মল্লিকা ধর'এর গল্প : নীলবৃষ্টি লালবৃষ্টি

১.

নীলমেঘ ভেঙে নীল বৃষ্টি নেমে আসছিল, একের পর এক বৃষ্টিবিন্দু । টুপ টাপ টুপ টাপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল রাধাশ্যামের মন্দিরের বাগানের গভীর দিঘির কালো জলে । মস্ত মস্ত নীল মুক্তোর মতন বৃষ্টিবিন্দু । কালো জলে ডুবে যাচ্ছিলো । ওরা কোথায় যায়?

ওই দিঘি কত গভীর কেউ জানে না, ঘাট থেকে জলে নেমে একটু এগোলেই আর থই পাওয়া যায় না, তখন সাঁতার দিতে হয় । আমি সাঁতার জানি না, তাই পাথরের ঘাটের কাছ থেকে বেশী দূরে যাই নি । লোকে গল্প বলে নাকি দিঘির গভীর তলদেশে আছে মণিমুক্তাসাজানো জলগুহা, তা হলো পাতালের দরজা । ঐ গুহাপথে পাতালে পৌঁছলে নাকি দেখা যাবে পাতালের রাজ্য, তাতে হীরা, মুক্তা, মণি, মাণিক্য ছড়াছড়ি যায় । 

আহা, পাতালে পৌঁছতে পারলে বেশ হতো! তাহলে এই ছেঁড়া কালো জামা পরতে হতো না আর, পেট ভরে খেতেও পেতাম দু'বেলা । যেখানে এত ধনদৌলত ছড়াছড়ি যায়, সেখানে ভালো ভালো খাবারও নিশ্চয় অনেক । মা ও এত মারতো না তাহলে, পেতই বা কোথায় আমাকে? আমি তো তখন সে-এ-এ-এ-ই পাতালের রাজ্যে! বাঃ, বেশ মজা হতো! 

" টুনি, ও টুনি, কই গেলি তুই? " মা ডাকে, আমি দিবাস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি । কোথায় বৃষ্টি? খটখট করছে দুপুর । ঘাটলার অশ্বত্থছায়া থেকে উঠে পড়ি । মা বেরোবে বিকালের কাজে, আমায় ঘরে থাকতে হবে । যাই, দেরি হলে মা আবার চুলের মুঠি ধরে এমন চড় দেবে যে গালে দাগ পড়ে যাবে । একদিন দিয়েছিল ওরকম, ঘুরে পড়ে গেছিলাম মাটিতে । এখনও মনে পড়লে কান মাথা ঝনঝন করে। 

যেতে যেতে ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলি, "যাই দিঘি, কালকে আবার আসবো । " 

উত্তরে দিঘি কী বললো শোনা হল না । 

আচ্ছা, সত্যি কি পাতালরাজ্য আছে? জলমানুষেরা আছে? থাকলে বেশ হতো কিন্তু! মা পেট ভরে খেতে দেয় না, দেবেই বা কোত্থেকে? একা একা খেটে আমাকে আর দু’টো ভাইকে খেতে-পরতে দেওয়া আবার নিজের জন্যও তো লাগে, এ কি সহজ? আরেকটু বড় হলে আমিও কাজ করতে শুরু করলে তখন বেশ ভালো হবে । পেট ভরে খেতে পাবো, আস্ত কাপড় পরতে পাবো । সে কবে? 

হয়তো আর কিছুদিন পরেই মা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, কোনো বাসায় কাজ ঢুকিয়ে দেবে । এই তো পাশের ঝুপড়ির মালতীকে গত মাসে স্টেশনের কাছের ঐ উঁচু বিল্ডিং এর এক বাসাবাড়ীতে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর মা । মালতী তো আমার বয়সীই প্রায়, একটু বড়ো । 

