মধুময় পাল'এর গল্প : অপারেশন লালমোহন

গাছ এল। এরিক পাম, জিঞ্জিবার ম্যাক্রাডেনিয়া, ঝুলনলতা, রূপসীলতা, চিত্রলেখা, বারগ্যান্ডি, কর্ডিলাইন, কচুগুন্ডুবি, সাইকাস, আইভি। এবং আরও, যাদের নাম মাধব মণ্ডলের কিছু জানা নেই, কিছু মনে নেই। এককালে গাছপালা নিয়ে পড়বে ও পড়াবে ভেবেছিল। বেঁচে থাকার প্রয়োজনটা তাকে এমন পেশায় টেনে আনে যেখানে বিস্তর হাবিজাবি জিনিস মাথায় টাটকা করে রাখতে হয় এবং নিজের পূর্বপুরুষ ও আত্মীয়স্বজনের নামও আবছা হয়ে যায়।

শিশুদের ধরে এনে যৌন নির্যাতন করে হত্যা করত কে? কোন মেয়েকে কবি বানানো ও বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্তঃসত্ত্বা করে খুন করেছিল কে? সংসদে কোন সরকারের আস্থা প্রস্তাবে ভোট দিয়ে কারা কত কোটি টাকা নিয়েছিল? আস্তাকুঁড়ের ইতিহাস। তবু তো এসব সাম্প্রতিক ঘটনা। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের বা কলকাতার পুলিশ কমিশনারদের বা রাজ্য পুলিশের ডিজি-দের নামের তালিকা থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অধিবেশনের দিনক্ষণ থেকে ভাঙনের ইতিহাস থেকে আরও আরও ভেঙে যেতে থাকার ইতিহাসও তাকে মনে রাখতে হয়। 

এইমনে রাখার ওপরই কর্মক্ষেত্রে তার কদর। মাধবদা, শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা কবে হয়েছিল? মাধবদা, নেলসন ম্যান্ডেলা কবে ছাড়া পেলেন? ইন্টারনেট চলে আসার পরও সে ফালতু হয়ে যায়নি এই জন্য যে বাসে যেতে যেতে বা সুকিয়া স্ট্রিটের ফুটপাথে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বা লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ভারতে রেপ অ্যান্ড মার্ডার বা পশ্চিমবঙ্গে লকআপ ডেথ-এর একটা নির্ভরযোগ্য সাম্প্রতিক হিসাব বলে দিতে পারে। কিন্তু এই মনে রাখার অভ্যেসে নিজের কাছে নিজেই যে ফালতু হয়ে গেল। 

লরি করে গাছ এসেছে। বাড়ি সাজানোর গাছ। কয়েকশো হবে। থানার বারান্দার বেঞ্চে বসে মাধব মণ্ডল দেখে লরি থেকে টবের মাটিতে দাঁড়ানো এক-গা খুশিতে ডগমগ সবুজ সজীব গাছ একটি একটি করে আদরে আপ্যায়নে নামানো হচ্ছে। ছোটোবেলায়, মানে স্কুল-শেষের পরীক্ষায় এককথায় প্রকাশের সম্ভাব্য একটি প্রশ্ন হিসেবে সে মুখস্থ করেছিল, সম্মুখে অগ্রসর হইয়া আগমনকারীকে অভ্যর্থনা জানানো = প্রত্যুদ্‌গমন। এখানকার ব্যাপার স্যাপার দেখে সেই প্রত্যুদ্‌গমন শব্দটা মনে পড়ে গেল। তত্ত্বাবধান করছে এলাকার শান্তি কমিটির উপদেষ্টা শান্তিস্বরূপ দিকপতি। দোতলার বারান্দা থেকে বড়োবাবু মল্লার দত্ত একবার দেখে গেছে। 

এখন আকাশের নীচে একটা আকাশ দাঁড়িয়েছে। মেঘের আকাশ। হাওয়া দিচ্ছে, দূরের বৃষ্টির হাওয়া। আজ জনসংযোগ হবে থানায়। 

সাপ্লায়ার মাঝে মাঝে বলে উঠছে, সাবধানে নামা। কোথাও চোট না লাগে। পাতা চোট খেলে তোদের মাথা চোট খাবে, মনে রাখিস! টবে যেন আঁচড় না লাগে। নিজের গাড়ির চকমাচক ব্যাকগ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে স্যুট-বুট পরা পাঁচ-ফুটি চিমনির মতো সাপ্লায়ার ধোঁয়া উড়িয়ে চলেছে। আর, ফাঁকে ফাঁকে উষ্ণায়ন ও সবুজায়ন নিয়ে একই পোস্ট এডিট করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঝেড়ে যাচ্ছে। লোকটা এলাকার অফিসে দোকানে বাড়িতে গাছ দেয়। পোলিও ড্রপের মতো ফোকটে নয়, বাজারের চেয়ে বেশি দামে। এর কাছ থেকেই নিতে হবে, এরকম একটা হুকুমনামা জারি আছে। এলাকার সবুজ সম্পর্কে এই সাপ্লায়ারের চেয়ে ভালো কেউ ভাবতে পারে না, এরকম রায়ও আছে মাতব্বরদের। মাধব মণ্ডল এসব জানে। সাপ্লায়ার লোকটা প্রায় সব জায়গাতেই ম্যাটার করে। এভাবেই ওর মাপটা বোঝায় এলাকার বাসিন্দারা। চুন বালি পাথরও দেয়। কোথায় কোথায় নতুন বাড়ি হচ্ছে, কারা করছে, কোথায় জমি লুট হচ্ছে, কোন দাদারা লুটছে, শরিকি বিবাদের ফোঁকর দিয়ে কে কোথায় মাথা গলাচ্ছে, সব খবর সাপ্লায়ারের ল্যাপটপে মজুত রাখতে হয়। 

