ইঁদুরটা নির্মলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্মলা খাটের ওপর জড়োসড় হয়ে বসে। গলা বুক তার জ্বলে যাচ্ছে। সব কিছু চেপে শুয়ে পড়েছিল চুপ করে, তবু তাকে উঠে বসতে হল। এত জ্বলছে সব কিছু! না, অম্বল নয়।
নির্মলা একবার ভাবছিল—সে চিৎকার করবে। চিৎকার করে পাশের ঘরে শোয়া মোক্ষদা মাসিকে ডাকবে। পরক্ষণেই নির্মলা ভাবল, কেন ডাকবে সে? তার জন্যে, না ইঁদুরের জন্য? আর চিৎকার করে ডাকলে কি মোক্ষদা মাসি শুনতে পাবে? মাসির যা ঘুম কানে কি যাবে? তার বদলে হয়তো মা’ই উঠে পড়বে। আর মা যদি তাকে এই অবস্থায় দেখে এমন হইচই জুড়ে দেবে, ছিঃ ছি! মায়ের এই এক স্বভাব, কথায় কথায় সাত পাড়ার লোক ডাকে। তারপর দোতলা থেকে দুই দাদা দুই বউদি নেমে আসবে। তাদের সঙ্গে বিন্টু, মিন্টু, সোনা! ইস ওই পুঁচকেগুলোর সামনে। সোনা নিশ্চয়ই শুনেই খুব কাঁদবে। বিন্দু মিন্টু ভয় পেয়ে যাবে। হয়তো ভয় পাবে না। তবে মেজদা এগিয়ে এসে ইঁদুরটার লেজ ধরে ওপরে তুলবে। তার খাটের সামনে দাঁড়িয়ে নাড়াবে। বিন্দু মিন্টুর মুখের সামনে এনে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবে। এসব কাণ্ড ওরা আগে করত, এখন কি করবে? নির্মলা ইঁদুরটার দিকে তাকাল।
ইঁদুরটা ঘরের মেঝের ঠিক মাঝমধ্যিখানে বসে। মাঝে মাঝে সামনের পা দুটো তুলে মুখের কাছে নাড়ছে। ইঁদুরেরা সামনের পা দুটো মুখের কাছে বড় চটপট নাড়ে। কিন্তু এই ইঁদুরটা বড় স্লো। তবে কি বিষ কাজ করছে, ইঁদুরটা শ্লথ হয়ে এসেছে। এবার মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে মরে যাবে।
মরে যাওয়ার কথায় নির্মলার কান্না পেল। দু চোখ বড় করে সারা ঘরটা ভালো করে একবার দেখলে। বাইরের দিকের জানলাগুলো বন্ধ। না, একটা খোলা। ওদিকে বারান্দা আছে। ভেতর ঘরের দরজাটা বন্ধ! বন্ধ, না ভেজানো? অনেকদিনই মোক্ষদা মাসি তার আর মায়ের ঘরের মাঝের দরজাটা বন্ধ করে না। আজ কি করেছে?
