২০১৮ সালে লেখা শাহনাজ মুন্নী'র সেরা গল্প : মৃতেরা শব্দ করে না

গল্পটি নিয়ে আলাপ--
গল্পটির প্রথম অংশ লিখেছিলাম ২০১৭ সালের দিকে, লিখে যেন থমকে গিয়েছিলাম, বহুদিন আর একটি লাইনও এগুতে পারিনি। মাঝে মাঝে ল্যাপটপ খুলে লেখাটা পড়েছি, মনে মনে নাড়াচাড়া করেছি, কিন্তু ঠিক কিভাবে কি লিখবো, তা ঠিক করতে পারিনি। কাজের সুবাদে প্রতিদিন দেশেবিদেশের খবরের সাথে বোঝাপড়া করতে হয়, হৃদয় ভাঙা ঘটনাগুলোর সাক্ষি হই, বুকের মধ্যে ছুরির মতো বিঁধে থাকে গল্পের বীজ।
নিজেকে বিযুক্ত করতে চাই বাস্তবতা থেকে, কুৎসিত সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় লাগে। কিন্তু মগজের কোষে কোষে ঠুক ঠুক করে ঘন্টা বাজতে থাকে, মনে হয় কি যেন খোঁচাচ্ছে করোটির ভেতর। ভাবি, এই গল্প কি শেষ পর্যন্ত লিখতে পারবো? লেখা সম্ভব? এটি কি আসলে গল্প হবে, নাকি হবে আমার রাগ ক্ষোভ আর অসহায়ত্বের দলিল? যেটাই হোক, বুঝতে পারি কিছু একটা না লিখলে শান্তি নেই আমার । 

তারপর একদিন ২০১৮র শুরুতে আবার সেই অসমাপ্ত গল্পের লাইনগুলোর সঙ্গে একলা বৈঠকে বসি, আবার কয়েক লাইন লিখি, ডিলিট করি, আবার লিখি। তারপর লিখতেই থাকি, প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে আমার মাথায় লেখাটা বস-বাস করে। তাকে একটু একটু করে নামাই। শব্দ পাল্টাই, বাক্য বদলাই। মনে হয়, কিছুই হয়নি। অন্তত প্রচলিত গল্পের কোন আঙ্গিক তো নেই-ই এতে। কখনো কখনো গল্পে নিজের উপস্থিতি আড়াল করতে পারিনি। তবু কিছু একটা তো লিখেছি। অন্তত লিখতে যে পেরেছি সেটাই শান্তি।
 

শাহনাজ মুন্নী'র গল্প : 
মৃতেরা শব্দ করে না 
-------------------------
“এখন সময় হয়েছে জাগার 
তার মনে পড়ে অতীতের বেদনার কথা 
অজস্র ক্ষতির কথা 
আর্তচিৎকার আর বৃথা ব্যাকুলতা 
তার মন ছুটে যায় অপার ঐশ্বর্য আর নিহত নীরব ইতিহাসে 
জাগার সময় হয়েছে এখন তার, যদিও একদা ধর্ষিতা সে।” 
-মায়া অ্যাঞ্জেলু (অনুবাদ : আলম খোরশেদ) 

মনে হলো,অনেক দূর থেকে মা ডাকছে, ছোট বেলায় যেমন নরম গলায় সুর করে ডাকতো, অনেকটা তেমন করে, ‘বিনু ও বিনু, বিনুরে, কই গেলি মা। ’ 

তারপর শুনতে পেলাম বাবার কাতর গলা, ভারী আর মোটা। কানের পাশে ভাইয়ার পায়ের শব্দও শুনলাম যেন। দুই ফিতার চটিটা মাটিতে ঘষে ঘষে ভাইয়াও হয়তো হেঁটে গেল খুব কাছ দিয়েই, আমি হঠাৎ ছটফট করে উঠলাম, ওড়নাটা কোথায়? আমার বুক ঢেকে রাখা ফিরোজা কালারের নরম সূতি ওড়নাটা? নিউমার্কেটের সূর্যমুখী ক্লথ ষ্টোর থেকে কিনেছিলাম যেটা, ওড়নার দুই আঁচলে কুশি কাঁটায় করা সাদা সুতার চিকন লেস। ক্লাস এইটে উঠার পরই তো মা খড়খড়ে গলায় বলেছিল, ‘এবার থেকে ওড়না নেও, বিনু। খোলা বুকে থাকা ভাল দেখায় না। বড় হইছো।’ 