একটি একটি করে গাছ নামে। সাজানো হতে থাকে উঠোনে সিঁড়ির গায়ে বারান্দায় রেলিংয়ে। সবুজ হতে থাকে থানা চত্বর। একটু ঘেঁষাঘেষি হয়। জায়গার তুলনায় গাছের ভিড় বেশি। শান্তিস্বরূপ বলে, দু থাক-তিন থাক করে বসিয়ে দে। পরে নীচে ইট লাগিয়ে মেক্সিকান ওয়েভ করে দেব। 

সাপ্লায়ার লোকটা হালকা চিৎকারে বলে ওঠে, ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া! এই না হলে শান্তিদা! কীরকম লাতিন আমেরিকান টাচ দিয়ে দিলেন! 

শান্তিস্বরূপ সাপ্লায়ারকে থামায়। বলে, মেক্সিকো ঠিক লাতিন আমেরিকা নয়। তবে মোর ক্লোজ টু লাতিন আমেরিকা দ্যান সেন্ট্রাল। 

ঠান্ডা হাওয়া আর মেঘের গম্ভীরা ভেঙে শুয়োরের আর্তনাদ ভেসে আসে। হঠাৎ। মাধব মণ্ডল চমকে যায়। গোবরার ধোপার মাঠে শুয়োরের পশ্চাদ্দেশে লাল-গরম শিক ঢুকিয়ে সবচেয়ে উপাদেয় রূপে হত্যা করা হত। মাধব মণ্ডল অনেক শুনেছে এই আর্তনাদ। পরে অবিকল শুনেছে জোড়াবাগান থানার লকআপে। প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার স্মৃতিটা গোবরার ধোপার মাঠ থেকে জোড়াবাগানের লকআপের বীভৎস জান্তবতায় মাধব মণ্ডলের মাথায় পাক খায় কিছুক্ষণ। 

সে দেখে শান্তিস্বরূপ মিটিমিটি হাসছে। বলছে, এখন বাজায় না, বাবা! এখন গাছ আসছে। সেতার বাজাও। সরোদ বাজাও। কল অফ ভ্যালি বাজাও। সন্তুর চলবে। শিবকুমার শর্মা। দারুণ! উপত্যকায় রক্তপাতের সময়ই তো বেশি করে বাজাতে হয়। বাজাও। তোমার তো দারুণ লাগে! পরে যখন বলব, ক্রাইসিস বাজাবে। তুমি তো সব বোঝো, বাবা, আমরা মুশকিলে না পড়লে ক্রাইসিস কেন বাজাবে? গাছ এসেছে। সাজানো হচ্ছে। সবুজ হচ্ছে। থানা সম্পর্কে ভুল ধারণাটা বদলে দিতে হবে, তাই তো, বাবা! উপত্যকার সুরে ভরে দাও। রক্তপাতের ওপর দিয়ে সুরের ঝরনাধারা। কী যেন গানটা, হ্যাঁ গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায় এলে, হুঁ-উ হুঁ-উ, যে সুর গোপন গুহা হতে ছুটে আসে আপন স্রোতে... মনে পড়ছে না। বাজাও। 

কাকে বলা হল, মাধব মণ্ডল বুঝতে পারে না। কিন্তু কাজ হল। তপ্ত শিকবিদ্ধ শুয়োরের আর্তনাদটা থেমে গেল। 

সাপ্লায়ার বলে, দারুণ! আমাদের টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে বাজাব। বিশ্বকাপের ভুভুজেলার চেয়ে ফিফ্‌টি পার্সেন্ট বেশি লাউড, হান্ড্রেড পার্সেন্ট বেশি এফেক্টিভ। 

সাপ্লায়ার লোকটার চোখে-মুখে পাশব উল্লাস ঝিকিয়ে উঠতে দেখে মাধব মণ্ডল। লোকটা পাড়ায় ফাংশন অরগানাইজ করে, খেলা অরগানাইজ করে, মিছিল-টিছিলও। হাতে প্রচুর কর্মী। সাপ্লাই দেয়, যেখানে যেমন লাগে। 

