জীবনে এই প্রথম কেউ ভিসেন্তেকে কাঁদতে দেখল।
সাধারণ কান্না নয়। রীতিমত হাউমাউ করে কান্না। জেল খাটা আসামী, দিন নেই-রাত নেই বারে-ক্লাবে মদ খেয়ে চুর হয়ে পড়ে থাকা, বউ খেদানো, ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ভিসেন্তে যে কাঁদতে পারে এই প্রথম জানলো সবাই। মায়ের মৃত্যুতে ওর আকুল কান্না আশেপাশের মানুষের মনকে আর্দ্র করল।
সবাই ওকে ধরাধরি করে গাড়ীতে জ্যাকসন হাইটস থেকে ব্রংকসে ওর বাসায় পৌঁছে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এতখানি মনোযোগ জীবনে কোনদিন পাইনি ও।
সবাই ওকে ধরাধরি করে গাড়ীতে জ্যাকসন হাইটস থেকে ব্রংকসে ওর বাসায় পৌঁছে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এতখানি মনোযোগ জীবনে কোনদিন পাইনি ও।
দোকানের আরেক কর্মচারী বাদল সারেংয়ের ওপর দায়িত্ব পড়ল গাড়ি চালিয়ে ভিসেন্তেকে নিয়ে যাবার। অথচ দুজনের মধ্যে সারাক্ষণ খিটিমিটি লেগেই থাকে। ভিসেন্তে সুযোগ পেলেই দোকানের বয়স্ক এই মানুষটির পিছনে লাগে। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে ভিসেন্তের ওপর সব রাগ পানি হয়ে গেল তার । বাদল সারেং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আজ রাতে এশার নামাজের পরে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে ভিসেন্তের মায়ের জন্য। অসম্ভব দুঃখী একজন মহিলা। স্বামী, তিন ছেলের কেউ ছিল না মৃত্যুকালে মাথার পাশে। সবাই তো থাকে আমেরিকায়। তিনি থাকতেন মেক্সিকোর পাহাড়ী অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।
সেখান থেকে কেউ খবরটা পাঠিয়েছিল ভিসেন্তের মোবাইলে। ও তখন গ্রোসারি শপের ফ্লোর পরিস্কার করছিল। সন্ধ্যা তখন সাতটা হবে। পাঁচটা থেকে ওর ডিউটি শুরু হয়ে শেষ হয় রাত বারোটায়। রাত বারোটা থেকে ভোর সাতটা পর্যন্ত থাকে গ্রোসারি শপের মালিক গিয়াসউদ্দীন। আর কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সকাল সাতটায় আসে বাদল সারেং। আগেও না পরেও না। কঠিন নিয়মে থাকেন তিনি। অন্ধকার থাকতে উঠে ফজরের নামাজ পড়েন। তারপর কিছুক্ষণ কোরআন তেলওয়াত করে হাঁটতে বের হন। ফিরে গোসল করে হালকা নাশতা করে চলে আসে দোকানে। নাশতাও একদম বাধা ধরা। ব্যাগেল খান চিজ ক্রিম দিয়ে। নয়ত ফ্রুট ফ্লেভার ওটমিল। গত সতের বছর ধরে এই বাধা ধরা রুটিনে ব্যাতিক্রম দেখতে পায়নি কেউ।
ভিসেন্তে এই দোকানে কাজ করছে তের বছর ধরে। এদেশে এসেছিল অবশ্য আরও দুই বছর আগে। তখন টেক্সাসে ছিল। সেখান থেকে নিউইয়র্কে পাড়ি জমায়। নানা জায়গায় ধাক্কা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত গিয়াসউদ্দীনের দোকানে এসে থিতু হয়। পাশেই জ্যাকসন হাইটসের সবচেয়ে পুরনো মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে। আশেপাশে লোকজনও বেশীরভাগ স্প্যানিশভাষী। তাই এখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি।