মার ওই কথায় প্রথম আমি আমার সদ্য জেগে ওঠা নতুন বুক নিয়ে সচেতন হয়েছিলাম। আর শিখেছিলাম কিভাবে ওড়নায় আব্রু ঢাকতে হয়, নইলে লজ্জা আর লজ্জা, ওড়না সামলানো নিয়ে কি যে বিড়ম্বনায় পড়তাম শুরুর দিকে, ভাইয়ার যেমন মুসলমানি করার পর লুঙ্গি পরতে গিয়ে বার বার আলগা হয়ে যেত মাড় দেওয়া কড়কড়ে লুঙিগর গিট, আমারও তেমন, এক টুকরো লম্বা পিছলা ওড়না ঠিক জায়গায় থাকতেই চাইতো না, আমি টেরই পেতাম না, কখন যেন ওড়না সরে যেত বুকের ওপর থেকে, মার চোখের কড়া আর ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি অনুসরণ করে তাড়াতাড়ি ঠিক করতে হতো ওড়নার অবস্থান। 

আমার সেই প্রিয় ওড়নাটা কোথায় গেল? ওড়না ছাড়া আমি বাড়ি ফিরবো কি করে? আর আমার পায়ের জুতা? বাদামি রঙের চামড়ার জুতা জোড়া, সরু সোনালি ফিতার সামান্য হিল তোলা, অনেক ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে আসা সেই জুতাগুলো? 

উঠে বসতে পারছিনা কেন আমি? কোন কিছুই যেন ঠিক নেই। কি হয়েছে আমার? আমি এইখানে কেন শুয়ে আছি ? এই নির্জন ঘাসের ওপর, ঝোপ-ঝাঁড়ের ভেতর, আশেপাশে কোথাও কি তীব্র গন্ধা কামিনী ফুল ফুটেছে? নাকি এটা কোন অচেনা বুনোফুলের গন্ধ? নাকি এটা আমারই শরীর থেকে বেরিয়ে আসা আহত রক্তের ঘ্রাণ? চারপাশে কুয়াশার মতো ঘন অন্ধকার ঘিরে আছে, কিন্তু এটা তো শীতকাল নয়, তবে কি অসময়ে রাত নেমে এলো আজ? 

হায়, হায়, বাসায় নিশ্চয়ই সবাই আমার জন্য চিন্তা করছে, ভাবছে, মাগরেবের আজান পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো টিউশনি সেরে পোষা কবুতরের মতো বিনু বাসায় ঢুকে যায়। শুধু যেদিন নাটকের রিহার্সাল থাকে বা তরঙ্গ নাট্য সংসদের নির্বাহি কমিটির মিটিং থাকে সেদিন মাকে আগে থেকে জানিয়ে রেখে একটু রাত করে ঘরে ফেরে বিনু। 

আজ বিনুর কি হলো? তার ফেরার পথে কি ওৎ পেতে ছিল উর্দিপরা বিপদ? কেন সূর্য ডুবে যাবার পরও ঘরে ফিরছে না সে? ঘরে না ফিরলে মেয়েটা যাবে কোথায়? কোন কারণে দেরী হলে সেটা বাড়িতে জানাবে তো ! 

রাত প্রায় শেষ হয়ে গেলো, রূপাও এখনো বাড়ি ফেরেনি। ময়মনসিংহ থেকে রূপা বগুড়ায় গিয়েছিল শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে। এই পরীক্ষায় ভাল করতে পারলেই মিলবে নতুন চাকরি। এখনকার বেসরকারি সংস্থার হাড়ভাঙা খাটুনির কাজটা ছেড়ে তখন শিক্ষকতা শুরু করবে রূপা। বাচ্চাদের পড়াবে। চশমা পরা রূপাকে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে খুব ভাল মানাবে। ছোট বোন, বড় ভাই আর মাকে নিয়ে তখন হয়তো স্বচ্ছলতার ছোয়া তার জীবনকে বদলে দেবে। রূপা বগুড়া থেকে রাতের বাস ধরে ফিরে আসবে ময়মনসিংহে তার কাজের জায়গায়। বড় ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে সব শেষ এমনই কথা হয়েছিল তার, বলেছিল, ‘আমি এখন বাসে আছি, বাসায় ফিরেই তোমাকে জানাবো।’ 

