মজিদ সাহেব লেখার কথা বলে রাত জাগেন, কিন্তু লিখেন না কিছু। মাঝে মাঝে কিছু বই পড়েন। বেশির ভাগ সময় ল্যাপটপ আর ফোনে টেপাটিপিতে থাকেন। এখানে কী কী করেন, আমরা জানিনা, তবে অনুমান- তাঁর কিছু ভক্ত আছে যারা তাঁর কোন লেখা পড়ে কি লিখলো সেসব তিনি পড়েন। এসব ভক্তদের মধ্যে কিছু তরুনীও আছেন, তাদের কথাকে বিশেষ গুরুত্ব তিনি দিয়েও থাকেন।
তাঁর লেখার বিষয় প্রত্নতত্ত্ব। ইদানিং তিনি প্রথম মানব নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন, সবই ইন্টারনেট ঘেটে। গুহামানব আগে না এডাম আগে, এটা নিয়ে লেখা। সেখান থেকে কোট করে তিনি কিছু স্ট্যাটাসও দিয়েছেন । অসংখ্য শেয়ার হয়েছে স্ট্যাটাসের। কমেন্টের পর কমেন্টে ভরে যাচ্ছে তাঁর ফেসবুক ওয়াল। দুইজন ফেসবুক ফ্রেন্ড তাঁর একটা কথা নিয়ে কমেন্ট বক্সে ক্রমাগত বিতর্ক করে যাচ্ছে। মজিদ সাহেবের খুব মজা।
ঘরে তাঁর বিদ্যান স্ত্রী। বিকেল বেলা অফিস থেকে ফিরে রান্না-বাড়া-খাওয়া-দাওয়া শেষে করে টিভির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকেন, যতক্ষণ না স্টার জলসায় চেঁচামেচি শেষ হয়। এই অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য লেখক পাশের ঘরে বই-খাতা-ল্যাপটপ নিয়ে বসেন। লেখকের স্মার্টফোনে হাত চলে ভালো। তিনি বসে বসে ল্যাপটপে আঙুল চালানোর জন্য সেলফোন নিয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি শুনেন, আর ফোনে গুঁতাগুঁতি করেন। বিষয়টি লেখকপত্নির একেবারে অপছন্দের। কিন্তু লেখকের কপাল বারাক ওবামার চেয়ে ভালো, মিশেলের মতো তাঁর স্ত্রী এখনো এসে তাঁর ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়নি।
একদিন রাত সাড়ে বারোটায় লেখক তাঁর ফোন টেপার ঘরের জানালার পাশে বসে আছেন। বাইরে ঝির ঝিরে শব্দ। বৃষ্টি হচ্ছে বোধ হয়। জানালার কাঁচ সরিয়ে তিনি নিশ্চিত হলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো, ছোটবেলার এক ঝড়ের রাতের কাহিনী লিখবেন। রাতে ঝড় এলে তাঁর দাদা আজান দিতেন আর তাকে চৌকির তলায় ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ঝড় না থামা পর্যন্ত চৌকি থেকে বেরোনো যেতো না।
তিনি ল্যাপটপ বন্ধ করলেন, ফোন সরিয়ে রাখলেন। লেখার খাতা বের করে দেখেন অনেক ধুলো জমে আছে।
মজিদ সাহেব প্রকৌশলী। কিন্তু তিনি লিখেন শুধু ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্বের বই। একটা আত্মজৈবনিক উপন্যাস লেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। গল্প উপন্যাস পড়েন তিনি, মাঝে মাঝে, কিন্তু এসব লিখে সময় নষ্ট করা তাঁর সাজে না। বয়স ষাটের কাছাকাছি। আর ক’দিনইবা আছেন। নানা জায়গায় পড়ে যা শিখেছেন সেগুলো তিনি লিখে যেতে চান। তাঁর নিজের জীবনের অসংখ্য কাহিনী আছে, সেগুলোও গল্প-উপন্যাসের মতো। সুতরাং বানানো কিছুতে তাঁর আগ্রহ নাই। তিনি বলেন- ওসব চাপাবাজি, খালি মিথ্যাকে সত্যের মত করে বলা। আজ রাতে তাঁর খেয়াল হলো সব বাদ দিয়ে কিছু লিখবেনই।
লেখার জন্য তাঁর খাতা আলাদা, কলম আলাদা। তিনি বাজারে পাওয়া সবচেয়ে দামী খাতা কিনে আনেন। কখনো তাঁর সাপ্লাইয়াররা তাঁকে এসব নোট বুক, ডায়েরি উপহার দেয়। সেখানে তিনি লেখেন। লেখার জন্য তাঁর বিশেষ কলম আছে। কালির কলম। কালির কলমে রেগুলার না লিখলে নিভে কালি জমে যায়। তিনি কলম পরীক্ষা করে দেখলেন- কলমে কালি আসছে না, নিশ্চয়ই কালি জমে গেছে।
