১
২
৩
পোড়া গন্ধে ভরে উঠে কামরা। নতুন পুরানো হিন্দু মুসলিম, শিখ, জৈন, খ্রিষ্টান লাশগুলো ভাইয়ের মত, বোনের মত হাত বাড়িয়ে দেয়, এসো এসো। অসংখ্য পোড়া লাশ পরম যত্নে, আত্মিক আদরে সাবধানে ধরে ধরে একজন আরেকজনকে বসিয়ে দেয়। গলে গলে পড়ছে তাদের মাংস। ধোঁয়া গন্ধ গলায় ককিয়ে ওঠে লাশগুলো, আমরা আম্মিজী আমরা গুজরাট, সবার চোখের সামনে পুড়ে গেলাম।
আমরা মোজাফফরনগর, আমরা সিলেট, চট্টগ্রাম, বাঁশখালি, নাসিরনগর। খলখল করে জেগে উঠে বরিশাল, নোয়াখালি, পাঞ্জাব, পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি, হরিয়ানা, লংগদু, ভোলা, রংপুর ---
রাবেয়া মির্যার আঁচল দীর্ঘতর হয়। কারা যেনো হেঁকে বলে, এইইইই খান্ডাওয়ালা খান্ডাওয়ালা, বল্লভগড় হরিয়ানা।
বড় সাজানো গোছানো একটি ছেলে সজল চোখে ওঠে আসে ট্রেনে। নালিশভরা মুখ। জিনাত ডেকে নেয় কাছে, এসো জুনেইদ। মন খারাপ করো না বাছা। অই দেখো ফারাজ, তারুশি---
সদাচারী পুরোহিত জুনেইদের চোখ দেখে কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে, গোপাল,ওরে গোপাল আমার। তুমি আসিছ ঠাকুর। এসো এসো। পরম যত্নে তুলে নেয় বুকে।
ফারাজ অবন্তি হাসে, জানিস জুনেইদ গেলো বছর আমরাও ঈদ মানাতে পারিনি রে। কাঁদিস নে ভাই। দেখবি ? এই দেখ অস্ত্রের দাগ! পুরোহিতের বুকে মুখ লুকোয় জুনেইদ, আম্মি বসে থাকবে। আম্মিকে নতুন কাপড় পরে সালাম করা হল না ভাইয়া !
ট্রেনের ইঞ্জিনে যেনো সোঁদা মাটির গন্ধ। কেমন যেনো, ‘বাংলা বাংলা, হেঁইয়ো বাংলা, এই তো বাংলাদেশ বলে থেমে গেলো ট্রেনটা। ধূমায়িত সন্ধ্যা। আজানের ধ্বনির সাথে নমিত আনন্দে বেজে উঠছে মন্দি্রা। মোষের কালো চোখে বিষণ্ণ সন্ধ্যার লালগোলা আলো। কাছেপিঠে কোথাও আত্রাইয়ের বুকে ধীরলয়ে বৈঠা বাইতে বাইতে দিনের মাঝি গান ধরেছে,
লাল গামছায় ঢাকা সদ্য বানানো প্যাড়া হাতে হেঁকে উঠে এক ফেরিওয়ালা, দিনাজপুর দিনাজপুর এই দিনাজপুর। মা বোনেরা ভাইবেরাদররা প্যাড়া খান। নিন নিন, কে নিবেন গো---
মিষ্টির গন্ধকে ছাপিয়ে ভেসে আসে সদ্য গজানো ধানগাছের তাজা ঘ্রাণ। চঞ্চল হয়ে উঠে লাশগুলো। ধর্মান্ধ লোকদের হাতে মার খাওয়া ভাঙ্গা দু হাত বাড়িয়ে দেয় জুনেইদ, আয় ধান্য। আয় ভাই।
ভীরু পায়ে উঠে আসে এক কিশোর। মাথায় বুকে খুচরো ধানের ছড়া, ছেঁড়া জামা, ছেঁড়া বোতামঘাট, খালি পা, ঠোঁটের কোণে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, দুই চোখে সমুদ্র ভাসিয়ে কেঁদে উঠে ধান্য, ওরা আমার মাকে---
রাবেয়া মির্যা বুকের ভেতর জড়িয়ে রাখেন সদ্য খুন হওয়া তখনও উষ্ণ দুটি শরীরকে। হরিয়ানার বল্লভগড়ের খান্ডাওয়ালার জুনেইদ আর দিনাজপুর কাহারোলের ধান্যরাম রায়। দুটি মুখ যেনো তার ছেলে রায়হানের মতই।
কে মেরেছে রে তোকে ? মুসলমানরা মেরেছে।
কে মেরেছে রে তোকে? হিন্দুরা মেরেছে।
আমি তবে কে ? কে আমি ? কিশোর ধান্য রায় আর জুনেইদ একসাথে জড়িয়ে ধরে রাবেয়া মির্যাকে। বুকভাঙ্গা হাহাকারের সাথে ট্রেনের দরোজায় আছড়ে পড়ে অগুন্তি শব্দ,
আইকাম বাইকাম তাড়াতাড়ি
মরছে মানুষ, পুড়ছে বাড়ি,
রেলগাড়ি ঝমাঝম
তুচ্ছ মানুষ ধর্ম দামি !