কথা শেষ করে রূপা হয়তো ফোনটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে একবার বাসের ভেতরটা দেখে নিয়েছিল। রাতের বাস, খুব বেশি যাত্রী নেই। ৬/৭ জন মাত্র। রূপার কি তখন একটু ভয় ভয় লাগছিল? ভয় কাটাতে সে হয়তো ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে চোখ রেখেছিল। বাসটা তখন যমুনা সেতু পার হচ্ছিলো, হাল্কা অন্ধকারে সেতুর লাইট পোষ্টগুলো সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছিলো দ্রুত। নদী-ভেজা বাতাসের ঝাপটা লাগছিল তার চোখে মুখে। দূরে যমুনার কালো জলে বিচুর্ণ আলো পড়ে চিক চিক করছিলো। একজন একজন করে যাত্রী নেমে যাচ্ছিলো পথে, তাদের গন্তব্যে, আর কি এক আশংকায় রূপার বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। ‘ভয় পাবার কি আছে? বাসের ড্রাইভার, হেলপার, সুপারভাইজার এরা তো মানুষই! রাক্ষস তো নয়, কি করবে আর?’ 

রূপা নিজেকে বোঝাচ্ছিল। ওড়নাটাকে গায়ে চাদরের মতো পেঁচিয়ে নিয়েছিল সে। কিছুক্ষণ পরে শেষ যাত্রীটিও নেমে গেলে চলন্ত বাসের একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দটাকেও কেমন ভীতিকর মনে হতে থাকে রূপার, যেন হামাগুড়ি দিয়ে গভীর কোন বিপদ ঘনিয়ে আসছে, রূপার একবার ইচ্ছা করে চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায়। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে। এবড়ো থেবড়ো ভাঙা রাস্তায় একটা ছোট্ট গর্ত পেরুতে গিয়ে বাসটা প্রায় লাফিয়ে উঠলে রূপাও প্রবল ঝাঁকুনি খায়। 

ফাঁকা বাসের হেলপার ছোকড়াটা তখন হঠাৎ জোরে বিশ্রি ভাবে শিস দিয়ে উঠে। আরেকজন, হয়তো সে বাসের সুপারভাইজার, দুই আঙ্গুলের ফাঁকে রাখা বিড়িতে টান দিয়ে একমুখ ধোয়া ছেড়ে বিশ্রি ভাবে রূপার দিকে তাকিয়ে বেসুরো গলায় একটা সিনেমার গান গায়। ড্রাইভার এক হাতে বাসের ষ্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে লুঙ্গি উঠিয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে উরু চুলকায় আর ময়লা দাঁত বের করে হাসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোয়া পরিবহনের বাসটা যেন একটা জ¦লন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়, নরক থেকে নেমে আসা কুৎসিত কালো ধূয়ায় ঢেকে যায় চারপাশ। রূপা হয়তো শেষ রক্ষার জন্য হাত জোর করে মিনতি করেছিল, বলেছিল ‘আমার ব্যাগে পাঁচ হাজার টাকা আছে, নিয়ে যাও, আমার মোবাইল ফোন, আমার এই ঘড়ি নিয়ে যাও তোমরা, আমাকে কিছু করো না, যেতে দাও।’ 

তারপর বাসের কর্কশ শব্দে রূপার কথা, রূপার চিৎকার হারিয়ে গিয়েছিল, আর কাউকেই কোন কিছু জানাতে পারলো না সে। যেমন জানাতে পারেনি মাহিমা। জানাবে কি করে? বোবা মেয়ে, কথাই তো বলতে পারে না, বয়স দু’বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ওর মুখে স্বাভাবিক ভাবে কথা ফুটলো না, তখন বাজারের ডাক্তার পরীক্ষা করে মাহিমার বাবা-মাকে জানালো, ও কানেও শোনে না। শুধু মুখ দিয়ে এক ধরনের অর্থহীন শব্দ করতে পারে মাহিমা। হাত পা নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে বোঝাতে পারে নিজের মনের কথা। সেই মাহিমা, যে কচি লাউডগার মতো হাতে পায়ে ডাঙ্গর হয়ে উঠছিলো, কথা না বলতে পারলেও মায়ের দেখাদেখি গেরস্থালি কাজ কর্ম শিখেছিল, একটু আধটু রান্না-বান্নাও করতে পারতো। বৃহস্পতিবার, দুপুরে গোসল করে উঠানের তারে পরনের নীল জামাটা ধুয়ে রোদে মেলে দিয়েছিল মাহিমা, সন্ধ্যা বেলা যখন মুরগীগুলো খোপে ফিরে আসছিলো, সারাদিন রোদের তাপে বাতাসের টানে ভেজা কাপড়গুলোও যখন প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল, তখন থেকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না মাহিমাকে। চাঁনপুরের সব জায়গাতে, আত্মীয়-স্বজন-পাড়া প্রতিবেশির বাড়িতে অনেক খোঁজাখুজি করেও মধ্য রাত পর্যন্ত মাহিমাকে, বোকা বোবা মেয়েটাকে খুঁজে পেল না কেউ। কে জানে, তার নীরব আর্তনাদ, তার অস্পষ্ট গোঙ্গানি হয়তো বাতাসে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছিল। চিৎকারের চেষ্টায় হয়তো তার গলা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। মাহিমার মা হয়তো তার নির্বাক মেয়ের জন্য কাঁদছিল আকুল হয়ে, 

