তাছাড়া এই প্রোবেশন পিরিয়ডটা খুব সাংঘাতিক একটা হার্ডেলস্‌। এটাকে যেভাবেই হোক টপকাতে হবে। তাই কথা বিক্রির চাইতে কথা ক্রয় করাকেই সে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে। 

স্টাফরুমে আজকাল যখন কালবৈশাখী ঘনায়, ও অনেকটা গোবেচারা টাইপ চোখ মুখ করে কুঁকড়ে বসে থাকে। ফলে অনেক কিছু থেকেই ওকে রেহাই দেওয়া হয়। 

মাঝে মাঝে বিদিশা হুংকার ছাড়ে, চল সবাই মিলে এইচ এমের কাছে যাই। কিন্তু প্রোসেশনে সামনের সারিতে কে কে থাকবে ? প্রশ্নটা উঠলেই দেখা যায় বেশির ভাগ টিচারের মোবাইলে নিঃশব্দে তখন নানা রকম কল আসতে শুরু করেছে। আর তারাও কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক সরে যাচ্ছে। অতএব আলোচনা মুলতবি। 

বিদিশার মাথায় সব সময় একটা হাই পাওয়ার ল্যাম্প অন করা। ও রাগে গড়্গড় করতে করতে বিষ ধোঁয়া ওগড়াতে থাকে। 

শ্রীর মাঝে মাঝে মনে হয় বিদিশার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে অদৃশ্য ঝান্ডাটা ধরে এগিয়ে যায় এইচ এমের ঘরে। এছাড়া আরও অনেকগুলো ইচ্ছে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। কিন্তু আড়াল থেকে কেউ একজন ছুটে এসে ওর পথ রোধ করে। কে সে ? শ্রী চেনার চেষ্টা করেছে। পারেনি। 

তবে নরম মাটিও তো একসময় রোদে পুড়ে পুড়ে শক্ত হয়। ফ্লাওয়ার ল্যান্ডের জমিতেও এখন এঁটেল মাটি। ফলে সব টিচারদের একদিন ধৈর্যের বাঁধন ভাঙল। প্রতিবারের মতো এবারও বিদিশা রিং লিডার। অল্প বয়সে সে যে গলাখানা ভালোই সেধেছিল তা বেশ বোঝা যায়। গলা চড়িয়ে বলে, এভাবে আমাদের ওপর আর কতদিন রোলার চালানো হবে ? একটাও একস্ট্রা ছুটি মিলবে না। অসুখ বিসুখ, বিপদ আপদ সব ফেলে আমাদের স্কুলের জন্য পড়ি কী মরি বলে ছুটতে হবে। সি এল, মেডিক্যাল লিভ সব নামকেওয়াস্তে । এই এক্সপ্লয়েটেশন আমরা মানব না। সঙ্গে সঙ্গে মিত্রা একটা হাত ওপরে তুলে প্রতিধ্বনি তুলল, মানব না, মানব না। 

সমর্থন পেয়ে বিদিশা আবার গর্জায়, কেন আমরা মানুষ নই ? লেখাপড়া শিখে এখানে আসি নি ? 

কিন্তু হম্বিতম্বিগুলো আর বেশি দূর গড়াল না। কারণ উত্তপ্ত আলোচনায় জল ঢেলে দিল মণিমালা। স্কুলের একজন নন টিচিং স্টাফ। এইচ এমের ফাই ফরমাশ খাটে। কিন্তু সবাই জানে ও এইচ এমের একনিষ্ঠ স্পাই। 

সামনে এসে দাঁত বার করে বলল, দিদিমণিরা আপনাদের মধ্যে যে কোনও একজন বড়দির ঘরে যান। এক্ষুণি। 

ব্যস্‌ হয়ে গেল। সবার দম শেষ। মুখের রক্ত চোঁ করে শুষে গিয়ে রং হয়ে গেল ফ্যাকাসে সাদা। পিয়ালি সব চাইতে ডরপুক। হিক্কা তুলতে তুলতে বলে, কে ডেকেছে ? মিত্রা ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, আর কে, আমাদের হিরিম্বা ম্যাডাম। 

এইচ এম অর্থাৎ হেড মিস্ট্রেসের ফুল ফর্ম এখন ওরা পালটে দিয়ে করেছে হিরিম্বা ম্যাডাম। মণিমালা খিলখিল হাসে, কী বললেন দিদি ? হিরিম্বা, হি হি। 

- এই তুই যা তো। হি হি করে হাসিস না। বল, যাচ্ছি আমরা। একা কেউ যাবে না। সবাই জোট বেঁধে যাব। কী তাই তো ? – বিদিশা সমর্থন চায়। 

- সবাই কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তাই। 

মণিমালার মুখটা তখনও হাসি হাসি। বলে, ঠিক আছে, তাহলে তাই বলি গিয়ে। হি, হি, হি, তোমরা জব্বর একটা নাম দিয়েছো গো। কী যেন হিরিম্বা ... 