এঁটো থালাবাসন ধুতে ধুতে এনাউন্সমেন্টটা শুনতে পায় ওরা। ফাইন্যালি তাহলে আজই শেষ হলো রোজা ! কাল ঈদ। ওহ্ বাঁচলাম আল্লাহ্ ! মনে মনে হাঁফ ছাড়েন রাবেয়া মির্যা।
শরীর আর নিতে পারছিল না। বুকের কাছে দমটা যেনো আটকে ছিল এই কদিন। রোদদগ্ধ গাছের মত নেতিয়ে পড়ছিল শরীর। পানি পানি করে হাহাকার জুড়েছিল প্রাণ।
হালিমের বাটি ধুয়ে মুছে রাখছিল নাসিমাবুয়া। ঈদ মোবারক বলে ওর দিকে তাকিয়ে মন ভালন হয়ে যায় রাবেয়া মির্যার। কিচেনের সাদা আলোয় বুয়ার মুখে হাসি উথলে পড়ছে। এখন মনে হচ্ছে সত্যি ঈদ মানে খুশী। স্ক্রাবে সাবান লাগিয়ে কেমন আনন্দিত ফুর্তিতে বাটিগুলো ধুয়ে মুছে র্যাকে রাখছে দ্রুত হাতে।
পপকর্ণ খেতে খেতে ছেলে রায়হান টিভি দেখছিল। বাটি মোছা শেষ হতেই ছুটে আসে নাসিমবুয়া, ও ভাইয়া কালকে কিন্তুক ঈদ। সত্যি সত্যি ঈদ। বিটিভি ধরো ত একবার! দেখি চান্দ দেখা হুজুররা কি বলতিছে !
অনেকদিনের বুয়া। রায়হানকে কোলে পিঠে করে বড় বোনের মত লালন করেছে। অন্য দিনের মত কোনো রকম ওজর আপত্তি না করেই স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড ছেড়ে বিটিভি ধরে রায়হান। ওয়াও ওয়াও ! ঈদ মোবারক খালাবুবু। ঈদ মোবারক আম্মু। ইয়াহু, খালাবুবু আপনার স্পেশাল চিকেন ফ্রাই কিন্তু মাস্ট মাস্ট মাস্ট। ইয়া আআ ---
নাসিমবুয়ার মুখে হাসি ছলকে ওঠে। মায়ের চাইতে বুবুর উপর রায়হানের বায়না বেশি। কুলকুল করে ওঠে মন। একুশ বছরের ভাইয়াটাকে একুশ মাসের শিশুর মত লাগছে এখন। কি ছেলেমানুষ ! খাওয়ার লোভে নাচছে দেখো। আহারে সোনামোনা ভাইটা আমার!
২
পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করতে বেরিয়ে পড়েছে মসজিদ কমিটির লোকেরা , ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক!
গ্যাস বার্নার মুছতে মুছতে নাসিমাবুয়া হাসে, এখন আর মাইনসেরে ঈদের ঘোষণার জন্যি হাপিত্যস করি বসি থাকতি হয় না। বছরে একেক জায়গায় একেক দিন ঈদ হতিছে তা দেখিছেন খালাম্মা ? হুজুররা ভাগ করি নেছে গোডা দেশডারে---
রাবেয়া মির্যা কিচেন টাওয়ালে ভিজে হাত মুছে ধমক দেন, যার যেমন খুশী ঈদ করুক। তুই তোর কাজ কর ত নাসিমা। কাউতারি করিস না এসব নিয়ে। তোর খালুআব্বা শুনলে কিন্তু চেঁচামেচি শুরু করে দেবে।
গরম জলে লিকুইড সাবান ঢালতে ঢালতে নাসিমা রাগ দেখায়, খালুআব্বার মাথাটা এক্কেরে গেছে গ্যা। হুজুরগে্রে কেউ বিশ্বেস করে ! ও খালাম্মা অই হারামজাদারা না যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিগোর কাছে আমাগের মাইয়াগো ধইরা ধইরা দিছিল! মাগো মা এগের যে ক্যান খালুআব্বা এত এত চান্দা দেয় বুঝিনা কিছু !
