সম্বিৎ চক্রবর্তী'র গল্প : নেগেটিভ


গল্পটি নিয়ে আলাপ--
গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো 2014 জানুয়ারি তে। সমান্তরাল পত্রিকায় ।
লেখা হয়েছিল তার মাস ছয়েক আগে ।আমি এখন যে চাকরি (শিশু বিকাশ প্রকল্প আধিকারিক ) করি তখনও তা-ই করি ।গল্পের প্রথম লাইন টি সত্যি ঘটনা ।বৃষ্টির দিনে ওরকমই আমার বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর পায়রা দেখছিলাম যদিও স্কুল পালাইনি ।ওই দৃশ্যটি এখনও স্পষ্ট আমার স্মৃতিতে ।একটা লোক এরকম গোনাগুনতির খেলা খেলে, যা-ই দেখে
তার মধ্যে মাপজোকের ব্যাপার নিয়ে আসে এটা আলাদা ভাবে মাথায় আসে আমার ।ওই প্রথম দৃশ্যে লোকটাকে স্থাপন করি । লেখাটির মাঝামাঝি এসে মনে হয় এমন কিছু পরিস্থিতি কি তৈরি করা যায় যাতে সুমন তার বিপন্নতা থেকে, বিপর্যয় থেকে তার মতো করে নেগেটিভ সংখ্যার ধারণা পায়? এর সঙ্গে আমার নিজের স্মৃতিমেদুরতা (পালটে যাওয়া চারপাশটাকে নিয়ে ) যোগ হয়েছে ।
গল্পটি দু দফায় লেখা । শেষ অর্ধেক এক মাসের ব্যবধানে লেখা ।
বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা ভাবে কাটাকুটি করে ঠিক করা হয়েছে । আমার অনেক লেখাই তাই।
প্রথম পাঠক স্ত্রী ।
মূল ভাবনা পাল্টে যাওয়া বলতে নেগেটিভ সংখ্যার ব্যাপার এসে যাওয়া ।সেটাই শেষে নাম হয়ে যায়।
গল্পটি নিয়ে আমার বিশেষ আক্ষেপ নেই ।তবে আমার বেশিরভাগ গল্প এর থেকে বেশি সময় ধরে লেখা যদিও সেই গোটা পর্যায়ে অনেকগুলো ব্যবধান থাকে মনে মনে লেখা গুছিয়ে নিতে পারিনা বলে।




সম্বিৎ চক্রবর্তী'র গল্প : 
নেগেটিভ

এক স্কুল পালানো বৃষ্টির দিনে রাস্তার ধারে একটা শেডের নীচে দাঁড়িয়ে সুমন আমাকে বলেছিল, ‘‘এই, পায়রা গোন্, পায়রা গোন্৷’’ 

সামনে পুরোনো রং-চটা একটা বাড়ি--- সাদা-কালো সিনেমার পুরোনো বাড়ির মতো৷ তার ছাদে পায়রাগুলো এসে এসে পড়ছে, খোপে ঢুকে যাচ্ছে বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে৷ কোনো কোনোটা কেন জানি বেরিয়েও আসছে আবার৷

সুমন গুনে যেতে লাগল, ‘‘এক, দুই, তিন...’’ সাদা ও ছাইরঙা--- দু’ধরনের পায়রাই ছিল, সুমন আলাদা আলাদা ভাবে ওদের গুনতে লাগল৷ এরপর ঘড়ি দেখে হিসেব করার চেষ্টা করতে লাগল কতক্ষণ সময়ে কতগুলো পায়রা খোপে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে এবং সেটা দু’ধরনের পায়রার ক্ষেত্রেই৷ 

বৃষ্টি বাড়তে লাগল, যেমন বেড়ে গেলে মনের ভিতরে একটা ঢেউয়ের মতো ওঠে৷ দেখে যাই৷ গাছের পাতায় পাতায়, সামনের প্রশস্ত রাস্তায়, চলমান গাড়ির মাথায় রুপোলি মাছের মতো ঝরে-পড়া বৃষ্টি৷ শেডের গা ঘেঁষে ওপর থেকে পুঁতির মতো জলকণা পড়ে চলেছে টুপ টুপ করে৷ 

লক্ষ করলাম সুমনও দেখছে৷ জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘‘মিনিটে ক’টা জলকণা পড়ছে হিসেবটা রাখা দরকার৷’’ 

‘‘কেন?’’ 