ভিসেন্তের মায়ের মৃত্যুর খবরে পাশের মেক্সিকান রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরাও ভিড় করে। বাদল সারেংও এসেছেন খবর পেয়ে। ফোন পাবার পরে ওর হাউহাউ কান্নায় দোকানের কাস্টোমাররাও সবাই চমকে যায়। মনে হচ্ছিল বুকের একদম গহিন ভেতর থেকে উঠে আসছে সমস্ত আবেগ। জীবনের বহু বঞ্চনা আর চাপা ক্ষোভের যন্ত্রণা। কোনভাবে নিজেকে সংবরন করতে পারছিল না ও।
বাদল সারেং দোকানের কর্মচারী হলেও মালিক গিয়াসউদ্দীন তাকে বড়দা বলে ডাকে। শরীয়তপুরের একই গ্রামের মানুষ তারা। ‘বড়দা, আমি তো দোকান রেখে যেতে পারছি না। আমার গাড়িটা নিয়ে যান। আপনি একটু কষ্ট করে বাসায় দিয়া আসেন ভিসেন্তেরে। পাশের রেস্টুরেন্টের ওর এক মেক্সিকান বন্ধুও যাবে।’
‘সমস্যা নাই আমি যাইতে পারব। আমার তো ঘর সংসার নাই এখানে। দেরীতে ফিরলেও সমস্যা নাই।’
পাশের রেস্টুরেন্টের ওয়েটার পেদ্রোর কাজ শেষ হয়েছে একটু আগে। ও প্রতিদিন যাওয়ার আগে ভিসেন্তের সঙ্গে গল্প করতে আসে। দুজনে মিলে একটা করে বিয়ার খায়। তারপর পেদ্রো বাড়ির পথ ধরে। আজ ও বাড়ি না গিয়ে থেকে গেছে। ভিসেন্তের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা পানির বোতল। টুলের ওপর বসে থাকা নিস্তেজ ভিসেন্তের পাশে এসে দাঁড়ায়। স্প্যানিশ ভাষায় কিছু একটা বলে পানির বোতলটা এগিয়ে দেয়। ভিসেন্তে হাত দিয়ে বোতলটা সরিয়ে দেয়।
গিয়াসউদ্দীন এসে ভিসেন্তেকে বলেন, ‘পানি খেয়ে গলা ভেজাও। অনেকক্ষণ তো কাঁদছ। গলা তো শুকাইয়া গেছে। তারপর চলে যাও বাসায়। আজ আর কাজ করতে হবে না। বড়দা তোমাকে দিয়ে আসবে। ’ কথা বলতে বলতে তিনি বাদল সারেংয়ের দিকে ইশারা করেন।
কথাবার্তা বাংলাতে হচ্ছে। ভিসেন্তে বাংলা কথা বোঝে। দোকানের মালিক গিয়াসউদ্দীন ভালো স্প্যানিশ বলতে পারে। তার দোকানটা রুজভেল্ট এভিনিওর ওপরে। আশেপাশে হিসপ্যানিকরা বেশী। তাদের অনেকে ইংরেজীতে কথা বলতে পারে না। বাদল সারেংও কাজ চালানোর মতো স্প্যানিশ ভাষা বলতে পারেন।
আদ্রিয়ান আসে ছুটতে ছুটতে। ভিসেন্তের আরেক বন্ধু। রুজলেল্ট এভিনিউর ওপরে একটা মেসেজ পার্লারে কাজ করে। ভিসেন্তের বন্ধুরা এমনই। বার,রেস্টুরেন্ট, মেসেজ পার্লারে কাজ করে। ওর মতো অল্প শিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ। ভিসেন্তের মতো অবৈধ। ভিসেন্তের মতো বেটে খাটো মেক্সিকান। কাঁদতে কাঁদতে চুপ হয়ে যাওয়া ভিসেন্তে আবার আদ্রিয়ানকে দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ এডি, মাই ফ্রেন্ড, মা আর নেই। আমার মা আর নেই। আমার আর যাওয়া হল না মায়ের কাছে। আমার আর গ্রামে যাওয়া হল না। মায়ের ছাগল-ভেড়ার পাল দেখা হল না।’ ভিসেন্তের আহাজারিতে আদ্রিয়ান ও পেদ্রো হাপুশ নয়নে কাঁদতে শুরু করে।
’কাঁদিস না ভিসেন্তে। তুই তো তোর মায়ের জন্য চেষ্টা কম করিস নাই। মেক্সিকো সিটির সেরা হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করিয়েছিস।’ দোকানের মালিক গিয়াসউদ্দীনের বাসা কাছে। ভিসেন্তের মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে গিয়াসউদ্দীনের স্ত্রী আসমা সুলতানা এসেছে। সে স্বান্ত্বনা দিয়ে কথাগুলি বলে। স্বামী-স্ত্রী দুজনে ভিসেন্তেকে খুব স্নেহ করেন। এই দেশে হায়ার আর ফায়ার খুব সাধারণ ঘটনা। অন্য মালিক হলে কবে এই মেক্সিকানকে ফায়ার করতো। গিয়াসউদ্দীন আর আসমা সুলতানা তেমন নন। এই যে ভিসেন্তে এখন চলে গেল। তার পরিবর্তে আসমা সুলতানা দোকান সামলাবেন। স্বামী বাসায় গিয়ে ঘুমাবেন রাত বারোটা পর্যন্ত।
