শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য'এর গল্প : আসুন সবাই ক্রিকেট খেলি

কপালের রেণু রেণু ঘাম স্যালুট স্টাইলে গরম পিচ রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললেন থুরথুরে রিকশাওয়ালা। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে তাকালেন আকাশের দিকে। আকাশ এবং রিকশাওয়ালার মাঝে ইউনিমার্ক এস্টেটের ধামাকা বিল্ডিং।এই রিকশাওয়ালার চোখে ঠিক এই সময় যদি একটা টেন ইনটু ফিফটি মিলিটারি বাইনোকুলার থাকত তাহলে আটাশ তলায় দ্বৈপায়ন চক্রবর্তীর ব্যাল্কনির বন্ধ দরজাটা নিশ্চয়ই দেখা যেত।ব্যাল্কনির দরজা বন্ধ কারণ ভেতরে এসি চলছে। 
দরজার ভেতরে ঢোকা যাক। 

সাজানো গোছানো ঘর। সঠিক জিনিস সঠিক জায়গাতেই রাখা। ঘরের ফার্নিচার মোটামুটি শহুরে কল্পনায় যা ধরে পড়ে ঠিক তাই। টিভির পাশেই অ্যাপল হোমপডের স্পিকার দুটো দারুন মানিয়েছে।ঠিক যেন দুটো ডিজিটাল সহোদর। স্পিকার দুটো সপ্তাহ খানেক হল ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে লঞ্চ করেছে। আসতেই যাকে বলে কামাল । এক সপ্তাহে রেকর্ড সেল।আইপড আইপ্যাড আর আইফোনকে টেক্কা দিয়ে কনসিউমার রেটিঙে পয়লা নম্বর। 

দ্বৈপায়ন স্পিকার দুটোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ভালো করে বোঝ।একবারের বেশি বলব না কিন্তু। এই স্পিকার দুটো আর্টিফিশিয়ালি ইন্টেলিজেন্ট। কীরকম? লেট মি ডেমনস্ট্রেট। 

দ্বৈপায়ন টিভি অন করল।ছাপ্পান্ন ইঞ্চি এলিডি টিভি স্ক্রিনে চারটে চতুর্ভুজ চ্যানেল সমানভাগে জায়গা ভাগ করে নিয়েছে। খবর, খেলা, বাংলা সিরিয়াল, বাংলা সিনেমা। 

দ্বৈপায়ন হাল্কা গলায় বলল, অন। 

স্পিকারের ঠিক ওপরে একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠল। 

রোহিত তালি মেরে বলল, ফাটাফাটি বস।এ তো ভয়েস রেকগনিসন।মানে ইফ আই সে অফ দেন অফ হবে । কারেক্ট? 

দ্বৈপায়ন মুচকি হেসে বলল, ট্রাই করেই দেখ না। 

রোহিত বলল, অফ। 

স্পিকারের সবুজ আলো অন্ধকারে জোনাকির আলোর মত এখনও পরিষ্কার। 

দ্বৈপায়ন হাসছে। ফিচেল হাসি।বলল, আমার ভয়েসের সাথে সিঙ্ক করা আছে। যে কেউ অন অফ বললে হবে না ভাই। এবার আসল মজা। জাস্ট ওয়াচ। 

দ্বৈপায়ন স্পষ্ট গলায় বলল, কানেক্ট টু টিভি। 

দ্বৈপায়ন কথাটা বলা মাত্রই ঘর জুড়ে গমগম করতে থাকল ক্রিকেট কমেন্টারি। জো রুট নে বহত আচ্ছা শট খেলা অউর ইয়ে মেড অন কে উপার সে ছে রান। 

হোলি শিট। হোয়াট আ সাউন্ড! ডলবি ডিজিটাল নাকি রে? পিনাকি এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। এবার সে মুখ খুলল। 