রাবেয়া মির্যা চাপা ধমক দিয়ে বেরিয়ে আসেন কিচেন ছেড়ে।
তার স্বামী মসজিদবাসী। এই একটা মাস তিনি মসজিদেই থাকছেন। যাওয়ার আগে কড়া করে বাসায় বলে গেছেন, সবাই যেনো সহিমত রোজা নামাজ করে। ছেলে রায়হান অবশ্য রোজা করে তের চৌদ্দ বছর বয়েস থেকে। কিন্তু এবার ক্ষেপে গেছে। আব্বু কি জোর করে আমাদের ধর্ম পালন করাতে চায় নাকি আম্মু ! করবো না রোজা। দেখি কি করে !
অনেক অনুরোধে রায়হান সেহরি খাচ্ছে বটে কিন্তু মসজিদে যাচ্ছে না। রাবেয়া মির্যার সন্দেহ , নাসিমা লুকিয়ে চুরিয়ে লাঞ্চও বানিয়ে দিচ্ছে রায়হানকে।
তিনি বুঝেও না বোঝার ভান করে তসবিহ গোনেন। বার বার তার গণনায় ভুল হয়ে যায়।
তার আঙুলের ডগায় অসন্তোষ ফণা তোলে। সত্যি ত জোর করে কেনো ধর্মের জুজু দেখাবে আমানুল্লাহ মির্যা ? সে কি ভুলে গেছে এই ধর্মের জুজুর ধাওয়া খেয়ে তারা সেই কবে নিজের দেশ গুজরাট থেকে পালিয়ে এসেছিল এই দেশে? খুব বেশি দিনের ঘটনা কি ?
মাত্র সত্তর বছর।
তার মনে একটা ভয় জাগে, স্বামী কি দেশটাকে পাকিস্তান আফগানিস্তান বানানোর দলে নাম লিখিয়েছে নাকি ?
দোতলার বারান্দার কোল ঘেঁষে হুজুরদের ছো্টো খাটো একটি মিছিল এসে থামে।
একজন তরুণ হুজুর হ্যান্ড মাইকে চেঁচিয়ে ওঠে, মুমিন মুসলমান ভাইসব আস্লামুআলাইকুম। শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে। ঈদ মোবারক। ঈদ মোবারক। আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদের প্রথম জামাত শুরু হবে সকাল আটটা নাগাদ। নামাজী মুসুল্লিভাইদের সবিনয়ে অনুরোধ জানানো হচ্ছে, পবিত্র ঈদের নামাজ পড়তে তারা যেনো কেবলমাত্র জায়নামাজ সাথে নিয়ে মসজিদে আসেএ এ এএন।
ভাইসব আমি আবার বলতেছি, মনোযোগ দিয়ে শুনেন সবাই। মসজিদ কমিটির নির্দেশ মোতাবেক আপনারা কেবলমাত্র জায়নামাজ সাথে নিয়ে নামাজ পড়তি আসবে এএ এন।
রাবেয়া মির্যা রোযার ধকলে ক্লান্ত অবসন্ন। শুয়ে পড়েন ডিভানে। মনে মনে ভাবেন, কি দিন যে আসলো ! ঈদের জামাতও এখন সেভ নয়। গত ঈদে শোলাকিয়ায় যা হয়ে গেলো ! তার আগে হলি আর্টিজানের দেশ বিদেশ কাঁপানো ঘটনায় তার প্রিয় বান্ধবী জিনাত খুন হয়ে গেছে। নৃশংস সে খুন। সত্যি মানুষ অমানুষ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। জঙ্গি জংলীগুলো উৎসব আনন্দের দিনগুলোতেই টার্গেট করছে মানুষ হত্যার জন্যে। এভাবে কি কখনো কোনো ধর্ম জিততে পারে !
অভ্যাসমত মাথার কাছে মোবাইল রেখে বুকচেরা একটি ভেজা শ্বাস ফেলেন তিনি। পা গুটিয়ে নিজেকে ছোট করে চোখ বন্ধ করে রাখেন। ঈদের কয়েকটা দিন নিঃশ্বাস ফেলা দায় হবে। রান্না বান্না গেস্ট সামলাতে কোমর ভেঙ্গে যাবে প্রায়। আগে ভাগে কিছু করে রাখলে তবু কিছুটা রিলিফ পাওয়া যায়। শরীরটাও কেমন অবসন্ন লাগছে। কিছুই করতে ইচ্ছা করছে না তার।
তার উপর সকাল থেকেই জিনাতকে মনে পড়ছে। সানরাইজ প্লাজার “বিশাল বাংলা রঙ” এর দোকানে সেদিন শাড়ি দেখতে গিয়ে মনে হয়েছিলো, জিনাত বেঁচে থাকলে নীল হলুদ পাড়ের কটন লাল শাড়িটা ফার্স্ট চয়েসেই কিনে ফেলতো। লাল খুব প্রিয় রঙ ছিল জিনাতে্র। সেলসগার্লের তীর্যক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে অনেকক্ষণ ধরে শাড়িটাকে ধরে ধরে দেখছিলেন রাবেয়া। উথাল পাথাল কান্না পাচ্ছিল তার!