আসমা সুলতানার কথায় সত্যতা আছে। দোকানে সাপ্তাহিক বেতন হয় প্রত্যেক কর্মচারীর। বেতনের অর্থ হাতে পেয়ে প্রথমেই ভিসেন্তে মায়ের জন্য ডলার পাঠাতো। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার কোন ত্রুটি রাখেনি সে।
মাকে চোখে দেখাটাই শুধু হল না ভিসেন্তের। মাও শেষ বারের মতো দেখতে পেল না ভিসেন্তেকে। ওর আরও দুই ভাই আমেরিকায় থাকে। তাদের মায়ের প্রতি অত টান নেই। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। অপদার্থ ভিসেন্তে ছিল মায়ের চোখের মনি। ওর বাবা যখন মেক্সিকো ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসে তখনই ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যেভাবে হোক এদেশে আসতে হবে। চেষ্টা করবে বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার মায়ের কাছে পাঠাতে। কিন্তু আমেরিকা মুলুকে ডলারের ঝনঝনাতিতে ভিসেন্তের বাবা ভুলে গিয়েছিল পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ছোট্ট কুটিরের কথা। অপেক্ষামান স্ত্রীর কথা। গ্রীনকার্ডের লোভে আরেক মহিলাকে বিয়ে করে। পরে সিটিজেনও হয়।
বাবা হিসেবে লোকটা একদম খারাপ নন। নিজে এদেশের নাগরিক হওয়ার পরে ছেলেদের স্পন্সর করার উদ্যোগ নেন। দুই ছেলেকে করেছেন। শুধু ভিসেন্তেকে রাজী করানো যায়নি। মাকে ছেড়ে আসার কারনে প্রচন্ড রাগ ছিল ওর বাবার ওপর।
দোকানের সামনে রুজভেল্ট এভিনিউর ওপর গিয়াসউদ্দীনের পিক আপ ভ্যানটা রাখা। ওপরের ট্রেন লাইন থেকে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছে। তাপমাত্রা সেলসিয়াসে চার ডিগ্রি। কিন্তু অনুভব হচ্ছে আরও বেশী। আবহাওয়া পূর্বাভাষে দেখাচ্ছে একটু পরে আবার বৃষ্টি শুরু হবে।
ঠান্ডায় হি হি কাঁপতে কাঁপতে ওরা সবাই মিলে পিক আপ ভ্যানে ওঠে। বাদল সারেংয়ের পাশে সামনের সিটে বসে পেদ্রো। ভিসেন্তেকে নিয়ে আদ্রিয়ান পিছনে।
গাড়ী চলতে থাকে। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি দেখলে বাদল সারেংয়ের নিজের শৈশবের কথা মনে হয়। ওর জন্মের দিন প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছিল। যে জন্য মা ছেলের নাম রেখেছিল বাদল। তখন গ্রামের মানুষ ধার্মিক ছিল। ধর্মান্ধ ছিল না। নাম শুনলে বোঝা যেত না হিন্দু না মুসলমান। বাদল সারেং নিজে মানুষটা ওই রকম। কোন ওয়াক্তের নামাজ তাকে কেউ কখনও কাজা পড়তে দেখেনি। আবার নিয়মিত নাচ-গানের অনুষ্ঠানে যান। জ্যাকসন হাইটসে অনুষ্ঠানের অভাব হয় না। নি:সঙ্গ জীবনে ওইটুকুই তার বিনোদন।
গাড়ীর সবাই চুপচাপ বসে আছে। প্রত্যেকে নিজেদের দুর্ভাগা জীবনের কথা ভাবছে। কাগজপত্র নেই কারো। ওরা সবাই এই দেশে অবৈধ। দালালের সাহায্যে জীবন বাজি রেখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মেক্সিকোতে এসেছে ভিসেন্তে। প্রথমে উত্তাল নদী পার হয় সাঁতার কেটে। তারপর দিগন্ত বিস্তৃত গম ক্ষেত পাড়ি দেয়। কাজটা কঠিন। আমেরিকার সুশিক্ষিত সীমান্তপ্রহরীদের চোখ ফাঁকি দেয়া সহজ না। হেলিকপ্টার পাহাড়া দেয় ওপর থেকে। ওর বন্ধু আদ্রিয়ান আমেরিকায় ঢুকেছিল সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে।
