ছিটকিনিটা আলগা করে। জানালা খুলতেই খুব আস্তে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢোকে জ্যোৎস্না। জানালার সোজাসুজি ঘরের ভিতর অনেকখানি জায়গা সাদা।
অসিত এই প্রথম নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না দেখছে :
ও পাশটা একদম দুধ-ভেজা ফর্সা। ঘাসের ডগায় চিকমিকি। গাছাগাছালির পাতা টলটলে। দূরে দু-একটা সদ্য নির্মিত ঘর বাড়ির কার্নিশ ধুয়ে যাচ্ছে।
অসিত বরফি জাল ঘেরা জানালার বক্সে হাত গলিয়ে বোঝে, ওপারে মোলায়েম বাতাস। একটু পরে টের পায় মিহি ট্যালকম পাউডার ঝরছে আকাশ থেকে!
সন্তর্পণে ড্রয়ার খুলে দেশলাই আর সিগারেট হাতে নেয়। ফের জানালার সামনে দাঁড়ায়। এখন একটু জোরে বাতাস। অন্তত কয়েক মিনিট আগের চেয়ে। হাত আড়ালে বারুদে কাঠি ঘষতেই হলদে আলো। খানিক ঝলসানি হাতের চেটোয়। সিগারেটে টান দিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলে :
আজকাল কি এই ব্র্যান্ডে বাড়তি কিছু মেশাচ্ছে...! বেশ মৌজ...মৌতাতের টান! বেশি বিকোবার নয়া কৌশল... বাড়তি ট্যাক্স আদায়ের নরম পথ।
নাকি, নিজের বাড়ির জানালায় জ্যোৎস্নাটা বেশ খোলতাই এবং এমন চিকন লাগে! কত দিন যে ভাড়া বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি, চাঁদ ওঠা দেখব। চাঁদ চাঁদের মতো করে যথারীতি উঠেছে কিন্তু আমার দেখা হয়নি! খুটখাট ভিড় লেগে থাকত...
কত দিন ভেবেছি, ভরা জ্যোৎস্নায় একবার ঝাড়্গ্রামের শালবনে হাঁটবো। যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। ছেলে বেলায় বান্ধবী তৃষা বছর খানেক ডিভোর্সী। বড় বাড়ির সুন্দরী মেয়ে। ভালো ছাত্রী ছিল।
কেন যে সাধারণ গ্রাম দেশের একান্নবর্তী না হলেও, আত্মীয় পরিজনের একটু বেশি আসা-যাওয়াময় পরিবারে বিয়ে করে বেশি গ্রাম জীবনের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে কৃষক গেরস্থদের অপরেশকে বিয়ে কররে গেল...। খাস শহুরে সম্পন্ন বাড়ির তৃষা-টা...
তাকে একবার ঝাড়্গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে দেখলে..., ঠিক তখনি টিক্ টিক্ শব্দটা দুকানের সুড়ঙ্গে ঠোক্কর মারে। পিছনে তাকিয়ে দেখে অসিত, ইলেকট্রনিক ঘড়িটা ঠিক টাইম দিচ্ছে। সকাল পাঁচটা তিপ্পান্নর ট্রেন আর তেমন মিস হয় না। টাইম সেটিং থাকলে মোবাইল সময়ে ডেকে দিচ্ছে।
টোকা মেরে সিগারেটের ছাই ফেলে। জানালা থেকে সরে আসে। নীলচে জিরো পাওয়ার বাল্বটা আলো-আঁধারি আচ্ছন্ন টান! এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে, চার ফুট বাই এক ফুট বেলজিয়ান কাচে নিজেকে দেখে। আবছা। থমকে দাঁড়ায়। খুব যত্নে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে,... তখনি একদম দেখতে পায় না। কাচের নিচে পারা ঝরে গেছে। ফোলা ফাঁপা মাসোনাইট। মনটা সেঁতিয়ে লতলতে!