বিদিশা পেছন থেকে ওর একটা হাত টেনে ধরে, অ্যাই শোন মণি, অত হি হি করার কিছু নেই। ওগুলো সবাই জোক করে বলে। এই সব কথা যেন এইচ এমের কানে না পৌঁছোয়। নইলে কিন্তু ... আর শোন তোর যেন মিত্রাদির কাছে গত মাসে কত ধার ছিল ? আর আমার টাকাটা তো মেরেই দিলি বোধহয়। 

মণিমালার মুখখানা সঙ্গে সঙ্গে ছোট আমসি । ঢোঁক গিলে বলে, ধ্যেত তোমরাও যেমন। পাগল আমি ? এ সব কথা কেউ বলে নাকি ? জানি তো মজা করছ। আর দিদিরা শোন, আমার সব ধার দেনা এই মাসে মাইনে পেলে আমি মিটিয়ে দেব। বার বার মনে করিয়ো না গো। মণিমালার মুখ একটু পাংশু দেখায়। 

মিত্রা চোখ টেপে, না, না, মনে করাচ্ছি কই। জাস্ট বললাম। এখন তাড়াতাড়ি যা, ওঁর ঘরে। বেল দিল মনে হয়। 

- হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাচ্ছি। তোমরা সবাই একে একে চলে এস তাহলে। - মণিমালা ছুটে চলে যায়। 


(দুই) 

এইচ এমের ঘরে একটা ছোটখাট মিটিং বসেছে। তাঁর একই রকম হাসি মুখ। হেসে হেসেই টিচারদের সমস্যার কথা জানতে চাইছেন। কিন্তু বিদিশার মনে হল তাঁর চোখ দুটো সারাক্ষণ যেন ওর দিকেই ঘুরে বেরাচ্ছে। 

অত সাহসী হয়েও বিদিশা অস্বস্তিতে বারবার রুমাল বার করে মুখ মুছছে। এইচ এম হেসে বলল, খুব কি গরম লাগছে বিদিশা ? সত্যি এ বছর গরমটা বড্ড ভোগাচ্ছে। অ্যাই ধ্রুব, এ সি টা একটু বাড়িয়ে দাও তো। দিদিমণিদের গরম লাগছে। তোমরা ঠান্ডা কিছু খাবে ? 

সবার মাথা এক সাথে নড়ে উঠেছে, না, না, বড়দি। ঠিক আছে। 

এইচ এম এবার মূল আলোচনায় এলেন। বলেন, আচ্ছা, আজ আমি একটা ব্যাপারে খুব হার্ট হয়েছি। তোমাদের স্টাফ রুম থেকে এত হাউলিং আসছিল কেন ? 

সবাই চুপ। মিত্রা আর বিদিশা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। 

- ইয়েস বিদিশা, তোমার কিছু বলার আছে ? 

-বিদিশার জায়গায় মিত্রা মুখ খুলল, আমরা ইদানিং বেশ কিছু প্রবলেম ফেস করছি। ভেবেছিলাম আপনার কাছে আসব। 

- রাইট। সেটাই তো উচিত ছিল। সমস্যা থাকতেই পারে। কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি করে তো তার সলিউশন হয় না। তোমরা টিচাররাই যদি এমন ইনডিসিপ্লিনড ওয়েতে বিহেভ কর তাহলে ছাত্র ছাত্রীরা কী করবে ? ছিঃ, আমি তোমাদের থেকে এরকম বিহেভিয়ার আশা করি নি। কী বিদিশা, তুমি এখন ঠান্ডা হয়েছ তো। এ সি কিন্তু জেট কুলে চলছে। বল তোমার কী বক্তব্য ? 

বিদিশা তবু একবার রুমাল বার করে মুখ মুছল। তারপর একটু কেটে কেটে বলে, মানছি বড়দি, আমাদের আলোচনা একটু বেশিই জোরালো হয়ে গেছে। কিন্তু দিনের পর দিন যে প্রবলেমগুলো আমরা ফেস করছি তা সম্বন্ধে কি আপনি যথেষ্টই ওয়াকিবহাল নন ? এবং সব জেনেশুনেও যখন ম্যানেজমেন্ট ঠুঁটো হয়ে বসে থাকে তখন টিচারদের রিঅ্যাক্ট করা তো স্বাভাবিক। 

এইচ এম তার রিমলেস চশমার ওপর দিয়ে এতক্ষণ বিদিশাকে দেখছিলেন।। ও থামতেই এবার তিনি মুখ খুললেন, তোমরা একটা কাজ কর। তোমাদের যা যা প্রবলেম সব ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে আমায় দাও। আমি কমিটির কাছে প্লেস করব। ইন ফ্যাক্ট, তোমাদের আজকের বিহেবিয়ার সম্বন্ধে রেক্টার ভীষণ আপসেট। ঘরে বসেই মনিটরে তিনি সমস্ত কিছু দেখেছেন। তাকেও আমার এখন রিপোর্ট করতে হবে। 

পিয়ালির আবার হেঁচকি উঠতে শুরু করেছে, ই – ই ! সর্বনাশ ? 

