সে শুতে না গেলে মা লম্ফ নেভাবে না। কিন্তু শ্যামলীর চোখে আজ ঘুম নেই। তবু সে মশারি তুলে বিছানার মাঝখানে শুয়ে পড়ে। একপাশে মা শোয়। অন্যপাশে বাবা। শ্যামলী বাবার গায়ের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে দু’হাতে বাবার গলা জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।
আজ সারাদিন শ্যামলীর আনন্দের শেষ নেই। কাল সাহেবের বড়দিন। পাড়াতো ভাইবোনেরা মিলে ঠিক করেছে কাল দুপুরে বাড়িতে কেউ খাবে না। প্রত্যেকের বাড়ি থেকে চাল, ডাল, তেল, নুন, হাঁড়ি-কড়াই নিয়ে গিয়ে মাঠে উনুন খুঁড়ে রান্না করে খাবে। কী রান্না হবে তাও সবাই মিলে ঠিক করে রেখেছে। মাঠ থেকে মদরঙ্গা শাক তুলে ভাজা হবে। পুকুর থেকে ছোট ছোট বোষ্টুমী মাছ আর গেড়িয়া চিংড়ি ধরে চচ্চড়ি।
সবাই মিলে রান্নাবান্না করবে। কেউ যাবে খেজুরগাছ থেকে শুকনো পাতা, ডাল ভেঙে আনতে, কেউ যাবে কলাপাতা কেটে আনতে। আবার কেউ যাবে পুকুর থেকে জল তুলতে। উঃ, আর ভাবতে পারছে না সে। কী যে আনন্দ হবে।
এক জ্ঞাতিবোন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সাহেব মানে সেই যাদের গায়ের রং সাদা সাদা?’
এক ভাই বলেছিল, ‘হ্যাঁ, যারা খুব ফর্সা আর বড়লোক।’
‘সাহেবের বড়দিন মানে কী রে?’
অন্য আর এক ভাই বলেছিল, ‘বড়দিন মানে ইস্কুল ছুটি, পড়াশোনা নেই, সারাদিন খেলা।’
এরা তো দেখা যাচ্ছে পুরোটা জানে না। শ্যামলী তাদের বুঝিয়ে বলেছে। কলকাতা থেকে জেনে এসেছে সে। নকল গাছ কিনে তাতে আলো দিয়ে সাজানো হয়। ঘরও সাজায় কেউ কেউ। রঙিন ফিতে আর ঝালর ঝোলায়। রাস্তাঘাট আলোয় ঝলমল করে। বাচ্চা-বুড়ো সবাই সুন্দর সেজেগুজে ঘুরতে যায়। পিকনিক করে, কেক খায়।
তবে শ্যামলী ঠিক পুরোটা কাউকে বলেনি। ওরা কেউ একটা কথা জানে না। কাল সকালে যখন দেখাবে, ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখবে সবাই। তাদের চমকে দেবে শ্যামলী।
চোখ খুলে যায় তার। ঘর অন্ধকার। মা-বাবা দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছে। শ্যামলী চুপি চুপি মশারি তুলে বাইরে এল। জামার ভেতর থেকে মোজাটা বের করে দড়ি দিয়ে বেঁধে মশারির কোনায় ঝুলিয়ে দিচ্ছিল সে।
কলকাতা থেকে বাড়ি ফেরার দিন অন্য জিনিসের সঙ্গে এই মোজাটাও লুকিয়ে ব্যাগে পুরে নিয়েছিল শ্যামলী। যে বাড়িতে সে কাজ করে সে বাড়ির দেবলীনাদিই তো তার মাকে বলে শ্যামলীকে মোজা কিনে দিয়েছিল। না হলে শ্যামলী জীবনে কখনও মোজা পরেছে নাকি! ভাগ্যিস দিয়েছিল। মোজায় কী মজা! শ্যামলী কলকাতায় গিয়েছিল, তাই তো জানতে পেরেছে। তার গ্রামের লোকেরা এসব কিছুই জানে না। কী বোকা!
তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে। নয় তো সাদা চুলওয়ালা বুড়োটা আসবে না। কাল সকালে মা-বাবার আগে উঠে মোজাটা খুলতে হবে। শ্যামলী টুক করে মশারিটা তুলে আবার শুয়ে পড়ে।
শুয়ে শুয়ে তার দেবলীনাদির কথা মনে পড়ছিল। সেও এখন নিশ্চয়ই মোজা বাঁধছে, কি বেঁধে ফেলেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কত জিনিস পাওয়া যাবে। ভাগিস্য মা তাকে পাড়ার সুতপাকাকির সঙ্গে কলকাতায় পাঠিয়েছিল।
শ্যামলী যখন তার গ্রাম তেঁতুলতলা থেকে বাসে করে কলকাতায় যাচ্ছিল তখন তার ভাল লাগছিল না। বাস যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। রাস্তা আর শেষ হয় না। কাকির দুই মেয়ে সুজাতা আর মলি অবশ্য তার কাছে গল্প করছিল। শ্যামলী কলকাতায় গিয়ে কত কী দেখতে পাবে। বড় বড় পাকা বাড়ি। কত লোকজন। প্রত্যেকের বাড়িতে টিভি আছে। দেখা যায়। পাখা আছে। গরমের সময় হাওয়া খাওয়া যায়।
বাস থেকে হাওড়ায় নেমে অবাক হয়ে গেছিল শ্যামলী। কত গাড়ি, কত মানুষ। সবাই দৌড়চ্ছে। সুজাতা আর মলি অবাক হচ্ছিল না। অনেকদিন হয়ে গেছে তারা কলকাতায় কাজ করে। শ্যামলী মুখ হাঁ করে সবকিছু দেখছিল আর তাদের বলছিল, ‘এই মলি, দ্যাখ দ্যাখ, কত গাড়ি, কত লোক। কী সুন্দর জামাকাপড় পরেছে সব দ্যাখ!’
শ্যামলীকে ধমকে বলেছিল, ‘চুপ কর, তোর মুখ বন্ধ কর। লোকে তোকে দেখে হাসবে আর ভাববে, এই গাঁইয়া মেয়েটা কোত্থেকে এসেছে রে!’
শ্যামলীর আরও অবাক লেগেছিল হাওড়ার পোল দেখে। ক্যালন্ডারের ছবিতে, পাড়ার কোনও পুজোয় ভিডিও শোয়ে দেখেছে। এখন চোখের সামনে দেখছে। মাথা ওপর দিকে করে, ঘাড় বাঁকিয়ে হাঁ হয়ে গেছে সে। বাসে চড়ে ওই পোলের ওপর দিয়ে গঙ্গা পার হয়েছিল।
চোখের সামনে একটার পর একটা জিনিস আসছে আর চলে যাচ্ছে। তাদের গ্রামে পাকাবাড়ি আছে কয়েকটা। তবে বেশিটাই তো মাটির। এখানে সেরকম একটাও দেখা যাচ্ছে না। সব দালানকোঠা। একটা বিরাট বাড়ির গায়ে আবার কাচ লাগানো। তাতে অন্য বাড়ির ছবি ভেসে রয়েছে। আকাশ ভেসে রয়েছে। কয়েকটা মেঘও। শ্যামলী মনে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আগেরটা মনে রাখার চেষ্টা করতে করতে পরেরটা এসে যাচ্ছে। কিছুই আর মনে রাখতে পারছে না। সবই ভুলে যাচ্ছে।
কোন একটা জায়গায় বাস থেকে নামতে হল। সেখান থেকেই সুজাতা আর মলি যার যার কাজের বাড়ি চলে গেল। শ্যামলী গেছিল সুতপাকাকির সঙ্গে, কাকির কাজের বাড়ি। কাকি যে বাড়িতে কাজ করে সে বাড়িতে এক বুড়ো ছাড়া আর কেউ নেই। বুড়ো দুটো ঘর, একটা রান্নাঘর, একটা বাথরুম নিয়ে থাকে। তার বউ মারা গেছে। একটাই ছেলে, বিদেশে চাকরি করে। শ্যামলী তো অবাক। তার কাছে তো কলকাতাই বিদেশ। তার বাইরে আরও আছে নাকি! কাকি বুড়োকে বলে একরাতের জন্য শ্যামলীর থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। পরের দিন শ্যামলীর কাজ ঠিক করে তাকে সেখানেই রেখে আসবে।
সকালে কাকি চা করে বুড়োকে এক কাপ দিল। তারপর নিজে নিয়ে শ্যামলীকেও দিল এক কাপ। চা বলে কী জিনিস তা গ্রামে থাকতে খায়নি শ্যামলী। সিনেমা, ভিডিওয় দেখেছে কাপে চা নিয়ে প্লেটে বসিয়ে দিতে। সেই চা আজ কাকি তাকে দিয়েছে খেতে!