‘কেন’র কোনো জবাব না দিয়ে সে বলে চলল, ‘‘হিসেবটা করা দরকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে, কারণ শেডটা একদিক থেকে আর একদিকে ঢালু হয়ে গেছে৷’’ তবে কি এক এক ঢালে এই জলের ফোঁটা চুইয়ে পড়ার হার কী, সেটা হিসেব করছে ও? অবাক হলাম৷ কারণ সুমন কিন্তু অঙ্কে তেমন কিছু ভালো ছিল না৷ 



আর-একবার এক আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য খড়গপুর লাইনে ট্রেন ধরতে যাব, হাওড়া স্টেশনে হঠাৎ সুমনকে দেখলাম৷ একই দিকে যাবে৷ স্কুল ছাড়ার অনেক বছর পর৷ 

সেই আনমনা ভুলো-ভুলো অগোছালো ভাব৷ পাশাপাশি সিটে বসলাম৷ জানালার ধারে৷ এ-কথা সে-কথায় বেশ কিছু সময় কাটানোর পর খানিকক্ষণ চুপচাপ বসেছি৷ লক্ষ করলাম ছোট্ট নোটবুকে ও কী যেন টুকছে আর ঘড়ি দেখছে৷ সেই বর্ষার দিনের পায়রা গোনার কথা মনে পড়ে গেল৷ জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দু’কূল-ছাপানো নদীর মতো আকাশ পর্যন্ত উপচে-পড়া ধানখেত৷ ধান পেকেছে; সোনালি ঢেউয়ের নদী৷ এই উদার বিস্তার সুমনের আনমনা ভাবের সাথে যেন খাপ খেয়ে যায়, কিন্তু ওর ওই হিসেব করার ব্যাপারটা নয়৷ প্রথমে কিছুই বলে না, অনেক জেরা করায় বলল৷ 

ট্রেনটা স্থির অবস্থা থেকে চলতে শুরু করলেই ইঞ্জিনের একটা বিশেষ গোঁ গোঁ আওয়াজ শুরু হচ্ছিল৷ সেটা ক্রমশ বাড়তে থাকে আবার একটা গতি চলে এলেই আওয়াজটা থেমে যায়৷ ফের সেটা শুরু হয় যখন কোনো স্টেশনের কাছাকাছি আসে, অর্থাৎ গতি কমতে থাকে৷ এই-যে দুই খেপে শব্দটার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়--- এই দুটো হিসেব করতে থাকে ও, প্রত্যেক দুটো স্টেশনের মধ্যবর্তীতে৷ উদ্দেশ্য এটা দেখা যে, এর মধ্যে কোনো নিয়ম আছে কি-না৷ 

মনে মনে একটু বিরক্তই হলাম৷ পাশকোর্সে কোনোরকমে বি. এ করেছে সুমন৷ এ-সবই আসলে ভান নয়তো? কিন্তু ওর সরল মুখ দেখে সে বিরক্তি মনে পুষে রাখতেও লজ্জা হয়৷ কথায় কথায় জানতে পারলাম স্টেশনের কাছে ও একটা ছোটো-খাটো বইয়ের স্টল চালায়৷ প্রধানত ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ আর চাকরির পরীক্ষার বইয়ে ওর দোকান চলে৷ নতুন বছরের গ্রিটিংস কার্ডও রাখে৷ 

প্রকৃত প্রস্তাবে, সুমনের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে এই সময় থেকেই৷ আমার মনে হলো এটা ওর চরিত্রের নিজস্বতা, সেই পায়রা গোনার দিন থেকে ধরলে আজ অনেক বছর হয়ে গেল--- সুমন এ-ব্যাপারটা ধরে রেখেছে এবং একেবারে নিজস্ব স্টাইলে৷ ছুটিছাটার দিনে ওর স্টলে গিয়ে মাঝেসাঝে বসি৷ বেশ কয়েকটা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন দেখা হয়ে যায়৷ খুব-একটা যে কিনি, তা কিন্তু নয়৷ না কিনে পড়লেও সুমন দেখি কিছু মনে করে না৷ বেচাকেনার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা চালিয়ে যায়৷ এই জায়গাটায় আরো বেশ কিছু স্টল আছে৷ ফুট পঞ্চাশেক দূরের এক বিরাট অশ্বত্থ গাছ আরো অনেক কিছুর মতো স্টলগুলোতেও ছায়ার শীতলতা এনে দেয়৷ 