মিত্রা পেছন ফিরে কটমট করে ওকে একবার দেখল। 

হঠাত এইচ এম রিভলভিং চেয়ারটাকে বোঁ করে এক পাক ঘুরিয়ে নেয়। অধস্তনদের সামনে এই ভাবে চেয়ার ঘোরালে বোধহয় নিজেকে একটু পাওয়ারফুল মনে হয়। আচমকা তিনি শ্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক হাসতে শুরু করেন। সবাই অবাক। হঠাত শ্রীর দিকে কেন ? শ্রীও অহেতুক দুবার শাড়ির আঁচলের গায়ে হাত বোলালো। এইচ এম বলে, কী শ্রী, আজকের ব্যাপারে তোমার কোনও বক্তব্য নেই ? 

- আমার ? মানে আমার বক্তব্য জিজ্ঞাসা করছেন ? 

- ইয়েস তোমাকে বলছি। বাই দা বাই। তুমি কি শাড়ি পরায় খুব একটা হ্যাবিটুয়েটেড নও ? প্লিট ফেলেছ অসমান করে, সেফটিপিন এমন করে গেঁথেছ ... - এইচ এম হাসছেন। 

- না, মানে তাড়াহুড়োয় হয়তো ... – শ্রীর কাঁচুমাচু মুখ। 

কেন যে হঠাত ওকে নিয়ে পড়ল এইচ এম, ওর ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। তবে ছোটবেলায় শ্রী ওর বাবাকে দেখেছে কোনো কিছুতে অসন্তুষ্ট হলে অহেতুক ওদের বাড়ির বুড়ো নিরীহ চাকরটাকে তিনি বকাবকি করতেন। আর সেই বকাঝকা শুনেই সবাই ওরা সমঝে যেত। হয়তো একই ট্যাকটিস এইচ এমও চালাচ্ছেন। 

- শোন সব কিছুতেই একটা ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করতে হয়। - এইচ এম প্রাঞ্জল ভাবে কথা বলছেন। - একটু সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে গাছিয়ে স্কুলে আসবে। আসলে বাচ্চাদের পড়াতে গেলে একটু সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্টও দরকার। এলোমেলো, অসুন্দর হয়ে এলে ওদেরও মন পাবে না। কী, ভুল বলছি ? – এইচ এম সবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন। 

কেউ কেউ তাঁর সমর্থনে মাথা নাড়ল, কেউ কাশি দিয়ে মুখ মুছল। 

- এনি ওয়ে, আজকের ব্যাপারে, ইওর কমেন্টস্‌ প্লিজ। - এইচ এম আবার সুন্দর হাসিটা উপহার দিলেন। জ্বলজ্বলে চোখ করে তাকিয়ে আছে শ্রীর দিকে। 

ও অসহায় ভাবে একবার বিদিশা আর একবার মিত্রার দিকে তাকাল। ওদের ভাবলেশহীন মুখ। যেন তুমি ট্রেনি। নিজের যুদ্ধটা নিজে লড়ো। পার্মানেন্ট স্টাফরা এর মধ্যে নেই। ট্রেনিং পিরিয়ড থেকে যুদ্ধ করতে শিখলে তবে না তুমি রিটায়ারমেন্টের আগে একজন ভাল যোদ্ধা হতে পারবে। 

অতএব শ্রী টলমল পায়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রর দিকে এগোতে শুরু করেছে। সামনে অনেকগুলো হার্ডলস। মাথা ঠান্ডা করে পেরোতে হবে, টপকাতে হবে। কখনও লো জাম্প, কখনও আবার হাই জাম্পে। 

এইচ এম অধৈর্য হয়ে ডাক দিল, কী হল শ্রী ? 

ও গলা ঝেড়ে কিছু একটা বলতে গেল কিন্তু কথাগুলো সব জড়িয়ে যাচ্ছে। যাবেই তো। খালি যে “একলা চল রে” গানের সুরটাই ভেতরে ভেতরে গুনগুন করে বেজে চলেছে। নাহ্‌, এভাবে হবে না। মনটাকে কোনো এক বিন্দুতে স্থির করতে হবে। ও তো এত ডরপুক ছিল না। শ্রী কলেজ জীবনের ছবিটা হাতড়াতে থাকে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ও মাইকের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা করে চলেছে আর ওর সহপাঠীরা ... 