‘ও মাহিমারে, ও মায়ুরে, তুই কই গেলিরে মা।.’ 

আহা বোবা মেয়েটা, যখন দুইটা শক্ত হাতে তার গলা টিপে ধরা হয়েছিল তখনও হয়তো কোন শব্দ করতে পারেনি। গোমতির জলে যখন তাকে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় তখনো সে নিশ্চুপই ছিল, তার বারো বছরের জীবন জগৎ ভাষাহীন, শব্দহীন আর্তনাদের ভেতর দিয়েই চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। 

দিনমজুরের দরিদ্র কন্যারা কি কখনো কাউকে ভালবাসতে পারে? লাকি, বিউটি, নার্গিস বা যে কোন নামই হোক তার, কোনদিন কি সে ভালবেসেছিলো কাউকে? তার সরল কিশোরী চোখে রঙীন সানগ্লাস পরা, গলায় সোনার চেইন ঝোলানো মহিলা মেম্বরের এইট পাশ ছেলেকে কখনো কি যুবরাজের মতো লেগেছিল? যার ক্ষণিক চাহনি তার হৃদয় ছুঁয়ে মর্মে দোলা জাগিয়েছিল। যাকে সে সর্বস্ব দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল, তারপর সেই নিবেদনের ইচ্ছা কবে যে উজ্জ্বলতা হারিয়ে সিলেটের বৃক্ষহীন টিলাগুলোর মতো ধূসর থেকে ধূসরতর রং ধরলো! বিউটি বা লাকি অথবা কোন দিনমজুরের কন্যা, যার মোটা নাকে একটা লাল পাথরের সস্তা নাকফুল, গোলাকৃতি শ্যামলা মুখে একজোড়া ঘন মোটা অবিন্যস্ত ভ্রুর নিচে কালো গভীর চোখ, ঠোঁটের উপর হাল্কা নরম লোমের রেখা। সেই মেয়েটি কখনো কোনদিন হয়তো কাউকে নীচু গলায় লাজুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল, 

‘আমারে কবে বিয়া করবা মেম্বরনির ফোয়া? গোপনে ইতা আওন- যাওন ভালা দেহায় না বা।.’ 

‘বিয়া? ছবুর আলীর ফুড়ি’রে? হুহ্ ! তরার লগে আমরার মিলেনি কুনু বায়? বউ আছে না আমার ঘরোত! তাইন ভালা ঘরের ফুড়ি !’ 

‘তাইলে কেনে আইয়ো তুমি? আইজ থাকি আর কথা নাই তুমার সাথে, বিয়া ছাড়া তুমি পর পুরুষ হইবায়, তুমার লগে আর সম্পর্ক রাখতাম নাই।.’ 