সন্তুর আর বাঁশি বাজে। এরিকা পাম দোলে। রূপসীলতা দোলে...। থানা এত সবুজ হয়ে যেতে থাকে যে ভাবা যায় না এটা থানা। বড়োবাবুর ঘরের সামনে পেতলের টবে এরিকা পাম। এত সুন্দর গড়ন যে মনে হয় সুসময়ের করিশ্মা কাপুর বা চোখের বালির ঐশ্বর্য রাই। বড়োবাবুর ঘরের ভেতরে ঢোকে পেতলের গামলায় বারগ্যান্ডি। একটা ছবিতে মাধব মণ্ডল দেখেছিল। গরিব চীনকে নিয়ে তৈরি ছবি। সামন্ত পরিবারের সুদর্শন যুবক হতদরিদ্র কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তরুণীকে টার্গেট করে। প্রেমের অভিনয়ে তুলেও নেয়। নিয়ে আসে তার ভোগের বাড়িতে। বাড়িটা মোটামুটি সাজানো-গোছানো। শিকার নিয়ে এসে তার একা খেলার জায়গা। তরুণীটি ধর্ষিত হওয়ার পর, শরীর-জোড়া তীব্র যন্ত্রণা সয়ে তরুণীর বোধে প্রথম প্রেমপর্বের পর, ঘরের ভেতর সাজানো গাছের টবে টবে জলধারা দিয়েছিল এই ভেবে যে এই ঘর তার, এই সব গাছ তার, তার যন্ত্রণার মতো প্রেমের মতো গাছের গোড়াগুলো স্নান চায় স্নেহ চায়। যুবক তড়িঘড়ি সব দাগ মুছে, নগ্ন তরুণীকে নতুন পোশাকে মুড়ে পথে ছেড়ে দেয়। এক গোছা টাকা বের করেছিল যুবক তরুণীর দারিদ্র্যের সামনে। মেয়েটি নেয়নি। ঠিক এইরকম পেতলের টব ছিল পেতলের গামলা ছিল যুবকের শিকারের ঘরে। চিত্রলেখা দোলে। আরও সব গাছ দোলে। যাদের কিছু নাম মাধব মণ্ডল জানে না, কিছু ভুলে গেছে। 

মাধব, কেমন লাগছে? সবুজের মধ্যে থাকলে মনটা জুড়িয়ে যায়। আরও সবুজ করে দিতে হবে। এর পর ওই মাঠে সবুজ যাবে। জনসংযোগে সবুজ না থাকলে কালারটাই আসে না। প্রত্যেক বছর মন্ত্রীদের ফুটবলে কিক্‌ মারার ছবি এত ন্যাড়া ন্যাড়া ছাপা হয়, বিচ্ছিরি লাগে। কাগজে তবু একরকম। আমরা বলে দিই, ফটোশপে ম্যানেজ করে নেয়। টিভিতে যাচ্ছেতাই রকমের বিচ্ছিরি। সব চ্যানেল এখনও আমাদের হয়নি। যত্ন নিয়ে এডিট করে না। জানোই তো সব। তোমার মাসির বাড়ির খবর। আগের ওসি-কে বলেছিলাম। হোক না দেড় কাঠা, আমরা তো মাঠই বলি। প্রত্যেক বছর এখানেই জনসংযোগের প্রোগ্রাম হয়। শোনেনি, বদলি হয়ে গেল। মল্লারটা ভালো। সাদাসিধে। যা বলি, শোনে। ও জানে কেন ওসি। শান্তিস্বরূপ বলে। 

মাধব প্রশ্ন করে, জঙ্গলমহলের এত সবুজেও কেন সেখানকার মানুষরা আর জুড়িয়ে থাকছে না? 

দ্যাটস নুইসেন্স! শান্তিস্বরূপ হঠাৎ চটে যায়! 

কারা? যাদের পিটিয়ে অন্ধ করে দেওয়া হল, হাড়গোড় ভেঙে দেওয়া হল, গর্ভবতীর পেটে লাথি মারা হল, তারা নুইসেন্স, নাকি যারা মারল? মাধব জানতে চেয়ে সোজা শান্তির চোখে চোখ রাখে। 

শান্তিস্বরূপের মাথার সামনের দিকে চুল বিশেষ নেই। যে কটা আছে তা হাতের তেলোয় প্রাচীন গর্বের স্পর্শে পেছনে ঠেলে, পেছনের অবশিষ্ট কিছু চুলে ক্রমহ্রাসমান রাগানুরাগে আঙুল বোলায়। বলে, আমি সবচেয়ে নরম শব্দটা ব্যবহার করেছি, মাধব! ওদের বর্বর বলতে আমাকে বাধ্য কোরো না। জানি, ওদের মধ্যে তোমার বন্ধুবান্ধব আছে, থাকতেই পারে, কিন্তু ওরা মানুষ নয়। মানুষ নয় বলেই জঙ্গল বেছে নিয়েছে। আর, যারা জঙ্গলের সন্তান, সেই নিরীহ আদিবাসী মানুষদের অস্ত্রের মুখে চালাচ্ছে। কথা না শুনলে পুলিশের চর বলে খতম করে দিচ্ছে। রোজ লাশ ফেলছে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে তোলা তুলছে। অস্ত্র কিনছে। মেয়েমানুষ করছে। এই ঘৃণ্য জানোয়ারগুলোর কথা বোলো না! 

এই জবাবটাই দেবে শান্তিস্বরূপ, জানে মাধব। এই লাইনেই বলে যেতে হবে ওকে। শান্তিস্বরূপরা নির্দিষ্ট একটা সময়ে সারা দেশে মাঠে মঞ্চে গলিতে দপ্তরে ঠেকে বৈঠকে বারান্দায় রান্নাঘরে বেদিতে এক ভাষায় এক কথা বলে যেতে পারে। এতটাই রেজিমেন্টেড। তবে কেন মাধব প্রশ্নটা করল? শান্তিস্বরূপের মধ্যে আগেকার শান্তির ভগ্নাবশেষ আছে কিনা জানতে? জবাবে নিজেকেই মাধব বলে, ম্যাচিওর হওয়ার আগেই তুই মরে যাবি! যা। 