- অ্যাকচুয়েলি বড়দি, - শ্রীর গলার স্বর এবার পালটে গেছে ম্যাজিকের মতো,- ইউ আর হানড্রেড পার্সেন্ট রাইট। যে কোনও জিনিসের সঙ্গে একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। এই যে আমাদের টিচারদের ওপর মেন্টাল টর্চার চালানো হচ্ছে সেগুলো আমাদের পড়ানোর ক্ষেত্রেও এফেক্ট করে। ফর এক্সাম্পল্‌, কিছুদিন ধরেই আপনি আমাকে সাতটা করে ক্লাস দিচ্ছেন। আমি করছি, বাধ্য হয়েই করছি। কিন্তু আমারও তো একটা লিমিটেশন আছে। এ ছাড়া আরও একটা ইন হিউম্যান ট্রিটমেন্ট স্কুল অথরিটি চালান আমাদের টিচারদের ওপর। বলব কী দিদি সেটা ? হয়তো শুনতে আপনার ভাল লাগবে না। – শ্রী চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে চোখ বুলিয়ে নেয় চক্রাকারে। 

এইচ এমের মুখের হাসি ব্লটিং পেপারে শুষে গিয়ে মুখখানা কঠিন, থমথমে হয়ে উঠেছে। বলে, অনেকের এই বদ অভ্যাস থাকে। মঞ্চে যদি একবার মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় থামতেই পারে না। 

শ্রী মুচকি হাসল, তাহলে বলব না বলছেন ? কিন্তু বড়দি, আমার আবার একবার ফ্লো এসে গেলে থামতে পারি না যে। সে আপনি বদ অভ্যেস বলুন আর সু অভ্যেস বলুন। 

বিদিশা হাঁ করে শ্রীকে দেখছে। কাদার তাল ভেবে এতদিন তাহলে ভুল অ্যাসেস করা হয়েছে মেয়েটাকে। কে বলবে ও ট্রেনি ? হাবভাবে মনে হচ্ছে শ্রী অ্যাসিসটেন্ট এইচ এম। আসলে নিজের উল্টোদিকে বসে থাকা মানুষটাকে যে দুর্বল আর কম বুদ্ধিমান ভাবে তার মতো মূর্খ আর এ জগতে নেই। বিদিশাকে কে যেন একবার এ কথাটা বলেছিল। 

শ্রীর মুখ দিয়ে এবার যেন লাভা নিঃস্রীত হচ্ছে। বলে, আমাদের টিচারদের কনটিনিউয়াস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়াতে হবে। এটাই নাকি নর্ম। বসার চেয়ার আছে কিন্তু বসতে পারব না। এর স্বপক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে, বসে পড়ালে নাকি আমরা বোর্ড ওয়ার্ক করতে পারব না। বলুন এটা কোনও লজিক হল ? এই অলিখিত নিয়মের কাছে আমরা নতি স্বীকার করেছি। ভয়ে ভয়ে সব অ্যাকসেপ্ট করে চলেছি। কিন্তু আফটার অল আমরাও তো মানুষ। কখনও তো মন বিদ্রোহ করে। ধরে নিন আজ তারই আউট বার্স্ট। 

ঘরের মধ্যে পিন ড্রপ সাইলেন্স। শ্রীর নিজেরও ভাল লাগছে গুছিয়ে বক্তব্যটাকে পেশ করার জন্য। কলেজ ছেড়েছে সেই কবে। ইউনিয়ন মিটিং এ বক্তব্য রাখতে শ্রী সেনগুপ্তর জুড়ি ছিল না। এখন অবশ্য চর্চাটা বন্ধ। এবং অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এই চাকরিটা পাওয়ার পর কেমন একটু নির্জীবও হয়ে গেছে। কিন্তু বক্তব্য শুরু করার পর বুঝল আবার জোসটা ফিরে আসছে। 

- তার মানে আজকের এই চেঁচামেচিকে তুমি সমর্থন করছ ? – এইচ এম কালো কোট পরা উকিলের মতো সওয়াল করল। 

- টু বি ভেরি অনেস্ট, আমি মনে করি একটা প্রতিবাদের দরকার ছিল। তবে প্রতিবাদের তারিকাটা হয়তো একটু বেশি লাউড হয়ে গেছে। ওই যে তখন বললাম বড়দি, আউট বার্স্ট। তবে আপনার কাছে আমাদের একটাই প্রেয়ার, টিচারদের ওপর যে সো কলড্‌ রুলস্‌ অ্যান্ড রেগুলেশনস্‌ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার দিকে একটু নজর দিন যাতে মন প্রাণ দিয়ে আমরা আমাদের দায়িত্বটা পালন করতে পারি। 

সবাই এবার সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে শ্রীকে দেখছে। যুদ্ধ জেতার পর বিজয়ী সেনাকে যেভাবে লোকে দেখে। এরপর আলোচনা আর বেশি দূর গড়ায় নি। এইচ এম তবু জোর করে একটা হালকা হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন। 

