নিবেদিতা আইচ'র গল্প : ঘুমতীর বুকে কিছু কান্না ছিল

ঘুমতীর বুকে কিছু কান্না ছিল

লছমনকে আমি হিংসা করতাম। লছমনের খলখল হাসি, কাকভোরে দরাজ গলায় অসমীয়া গান শুনে ভেতরে ভেতরে জ্বলুনি হতো খুব। অথচ সেই লছমনের এমন কিছু হয়ে গেছে জানতে পেরেও আমি খুশি হতে পারছি না। খবরটা পেয়ে প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। এখন যতই সময় গড়াচ্ছে ততই দুশ্চিন্তা লাগছে।

“মনতলা সেবাশ্রম” এ গিয়ে লছমন বর্মণের সাথে আমার পরিচয় হয়। ‘ঘুমতী’ নদীর ধার ঘেঁষে কটকবাজারের মোড়ে সেবাশ্রমের ভাঙাচোরা ভবন। এখানে পুরো এক বছর নিয়মিত যাতায়াত ছিলো আমার। 

নদীটা শহরের বুক চিরে একটা নাগিনীর মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে। সবাই যাকে গোমতী নামে চেনে তাকে লছমনরা ‘ঘুমতী’ বলে ডাকতো। আমারও নামটা বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। সেবাশ্রমের বাইরে বসে অলস দুপুরে ঘুমতীর ঢেউ দেখতে দেখতে গুনগুন করতো লছমন। আমি ওর পাশে চুপচাপ বসে থাকতাম। 

“মেঘে গির গির করে
আহা হির হির মেঘে করে”

গানের এই দুটো লাইন শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। পুরোটা ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও গানের সাথে একটা বিষাদ ধীর পায়ে হেঁটে এসে আমাদের পাশে বসে থাকতো চুপচাপ,এমনটা বেশ টের পেতাম। পরে জেনেছি এটা ভূপেন বাবুর গান।

এখানকার সমাজকল্যাণ অফিসে সাঁটলিপিকার হিসেবে দেড় বছর ধরে চাকরি করছি আমি। প্রথম যখন এই শহরে আসি তার আগে থেকেই আমার সমস্যার শুরু। রাতে একেবারে ঘুমোতাম না। মনে হতো ঘুমোলেই যদি আর না জাগি? মৃত্যুভয় আমাকে একটু একটু করে মেরেই ফেলছিলো তবু পুরোপুরি মরতে চাইতাম না আমি। 

তাছাড়া ঘুম মানেই যে সেই পুরনো দুঃস্বপ্নটার ফিরে আসা। চারপাশে ঘুরঘুর করে, ওৎ পেতে থাকে স্বপ্নটা। ঘুমোলেই আমার বুকের উপর চেপে বসবে। তারপর ধীরে ধীরে পাঁজরের ভেতর হাত রেখে হৃপিন্ড বরাবর একটা নিদারুণ আঘাত হানবে আর আমি যেন বিগতজন্মের এক বীভৎস স্মৃতি ফিরে পেয়ে অসহনীয় যাতনায় কাতর হবো। তাই পারতপক্ষে ঘুমোই না আমি। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝিতে রাতগুলো পার করি। 

এই অফিসে যোগদান করার পর কয়েকটা দিন কিন্তু ভালোই কাটলো। সারাদিন শর্টহ্যান্ডের কাজ করার পর মাথার ভেতর একটা ভোঁতা যন্ত্রণা নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যেতো। ভীষণ ক্লান্তিতে কয়েক রাত একটু ঘুমোতে পারলাম। সকালে ধড়মড় করে জেগে উঠে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগতো, বেঁচে আছি কি নেই এই সন্দেহের দোলাচলে দুলতাম আমি। 