দ্বৈপায়ন ফ্রিজ থেকে পাঁচটা চিল্ড কার্লসবার্গ বিয়ারের বোতল সেন্টার টেবিলে এনে রেখেছে। বিয়ারের ছিপি খুলতে খুলতে বলল, ডলবি ডিজিটাল জুরাসিক এজে চলত ভাই। দিস ইস কলড হাই ফাইডেলিটি সাউন্ড উইথ সিরি ইন্টেলিজেন্স। এখন তো হাইলাইটস দেখছিস। ইন্ডিয়ার খেলাটা একবার শুরু হোক মনে হবে মাঠে বসে খেলা দেখছিস।যাকে বলে আল্টিমেট রিয়ালিটি। 

রোহিত বলল, আচ্ছা বস একটা কথা বল। টিভিতে তো চারটে চ্যানেল। অন্যগুলো পিক করল না কেন? হোয়াই ওনলি স্পোর্টস? 

—ভেরি গুড কোয়েসচেন ।ওখানেই তো মজা ভাই। যে চ্যানেলটা এখন সবচেয়ে বেশি দেখা হচ্ছে সেটাকেই ও পিক করে। আজ তো ফাইনাল। সবাই খেলা দেখবে বলে স্পোর্টস চ্যানেল দেখছে। পাতি কথায় টি আর পি বেসড রেকগ্নিসন বলতে পারিস। দেয়ার আর আদার প্যারামিটারস। সবে তো কিনলাম।ম্যানুয়ালটা পড়ে পড়ে শিখছি। 

রোহিতের পেটের ভিতরটা আসার পর থেকেই কেমন ভুটভাট করছে। গতকাল একটা জবরদস্ত রিসেপসান পার্টি ছিল। মাটন চিকেন চিংড়ির সবকটা আইটেমই দাপিয়ে খেয়েছে। 

টিভিস্ক্রিনে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা লাইন করে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় সঙ্গীত শুরু হবে। রোহিতের মুখ কুঁচকে গেছে।কুঁচকে যাওয়ার কারণ পেটের ভিতর থিতিয়ে যাওয়া ফটকা ফাটার শব্দ। পেটে হাত দিয়ে রোহিত বলল, বাথরুমটা খালি তো? 

কেন? 

এমারজেন্সি বস এমারজেন্সি । 

দাঁড়া না শালা। ন্যাশনাল অ্যান্থেমটা হয়ে যাক।এখনই তোর পেল। 

পিনাকি এইসব চিপ কাণ্ডকারখানা দেখে দাঁত বার করে হাসছে। 

রোহিত কোনও উত্তর না দিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড়ল। দ্বৈপায়ন পিনাকি দাঁড়িয়ে পড়েছে। পিঠ সোজা। চোখ এলিডি স্ক্রিনে।জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে...রোহিত কমোডের ওপর বসে চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টেনে পেটের ভেতর যতটা সম্ভব হাওয়া ভরল। 

টিভিস্ক্রিনে গিজগিজে গ্যালারী। স্যালুট স্টাইলে তিনজন মুগ্ধ দেশপ্রেমিক।মাথায় পতাকা পাগড়ি। চোখে ক্যারিবিয়ান গগলস।ঠোঁটে বিড়বিড় করছে,গাহে তব জয় গাথা। পিনাকি ভুল করে বিয়ারের বোতলটা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছে।দ্বৈপায়নের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অন্য হাতে বিয়ারটা নিয়ে ভেজা আঙুলগুলো মুছল জিন্সের পেছনে। 

পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত শুরু হয়েছে। পিনাকি টিভি থেকে চোখ সরিয়ে বলল, কীরে দৈ তোর গ্ল্যামার তো দিনদিন বেড়েই চলেছে। গালগুলোতো মাল খেয়ে পুরো কাশ্মীরি আপেল। 

রোহিত বলল, শুধু গাল।গায়ের রঙটা দ্যাখ—ছুরি চালালে এক কিলো মাখন উঠে আসবে বস। 

দ্বৈপায়নের কিন্তু এসব শুনতে ভালোই লাগে। মোটা কাঁচের গ্লাসে বিয়ার ঢেলে সে গাল আর গায়ের রঙ নিয়ে আরও কিছু শুনতে চায়। 