তবে সেদিনের পর থেকে সবাই সাবধানী। কারণ এইচ এম ঠাঁরে ঠোরে শুনিয়ে দিয়েছেন ওদের সবার সব ফুটেজ নাকি ধরে রাখা আছে সি সি ক্যামেরায়। সুতরাং কী দরকার আর ঝামেলা বাড়ানোর ? চাকরিটা যে সবারই প্রিয়। 

দিন দুয়েকের মধ্যেই দু দুটো চিঠি ইসু হল দুজন টিচারের নামে। এক বিদিশা অন্যজন শ্রী মুখার্জি। স্কুল অথরিটি শ্রীকে ভদ্র ভাষায় একটা ওয়ার্নিং দিতে চায়। তার প্রোবেশন পিরিয়ডে কোনরকম ইনডিসিপ্লিন অ্যাকটিভিটিজ স্কুল সহ্য করবে না। দ্বিতীয় বার এমন কোন দৃষ্টান্ত চোখে পড়লে বিনা নোটিসেই তার চাকরির টার্মিনেশন লেটার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। 

মনে একটু চাপ চাপ উদ্বেগ নিয়েই সেদিন শ্রী বাড়ি ফিরল। অলক চিঠিটা পড়েই ফায়ার। বলে, নিজের ভালো পাগলও বোঝে। তুমিই একসেপশন। ছাত্রজীবন তো কাটিয়ে এসেছ অনেক দিন। এখনও ফোর ফ্রন্টে থাকার এত নেশা ? চাকরিটা গেলে কেউ তোমার জন্য লড়বে ? 

শ্রী অলকের কথার মাঝখানে বোঝাতে চাইল সবটাই তার দোষ নয়। এইচ এম জোর করে তার বক্তব্য শুনতে চাইল। নইলে তো ... 

- এবার ধরতে পারছ এর পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা ? কী রাজনীতি করলে কলেজ লাইফে ? মুখের পেছনে মুখোশই ধরতে পারো না। আর তাছাড়া জানো, আমার কোম্পানি সদ্য রিসেশন কাটিয়ে উঠেছে। তবু কী হয়, কী হয় অবস্থা সবার মধ্যে। আর তুমি সেখানে এত কষ্ট করে একটা চাকরি যাও জোটালে প্রবেশন পিরিয়েডেই ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেলে। কী, না নেত্রী সেজে লম্বা চওড়া বক্তৃতা ঝেড়ে এলে। নাও এবার ঠ্যালা সামলাও। হোল সার্ভিস লাইফটা তোমার হেল করে ছেড়ে দেবে এরা। প্রাইভেট স্কুল তো চেনো না। 

কিছুদিন ভয়ে ভয়েই কাটিয়ে দিল শ্রী। সত্যি, বড্ড বেহিসেবির মতো কাজ হয়ে গেছে। নতুন ফ্ল্যাটের ই এম আই চলবে এখনও অনেকদিন। ছেলেটাকেও নামী দামী একটা স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। তার খরচ খরচাও যথেষ্ট। গ্রামের বাড়িতে অলকের বাবা মা মাস গেলে ওদের টাকার আশায় বসে থাকেন। এ ছাড়াও আজ এটা, কাল সেটা, তো লেগেই আছে। ছোট ননদও হয়তো ওদের বাড়ি চলে আসবে সামনের বছর। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে এম এ পড়ার খুব স্বপ্ন। দুজনের চাকরি না থাকলে এত কিছু সামাল দেওয়া সম্ভব ? 

কিন্তু ওর কপালটাই খারাপ। আবারও আর একটা ঘটনায় শ্রী জড়িয়ে পড়ল। বায়োলজি ওর পড়ানোর বিষয়। একদিন ক্লাসে পড়াতে পড়াতে হঠাত নজর গেল অর্ণব নামের একটি ছেলে মন দিয়ে একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে। পাশ থেকে আরও দুটো ছেলে সে বইয়ের মধ্যে ঝুঁকে কী দেখছে। শ্রী সামনে গিয়ে দেখে একটা কুরুচিকর ম্যাগাজিন টেবিলের ওপর। ওটাতেই ছ জোরা চোখ আটকে আছে। মাথাটা তখনই গরম হয়ে গেল। টান মেরে ম্যাগাজিনটা নিয়ে ও অর্ণবের গালে একটা চড় কষায়, শেমলেস বয়। এতবড় সাহস তোমার! দেখি তোমার ডায়রীটা খোল। 

অর্ণব ভয় পেয়ে বলে, ডায়রী তো আজ আনি নি ম্যাম। 

শ্রী নিজেই ওর ব্যাগ ঘেঁটে ডায়রী বার করল। তারপর ইনফরমেশন কলমে ওর গার্জেনকে পরেরদিন দেখা করার জন্য ডেকে পাঠাল। 