গ্রামে গরমকালে তার মা ছোলা ভেজানো জল দিয়েছে তাকে। মিছরি ভেজানো জলে ভুষি মিশিয়ে শ্যামলীকে, তার বাবাকে খাইয়েছে মা। কিন্তু এখানে লোকেরা সকালে চা খায়। শ্যামলী যা কিছু ভাল খাচ্ছে, ভাল কিছু দেখছে, সব মাথায় গেঁথে নিচ্ছে। দেশে ফিরে বাবা-মাকে গল্প করে শোনাবে।
সুতপা বুড়োর রান্নাবান্না করে, ঘরের সব কাজকর্ম সেরে শ্যামলীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ খুঁজতে বেরোয়। কয়েকটা চেনা বাড়ি ঘোরার পর এক বাড়িতে বলল, ‘আরে আমার মেয়ের বাড়িতে তো এরকম একটা ছোট মেয়ে খুঁজছে। আমার মেয়ের আড়াই বছরের ছেলে আছে। মেয়ে-জামাই অফিস করে, শাশুড়ি একা সারাদিন বাচ্চাটাকে সামলাতে পারে না। এরকম একটা মেয়ে হলে সারাদিন থাকবে, বাচ্চাটাকে দেখাশোনা করতে পারবে। নাম কী ওর?’
‘শ্যামলী। আমার পাড়াতো ভাশুরের মেয়ে। দেশে ওদের জায়গাজমি বলতে ঘরটুকু। বাপটারও পেটে কী অসুখ আছে। কাজকর্ম কিছু করতে পারে না। অন্যের জমিতে চাষের কাজ করে যা পায়। যে ক’দিন সুস্থ থাকে, কাজ করে, শরীর খারাপ হলে ঘরে বসে যায়। মা মেয়েমানুষ, একা কী করবে। তাও তো এর তার গোরু নিয়ে গোঠ করে মাঠে নিয়ে চরায়। যা গোবর পায়, ঘুঁটে বানিয়ে বিক্রি করে। এর বাপটাকেও তো খেয়াল রাখতে হয়। তাই ওকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে। খেয়েপরে বেঁচে থাকুক। আমার দুই মেয়েও তো কাজ করে। আমাদের ঘরে আর কী হবে!’
‘বয়স কত?’
‘আট-নয় হবে।’
‘বাড়ি কোথায়?’
‘মেদিনীপুরে, তেঁতুলতলা গ্রামে।’
‘তোমরা দাঁড়াও। আমার মেয়ে তো এখন অফিসে বেরিয়ে গেছে। বেয়ানকে ফোন করে দেখি। যদি রাজি হয়, ও আজ থেকে কাজে লেগে যাবে।’
মহিলা অন্য ঘরে ফোন করতে চলে যান। শ্যামলী ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছিল। ঘরের মধ্যে কত জিনিস। মাথার ওপর পাখা। নীচে চেয়ার-টেবিল, টেবিলের ওপর কতরকমের ফল রাখা। ঘরে একপাশের দেওয়ালে কাচের আলমারি, তাকে তাকে সুন্দর কত কিছু সাজানো।
শ্যামলী দেখল সামনে মোটা মোটা বেঁটে সুন্দর দেখতে কী রাখা রয়েছে। সে জিজ্ঞেস করে, ‘কাকি, ওইগুলো কী গো?’