দ্বৈপায়নের স্ত্রী কিছুক্ষণ আগে শিক কাবাব আর চিকেন সিক্সটি ফাইভ রেখে গেছে। পিনাকি একটা শিক কাবাব মুখে তুলে নিয়েছি। প্রচণ্ড গরম। সেটাকে মুখ থেকে বার না করে ফুঁ দিতে দিতে বলল, রোহিতও কম মজায় নেই। সালা বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে শনি রোববার অফিসে ডেকে খাটায়। একটার পর একটা প্রজেক্ট টানছে। ইউএস থেকে বেলজিয়াম থেকে । তুই তো ডলার ইউরোতে খেলছিস রে। 

ঠিক এই সময় পাকিস্তানের একটা উইকেট পড়ল। তিনজনেই হাততালি দিয়ে উঠল। রোহিত চেঁচিয়ে বলল, ভাগ শালা! একশো রানে গুটিয়ে দেব তোদের। 

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। আর কিছু আলোচনার বিষয় না পেয়ে খালি গ্লাসগুলো বিয়ারে ভর্তি করে ঠোকাঠুকি করে তিনজনে বলল, চিয়ার্স। বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনজনেই টিভির দিকে মুখ ঘোরালো। এ তো ক্রিকেট নয়। মনে হচ্ছে কোনও পুরনো দিনের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সিনেমা। জোরালো শব্দে টিভিস্ক্রিনে মাথায় শাল জড়ানো একটা অদ্ভুত দেখতে মানুষ বলছে, সে যে কী বীভৎস মজা...তুমি দাঁড়ায়ে দ্যখবা আর অবাক হয়ে যাবা। 

রোহিত চোখ গোল গোল করে বলল, কে রে। এই বুড়োটা কে রে শালা? কোত্থেকে এল? খেলা হচ্ছিল তো? দৈ কী হল? দেখ তোর ওই হাইফাই স্পিকার কিছু গণ্ডগোল করেছে।কী দেখাতে গিয়ে কী দেখিয়ে ফেলেছে। 

দ্বৈপায়নের শরীর জুড়ে প্রেস্টিজ পাঙচার হয়ে যাওয়া হাবভাব। চোখ টিভি স্ক্রিনে আটকে।সত্যিই তো,কী হল ব্যাপারটা ! টিভিস্ক্রিনের মানুষটা আঙুল তুলে আবার বলে উঠল, ভোগই মুক্তির পথ। 

পিনাকি আর থাকতে পারছে না। বিয়ারের গ্লাসটা ঠকাস করে কাঁচের টেবিলে রেখে বিরক্ত গলায় বলল, দাঁড়িয়ে দেখছিস কি হাঁদার মত। একটা ওভার হয়ে গেল। আরও দুটো মনে হয় গেল। কিছু কর দৈ। পিনাকি উত্তেজনায় আর একটা শিক কাবাব তুলে নিল। খুব দ্রুত বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে সে। টিভিস্ক্রিনে ওই ভদ্রলোক বলেই চলেছে, উত্তাল উদ্দাম স্রোতের মধ্যে আকণ্ঠ ভোগ...সে যে কী নেশা... সব বিকাইয়া যায়...তবু নেশা। 

দ্বৈপায়ন কিছু করার আগেই আবার টিভিস্ক্রিনে লন্ডনের সবুজ মাঠ। হাফিজের আউট হয়ে যাওয়া স্লো মোসানে দেখানো হচ্ছে। ইন্ডিয়ার পতাকা হাতে নিয়ে গ্যালারিতে দর্শকদের তুমুল উল্লাস। 

রোহিত বলল , তুই টিভিতে ওই বাকি চ্যানেলগুলো বাদ দে তো। শুধু ক্রিকেট রাখ। নইলে আবার ওই খিটখিটে বুড়োটা এসে আংবাং বকবে। 