বিউটি বা লাকি বা ঘন ভ্রুয়ের মেয়েটি হয়তো সত্যিই সম্পর্ক রাখতে চায় নাই মেম্বরনির বখাটে ছেলের সাথে। হয়তো ছবুর আলী তার মেয়ের বিয়ের জন্য অন্য কোথাও সম্মন্ধ করার চেষ্টা করেছিল। হয়তো কোন ভ্যানচালক বা আরেকজন দিনমজুরের সাথে, হয়তো যাকে পছন্দ ছিল না লাকির। হয়তো আবার সে মেম্বরনির পোলার মিষ্টি কথায় ভুলেছিল, হয়তো বিয়ের লোভ, হয়তো ঘরের স্বপ্ন তাকে ঘর ছাড়া করেছিল বা ক্ষমতা প্রদর্শনের বিকৃত আনন্দে হয়তো তাকে অপহরণই করা হয়েছিল। জোর করে কাউকে কোথাও নিয়ে যাওয়া, প্রতারণা করে, ফুঁসলিয়ে বা ভুল বুঝিয়ে বা ভয় দেখিয়ে বা যে কোন উপায়ে যেভাবেই নিয়ে যাওয়া হোক, সে তো অপহরণই। নার্গিস, বিউটি বা লাকি যে নামই হোক অপহৃতার, কি আসে যায় তাতে? হতে পারে না বুঝে মেম্বরের ছেলের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির জালে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল সে। কিন্তু প্রেমহীন বন্দি থাকার প্রতিটা মূহুর্ত তাকে কি তিল তিল করে উপায়হীন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় নাই? প্রতারিত হতে হতে, অসম্মানিত হতে হতে সে কি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠে নাই বেদনার ঈশ্বরী? 

‘বিয়ার মাত তো দেহি আর মাতো না বা, অ মেম্বরনির ফোয়া? মিছা মাত মাতিয়া আমারে ঘরতন বাইর করছো, আমার মুখ পুড়াইছো তুমি।.’ 

‘ইতা কতা বাদ দে ছবুর আলীর ফুড়ি, খালি বিয়া, বিয়া। বিয়া বাদে অইবনে। অকন নিজোর ঘরোত যা। টাইম অইলে আমি আইমুনে।’ 

‘তুমি আমারে মিছা মাতিয়া ধোঁকা দিলায় কেনে মেম্বরনির ফোয়া, আমারে নষ্ট করলায়, মিছা আশা দিয়া আমারে’নি বাউল করিমের কূল হারা কলংকিনি বানাই দিলা।.’ 

‘আরে আরে, কামলার ঝি, কইলাম তো, টাইম অইলে যামুনে।.’ 

এক মাস পর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরাজিত আর বিপর্যস্ত শরীরটা টেনে, ছেঁড়া ওড়নায় মুখ ঢেকে যখন সে ফিরে এসেছিল বা তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল পিতৃগৃহে, তখন সে তো এক প্রকার মৃতই, তার ক্ষয়গ্রস্থ দেহে তখন শুধু ধ্বংসের চিহ্ন, তার নির্যাতিত আত্মায় তখন শুধু অসহায় ক্রন্দন। তখন কি কেউ তাকে একবারো জীবনের গান শুনিয়েছে? কেউ কি বলেছে, এ দুঃসময় থেকে একদিন মুক্ত হবে তোমার আহত প্রাণ, নাকফুলের লাল পাথরের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠবে স্বপ্নসূর্য। 

‘এই ফুড়িরে আর বিয়া দিতা পারবানি? এর লাগি ছুট্টু বইনান্তেরও বিয়া অইত নাই। এরে মারি ফালাইলে আর কিতা অইব? বরং বাঁচবায়, মেম্বরনিও শায়েস্তা অইব ...।.’ 

কুচক্রীদের এমন কথায় জনকের মনে হয়তো খানিকটা দ্বিধা ছিল, হয়তো ছিল না, কিন্তু একবার মরে যাওয়ার পর, সতীত্ব হারানোর অজুহাতে যতবার বিউটি বা লাকি বা যে কোন নামের মেয়েটিকে খুন করা হোক, তাতে তার কি-ইবা আসে যায়? সেই হত্যাকারী হোক তার পিতা, হোক চাচা, হোক ভাই, গ্রামবাসী, দেশবাসী, প্রতিবেশি বা পেশাদার ভাড়াটে খুনি, কে আর নতুন করে কোন মৃত্যুর দুয়ারে পৌছে দেবে তাকে? 

যখন জন্মদাতার সম্মতিতেই মেয়েটি মৃত্যুর ঘোলা সমুদ্রে বার বার ডুবে যাচ্ছিলো, তখন কি তার মুমূর্ষ বিপন্ন আত্মা একবারো আশা করে নাই, উদ্ধারকারী হয়ে কেউ আসুক, একবার হাতটা ধরে বাঁচাক তাকে। ‘ও মেম্বরনির ফুয়া, তুমার দিলো কি কুনু কিছু জানান দেয় না? তুমার শইল্যে কি কুনু দরদ নাই? তুমি এই নিদান কালেও আইতায় না? বাঁচাইতা না তুমার লাকিরে?’ 