এরকম সময়ে একদিন বিষ্ণুপ্রিয়া বর্মণের কাছে সেবাশ্রমের খোঁজ পাই। বিষ্ণু, লছমনের স্ত্রী আমার অফিসে অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করতো। স্বভাবে ছিলো পুরোপুরি লছমনের বিপরীত মেরুর,বয়সের তুলনায় গম্ভীর, রাশভারী। মেয়েটা একদিন নিজ থেকেই উদ্যোগী হয়ে আমাকে কটকবাজারে নিয়ে যেতে চাইলো। আত্মীয়পরিজন ছাড়া একা একা এত দূরে থাকি, ভাবলাম যাই একটু বেড়িয়ে আসি। প্রথমদিন বেশ লাগলো। কেমন ছিমছাম মাটির ঘরগুলোতে থাকছে লোকজন। শুরুতে ভেবেছিলাম ওটা তথাকথিত আশ্রম। কিন্তু কয়েকবার ঘুরে এসে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। আশ্রমে অন্যান্য আশ্রিতের সাথে দুয়েকজন বদ্ধ উন্মাদ লোককেও দেখেছি। সেখানে নাকি তাদের চিকিৎসা চলছে। 

এসব দেখেশুনে ভীষণ বিরক্ত হয়েছি। বিষ্ণুপ্রিয়াকে দু’কথা শোনাতে ছাড়িনি। হ্যাঁ, আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম তাই বলে মেয়েটা আমাকে পাগল ভেবে নিলো! কয়দিনের পরিচয় আমাদের? কথাগুলো বিষ্ণু চুপচাপ শুনলো। শত হোক অফিসে আমি ওর চেয়ে উপরের পদে আছি তাই হয়তো উচ্চবাচ্য করলো না। আমিও এরপর আর এ প্রসঙ্গ তুলিনি। নিজের মতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। 

অফিস শেষে বাড়ি ফিরে কিছুই করার থাকতো না। ছুটির দিনগুলি ছিলো সবচেয়ে আতঙ্কের। ঘরের দেয়ালগুলো যেন এক পা এক পা করে কাছে এসে গা ছুঁয়ে দাঁড়াতো আর আমায় পিষে ফেলার সুযোগ খুঁজতো। পালিয়ে বাঁচতে খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে পড়তাম। একদিন ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম ঘুমতীর তীরে। অনেকক্ষণ বসে থেকে যখন ঝিমোতে শুরু করেছি তখন পাশে এসে বসলো লছমন। বসেই আমার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলো। 

‘বাবু কোন পারা আহিছো? নয়ি লাগিছে..’

ওর কথায় একটা অন্যরকম সুর টের পেয়ে চমকে তাকিয়েছিলাম। ছোট ছোট চোখ, থ্যাবড়ানো নাক আর মাথার কোঁকড়ানো চুল দেখে কৌতুহল হয়েছিলো।

নিজের নামধাম বলে পরিচয় দিতে লাগলো লছমন। সীমান্তের ওপারে সাতচান্দ এলাকায় তাদের পূর্বপুরুষের নিবাস ছিলো। এরপর এপারে এসে কীভাবে বসবাস শুরু হলো সেসবের বৃত্তান্ত দিচ্ছিলো সে৷ কিছু বুঝলাম,কিছু অস্পষ্ট থেকে গেলো। একসময় সে চুপ হয়ে গেলে আমিও আর আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চাইলাম না। তবে শামুকের মতো সময়টা কেমন অন্যরকম হয়ে গেলো! এরপর থেকে অফিস শেষে প্রায় প্রতিদিনই ওখানে চলে যেতাম। ঘুমতীর তীরে আমার বিকেলগুলো খুব একটা মন্দ কাটতো না। 

কয়েকদিন যেতেই জানতে পারলাম লছমন আমাদের অফিসের বিষ্ণুপ্রিয়ার বর্মণেরই বর। প্রথমদিকে একটু অবাক হয়েছিলাম। বিষ্ণুকে দেখে আসলে বোঝার উপায় নেই, সে চমৎকার বাংলায় কথা বলে। চালচলন বাঙালি মেয়েদের মতোই। তার চেহারাও বেশ ধারালো, ঠিক লছমনদের মতো নয়। আর অফিসের কাজেও বেশ করিৎকর্মা। 

এই মনতলা সেবাশ্রমে কিছুদিন হলো লছমনকে আনা হয়েছে। এখানে ওর চিকিৎসা চলছে। রোগের কথা জানতে চাইলে ফিক করে হেসে ফেলতো লছমন।

‘তেও লোক কয় মোর মাথাত বেমার আছে!’