দ্বৈপায়ন বলল, দাঁড়া দাঁড়া। কী করে গণ্ডগোল হল সেটা বুঝতে হবে তো। অ্যাপেলের প্রোডাক্ট তো এরকম গণ্ডগোল করে না। আরেকটু দেখি। যদি আবার হয় তাহলে বাকি চ্যানেলগুলো হাটিয়ে দেব। 

বিয়ারের গ্লাসটাকে ব্যালেন্স করে পিনাকি সোফার পেছনদিকে হেলে পড়েছে।মারবেল ফ্লোর থেকে ভাঁজ করা পা দুটো ফুট দুয়েক উপরে। পায়ের নিচে বিমলাদি। মাথা নামিয়ে ঘর মুছছে। পিনাকি ওভাবেই বলল, তোর ওই সেটিং-এ কিছু এদিক ওদিক হয়েছে। ওই যে বললি না টি আর পি দিয়ে চ্যানেল ট্র্যাক করছে। ম্যানুয়ালটা ভালো করে পড়। 

দ্বৈপায়নের স্ত্রী আরও দু প্লেট রেখে গেছে। এবার ফিশ ফিঙ্গার আর প্রন পকোরা। পিনাকি বলল, বউদি আপনি বসুন না। আপনাকে খুব খাটাচ্ছি তাই না? একটার পর একটা ডেলিভারি করছেন। 

আরে না না। রিককে সামলাতেই আমার অবস্থা খারাপ। ওকে না সামলালে আপনাদের পার্টি পুরো ভণ্ডুল করে দেবে। ভিডিও গেম দিয়ে কোনরকমে বসিয়ে রেখেছি। 

খেলা আপাতত বন্ধ। পিচ ঢাকা পরেছে। ওভাল মাঠে বৃষ্টি। এই সুযোগে একটি সুন্দরী মেয়ে মাউথপিস হাতে সোজা গ্যালারীতে ঢুকে পড়েছে। দর্শকরা কত কিছু বলতে চায়।সেটা জানতে হবে তো।সুন্দরী মেয়েটি মাউথপিস নিজের মুখের কাছে নিয়ে আসতেই টিভিস্ক্রিন আবার বদলে গেল। এক মহিলা কোলে বাচ্চা নিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।হাউ হাউ করে কাঁদছে কোলের ল্যাঙটো ছেলেটা। হাই ফাইডেলিটি সাউনড সিরি ইন্তেলিজেন্সে ওই বাচ্চার আর মহিলার টোনাল কোয়ালিটি অ্যাকিউরেটলি ধরা পড়ছে।আমাদের ঘর পুড়ে গেল গো। আমাদের কী হবে গো। ওর বাপটাকে আগুনে খেয়ে নিল গো। 

এই হোমপড যেহেতু আল্টিমেট রিয়্যালিটি তৈরি করে তাই এই লিভিং রুমটাই এখন মনে হচ্ছে পুড়ে যাওয়া বস্তি। মহিলার চারপাশে মানুষগুলো সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠল। আমাদের বস্তিতে ইচ্ছে করে আগুন ধরানো হয়েছে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। লোকগুলো এমন পুড়েছে মুখগুলো চেনা যাচ্ছে না। 

রোহিত পিনাকি দ্বৈপায়ন স্থির হয়ে বসে।মহিলা আর কোলের ল্যাঙটো ছেলেটার মুখে হাতে পায়ে ছোপ ছোপ কালচে ছাই লেগে আছে। এলইডি টিভির এটাই জাদু। ড্যানড্রাফ থেকে দাঁতের পোকা সব পরিষ্কার ধরা পড়ে। ঝকঝকে স্ক্রিনে ছেলেটার ভাঙাচোরা চেহারা।বোঝাই যায় ক্যারামের ঘুঁটি ভেবে ওর মাড়িতে টোকা মারলে নির্ঘাত রক্ত পড়বে। 