এই সব বিলাপ আমরা শুনি না, জানি না। জানতেও চাই না। 

এই যে এখানে ঝিঁঝিঁ ডাকা একঘেয়ে অন্ধকারে বিবর্ণ ঝোপের ভেতর, খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে স্থির নীরব নিস্পন্দ মেয়েটা, এই যে হাওড়ের খোলা প্রান্তরে ধানক্ষেতের পাশে হাত পা ছড়িয়ে একটা লাল পোকার মতো মরে পড়ে আছে শীর্ণদেহী মেয়েটা, নিথর ও শীতল, দুর্বা ঘাসে যার রক্ত লেপ্টে আছে কালো হয়ে, লক্ষ লক্ষ বিষাক্ত ক্ষত যার দেহে, নাম কি তার? তাদের? বিনু, তনু, ইয়াসমিন, রূপা, তানহা, মাহিমা, লাকি নাকি বিউটি? কী সুন্দর থোকা থোকা ফুলের মত নাম মেয়ে গুলোর। শিশুগুলোর। মৃতদেহগুলোর। 

অভাবের সংসারে যখন দু বেলা ভাতই জোটে না তখন দুস্প্রাপ্য চকলেটই হয়তো বড় প্রিয় ছিল এই শিশুটির কাছে। আইসক্রীম পেলে তো কথাই নাই। শিশুটিতো জানে না এই চকলেট বা আইসক্রীমের ফাঁদ পেতেই তাকে বন্দী করছে তারই চেনা কোন মানুষ। সে তো জানে না, তার অপরিণত অঙ্গ, তার অপ্রস্ফুটিত দেহতেও লালসার আঘাত করতে দ্বিধা করবে না সেইসব নৃশংস কাপুরুষের দল। তারা শিশুদের হাসি মুছে দেবে, চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেবে অবিশ্বাসের অন্ধকার পর্দা, গাছ থেকে নিষ্ঠুরভাবে ছিঁড়ে নেবে গোলাপের কোমল কুঁড়ি। আমরা কি কখনো ভাবতে পারবো সেই শিশুটির কথা, জগত-জীবন সম্পর্কে কী নিদারুণ ভয়াবহ ধারণা নিয়ে যে চলে গেল মৃতদের জগতে। 

হায় ! এই পৃথিবী কেন এখনো ধ্বংস হয়ে যায় নাই? কেন আকাশ থেকে নেমে আসে নাই বিধ্বংসী বজ্র? কেন শুকিয়ে যায় নাই হাওরের সব জল? কেন পুড়ে খাক্ হয়ে যায় নাই সমস্ত সবুজ? গোমতির প্রবল স্রোত কেন ফুঁসে উঠে ডুবিয়ে দেয় নাই সব চরাচর? আর কিসের অপেক্ষা? আর কি বাকি আছে? রে মানুষ, রে পাথরহৃদয় মানুষ, যে ঘটনায় বনের পশু পাখির চোখেও জল আসে, যে ঘটনায় প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে যায়, ব্যাথায় মুষড়ে পড়ে জগতের সমস্ত আনন্দ ফুল, সেই ঘটনায় তোর হৃদয় কি বিদীর্ণ হয় না? 

মৃত্যুর ফেরেশতার পাষাণ বুকটাও কি একটু কেঁপে উঠে না, দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহগুলো থেকে আত্মা খুলে নিতে। কিন্তু তোমরা কি জানো না, মৃত্যু জন্মের মতোই স্বাভাবিক, প্রতিটি জীবনের আসল গন্তব্য তো মৃত্যুই। তবে মৃত্যুর ফেরেশতা নিশ্চয়ই জানে, এদের জীবনে মৃত্যু এসেছে অসময়ে, বিভীষিকা হয়ে। 

‘মৃত্যুর ফেরেশতা, আমরা কী তবে মরে গেছি?’ 

‘ আহ্! চুপ করো। মৃতেরা কখনো শব্দ করে না। তোমাদের মেরে ফেলা হয়েছে মেয়ে, ভুলে গেছো?’ 