সেরকম হলেও ভালো হয়, বাসাবাড়ীতে ফ্যান আছে, হাওয়া খাওয়া যায়, টিভি আছে দেখা যায় । সবসময় তো আর কাজ না, কাজ ফুরালে টিভি দেখা যায় । তাছাড়া মালিকেরা জামাকাপড়ও দেয় অনেক, ওদের ছেলেমেয়েদের একটু পুরানো হয়ে যাওয়া জামা দিয়ে দেয় কাজের লোকেদের । খাবারদাবারও ভালো পায় সেখানে মালতী । বেশ মজাতেই আছে । মাঝে মাঝে আসে, ওর মাসমাইনের টাকা ওর মাকে দিয়ে যায় । 

পৌঁছে গেছি, মা রেগে আছে । আমার দিকে তেড়ে এসে বলে, "কোন্‌খানে ছিলি এতক্ষণ? এত বড় বুড়োধাড়ি মেয়ে রাতদিন টইটই করে বেড়ানো? ঘরের কাজগুলো তো খানিক করে রাখলে পারিস, তা করার নাম নেই! তাহলে যে মা'র সুবিধা হয়! ছোটো ভাই দুটোকে দেখে রাখলেও তো কিছু কাজের কাজ হয় । তা না, ইনি পাড়া বেড়িয়ে বেড়াবেন! দাঁড়া আজকে এমন মজা দেখাবো যে আর ভুলবি না । " 

বলতে না বলতেই চুলে টান আর ঠাস করে ডান গালে এক প্রচন্ড জোরে চড়, পড়ে যেতে যেতে সামলাই, চোখে অন্ধকার । সামলাতে না সামলাতেই বাঁ গালে আরেক চড় । আঃ, কেন মা এত মারে! 

এইবারে মালতী ওর মাকে মাসমাইনের টাকা দিতে বাড়ি এলে চুপিচুপি ওকে জিজ্ঞেস করবো ওর চেনা কোনো বাসাবাড়ীতে কাজের লোক রাখবে কিনা কেউ । ও যদি বলে হ্যাঁ, তাহলে ওর সঙ্গে চলে যাবো মাকে না জানিয়ে । 

লুকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলে মাকে বলি, "আমি ছোটন আর বুড়নকে দেখে রাখছি । তুমি কাজে যাও । " 

ঘুমিয়ে থাকা ভাইদের পাশে গিয়ে বসি, তালপাতার আধাভাঙা পাখাটা দিয়ে আস্তে আস্তে হাওয়া করতে থাকি । মা কিন্তু যায় না, আমাকে একটা রুটি আর অল্প কাঁচকলাভর্তা এনে দিয়ে বলে,"খিদে পায়নি তোর? সেই তো কোন সকালে দু’টি পান্তা খেয়েছিলি, তারপরে তো আর কিছু খাস নি । " 

আমি মায়ের দিকে না তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলি, "আমার খিদে পায় নি । তুলে রেখে দাও, রাত্তিরে দিও।" 

মুখের কষ বেয়ে রক্ত পড়ে, ছেঁড়া ফ্রকের হাতায় মুছি । মা যাতে না দেখতে পায় সেই চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু মা দেখতে পেল । 

মা খুব কেমন রকম গলায় বলে, "কী রে তোর মুখে রক্ত! এত লাগলো? " 

কাছে এসে আমাকে আলতো করে ধরে, আমি চোখ বন্ধ করি, হাতের পাখাটা পড়ে যায় । নীল মেঘ ভেঙে নীল বৃষ্টিরা নেমে আসছে, অনেক অনেক নীল বৃষ্টিকণা । টুপ্‌ টুপ্‌ করে ডুবে যাচ্ছে দিঘির কালো জলে । আমিও ডুবে যাচ্ছি ওদের সঙ্গে, আমার সারা শরীরে ঠান্ডা জলের ছোঁয়া লাগছে, দেখতে পাচ্ছি চারপাশে মাছেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছে, বড় বড় সব মাছ । 

একটা মস্তবড় মাছ আমার কাছে এসে কথা বলে উঠলো, বললো, " পাতালের প্রাসাদে যাবে? এসো আমার সঙ্গে ।" সে ডানা নেড়ে নেড়ে সাঁতরে চলে পথ দেখিয়ে, আমি পিছু পিছু চলি । কিন্তু আমি তো ভালো সাঁতরাতে পারি না, আমার হাত-পা সব ভারী হয়ে আসে, খুব কাশি পায়, কাশি চাপতে পারি না, কাশতে কাশতে ঝলক ঝলক রক্ত উঠে আসে, জল লাল হয়ে যায় । 