মাধব, একটু আগে তোমাকে যা বলেছি, এখন আরও এম্‌ফ্যাসিস দিয়ে বলছি, তোমার মনটা মফস্‌সলের নিষিদ্ধপল্লীর ডিস্‌পেন্সারি হয়ে গেছে। শুধু বাচ্চা আটকানো, নয়তো বাচ্চা নষ্ট করার ওষুধ, কিংবা গোপন কুৎসিত আধিব্যাধির ওষুধের দোকান। নিজে একটু খুশি থাকা, অন্যকে একটু খুশি করার ওষুধ তোমার দোকানে নেই। 

শান্তিকে তখন যে জবাব দিয়েছিল, সেটাই সংক্ষেপে মাধব আবার বলে, আমার নিজের কোনো দোকান নেই। অন্যের দোকানে কাজ করে গেলাম। এর সঙ্গে যোগ করে, শান্তি, তুমি কি ওষুধের দোকানে কস্‌মেটিকস্‌ বিক্রির কথা বলছ? তা এখন অনেক দোকান করে। আমার মালিককে বলে দেব। 

তোমাদের এই শালীন ভাষাটাই নৈরাজ্যের বন্ধু। একজন লিখেছেন, ‘যা ঘটে তা সত্য নয়, সেই সত্য যা রচিবে তুমি।’ এসবের মানে কী? এভাবে বলার মানে কী? আমরা কি ইয়ে, হুড়কোর টার্গেট বুঝি না? যেদিন তব্‌লি ফাটিয়ে দেব, টের পাবে! হাতে নিয়ে ফুটপাথে বসে থাকবে, নড়তে পারবে না। শান্তিস্বরূপের ডানদিকের কুকুরের দাঁতটা বেরিয়ে আসে। 

মাধব মণ্ডল জিজ্ঞেস করতেই পারে, কেন লেখা হয় এসব? আগে কি লেখা হয়নি? তখনকার লেখা কি তোমরা নিজেদের দিকে টেনে নাওনি? জিজ্ঞাসা করলে বাঁদিকের কুকুরের দাঁতটাও বেরিয়ে পড়বে। আপাতত উপত্যকায় থাকুক শান্তিস্বরূপ। ঝাউ দোলে। বাঁশিতে-সন্তুরে মনের ভেতরে একটা উদাস-ছুট লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। 

শান্তিস্বরূপের মাথাটা আগে এরকম ছিল না। অনেক দিন দেখছে মাধব। যখন খেলত, একমাথা চুলে জোহান ক্রুয়েফের মতো লাগত। উকিলবাড়ির বড়ো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করত। ডি ভি সি খালের বিকেলের ব্রিজে ওদের দেখা যেত। মেয়েটা বাড়ির ভয়ে দু মাইল সাইকেলে গিয়ে ঝকঝকে বিকেলেই ফিরে আসত। অবশ্য কলেজে ভরতি হওয়ার পর ভয়টা ফিকে হয়। ব্রিজের বিকেল সন্ধে হয়েছে হাত ধরাধরি কাছাকাছি করে। তখন শান্তিকে চারুলতার অমল লাগত। আবৃত্তি করে চমকে দিয়েছিল কলেজ সোশ্যালে: ‘টুকরো টুকরো করে ছেঁড়ো তোমার/অন্যায় আর ভীরুতার কাহিনী।/শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে/একত্রিত হোক আমাদের সংহতি।’ ১৯৬৭। বাতাস তখন আগুনমুখো। কলেজ থেকে বেরিয়ে কিছুদিন জীবনানন্দ নিয়ে কাটে। সে-সময় মাধবের সঙ্গে মেলামেশা বাড়ে। কিন্তু জীবনানন্দ বেশিদিন ভালো লাগেনি ইন্‌হেরেন্ট মরবিডিটির জন্য। নিখিলদা তুলে নিল শান্তিকে রাজনীতিতে। তখন তার মুখে মাধব শুনেছে মায়াকোভস্কি। ‘আমার কবিতা মরুক/সৈনিকের মতো,/যেমন আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে/মরে আমাদের নামহীন কেউ।/তাল তাল ব্রোঞ্জ/আমি তার থোড়াই পরোয়া করি,/তোমাদের চকচকে শ্বেতপাথর/আমি তার থোড়াই পরোয়া করি।/গৌরবের অংশীদার হওয়া?/তাহলে নিজেদের মধ্যে বলা যায়/আমাদের দ্বারা স্থাপিত/একটি মাত্র সম্মিলিত/কীর্তিস্তম্ভ/থাকুক,/সমাজতন্ত্র।’ 

শান্তিস্বরূপ এখন সাপ্লায়ারের গা ঘেঁষে কথা বলছে। গলা নামিয়ে। হতে পারে, মাধব মণ্ডলের কথাই বলছে। মাধব একটা নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারণ করেছে থানার ভেতর। জঙ্গলমহল। এটা জানাজানি হলে শান্তিস্বরূপের সাংগঠনিক দক্ষতা, এমনকি সংগঠনের প্রতি আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠে যেতে পারে। সেটাই হয়তো সামলাচ্ছে শান্তিস্বরূপ। 