‘তোর ভাই মোরালেসের হাত দিয়ে গত ক্রিস মাসে কত কিছু পাঠিয়েছিল তোর মা। ছাগলের দুধ, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, ঝিঁঝি পোকা ভাজা, সূর্যমুখী ফুল। তোর মায়ের বানানো টাকিলা মদটা খুব ভালো হয়। আর কোনদিন খাওয়ার সুযোগ হবেনা।’ আদ্রিয়ান নিজের মনে কথা বলে। ভিসেন্তের কান্না থামেনি। তবে আওয়াজ করে কাঁদছে না। চোখ টসটস করছে পানিতে। বার বার শার্টের হাতা দিয়ে মুছছে।
মা ছেলের জন্য মদ বানিয়ে পাঠায় ! মুখে কিছু না বললেও মন থেকে এটা মানতে পারেননি বাদল সারেং। ভিসেন্তের এমনিতেও প্রচন্ড মদের নেশা। মাঝেমধ্যে এজন্য কোন খবর থাকে না ওর। বাদল সারেং এই নিয়ে মাঝেমধ্যে গজগজ করেন মালিকের সঙ্গে।
‘এমন দায়িত্বহীন, অপদার্থ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। পাঁচদিন কাজ করবে আর এক রাতে সেই টাকা বারে উড়িয়ে দিয়ে আসবে, এটা কোন জীবন হল! বউ-ছেলেমেয়ের কোন খবর রাখে না।’
মালিক গিয়াসউদ্দীন বাদল সারেংয়ের কথায় হাসে। তার মুখে সব সময় ভিসেন্তের জন্য একটা প্রশয়ের হাসি লেগে থাকে। যেটা মাঝেমধ্যে বিরক্ত করে বাদল সারেংকে। একবার অনেকদিন খোঁজ নাই ভিসেন্তের। মালিক খুব চিন্তিত। হঠাৎ ফোন এল ভিসেন্তের। ‘বস, আমারে এখান থেকে নিয়ে যান।’
মালিক জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই কই?’
‘আমি তো জেলখানায় বস।’ ভিসেন্তের উত্তর।
ওইবার আরেক মেক্সিকান দেশী ভাইয়ের সঙ্গে মারামারি করার জন্য জেলে যেতে হয়েছিল ভিসেন্তেকে। আরেকবার একই নামে দুটি ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স রাখার জন্য পুলিশ ওকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। দুইবারই গিয়াসউদ্দীন বন্ড সই করে আড়াই হাজার ডলার জরিমানা দিয়ে ভিসেন্তেকে ছাড়িয়ে আনে। ভিসেন্তে কাজ করে সেই টাকা শোধ করে।
গিয়াসউদ্দীন সারাদিন ভিসেন্তেকে তার দায়িত্বহীনতার জন্য গালিগালাজ করে। কিন্তু কাজ থেকে বাদ দেয় না। মালিকের স্ত্রী আসমা সুলতানাও স্বামীর মতো। সেও সারাক্ষণ বকাঝকা করে ভিসেন্তেকে। আবার স্নেহও করে। ভিসেন্তের খামখেয়ালী মনোভাবের জন্য ওর স্ত্রী চার ছেলে মেয়ে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এই নিয়ে কত কথা শুনিয়েছে আসমা সুলতানা। ‘তুই এত পাষাণ হস কিভাবে বলতো। এইরকম ছোট ছোট বাচ্চা ছাইড়া থাকতে পারস!’ মালিকের স্ত্রীর কথায় ভিসেন্তে বেক্কলের মতো হাহাহা করে হাসে।
বাদল সারেং প্রথম দিকে বিরক্ত হত। এখন আর হয় না। সে বুঝে গেছে মালিক আর তার বউ ভিসেন্তেকে গালিও দেবে, আবার রাখবেও। কারণ ও পরিশ্রমী আর সৎ। সমস্ত মালপত্র কেনা, সেসব দোকানে তোলা সব কিছু সে করে নিখুঁতভাবে। কিন্তু সংসারের ব্যাপারে প্রচন্ড উদাসীন ভিসেন্তে। পুরো সপ্তাহের বেতন এক রাতে মদ খেয়ে উড়িয়ে দিলে কিভাবে বাসা ভাড়া দেবে আর বাজার করবে!