ইঁদুরটা মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল ঝিম মেরে। নির্মলার মনে হল, যাঃ মরে গেল। ঠিক তখনই ইদুরটা আবার ঠেলে উঠে বসল। বিষ খেয়ে ইঁদুর এমনই করে? ইঁদুর উঠে বসলেও নির্মলা এবার শুয়ে পড়ল। বিছানার ওপর শুয়ে পড়ে বালিশে মুখ চেপে ধরল। মুখ চেপে ধরতে গলা বুকের জ্বালা অনেকটা কমল। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ থেকে নির্মলা উঠে বসল। | নির্মলাকে শুয়ে পড়তে দেখে ইঁদুরটা দৌঁড়ে গেল দরজার দিকে। দরজার সামনে এসে বুঝল সে ভুল দরজার দিকে ছুটে এসেছে। এটা ভেতরের ঘরের দরজা নয়। বাইরে যাওয়ার দরজা। ইঁদুরটা ফেরার চেষ্টা করল, পারল না। অনেকটা এসে সে আবার ঘরের মাঝমধ্যিখানে থমকে দাঁড়াল। তার দু চোখে অন্ধকার। একটু যদি জল পাওয়া যেত বড় ভালো হত। জল খেলে বিষ নেমে যায়।
নির্মলাও ভাবছিল, এখন একটু জল খেলে গলা বুক জ্বালা কমে যাবে। মোক্ষদা মাসি তার জন্যে এক গেলাস জল টেবিলে চাপা দিয়ে বলেছিল, জল তেষ্টা পেলে পুরো খেয়ো। আধ গেলাস আবার ফেলে রেখোনি। বিষ খাওয়া ইঁদুর জল খোঁজে। জল পেলে আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
নির্মলা জানে গেলাসের তলায় এখনও বেশ অনেকখানি জল আছে। এই জল যদি ইঁদুরকে দেয় ইঁদুরটা প্রাণ ফিরে পাবে। গেলাস উলটে নির্মলা জল দেবে না। এক ফোঁটাও না। এই ইঁদুরের জন্য মায়ের বড় কষ্ট। কাগজ কাপড় কাটা ছেড়ে দাও,ওরা ঠাকুরের সিংহাসনে বড় বেশি দাপাদাপি করে। ঠাকুরের পট উলটে ফেলে দেয়। ঘট গড়িয়ে দেয়।
ইঁদুরটা নির্মলাকে দেখল, কিন্তু সে মুখ ফুটে বলল না, তোমার জন্য তোমার মায়ের বড় কষ্ট। নির্মলা এটা জানে। তার জন্যে তার মায়ের কষ্টের সীমা নেই। তার জন্যে তার মা অনেক অপমান সহ্য করেছে। দাদা বউদিরা ওপরতলা থেকে মাকে নীচে নামিয়ে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, ওরা কিছুতেই নির্মলাকে ওপরে তুলবে না। নির্মলা যে মায়ের গয়না নিয়ে বাবলুর সঙ্গে চলে গিয়েছিল। কে জানত বাবলু বিয়ে করবে, সংসার করবে বলে নির্মলাকে এমন ঠকিয়ে দেবে। এক হাত নুলো মেয়েকে কোন ছেলে বিয়ে করবে। কিন্তু বাবলু বলেছিল, করবে। তার দুটো হাত আছে। নির্মলার একটা হাত কম থাকলে কোনও অসুবিধা হবে না। বাবলুর সঙ্গে সে আগে তিন দিন বেরিয়েছে। বাবলু তিন দিনই তার ডান দিকটা গার্ড করে ছিল। নির্মলার ডান হাত যে স্থির, পাথর, বাইরের কাকপক্ষীতে টের পায়নি। মিলেনিয়াম পার্কে বসে নির্মলা খুশিতে বলেই বসেছিল, “আজ আমার ডান দিকটা কেউ টেরই পেল না।' বাবলু বলেছিল, ‘ডান দিক বলছ কেন? বলো ডান হাত।’ নির্মলা বলেছিল, “ওই হল’। বাবলু বলেছিল, 'না, হল না’। কথা শেষ করেই বাবলু খপ করে নির্মলার ডান দিকের স্তন চেপে ধরেছিল, ‘বলেছিল ভালো লাগে? টের পাও?' নির্মলা লজ্জায় মাথা নামিয়ে দিয়েছিল। বাবলু বলেছিল, ‘ডান দিকের সবচেয়ে ভালো মালটাই সাড়া দিচ্ছে আর তুমি বলছ ডান দিক পাথর’!