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে পাক ফৌজি আর রাজাকারদের অত্যাচারে রাগে ক্রোধে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখলেন, ‘ক্ষমা? ক্ষমা নেই!’ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জবাব দিলেন, মনে করতে পারে মাধব, শান্তি সেই কবিতা এনে শুনিয়েছিল তাকে, ‘সুভাষ! যা দেখেছেন যশোহরে, মণিরামপুরে; যে পিশাচ/জল্লাদ মেহের আলি -- তার কীর্তি পাশবিক ধর্ষণ ও নরহত্যা:/চোখে কি পড়েনি অন্য এক বাংলায়, যা আপনার স্বদেশ, সেখানে/ঐ কালো ছায়া -- ঐ ভয়ঙ্কর মুখ! মানুষের মাংসপিণ্ড লোলুপ নরখাদক/আমাদের আকরমের মায়েদের থালায় লাথি মেরে/নিয়ে যায় আকরমকে থানায়; বেয়নেট খুঁচানো ইসমাইল পড়ে থাকে/নির্জন খালের ধারে...’। মাধব মনে করতে পারে, শান্তিরও রাগ হয়েছিল। বলেছিল, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এত উদাসীন কেন? কেন পলাতক? কেন এই দ্বিচারিতা? অন্যের শিশু কাঁদলে উদ্বেগ, নিজের সন্তানের কান্নায় বধিরতা? আমেরিকায় নিগ্রোকে পুলিশ মারলে এখানে প্রতিবাদ সভা। আর বহরমপুরে লকআপে আমার ভাইয়েরা মরলে আশ্চর্য নীরবতা! 

শান্তিস্বরূপ সাপ্লায়ারকে বলে, মন্ত্রী যেখানে বলে কিক্‌ করবে, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে কয়েকটা বনসাই চাই। মন্ত্রীর পা প্রমিনেন্ট করে ধরতে হবে। চারটে বনসাই থাকবে লকআপে ঢোকার মুখে। মাধবের দিকে তাকিয়ে বলে, জঙ্গলমহলের লেটেস্ট খবর কিছু আছে নাকি তোমার পেটিকায়? 

মাধব মণ্ডল জানায়, কীভাবে থাকবে? ১৪৪ আর যৌথবাহিনী সংবাদমাধ্যমকে ঢুকতে দিচ্ছে না। কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না। 

তাই নাকি? 

ঢোকার চেষ্টা করলে, মারছে, মামলা করছে। 

এসব খবর তাহলে বেরোচ্ছে! 

শুধু পড়ে-থাকা নির্বাচিত কিছু মৃতদেহের ছবি তুলতে দেওয়া হয়। কিছু নির্বাচিত ঘরপোড়ার ছবি, কিছু গ্রামছাড়ার ছবি। তোমরা যা বলবে, সেটাই খবর, বাকিটা তো উসকানি আর রাষ্ট্রদ্রোহ। যা ঘটে তা সত্য নয়, সেই সত্য যা রচিবে তুমি! 

তুমিও তো এতদিন সেটা করেই খেলে, মাধব! একদিন বলেছিলে, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। সারা জীবন দেখিয়ে গেলে, থানার ব্রিফিংই তোমার রোজগারের উৎস। অস্বীকার করবে? স্বাধীন সাংবাদিক হতে চাও শেষবেলায়? শান্তিস্বরূপ প্রশ্ন করে। 

মাধব বলে, বেয়নেট খুঁচানো ইসমাইল পড়ে আছে নির্জন খালের ধারে। মনে পড়ে? পড়ে আছে লালমোহনের লাশ। সব গুলি বুকে। তোমরা ভয়ে বলছ এনকাউন্টার। নিজেরাই লাশ হয়ে গেছ নিজের ভয়ের কাছে। থেঁতলানো দেহ পড়ে আছে জঙ্গলে। হাড়ভাঙা মানুষ সব ভাঙাঘরে। কত শত নিখোঁজ তোমাদের খেলার প্রতিভায়। 

বনসাইগুলো দারুণ বানিয়েছ সাপ্লায়ার! তোমার ফার্মে কতজন কাজ করে? পঞ্চাশ। এটা একশো দুশো করতে হবে। আরও বড়ো হতে হবে। কর্মসংস্থান চাই, সাপ্লায়ার! আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা তোমাদের মতো লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শান্তিস্বরূপ বলে। এর পর মাধবকে, বৃষ্টি আসছে। কোথাও হচ্ছে। দেখো, আকাশ কেমন নামো নামো হয়ে আছে। নিষিদ্ধ পল্লীর ডিসপেনসারি থেকে তুমি কি বেরোতে পারো না, মাধব? 

সাপ্লায়ার শান্তিস্বরূপকে বলে, কিছু ভাবলেন, শান্তিদা? মালখানায় ঢুকিয়ে দেব? 

এখানেই রাখো। শান্তিস্বরূপ বলে। 

সাপ্লায়ার হাঁক দেয়, শহিদ বেদিগুলো এখানেই নামিয়ে দে। সাবধানে নামাস। চোট না লাগে। 

শহিদ বেদি! বিস্মিত মাধব মণ্ডলের চোখের সামনে ট্রাক থেকে অসংখ্য কালো রং করা কাঠের বাক্স নেমে নেমে বিস্ময়ের স্তূপ হতে থাকে। ভরে যায় থানায় ঢোকার ডানদিকের চাতাল। দু ফুট বাই তিন ফুট মতো মাপের বাক্সগুলোর মাথায় দুটো করে গর্ত। সম্ভবত পতাকার ডাণ্ডা গোঁজার জন্য। 

