২০১৮ সালে লেখা সাগরিকা রায়'এর সেরা গল্প : জলের শব্দ

গল্প লেখার গল্প নিয়ে আলাপ

১/ গল্পটি কখন ও কোথায় লিখেছেন।

-এই গল্পটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সাল,২রা সেপ্টেম্বর। দেশ পত্রিকায়।


গল্পটি লেখার সময়ে আমি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছি তখন। রবিবাসরীয় বর্তমানএর শিলিগুড়ি সংস্করণে গল্প, অলৌকিকের ওপর ধারাবাহিক, অনুষ্টুপ পত্রিকা,আনন্দমেলা…ইত্যাদি নানা পত্রিকায় লিখছি।


২/গল্পটির বীজ কোথায় পেয়েছিলেন? 
-এটি একটি বড় প্রশ্ন। আমার জন্ম ডুয়ার্সে। সেখানে নিয়মিত একটি সমস্যা ছোট থেকেই কানে বাজতো। গোরু চুরি হয়ে যাওয়া ! কিছু লোক ছিল,যারা গোরু চুরি করে বর্ডার পার করে দিত। ছোট বয়সে বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাইনি এমন নয়,একটা ভয় কাজ করত। ভয়টা হল,আমাদের বাড়িতে প্রায় সাত আটটি গোরু ছিল। তাদের দেখাশোনার লোক ছিল। চা বাগান থেকে ঘাস নিয়ে আসার জন্য বেতনভূক লোকও ছিল। প্রতিটি গোরুর নাম ছিল। ধলি,মনুয়া,লাভলি,শ্যামলী,চমরি…! এদের আমরা ভালবাসতাম। গোরু যথা সময়ে বাড়িতে না এলে ত্রাস সৃষ্টি হত। সেই ত্রাস মনের গভীরে নিরন্তর খুঁচিয়ে গিয়েছে।বীজ এভাবেই উড়ে এল।

৩/এই বীজ নিয়ে আগ্রহী হলেন কেন ? কেন মনে হল এই বিষয়টা নিয়ে গল্প লিখবেন ?

- পরবর্তীতে গোরু পাচার নিয়ে নানান খবর পেতাম। রীতিমতো আগ্রহ নিয়ে বিষয়টা লক্ষ্য করেছি। একটা সময় গিয়ে মনে হল,আমার কিছু বলা উচিত ! ইচ্ছে বা বলা ভাল একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম।

৪/গল্পটি কতদিন ধরে লিখেছেন ? কতবার কাটাকুটি করেছেন ?

- দুদিনে গল্পটি শেষ করি। মাত্র একবারই সামান্য পরিবর্তন করেছিলাম। শুরুটা।

৫/ লিখতে লিখতে কি মূল ভাবনা পালটে গেছে ?

-না। আমি এই বিশয়,এই ভাবনা নিয়েই লিখতে চেয়েছি। চিত্র এবং গোরু কোথাও গিয়ে এক হয়ে যাচ্ছে ! দুজনেই অবস্থার শিকার।

৬/গল্পটি লেখার পরে প্রথম পাঠক কে ছিলেন ?

-দেশ পত্রিকায় গল্পটি পাঠিয়ে দিতে সম্ভবত সম্পাদক/ বিভাগীয় সম্পাদক-ই প্রথম পাঠক ছিলেন। তার আগে আমি গল্পটি কাউকে পড়াইনি। আসলে আমি নিজে যদি মনে করি গল্পটি আমার মনের কথা বলতে পেরেছে,তাহলে আর দ্বিতীয়বার ভাবি না।

৭/লেখার পরে কি মনে হয়েছে যা লিখতে চেয়েছেন,তা লিখতে পেরেছেন ?

- বলতে পারেন। গল্পটি এই মুহূর্তে লিখলে কিভাবে লিখতাম,সেটা অন্য ভাবনা। তবে সেই সময়ে যখন লিখেছি,তখনকার ছবি হিসেবে গল্পটি লিখে ভাল লেগেছিল।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
গল্প
জলের শব্দ
সাগরিকা রায়