আহ, আর যাওয়া হলো না প্রাসাদে । সেই যেখানে ধনরত্ন মণিমুক্তা ছড়াছড়ি, যেখানে কোনো কষ্ট নেই, যেখানে খিদে পেলেই খেতে পাওয়া যায় । যেখানে একজন খুব সুন্দর মা আছে । কেউ সেখানে মারে না । আহ, যাওয়া হলো না । মাছকে বলি, "ও মাছ, মাছ, শোনো, একটু থামবে? আমি যে পারিনা আর এগোতে । " 

মাছটা পিছন ফেরে, ওর হাসিহাসি মুখটা বদলে যায়, বদলে যায় আরো । অচেনা কার মুখের মতন হয়ে যায়, সেই মুখে ভয়ঙ্কর দাঁতালো হাসি । 

চোখ মেলি, চোখে মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল, মা ঝুঁকে পড়েছে আমার মুখের দিকে । জলের ঝাপটা দিচ্ছিলো বোধহয় । আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখে সোজা হয়ে বসে । আমি উঠে বসতে গেলে মা বলে, " শুয়ে থাক, শুয়ে থাক, উঠতে হবে না । " 

আমি তবু উঠে বসি, কোনোরকমে বলি, "আহ, আ-আমাকে একটু খাবার জল দেবে? বড্ড তেষ্টা । " 

মা গেলাসে করে জল এনে গেলাস আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেয় । 

মাকে জিজ্ঞেস করি, "কাজে যাও নি? " 

"তোকে এই অবস্থায় রেখে যাবো? এখন একটু ভালো লাগে রে টুনি? " 

"এখন ভালো । তুমি কাজে যাও । আমি ভাইদের কাছে শুয়ে শুয়ে হাওয়া করি । " 

মা কাছে এসে আমার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, "বুঝতে পারিনি টুনি, তোর এত লাগবে । আমি তোকে রুটিভর্তা খাইয়ে দিই? তারপরে কাজে যাবো । " 

রুটি-ভর্তা মা খাওয়ায়, আমি নিজেই খেতে পারতাম, কিন্তু মা নিজে হাতে করে খাওয়ায়, আমি খেয়ে যাই । মুখের ভিতরে কোথাও কেটে গেছে হয়তো, জ্বালাজ্বালা করে, কিছু বলি না । কী হবে বলে? দু'দিন গেলে সেরে যাবে । 

মা কেমন কোমল গলায় বলে, " আমার কথা শুনে চললেই তো আমার রাগ হয় না । একা একা ঘুরে বেড়াস, জানিস কত বিপদ আপদ চারপাশে? কথা না শুনলেই আমার রাগ ওঠে । আমার কথা শুনবি তো টুনি? আর এমন ঘুরবি না তো? " 

আমি মাথা কাত করে জানাই শুনবো । মা বিপদ-আপদের কথা বলে প্রায়ই, কিসের বিপদ? কিজানি হয়তো ছেলেধরারা ধরে নিয়ে যেতে পারে, সেই বিপদ । কিংবা হয়তো অন্য কোনো বিপদ, অন্য কোনো ভয়, কেজানে! 

পাতালের প্রাসাদ দেখছিলাম স্বপ্নে, সেখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল যে মাছটা, ওর মুখ অমন বদলে গেল কেন? 


২.

মা কাজ করতে চলে যায়, আমি হাওয়া করতে থাকি ভাইদের । গরমটা পড়েছে আজ খুব । মনে হয় বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি হবে । তাহলে বেশ মজা হতো কিন্তু । রাধাশ্যামের মন্দিরের বাগানে মস্ত মস্ত সব আমগাছ আছে, এখন সেসব গাছে অনেক কাঁচা আম । ঝড় এলেই পড়বে আম । একটা গাছ আছে, কাঁচামিঠে আম তার । ওহ, কী তার সোয়াদ! 