মাধব, আষাঢ়ের গান শুনবে? ভালো স্টক আছে। এপার বাংলায় এখন আর তেমন গাইতে পারছে না কেউ। বললে চটে যায়। সত্যি কথা বলার জায়গাটা কেমন যেন ছোটো হয়ে যাচ্ছে। সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। দুর্বলতাটা না জানলে কী করে কাটিয়ে উঠবে? আমরা সৃজনশীল সমালোচনার পরিসর তৈরির যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। ওপারে কিন্তু দারুণ গাইছে, বিশেষ করে মেয়েরা। শান্তিস্বরূপ জানায়। 

এনকাউন্টারের সেই পচা গল্পটা তোমরাও খাইয়ে যাচ্ছ, শান্তি? মাধব বলে। লালমোহনরা এনকাউন্টারের জায়গায় নেই। দু বেলা খেতে পায় না। কাজ করতে চায়, পায় না। তিরিশ পেরোতে না পেরোতে বুড়ো হয়ে যায়। রোগ-শোক ধরে। চিকিৎসা পায় না। ওদের উন্নতির নাম করে টাকা আসে। পার্টি মারে, এনজিও মারে। লালমোহনদের সবাই মারে। মাধব কথাগুলো বলে ফেলে। 

থানার ব্রিফিংয়ের অনেক বাইরে চলে গেছ তুমি, মাধব! চাকরিটা করবে কী করে? 

করব না। 

খাবে কী? 

খেতে পাব না। এখানেই তো তোমাদের জোর। লালমোহন পেত না। আমিও পাব না। লালমোহন পেত, যদি তোমাদের সব মেনে নিত। আমি যেমন এতদিন পেয়েছি। 

আকাশ গুমগুম ডাকে। মেঘ যেন অবশিষ্ট পাখিদের ডানার কাছে এসে গেছে। আষাঢ়ের গান বাজে। 

তোমাকে নিয়ে একটা সংশয় আমার ছিলই। থানার ব্রিফিং বা রাইটার্সের ব্রিফিং নিয়ে সারা জীবন চালাবে, এতটা অপদার্থ হয়তো নও। যাই হোক, হাতে সময় নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মন্ত্রী চলে আসবে। তার আগে আমাকে রেডি হয়ে নিতে হবে। একটা কথা বলি মাধব, গবেষণা বলে একটা বস্তু আছে। সামাজিক মানুষের স্বার্থে, উন্নতির স্বার্থে সেটা করে যেতে হয়। এই যে মারণব্যাধির ওষুধ বেরোচ্ছে, সে তো গবেষণা করেই বের করতে হচ্ছে। তার জন্য প্রাণ যাচ্ছে কিছু ইঁদুর-বাঁদরের। উপায় নেই। ওষুধটা মানুষের ওপর ব্যবহারের আগে প্রয়োগ করে দেখতে হবে তো। লালমোহনদের মরতে হচ্ছে সামাজিক উন্নতির স্বার্থে। ওসব নিয়ে ভাবলে এগোনো যাবে না। বলেই শান্তিস্বরূপ দিকপতি থানার ভেতর ঢুকে যেতে চায়। 

মাধব থামায়। বলে, শুধু লালমোহনরাই মরবে? 

কেন? আমাদেরও মরে। তার জন্যই তো এত শহিদ বেদি। এমনি এমনি এল? 

সাপ্লায়ার জিজ্ঞেস করে, শনি বেদিগুলো কোথায় নামাব? 

শান্তিস্বরূপ জানায়, মাঠে। মন্ত্রী যেখানে বল কিক্‌ করবে, তার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে ডিস্ট্রিবিউট করে দিতে হবে। রিপোর্ট পাচ্ছি, বহু জায়গা থেকে আসছে, শুক্রবার রাতে নাকি শহিদ বেদি হাওয়া হয়ে যায়। শনিবার দিনভর শনি বেদি খেটে আবার রোববার ভোরে ফিরে আসে। এটা ঠিক নয়। শহিদ বেদি দিয়ে শনি বেদির কাজ ঠিক নয়। যাদের শনি বেদি দরকার, নিয়ে যাবে। চাওয়ার অধিকার তাদের আছে। ধর্ম একটা ট্র্যাডিশনাল পাবলিক ফেথ। সমাজকে নানারকম ব্যাধির হাত থেকে বাঁচায়। দুর্যোগ থেকে বাঁচায়। সব চেয়ে বড়ো কথা সমাজকে ধরে রাখে। সেটাকে কোনো ভাবে ডিসটার্ব করা যাবে না। সোভিয়েতভূমি থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। মাধব, তুমি থাকো। আমি রেডি হয়ে আসছি। 