কথায় কথায় হঠাৎ একদিন বলল সুমন, ‘‘জানিস সন্তু, শীতের শেষে যে পাতা পড়া শুরু হয় সেসময়ে এ-গাছটা থেকে ডেইলি সাঁইত্রিশ থেকে বিয়াল্লিশটা পাতা পড়ে৷ চলে টানা তিনমাস৷ দেখেছি, পরের দিকে কমে যায়৷’’ বললাম, ‘‘এ-সবে তোর ব্যাবসার ক্ষতি হয় না সুমন?’’ ‘‘কিস্যু না৷ প্রতি সেকেন্ডে তো আর বিক্রি হয় না৷’’ 

যাক গে৷ ওর ব্যাপার ও বুঝবে৷ আমি ভাবি৷ 

এরপর বই নাড়াচাড়া করতে করতে একটা মতলব মাথায় এল৷ মোটা একটা বই নামিয়ে মাঝখানে আঙুল দিয়ে বললাম, ‘‘অ্যাই ব্যাটা, বল্ তো কত পৃষ্ঠায় আঙুল রেখেছি?’’ 

সুমন কিন্তু নির্বিকার৷ পাশ থেকে থিকনেসটা একটু দেখে নিয়ে বলল, ‘‘কত আর হবে? দেড়শো কি একশো পঞ্চান্ন৷’’ থ মেরে গেলাম৷ একশো সাতান্ন পৃষ্ঠায় আঙুল রেখেছিলাম৷ 

এই-সব কথার মধ্যেই একটি খুব কিউট দেখতে মেয়ে এসে একটা কম্পিটিশন মাস্টার নিয়ে চলে গেল৷ সুমন আস্তে করে বলে উঠল, ওর পায়ের স্টেপিংটা লক্ষ কর৷ বড়ো রাস্তায় পড়তে ওর একান্ন পা লাগবে৷ তাই-ই হলো৷ এবার ঘাবড়ে গেলাম৷ 

‘‘করেছিস কি সুমন? দেখছি চিতাবাঘের মতো মেয়েটাকে লক্ষ করেছিস!’’ কিছু না বলে ও হাসল৷ ‘‘কিন্তু সুমন, এ-সব করে তুই কী পাস?’’ 

‘‘তোর মনে আছে সন্তু, একসাথে খড়গপুর যাওয়ার কথা? সেদিনও তুই বলেছিলি দু’পাশের মাঠ-ঘাট, শস্যখেতের সৌন্দর্য না দেখে তুই কি-না ইঞ্জিনের শব্দের হিসাব কষছিস, বেরসিক? আসলে আমি এই-সব দেখি, সৌন্দর্য উপভোগও করি তবে আমার মতো করে৷ ধর, একটা ঘোড়ার ছবি দেখলাম৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে ঘোড়াটা দৌড়োচ্ছে৷ সত্যিই তো আর ঘোড়া দৌড়োচ্ছে না ছবিও না৷ দেখলেই বোঝা যায় পাগুলো মাটির সাথে লম্বভাবে না থেকে সূক্ষ্ম কোণ করে আছে৷ দৌড়ের দিকের অনুভূমিক রেখার সাথে পায়ের সূক্ষ্মকোণ যত সূক্ষ্ম অর্থাৎ ছোটো হবে, মনে হবে ঘোড়াটা তত জোরে দৌড়োচ্ছে৷ আমি কিন্তু অ্যাংগেলটা মেপে রাখি৷ এই অ্যাংগেলের হেরফেরে দৌড়ের গতি আর মরিয়াভাবের মধ্যে হেরফের আনা যায়৷ তারপর ধর, টিভিতে বা কাগজে যখন শুনি ঘণ্টায় নববই বা একশো কুড়ি কিলোমিটার বেগে ঝড় আসছে তখন সত্যিই ঝড় এলে আমি বাইরে বেরিয়ে একটু গায়ে লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করি গতির মাত্রা আর এফেক্টটা কেমন৷’’ 

‘‘কিন্তু এতে আর নতুন কী আছে রে?’’ 