মেন্দাবাড়িতে গিয়েছিল চিত্র। এখন ফিরছে। বিকেল হয়ে এসেছে। বড্ড কনকনে বাতাস। যেন তিনদিক ঘেরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা জন্তুরা কামড়ে ধরেছে শরীর। ছিঁড়ে খাবে বুঝি! বুড়িবাসরা নদীতে এখন জল নেই। হেঁটে হেঁটে নদী পার হয় চিত্র। নদীর বিরাট শরীর জুড়ে এখন চড়া পড়েছে। বালি পাথরে ঠোক্কর খায় চিত্র। বালি শীতল হয়ে আছে। সাপের শরীরের মত। শিনশিনে বাতাস সব জড়- অজড়কে ঠান্ডা করে তুলেছে। অথচ, বর্ষায় এই নদীর রোষ দেখে কে ! কী ডাঁট তখন তার ! নদী পেরিয়ে শহরে পা রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের স্কুলেও যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। শীত এলেই সব জল হুড়মুড় করে গিলে ফেলে মা ধরিত্রী। তখন কোথায় রোষ,কোথায় কী ! বালি-পাথরে ভরাট শরীর রুক্ষ। কোথাও এক ঝলক জল নদীর চিহ্ন বহন করছে মাত্র। ফের বর্ষা না আসা পর্যন্ত বুড়িবাসরা নদীপথ ধরে ব্লকের অন্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে ডুয়ার্সের দক্ষিণ মেন্দাবাড়ি বনবস্তির বাসিন্দারা। এই শীতকালেই বাড়িতে আসতে পারে চিত্র। বাপ-মা,বোন কবিতাকে দেখে যায়। কাকা ধনেশ মন্ডলের পাঠানো স্বর্ণধান এনে দেয় মাকে। অল্প করে নুনিয়ার চালও। ভাপা পিঠে খাওয়ার জন্য। চিত্রর পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে বুড়িবাসরা নদী। ঘরে বসে থাকা ‘ ছাওয়া’-র মাথায় শয়তান ভর করবে ভেবে ধনেশ মন্ডল একদিন এসে চিত্রকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে কাকার অল্প স্বল্প জমি আছে। ধানি জমি। কিন্তু দেখাশোনার লোক কোথায় ? চিত্র আছে। সে জমি দেখাশোনা করে। দুটো গোরুর দেখভাল করে। পাহারা দেয় ওদের। বর্ডারের ধারে গ্রাম। গোরু পাচারের রমরমা কারবার চলে এখানে। পাহারাদার না থাকলে যখন তখন গোরু পাচার হয়ে যাবে। খুড়তুতো ভাই আদুল আর উমনকেও যত্ন করে চিত্র। চানের আগে ওদের তেল মাখায় জবজবে করে। চানের পরে গামছা ঘষে সে তেল তুলেও দেয়। ওদের জন্য সিগারেট কিনে আনে বাসনার বরের দোকান মধু স্টোর্স থেকে। বদলে পেটপুরে ভাত খায়। মাথায় তেল মাখে। লাল সাবান দিয়ে চান করে। আর কী চাই ‘এট্টা মানষের’ ?

উনিশ বছরের চিত্র শীতে কাঁপতে কাঁপতে মেন্দাবাড়ি থেকে চ্যাংরাবান্দা যাবে বলে বেরিয়েছে। দুপুরের ভাত খেয়েই। পৌঁছতে রাত নেমে যাবেই। অভ্যেস আছে। অন্য দিন একা হলে গান গায়। আজ ওর মন-শরীর গান গাইছে। পঞ্চবটীর গাওয়া গান। যে গান ও শিখেছে ওর মায়ের থেকে। কবে কোন সিনেমা না যাত্রায় শুনেছিল ওর মা। দিনহাটায় মামাবাড়ি গিয়ে কমলা রঙ্গের লিপস্টিক কিনেছিল পঞ্চবটী। কমলাকোয়া ঠোঁট ফুলিয়ে ও গান গায়- মন যে আমার কেমন কেমন করে/ প্রাণে যে সয়না সখি/ নাগর গেছে পরের ঘরে...! মেন্দাবাড়িতে যেদিন এসেছিল চিত্র,ঠিক সেদিন একটা কান্ড হয়েছে। আসার একটু আগে পঞ্চবটীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল চালকলের সামনে। চিত্র সাজগোজ দেখে কেমন একরকম হেসেছিল- সিনামায় নামতেছ নাকি ? এত সাজাগোজা ?

লজ্জার হাসি হেসেছিল চিত্র-মেন্দাবাড়ি যাই। মাকে দেখতে।

মুখ গম্ভীর করে পঞ্চবটী বলেছিল-তাড়াতাড়ি ফিরবা। এখানকার কথা ভুলে যেওনা যেন আবার ! মনে রাখবা কিন্তু।

কেন বলেছিল ও কথা পঞ্চবটী ? চিত্র ভেবে ভেবে কূল পায় না। তারপর থেকেই মনটা গান গেয়ে চলেছে- মন যে আমার কেমন কেমন করে...! কী যে করে চিত্র ! মনটা কেবল লাফায় আর লাফায় ! কাকার ভাষায় –ফাল পাড়ে ! মন ফাল পাড়ে !