আমি অবাক চোখে ওকে দেখতাম। বিষ্ণুকে বেশ ভালবাসতো লোকটা। প্রায়ই ওদের সংসারের গল্প শোনাতো। লছমনের মুখে শুনেছি বিষ্ণুপ্রিয়া খুব সংসারী মেয়ে, একহাতে সব দেখেশুনে রাখে। লছমনের মাথার দোষ থাকলেও যত্নআত্তিতে কোনো ত্রুটি রাখে না। এসব বলতে বলতে মাঝেমাঝে লছমন খুব খেপে উঠতো। কেন শুধু সেই সব বলবে? নিজের ব্যাপারে আমার এত

নীরবতা কেন- এই নিয়ে ওর আক্ষেপ হতো। নানা রকম প্রশ্ন করতো আমাকে, যেগুলো দিনের পর দিন এড়ানো কঠিন হয়ে উঠছিলো। 

‘মোক এক কথা আজি ক তই! কোনফালে ঘর তাম বাবু? কিয়ো আহিছো এইফালে?’

খপ করে আমার হাত ধরে ফেলে লছমন। ততদিনে আমি ওর ভাষাটা মোটামুটি বুঝতে শিখে গেছি। সত্যি বলতে আমারও মাঝেমাঝে সব উগড়ে দিতে ইচ্ছে হতো। ভেবে দেখলাম আসলে লছমনকে সব বলা যায়৷ মাথার দোষ থাকে যাদের তারা কি সুস্থ লোকের মতো কূটকচাল হয়? না, লছমন এসব দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে নিরাপদ। 

‘আজি ক মোক...তই অকলে কিয়ো? তাম পত্নী, ছল কোনফালে? ‘

এতদিনের পরিচয়ে আমাদের মধ্যে একটা সখ্যতা হয়ে গিয়েছে। লছমন আমার গায়ে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে ওর কৌতুহলের তীব্রতা জানান দেয়। 

‘আমার বৌ-ছল কেউ আর নাই রে ভাই লছমন! সব শেষ হয়ে গেছে...আগুন সব খেয়ে নিয়েছে।’ 

‘ হা ভাগবান! কিমান বাবু?'

লছমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আমি ভেতরের জলোচ্ছ্বাসটাকে প্রাণপণে আটকে রাখার চেষ্টা করি। লাভ হয় না, এতদিন পর আগল সরে যাওয়ায় সমস্তটা তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়৷ সেদিন আরেকবার বছর খানেক আগের দুর্যোগের রাতটা চোখে ভেসে উঠলো৷ যেন একটা অগ্নিকুন্ডের পাশে বসে লছমনকে গল্পটা শোনাচ্ছিলাম। 

পূজোর ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম সবাই। প্রতিদিনই প্রতিমা দেখতে বের হতাম। নবমীতে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো আমাদের। এদিকে পরদিন সকালেই সিঁদুর খেলা। ভোরে উঠে বাড়ির সকল আয়স্তী মহিলাদের কত কাজ! লতা দ্রুত বাইরের

কাপড় ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে বিছানায় ঘুমোতে গেলো। কিন্তু মুনিয়া কিছুতেই ঘুমোচ্ছিলো না। ওকে কোলে নিয়ে দোল দিলাম কিছুক্ষণ, তারপর ঘুমোলো। লতাও আর জেগে রইলো না।