‘‘নতুনের দাবি তো আমি করি নি সন্তু৷ আমি শুধু যা দেখি তার ভিতর এই গণনা বা সংখ্যার দিকটাকে ধরার চেষ্টা করি৷ কারণ এতে চরিত্রটা ফুটে ওঠে৷ জানিস, মানুষের বিভিন্ন সময়ের হাসিও লক্ষ করি? একই লোকের বিভিন্ন হাসিতে, আনন্দের কম-বেশির জন্য দাঁত ও ঠোঁটের কৌণিক বিস্তারে কত পার্থক্য হয়? যাকে স্টাডি করছি, তাকে একটা মজার বা তৃপ্তির কথা বলে নজর দিই তার হাসিতে দাঁত ও ঠোঁটের রৈখিক বা কৌণিক বিস্তার কত হলো৷ অবশ্য কী মুডে আছে সে, সেটাও একটা ফ্যাক্টর৷’’ 

শুনে একটু চুপ করে রইলাম৷ আসলে একটু খেয়ালি হলেও ছাপোষা নিরীহ চরিত্রের ছেলে বলেই হয়তো ওর কাছে যখন-তখন আসতে ভরসা পেতাম৷ কোনো মাতববরি বা ঘ্যাম নেওয়ার ব্যাপার ওই সামান্য দোকানদারিতে থাকার কথা নয়৷ কিন্তু কেস দেখছি সহজ নয়৷ এরকম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবাইকে ও লক্ষ করে তাহলে! 

সব মিলিয়ে মনে মনে পাগল-ছাগল ভাবার চেষ্টা করেও ভাবনায় কোনো জোর পেলাম না৷ কারণ ব্যাবসাটা ও সত্যিই মন দিয়ে করে, কাস্টমারের সাথে ব্যবহার ভালো৷ সেক্ষেত্রে পাগলামি না বলে একে অসাধারণত্ব বলতে হয়৷ কিন্তু এত সামান্য ক্যারিয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের এত ঘাটতিতে কাউকে অসাধারণ বলে স্বীকার করতে আমার ভেতর থেকে আপত্তি হলো৷ তবু ব্যবহার সবসময়ই ভালো করত বলে রাগ হতো না শেষপর্যন্ত৷ তাই স্টলেও যাতায়াতটা রয়ে গেল আর কি৷ যাই, ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজ পড়ি, টুকটাক কথা চলে৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে যায় ওর ওই মাপজোক, হিসাবনিকাশ, গোনা-গুনতির কথা--- সে যে-কোনো প্রসঙ্গে, যে-কোনো অনুষঙ্গে৷ 

মাঝে-মাঝে তাই অবাক হয়ে ভাবি এতে ওর মনের উপর চাপ পড়ে না? এরকম একজনের সাথে পরিবারের লোকেরা দীর্ঘ সময় কাটায় কিভাবে? নাকি এ-সব শুধু ও বাইরের, আমাদের মধ্যে করে দেখায় স্রেফ প্রশংসা পাওয়ার জন্য, আইডেনটিটির জন্য? 

ফলে, মাঝে-মাঝে বিরক্তির কারণে যাওয়াতে বিরতিও দিতাম৷ কখনো কখনো মনে হতো সুমন আর ওর এই নেশা--- এরকমই যেন চলতে থাকবে অনন্তকাল৷ আবার সেই মনে হওয়ার ফাঁকে ফাঁকে খটকাও লাগত এই ভেবে যে, এরকম অদ্ভুত কোনো ব্যাপারে এমন নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা কি প্রকৃতি অনুমোদন করে? কার্যকারণ-সম্পর্ক বুঝি না, তবে মনে হতো এ যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়৷ 

সত্যিই একদিন এল আকস্মিক পরিবর্তন এবং পরপর৷ সুমনের স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়ল৷ বেশ কয়েকদিন ওর স্টল বন্ধও ছিল৷ খবরটা কার কাছ থেকে যেন পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম৷ 