বুড়ন মানে বড়ো ভাইটা আমার থেকে মাত্র এক বছরের ছোটো, আমার এখন এগারো বছর আর ওর দশ বছর বয়স । ছুটন মানে ছোটো ভাইটা আরো অনেক ছোটো, মাত্র ছয় বছর ওর । 

আমরা কেউ ইস্কুলে যাই না । আমি আর বুড়ন ছোটোবেলা দু'বছর পড়েছি এক পাঠশালে, অ য়ে অজগর আসছে তেড়ে আ য়ে আমটি আমি খাবো পেড়ে শিখেছি, এক দুই তিন চার এসব শিখেছি, যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ শিখেছি , নামতা শিখেছি, একটু একটু পড়তে শিখেছি বাংলা বাক্য । ব্যস, তার পর বন্ধ হয়ে গেল পাঠশালে যাওয়া । বাবা যে তখনই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল! ছুটন তখন মাত্র তিন বছর বয়সের । 

মা পাঠশালা ছাড়িয়ে দিল, বললো, "লেখাপড়া আর করতে হবে না, লেখাপড়া শিখলে শয়তানি শেখে মানুষ । দেখলি না তোদের বাবা কেমন তোদের ফেলে চলে গেল? শয়তান লোকেরা ওরকমই হয় ।" 

বুড়ন এখন একটা ভাতের হোটেলে কাজ করে, রেলস্টেশনের কাছেই হোটেলটা । সন্ধ্যে থেকে মাঝরাত অবধি কাজ । তারপরে এক ঠোঙা খাবার নিয়ে ঘরে ফেরে । ঐ খাবার আর সপ্তাহে কিছু টাকা মাইনে, এই পায় । তাও, সেইটুকুই বা এমনি দেয় কে? 

মাঝে মাঝে উপরি জোটে মালিকের হাতে বেদম ঠ্যাঙানি । একবার একটা গেলাস ওর হাত থেকে পড়ে ভেঙেছিল বলে মালিক এমন মার মেরেছিল যে জ্বরে তিনদিন বিছানায় পড়েছিল ও । খবর পেয়ে অবশ্য এসেছিল লোকটা, মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়েছিল চিকিৎসার জন্য । সেই টাকা দিয়েই মা বুড়নের জন্যে ওষুধ আর ফল কিনে এনেছিল । 

বুড়ন সেরে উঠে আবার কাজে যেতে শুরু করেছিল । কালো, রোগা, দুর্বল একটা বাচ্চা ছেলে বুড়ন, দেখলেই মায়া লাগে । এমন একটা ছেলেকে কী করে অমন করে মারতে পারে ঐ বিশাল মোষের মতন চেহারার হোটেল মালিক লোকটা? কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে পিঠ রক্তাক্ত করে দিয়েছিল । 

ওকে বড্ড ভয় পায় বুড়ন, কিন্তু কিছু করার নেই, কাজ করতে তো যেতেই হবে । আমারও লোকটাকে দেখলে কেমন খারাপ লাগে, কেজানে কেন! এমনি এমনি একদিন আমাকে ডেকে "খুকী, এই নাও, চানাচুর কিনে খেও" বলে কিছু টাকা দিয়েছিল । আমি প্রথমে নিতে চাইনি, হাতটা শক্ত করে ধরে জোর করে টাকাটা হাতে গুঁজে দিল । 

শুয়ে শুয়ে ভাইদের হাওয়া করি আর তাকিয়ে থাকি বাইরের দিকে । ঐটুকু রুটি-ভর্তা খেয়ে পেট ভরে নি, কিন্তু ঘরে আর কিছু নেই । মা কাজের থেকে ফেরার পর আমাদের তিন ভাইবোনকে দু’টি খেতে দেবে । খাওয়া হলে বুড়ন যাবে হোটেলে কাজ করতে আর আমি ছোটনকে নিয়ে যাবো রাধাশ্যামের মন্দিরের ওখানে আবার । আজকে ওদের কী একটা পরব আছে, মন্দিরে নামগান হবে । 