পুবের দিকে দুটো ঘর লাগোয়া। বাইরের ঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকে। উঠোনের উল্টোদিকে আরেক ঘরে আমার মা আর বিধবা বোন ঘুমোয়। গ্রামের রাত দ্রুত নিরালা হয়ে যাওয়ার দিনকাল আর নেই। তবু ভোরে উঠতে হবে বলে সবাই শুয়ে পড়েছে। ভালো করে দরজা লাগিয়ে আমিও ঘুমোতে গেলাম। খুব কাছেই কোথাও ঘন ঘন বাজি ফোটানোর শব্দ হচ্ছিলো। এইসব গোলমালের মধ্যেও ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে এলো আমার। 

তখন জানতাম না এই ঘুম আমার জীবনের শেষ শান্তির ঘুম হবে। সেদিন ঘন্টাখানেক পর আমার ঘুম ভেঙে যায়, চমকে জেগে প্রথমে মনে হয় যেন কোন দুঃস্বপ্ন। চারপাশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে ভীষণ বিভ্রান্তি লাগে। উত্তাপে শরীরের চামড়া পুড়ে যাচ্ছিলো আমার। ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে চারপাশে আমার স্ত্রী আর বাচ্চা মেয়েটাকে খুঁজছিলাম। কিন্তু চোখ মেলে তাকানোর উপায় ছিলো না, খড়ের ছাউনি দেয়া ঘরটা নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো। বাইরে থেকে কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দিলে আমি নিজেকে বাঁচাতে সেই হাত ধরে ফেললাম। পেছনে তখন লতার আর্তনাদ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে আর আমাদের মুনিয়ার কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। 

পরদিন শুধু মা দুর্গা নয়, আরো দুটো প্রতিমার বিসর্জন হলো। নিজের স্বার্থপর কুৎসিত চেহারাটা দিনদিন অসহনীয় লাগছিলো। ওদেরকে পুড়ে মরতে দিয়ে কী করে পালিয়ে এলাম আমি? ফিরে গিয়ে কেন ঝাঁপ দিলাম না ? হয়তো বাঁচাতে পারতাম না, তবু একসাথে মরা তো যেতো। এখন এই অনুতাপে জ্বলে আরো বেশি করে মরছি। আমি বহুবার সত্যি সত্যি মরতে চেয়েছি, কিন্তু পারি নি। নিয়তি আমাকে এত সহজে মুক্তি দেবে না বুঝতে পেরেছিলাম। 

আমার গল্পটা শুনে লছমনের মনে কত প্রশ্ন এলো! অনেক কিছু জানতে চাইলো সে, আমি বাষ্পরুদ্ধ গলায় সবটা বলে উঠতে পারলাম না। বাজির আগুন খড়ের ঘরকে এভাবে জ্বালিয়ে দিতে পারে আমি নিজেই এটা মানতে পারিনি বহুদিন। কিন্তু যা সর্বনাশ হবার তা তো হয়েই গেলো। লছমন সব শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। 

‘মই বুজি না পাও বাবু...এনে দুখ লুকা রাখিছু তই!’ 

সত্যিই তো! এক অতলান্তিক কষ্ট বুকে বয়ে চলেছি। তবু সেদিন থেকে আমি যেন আগের চেয়ে হালকা হলাম। এই কথাগুলো বলতে পেরে ভালো লাগছিলো। সব ছেড়ে এই দূরের শহরে এসে এক ভিনদেশী লোকের কাছে যেন আমার একটু ঠাঁই হলো। ঘুমতীর বুকে কুলুকুলু স্রোত বয়ে চলে অবিশ্রান্ত, সেই স্রোতের সাথে সেদিন আমার কিছু বিষাদ মিশে গেলো। 

‘ বাবু, ঘুমতী নৈ এর বুকত নিমখ আছো, জানিছো? 

লছমন মাঝে মাঝেই বলতো কথাটা। আমি শুনে অবাক হতাম। কারণটা জানতে চাইলে গা কাঁপিয়ে হাসতো লোকটা। ওর এই অদ্ভুতুড়ে হাসি দেখে প্রতিবারই শিউরে উঠতাম আমি। 

‘চকুর জল মিশি আছো, তই জলটে মুখোত দি চাওক!’ 