এখন যে কী করা উচিত সেটা ভেবে না-পেয়ে, অসিত এলোমেলো তাকায় ঘরের চারদিকে। দেওয়াল ঘেঁষে আলমারি, বেশ ক'খানা বই সাজানো। ওপাশে আলনায় পরমার শায়া শাড়ি চুড়িদার পাঞ্জাবি। সবুজ রঙের ওড়নায় নীলচে আলো পড়ে রঙটা আরও ঘন। পুরোনো কিছু পত্রপত্রিকা, ডেটলের মোড়ক, রিং করা সরু তার কাজের শেষে কিছুটা পড়ে আছে। এতগুলি দেখেও নিজেকে ঠিক জমিয়ে রাখতে পারছে না। খাটের ছত্রি থেকে মশারি ঝুলছে। সাদা মিহি নাইলন নেটের মশারি। মশারির গায়ে জ্যোৎস্না, নাইলন থ্রেডের বুনন ফাঁক গলে গলে জ্যোৎস্নার বরফি কুচি। ভিতরে লম্বা শুয়ে এলোমেলো আটাশ-উনত্রিশের পরমা। শ্বাস-প্রশ্বাসে ভরাট গা বুক ওঠে নামে। পাশে ন'দশ মাসের পিন্টা শুয়ে। পিন্টাকে ডিঙিয়ে পরমাকে... শুধু পরমাকে দেখলে মনে হয়, ও তো যুবতী পরমা...! মা পরমা-টা তাহলে কোথায়...! কোন্ ভুবনে...! ও-ই তো বহন করেছে... কষ্ট পেয়েছে...!
টেবিলের উপর মোবাইলটায় টুং শব্দে স্ক্রিনে আলো জ্বলে। কোনও মেসেজ ধারণ করে প্রযুক্তিময় নিজ দেহে। তখনই মনে হল অসিতের, এক জন পুরুষ যে বাবা হয়ে ওঠে সেটা দৃশ্যত দ্রুত বোঝা যায় কী করে...!
মশারি ছুঁয়ে দাঁড়ায় অসিত। মশারির মধ্যে পিন্টাকে দেখে, ঘুমে পবিত্র শিশুমুখ। পৃথিবীর কোনও কিছু তেমন ছায়া ফেলে নি। এমন মুখ নিয়ে যদি মানুষ গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারত...!
পাশ ফেরে পরমা। বালিশে হাতের চুড়ি রিনঠিন বাজে। ...এমন তুলতুলে নৈঃশব্দ্যে বাজনাটা ঢেউ কাটে ঘরময়। বুকের মধ্যে চিরে যায় চকিতে অসিতের। মশারির নাইলন সুতোয় বরফি জালে চোখ রাখে, পিন্টা... পিন্টাইটা দু-হাত দু-পা মেলে বিছানায় দেবীঘটে আঁকা স্বস্তিকা চিহ্ন। চরাচর। জ্যোৎস্নায় ডুবে!
পিন্টাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, কদিন খুব কষ্ট পেয়েছে বেচারা। অবিরাম কাশি। দু-চোখ ঠেলে যেন বেড়িয়ে আসতে চায়..., তখন মনে হত, এটা বোধহয় বড় ধাক্কা! অফিস কামাই করে মাথার কাছে বসে থাকতে হয়েছে তিনদিন তিন রাত। নিজের মারাত্মক রোগে নিজেকে নিয়ে এমন আশঙ্কা তো জাগেনি।
হাতের সিগারেটে টান দিয়ে হঠাৎ মৌজ কেটে অসিতের ব্রহ্মতালুতে চকিত ঠোক্কর। তৎক্ষণাৎ সিগারেটটা তিন আঙুলের চাপে মুচড়ে দেয়। আগুন নিভে গেছে সাব্যস্ত করে, পোড়া সিগারেটটা দু-এক পলক দেখে। পরক্ষণে ভাবে, মাত্র ক'মাসের শিশু... এ ঘরে খাওয়া তো উচিত হয় নি! সুতরাং অসিত জানালার কাছে চলে আসে। চৌকো খোপ জালে ঘেরা জানালার বক্স ফোঁকর দিয়ে হাত গলায়। আঙুল আলগা দিতেই থুপথাপ শব্দ। বাম দিকে তাকাতেই দেখে, পিন্টাই পাশ ফিরছে। থমকে দাঁড়ায় অসিত! তার মাথায় কিছু জিজ্ঞাসা বা বুকের মধ্যে আশঙ্কা আঁচড় কাটে :
এ রকম শৈশব কাটিয়ে ইস্কুল কলেজ ডিঙিয়ে কয়েকটা ছাপছোপ গায়ে লাগিয়ে একটা কাজকর্মের জন্যে কত হন্যে হয়ে ঘোরা ওর জন্যে কি অপেক্ষা করছে...! পরিচিত জন, সমাজসেবী তকমাধারী বা ক্ষমতাবান মানুষদের কাছে অসংখ্য চালাকি ধারা ও সহানুভূতির পর আমার এই চাকরি। এসব বাঁধা ছক থেকে ও...ওর মতো বংশক্রম, মানুষের প্রজন্ম কি স্বাভাবিক ছন্দে, মস্তিষ্কে, বোধে যোগ্যতায় মুক্তি পাবে না! নাকি লুপ্ত দাসপ্রথা, বাতিল ভূস্বামীত্বের পুনর্বিন্যাস...। সত্যি কি মানুষের হাত থেকে মানুষের মুক্তি আছে...!