সেদিন হলি আর্টিজান বেকারিতে তারও থাকার কথা ছিল। হালকা শপিং শেষে ইফতারিটা একটু অন্যরকম করবে বলে জিনাতের সাথে প্রোগ্রাম ফিক্স করা ছিল। কিন্তু তিনি যেতে পারেন নি। হঠাত কিছু গেস্ট এসে পড়েছিল বাসায়। আরেক দিন হবে বলে তিনি জিনাতকে ফোনে বলেছিলেন, স্যরি রে দোস্তো। হঠাত গেস্ট এসে পড়েছে। চানরাতে বেরুবো সিওর। টেক কেয়ার। বাইইইই----
পেটের ডানদিকে ব্যাথাটা আবার জানান দিচ্ছে। হাত দিয়ে চেপে রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকেন তিনি। তার দুচোখ জুড়ে অকাল শিশির কান্না হয়ে বয়ে যাচ্ছে শরীর আর মনে।
দীর্ঘ রোজাকাল। তায় সারাটা দিন আগুনের মত মাথার উপর সূর্য তাপাচ্ছে। একেবারে এলিয়ে পড়েছেন রাবেয়া মির্যা। শরীরের প্রতিটি সূতো খুলে পড়তে চাইছে যেনো। আজ দুপুরের দিকেই মনে হচ্ছিল, আর পারছেন না। রোজা মনে হয় ভেঙ্গেই ফেলতে হবে। ডান দিকের পেটে থেকে থেকেই চিলিক মেরে উঠছিল একটা তীব্র ব্যাথা। গরম হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সমস্ত পেট জুড়ে। এরকম আগে কখনো হয়নি। এই প্রথম। তবে ব্যাথাটা তেমন মারাত্মক হয়ে উঠেনি এই যা রক্ষে।
ছুটকা ছাটকা ব্যাথা বেদনাকে তিনি অবশ্য তেমন পাত্তা দেন না। বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে এই সেদিন। ডাক্তারি জার্ণাল পড়ে জেনেছেন এখন শরীর বুড়ো হচ্ছে। এরম অফ অন মাঝে মধ্যেই হবে। হতেই থাকবে। শরীর তো একরকম যন্ত্রই।
তারপর এভাবেই একদিন একবারে স্লিপ মুডে চলে যাবে শরীর মন প্রাণ। এতো দুনিয়ার চিরন্তন নীতি। তাই ভয় তিনি তেমন পান না। স্বাভাবিক মৃত্যুকে ভয় কি !
তবে শরীরের চেয়ে তার মন খারাপ আরও বেশি। শেষ পর্যন্ত তার স্বামী এতটা ধর্মান্ধ হয়ে যাবে এটা তিনি ভাবতেও পারছেন না। জঙ্গিদের হাতে প্রিয় বান্ধবী খুন হয়ে যাওয়ায় আজকাল বড় নির্জীব লাগে তার। নিজের কাছে নিজেকে বড্ড ভারী লাগে যখন তখন। তার সুখপাখি বন্ধুটা যে নেই আর।
মাঝে মাঝে অজানিত একটি ভয় শিরদাঁড়া বেয়ে চিনচিন করে ওঠে। জিনাত খুন হওয়ায় তিনি আর রায়হান প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন। পাগলের মত কেঁদেছিলেন। ফেসবুক থেকে প্রেসক্লাব, শাহবাগের প্রতিটি প্রতিবাদ সভায় তারা মা ছেলে সরবে অংশ নিয়েছিল। নাসিমাবুয়া হায় হায় করে মাতম করে ওঠেছিল। কিন্তু তার স্বামী আমানুলাহ মির্যা কেমন নির্লিপ্ত মুখে খবরগুলো দেখে ওঠে চলে গেছিল নিজের রুমে। অথচ পারিবারিকভাবে জিনাত তারও বন্ধু ছিল। বেশ ভালো বন্ধু। কত কথা , গল্প। খুনসুটি । তবে ! তবে কি ?
আজকাল রাবেয়া মির্যা ঘরেই থাকেন বেশিটা সময়। জিনাতের উপহার দেওয়া শাড়ি, হিজাবগুলো নেড়ে চেড়ে দেখেন। মাঝে মাঝেই কাজে বা ঘুরতে এদেশ ওদেশে যেতে হত জিনাতকে। নানা রঙের অনেকগুলো হিজাব এনে দিয়েছিল তাকে। যদিও জিনাত কোনোদিন হিজাব পরেনি। রাবেয়া বেগম প্রথম যেদিন হিজাব পরা ধরলেন, জিনাত হেসে বলেছিল, তুই কি শান্তি পাচ্ছিস? যদি পাস, তো পরবি না কেনো ? যে যেভাবে বেঁচে সুখ খুঁজে নিক এই পৃথিবীতে। জীবন তো একটাই তাই না রে দোস্তো !