‘ওগুলোকে বলে সোফা। খুব নরম। বসলে খুব আরাম লাগে। তুই বসতে যাস না যেন। বকবে। আমাদের ওখানে বসতে নেই।’
শ্যামলী বুঝতে পারল না, বসলে যদি আরাম লাগে তাহলে কেন তাদের বসতে নেই। তার মনে হল, গিয়ে একবার বসে দেখি। কিন্তু পাশের ঘর থেকে মহিলা ফিরে এলেন।
‘তোমরা বিকেলে সাতটার পর এসো। তখন সবাই বাড়িতে থাকবে। সবার সঙ্গে কথা বলে ওকে রাখবে। আমার এখানেই এসো। আমি নিয়ে যাব।’
ফেরার সময় শ্যামলী আস্তে আস্তে কত কথা যে বলছিল। ‘কাকি, এখানে কত উঁচু উঁচু সব বাড়ি। সরু সরু রাস্তা। গাছপালা নেই। মাথার ওপর আকাশ দেখা যাচ্ছে না। আমাদের গ্রাম কত ভাল বলো!’
সুতপা শুধু একবার ‘হুঁ’ বলে চুপ করে যায়।
শ্যামলী তাতেও থামে না। আবার শুরু করে। ‘আমাদের গ্রামে গাছপালা, রাস্তাঘাট, রাস্তার পাশে পুকুর, খেলার মাঠ। মাটির একতলা-দোতলা বাড়ি— ’
‘তোর মুখটাকে কিছুক্ষণ আরাম দিবি?’
শ্যামলী চুপ করে যায়। বুঝতে পারে কাকি তার বকবকানি শুনে রাগ করছে।
সাড়ে সাতটার সময় সুতপা শ্যামলীকে নিয়ে গেল সেই মহিলার বাড়ি। তিনি আবার রিকশা করে নিয়ে গেলেন তার মেয়ের বাড়ি। তার বেয়ান শ্যামলীকে দেখে বললেন, ‘এ তো একেবারে ছোট মেয়ে। বাড়ির কোনও কাজই করতে পারবে না।’
সুতপাকে আবার সেই একই প্রশ্ন। ‘কত বয়স মেয়েটির?’
‘আট-নয় হবে।’
এবার শ্যামলীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর নাম কী রে?’
‘শ্যামলী।’
‘আমার নাতিকে সামলাতে পারবি?’
শ্যামলী মাথা কাত করে হ্যাঁ জানায়।
‘আমার বউমা অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর নাতিকে দেখাশোনা করবে আর টুকটাক ফাইফরমাশ খাটবে। ও পারবে তো?’
সুতপা বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ও পারবে।’
‘তাহলে রেখে যাও।’
সুতপা সেইদিনই শ্যামলীকে রেখে চলে আসে। পরে একবার এসে তার জামার ব্যাগটা দিয়ে গিয়েছিল। শ্যামলী কাজে লেগে যায়। মহিলা নিজেকে দিদা ডাকতে বলে। ছেলে-বউমাকে দাদা-বউদি।
প্রথম প্রথম কথা কম বলত শ্যামলী । সে বাংলা কথা বলতে পারে না। তাদের গ্রামের ভাষা আলাদা। তাই সে দুটো কথা বলত। এক হ্যাঁ। আর এক না। এদের অবশ্য কথায় কোনও দরকার নেই। কাজ হলেই হল।
শ্যামলী সারাদিন দিদার ফাইফরমাশ খাটে আর বাচ্চাটা কাঁদলে তাকে কোলে নিয়ে এ ঘর ও ঘর ঘোরায়। দাদা-বউদি সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরলে তাদের মুখের সামনে জলের গেলাস, চায়ের কাপ, জলখাবার এগিয়ে দেওয়া— সবই তাকে করতে হয়। কাজে একটু ভুল হলেই দিদা তাকে বকা দেয়। তখন কষ্ট হয় শ্যামলীর। দেশের কথা, মা-বাবার কথা মনে পড়ে। ওখানে