তবে মোক্ষদা মাসি বার বার নির্মলাকে সাবধান করে দিয়েছিল। বাবলু এ পাড়ার অনেক কাজের মেয়ের সর্বনাশ করেছে—তুমি বাবলুকে বিশ্বাস কোরো না। নির্মলা সে কথা বাবলুকে বলেছিল। তবে মোক্ষদা মাসির নাম করেনি। বাবলু চুপটি করে সব কথা শুনেছিল। বলেছিল, দস্যু রত্নাকর যদি এত কেস করার পরে সাধু হতে পারে আমি কি একটা চান্স পেতে পারি না?’ নির্মলা ওকে চান্স দিয়েছিল। মায়ের গয়না নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে বাবলু ওকে নিয়ে হোটেল থেকেছিল পাক্কা পাঁচ দিন। তারপর সব গয়না নিয়ে, বিল বাকি রেখে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। বাবলু দস্যু! বাবলু দস্যু রত্নাকর নয়। হোটেলের মালিক ওকে দিল পুলিশে। পুলিশ ফেরত দিল বাড়িতে। ফেরত দেওয়ার আগে দুই পুলিস ওকে সারাদিন ধরে দেখল । আদর করল, সোহাগ করল। বলল, তোকে কোর্টে দেব না। তোকে বাড়ি ফিরিয়ে দেব। এও বলল, ‘তোর হাতটা ডিফেক্ট না হলে তোকে ভাগাভাগি করে রেখে দিতাম’। নির্মলা বলেছিল, ‘বাড়ি যাব! মার কাছে’। তবু ওরা যদি রেখে দিত নির্মলা থেকে যেত। নির্মলা জানে, তাকে নিয়ে মায়ের বড় কষ্ট।
অবশ্য মোক্ষদা আশ্বাস দিয়েছে ১৭ তারিখ যাক। তারপর আর চার দিন দেখবে। তারপর ও নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে ওয়াশ করিয়ে আনবে। একবার ওয়াশ করে দিলে মা-হওয়ার সব ভয় কেটে যাবে। মায়ের কষ্ট কমবে না।
ইদুরটা বলল, বড় কষ্ট হচ্ছে।
নির্মলা দেখল ইঁদুরটা থম মেরে বসে। আচ্ছা, বিষ খেয়ে ইঁদুর কি ছুটোছুটি করে না? নির্মলা তো ছোটবেলা থেকে তেমনই শুনেছে। তবে ইঁদুরটা ছুটোছুটি করছে না কেন? ওর তো ছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। মোক্ষদা মাসি তো তেমনই বলেছিল, টিভিতে নাকি বিজ্ঞাপন দেয় ‘খাবে ঘরে, মরবে বাইরে’। তবে ও বাইরে চলে যাক। ইঁদুরটা ওর সামনের দুটো পা তুলতে গিয়ে পারল না। মাথাটা নেমে এল। আর একটু হলে মুখটা মাটিতে ঠুকে যেত।
নির্মলা সাহস করে বলল, হুস, যা যা।
ইঁদুরটা বলল, না যাব না।
নির্মলা অবাক হয়ে তাকাল। চোখ ছোট করে, কান খাড়া করে ভাবল কথাটা কে বলল। তখনই ইঁদুরটা বলল, এই যে আমি বললাম।
গলাটা শুনে নির্মলার মনে হল বড় চেনা। এ গলা সে অনেক দিন রাতে শুনেছে।
ইঁদুরটা বলল, কি গলাটা চেনা চেনা লাগছে?
নির্মলা টোক গিলে বলল, হ্যাঁ।
ইঁদুরটা বলল, হ্যা শুনতেই পার। এক জায়গায় বসবাস করি, পরস্পরের গলার আওয়াজ তো চিনবই। এই তো সেদিন ভুল করে তোমার গায়ে উঠে পড়েছিলাম। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে নেমেও গেছি। তোমাকে সরিও বলেছি।
নির্মলা বলল, তাই না কি? আমি তো শুনিনি।
তোমরা শোনো না। তোমরা দেখ। আর যা শোন তা খুট খুট। তোমরা ভাব আমরা কাটছি। তোমাদের সব জিনিস কেটে ফেলছি।
নির্মলা বলল, কাটোই তো। বইগুলোর কি অবস্থা করেছ। ইদানীং জামা কাপড়ও রেহাই দিচ্ছ না। মোক্ষদা মাসি ঠিক করেছে বিষ দিয়ে।
ইঁদুরটা মুখ থুবড়ে শুয়ে পড়ল। বলল, বুঝতেই পেরেছি আজ আমি বিষ খেয়েছি।