নামগানের পর ওরা প্রসাদ দেয়, সিন্নি । সিন্নি খুব ভালোবাসি আমরা তিন ভাইবোনেই । আমার সিন্নির খানিকটা ঘরে এনে বুড়নের জন্য রেখে দেবো বাটিতে ঢাকা দিয়ে । মাকে বলে রাখবো । ও রাত্রে হোটেল থেকে ফিরে যখন ওর আনা ঠোঙার খাবার মায়ের সঙ্গে ভাগ করে খেতে বসবে, তখন মা ওকে ঢেকে রাখা সিন্নিটুকু দেবে । 

কিন্তু বিকেলে ঝড় উঠলে সব ওলোটপালোট হয়ে যাবে । মেঘ কি আসছে? তাকিয়ে থাকি বাইরের দিকে । সত্যি সত্যি আস্তে আস্তে রোদ মুছে যেতে থাকে, তাহলে মেঘ ঘনিয়ে এলো কালবৈশাখীর? 

রোদ মুছে যায় । আকাশ ভরে উঠেছে কালবৈশাখী মেঘে । দেখতে দেখতে ধুলোয় চারদিক অন্ধকার করে শোঁ শোঁ করে এসে পড়ে ঝড় । বুড়ন আর ছুটন ঘুম থেকে উঠে পড়ছে ততক্ষণে । উঠেই ঝড় দেখে তখনই প্রায় ছুটে যেতে চায় মন্দিরে আমবাগানে । অনেক কষ্টে ওদের থামাই । ঝড়বৃষ্টির পরে যেতে হবে । 

চড় চড় করে বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি এসে গেল । গরম মাটিতে প্রথম বৃষ্টি পড়লে কী আশ্চর্য একটা গন্ধ পাওয়া যায়! দেখতে দেখতে বৃষ্টি বেড়ে ওঠে, ঝড়ের দাপট ততক্ষণে একটু কমেছে । 

কোন্‌ কোন্‌ আমগাছের কাছে যাবো, কোন্‌টায় কাঁচামিঠে আম হয়, কোন্‌টার আম খুব টক --- সেইসব নিয়ে কথা বলি আর দেখি বৃষ্টি থামলো কিনা ! 

কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা মাফিক কিছু হয় না, ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে মা ফিরে আসে কাঁদতে কাঁদতে । বৃষ্টির জলে মায়ের চুল আর কাপড় ভিজে সপসপে । ওই অবস্থাতেই মা আমাদের তিনজনকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে । মায়ের ভেজা শরীর বারে বারে কেঁপে উঠছিল । 

"কী হয়েছে, মা, কী হয়েছে?" আমরা তিনজনেই এই প্রশ্ন করি বার বার, কিন্তু মা কিছু বলে না । 

কান্নাকাটির পর একটু শান্ত হয় মা । আমাদের ছেড়ে দিয়ে চোখ মোছে, ভেজা কাপড় বদলে আসে । তারপর মা সব বলে । 

পাশের ঝুপড়ির মালতী, যে স্টেশনের কাছের উঁচু বাড়ির একটা ফ্ল্যাটে কাজ করত, সেই মালতী মরে গিয়েছে । দোতলার খোলা ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়েছিল নিচে, সেইখানেই মৃত্যু । 

শুনতে শুনতে কাঁপুনি ধরে আমার । এই কিছুক্ষণ আগেও তো মালতীর কথা ভাবছিলাম! ভাবছিলাম ওর সঙ্গে চলে যাবো, কোনো ফ্ল্যাটে কাজ নেবো । যখন ভাবছিলাম তখন হয়তো মালতী আর বেঁচে ছিল না । 

আজ আর বুড়নকে কাজে যেতে দিল না মা, আমাদের একজনকেও বেরোতে দিল না । বুড়ন একবার বলছিল, "মা, ঐ মালিক লোকটা যে কামাই করলে রাগ করে খুব । আজ যদি না যাই, পরের দিন গেলে হয়তো মারবে ।" 