অদ্ভুতভাবে বসেছিল৷ অন্ধকারের স্তব্ধ গভীরতার মতো মুখখানা ভারী হয়ে রয়েছে৷ একটা আনমনা হাসি দিয়ে বসতে বলে অন্য দিকে চেয়ে রইল৷ যতক্ষণ ছিলাম দেখলাম নিজের মনে বিড় বিড় করে কী যেন বলে গেল৷ সুমনের বিধবা মায়ের পাশে বসে ওর একমাত্র সন্তান, ছ-বছরের ছেলেটা একটা খেলনাগাড়ি নিয়ে খেলে যাচ্ছে৷ কিন্তু ওখানেই শেষ নয়৷ ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে সুমনের স্ত্রী যখন শেষ দিনগুলো কাটাচ্ছে, তখন হঠাৎ দিন কয়েকের নোটিশে সুমনসহ ওই জায়গাটার প্রায় সবারই স্টল ভেঙে দেওয়া হলো৷ ওগুলো নাকি ছিল বেআইনি দখল৷ আদতে সে-স্থান পুরসভা অনুমোদিত এক সোসাইটির৷ ‘জবরদখলকারি’ সুমন ও আরো অনেকে একদিন দেখল সমস্ত স্টল ভেঙে লক্ষ আলোর মালা পরে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত বড়ো এক শপিং মল৷ একশোজনে দু’জন কি চারজন স্টলমালিক নতুন গড়ে-ওঠা মলে জায়গা পেল৷ কেউ কেউ হলো কর্মচারী৷ আর সুমনের মতো বাকিরা--- জাস্ট নেই৷ কোথাও নেই৷ সবই অবশ্য হয়েছে নিখুঁত ভাবে, আইন মেনে৷ আমাদের এলাকা যে-পার্টির উপনিবেশ, তারা (পৌরসভাকে দিয়ে) ব্যাপারটা এভাবেই সাজিয়েছে৷ যে-দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাজ করে গেছে, সে-দেশে পার্টিগুলোর ফাইলওয়ার্ক এত গুছানো হওয়ারই কথা৷ হয়তো খুবই আড়ম্বরহীনভাবে সুমনের এই দুর্যোগের কাহিনি বলছি আসলে আমার কাছেও এরা আকস্মিক৷ এই-যে অসংখ্য অল্প চেনা, অচেনা মানুষ চারপাশে হেঁটে চলে বেড়াছে তাদের প্রত্যেকের সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য আমাদের কাছে আকস্মিক৷ 

সুমনের কথাতেই আসা যাক বরং৷ ওকে শেষপর্যন্ত পুরসভা থেকে একটা কাজের প্রস্তাব দেওয়া হলো৷ বাড়ি বাড়ি আবর্জনা সংগ্রহ করে ফেলে দেওয়ার কাজ, হাতলটানা ভ্যানের সাহায্যে৷ তবে তা অবশ্যই এলাকার সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করার শর্তে৷ শর্তটা কোথাও লেখা ছিল না অবশ্য৷ 

সেদিন সুমনের ভাব দেখে আমাদের মনে হয়েছিল, ও বোধহয় ভাবছে পার্টির কাছে এভাবে মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করার চেয়ে কাছের বন্ধুদের সাহায্য নেওয়া অনেক কম অপমানজনক৷ 

কিন্তু আমরা বন্ধুরা ওর থেকে অনেক বেশি শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় জোরের সঙ্গে একথা প্রমাণ করে দিলাম যে, ব্যক্তিনির্ভরতা আসলে অনেক বেশি অপমানজনক৷ তার চেয়ে কাজ, যার বেতন দেয় পুরসভা, অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্স, তা বেশি গ্রহণযোগ্য৷ পার্টির ব্যাপারটা আসলে খুবই তুচ্ছ৷ দু’চোখে জ্বলন্ত হতাশা নিয়ে আমাদের কাউন্সেলিং ও মেনে নিয়েছিল সেদিন৷ 



দুই 


হাতলওয়ালা ঠেলাভ্যান নিয়ে বাড়ি বাড়ি আবর্জনা সংগ্রহের কাজেই বেরিয়ে পড়ল সুমন৷ ‘কোনো কাজই লজ্জার নয়’--- একথা তো ছোটোবেলা থেকে জেনে আসছি৷ মনে হয়, আদতে বড়ো হয়ে যে ছোটো কাজে হাত লাগায়, কাজের গৌরব সে-ই পায়৷ নেহাত বেঁচে থাকার তাগিদে ছোটো কাজ নিলে কাজের সে-গৌরব কি কেউ তাকে দেবে? কেউ? 