আমি এখন কোথায় যাব? কী খাব?আমাদের কোনও ঘর লাই। 

পিনাকি কান চেপে ধরে বলল, কানের পর্দা ফেটে গেল মাইরি, প্লিস ডু সামথিং। খেলাটা দে। 

দ্বৈপায়ন গিয়ে টিভির সেটিং চেঞ্জ করল। আগুন ঝলসানো বস্তি আর ওই মহিলার চিৎকার একটা বাটনপ্রেসেই ভ্যানিশ। এখন আবার ক্রিকেট। 

দ্বৈপায়ন সোফায় বসে একটা তুরি মেরে বলল, বুঝতে পেরেছি হোয়ের ইস দ্য প্রবলেম । যে চ্যানেলে নয়েস যত বেশি সেটাকেই স্পিকারটা পিক করছে। মানে মাঠে দর্শকদের হাল্লাগুল্লার চেয়ে ওই মহিলাটা অনেক বেশি চ্যাঁচাচ্ছিল।বুঝলি। রাতে আমাকে একবার ভালো করে টেস্টিং করতে হবে। 

রোহিত বলল, ওসব দিখাওয়া বস।ওই ক্লাসটাকে আমি ভালো করেই চিনি। ওভার অ্যাকটিং করছিল বুঝলি না? পেটের সমস্যায় ভুগলেও রোহিতের ব্রেন কিন্ত খুব শার্প। আর ও খুব শার্প বলেই ও আসল ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে।সত্যিই ওই মহিলা ভালো কাপড় চোপর পড়া সাংবাদিককে সামনে পেয়ে একটু বেশিই চিৎকার করেছে।ভেবেছে যদি এবার সুবিচার পাওয়া যায়। হাত পা তাই একটু বেশি নাড়িয়েছে। একে দোষ দিয়েছে তাকে দোষ দিয়েছে। যদিও একথা মোটেই বানানো নয় যে সেই মহিলার স্বামী মানে ওই ল্যাঙটো ছেলেটার বাবার মাথার ঘিলু টিলু আগুনে পুড়ে একেবারে দলা পাকানো মাংসপিণ্ড হয়ে গেছে। ছেলেটার পাছার অর্ধেক পুড়ে ছাল উঠে গেছে। যাক গে সে কথা। 

এর পর বিশেষ বলার মত কিছু বাকি থাকল না। ওরা তিনজনেই ইন্ডিয়ার খুব সহজেই পাকিস্তানকে হারানোর মজাটা প্রন পকোরা আর ফিশ ফিঙ্গারের সঙ্গে চেটেপুটে খেল। যাওয়ার আগে দ্বৈপায়নের স্ত্রী এল বাই বলতে।মুখে ফ্যাকাশে হাসি। রিক এল আঙ্কেলেদের দেখতে। আগেই বলেছি রোহিত অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু তিন বোতল বিয়ার পেটে পড়লেই ওর কথা বলার অ্যালজেব্রাটা ওলটপালট হয়ে যায়। রিকের গাল টিপে বলল, তোমার গালগুলোও তোমার বাবার মত এক্কেবারে কাশ্মীরি আপেল। আর হাতগুলো পুরো মাখন। আমার ছন্টুমন্টু। 

রাতে খাওয়ার টেবিলে দ্বৈপায়নের স্ত্রী বলল, তোমার ওই রোহিত। কোনও সেন্স নেই। কখন কোথায় কার সামনে কী বলতে হয় কিছুই শেখেনি। অসভ্য একটা! 