মা বলে, "আমি সঙ্গে যাবো পরের দিন, তোর মালিককে সব বলবো । আজ তোকে যেতে দেবো না কিছুতেই ।" 

সরা ঢাকা মাটির কলসী থেকে চারজনের খাবার মতন ভাত রাঁধার চাল বার করে মা, আমায় চাল ধুয়ে আনতে বলে উনুন ধরায় । আমি চাল ধুয়ে আনলে হাঁড়িতে দিয়ে বসিয়ে দেয় উনুনে । আনাজপাতির ঝুড়িতে দু’টি আলু আর দু’টি বেগুন ছিল শুধু । ওই আলু আর বেগুন ধুয়ে গোটা গোটাই টাবুর টুবুর করে ফুটতে থাকা চালের সঙ্গে সেদ্ধ দিয়ে দেয় । 

ভাত হয়ে গেলে সন্ধ্যে রাতেই আমাদের তিনজনকে খাইয়ে মা নিজেও খেয়ে নেয় । তারপরে বিছানা করে শুইয়ে দেয়, নিজেও শুয়ে পড়ে । দুইভাই মাঝে, আমি একধারে, মা অন্যধারে । 

ছুটন মায়ের পাশে, ও আব্দার ধরে গল্প শুনবে । মা আস্তে আস্তে গুনগুন করে গল্প বলে, কবে কোন্‌ এক অন্য দেশে থাকতো মা তার ছোটোবেলায়, সেই দেশের গল্প । রূপকথার মতন সেই দেশের কথা শুনতে শুনতে আমার বুকের মধ্যেটা কেমন করে । সেই দুপুরবেলার মেরে-মুখ-ফাটিয়ে-দেওয়া মা আর সন্ধ্যেবেলার ঝড়বৃষ্টি মাথায় কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসা মা, এরা কি একই মানুষ? এই বুকের কাছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গল্প শোনাতে থাকা মা, এও কি সেই মানুষটাই? 

আস্তে আস্তে মায়ের গল্প থেমে যায়, ভাইরা দু'জনেই ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়, অন্ধকারে ওদের ঘুমভারী শ্বাসের শব্দ শোনা যায় । মা ও হয়তো ঘুমিয়েছে । আমার ঘুম আসে না । চোখ বুজে শুয়ে থাকি চুপ করে । মালতীর কথা মনে পড়ে । কীভাবে ও নিচে পড়ে গেল দোতলার ব্যালকনি থেকে? কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল? নাকি ও নিজেই লাফ দিয়ে পড়ল? 

ওইরকম একটা বাড়িতে যদি মালতীর জায়্গায় আমি থাকতাম? আমাকেও কি কেউ ধাক্কা দিয়ে--- 
কে যেন ধাক্কা দিল? 


৩.

চমকে চোখ খুলি । অন্ধকারে দু'টো ছায়ামূর্তির মত মানুষ । একজন থাবার মত বড়ো বড়ো হাত দিয়ে আমার মুখ আর হাত দু’টো চেপে ধরেছে, অন্যজন চেপে ধরেছে পা দু'টো । চিৎকার করতে চাই, ছটফট করতে চাই, কিন্তু কোনোটাই পারি না । ঝুপড়ির তো দরজা বা আগল বলতে সেরকম কিছুই নেই, ঘুমন্ত মা আর ভাইদের একেবারে পাশ থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যায় অন্ধকারের দুই ছায়ামূর্তি । 

কারা এরা? কোথায় নিয়ে যাবে? ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপতে থাকে, আবারও চেষ্টা করি ঝটকা দিয়ে উঠতে । একটা লোক, যে হাত আর মুখ চেপে ধরেছিল, সে ঐ থাবার মতন হাতটা দিয়ে মুখে এমন চাপ দেয় যে কোঁক করে উঠে অবশ হয়ে যাই । 

আমবাগানেই নিয়ে গেল ওরা । ঝড়ের পরের আমবাগান তখন ভেঙে পড়া ডাল আর ছেঁড়া পাতায় ভর্তি । তার মধ্য দিয়ে ওরা চললো পশ্চিমের খালের দিকে । আমবাগানের পশ্চিম পাশে একটা খাল আছে, আগে নাকি নদী ছিল সেটা । 

আমিও কি মরে গেছি তাহলে মালতীর মত? এরাই কি যমদূত? আমাকে নিয়ে যাচ্ছে যমরাজার কাছে? সেখানে মালতীর সঙ্গে দেখা হবে? 