ভিসেন্তেকে বোধবুদ্ধিহীন জড়পদার্থ হিসেবে জানতো বাদল সারেং। আজ তার ভুল ভাঙ্গল। মায়ের মৃত্যুতে আকুল কান্না বলে দিল, ওর একটা নরম কোমল মন আছে। ওর মতো জড়পদার্থেরও একটা স্বপ্ন আছে। ১৪ বছর ধরে না দেখা মায়ের শীর্ণ মুখটা স্পর্শ করতে অতৃপ্তি ওকেও কুরে কুরে খায়।
এক বছর হল ভিসেন্তের বউ ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে এক সেফ হোমে আশ্রয় নিয়েছে। ‘বউ চলে গেছে, তাতে কি হয়েছে? তোমার তো গার্লফ্রেন্ডের অভাব নাই!’ ভিসেন্তেকে কত যে তীর্যক কথা শুনিয়েছে বাদল সারেং। অবাধ যৌনতার দেশ মেক্সিকোতে মাত্র ষোল বছর বয়সে সন্তানের বাপ হয়ে যায় ভিসেন্তে। ২৫ বছর বয়সে চার ছেলেমেয়ের বাবা। বাদল সারেং হিসাব করে দেখেছে, ওর নিজের সেই বয়সে বিয়ে হয়নি। আর বাংলাদেশে বিয়ের আগে যৌন সংসর্গের কথা তো চিন্তা করা যায় না। অন্তত বাদল সারেং নিজে কখনও মাথায় আনেনি। এই যে নিউইয়র্কে ১৭ বছর ধরে একা আছেন, কখনও চিন্তা করেননি অবৈধ উপায়ে যৌন তৃপ্তি খোঁজার।
সন্ধ্যা বেলায় ব্রঙ্কসে যাবার পথে ট্র্যাফিক জ্যাম থাকে প্রচন্ড। সামনে ব্রীজ। সেটা পার হলে অবশ্য সময় লাগবে না। বাদল সারেং গাড়ী চালান দেখেশুনে। তবে জীবনে বেশী সতর্ক হয়েও কোন লাভ হয়নি। জীবনভর একটার পর একটা কঠিন অসুখে ভুগতে হয়েছে। এজন্য ছোটখাটো মানুষটি বরাবরই শীর্ণকায়। কথা বলেন খলবলিয়ে, অতি দ্রুত। সরল মানুষেরা যেভাবে বলেন।
ভিসেন্তে থেমে থেমে কেঁদে চলেছে। কাঁদছে প্রকৃতিও। বাদল সারেংয়ের বুকেও এক ধরনের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এক-দুই বছর নয়, ১৭ বছর অপেক্ষা করেছেন একটা চিঠির জন্য। মনে মনে কত ভেবেছেন, একটা সোনালী সকালের কথা। জায়নামাজে বসে খোদার কাছে কত ভাবে ফরিয়াদ জানিয়েছেন! শয়নে স্বপনে জাগরণে কত ভাবেই না ডেকেছেন! কিন্তু সেই চিঠি আর আসেনি। আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্ট তাঁকে এই দেশে বৈধ ভাবে থাকার অনুমতি দেয়নি।
ভাগ্য অন্বেষণে এসেছিলেন নিউইয়র্কে। ভেবেছিলেন পরিবারের সবাইকে আনতে না পারলে দুই এক বছরের মধ্যে ফিরে যাবেন দেশে! নিউইয়র্কে আসার দুই বছরের মাথায় ব্রেন স্ট্রোক করেন তিনি। কোমায় চলে যান। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরে এলেও ডাক্তারের কড়া পর্যবেক্ষণে থাকতে হত। অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন বাদল সারেং। বাংলাদেশে চলে গেলে আর আমেরিকায় ফিরতে পারবেন না। উন্নত দেশের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া হবেনা। পরিবারের কারো ভিসা হয়নি আজো।
