রমাপদ চৌধুরীর গল্প : বুকের মধ্যে ভূমিকম্প

বয়স তখন উনিশ। দক্ষিণের ও তল্লাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজের তিন-চারটি বন্ধু কাছাকাছি থাকতাম, লেকের ধারে আড্ডা দিতাম। আর হঠাৎ কখনো সুন্দর চেহারার মেয়ে দেখলে, তার চোখে চোখ পড়লে বুকের ভেতরটা কেমন কেমন করে উঠতো।

তখন পুজোর সময় এত ভিড় ছিলো না, দিব্যি এ-প্যাণ্ডেল থেকে ও-প্যাণ্ডেলে বেড়াতে বেড়াতে যাওয়া যেতো। সেদিনও প্রতিমা কিংবা সুন্দর মুখ দেখতে বেরিয়েছি তিন-চারজনে। সাদা কথা, প্রতিমা আমরা দেখতাম না, প্রতিমার মতো মেয়েদের দেখতাম। গল্প করছি, হাঁটছি, কিংবা জোর তর্ক চলেছে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু চোখ দুটো গোয়েন্দাগিরিতে ব্যোমকেশ, হাজার ভিড়ের মধ্যে উৎকৃষ্ট সুন্দরী কোনো তরুণীকে এক লহমায় খুঁজে বের করে ফেলে। আর সেই সুতনুকা মেয়েটি যদি বাই-চান্স ফিরে তাকায়, চোখাচোখি হয়ে যায় কোনোক্রমে তা হলে নির্ঘাত হদয়কম্প, বুক থরথর করে ওঠে। সাত দিন তার স্বাদ লেগে থাকে বুকের মধ্যে। একজনের কথা তো বছরখানেক মনে ছিলো। আরেকজনের কথাই বলছি, তার কথা আজও ভুলিনি। 

একটা পুজো-প্যান্ডেলে বেশ ভিড়। স্মৃতির কৌটোয় কালেকশন বেশ ভালোই হবে মনে করে  তিন-চার বন্ধুই এগিয়ে গেলাম। আর এক পলকের মধ্যেই আমার চোখ পৃথিবীর এইটথ ওয়ান্ডার আবিষ্কার করে ফেললো। কাছাকাছি কোনো গ্রাম-ট্রাম থেকে একটা দল এসেছে, বুড়ী-বুড়ো, মাঝবয়েসী, বউ। স্টকিং আর ফিতে-বাঁধা জুতো পায়ে এক গেয়ো বাবুও আছেন। কিন্তু তার মধ্যে একটি অসাধারণ সুন্দরী কিশোরী মেয়ে। না-খুব-সাদাসিধে একখানা ডুরে শাড়ি, কপালে লাল টিপ, কিন্তু সমস্ত শরীর বেয়ে যেন লাবণ্য ঝরছে। মুখের ওপর বর্ষার সবুজ ঘাসের, শান্ত দিঘির, নির্জন শালিকের ছায়া। আমার উনিশ বছরের চোখ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন ফিরে তাকালো মেয়েটি। চোখাচোখি হতেই আমার বুক কেঁপে উঠলো। মনে হলো এমন সজল স্নিগ্ধ রূপ আমি কখনো দেখিনি। পরমূহর্তেই মেয়েটি আবার ফিরে তাকালো, আবার চোখাচোখি হলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের মধ্যে ভূমিকম্প হলো। 

কারণ, দ্বিতীয়বার তাকানোর পরই শহরভীরু মেয়েটি দু কানের লতিতে দু হাত ঠেকিয়ে 

কানের মাকড়ি সামলালো। 

কোনো মেয়েই বোধ হয় কোনো ছেলেকে এর চেয়ে বেশী অপমান করতে পারে না। 

বুকের মধ্যে ভূমিকম্প সেজন্যেই। তারপর থেকে আমি আর কোনো মেয়ের দিকে ভালো লাগার চোখ নিয়ে তাকাতে যাইনি। আমি জানি, যে-কোনো ছেলে যখন আজও ভালো লাগার বা ভালোবাসার চোখ নিয়ে কোনো মেয়ের দিকে তাকায়, তখন মেয়েটি দু হাতে তার সোনার মাকড়ি দুটি সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