দৃশ্যত বদল ঘটলে, মানুষের অন্তর্গত বদল কি ঘটে...। কত যে পরিমার্জনা চায় আজন্মের বস্তুগুলো।
জানালার ওপারে জ্যোৎস্না মরা মরা লাগে। অসিত চৌকো-খোপ জালে মুখ ঠুকে চোখ চালায়। চাঁদটা সরাসরি দেখতে পায় না। খোঁজাখুঁজি করতেই দেখতে পেল, এক বোঝা থকথকে কালো মেঘ আকাশের গায়ে বেয়ে বেয়ে কোন্ সুদূরের টানে...! চাঁদটা ঢেকে গেছে। মেঘের পরত ছিঁড়ে জ্যোৎস্না আসতে পারছে না। ফলত জানালায় জ্যোৎস্না তেমন ভাবে নেই। অসিত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
বুকের মধ্যে ছিঁড়েকুটে যাওয়ার জ্বালা। ভালো বাতাস পেলে একটু সুস্থ লাগত। আশপাশের বাতাস বড্ড পুরোনো, গা সওয়া। অতএব সিদ্ধান্ত নেয়, সামনের গুড ফ্রাইডেতে একবার অন্তত এক দিনের জন্যে বকখালি বেড়িয়ে আসা উচিত। বন্ধুরা বেড়িয়ে এসে মনোরম বর্ণনা দিয়েছে :
উদ্দাম বাতাসে ঝাউ বনের চেরা পাতা রিন রিন বাজনা শোনায়।
ঝাউবন পেরোলেই সমুদ্রের গর্জন। নোনা গন্ধ। অসংখ্য বক গাঙচিল বাটাম পাখির ঝাঁক।
সমুদ্রে ছোটো বড় ঢেউ মাথায় ফণা উঁচিয়ে চরের বালিতে গড়ায়। হৈ চৈ করে কত তরুণ তরুণী যুবক যুবতী সাঁতার কাটে সে ঢেউয়ের দোলায়। পাল খাটিয়ে মেছো ডিঙি সেই হাওয়ায়। আবার মেশিন লাগানো জেলে ডিঙির ভট্ ভট্ শব্দ অথৈ জলে...
ফেনা-কাটা ঢেউ বালি চরে গড়িয়ে সাদা নুনের থিকথিকে সর লাল লাল খুদে কাঁকড়ারা ফুলের মতো ফুটে আছে বালির উপর। 'আমি সে ও সখা'র শুটিং হয়েছিল ট্যুরিস্ট লজে। এখনও সে কথা লোকের মুখে মুখে।
লজের স্টাফেরা বসে, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এসে গলা ছেড়ে গান শোনাতো সমুদ্রকে... বুকটা ফুলে ওঠে। বাসনায় প্রবল চনমন করে অসিত। এক সময় হিংসুটে হয়ে ওঠে, কী করে যে ওরা বেরিয়ে পড়ে...!
মেঘাচ্ছন্ন জ্যোৎস্নায় জানালার ওপারে ঘাসে দেখা যায় পোড়া সিগারেটটা। হালকা বাতাসে ঘাসের ডগা সামান্য নড়ে। নড়ে ওঠে অসিত পিছনের কণ্ঠস্বরে, এখনও শুয়ে পড়োনি...