নদীর জল মুখে দিয়ে দেখতে বলতে লছমন। আমি এড়িয়ে যেতাম ওর এসব উদ্ভট কথা। সে কেমন গোয়াড়ের মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলেই যেতো- ’চকুর জল মিশি আছো, নৈ এর বুকত নিমখ আছো..’

ইদানিং মাথাটা খুব বিগড়ে গিয়েছে ওর। বেঁধে না রাখলে যেন সামাল দেয়া যাবে না। বিষ্ণুপ্রিয়া খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। আমি বহুবার ওকে ভালো কোথাও নিয়ে চিকিৎসা করাতে বলেছি । মেয়েটা কথাটা কানেই নেয় নি। এটা নাকি লছমনদের পারিবারিক রোগ, বংশানুক্রমে চলছে। তবু বোঝালাম, বললাম বড় হাসপাতালে একবার অন্তত দেখিয়ে আনতে। বিষ্ণু শোনেনি, ওরা আসলে এসবে বিশ্বাসই রাখে না। তাই আগের মতোই আশ্রমে পড়ে রইলো লছমন। 

চোখের দৃষ্টি দেখে আমার মনে হতো লছমন বোধ হয় এবার সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। নইলে কথায় কথায় কারো চোখ দুটো এমন ধপ করে জ্বলে উঠে আবার সাথে সাথে নিভে যায়? কিংবা সারা বিকেল নিজের পূর্বপুরুষের গল্প করতে কর‍তে সন্ধ্যে নামার আগে ‘সব ভুলে গেছি’ বলে কেউ? আমি ওকে মনে করিয়ে দিতে একটু আগের শোনা কথাগুলোই ওকে বারবার বলে যাই। কিন্তু ঘন ঘন মাথা নাড়ে লোকটা। 

‘মই পাউরি গেছু.. মোক ক্ষেমা করিবু...আহু বাবু...আহু’ 

দু'হাতে কপালে প্রণাম ঠুকে গটগট করে আশ্রমে ঢুকে যেতো লছমন। দূর থেকে ওকে দেখে আমার হিংসে হতো। ভাবতাম কবে ওর মতো সব ভুলে যেতে পারবো। এরকম দিনগুলিতে আরো বেশি বিষাদ বুকে নিয়ে ঘরে ফিরতাম আমি। 

দু'দিন আগে ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে। খ্যাপাটের মতো ঢিল ছুঁড়ছিলো নদীর জল বরাবর। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তেড়ে এলো আমার দিকে। এর আগে এরকম কখনো করেনি। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মুখের রেখা দেখে ফিক করে হেসে ফেললো লছমন। আবোলতাবোল গুনগুন করলো কিছুক্ষণ। আমি সুযোগ বুঝে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। আবার তেড়ে এলো, এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলো আমাকে। 

‘ বহবি না..যা, তই ইয়াতে চলি যা…তই জলের মাঝত নিমখ দিবুক ’

শেষ কথাটা শুনে খুব চমকে গেলাম। লছমন সত্যিই বিশ্বাস করে ঘুমতীর বুকে নোনা জল আছে? হয়তো আমার মতো মানুষের জমাট কান্নাগুলো এখানে এসে ঝরে যায়, তাই নদীর জল দিনকে দিন নোনা হয়ে যাচ্ছে। এসব ভেবে ভেবে মাথা গুলিয়ে যায় আমার। জোরে জোরে পা ফেলে ঘরে ফিরে যাই আমি। 