কলম নিয়ে যাওয়া হলো বেসিনে। নিজ হাতে নিভ খুলে ধুতে গিয়ে দেখেন- কালির টিউব সাদা হয়ে আছে, কালি নাই।
কলম নিয়ে এতো আয়োজন হচ্ছে দেখে আর তাঁর স্ত্রী খুব খুশী। আজ রাতে হয়তো লেখা হবে তার। লিখলেই ভালো। না হলে রাতে না জানি কার সঙ্গে ফেসবুকে চ্যাট করতে বসে যাবে। ইদানিং কতো রকমের কথা শোনা যায়। কত মেয়ে এসব লেখকদের ফেসবুক চ্যাট কপি করে রাখে। লেখকরা রাতের ঘোরে কত কথাই না বলে। এসব নিয়ে স্ত্রীর অনেক চিন্তা। তিনি তার বিছানায় বসে ছোট পুত্রকে ডাকেন- বাবার কলম ঠিক করে দাও। কালি ভরে দাও।
ছেলে গেলো কালি ভরতে। গিয়ে দেখে- যে সিরিঞ্জ দিয়ে বাবা কালি ভরতো তার উপরে লাগানো সুঁই নাই, কোথাও খুলে পড়ে গেছে। সে সুঁই ছাড়া সিরিঞ্জ দিয়ে কলমের টিউবের ভেতর কালি ভরতে গিয়ে তার নিজের হাত আর টেবিল কালিমাক্ত করলো। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো, তিনি খুব বিরক্ত। বাবাকে খুশী করার জন্য বলল, চিন্তা করো না, আমি এক্ষুণি তোমাকে সিরিঞ্জ এনে দিচ্ছি। তুমি লিখতে বসতে পারবা।
- সিরিঞ্জ পাবি কই ?
- দোকানে।
- কোন দোকান?
- এই যে, ফার্মেসি। সারা রাত খোলা থাকে। আমি যাবো।
- একা যাবি? সমস্যা নাই। দারোয়ানকে নিয়ে যাব সঙ্গে। পাচ মিনিট লাগবে, তুমি থাকো। টাকা দাও।
- কত?
- দাও, পাচ-দশ টাকা হবে।
রাতের বেলা ষোড়শবর্ষীয় পুত্র বেরিয়ে যায় সিরিঞ্জ কিনতে। পেছন পেছেন পিতা। পিতা খালি গায়ে, পিঠের উপর পাঞ্জাবী রাখা, লুঙ্গি পরা। ছেলে বাবার দিকে তাকায় –
- আমি যাবো না তোমার সংগে
- কেন?
- তুমি খালি গা কেন?
- এই দেখ, পাঞ্জাবি পরছি।
- তোমার তো লুঙ্গি পরা
- লুঙ্গিতে সমস্যা নাই। এখন রাত একটা, কে দেখবে?
- তুমি নীচে বসো, আমি যাই।
মজিদ সাহেব এপার্টমেন্টের দারোয়ানের টুলে বসে পড়েন। দারোয়ানের কাছ থেকে একটা ছাতা নিয়ে পুত্র চলে যায়। তিন বিল্ডিং পরে একটা ফার্মেসি আছে বটে, কিন্তু এটা এখনই বন্ধ হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুই সাটারের ফার্মেসি। এক সাটার বন্ধ, আরেকটা অর্ধেক নামানো। এ অবস্থায় এক কিশোরকে দেখে দোকানি হতবাক। আবার সে এসেছে সিরিঞ্জ নিতে। এসব সিরিঞ্জ দিয়ে কিশোরেরা নানা রকমের ড্রাগ নেয়।
দোকানি বলে- এ সিরিঞ্জ কিসের জন্য নেবে?
কিশোর বলে- কলমে কালি ভরার জন্য। আমার বাবা লেখকতো, তিনি কালির কলম ছাড়া লেখেন না।
দোকানী হেসে ফেলে ।
লেখকপুত্র সিরিঞ্জ নিয়ে আসে পিতার কাছে। এতো গভীর রাতে সিরিঞ্জ কেনার কাহিনী বলতে বলতে সে নিজ হাতে কলমের টিউবে কালি ভরে টিসু পেপার দিয়ে মুছে বাবার হাতে কলম দিয়ে বলে- এখন লেখো।
মজিদ সাহেব কলমটি তার লেখার খাতার পাশে রাখেন। কাগজ, কলম, হাতের লেখা, সবকিছু মিলে কী সুন্দর একটা জিনিস হয়েছে !
তিনি পাশ থেকে সেলফোনটা তুলে এনে তার একটা ছবি তুলেন। এবার এই ছবিটা তিনি ফেসবুকে দিয়ে দেন, সংগে একটা ছোট স্ট্যাটাস- এখন আমার আর লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে না ।
তার কালি ভর্তি কলম পড়ে থাকে সেভাবেই। তিনি ফেসবুকে নোটিফিকেশনে নজর দেন। অনেকগুলো কমেন্ট পড়ে গেছে । শেষ কমেন্ট লিখেছে – রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কথা – ভাইরে, ফেসবুক সামনে থাকলে আমারো লেখা আসে না।
1 মন্তব্যসমূহ
'ভাইরে ফেসবুক সামনে থাকলে অামারো লেখা অাসেনা '...
উত্তরমুছুন