সেই জিনাতকে খুন করে ফেললো ছেলের বয়সি কয়েকজন জঙ্গি ! ছেলেগুলোর মন একবারের জন্যেও কি কেঁপে উঠলো না ! ওরাও ত মানুষ নাকি ! বুক ভেঙ্গে কান্না ওঠে আসে। হিজাবগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আলমারির আব্রু খুলে সেগুলো তলোয়ারের মত উড়তে থাকে সমস্ত ঘর জুড়ে। রাবেয়া মনে মনে ভাবেন, এগুলো কি হিজাব, নাকি জঙ্গিদের খুনাস্ত্র !
বুকের ভেতর কুশন জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। অঘোর ঘুম। শ্রান্ত ক্লান্ত। গোপন দুশ্চিন্তাকে সাথে নিয়ে তিনি হারিয়ে যান ঘুম সম্মোহনের অতল তলে।
ঘুমের ভেতরে স্বপ্ন দেখেন, ডিভানটা দুলছে। ছন্দিত দোলন। তিনি ভালো করে খেয়াল করেন, কেবল যে দুলছে তা নয়। কেমন একটা গতিক আওয়াজ করে ডিভানটা যেনো চলে চলে চলছে। যেনো একটা ট্রেন। তিনি ট্রেনের কামরার ভেতর, মধ্য সারির সিটে পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। বহুদূরের যাত্রীদের মতন নিশ্চিন্ত অভ্যাসে।
কিন্তু তিনি যাচ্ছেন কোথায় ? ঘুমের ভেতরেই তার মনে প্রশ্ন জাগে, গন্তব্য কি তার এই যাত্রার? বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, জার্মান, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, আফ্রিকা, ফ্রান্স, মায়ানমার! সে কী এ যে চট্টগ্রামের বাঁশখালি এসে পড়েছেন। তা কি করে হয় ! তিনি ত ঘুমুচ্ছিলেন নিজের ঘরে।
রাবেয়া মির্যা ঘুমের ভেতরেই বুঝতে পারেন, তিনি স্বপ্ন দেখছেন। কাল ঈদ। অনেক কাজ পড়ে আছে। শিক কাবাবের জন্যে স্পেশাল মশলা বানাতে হবে। রাজ্যির পেঁয়াজ রসুন আদা ব্লেন্ড করতে হবে। পুরনো মশলায় রান্না করা তিনি একদম পছন্দ করেন না।
খাসির রেজালা, চিকেন রোষ্ট, ফ্রাইড চিকেনের মশলা আলাদা আলাদা বানাতে হবে। ছেলে রায়হান মুন্নার দোকান থেকে স্পেশাল কাট্ দিয়ে গরুর মাংসের স্টেক এনে রেখেছে। ছেলের বন্ধুদের জন্যে ক্রাব ফ্রাই, পোস্তো বড়া, বিফ সিজলিং, প্রণ আর ভেজিটেবল আইটেম করতে হবে ! আজকাল ছোট বড় কেউই মিষ্টি খেতে চায় না। তবু প্রথা মেনে কিছু মিষ্টির আইটেমও বানাতে হবে। ভাগ্যিস প্রচুর পরিমাণ টিকিয়া বানিয়ে রেখেছিলেন বলে টিকিয়া নিয়ে এখন চিন্তা নেই। কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে ভর দিয়ে এরম নিরুদ্দেশের দেশে বেড়াতে গেলে তার এত এত কাজ কে করে দেবে শুনি ! তিনি জোর করে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন।
আড়মোড়া ভেঙ্গে পা নামিয়ে শিউরে পা তুলে নেন রাবেয়া মির্যা, আরে একি ! এ কি করে সম্ভব ! সমস্ত ট্রেন জুড়ে এত রক্ত কেনো ? রক্তে থকথক করছে ট্রেনের ধাতব ফ্লোর। কাঁচা রক্তের গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে তার।
চরম ভয় আর আতঙ্কে আঁতকে তিনি চিৎকার করে ডাক দেন, রায়হান রায়হান। তুই কোথায় ? এদিকে একটু আয় তো বাবু। নাসিমা কই তুই ? শিগগির আয়। দেখে যা। একি সর্বনাশ হচ্ছে এখানে।
জমাট থকথকে রক্তের উপর ধোঁয়ার মত ভেসে ওঠে জিনাতের মুখ। কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে আগের মত। চোখে মুখে সেই স্নিগ্ধ আলো। তিনি চিৎকার করে ডাক দেন, জিনাত জিনাত এই জিনাত তুই এখানে ! আমরা কোথায় যাচ্ছি রে ? এত রক্ত কেনো ট্রেনের ভেতর ? কোথায় কি সর্বনাশ হলো আবার জানিস কিছু ?