আমি জানি একটু পরেই ওর এই রাগটা থাকবে না। সব ভুলে শিশুর মতো হেসে কুটি কুটি হবে। কালকেই দেখা হলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবে আমাকে। লছমনের এই স্বভাবটা দেখলেই আমার দারুণ হিংসা হতে থাকে। এভাবে ভুলে যাওয়া এত সহজ? তবে আমি কেন পারি না? ওই লছমন যদি পারে তবে আমি কেন পারি না! অক্ষম আক্ষেপে জ্বলতে থাকি আমি। মনে মনে ওকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবি। ওকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করি তবু আমার মনে এতটুকু স্বস্তি আসে না। 

সেই লছমন, আমার বন্ধু লছমন বর্মণ যতই পাগলাটে হোক, সে যে এমন কিছু করে ফেলবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। অফিস ছুটির ঠিক আগে খবর পেলাম আমাদের লছমন কোথায় যেন চলে গেছে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ ওকে নদীর কাছে দেখেছে ভোরবেলা। কিন্তু এরপর আর চোখে পড়েনি। খবরটা পেয়ে আমি খুব খুশি হতে পারতাম। যাকে এত হিংসে করি সে আর হুট করে সামনে এসে দাঁড়াবে না-এই সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে নির্ভার হতে পারতাম আমি। কিন্তু কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। হয়তো ওকে আমি ভালোবাসতে শুরু করেছি, একটা মায়ার গ্রন্থিতে বাঁধা পড়ে গেছি আমরা। 

আশ্রমের কেউ লছমনের খোঁজ জানে না। বিকেলে অফিস শেষে বিষ্ণুপ্রিয়া সেখানে গিয়ে ওকে দেখতে পায়নি। তারপরই সবাই ব্যাপারটা টের পেয়েছে। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হচ্ছে ওকে। আশেপাশের কয়েক মাইল এলাকায় কেউ ওকে দেখেনি। তাহলে কোথায় গেলো লোকটা? বাতাসে মিলিয়ে গেলো? 

আমার মনে হলো লছমন হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছে। নইলে আর যাই হোক এতক্ষণে ঘুমতীর তীরে ফিরে আসতো ঠিকই। ইদানিং অনেক কিছুই সে আর মনে রাখতে পারছে না। নিশ্চিত পথ ভুলে দূরে কোথাও চলে গিয়েছে। কতদূর যেতে পারে? আচ্ছা কোনো অঘটন ঘটে নি তো? নানান আশংকায় আমার দুশ্চিন্তাটা বেড়ে চলে। 

অফিস থেকে কোনোভাবে বেরিয়ে এসে কটকবাজারে পৌঁছে ভ্যান থেকে নেমে পড়লাম। তারপর সোজা নদীর দিকে এগোলাম। যতই এগোই ততই একটা অদ্ভুত ভাবনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে থাকি আমি। হয়তো আর কোথাও না, ঘুমতীর স্রোতের সাথেই লছমন কোথাও বয়ে চলে গেছে। নদীর জলের আস্বাদ নেবার ইচ্ছেটা আমার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

8 মন্তব্যসমূহ

  1. নদী বিষয়ক যে কোনো লেখাই খুব প্রিয় আমার, নদীর লেখার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে। চমৎকার এই গল্পটি পড়ে গেছি একটানে। অসমীয়া ভাষার ব্যবহারও ভালো লেগেছে। এই গল্পকারের কাছ থেকে আরও সুন্দর সব গল্প পাবো আশা করি।

    উত্তরমুছুন
  2. দারুণ ঝরঝরে বয়ানে এক অনবদ্য গল্প। নাম, কাহিনী আর গল্প বুননের চমৎকার সমন্বয় এই লেখাটা। গল্পকারের কাছ থেকে এমন আরও গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এত সুন্দর মন্তব্য! আন্তরিক ধন্যবাদ। লেখালেখির চেষ্টা চালিয়ে যাবো।

      মুছুন
    2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

      মুছুন
  3. ভাল লাগল। অসমীয়া ভাষা কোথা থেকে শিখলে?��

    উত্তরমুছুন
  4. প্রস্তুতি হিসেবে অনেক পড়তে হয়েছে তার আগে।

    উত্তরমুছুন