জীবনে অনেক জিনিস ঘটে, যাহার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না—তাহাকে আমরা অতিপ্রাকৃত বলিয়া অভিহিত করি। জানি না, হয়তো খুঁজিতে জানিলে তাহাদেরও সহজ ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কারণ বাহির করা যায়। মানুষের বিচার, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতালব্ধ কারণগুলি ছাড়া অন্য কারণ হয়তো তাহাদের থাকিতে পারে—ইহা লইয়া তর্ক উঠাইব না, শুধু এইটুকু বলিব, সেরূপ কারণ যদিও থাকে—আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দ্বারা তাহার আবিষ্কার হওয়া সম্ভব নয় বলিয়াই তাহাদিগকে অতিপ্রাকৃত বলা হয়।
আমার জীবনে একবার এইরূপ একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার যুক্তিযুক্ত কারণ তখন বা আজ কোনোদিনই খুঁজিয়া পাই নাই—পাঠকদের কাছে তাই সেটি বর্ণনা করিয়াই আমি খালাস; তাঁহারা যদি সে রহস্যের কোনো স্বাভাবিক সমাধান নির্দেশ করিতে পারেন, যথেষ্ট আনন্দ লাভ করিব।
ঘটনাটা এইবার বলি।
কয়েক বছর আগেকার কথা। মানভূম জেলার চেরো নামক গ্রামের মাইনর স্কুলে তখন মাস্টারি করি।
প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখি, চেরো গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য এমনতর যে এখানে কিছুদিন বসবাস করিলে বাংলা দেশের একঘেয়ে সমতলভূমির কোনো পল্লি আর চোখে ভালো লাগে না। একটি অনুচ্চ পাহাড়ের ঢালু সানুদেশ জুড়িয়া লম্বালম্বি ভাবে সারা গ্রামের বাড়িগুলি অবস্থিত—সর্বশেষ সারির বাড়িগুলির খিড়কি দরজা খুলিলেই দেখা যায় পাহাড়ের উপরকার শাল, মহুয়া, কুরীচ, বিল্ববৃক্ষের পাতলা জঙ্গল, একটা সুবৃহৎ বটগাছ ও তাহার তলায় বাঁধানো বেদি, ছোটো বড়ো শিলাখন্ড ও ভেলা কাঁটার ঝোপ।
আমি যখন প্রথম ও-গ্রামে গেলাম তখন একদিন পাহাড়ের মাথায় বেড়াইতে উঠিয়া এক জায়গায় শালবনের মধ্যে একটি পাথরের ভাঙা মন্দির দেখিতে পাইলাম।
সঙ্গে ছিল আমার দু-টি উপরের ক্লাসের ছাত্র—তাহারা মানভূমবাসী বাঙালি। একটা কথা—চেরো গ্রামের বেশির ভাগ অধিবাসী মাদ্রাজি, যদিও তাহারা বেশ বাংলা বলিতে পারে, অনেকে বাংলা আচার-ব্যবহারও অবলম্বন করিয়াছে। কী করিয়া মানভূম জেলার মাঝখানে এতগুলি মাদ্রাজি অধিবাসী আসিয়া বসবাস করিল, তাহার ইতিহাস আমি বলিতে পারি না।
মন্দিরটি কালো পাথরের এবং একটু অদ্ভুত গঠনের। অনেকটা যেন চাঁচড়া রাজবাড়ির দশমহাবিদ্যার মন্দিরের মতো ধরনটা—এ অঞ্চলে এরূপ গঠনের মন্দির আমার চোখে পড়ে নাই—তা ছাড়া মন্দিরটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত ও বিগ্রহশূন্য। দক্ষিণের দেওয়ালের পাথরের চাঁই কিয়দংশ ধ্বসিয়া পড়িয়াছে, দরজা নাই, শুধু আছে পাথরের চৌকাঠ। মন্দিরের মধ্যে ও চারিপাশে বনতুলসীর ঘন জঙ্গল—সান্ধ্য আকাশের পটভূমিতে সেই পাথরের বিগ্রহহীন ভাঙা মন্দির আমার মনে কেমন এক অনুভূতির সঞ্চার করিল। আশ্চর্যের বিষয়—অনুভূতিটা ভয়ের। ভাঙা মন্দির দেখিয়া মনে ভয় কেন হইল একথা তারপর বাড়ি ফিরিয়া অবাক হইয়া ভাবিয়াছি। তবুও অগ্রসর হইয়া যাইতেছিলাম মন্দিরটা ভালো করিয়া দেখিতে, একজন ছাত্র বাধা দিয়া বলিল, ‘যাবেন না স্যার ওদিকে...’