হাট থেকে ফিরছিল নাগরু রাভা। সাইকেলের সামনে মুরগি বেঁধে রেখেছে। পাখিটার মাথা ঝুলছিল মাধ্যাকর্ষণের টানে। উঁচু নীচু রাস্তায় সাইকেল হোঁচট খায়। মাঝে মাঝে মুরগিটা কঁক কঁক করে ওঠে। চিত্রকে দেখে নাগরু হাসল। চিত্রও।একটু বেশিই হাসল। মন ভাল আছে বলে হাসিতে সেই ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ে। নাগরুর আদিম মুখখানা বড় সুন্দর মনে হয়। বস্তুত সব কিছুই আজ ভাল লাগছে। এমনকি কাকা ধনেশ মন্ডলকেও। সে লোক খারাপ নয়। তবে,বড্ড মুখখারাপ। এমন গালাগালি করে যে,গোরুদুটো আর চিত্র একাকার। কাকে যে বলছে,গালি দিচ্ছে বুঝতে পারে না চিত্র। আসলে কাকা চিত্রকে মানুষ হিসেবে গণ্যই করেনা। দুটো গোরুর মত চিত্রও তো নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে আছে । চারধারে ঘর।মাঝে উঠোনে গোরুগুলো থাকে। কাকা,তাঁর দুই ছেলে,চিত্র সবাই ঘরের বারান্দায় শোয়। কাকিমা আর ফুলকলি,আন্না ঘরের ভেতরে। গোরু চুরির হিড়িক চলে রাতে। গোরুদুটো চোখের সামনে রেখে চোখ বোজে ওরা। কান খাড়া,মাথা সজাগ রাখে। শীতে একবার চিত্র মেন্দাবাড়ি আসে,তাতেও কাকার মুখ ফোলে ! জমি ঘরের কাজকম্মো ছাড়াও গোরু পাহারার কাজ কি সোজা কথা ! চিত্র সজাগ থাকলে ওরা বাপ-ব্যাটা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। বোঝে চিত্র। ওদের অবজ্ঞা আর নির্ভরতা সবটাই আছে চিত্রকে ঘিরে।

মুরগিটা কঁক কঁক করে উঠল।চিত্র একবার পিছন ফিরে নাগরুকে দেখল। নাগরু মানে কী ? নাগরু শব্দের সঙ্গে পঞ্চবটীর গানের ‘নাগর’শব্দের মিল আছে। একথা ভেবে মনে মনে হাসতে থাকে চিত্র। মন থেকে হাসি ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ল। হাসতে হাসতে দৌড়তে থাকে চিত্র। তিনদিক ঘেরা জঙ্গলের জন্তু-টন্তুরা দেখলে নির্ঘাত পাগল ভাবত ওকে। মন মাতাল,শরীর পাগলপারা চিত্র গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে-পনচিই...ইইইইই...পন...চিইইই! তারপর চেঁচিয়ে গান ধরে ‘বন্ধু আসো নাই’ যাত্রায় শোনা ‘আমি সখি প্রেমাগুণে পোড়া...আ আ আ ...আমি মরলে না পোড়াইস তোরা...আ আ আ ...! শীতের শুকনো খনখনে বাতাসে চিত্রর গলার সুর কাঁপতে কাঁপতে অনেক দূরে চলে যায়। বনবস্তির হাট পেরিয়ে,নদী,জঙ্গল,লোকালয় পেরিয়ে আরও দূরে চলে যায়। সেই সেখানে,যেখানে পঞ্চবটী অন্ধকার বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে আছে। সুরের কাঁপনে পঞ্চবটীর কানের দুল দুলে ওঠে। চুল ওড়ে।

এবারে জব্বর শীত পড়েছে। উষ্ণতার জন্য প্রাণটা হাঁপিয়ে উঠেছে। চিত্র আজ বাড়ির সামনের প্রাইমারি স্কুলের সিঁড়িতে বসেনি অন্য দিনের মত। পঞ্চবটীর চোখে জল। চিত্রর জন্য মনে হাহাকার। সত্যি কি তাই ? সত্যি পঞ্চি এসব ভাবছে ? না হলে বলল কেন ‘তাড়াতাড়ি ফিরবা’!