‘এসব কি তবে সত্যিই ঘটেছে? আমরা তো ভেবেছিলাম, ভয়ংকর বীভৎস এক দুঃস্বপ্ন দেখছি শুধু। দেখছিলাম, হিংস্র কিছু অচেনা প্রাণী নির্মমভাবে অত্যাচার করছিল আমাদের উপর। খুবলে খাচ্ছিলো মাংস, টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছিল চুল, গুড়া গুড়া করছিল পাঁজরের হাড়, শুষে নিচ্ছিলো রক্ত, নিঃশেষ করে দিচ্ছিলো সমস্ত শক্তি, ভয়ে ঘৃণায় দুঃখে আমরা কুঁকড়ে ছিলাম, চেতনারহিত ছিলাম .. ভেবেছিলাম, ঘুম ভেঙে গেলেই এই অভিশাপ মুছে যাবে। এই অসহ্য যন্ত্রণা, এই দুঃসহ অপমান থেকে মুক্তি পাবো।’ 

‘না, মেয়েরা দুঃস্বপ্ন নয়, ওটাই সত্যি।’ 

‘সবাই কি জেনে গেছে, আমরা মারা গেছি? বাবা মা, ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি..।.’ 

‘পৃথিবীর সবাই জানে তোমাদের মেরে ফেলা হয়েছে ।.’ 

‘হায় ! মৃত্যুর ফেরেশতা, কত কষ্ট পাচ্ছে তারা, তুমি তাদের কাঁদতে মানা করো, বলো, আমরা পাখি হয়ে কোথাও উড়ে গেছি, বলো, নক্ষত্র হয়ে আকাশে জ¦লে আছি কিংবা পাথর হয়ে জমে গেছি পাহাড়ের গায়ে, বলো আমরা ধুলিকণা হয়ে মাটির সঙ্গে, বাস্প হয়ে মেঘের সঙ্গে, স্রোত হয়ে হাওড়ের কালো পানির সঙ্গে মিশে গেছি ।’ 

‘তোমাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবন শুরু হয়ে গেছে মেয়েরা, এখন তোমরা দৃশ্যে নেই, দৃশ্যান্তরে আছো, তোমাদের দেহ নেই শুধু দেহের অনুভব আছে, ভালবাসা নেই কিন্তু ভালবাসার ইচ্ছা আছে, অঙ্গ নেই কিন্তু প্রিয় মুখগুলোকে আবার ছুয়ে দেখার করুণ ইচ্ছা আছে, অস্তিত্ব নেই তবু খাঁ খাঁ তৃষ্ণা আছে ..। ’ 

ক্রমে চর্তুপাশে নীরবতার জমাট দেয়াল নেমে আসে, নেমে আসে ম্লান নৈঃশব্দ, বয়ে চলা বাতাস থেমে যায়, আলো নিভে যায়, একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস হাহাকারের মতো বেজে উঠে দিগন্ত জুড়ে। 

‘.. .. এটাই রীতি, এভাবেই এখন থাকবে তোমরা, শুধু জেনে রাখো, জন্মান্তরের বেদিতে তোমাদের নাম করে বেঁধে দিয়েছি প্রত্যাবর্তনের উজ্জ্বল বেগুনি সুতা। হয়তো আবার জন্মাবে এ দেহ, হয়তো আবার ফিরে আসবে তুমি, বিগত জন্মের শোক আর অপমানের চাদর গায়ে দিয়ে। হয়তো তোমার চোখের মণি হবে গাঢ় নীল, সারা দেহে থাকবে বিষণ্ন কাঁটা, হয়তো অপাপবিদ্ধ শুদ্ধ তুমি জেগে উঠবে পুর্ণবার। জেগে জেগে দেখবে বিস্ময় বিস্মৃত আধপোড়া জীবনের স্মৃতি জন্ম দাগ হয়ে তোমার পিঠে কালশিটের মতো, বিষাদের গাঢ় সবুজ ফুল হয়ে ফুটে আছে। তুমি জেগে উঠবে, নিশ্চয়ই একদিন জাগবে।’


লেখক পরিচিতি
শাহ্‌নাজ মুন্নী 
জন্মস্থান : ঢাকা 
জন্মতারিখ বা শাল: ৮ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬৯। 
পড়াশুনা—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স 
বর্তমানে কোথায় থাকেন—ঢাকায় 
প্রকাশিত বইয়ের নাম--(গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি সঙ্গে প্রকাশকের নাম ও ঠিকানা)।
 ------------------------------------------------------------------- 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