‘কেন?’
‘জায়গাটা ভালো না। সাপের ভয় আছে সন্ধ্যেবেলা। তা ছাড়া লোকে বলে অনেক রকম ভয়ভীত আছে—মানে অমঙ্গলের ভয়। কেউ ওদিকে যায় না।’
‘ওটা কী মন্দির?’
‘ওটা রঙ্কিণীদেবীর মন্দির, স্যার! কিন্তু আমাদের গাঁয়ের বুড়ো লোকেরাও কোনোদিন ওখানে পুজো হতে দেখে নি—মূর্তিও নেই বহুকাল। ওইরকম জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে আমাদের বাপ-ঠাকুরদার আমলেরও আগে থেকে!—চলুন স্যার নামি।’
ছেলে দুটা যেন একটু বেশি তাড়াতাড়ি করিতে লাগিল নামিবার জন্য।
রঙ্কিণীদেবী বা তাঁহার মন্দির সম্বন্ধে দু-একজন বৃদ্ধ লোককে ইহার পর প্রশ্নও করিয়াছিলাম—কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, লক্ষ্য করিয়াছি, তাহারা কথাটা এড়াইয়া যাইতে চায় যেন, আমার মনে হইয়াছে রঙ্কিণীদেবী সংক্রান্ত কথাবার্তা বলিতেও তাহারা ভয় পায়।
আমিও আর সে-বিষয়ে কাহাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করা ছাড়িয়া দিলাম।
বছর খানেক কাটিয়া গেল।
স্কুলে ছেলে কম, কাজকর্ম খূব হালকা, অবসর সময়ে এ-গ্রামে ও-গ্রামে বেড়াইয়া এ অঞ্চলের প্রাচীন পট, পুথি, ঘট ইত্যাদি সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। এ বাতিক আমার অনেকদিন হইতেই আছে। নূতন জায়গায় আসিয়া বাতিকটি বাড়িয়া গেল।
চেরো গ্রাম হইতে মাইল পাঁচ-ছয় দূরে জয়চন্ডী পাহাড়। এখানে খাড়া উঁচু একটা অদ্ভুত গঠনের পাহাড়ের মাথায় জয়চন্ডী ঠাকুরের মন্দির আছে। পৌষ মাসে বড়ো মেলা বসে। বি. এন. আর লাইনের একটা ছোটো স্টেশনও আছে এখানে।
এই পাহাড়ের ধারে একটি ক্ষুদ্র বস্তিতে কয়েক ঘর মানভূমপ্রবাসী উড়িয়া ব্রাহ্মণের বাস। ইহাদের মধ্যে চন্দ্রমোহন পান্ডা নামে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সঙ্গে আমার খুব আলাপ হইয়া গেল—তিনি বাঁকা বাঁকা মানভূমের বাংলায় আমার সঙ্গে অনেক রকমের গল্প করিতেন। পট, পুথি, ঘট সংগ্রহের অবকাশে আমি জয়চন্ডীতলা গ্রামে চন্দ্রমোহন পান্ডার নিকট বসিয়া তাঁহার মুখে এদেশের কথা শুনিতাম। চন্দ্র পান্ডা আবার স্থানীয় ডাকঘরের পোস্টমাস্টারও। এদেশে প্রচলিত কতরকম আজগুবি ধরনের সাপের, ভূতের, ডাকাতের ও বাঘের (বিশেষ করিয়া বাঘের—কারণ বাঘের উপদ্রব এখানে খুব বেশি) গল্প যে বৃদ্ধ চন্দ্র পান্ডার মুখে শুনিয়াছি এবং এইসব গল্প শুনিবার লোভে কত আষাঢ়ের ঘন বর্ষার দিনে বৃদ্ধ পোস্টমাস্টারের বাড়িতে গিয়া যে হানা দিয়াছি, তাহার হিসাব দিতে পারিব না।