জিনাতের স্নিগ্ধ মুখে ভয়ের ইশারা। টকটকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে রায়হান।
আর্তনাদ করে ওঠেন রাবেয়া, কি হয়েছে তোর বাবু ? এত রক্ত ! তোর মাথা মুখে যে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে ! এক্সিডেন্ট করেছিস নাকি ? কখন? কোথায় ? কি করে হলো ? হায় আল্লাহ, আমি কেনো ঘুমিয়ে পড়লাম! আমার ছেলে যে এক্সিডেন্ট করে মরতে বসেছে ! নাসিমা মুখপুড়ি গেলি কোথায় !
উদ্ভ্রান্ত মুখে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখেন রায়হানের পাশে ফারাজ,তারুশি, অবন্তিকার মুখ, ম্যাম ভয় কি ! এই যে আমরাও ত আছি ! ওদের তাজা শরীরে রক্তের ফোয়ারা। এ কি রে ! তোরা ? তোদের না ওরা মেরে ফেলেছিল ?
ওরা একসাথে বলে উঠে, হ্যা ম্যাম, হলি আর্টিজান ক্যাফেতে জিনাত ম্যামের সাথে জঙ্গিরা আমাদেরকে মেরে ফেলেছিল। কিন্তু আমরা এসেছি আরো লাশ কুড়াতে। ধর্ম ধর্ম করে যারা মারছে আর যারা মরছে আমরা তাদের নিয়ে যেতে এসেছি এই ট্রেনে করে।
ট্রেন ? তাই তো ! কি ট্রেন রে এটা ?
কান থেকে হেড ফোন খুলে জিনাত হাসে, পেশোয়ার এক্সপ্রেস! সেই যে তুই ত পড়তে দিয়েছিলিস ! কৃষাণ চন্দরের ! ওটা এখন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন হয়ে গেছে জানিস তো রাবেয়া ! আমরা যারা লাশ হয়ে গেছি, তারা দেশে দেশে ধর্মের জন্যে খুন হওয়া নতুন নতুন লাশ কুড়িয়ে ফিরি এই ট্রেনে। অই দেখ!
চোখের সামনে বেদনায় নীল হয়ে ওঠে ওরা। রক্তাক্ত দেহ। কান থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। বাঁ চোখ গলে বেরিয়ে এসেছে প্রায়। হাত পা ভাঙ্গা, কাটা। বুক থেকে গলগলিয়ে বেরুচ্ছে রক্ত। রাবেয়া দু হাতে ওদের জড়িয়ে ধরে হাহাকার করে কেঁদে উঠেন, একি হলো ! ও আমার আল্লাহ, এ কি করলে তুমি ! দুদিন পরেই যে ঈদ। ওরা কত খুশি হয়ে বন্ধুদের সাথে কতকিছু প্ল্যান করেছিল। আর আজকেই ওদের খুন হতে হলো !
চিৎকার করে কাঁদতে গিয়ে বিহবল বিস্ময়ে তিনি আমূল কেঁপে উঠেন।
সমস্ত কামরা জুড়ে কেবল লাশ আর লাশ। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধের অসংখ্য লাশ। তাদের হাত পা মাথা মুখ, পেট, বুক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। কিছু মুন্ডুহীন ধড়, নিজেদের কাটা মাথা কোলে নিয়ে ঘড়ঘড়ে আওয়াজে কি যেন বলতে চাইছে। অন্যরা চেয়ে আছে তার দিকে।
কেউ এক চোখে, কারো চোখ নেই গলে গেছে। কারো দুচোখের কোটরে রক্ত ভাসছে। কারো পেট কাটা। বেরিয়ে এসেছে নাড়িভুঁড়ি। ছিন্নভিন্ন যোনি, কাটা স্তনে রক্ত ঝরছে। শিশুরা চূর্ণ বিচূর্ণ। কারো কারো শরীরে স্কুল ইউনিফর্ম। রক্তে ভিজে গেছে, মুছে গেছে নাম ঠিকানা। ওরা লাশ হয়ে গেছে, কেবল লাশ। নিরুপায়। ভয়াবহ। উৎকট বীভৎস।
রাবেয়া মির্যা আশ্চর্য হয়ে দেখেন, ট্রেনের জানালা, দরোজায় অনেক কাল আগের শুকনো কালো রক্ত নতুন করে গলে গলে পড়ছে। টকটকে লাল তাজা রক্তের পাশে পুরনো কালো রক্তের ধারা মিলেমিশে অগাধ বিভ্রম তৈরি করে নড়ছে, চড়ছে, দুলে যাচ্ছে। চেনা অচেনার ভাপ উঠছে রক্তের ধারা থেকে। এই রক্তসাগর কাদের শরীর থেকে বয়ে এসেছে এখানে ? এই লাশগুলো কাদের ? কারা এরা ?