থাকতে রোজ বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যেত। কতরকমের যে খেলা। বুড়ি বুড়ি তোর ক’টা বাচ্চা, বাঁশ কাটে কে বুড়া ভেলকি, কচি কচি পেয়ারা। এখানে তো দিদা ঘরের বাইরেই বেরোতে দেয় না। এখানকার লোকেরা এসব খেলার নামও জানে না। শুনলে হাসতে পারে। হাসলেই হল? খেলার জায়গা নেই তার আবার হাসি। চারদিকেই তো ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি। তার ফাঁক দিয়ে হাসিও গলে না।
বাড়িটাতে থাকতে ভাল লাগছিল না শ্যামলীর। তাকে খেতে দিয়ে দিদা বলে, ‘রান্নাঘরে গিয়ে খেয়ে নে।’ সেখানে কেউ নেই। একা একা ভাতের থালার দিকে মাথা নিচু করে খেতে হয় শ্যামলীকে। থাকার জন্য একটা ঘর আছে। যত রাজ্যের ভাঙাচোরা নোংরা জিনিস রাখা। সেইসঙ্গে প্রচুর টিকটিকি আর আরশোলা। রাতে শুয়ে ভয় করে শ্যামলীর। আরশোলাগুলো ঘুরে ঘুরে মাটিতে পাতা বিছানার পাশে চলে আসে। গোদা টিকটিকিগুলো ডাকে আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে দেওয়াল জুড়ে দৌড়ে বেড়ায়। লাতুস লাতুস করে মাটিতে পড়ে। গ্রামে তো মাটিতেই বিছানা করে শোওয়া কিন্তু সেখানে এমন উৎপাত ছিল না।
একদিন বিকেলে সুতপা দেখা করতে আসে। ‘কী রে, ঠিক করে কাজ করছিস তো? ভাল লাগছে তো তোর?’
দিদা বলেছিল, ‘তোমার মেয়েটা খুব ভাল, শান্ত। যা বলি তাই করে।’
শ্যামলী কাকিকে চুপি চুপি বলে, ‘কাকি, আমি এখানে থাকব না। আমাকে নিয়ে চলো। দিদা আমাকে একটুও বসতে দেয় না, খেলতে দেয় না। সারাক্ষণ বলতে থাকে এটা নিয়ে আয়, ওটা রেখে আয়, আলমারি মুছে পরিষ্কার কর। তুমি আমাকে আজই নিয়ে চলো।’
‘এক্ষুনি তোকে কোথায় নিয়ে যাব? সবে তো কয়েক মাস হল ঢুকেছিস। ঠিক আছে, দু-চারদিন থাক। অন্য বাড়িতে কাজ ঠিক করে নিয়ে যাব।’
কয়েকদিন পর অন্য এক বাড়িতে কাজ ঠিক করে দেয় সুতপা। তাদের চালের ব্যবসা। এখানেও শ্যামলীকে ফাইফরমাশ খাটতে হয়, ঘর ঝাঁট দিয়ে দিতে হয়, রান্নার সবজি কেটে দিতে হয়। কিন্তু তারপর দেবলীনাদির সঙ্গে লুডো খেলে, টিভি দেখতে পারে। শ্যামলী তাকে শুধু দিদি বলে ডাকে। তার চেয়ে মাত্র একবছরের বড়। তাকে বেশ ভাল লাগে তার। শ্যামলীকে ভালবাসে। তার মা-বাবাও ভাল। মেয়ের জন্য খাবার আনলে শ্যামলীর জন্যও আসে। জামা কিনলে শ্যামলীও পায়। দেবলীনা তো মাঝে মাঝেই স্কুল থেকে ফেরার সময় শ্যামলীর জন্যে ক্যাডবেরি নিয়ে আসে। এ জিনিস আগে কখনও মুখে ওঠেনি তার।
এখানে এসে কত কিছু খেতে পায় শ্যামলী। তার মা-বাবা তো এসব চোখেও দেখেনি কোনওদিন। খাবে কী! দেশে থাকতে মা কোনওদিন লোকের বাড়ির বাগান থেকে মারিশ শাক চেয়ে এনে ভাজা করে দিত। সে শাক ভাতে মাখলে গোটা ভাত লাল। মাঠ থেকে ঘোড়াগিমে শাক তুলে এনেও কোনও কোনওদিন ভাজা করত মা। ভাতের পাতে তাই খেয়ে কত সুখ।