মানভূমের এই সব আরণ্য অঞ্চল সভ্যজগতের কেন্দ্র হইতে দূরে অবস্থিত। এখানকার জীবনযাত্রাও একটু স্বতন্ত্র ধরনের। যতই অদ্ভুত ধরনের গল্প হউক, জয়চন্ডী পাহাড়ের ছায়ায় শালবনবেষ্টিত ক্ষুদ্র গ্রামে বসিয়া বৃদ্ধ চন্দ্র পান্ডার বাঁকা বাঁকা মানভূমের বাংলায় সেগুলি শুনিবার সময় মনে হইত—এদেশে এরূপ ঘটিবে ইহা আর বিচিত্র কী! কলিকাতা বালিগঞ্জের কথা তো ইহা নয়।
কথায় কথায় চন্দ্র পান্ডা একদিন বলিলেন, ‘চেরো পাহাড়ে রঙ্কিণীদেবীর মন্দির দেখেচেন?’ আমি একটু আশ্চর্য হইয়া বৃদ্ধের মুখের দিকে চাহিলাম।
রঙ্কিণীদেবী সম্বন্ধে এ পর্যন্ত আমি আর কোনো কথা কাহারও মুখে শুনি নাই, সেদিন সন্ধ্যায় আমার ছাত্রটির নিকট যাহা সামান্য কিছু শুনিয়াছিলাম, তাহা ছাড়া।
বলিলাম, ‘মন্দির দেখেচি, কিন্তু রঙ্কিণীদেবীর কথা জানবার জন্যে যাকেই জিজ্ঞেস করেচি সেই চুপ করে গিয়েচে কিংবা অন্য কথা পেড়েচে— এর কারণ কিছু বলবেন?’
চন্দ্র পান্ডা বলিলেন, ‘রঙ্কিণীদেবীর নামে সবাই ভয় খায়।’
‘কেন বলুন তো?’
‘মানভূম জেলায় আগে অসভ্য বুনো জাত বাস করত। তাদেরই দেবতা উনি। ইদানীং হিন্দুরা এসে যখন বাস করলে, উনি হিন্দুদেরও ঠাকুর হয়ে গেলেন। তখন তাদের মধ্যে কেউ মন্দির করে দিলে। কিন্তু রঙ্কিণীদেবী হিন্দু দেব-দেবীর মতো নয়, অসভ্য বন্য জাতির ঠাকুর—আগে ওই মন্দিরে নরবলি হত—ষাট বছর আগেও রঙ্কিণীদেবীর মন্দিরে নরবলি হয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করে রঙ্কিণীদেবী অসন্তুষ্ট হলে রক্ষা নেই—অপমৃত্যু আর অমঙ্গল আসবে তাহলে। এ-রকম অনেকবার হয়েচে নাকি। একটা প্রবাদ আছে এ অঞ্চলে, দেশে মড়ক হওয়ার আগে রঙ্কিণীদেবীর হাতের খাঁড়া রক্তমাখা দেখা যেত। আমি যখন প্রথমে এদেশে আসি, সে আজ চল্লিশ বছর আগের কথা— তখন প্রাচীন লোকদের মুখে একথা শুনেছিলাম।
‘রঙ্কিণীদেবীর বিগ্রহ দেখেছিলেন মন্দিরে?’
‘না, আমি এসে পর্যন্ত ওই ভাঙা মন্দিরই দেখচি। এখান থেকে কারা বিগ্রহটি নিয়ে যায়, অন্য কোন দেশে। রঙ্কিণীদেবীর এসব কথা আমি শুনতাম ওই মন্দিরের সেবাইত বংশের এক বৃদ্ধের মুখে। তাঁর বাড়ি ছিল ওই চেরো গ্রামেই। আমি প্রথম যখন এদেশে আসি—তখন তার বাড়ি অনেকবার গিয়েচি। দেবীর খাঁড়া রক্তমাখা হওয়ার কথাও তাঁর মুখে শুনি। এখন তাঁদের বংশে আর কেউ নেই। তার পর চেরো গ্রামেও আর বহুদিন যাই নি—বয়েস হয়েচে, বড়ো বেশি কোথাও বেরোই নে।’
‘বিগ্রহের মূর্তি কী?’