পরদিন অর্ণব বাবা আর মা-কে সঙ্গে নিয়ে আসল ঠিকই, কিন্ত শ্রীর সঙ্গে দেখা না করে সোজা চলে গেল এইচ এমের কাছে। ব্যস্‌, শ্রীর পালস্‌ রেট তখনই বাড়তে শুরু করেছে। তবু ও মনকে বোঝায় অন্যায় তো কিছু করে নি। একজন টিচারের এইটুকু শাসনের অধিকার তো আছেই। 

ওরা চলে যেতেই এইচ এমের ঘরে ওর ডাক পড়ল। শ্রী ঢুকতেই ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে একটা সাদা কাগজে কী লিখতে লিখতে তিনি বললেন, তোমার কটি সন্তান শ্রী ? 

আচমকা অমন প্রশ্নে ও থতমত খেয়ে বলে , কেন বড়দি ? 

- আহ্‌, আমি তোমার কাছে একটা আনসার চাইছি। কথায় কথায় আরগিউ করা তোমার একটা বিশ্রী হ্যাবিট দেখছি। 

- একটি ছেলে। 

- ওর স্বভাব কেমন ? আই মিন খুব ঠান্ডা, ভদ্র, সভ্য ? 

- নাহ্‌। দুষ্টু আছে। তবে লিমিটের মধ্যেই থাকে। 

- কোনদিন গার্জেন কল হয়েছে ওর স্কুলে ? 

- নাহ্‌। - শ্রী আঁচ করার চেষ্টা করে কী প্রসংগে এসব জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। 

-তাহলে বুঝতে পারছ কথায় কথায় গার্জেনকে হ্যারাস করা কোনও কাজের কথা নয়। তুমি ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখো তোমার ছেলে এরকম ছোটখাট দুষ্টুমি হামেশাই করে যাচ্ছে। কিন্তু সেগুলো টিচাররাই দায়িত্ব নিয়ে ট্যাকেল করে । তুমি জানো অর্ণবের বাবা কলকাতার নামি সার্জেন। আর ওর মা পুলিসের এন ফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চে আছে। আজ কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ রেখে ওরা এখানে ছুটতে ছুটতে চলে এসেছে। 

শ্রীর খুব ইচ্ছে করল একবার বলে, অর্ণব কোনও ছোটখাট দুষ্টুমি করে নি, বড়দি। ও যা করেছে সেটা গার্জেনকে জানানো জরুরি ছিল। নইলে ওর সঙ্গে সঙ্গে আরও পাঁচটা ছেলেমেয়ে পলিউটেড হয়ে যাবে। 

কিন্তু মুখে এলেও কথাগুলো গিলে ফেলল শ্রী। অলক এ কদিন ওকে অনেক পাখি পড়া করে বুঝিয়েছে। কর্পোরেট দুনিয়াটা কী তার অনেক ধ্যান ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সুতরাং মুখ বুজেই এইচ এমের সব জ্ঞান শুনতে থাকে। 

এইচ এম একটা রেজিস্টার ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, তুমি এক্ষুণি ক্লাসে গিয়ে অর্ণবকে ডেকে নাও। ওকে আলাদা করে খুব পোলাইটলি বোঝাবে যে কাল যেটা ও করেছে সেটা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। ভবিষ্যতে স্কুলের মধ্যে যেন ও কখনও এমন না করে। 

শ্রী নিঃশব্দেই সব শুনে চলে আসছিল। কিন্তু এইচ এম ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে মোবাইল থেকে একটা ফোন কল সারলেন। দুবার লাল বাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টাস কথাগুলো শুনল ও। বাকি কথা সামনে দাঁড়িয়েও আর শোনা যাচ্ছে না। এইচ এমের কথা বলার এই আর্টটা বেশ পছন্দ হল। রপ্ত করতে হবে। অলকের সঙ্গে কথা কাটাকাটির সময় সাত পাড়ার লোক জেনে যায়। 

ফোন শেষ করে এইচ এম আবার রিভলভিং চেয়ারটাকে দুবার বোঁ করে ঘোরালেন। তারপর হাতের কলমটা ঠোঁটের ওপর নাচাতে শুরু করেছেন। কপাল কোঁচকানো। বলেন, শ্রী তোমাকে কিন্তু অর্ণবের মা বাবার কাছে অ্যাপোলজি চাইতে হবে। 

- মানে ? ফর হোয়াট ? 