বড়দিন আসার দশ-পনেরোদিন আগে থেকেই দেবলীনা লাফালাফি শুরু করেছিল। এর আগের বছরগুলোয় সে একা আনন্দ করেছে, সঙ্গী ছিল না কেউ। এ বছর শ্যামলীকে পেয়ে আনন্দ বেড়ে গেছে তার। কী করবে না করবে শ্যামলীর কাছে সব বলেছে। ঘর সাজাবে, গাছ কিনে এনে আলো লাগাবে, কেক কিনবে।
শ্যামলী ভাবছিল, তাদের গ্রামে তো এসব কিছুই হয় না। রংবেরঙের আলোও নেই, নকল গাছও পাওয়া যায় না। গাছ কী করে যে নকল হয় তাও বুঝতে পারে না শ্যামলী। সে তো কত আসল গাছে উঠে বসে থেকেছে। কুলগাছ থেকে কুল, চালতাগাছ থেকে চালতা, নারকেলগাছ থেকে নারকেল অবধি পেড়ে খেয়েছে। আর বড়দিন বলতে বড় বড় ছেলেমেয়েরা বলে, ফিস্টি করব, ফিস্টি। তারা চাঁদা তুলে ডিমের ঝোল ভাত রান্না করে খায়। ছোটরা হাতে পয়সা পায় না। বাড়ির চাল, নুন তেল সব নিয়ে মাঠে চলে যায়। শীতের মাঠ ফেটে হাঁ হয়ে আছে অনেক জায়গায়। বেখেয়ালে পা গলে গেলে মচকে যাবে। সেসব বাঁচিয়ে ভাল জায়গা বেছে সেখানে বসে কাঠকুটো জ্বালিয়ে রান্না করে খেয়েই তারা খুশি।
দিদিই তাকে বলেছিল মোজা বাঁধার কথা। বড়দিনের আগের রাতে মশারির দড়িতে মোজা বাঁধছিল। ঘরটা কী সুন্দর করে সাজিয়েছিল। ছোট ঝিকমিকি সবুজ রঙের গাছ। তার এখানে ওখানে ছোট ছোট বল, তারা, ঘণ্টা বাঁধা। গাছটার ওপর নানা রঙের আলো লাগিয়েছিল।
শ্যামলীকে দেবলীনা বলেছিল, ‘তোর মোজা নিয়ে আয়। আমার মোজার পাশে বেঁধে দেব।’
‘মোজা!’ আবার শ্যামলীর মুখ হাঁ। ‘আমার তো মোজা নেই।’
‘নেই! তুই তো স্কুলে যেতিস, জুতো-মোজা পরতিস না?’
মাথা নাড়ে শ্যামলী। ‘খালি পায়ে যেতাম তো। পিঠে ব্যাগ নিয়ে। মোজা কোথায় পাব?’
‘বাবা বলে এখন তো জুতো-মোজা সব স্কুলে দিচ্ছে।’
‘তার আগেই আমার পড়া বন্ধ।’
‘খালি পায়ে যেতিস, ধুলো নোংরা লাগত না?’
‘লাগত তো। কতবার ছুটতে গিয়ে পায়ের নখ উপড়ে গেছে।’
‘ইস, তুই কী রে!’
শ্যামলী জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন দিদি মোজা বাঁধছ?’
‘আমরা ঘুমিয়ে পড়ার পর সান্তাক্লজ এসে গিফ্ট দিয়ে যাবে।’
‘সে কে দিদি?’
‘ও, তোর মোজাই নেই, তুই কী করে জানবি। সান্তাক্লজ একজন বুড়ো। মাথায় লম্বা লম্বা সাদা চুল, মুখেও সাদা দাঁড়ি-গোঁফ ভরা। মাথায় লাল টুপি। গায়ে লাল জামা। অনেক দূরে থাকে। যারা ভাল মেয়ে, দুষ্টুমি করে না, তারা ঘুমিয়ে পড়লে সান্তাক্লজ খুশি হয়ে গিফ্ট দিয়ে যায়। মানে অনেকরকম জিনিস দেয়।’
‘শুধু মেয়েদেরই দেয়?’