আদ্রিয়ান আর পেদ্রোর চিৎকারে চিন্তায় ছেদ পড়ল। ভিসেন্তের বাড়ীর গলি ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল গাড়ী। ‘সরি..সরি’ বলে কোনভাবে গাড়ীটা পিছনে নিল বাদল সারেং। তারপর গলিতে ঢুকাল। ভিসেন্তের বাসা সামান্য ভিতরে। বাদল সারেং হালকা করে মাথাটা একটু পেছনে ঘোরালেন। ভিসেন্তে গা এলিয়ে নিস্তেজের মতো বসে আছে।
‘আমরা বাড়ির কাছে চলে এসেছি।’ আদ্রিয়ানের কথাতে চোখ খুলে তাকায় ভিসেন্তে। সোজা হয়ে বসে।
‘তোমরা আজ রাতে ভিসেন্তের বাড়ীতে থেকো।’ আদ্রিয়ান আর পেদ্রোকে বলে বাদল সারেং।’ ওরা মাথা নাড়ায়।
ভিসেন্তের বাড়ীর সামনে গাড়ী থামতে ‘পাপা’ বলে একটা শিশু ছুটে আসে। ওরা তাকিয়ে দেখে ভিসেন্তের ছোট ছেলে জাভি। বড় তিনজনকে নিয়ে ভিসেন্তের স্ত্রী এ্যাঞ্জেলিনা বৃষ্টির জন্য একটা শেডের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। স্ত্রী ছেলেমেয়েকে দেখে ভিসেন্তের ধরে আসা কান্না আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে নামল। সবাই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।
খুব আবেগপ্রবণ বোধ করে বাদল সারেং। কিছু না বলে চলে আসে সে। গাড়ী ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন আসে মালিকের। ‘বড়দা, তোমরা ব্রঙ্কসে পৌছাতে পারছ? ভিসেন্তের বউ-ছেলেমেয়ে আসছে?’।
‘হ্যা। আমরা কয়েক মিনিট আগে পৌছালাম। এ্যাঞ্জেলিনা আসছে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে। ওরা আসাতে ভিসেন্তের জন্য ভালো হইছে।’ বাদল সারেং বুঝতে পারে এ্যাঞ্জেলিনাকে মালিক ফোন করেছে। গিয়াসউদ্দীন ফোন কেটে দেন। বাদল সারেং গাড়ী চালাতে থাকেন প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে।
বাদল সারেংয়ের জন্য বৃষ্টির দিনগুলি আসলেই অন্যরকম। এমন বৃষ্টির দিনে জন্ম হয়েছিল বলে ওর নাম বাদল। পূর্বপুরষরা জাহাজে চাকরী করতো বিধায় নামের শেষে যুক্ত হয়েছে সারেং। সারেংরা রাতে স্টিমার নিয়ে নীল দরিয়ায় ঘুড়ে বেড়ায়। স্বামীর চিন্তায় একেলা রাত জাগে সারেং বৌ। ১৭ বছর ধরে বাদল সারেংয়ের বৌ একলা অপেক্ষা করে আছে দেশে।
বৃষ্টি স্নাত পথের দিকে তাকিয়ে চোখ ভিজে আসে বাদল সারেংয়ের। সতের বছর অবৈধ থাকার পরে সে সারেং বৌয়ের কাছে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
লেখক পরিচিতি
মনিজা রহমান
গল্পকার। নিউ ইয়র্কে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
likhati obes valo lagche. keep it up. onek dua r shuvao kamona roilo.
উত্তরমুছুন