একদিন ব্রহ্মানন্দ স্টেডিয়ামের বাঁ পাশের গলি দিয়ে সাইকেলে এসে বাঁক নিতেই দেখি সুমন৷ প্রায় এক বছর পর দেখলাম৷ হাতলওয়ালা ঠেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মুখে বাঁশি, আমাকে দেখতে পেল কি-না বুঝলাম না৷ ও সামনে এগিয়ে গেল৷ সাইকেল করে পিছু পিছু ধাওয়া করে ধরলাম৷ আমি যদি ওকে এড়িয়ে যেতাম আর, ও যদি সেটা টের পেত, লজ্জার ব্যাপার হতো৷ পাশাপাশি চলতে লাগলাম৷ 

সুমন বলল, ‘‘কেমন আছ?’’ 

স্কুল থেকে বয়ে-আসা সম্পর্কে এই প্রথম সুমন আমাকে তুমি করে বলল৷ চমক খেয়ে নিজের অজান্তেই আমার দৃষ্টি চলে গেল ওর হাতলওয়ালা ঠেলার দিকে৷ একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘রোজ তোকে অনেকটা পথ ঘুরতে হয়, তাই না?’’ 

‘‘ঠিক, জান সন্তু, এই কাজ করতে করতে এই দুটো ওয়ার্ডের অনেকটাই ঘোরা হয়ে যায় আর---আর কাজ হয়ে গেলে ইচ্ছে করলে আরো আরো এলাকা ঘুরি৷ হ্যাঁ ইচ্ছে করেই৷ কত পালটে গেছে আমাদের ছোটোবেলার টাউনটা৷ এক-একটা লেন-এ কত নতুন সব বাড়ি উঠেছে৷’’ বলে, একটু থেমে কী যেন ভাবল ও৷ 

তারপর বড়ো বড়ো চোখ করে গলা নামিয়ে টেনে টেনে বলল, ‘‘বাড়ির হিসেব করি, জান? ধরো এই লেনটা, যেটা দিয়ে আমরা যাচ্ছি... তো ওই মাথা পর্যন্ত বাড়ির সংখ্যা হলো ছাবিবশ... এভাবে লেন অনুযায়ী আমি...’’ 

‘‘তুই এখনও গোনাগোনির খেলা খেলিস সুমন?’’ 

‘‘হ্যাঁ খেলিই তো!’’ গাড়ির হাতল ছেড়ে হঠাৎ বাঁ-হাতটা শূন্যে ছুঁড়ে কেমন একটা হাসি দিল ও৷ ‘‘তবে এবার,’’ বলে, আমার প্রায় মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে গোপন কথা বলার মতো করে বলল, ‘‘এবার হিসেবটা একটু অন্যরকম৷ ধরো, একশো সাতাশটা ফ্ল্যাট গোনার সাথে সাথে হিসেব করি কটা পুকুর বোজানো হয়েছে৷ কাজেই ওই ‘পূর্ণিমা আবাসন’ আর এ-ধারের কিং পার্কের ‘শ্রী আবাসন’-এর ফ্ল্যাটের নির্মাণ যদি পুকুরের হিসেবে চাও তো হবে মাইনাস তিন৷ একইভাবে ধরো ওই জলের ট্যাংকের উত্তরের যে রো, ওতে সাতচল্লিশটা নতুন বাড়ি আসলে গাছের হিসেবে মাইনাস উনিশ৷ সাতচল্লিশ বাড়ি উঠল আর উনিশ গাছ পড়ল৷ উনিশ গাছ পড়ল তো সাতচল্লিশ বাড়ি উঠল৷’’ 

এভাবে হাত পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সুমন বলে যেতে থাকল৷ ‘‘সদরের আয়রন ফ্যাক্টরির মাপ তুমি যদি প্রোজেক্টের হিসেবে করো, এক্সপেন্সের হিসেবে করো তো পুরোটা পাবে না৷ জমির হিসেবে ওটা মাইনাস এক হাজার একর৷’’ 