‘না, ছেলেদেরও দেয়। ভাল ছেলেদের।’
‘বাড়িতে এসে দিয়ে যায়?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী করে চেনে?’
‘ও সান্তাক্লজ সব চেনে।’
‘কী করে আসে দিদি?’
‘হরিণের গাড়িতে। বড় বড় শিংওলা হরিণ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসে। আমরা ঘুমিয়ে পড়ার পর সান্তা এসে গিফ্ট দিয়ে যায়। তাকে দেখা যায় না।’
শ্যামলী ভাবে, আমরা কী বোকা। জানিই না। কখনও মোজা বাঁধিইনি। এবার সে দেশে গিয়ে বড়দিনে মোজা বাঁধবে। পাড়ার সবাইকে বলবে মোজা বাঁধার কথা।
পরের দিন সকালে দেবলীনা তাকে ঘুম থেকে তুলেছিল। ‘ওঠ শ্যামলী ওঠ। দ্যাখ তোর মোজা। কত গিফ্ট দিয়ে গেছে।’
শ্যামলী ধড়মড় করে উঠে দেখেছিল, তার মোজা পুরো ভর্তি। কতরকমের চকলেট, লজেন্স, ছোট ছোট খেলনা, একটা চিরুনি। অবাক হয়ে বারবার সেসব নেড়েচেড়ে দেখছিল শ্যামলী। এরকম কখনও ঘটবে তা সে ভাবতেই পারে না। তার মানে সে ভাল মেয়ে। কিন্তু কোন ভাল কাজটা করেছে সে? কলকাতায় কাজ করতে আসা কি কোনও ভাল কাজ তা হলে?
এ বছর শ্যামলী দেবলীনাদের বাড়িতে নেই। এক বছর পর পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে। আসার সময় দিদি খুব মনখারাপ করছিল। শ্যামলীরও মনটা কেমন কেমন করছিল কিন্তু আনন্দ হয়েছিল তার চেয়ে বেশি। কতদিন পর বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে পারবে।
বাড়ি এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে সে যখন মাকে জড়িয়ে ধরেছিল, মা সে কী খুশি। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছে। আসার সময় ও বাড়ির কাকিমা সুতপাকাকির হাতে তার মাইনের টাকা দিয়ে দিয়েছিল। সুতপা যখন সেই টাকা শ্যামলীর মায়ের হাতে দিল তখন সে টাকাগুলো চোখের সামনে ধরে বারবার দেখছিল আর শ্যামলীর গালে চুমু খাচ্ছিল। বাবা দাওয়ায় বসে ছিল। শ্যামলীকে কাছে ডাকে। ‘আয়, আমার কাছে আয় মা।’
শ্যামলী ফিরেছে শুনে পাশের বাড়ির এক ঠাকুমা দেখতে এসেছিল। এসেই বলল, ‘কল্পনা, তোর ঝি তো কলকাতার হাওয়া লেগে দেখতে-শুনতে বেশ ভাল হয়ে গেছে।’
কথাটা শুনে ধক করে উঠেছিল শ্যামলীর বুক। সে যখন প্রথম বাড়িতে কাজ করত তখন একদিন সেই দিদার মতোই আর একজন এসে বলেছিল, ‘এত ছোট মেয়েকে ঝি রাখলে! ওকে দিয়ে কাজ চলবে তোমাদের?’