‘শুনেছিলাম কালীমূর্তি। আগে নাকি হাতে সত্যিকার নরমুন্ড থাকত অসভ্যদের আমলে। কত নরবলি হয়েচে তার লেখা-জোখা নেই—এখনও মন্দিরের পেছনে জঙ্গলের মধ্যে একটা ঢিবি আছে—খুঁড়লে নরমুন্ড পাওয়া যায়।’
সাধে এদেশের লোক ভয় পায়। শুনিয়া সন্ধ্যার পরে জয়চন্ডীতলা হইতে ফিরিবার পথে আমারই গা ছমছম করিতে লাগিল।
আরও বছর দুই সুখে-দুঃখে কাটিল। জায়গাটা আমার এত ভালো লাগিয়াছিল যে হয়তো সেখানে আরও অনেকদিন থাকিয়া যাইতাম—কিন্তু স্কুল লইয়াই বাঙালিদের সঙ্গে মাদ্রাজিদের বিবাদ বাধিল। মাদ্রাজিরা স্কুলের জন্যে বেশি টাকাকড়ি দিত, তাহারা দাবি করিতে লাগিল কমিটিতে তাহাদের লোক বেশি থাকিবে—ইংরাজির মাস্টার একজন মাদ্রাজি রাখিতেই হইবে, ইত্যাদি। আমি ইংরাজি পড়িতাম—মাঝে হইতে আমার চাকুরি রাখা দায় হইয়া উঠিল। এই সময়ে আমাদের দেশে একটি হাই স্কুল হইয়াছিল, পূর্বে একবার তাহারা আমাকে লইয়া যাইতে চাহিয়াছিল, ম্যালেরিয়ার ভয়ে যাইতে চাহি নাই— এখন বেগতিক বুঝিয়া দেশে চিঠি লিখিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব কারণে চেরো গ্রামের মাস্টারি আমায় ছাড়িতে হয় নাই। কীসের জন্য ছাড়িয়া দিলাম পরে সে-কথা বলিব।
এই সময় একদিন চন্দ্র পান্ডা চেরো গ্রামে কী কার্য উপলক্ষে আসিলেন। আমি তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম আমার বাসায় একটু চা খাইতে হইবে। তাঁহার গোরুর গাড়ি সমেত তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া বাসাবাড়িতে আনিলাম।
বৃদ্ধ ইতিপূর্বে কখনো আমার বাসায় আসেন নাই; বাড়িতে ঢুকিয়াই চারিদিকে চাহিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিলেন, ‘এই বাড়িতে থাকেন আপনি?’
বলিলাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ছোট্ট গাঁ, বাড়ি তো পাওয়া যায় না—আগে স্কুলের একটা ঘরে থাকতাম। বছর খানেক হল স্কুলের সেক্রেটারি রঘুনাথন এটা ঠিক করে দিয়েচেন।’
পুরোনো আমলের পাথরে গাঁথুনির বাড়ি। বেশ বড়ো বড়ো তিনটি কামরা, একদিকে একটু সরু যাতায়াতের বারান্দা। জবরদস্ত গড়ন, যেন খিলজিদের আমলের দুর্গ কী জেলখানা—হাজার ভূমিকম্পেও এ বাড়ির একটু চুন বালি খসাইতে পারিবে না। বৃদ্ধ বসিয়া আবার বাড়িটার চারদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। ভাবিলাম বাড়িটার গড়ন তাঁহার ভালো লাগিয়াছে, বলিলাম, ‘সেকালের গড়ন, খুব টনকো—আগাগোড়া পাথরের।’
চন্দ্র পান্ডা বলিলেন, ‘না, সেজন্যে নয়।’ আমি এই বাড়িতে প্রায় ত্রিশ বছর আগে যথেষ্ট যাতায়াত করতাম—এই বাড়িই হল রঙ্কিণীদেবীর সেবাইত বংশের। ওদের বংশে এখন আর কেউ নেই। আপনি যে এ বাড়িতে আছেন তা জানতাম না।...তা বেশ বেশ। অনেকদিন পরে বাড়িটাতে ঢুকলাম কিনা, আমার বড়ো অদ্ভুত লাগচে। তখন বয়েস ছিল ত্রিশ, আর এখন হল প্রায় ষাট।’ তারপর অন্যান্য কথা আসিয়া পড়িল। চা পান করিয়া বৃদ্ধ গাড়িতে গিয়া উঠিলেন।