থাকতে বলাটা কি সৌজন্যবশত? থানার জনসংযোগে প্রায় প্রতিবার থাকে মাধব মণ্ডল। খবর করে। নিয়মমাফিক ব্যাপার হয়ে গেছে, বাধ্যতামূলকও। সরকারের সব কর্মসূচিরই খবর করা হয়, থানার জনসংযোগ প্রায়োরিটি পায়। থানা থেকে যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবেই এতদিন খবর করেছে মাধব মণ্ডল। কিন্তু এবার থানা তাকে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ জানায়নি। অফিসও অ্যাসাইনমেন্ট দেয়নি। সে যে এখন অন্যরকম ভাবে, সেটা জানাজানি হয়েছে অফিসে, অফিসের বাইরেও। নিজেই জানিয়েছে। কিন্তু কখনও নিজের ভাবনা স্মাগল করেনি কাগজে। চেষ্টাও করেনি। সেটা অনৈতিক। এ দিক থেকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সৎ ক্রীতদাস। জঙ্গলমহলের কথা, লালমোহনের কথা থানার ভেতরে, তার মুখের ওপর বলা হবে এটা সম্ভবত ভাবতে পারেনি শান্তিস্বরূপ দিকপতি। রেগে গেছে। মাধব মণ্ডলের সঙ্গে কথা না বলাটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। শান্তিস্বরূপ ব্যস্ততার ছলে তাকে এড়িয়ে যেতে পারত। বেরিয়ে যেতেও বলতে পারত কায়দা করে। তা করেনি। বরং ব্যস্ততার মধ্যেই মাধব মণ্ডলের খোঁচা-মারা কথাগুলো শুনে গেছে। মেজাজ হারালেও সামলে নিয়েছে। তেমন আক্রমণাত্মক হয়নি। মাধব মণ্ডল চেয়েছিল তাকে উত্তেজিত করতে। কিছু কথা তাহলে বলা যেত, যা স্বাভাবিক অবস্থায় বলতে দ্বিধা হয়। তবে সম্পর্কটা যে একেবারে ছেড়ে গেছে তা স্পষ্ট করতে পেরেছে মাধব। এর পরও শান্তিস্বরূপ তাকে থাকতে বলল। এতটাই সৌজন্য? 

শনি বেদি নামানো হচ্ছে। লাল রঙের কাঠের বাক্সে জুড়ে যাচ্ছে দেড় কাঠা মাঠের অনেকটা। সমুদ্রনীল ম্যারাপের নীচে সবুজ আর লালের একটা বিপরীত সহাবস্থান। আষাঢ়ের গান বাজে। আকাশের গুমগুম দূরে সরে গেছে। মেঘ আর অবশিষ্ট পাখিদের ডানার তত কাছাকাছি নেই। এ দেশে থানা ইচ্ছেমতো বাড়তে পারে। এখানেও পাঁচিল ছাড়িয়ে গাড়ি চলাচলের একটা লাইন আটকে বেড়েছে। পুলিশের মহোৎসব বেশ দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। অন্য এলাকার পুলিশও আনা হয়েছে। জনগণ বলতে যাদের বোঝায়, এ অনুষ্ঠানে আসে না। সেজেগুজে কিছু নির্বাচিত আসে। হেসে হেসে নিজেদের মধ্যে কথা কয়, কাজের কথা হয়, কথার পেটে কথা হয়। এবারও আসবে। তারকাখচিত হয়ে যাবে জনসংযোগ। মন্ত্রী আসবে। বলে কিক্‌ মারবে। সবাই হাততালি দেবে। ক্যামেরা বুম লাঠি বুট হেলমেট বেতের ঢাল দাঁত-ক্যালানো ঝিকিয়ে উঠবে। মন্ত্রী এবার রসিকতা করতে পারে বলে কিক্‌ মারার আগে, বলটা দু হাতে ধরে বলতে পারে, জাবুলানি। মানে যাকে ধরে রাখা যায় না। যত কাছে চাই, তত সরে যায়, পড়ে যায় বারে বারে। যাবনি থাকবনি! আষাঢ়ের আকাশ ছুঁয়ে হাততালি আর বাইট ছড়িয়ে পড়বে ঘরে ঘরে। 

এই থানাতেই আশুতোষকে খুঁচিয়ে খুবলে মারা হয়েছিল। যদিও আশুতোষ তখন গুলিবিদ্ধ। আহত বলেই পুলিশের বিক্রম দশগুণ হতে পারে। আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে অত্যাচার। ওরা আশুতোষের মুখ থেকে সঙ্গীদের নাম বের করতে চেয়েছিল। পারেনি। তাতে আরও রেগে যায়। ঘুষি মেরে মুখ ফাটায়। ছুরি দিয়ে চামড়া চিরে দেয়। মাথার চুল উপড়ে নেয়। আশুতোষ সব সয়ে চুপ থেকেছে। এই পরাভব মানতে পারেনি পুলিশ অফিসার সুবিমল দাশগুপ্ত। আশুতোষ যখন ধরা পড়ে তার ডান হাতে কাঁধের কাছে গুলি লেগেছিল। যখন হাসপাতালে আনা হল, তার শরীরে বুলেটের ক্ষত চারটি। লকআপে তাকে তিনবার গুলি করা হয়। ৯ মার্চ ১৯৭১। আশুতোষ একটা শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল। 

আশুতোষকে থানায় নির্মমভাবে খুন করার বিরুদ্ধে পথসভা হয়। থানার সামনে। এখন যেখানে কালো কালো আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মাথায় কালো ফেট্টি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্র, সেইখানে। শান্তি ভাষণ দেয়। গুলিবিদ্ধ ছ্যাঃ গুয়েভারাকে ধরে এনে তাঁর ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল বারিয়ান্তোস সরকারের রাষ্ট্রীয় গুণ্ডারা। চে-র সঙ্গীদের একে একে গুলি করে খতম করা হয় তাঁর চোখের সামনে। কিন্তু চে-কে দিয়ে বিপ্লব সম্পর্কে একটি বিরূপ মন্তব্য করানো যায়নি। তার পর মহান বিপ্লবীর দেহ ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। তাঁকে মারার অনেক আগেই অবশ্য রাষ্ট্রীয় বেতারে ঘোষণা করা হয়, জঙ্গলে এনকাউন্টারে মারা গেছে গুয়েভারা। সেই সভায় বলেছিল শান্তি। চে গুয়েভারাকে যেমন শেষ করে দেওয়া যায়নি, আশুতোষকেও শেষ করা যাবে না। 