নির্মলা বলল, মোক্ষদা মাসি বলেছে তোমাদের ঝাড়ে বংশে নিকেশ করবে। চার প্যাকেট বিষ এনেছে। তুমি এবার মরবে—যাও বাইরে গিয়ে মরো।
বাইরে যাব কেন—এটা তো আমরাও ঘর ।
না, তোমার ঘর নয়, তুমি অনুপ্রবেশকারী।
কী বলছ, আমি অনুপ্রবেশকারী হব কেন? এখানে আমার বাপ ঠাকুরদা জন্মেছে, বেঁচেছে, তোমাদের পোষা বেড়ালের থাবায় মরেছে, ইঁদুর কলে ঢুকেছে, বিষ খেয়েছে। তবু আমরা অনুপ্রবেশকারী।
নির্মলা বলল, আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। কথা ছিল তোমরা ঘরে বিষ খাবে বাইরে গিয়ে মরবে। যাও, বাইরে যাও।
ইঁদুর বলল, না, যাব না। কিছুতেই যাব না। এ আমারও ঘর। আমি বাইরে গেলে তুমিও বাইরে যাবে। কেন না, এ বাড়ির লোকজন তোমাকে পছন্দ করে না। সবাই চায় তুমি মরে যাও। আমাদের অপছন্দ হলে বিষ দিতে পারে, তোমাকে পারে না। এই যা তফাত।
নির্মলা বলল, আমি ওদের ধার ধারি না। আমি নিজেই মরে যাব। তোমাদের চার প্যাকেট বিষের তিন প্যাকেট আমিই খেয়ে ফেলেছি।
আঁ, বলো কী! ইঁদুরটা হতবাক হয়ে সামনের দুটো পা মুখের কাছে ঘষল। বলল, বাবলুবাবুকে বিশ্বাস করে তুমি এক নম্বর ভুল করেছিলে, এখন দু'নম্বর ভুল করছ। গোটা এক প্যাকেট বিষ খেয়ে আমিই মরছি না। টলমল করছি। মরো মরো হয়েও মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছি। আর তুমি কি না এত বড় মানুষ তিন প্যাকেট বিষ খেয়ে মরে যাবে? আরে সে দিনকাল কি আছে? বিষে এখন পাওয়ার কম! একটু জল ম্যানেজ করতে পারলে আমিই বেঁচে যেতাম। তোমার কিচ্ছুটি হবে না। ব্যথা উঠলে, জ্বলন হলে চেল্লাবে। ওরা তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। পেট ওয়াশ করে দেবে। তোমাকে আবার বাড়ি ফিরতে হবে। সবাই চাইবে তুমি মরে যাও তবু তুমি ফিরে আসবে।
তোমার মায়ের আবার কষ্ট বাড়বে। উঃ তোমারও কী কষ্ট! যেখানে কেউ তোমায় ভালোবাসে না সেখানেই তোমাকে থাকতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে। যত দিন না মরে যাও ততদিন।
নির্মলা বলল, আমি মরব না ?
মরবে না। শুধু লোক হাসাবে। যাও, পেট ঠেসে জল খেয়ে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করো। জল খাও আর বমি করো। লোক হাসিও না।
ইঁদুরটা কথা শেষ করতে পারল না। মাটিতে মাথা নামিয়ে রাখল। ওর চোখে এখন অন্ধকার। অন্ধকারে আরও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বিছানা থেকে ঠেলে উঠল নির্মলা। ও আমি বেঁচে থাকব, আর তুমি মরে যাবে—তা হবে না। নির্মলা গেলাসের তলানি জল ইঁদুরের গায়ে ধীরে ধীরে ঢেলে দিল।
ঘরের ভেতর লাইন দিয়ে এগিয়ে আসা পিঁপড়েরা থমকে দাঁড়াল। তাদের পায়ের তলার মাটি এখন জল আর বমির আওয়াজে দুলছে। কেন না নির্মলা এখন গেলাস গেলাস জল খাচ্ছে আর গলায় আঙুল দিয়ে বমি করছে। জল খাচ্ছে আর বমি করছে।
5 মন্তব্যসমূহ
খুব নাড়িয়ে দিল।
উত্তরমুছুনআলোড়িত
উত্তরমুছুনস্পিচলেস করে দিলেন
উত্তরমুছুনখুব চমৎকার গল্প । অনবদ্য লিখনরীতি । ভাবালো ।
উত্তরমুছুনচমৎকার!
উত্তরমুছুনদীপেন ভট্টাচার্য