আরও বছর খানেক কাটিয়াছে। দেশের স্কুলে চাকুরির আশ্বাস পাইলেও আমি এখনও যাই নাই, কারণ এখানকার বাঙালি-মাদ্রাজি সমস্যা একরূপ মিটিয়া আসিয়াছে, আপাতত আমার চাকুরিটা বজায় রহিল বলিয়াই তো মনে হয়।
চৈত্র মাসের শেষ।
পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূরবর্তী এক গ্রামে আমারই এক ছাত্রের বাড়িতে অন্নপূর্ণা পূজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম—মধ্যে রবিবার পড়াতে শনিবার গোরুর গাড়ি করিয়া রওনা হই, রবিবার ও সোমবার থাকিয়া মঙ্গলবার দুপুরের দিকে বাসায় আসিয়া পৌঁছিলাম।
বলা আবশ্যক বাসায় আমি একাই থাকি। স্কুলের চাকর রাখহরি আমার রাঁধে, এ কয়দিন স্কুলের ছুটি ছিল, রাখহরিকে আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম। বাহিরের দরজার তালা খুলিয়াই রাখহরি বলিয়া উঠিল, ‘এ বাবু, এ কীসের রক্ত! দেখুন...’
প্রায় চমকিয়া উঠিলাম।
তাই বটে। বাহিরের দরজায় চৌকাঠের ঠিক ভিতর দিক হইতেই রক্তের ধারা উঠোন বাহিয়া যেন চলিয়াছে। একটানা ধারা নয়, ফোঁটা ফোঁটা রক্তের একটা অবিচ্ছিন্ন সারি। একেবারে টাটকা রক্ত—এইমাত্র সদ্য যেন কাহারও মুন্ড কাটিয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছে।
আমি তো অবাক। কীসের রক্তের ধারা এ! কোথা হইতেই বা আসিল, আজ দু-দিন তো বাসা বন্ধ ছিল—বাড়ির ভিতরের উঠোনে রক্তের দাগ আসে কোথা হইতে—তাহার উপর সদ্য তাজা রক্ত!
অবশ্য কুকুর, বিড়াল ও ইঁদুরের কথা মনে পড়িল। এ ক্ষেত্রে পড়াই স্বাভাবিক। চাকরকে বলিলাম, ‘দেখতো রে, রক্তটা কোনদিকে যাচ্চে—এ সেই বড়ো হুলো বেড়ালটার কাজ...’
রক্তের ধারাটা গিয়াছে দেখা গেল সিঁড়ির নিচের চোরাকুঠুরির দিকে। ছোট্ট ঘর, ভীষণ অন্ধকার ঘর এবং যত রাজ্যের ভাঙাচোরা পুরোনো মালে ভরতি বলিয়া আমি কোনোদিন চোরকুঠুরি খুলি নাই। চোরকুঠুরির দরজা পার হইয়া বন্ধ ঘরের মধ্যে রক্তের ধারাটার গতি দেখিয়া ব্যাপার কিছু বুঝিতে পারিলাম না। কতকাল ধরিয়া ঘরটা বাহির হইতে তালা বন্ধ, যদি বিড়ালের ব্যাপারই হয়, বিড়াল ঢুকিতেও তো ছিদ্রপথ দরকার হয়।
চোরকুঠুরির তালা লোহার শিকের চাড় দিয়া খোলা হইল। আলো জ্বালিয়া দেখা গেল ঘরটায় পুরোনো ভাঙা, তোবড়ানো টিনের বাক্স, পুরোনো ছেঁড়া গদি, খাটের পায়া, মরিচাধরা সড়কি, ভাঙা টিন, শাবল প্রভৃতি ঠাসা বোঝাই। ঘরের মেঝেতে সোজা রক্তের দাগ এক কোণের দিকে গিয়াছে—রাখহরি খুঁজিতে খুঁজিতে হঠাৎ চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘এ কী বাবু! এতে কী করে এমনধারা রক্ত লাগল...’