জিনাত হাসে, কি রে তোর তো অনেকেই চেনা ! তোর একুশের বইমেলা, প্রিয় আজিজ সুপার মার্কেট। প্রিয় মুখগুলো মনে পড়ে? সেই যে দেশভাগ দেশভাগ আন্দোলন ! তোর দাদা দাদির লাশ পড়েছিল গুজরাটে। পাকা ফসলের মাঠে আরো অনেকের সাথে মনে নেই? জ্বলে উঠেছিল হিন্দুপাড়া, মুসলিম মহল্লা। তারপরেই ত শুরু !
রাবেয়া চেঁচিয়ে উঠেন ভয়ে, তুই থাম, থাম জিনাত। আমি এই দাঙ্গা খুন, হত্যা চাইনা চাইনা।
সরফরাজ , বেটা ছুটে চল্, পালিয়ে যা বেটা। রাবেয়া মির্যা দেখেন, তার দাদাদাদি পালাচ্ছে পালাচ্ছে। ধানবতী জমি ভেঙ্গে ছুটছে তারা অনেকেই। দাদির কোল থেকে ছিটকে গেলো লায়লাবানু নামের মেয়েটি। দাদার কোলে ছিল আহসানরাজ নামের ছেলেটি। মূহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো সবাই। তার বাবা সরফরাজ, ছোট ভাই শাহনেওয়াজকে নিয়ে লুকিয়ে পড়েছিল পাকা ধানগাছের নিচে। কেউ একজন তাদের বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিলো এই দেশে। দাঙ্গাকে তাই ভীষণ ভয় রাবেয়া মির্যার।
মরিয়া হয়ে চেন টানার চেষ্টা করলে হেসে ওঠে লাশগুলো, এ ট্রেন থামবে না এখুনি। লাশ কুড়াতে যেতে হবে আরো অনেক অনেক দেশে।
সাদা কালো নারী পুরুষ শিশু লাশ হাত নাড়ছে, আরো আরো অনেক দূরে অনেক দেশে যাবে এই ট্রেন। আরো অনেক অনেক লাশ পড়ে আছে পৃথিবীর অনেক দেশে। আরো অনেকেই লাশ হবে। এই ট্রেন আমরাও থামাতে পারিনি।
এ এক লাশটানা ট্রেন আম্মু । রায়হানের সবুজ টিশার্টে বাংলাদেশ লেখা লাল অক্ষরগুলো ভিজে গেছে রক্তে, এই সেই ট্রেন আম্মু। সাতচল্লিশে লাশ টেনেছে, পঞ্চাশ, পঁয়ষট্টিতে লাশ টেনেছে। আবার বেরিয়ে এসেছে লাশ কুড়াতে। আর এবার আমরা লাশ হয়েছি মাগো।
দিদি গো এই যে আমি, রায়হানের পাশে রক্তাক্ত কোটালীপাড়ার সদাচারী পুরোহিত, গভির রাইত নামি নামি করিছে, শ্যামাসংগীতের শেষ পদডা কেবল গাতিছি, এমুন সুমায় ওরা আসি গলাডা কাডে ফেলালো। কয় কি শালা মালাউন যা তোগের দেশে চলি যা শুয়োরের বাচ্চারা।
পুরোহিতের পেছনে, সুবল, দীপালি, নারাণ আরো কত মুখ, দুডে একডা মুরতি ভাঙ্গি দেয় , তা সই কিন্তুক ওরা যে আমাগের মারি ফেলাতিছে, ইজ্জত কাড়ি খুন খারাপি করি মারতিছে মাগো।
আম্মিজী, এই যে আমরা আমরা, মোরাদাবাদ, শতাধিক নামাজীর রক্তাক্ত বিপন্ন অসহায় মুখ, ঈদের নামাজ পড়ছিলাম। জামাত শুরু হতেই কারা যেনো শূয়োর ছেড়ে দিলো নামাজের ময়দানে। তারপর রাতারাতি ফুলকপি হয়ে গেছি আমরা। কেউ আমাদের খুঁজে পায়নি।
আম্মিজী আমরা হাসিমপুর, জলগন্ধভরা অর্ধশত লাশ জলগেলা গলায় বলে ওঠে, কেনো কি কারণে আজো জানিনা, আমাদের মেরে ফেলে দিয়েছে এই নদীতে।
পোড়া গন্ধে ভরে উঠে কামরা। নতুন পুরানো হিন্দু মুসলিম, শিখ, জৈন, খ্রিষ্টান লাশগুলো ভাইয়ের মত, বোনের মত হাত বাড়িয়ে দেয়, এসো এসো। অসংখ্য পোড়া লাশ পরম যত্নে, আত্মিক আদরে সাবধানে ধরে ধরে একজন আরেকজনকে বসিয়ে দেয়। গলে গলে পড়ছে তাদের মাংস। ধোঁয়া গন্ধ গলায় ককিয়ে ওঠে লাশগুলো, আমরা আম্মিজী আমরা গুজরাট, সবার চোখের সামনে পুড়ে গেলাম।