প্রতিটা অক্ষর ঘুম জড়িয়ে চিটচিটে। উত্তর দিতে গিয়ে গলার কাছে আটকে যায়। বুকের মধ্য থেকে দূষিত বায়ু ঠেলে ঠেলে ওঠে। প্রথমে পরমার ঘুমঘোরে বিবশ অবয়ব দেখে অসিতের মধ্যে আচমকা দ্বিধা হানে...। পরক্ষণে, পিন্টাইকে ঘিরে আর্তি এবং মমতা ঘুরপাক খায়। বিড় বিড় করে, ক'বছর আগের খানাখন্দ ডিঙিয়ে আসতে না আসতে, আবার নতুন করে গাড্ডায় পড়ছি...।
মহাশূন্যে কালো মেঘের পুঞ্জ সরে যেতেই ফিনফিনে জ্যোৎস্না ভেসে যায়। দুধের ঢেউ গায়ে লাগে। রোমকূপ ভিজে ভিজে।
বিছানায় এক কাত মেরে পিন্টাই। মুখোমুখি পরমা। এলোথেলো ঘুমিয়ে কাদা। বরফিকাটা সুতোর নেট মশারি। পিন্টাইয়ের নরম কপালে নাকের কচি পাটায়, কানের লতিতে জ্যোৎস্নার বরফি। অসিত চুপচাপ দেখে কয়েক মিনিট...। পাশাপাশি পরমার মুখ। চকচকে ফর্সা। আস্তে আস্তে নিজের হাতের চেটোটা দেখে অসিত। সাদা ট্রাউজারে মুছে পরিচ্ছন্ন করে নেয়। পিন্টাইয়ের মুখে পেলব ত্বকে আলতো হাত রাখে। বুকের কোষ চিরে চিরে অন্তরীণ প্রবেশ।
অসিত থমকে তাকাত পরমার দিকে। নিবিড় অভিনিবেশে ভাবে, এমনটা... কাছাকাছি এমনটা যেন সারা শরীর একটু একটু চেনা...
অসিত পরমার শরীরের খাঁজে ভাঁজে আঁতি পাতি খুঁজে হাঁপিয়ে ওঠে। পরমাকে প্রথম লুকিয়ে হাত ধরার বিকেলটা বুকের চামড়ায় নখ ফোটায়। প্রবল তড়িৎ তরঙ্গ ভরাট পরমা একটু একটু করে বিলিয়ে বিছিয়ে একেবারে টানটান...।
জানালা থেকে সরাসরি জ্যোৎস্না। পরমার গায়ে পিঠে কোমর নিতম্ভে জ্যোৎস্না মাখামাখি। এবং গুঁড়ো গুঁড়ো আলোয় পিন্টাইয়ের মুখের নরম চামড়া ছুঁয়ে যেটুকু মনে হল, পরমা ঠিক তেমন করে যেন আগের মতো আর নেই। তার কত কি যে ঝরে পড়ে গেছে কোথায়...কোন্খানে...
এ ঘরটায় জনহীনতা না হলেও, এমন নির্জনতায় অসিত একলা হয়ে যায়। দরজার খিলটা সাবধানে খুলতেই খুট করে শব্দ। পরমার ঘুম ছিঁড়ে যায়। কষ্ট করে সাড়া দেয়, কে...এ...কে...এ
কোনও উত্তর না শুনতে পেয়ে আচমকা বিছানা থেকে নামে পরমা। দরজার চৌ-কাঠে দাঁড়াতেই এক পাও এগোতে পারে না। বন্যার বেগে জ্যোৎস্না ঢুকছে!
-কোথায় চললে?
কোনও উত্তর নেই।
-কোথায়...কেন...কখন... তুমি..., কী অকুলতা যে সে কণ্ঠস্বরে!
কথাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ফিরে আসে পরমার নিজের কানেই। ধীরে ধীরে ফিরেভ আসে জানালার কাছে। যেটুকু দেখতে পাচ্ছে :
অসিত ক্রমান্বয়ে এগোয়। জ্যোৎস্না বরফের গুঁড়ো হয়ে ঝরছে। মাথায় বরফ জমেছে, ঘাড়ে পিঠে কাঁধে। কষ্ট করে বরফের ঢিপি পেরোচ্ছে আদিমানব!
বিছানায় হাত পা নড়ে। পিন্টাই নরম ঠোঁটে জিভ চাটে। পরমা তাড়াতাড়ি মশারিতে ঢুকে স্তনবৃন্ত বাচ্চাটার কচি ঠোঁটে গুঁজে দেয়। জ্যোৎস্না পানীয় হয়ে পিন্টাইয়ের শুকনো গলা ভেজায়...।
0 মন্তব্যসমূহ