আমি, অজিত আর হানু। খুব ফর্সা সব-চুল-পাকা বাবাটা, মোটাসোটা মা, রাগী আর ঝগড়াটে একটা দাদা, দুটো বোন, একটা ওর পিঠোপিঠি, একটা পুচকে। একটা কাবলিওয়ালা, একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক, তার মাঝবয়সী গিন্নী। দুজন খাকী পোশাকের মাদ্রাজী, আধা-মিলিটারি কোনো কাজ করে। আরো কে কে যেন ছিলো। সবাই অবান্তর। আসলে ঐ পিঠোপিঠি দু বোনের মধ্যে যাকে চুন্নী বলে ডাকলো দাদাটা-- সেই আসল।
বললে, স্যটকেসটা বাঙ্কে তুলে দে চুন্নী।
মা কালো, তাই মেয়েটা বাপের রঙ পায়নি। কিন্তু শ্যামলা রঙের ওপর একটা হলদে-হলদ আভা পড়ে ওকে খুব সুন্দর লাগছিলো। চোখে কেমন একটা জাদু-জাদু।
কামরায় তেমন একটা ভিড় ছিলো না। কলকাতা ফেরার সময় তেমন বাড়তি ভিড় থাকে না।
আমি, অজিত আর হানু, গল্প করছিলাম। অথচ বেশ বুঝতে পারছিলাম নিজেদের কথায় নিজেদেরই মন ছিলো না। অজিত আর হানুও নিশ্চয় ওদের কথাই শুনছিলো। চুন্নীকে দেখছিলো।
ছটফটে অস্থির প্রকৃতির মেয়েটা অকারণে হাসছিলো, জায়গা বদল করছিলো, পিঠোপিঠি বোনটার সঙ্গে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে কি বলাবলি করে হাসছিলো। অকারণেই সরু করিডর দিয়ে দরজা অবধি গিয়ে দরজার জানালায় মুখ বাড়িয়ে বাইরের ছুটন্ত মাঠ-গাছ দেখছিলো, ফিরে এসে বলছিলো, এই দাদা, ওঠ না, আমি ওখানে বসবো। অর্থাৎ জানালার পাশে।
ছটফটে অস্থির প্রকৃতির মেয়েটা অকারণে হাসছিলো, জায়গা বদল করছিলো, পিঠোপিঠি বোনটার সঙ্গে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে কি বলাবলি করে হাসছিলো। অকারণেই সরু করিডর দিয়ে দরজা অবধি গিয়ে দরজার জানালায় মুখ বাড়িয়ে বাইরের ছুটন্ত মাঠ-গাছ দেখছিলো, ফিরে এসে বলছিলো, এই দাদা, ওঠ না, আমি ওখানে বসবো। অর্থাৎ জানালার পাশে।
চুন্নী জানালা পাচ্ছিলো না। আমি পেয়েছিলাম। ঠিক ওর দাদার সামনের সীট। আর সেজন্যেই বোধ হয় ওর দাদা জানালা দিচ্ছিলো না।
আমার একবার ইচ্ছে হলো জানালাটা দিয়ে দিই। অজিত বললে, খবরদার। হানু বললে, ভালো হবে না কিন্তু।
চাপা গলায় বললে আমাকে। কারণ মেয়েটা, মানে চুন্নী ওর দাদাকে জানালা ছাড়তে বললেও তাকালো কিন্তু আমার দিকে।
মানে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছিলো। অবশ্য প্রতিদানে।
ওরা যখন উঠলো, তখন ওদের মালপত্র তোলায় আমরা তিনজনই একটু সাহায্য করেছিলাম।
মাঝখানে কোনো একটা স্টেশনে ওরা চা খেলো। চায়ের একটা ভাড় আমি এগিয়ে দিয়েছিলাম চুন্নীকে। আঙুলে আঙলে লেগেছিলো।
চুন্নী থ্যাঙ্কিউ বলেছিলো মজা করে। একবার দাদাটাকে জিগ্যেস করা আমার কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলো চুন্নী।
তারপর যেমন হয়ে থাকে ট্রেনে, চোখে চোখে কি যেন হয়ে গিয়েছিলো। আমার বুকের ভেতরটা রিনরিন করছিলো, মিষ্টি ব্যথার মতো।
ও হঠাৎ আবার উঠলো, বাঙ্ক ধরে ধরে দরজার দিকে যাবার সময় আড়চোখে একবার তাকালো। আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। মনে হলো ও যেন কিছু ইশারা করলো।
আমি উঠলাম। অজিত বললে, কোথায় যাবি? হানু বললে, বস না চুপ করে। আমি বললাম, পায়ে ঝিনঝিনিয়া ধরে গেছে।
অনেককাল আগের কথা বলছি তো, তখন ঝিনঝিনিয়া বলে একটা রোগের কথা শোনা যেতে।
ওদের উপেক্ষা করেই আমিও দরজার দিকেই চলে এলাম। ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় আস্তে করে বললাম, এই, শোনো।
বলে ওর বিপরীত দিকের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখানে দাঁড়ালে কেউ দেখতে পাবে না।
চুন্নী গলা বাড়িয়ে মাঠ দেখলো। তারপর আড়চোখে একবার ওদের দিকে তাকিয়ে নিয়েই হঠাৎ এগিয়ে এলো, হাসতে হাসতে চাপা গলায় বললে, কি হচ্ছে কি, ওরা বুঝতে পারবে।
বলেই ফিরে গিয়ে নিজের সীটটিতে বসলো। সুতরাং আমিও গিয়ে জানালার ধারটিতে আবার বসলাম।
আমার মুখ খুশিতে হাসছিলো বোধ হয়। চুন্নী ওর দু ঠোঁটের ওপর আড়াআড়ি করে তর্জনী রাখলো, সবাইকে লুকিয়ে। অর্থাৎ হাসতে বারণ করলো।
আমার নিজেকে ভীষণ সুখী লাগছিলো। সারা পথ।
তারপর ব্যাণ্ডেল স্টেশন এলো, ওরা হুড়মুড় করে নেমে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম। মালপত্র নিয়ে ওরা তখন খুব ব্যস্ত।
কুলির মাথায় মোটঘাট তুলে দিয়ে ওরা সাবওয়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলো, আমি তাকিয়ে রইলাম, আমার বুকের মধ্যে তখন তোলপাড় চলছে, চুন্নী নিশ্চয় এবার ফিরে তাকাবে, সাবওয়ের সিঁড়িতে পা দিয়ে অদৃশ্য হবার আগে একবার ফিরে তাকাবে।
আমাদের ট্রেন হুইসল দিয়ে চলতে শুরু করেছে তখন।
চুন্নী, একবার, একবার ফিরে তাকাও, শুধু একবার।
আশ্চর্য, ও একবারও ফিরে তাকালো না, নির্বিকার নীচে নেমে গেল। আর তারপর থেকে আমি প্রায়ই ফিরে তাকাই। সেই দিনটির দিকে।
0 মন্তব্যসমূহ