-কারণ কাল তুমি অর্ণবের গায়ে হাত তুলেছ। ওর ব্যাগ ঘেঁটে তছনছ করেছ ডায়রী খুঁজতে গিয়ে। এবং মাইনর একটা দোষের জন্য ওর গার্জেনদের হ্যারাস করেছ। অর্ণবের মা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন। এখন কর্পোরাল পানিশমেন্ট, জানোই তো একটা পানিশেবল অফেন্স। তোমার এগেনস্টে উনি অ্যালিগেশন আনতে চলেছেন। সো, আই পারসোনালি থিংক তুমি ওদের কাছে অ্যাপোলজি চেয়ে নাও। ব্যাপারটা তাহলে ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে। নইলে স্কুলেরও একটা বদনাম। নানা ধরনের মিডিয়াকে ফেস করতে হবে। 

শ্রী স্তম্ভিত হয়ে শুধু কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। এইচ এমের চোখ এড়িয়ে একবার কড়ও গুনে নিল। প্রোবেশন পিরিয়ড এখনও সাত মাস বাকি। 

থমথমে মুখ করে বেরিয়ে আসছিল ঘর থেকে হঠাত শুনল পেছন থেকে এইচ এম বলছেন, ওয়ান মোর থিং শ্রী। এ ব্যাপারে আইন কানুন এখন ভীষণ রিজিড। তাই স্টুডেন্টসদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আগে একটা প্লিজ যোগ করবে। এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। নিজের ঘরের বাচ্চাদের বাবা বাছা বলে টেম কর না। 


(দুই) 

বাড়ি ফেরার সময় আচমকা আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। শ্রী ছুটে গিয়ে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। সঙ্গে ছাতা নেই। মাথাটা অন্তত বাঁচুক। হঠাত দেখে দুটো রোগা রোগা ছেলেমেয়ে একমনে খেলা করছে। ছেলেটার গা খালি। ধূলো মাটি মাখা। মেয়েটার পরনে একটা ছেঁড়া, অপরিচ্ছন্ন ফ্রক। বৃষ্টির দিকে একমনে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। হঠাত সে বলে ওঠে, এই ছোটু তোকে বলেছিলাম না আজ বৃষ্টি নামবে। 

ছোটু একটা পাথর দিয়ে একটা ছোট ইঁটের টুকরো ভাঙছিল। বলে, কী করে জানলি ফুলি আগে থেকে ? 

মেয়েটা হি হি হাসল। একটা হাত বাড়িয়ে টুপটাপ বৃষ্টির জল ধরে সারা মুখে মাখিয়ে বলে, আমি বৃষ্টির গন্ধ পাই তো। 

শ্রী অবাক হয়ে ওদের কথা শুনছে দেখে এবার একটু লজ্জা পেল ফুলি। ছোটু বলে, ও না পাগলী আছে। তুমি আর একটু ভেতরে ঢুকে দাঁড়াও মাসি। বৃষ্টিতে কাপড় ভিজে যাবে। 

ফুলি তখনও হাপুস হুপুস করে বৃষ্টি মাখছে। বলে, বৃষ্টি ভাল তো। একটু ভিজলে কিচ্ছু হবে না। কী ঠান্ডা, মিষ্টি জলটা। 

শ্রী হাসে। বলে, লেখাপড়া করিস না ? খালি খেলিস ? 

হলুদ দাঁত বার করে ছোটু বলে, বই নেই তো। পড়ব কেমন করে ? 

ভেজা শরীরে ভেজা মন নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরল শ্রী। সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে এসেছে রেজিগনেশন লেটারের বয়ানটা কেমন হবে। অলক শুনেই ধমকে উঠল, ওসব ভূত মাথার থেকে তাড়াও। এ বাজারে কেউ চাকরি ছাড়ে ? জীবনের সব জায়গায় একটু আধটু কমপ্রোমাইজ করতেই হয়। 

অর্ণবের বাবা মায়ের সঙ্গে পরের দিনই কথা বলে নিল শ্রী। মোবাইল নম্বর এইচ এমই দিয়েছেন। বললেন, আমার ঘর থেকেই ফোন কর। 

অর্ণবের মায়ের গলার স্বর গম্ভীর। বেশ একটু আপার হ্যান্ড নিয়ে বলল, আপনারা তো ট্রেনিং নিয়েই এই প্রোফেশনে এসেছেন। তা হলে কথায় কথায় আমাদের ডেকে পাঠান কেন ? তাছাড়া অ্যাডলোসেন্স পিরিয়েডের স্বাভাবিক কৌতূহল এগুলো। আপনি বায়োলজির টিচার। ইউ বেটার নো হাউ টু গিভ আনসার টু দেয়ার কোয়ারিজ। এনি ওয়ে। আমি এ বারের মতো আপনার ওপর থেকে আমার গ্রিভেন্স তুলে নিচ্ছি। 