খালের কাছে এসে আমায় মাটিতে ফেলে ঠেসে ধরে রাখলো একজন, অন্যজন খুলে ফেললো আমার ছেঁড়া ফ্রকটা আর জাঙ্গিয়াটা । চিৎকার বা ছটফট করার মত অবস্থা তখন আর নেই আমার । ভয়ে, যন্ত্রণায় অবশ হয়ে আসছে তখন সব । নির্মমভাবে বুকটা মুচড়ে দিল কে যেন, পা দু'টো টেনে ফাঁক করে দিল । প্রচন্ড ব্যথায় গোঙাতে শুরু করতেই প্রচন্ড চড় খেলাম দুই গালে । 

অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতে দেখছিলাম গোটা আকাশটা লাল, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা লাল বৃষ্টি পড়ছে । রক্তের বৃষ্টি যেন । যেখানে যেখানে সেই বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, সেখানে সেখানে জ্বালা করে উঠছে । ঐ ভয়ঙ্কর বৃষ্টি থেকে পালাতে চাইছি, কিন্তু তাড়া করে আসছে দুই বীভৎস দৈত্য । 

প্রাণপণে ছুটছি আর ছুটছি, সেই রাধাশ্যামের মন্দিরের বাগানের গভীর দিঘির দিকে । দিঘির জলে লাফিয়ে পড়লেই দৈত্যেরা আর পারবে না ধরতে । 

কিন্তু কোথায় সেই দিঘি? সমস্ত রাস্তা অচেনা লাগে, যেদিকে তাকাই শুধু লালবৃষ্টির জল জমে জমে তৈরী ছোটো ছোটো পুকুর । এর মধ্য দিয়ে ঐ দিঘির কাছে যাবার পথ কোথায়? 

হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, দৈত্য দুটো দৌড়ে এসে ক্যাঁক করে চেপে ধরলো আমায় । তারপর গলাটা টিপে ধরে মুচড়ে দিল । 

প্রচন্ড কষ্টের কয়েকটা মুহূর্ত! যেন একটা কালো গর্তের মধ্যে পড়ে গেছি, দম বন্ধ হয়ে আসছে । তারপরেই হঠাৎ দেখি না তো, আর তো দমবন্ধ ভাব নেই ! এখন তো আমি খোলা আকাশের নিচে, হাওয়ায় ফুলের গন্ধ! 

সামনেই সেই দিঘিটা । তার কালো জল স্থির হয়ে আছে সামনেই । ঝপাস করে ঝাঁপিয়ে পড়ি জলে । 

সেই বিশাল মাছটা অপেক্ষা করে ছিল জলের ভেতর । কাছে এসে সে আলতো করে পাখনার ডগা দিয়ে আমায় ছুঁয়ে বললো, "চলো, চলো, আর অপেক্ষা করে লাভ নেই । চলো সেই প্রাসাদে, যেখানে সেদিন নিয়ে যাচ্ছিলাম তোমাকে, সেইখানে । সেদিন যেতে পারোনি, আজকে পারবে । চলো ।" 

দিব্যি সাঁতার কাটছিলাম, কে বলবে আমি সাঁতার জানতাম না? ঐ বিশালকায় দয়ালু মাছটার মতই সচ্ছন্দে সাঁতার কাটতে কাটতে ওর পাশে পাশে চলছিলাম । 

সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম ভয়, দুঃখ, অত্যাচার, হত্যা, ক্ষুধা ও গরল । আমাদের ঘিরে নেমে আসছিল অজস্র নীল বৃষ্টিকণা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