চ্যাংরাবান্দার গাড়ি যখন পেল,তখনও চিত্রর মন একই ভাবনায় মশগুল। তাই চ্যাংরাবান্দায় নেমে কাকার বাড়ির দিকে যেতে যেতে একবার পঞ্চিকে দেখতে ইচ্ছে হল। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পঞ্চবটীদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল চিত্র। কেউ নেই বাইরে! জানালা দরজা বন্ধ। গতকাল মাথাভাঙা থেকে পঞ্চবটীর দিদিমা এসেছে। ভ্যানরিকশার ওপর দলা পাকানো মালটাকে দেখে প্রথমে নারকেল ভেবেছিল চিত্র। পৌষ পার্বণের জন্য নারকেল এসেছে পঞ্চবটীদের বাড়িতে। সঙ্গে ছিল পঞ্চবটীর মামা ঊষানাথ। ভ্যান রিকশায় পা ঝুলিয়ে বসেছিল ঊষানাথ। পঞ্চির বাবার শালা বাড়ির গাছের নারকেল নিয়ে এসেছে। মামা এসেছে বলে দৌড়ে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে পঞ্চবটী। এই আশায় প্রাইমারি স্কুলের ভাঙা,শেকড় গজানো সিঁড়ির ওপর বসে ছিল চিত্র। পঞ্চবটী দৌড়ে এল অবশ্য। নীল নীল সিন্থেটিক শাড়ি সিলিক সিলিক করে পড়ে পড়ে যায়। পঞ্চবটী হি হি করে হসে। হাসতে হাসতে নারকেলের বস্তাটাকে জাপটে ধরে দুহাতে। আশ্চর্য হয়ে চিত্র দেখে নারকেলের বস্তাটা নড়েচড়ে উঠল। পঞ্চিকে জাপটে ধরার চেষ্টা করল। পঞ্চবটীর মা এসে ‘ অ মা,তুমি আইছ’ বলে কেঁদেকেটে একাকার করল।

পঞ্চবটীর দিদিমা এসেছে দেখে মনে মনে খুশি হল চিত্র। বুড়িটাকে দেখতে পঞ্চিদের বাড়িতে যাওয়া যায়। পেন্নাম করবে চিত্র। বয়স হলে তোষামোদে খুশি হয় মানুষ। বলা কি যায়,এই বুড়িই হয়তো একদিন বলবে-‘ছেলেটা বড় ভাল রে। পঞ্চির লগে বিয়া দে’। সিরসির করে চিত্র। কী জানি,কী হবে ! শিবের থানে জল ঢালবে ও। ঊষাকালে চান করে জল ঢালবে। শিব বর দেবে,-বল,কী বর চাও? চিত্র হাতজোড় করে বলবে,’ভোলানাথ,পঞ্চিরে দ্যান। বড় ইচ্ছা সংসার করার। বড় শখ বাবা !’ ভাবতে ভাবতে চোখে জল আসে চিত্রর। শীতের বাতাসে বরফের ছুরি আছে। এই ছুরিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছিল ও। শরীরে কাঁথা সেলাই চলছে যেন। এখন ওদের বাড়িতে ঢুকলে পঞ্চবটী রাগ করবে।‘তুমি যেন কী ! বলা নাই,কওয়া নাই...লজা করেনা বুঝি !’ আমি থাকতে পারি না পঞ্চি ! তোমাকে না দেখে থাকা যায় বল ? ঠোঁট নড়ে।কন্ঠ শব্দ করে না। ঠান্ডায় ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ে। চিত্র রক্তের নোনতা স্বাদের ভেতরে উষ্ণতা অনুভব করে। হয়তো পঞ্চবটী এখনই ওদের টিনের দরজা ঠেলে বাইরে আসবে। দেখবে,ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে চিত্র। পঞ্চবটী কেঁদে ফেলবে-তুমি যেন কী !

কিন্তু কেউ আসে না।

রাত ঘন হলে বাইরে ঘোরাঘুরি করা বারণ। বর্ডার ঘেঁষে গ্রাম। দিনরাত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর টহল। ধরা পরলে নানান হাঙ্গামা। ধনেশ মন্ডল বলে দিয়েছে-‘রাইত বাড়ার দরকার নাই। বিকালেই ঘরে ঢুইকা পড়িস।‘ পঞ্চবটীদের বাড়ির সামনে থেকে কাকার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে চিত্র। গোরুদের ঠিকঠাক ভাবে রেখে শুতে শুতে রাত আরও বাড়ে। অন্ধকার মাটির দাওয়ায় চাটাই পেতে বিছানা করে নেয় ও। ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও তারার আলো অল্প একটু এসে পৌঁছেছে। চাটাইয়ের ওপর খড়ের গাদা ছড়িয়ে তার ভেতরে ঢুকে কাঁথাটা টেনে নেয়।ঘুম আসে না। প্রেমাগুণ কী জিনিস,কী রকম সেটাই ভাবতে ভাবতে ঘুমে ঢুলে পড়তে থাকে চিত্র। কাকা ঘুমের ভেতরে কাশল। কাশতে কাশতে উঠে বসবে। গোরু গুনবে। দুটো গোরু দেখা যায়। তবু গুনবে।জোরে জোরে গুনবে। গালাগালি দেবে নিজে নিজেই।