কী পালটে গেল ভেতরে ভেতরে। মাথাটা এখন কেমন বাঁকাটেরা। সামনের চুল উঠে উঠে পেছনের চুল ঝুলে ভীমরতিগ্রস্ত বয়স্কের কার্টুনের মতো লাগে শান্তিস্বরূপকে। 

কে বা কারা সেই ক্রাইসিসটা বাজিয়ে দেয়। সেই ভয়ঙ্কর আর্তনাদ। গোবরার মাঠে শুয়োরের পশ্চাদ্দেশে গরম শিক বেঁধানো থেকে জোড়াবাগান থানা লকআপে মধ্যরাতের আর্তনাদ। কেন বাজানো হল এটা? সমস্যায় পড়ল কি শান্তিস্বরূপরা? গাড়ি চলাচলের একটা লাইন পর্যন্ত থানার বিস্তারে সব সুরক্ষিত। কয়েকজন বয়স্কের হাফপ্যান্টের নীচে রোগা ডিগ্‌ডিগে কিছু পা দৌড়ে আসতে দেখা গেল। সাপ্লায়ারের লোকজন কেউ শহিদ বেদি হাতে, কেউ শনি বেদি হাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেজা সাদা কাপড়ের মতো একটা আলো ছড়াল। কোথাও সমস্যা দেখতে পায় না মাধব মণ্ডল। গেটের বাইরের পুলিশরা কাঠ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অফিস থেকে বেরিয়ে বারান্দায়, চাতালে মোতায়েন হয়েছে অভ্যন্তরীণ বাহিনী। দৃশ্যটা খুব চেনা মাধব মণ্ডলের। মন্ত্রী আসার আগে এরকম হয়। অচেনা জায়গা হল ক্রাইসিস এবং সাপ্লায়ারের লোকজন। 

মল্লার দত্ত গটগটিয়ে দোতলা থেকে নেমে বারান্দায় এক মুহূর্ত থেমে মাধব মণ্ডলের কানের কাছে মুখ রেখে বলে, আপনাকে ভেতরে ডাকছেন শান্তিদা। 

মাধব মণ্ডল ভেতরে যায়। ভেতরে মানে কোন ভেতরে? এ থানার ভেতরটা জানা আছে তার। সে সব ভেতর খোঁজে। কিন্তু শান্তিস্বরূপকে দেখতে পায় না। ইনটেরোগেশন রুমটা একেবারে পেছন দিকে। আগে ছিল না। থানার নিজস্ব একটা ইনটেরোগেশন দরকার বুঝে বছর দশেক আগে বানানো হয়েছে। এখান থেকেই কি বাজানো হচ্ছে সন্তুর বাঁশি ক্রাইসিস? মাধব জানে এ ঘরে আলো ঢোকার পথ কম রাখা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। আলো ঢোকার পথ মানে আওয়াজ বেরনোরও পথ। ইনটেরোগেশন বাইরে কেন শোনা যাবে? সেটা মোটেই ভদ্রসভ্য ব্যাপার নয়। যেটুকু শোনানো দরকার, আমরা শোনাব। তেমন হলে টেপ করা থাকবে। বাজিয়ে শোনানো হবে। 

মাধব মণ্ডল দেখে, ঘরের মাঝখানে ইনটেরোগেশন টেবিলে কে শুয়ে আছে। সে এগিয়ে যায়। গোবরার মাঠের শুয়োরের পশ্চাদ্দেশে গরম শিক বেঁধানো থেকে জোড়াবাগান থানা লকআপের আর্তনাদটা এখানে বড়ো বেশি জোরালো। মাথা ঝিমঝিম করে মাধব মণ্ডলের। সে ঝুঁকে দেখতে চায় টেবিলে কে? মনে হল আশুতোষ শুয়ে আছে। বেয়নেট খোঁচানো শরীর। ওপড়ানো চুল পড়ে আছে টেবিলে। কয়েক খণ্ড মাংস। হয়তো আশুতোষের শরীরের। অজস্র পোড়া সিগারেটের টুকরো। আরও ভালো করে দেখতে গিয়ে তার মনে হল, লালমোহনের লাশ পড়ে আছে। বুকে বুলেটের ক্ষতগুলো চেয়ে আছে। রুপোর চাকতি বসানো আছে কি ক্ষতের মুখে মুখে? যেটুকু আলো আসে তা ধরে রেখেছে। ক্ষত গোনার সুবিধে হবে বলে? আর্তনাদ থেমে যায়। সরোদ বাজে। 

মাধব মণ্ডল শুনতে পায়, তার কানের কাছে মুখ এনে শান্তিস্বরূপ বলল, ব্রিফিংয়ের বাইরে যেতে চেয়েছিলে, যাও স্বাধীনতা! 

মাধব মণ্ডল শুনতে পায়, মন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছে, আমাদের এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে। এই সাফল্য— এই সাফল্য আমরা হাতছাড়া করতে পারি না। এই সাফল্য— যেভাবেই হোক ধরে রাখতে হবে। 

মাধব মণ্ডল দেখতে পায়, তার দেহ দুই প্রফুল্ল বাহকের কাঁধে বাঁশে ঝুলে ঝুলে দুলে দুলে বেরিয়ে যাচ্ছে সাফল্যের পথ ধরে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