দ্বৈপায়ন আর কী বলবে! মাথায় ওর এখন একটাই চিন্তা। অ্যাপেলের স্পিকারটার সেটিং-এ কোথায় গণ্ডগোল হচ্ছে।এতো দাম দিয়ে কেনা জিনিসটা। সারাদিনে ধকল আর আর পেটে বিয়ারের কম্বিনেশন খুব তাড়াতাড়ি দ্বৈপায়নকে বিছানায় টেনে নিয়ে গেল। রিককে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েও পড়ল। 

দ্বৈপায়নের চোখের সামনে এখন বস্তির ওই মহিলা। কোলে সেই ল্যাঙটো বাচ্চা।কালো ছাই মাখা মুখ। ওভালের সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই রিক। মহিলা কোলের বাচ্চাটাকে বলল, হ্যা রে বেটা। বাপ কা বেটা আপেল খাবি। মাখন খাবি। কাশ্মীরি আপেল। লাল লাল। কী স্বাদ! 

রিকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, লে এবার খা। বলা মাত্রই ল্যাঙটো ছেলেটা দৌড়ে গেল রিকের দিকে। ছেলেটার পুড়ে যাওয়া পাছাটা এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।দ্বৈপায়নের দিকে একবার তাকিয়ে এবড়োখেবড়ো দাঁত দিয়ে একটা কামড় বসাল রিকের গালে। 

রিক চেঁচিয়ে উঠতেই দ্বৈপায়নের ঘুম ভেঙে গেল। রিক দিব্বি ঘুমোচ্ছে। মসৃণ ফুলকো গালে কোনও কামড়ের দাগ নেই। কেউ কোত্থাও নেই। ওইপাশে স্ত্রী ঘুমে কাদা। দ্বৈপায়ন রিককে জাপটে ধরল। চুমু খেল ওর কানের উপর।কপালে। গালে। 

দ্বৈপায়নের এই এক সমস্যা। একবার কাঁচা ঘুম ভাঙলে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। এমনিতে ও খুব কাজের ছেলে। একদম সময় নষ্ট করে না। সময়কে কীভাবে প্রোডাক্টিভ বানাতে হয় তা নিয়ে ও দুটো ট্রিমেন্ডাস লেকচার দিয়েছে গতমাসে অফিসে। 

লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল দ্বৈপায়ন। টিভিটা চালাল। সেটিঙের কেরামতিতে দুটো চতুর্ভুজে এখন খবর আর খেলা। টিভিস্ক্রিনের মুখোমুখি বসে দ্বৈপায়ন বলল, অন। হোমপডের সবুজ আলো জ্বলে উঠল। টিভিস্ক্রিনে ইন্ডিয়া পাকিস্তান হাইলাইটস। আউর ইয়ে রোহিত শর্মাকা বাড়িয়া শট। ছে রান! দর্শকদের উল্লাস। আউর ইয়ে চার রান ফির সে।আমাদের পুরো বস্তিটা পুড়ে গেল গো। আমাদের কী হবে এবার!ওর বাপটাকে আগুনে খেয়ে নিল গো! সেই মহিলা আবার ফিরে এসেছে রিপিট টেলিকাস্টে। দ্বৈপায়ন সঙ্গে সঙ্গে বলল, অফ। 

স্পিকার বন্ধ। 

অন। 

কভার কে বিচোবিচ সে মাইন্ড ব্লুোইং শট। আমি এখন কোথায় যাব? কী খাব?আমাদের কোনও ঘর লাই। 

অফ। 

রিকের ঘুম ভেঙে গেছে টিভির শব্দে। দরজার আড়াল থেকে উঁকি মেরে সে বাবাকে দেখল।এভাবে বাবাকে ও আগেও দেখেছে। ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে। সারাদিন আজ রিক বাবার সঙ্গে কথাই বলতে পারে নি। ঠোঁট ফুলিয়ে বিছানায় ফিরে এল।আইপ্যাডটা বালিশের পাশেই রাখা থাকে। 


দ্বৈপায়ন ক্রমাগত বলেই চলেছে। অন ...অফ...অন...অফ...।রিকেরও আইপ্যাড অন।স্ক্রিনে ই এস পি এন ক্রিকেটের লেটেস্ট ভারসন।টেপাটিপি শুরু করল রিক। বাপ কা বেটা।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