আমার কেমন লাগছিল, ওর কথাগুলো ঠিক নিতে পারছিলাম না যেন৷ 

আমার প্রতিক্রিয়ার পরোয়া না করে ও বলে যেতে লাগল, ‘‘এভাবে আমি আজকাল মাইনাস সংখ্যাগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পাই৷ আগে ভাবতাম এ-সব মাইনাস ওয়ান, মাইনাস টু স্রেফ বইয়ের ব্যাপার৷ এখন বুঝি, হুঁ হুঁ বাবা, এরা আছে৷ এমনকি মানুষও মাইনাস হয়৷’’ 

‘‘বলিস কিরে?’’ 

‘‘তো আর বলছি কী৷’’ ঠেলার গায়ে বিরাট এক চাপড় মেরে সুমন হেসে উঠল৷ ‘‘ধরো বিদ্রোহী মোড়ে চৌধুরীদের ওই নার্সিংহোমের পাশ দিয়ে যেতে যেতে প্রায়ই দাঁড়িয়ে পড়ি, আর হিসেব করি ক’জন রোগী ভর্তি হতে পারে৷ ব্যাপারটা এরকম৷ নার্সিংহোমে প্লাস একান্ন রোগীর অর্থ হলো সরকারি স্টেটস জেনারেল হাসপাতালে মাইনাস চার৷ চারজন রোগী সরকারি হাসপাতালে মরল বলেই-না একান্ন জন রোগী নার্সিংহোমে যেতে বাধ্য হলো৷ আবার দেখো তুমি সন্তু, যে-লোকগুলো নার্সিংহোম থেকে বেঁচে বেরিয়ে এল তাদের মধ্যেও একটা বড়ো অংশ,’’ বলে সুমন তাকাল আকাশের দিকে, ‘‘হ্যাঁ, তাদের বেশ কয়েকজনের কী হলো? ঘটি গেল, বাটি গেল, জমি গেল, মাথার ওপর ধার ছ’লাখ টাকা... তো লোকগুলোই তো আপাদমস্তক নেগেটিভে পরিণত হলো৷ মাইনাস মানুষ, মাইনাস মানুষ!’’ 

সে কী হাড়-কাঁপানো হাসি সুমনের! 

আপনারা জানেন কি-না জানি না, এ-শহরের অনেকেই এখন জেনে গেছে সুমনকে৷ আর হ্যাঁ, তা ওর এমন সব ব্যাপারের সূত্রেই৷ রাস্তা-ঘাটে ওকে দেখলেই আজকাল সরে যাই৷ বাজ-পড়া গাছের মতো শরীর হয়েছে৷ রুগ্ণ চেহারার সাথে অসম্ভব তীক্ষ্ন দুটো চোখ৷ কোনো অজানা ভয়ে কেঁপে উঠি ভিতরে ভিতরে৷ 

ঘড় ঘড়, ঘড় ঘড়, ঘড় ঘড়৷ সেদিনও দেখলাম ওকে৷ ঠেলাগাড়ির আওয়াজটা শুনেই মনে হয় কী যেন কোথায় ভেঙে ভেঙে পড়ছে৷ 

হাতলওয়ালা ঠেলাগাড়ি উত্তরে চলেছে৷ 

সুমনের মাথা অবিরাম দুলে যাচ্ছে দক্ষিণ ঘেঁষে পুব-পশ্চিমে৷ 

আর, ওর নিদারুণ অদৃষ্ট ওকে কোন্ অনির্দেশ্য কক্ষপথে নিয়ে চলেছে, সে- হিসেব কে করবে? 


লেখক পরিচিতি
সম্বিত চক্রবর্তী
পড়াশুনা--
রহড়া কল্যাণনগর বিদ্যাপীঠ।
রহড়া বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী কলেজ।
পদার্থ বিদ্যায় অনার...
বাসস্থান;:রহড়ায় বিভিন্ন জায়গায় ভাড়াটে হিসেবে কাটিয়ে আজ বছর পনেরো কল্যাণনগরে নিজেদের বাড়িতে থিতু হয়েছি।

একমাত্র গল্পের বই আমি ও আমরা
প্রকাশক Swarantar

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