দিদা বলেছিল, ‘কী করব? ঝি পাওয়া এত মুশকিল হয়ে গেছে, দিন-রাতের লোক তো এখন পাওয়াই যায় না।’
তাদের দেশে ঝি বলতে মেয়ে বোঝায়। শ্যামলী ভেবেছিল তাকে মেয়ের মতো রাখার কথা বলছে বোধহয় ওরা। পরে জেনেছিল কলকাতায় ঝি বলতে মেয়ে নয়। চাকরানি। সেই কথাটার কষ্টও তার সঙ্গেই ফিরে এসেছে কলকাতা থেকে।
এখন সে কলকাতায় কাজ করে। সেখানে কাজের লোকের বিছানাপত্তর আলাদা। প্রথমে যে বাড়িতে কাজ করত সেই দিদা মশারিও দেয়নি। জিলিপির মতো দেখতে একটা জিনিস দিয়েছিল। সেটা নাকি মশা তাড়ানোর ধূপ। তাই জ্বালিয়ে শুত শ্যামলী। গন্ধে জ্বলে যেত নাক-মুখ। ছোটবেলা থেকে মাকে নয়, বাবাকেই জড়িয়ে নিয়ে শুয়েছে শ্যামলী। কতদিন পর আবার তেমন করে শুতে পারছে সে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না মোজাটা। না ঘুমোলে আবার মুশকিল। কখন দাড়িওয়ালা বুড়োটা এসে মোজার ভেতর জিনিস রেখে যাবে। ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে পড়ে তার চোখে।
বাবা-মা ঘুম থেকে ওঠার আগেই শ্যামলী উঠে পড়েছে। চোখে হাত ডলতে ডলতে মশারির বাইরে এসে মোজাটা খোলে সে।
এ কী! মোজার ভেতরে তো কিছুই নেই! শ্যামলীর চোখ থেকে ঘুম চলে যায়। সে চারপাশটা ভাল করে খুঁজে দেখে। যদি মাটিতে পড়ে গিয়ে থাকে। না, কোথাও কিচ্ছু নেই।
শ্যামলী মোজাটা খুলে নেয় মশারি থেকে। দরজা খুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। চারপাশটা কুয়াশা ঢেকে রেখেছে। মাটির রাস্তার দু’পাশে ঘাসের ওপর হিম পড়ে আয়নার মতো হয়ে রয়েছে। কচুপাতার ওপরেও এক-দু’ফোঁটা হিম টলটল করছে। শ্যামলী মাথা নিচু করে রাস্তায় পা ঘষতে ঘষতে হাঁটে।
সে কি ভুল দিনে মোজা বেঁধেছিল? পরের দিন কি বড়দিন? না কি আগে পেরিয়ে গেল? তা কী করে হবে। মোজা লুকিয়ে নেওয়া থেকে দিন গুনেগেঁথে রেখেছিল সে। তা হলে সাদা চুলওয়ালা বুড়োটা কি কলকাতা থেকে এতদূর বলে আসতে পারেনি? সে তো হরিণের গাড়ি করে ঘোরে। তবু কেন আসতে পারল না? রাস্তায় কোনও আলো ছিল না, গ্রাম তো ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাই কি বুড়োটা বুঝতে পারেনি এখানেও বাচ্চারা থাকে? না কি সে শুধু কলকাতাতেই আসে? নকল গাছ, আলো, তারা, ঘণ্টা, কেক না থাকলে আসে না সে। গ্রাম বলে কি এল না?
হাঁটতে হাঁটতে শ্যামলী এদিক ওদিক তাকায়। এতক্ষণ টের পায়নি। এবার শীত শীত করছে। মোজাটার দিকে দেখে একবার। ঝুঁকে পড়ে রাস্তার পাশ থেকে ভাঙা টালির একটা টুকরো তুলে তাতে ভরে। তারপর আরও অনেক কিছু কুড়োতে থাকে। মাটির কলসি ভাঙা, কুচি পাথর, মাটির ডেলা...। সাহেবের বড়দিনে সে তার বন্ধুদের চমকে দিতে পারবে না। মোজাটা ভরে গেছে। আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা পুকুর। জল থমকে রয়েছে। মোজার মুখটা বেঁধে সে পুকুরের জলে ছুড়ে ফেলে দেয় সেটা।
ভেতরে অনেক জিনিস ছিল। তাই জলের তলা থেকে বুড়বুড়ি উঠছে।
5 মন্তব্যসমূহ
valo laglo galpota. lokkhir panchali porechilam,eta niye 2Ti galpo pora holo.jotodur bujhte parchi jibonke khub kach thekhe dekhechen.
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকে। এইরকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া আমার পক্ষে সৌভাগ্যের।
মুছুনGood one . Keep it up .
উত্তরমুছুনStay safe
উত্তরমুছুন