শ্রীর শরীরে আজকাল অদ্ভুত এক ধরনের ব্যামো তৈরি হয়েছে। হঠাত হঠাত সারা শরীর দিয়ে জোরো রোগীর মতো তাপ বেরোয়। অর্ণবের মায়ের কথা শুনতে শুনতে আবার ওরকম হল। সে সময় প্রাণপণে ও অলকের কথা ভেবে গেছে, কমপ্রোমাইজ, কমপ্রোমাইজ। 

শ্রী আজকাল প্রায় দিনই সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। দরিদ্রতার সঙ্গে ওঠা বসা করেও ছোটু আর ফুলি কী সুন্দর খেলাঘর সাজায় রোজ। দেখতে বেশ লাগে। ওদের সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেছে এখন তার। মাঝে মাঝে ঠোঙায় করে বাদাম ভাজা, মুড়ি মাখা নিয়ে যায়। পেয়ে দুজনের আনন্দ দেখে কে। 

শ্রী এখন স্কুল চলাকালীন প্রায় নিঃশব্দে নিজের কাজ করে। স্টাফ রুমে থাকলেও খুব বেশি কোনও ব্যাপারে যোগদান করে না। আর মাত্র দু মাস বাকি প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হবার। তবে পার্মানেন্ট টিচারদের হালও যে খুব ভাল তা নয়। তবু তাদের খুঁটিতে জোর বেশি। 

সেদিন লাঞ্চ ব্রেক শেষ হওয়ার একটু আগেই শ্রী ক্লাস এইটে ঢুকে পড়ল। আজ একটা ক্লাস টেস্ট নিতে হবে। কোয়েশ্চেন ডিকটেট করতে সময় নেবে। তাই একটু আগেই এসেছে। 

ফাঁকা ক্লাসরুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক জন বসে আছে। টিফিনের বেল না পড়লে সবাই আসে না। হঠাত পেছন দিকের বেঞ্চে দেখল আট দশ জন ছেলে এক সঙ্গে জটলা পাকিয়ে বসে আছে। মাঝখানে মধ্য মণি হয়ে অর্ণব। ওর হাতে একটা মোবাইল। 

ওখানে না পৌঁছেও শ্রী বুঝতে পারছে ওরা নিষিদ্ধ কিছু দেখে যাচ্ছে। কচি কচি ছেলেমেয়েগুলোর মুখের ছবিগুলো খুব নিদারুণ। ওর পা দুটো সচল হয়েও কীভেবে থেমে গেল। আবার সেই অর্ণব। ওর মা যেন কোথায় চাকরি করে ? পুলিশের ... সে বার কী বলে যেন শাসিয়েছিল শ্রীকে ? 

তুহিন বলে একটা ছেলে হঠাত ই-ই বলে জিব কেটে চোখ ঢেকে ফেলল। শ্রীর সব বাধা, সব ভয় কে যেন কেড়ে নিল তৎক্ষণাৎ। ও প্রায় ছুটে গিয়ে অর্ণবের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে দেখে কতগুলো পর্ণো পিকচার লোড করা সেখানে। তারই প্রদর্শন চলছিল এতক্ষণ। 


(তিন) 

একটু দেরী হল এইচ এমের ঘরে পৌঁছতে। কারণ অর্ণবের মোবাইটা জমা করার আগে শ্রী নিজের একটা রেজিগনেশন লেটার লিখে নিয়েছে। ভাগ্যিস বয়ানটা আগে থাকতে ঠিক করাই ছিল। 

এইচ এম সব শুনে স্তম্ভিত। শুধু বললেন, আমি দেখছি ব্যাপারটা। তুমি রেজিগনেশন লেটারটা ফেরত নিয়ে নাও। 

স্টাফ রুমে সবাই অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা ব্যবহার করল। খুব কাছের সহকর্মীদের মধ্যেও নিষ্পৃহ ভাব। শ্রী বুঝতে পারল না ওর এটা জিত না হার। হঠাত মোবাইলে অলকের ফোন। ধরতেই উত্তেজিত ভাবে বলল, কাল স্কুলে বলে এসো যেতে একটু লেট হবে। 

- কেন ? – শ্রীর নার্ভাস গলা। 

- বাবানের স্কুল থেকে গার্জেন কল হয়েছে। কাল আমাদের দুজনকেই যেতে হবে। কী জানি কী করে বসে আছে ছেলেটা। 

আর বেশি কিছু বলার বা শোনার সুযোগ না দিয়ে অলক ফোন ছেড়ে দিল। 

বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ছটফট করছিল শ্রীর। কিন্তু তবু কীভানে যেন পায়ে পায়ে ও পৌঁছে গেল ছোটু আর ফুলির কাছে। ওদের সাজানো খেলাঘরটা বড্ড টানছে। তাছাড়া মনের মধ্যে একটা খাঁ খাঁ শুকনো হাওয়া পাক খেয়ে যাচ্ছে। ফুলির কাছে গেলে যদি একটু বৃষ্টির গন্ধ পাওয়া যায়। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