আমরা মোজাফফরনগর, আমরা সিলেট, চট্টগ্রাম, বাঁশখালি, নাসিরনগর। খলখল করে জেগে উঠে বরিশাল, নোয়াখালি, পাঞ্জাব, পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি, হরিয়ানা, লংগদু, ভোলা, রংপুর ---
রাবেয়া মির্যার আঁচল দীর্ঘতর হয়। কারা যেনো হেঁকে বলে, এইইইই খান্ডাওয়ালা খান্ডাওয়ালা, বল্লভগড় হরিয়ানা।
বড় সাজানো গোছানো একটি ছেলে সজল চোখে ওঠে আসে ট্রেনে। নালিশভরা মুখ। জিনাত ডেকে নেয় কাছে, এসো জুনেইদ। মন খারাপ করো না বাছা। অই দেখো ফারাজ, তারুশি---
সদাচারী পুরোহিত জুনেইদের চোখ দেখে কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে, গোপাল,ওরে গোপাল আমার। তুমি আসিছ ঠাকুর। এসো এসো। পরম যত্নে তুলে নেয় বুকে।
ফারাজ অবন্তি হাসে, জানিস জুনেইদ গেলো বছর আমরাও ঈদ মানাতে পারিনি রে। কাঁদিস নে ভাই। দেখবি ? এই দেখ অস্ত্রের দাগ! পুরোহিতের বুকে মুখ লুকোয় জুনেইদ, আম্মি বসে থাকবে। আম্মিকে নতুন কাপড় পরে সালাম করা হল না ভাইয়া !
ট্রেনের ইঞ্জিনে যেনো সোঁদা মাটির গন্ধ। কেমন যেনো, ‘বাংলা বাংলা, হেঁইয়ো বাংলা, এই তো বাংলাদেশ বলে থেমে গেলো ট্রেনটা। ধূমায়িত সন্ধ্যা। আজানের ধ্বনির সাথে নমিত আনন্দে বেজে উঠছে মন্দি্রা। মোষের কালো চোখে বিষণ্ণ সন্ধ্যার লালগোলা আলো। কাছেপিঠে কোথাও আত্রাইয়ের বুকে ধীরলয়ে বৈঠা বাইতে বাইতে দিনের মাঝি গান ধরেছে,
লাল গামছায় ঢাকা সদ্য বানানো প্যাড়া হাতে হেঁকে উঠে এক ফেরিওয়ালা, দিনাজপুর দিনাজপুর এই দিনাজপুর। মা বোনেরা ভাইবেরাদররা প্যাড়া খান। নিন নিন, কে নিবেন গো---
মিষ্টির গন্ধকে ছাপিয়ে ভেসে আসে সদ্য গজানো ধানগাছের তাজা ঘ্রাণ। চঞ্চল হয়ে উঠে লাশগুলো। ধর্মান্ধ লোকদের হাতে মার খাওয়া ভাঙ্গা দু হাত বাড়িয়ে দেয় জুনেইদ, আয় ধান্য। আয় ভাই।
ভীরু পায়ে উঠে আসে এক কিশোর। মাথায় বুকে খুচরো ধানের ছড়া, ছেঁড়া জামা, ছেঁড়া বোতামঘাট, খালি পা, ঠোঁটের কোণে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, দুই চোখে সমুদ্র ভাসিয়ে কেঁদে উঠে ধান্য, ওরা আমার মাকে---
রাবেয়া মির্যা বুকের ভেতর জড়িয়ে রাখেন সদ্য খুন হওয়া তখনও উষ্ণ দুটি শরীরকে। হরিয়ানার বল্লভগড়ের খান্ডাওয়ালার জুনেইদ আর দিনাজপুর কাহারোলের ধান্যরাম রায়। দুটি মুখ যেনো তার ছেলে রায়হানের মতই।
কে মেরেছে রে তোকে ? মুসলমানরা মেরেছে।
কে মেরেছে রে তোকে? হিন্দুরা মেরেছে।
আমি তবে কে ? কে আমি ? কিশোর ধান্য রায় আর জুনেইদ একসাথে জড়িয়ে ধরে রাবেয়া মির্যাকে। বুকভাঙ্গা হাহাকারের সাথে ট্রেনের দরোজায় আছড়ে পড়ে অগুন্তি শব্দ,
আইকাম বাইকাম তাড়াতাড়ি
মরছে মানুষ, পুড়ছে বাড়ি,
রেলগাড়ি ঝমাঝম
তুচ্ছ মানুষ ধর্ম দামি !
0 মন্তব্যসমূহ