তারপর সে কী একটা জিনিস হাতে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, ‘দেখুন কান্ডটা বাবু...’ জিনিসটাকে হাতে লইয়া সে বাহিরে আসিতে তাহার হাতের দিকে চাহিয়া আমি চমকিয়া উঠিলাম।
একখানা মরিচাধরা হাতলবিহীন ভাঙা খাঁড়া বা রাম-দা—আগার দিকটা চওড়া ও বাঁকানো—বড়ো চওড়া ফলাটা তাজা রক্তে টকটকে রাঙা! একটু আধটু রক্ত নয়, ফলাতে আগাগোড়া রক্ত মাখানো, মনে হয় যেন খাঁড়াখানা হইতে এখনি টপটপ করিয়া রক্ত ঝরিয়া পড়িবে।
সেই মুহূর্তে একসঙ্গে আমার অনেক কথা মনে হইল। দুই বৎসর পূর্বে চন্দ্র পান্ডার মুখে শোনা সেই গল্প। রঙ্কিণীদেবীর সেবাইত বংশের ভদ্রাসন বাড়ি এটা। পুরোনো জিনিসের গুদাম এই চোরকুঠুরিতে রঙ্কিণীদেবীর হাতের খাঁড়াখানা তাহারাই রাখিয়াছিল হয়তো।...মড়কের আগে বিগ্রহের খাঁড়া রক্তমাখা হওয়ার প্রবাদ।
আমার মাথা ঘুরিয়া উঠিল।
মড়ক কোথায় ভাবিতে পারিতাম যদি সময় পাইতাম সন্দেহ করিবার। কিন্তু তাহা পাই নাই। পরদিন সন্ধ্যার সময় চেরো গ্রামে প্রথম কলেরা রোগীর খবর পাওয়া গেল। তিন দিনের মধ্যে রোগ ছড়াইয়া মড়ক দেখা দিল—প্রথমে চেরো, তারপর পাশের গ্রাম কাজরা, ক্রমে জয়চন্ডীতলা পর্যন্ত মড়ক বিস্তৃত হইল। লোক মরিয়া ধুলধাবাড় হইতে লাগিল। চেরো গ্রামের মাদ্রাজি বংশ প্রায় কাবার হইবার জোগাড় হইল।
মড়কের জন্য স্কুল বন্ধ হইয়া গেল। আমি দেশে পলাইয়া আসিলাম; তারপর আর কখনো চেরোতে যাই নাই—গ্রীষ্মের বন্ধের পূর্বেই দেশের স্কুলের চাকুরিটা পাইয়াছিলাম।
সেই হইতে রঙ্কিণীদেবীকে মনে মনে ভক্তি করি। তিনি অমঙ্গলের পূর্বাভাস দিয়া সকলকে সতর্ক করিয়া দেন মাত্র। মূর্খ জনসাধারণ তাঁহাকেই অমঙ্গলের কারণ ভাবিয়া ভুল বোঝে।
3 মন্তব্যসমূহ
এই গল্পের পটভূমি নিয়ে কৌতূহল রয়েছে। প্রাক্তন মানভূম অধুনা পুরুলিয়া ও ধানবাদ জেলার অংশ। জয়চন্ডী পাহাড়, পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর ব্লক এর অন্তর্গত । জয়চন্ডী পাহাড় এ জয়চন্ডী মন্দির ও রয়েছে । ওখানে পৌষ মেলা হয় । এই গল্পের সুতো ধরে জয়চন্ডী পাহাড়ের পাঁচ-ছয় মাইল বা প্রায় ১০ কিলোমিটার এর মধ্যে চেরো পাহাড়ের পাদদেশে চেরো গ্রাম থাকার কথা। কেউ কি জানেন এরকম গ্রামের হদিস ?
উত্তরমুছুনহয়তো বেরো পাহাড়কে চেরো করেছেন। লেখক এমন বদল করেন লেখার সময়, করতে হয় কেন না স্থানীয় মানুষের মান-অভিমান থাকে হুবহু সত্য নিয়ে। সেই কাহিনি না লিখলে তাঁরা আহত হন। কিন্তু গল্প তো বাস্তবের সত্য থেকে বেরিয়ে অন্তরের সত্যে প্রবেশ করে। গল্পে কল্পনা থাকে প্রধান হয়ে।
উত্তরমুছুনবাহ । গল্পে বাস্তবের ছোঁয়া 😊
উত্তরমুছুন