উষাকালে মন্তর পড়ে স্নান করে পঞ্চবটী। বুড়ো বটতলায় শিবের থানে জল ঢালে স্টিলের ঘটি থেকে। এই ঘটিখানার বয়স পয়ঁত্রিশ বছর। পঞ্চবটির থেকে সতের বছরের বড় এই ছোট ঘটিখানা। সে অনেককাল আগে স্টিলের খুব চল হয়েছিল গাঁ গঞ্জ থেকে শহর পর্যন্ত। তখন পঞ্চবটীর দিদিমা সীতামণি ভ্রাম্যমাণ বাসনওলার থেকে একটি কাঁসার ঘটির বদলে দুটো স্টিলের ঘটি নিয়েছিল। সে হয়ে গেল কত কালের কথা। সেই ঘটির একখানা সীতামণি দিয়েছিল মেয়ে রূপলক্ষ্মীকে। অন্যটা ছেলের বউ উজ্জ্বলাকে। রূপলক্ষ্মীর পাওয়া ঘটিখানা এসে বর্তেছে তার মেয়ে পঞ্চবটীর হাতে। আঠের বছরের যুবতী ব্রত-পার্বণ করবে। তার একখানা ঘটি চাই। জল রাখার ঘটি। এই জলে তার প্রার্থনা সঞ্চিত থাকবে।দেবদেবী তুষ্ট হয়ে বর দেবেন পঞ্চবটীকে। বর মানে পাত্র। হাতে টাকা,গোলায় ধান,ধা্নিজমি, গোটা দশ-বারো ছাগল,অন্তত দু চারটে বলদ গোরু না থাকলে ভাল পাত্র হয় কীসে ? সীতামণির দূরদৃষ্টি আছে। সে জানে,বেঁচে থাকা মানে অনেক সুযোগ সুবিধেকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকা হয়।

পৌষের পুকুরের জল বরফ-ঠান্ডা। পঞ্চবটী হি হি কাঁপুনির সঙ্গে জল ঢালে শরীরে। আঠের বছরের নারী শরীর সুখের প্রত্যাশায় কেঁপে ওঠে। ভাল বর দাও।পঞ্চবটীকে সে খুব ভালবাসবে। তার অনেক টাকা হবে। পেটপুরে নুনিয়ার চালের ভাপা পিঠে খাবে পঞ্চবটী। ক্ষেতে থাকবে ক্ষিতীশ, স্বর্নধানের লক্ষ্মীর ভান্ডার।

চোখ বুজে হাতজোড় করে বিড়বিড় মন্তর পড়ে পঞ্চবটী। ভাল বর। ভাবতেই চোখে ভাসে মায়াময় একটি মুখ। বলেছে সে-‘গাঁয়ের মধ্যে তুমি সব থিকা ভাল দেখতে’! সত্যি কি তাই ? তাহলে দাদা সিধু কেন ওকে ‘থেবরি নাকু’বলে ডাকে ?

ঠান্ডায় হি হি করে পঞ্চবটী। ভোরের বাতাসে ঘন বার্লির মত কুয়াশা চেপে বসেছে। বটগাছের ঠিক পিছনেই থাকে চিত্র। বসে বসে পুজো দেখে পঞ্চবটীর। ঠাকুরের কাছে কী বর মাঙে পঞ্চি ? জানতে ইচ্ছে করে। পঞ্চবটী ওকে দেখতে পায়নি। অথবা দেখেছে, না দেখার ভান করছে ! বাবুলাল বলে-মেয়েরা ন্যাকামি করে। বাবুলাল অনেক জানে। শেফুর সঙ্গে ওর একটু ভাবসাব আছে। শেফুর বর গেল বছর রাখালি করতে গিয়ে মরেছে গুলি খেয়ে। এখন বাবুলাল নাকি শেফুর দেখভাল করে দুপুরে টুপুরে। বাবুলাল শেফুকে দেখে বুঝে গেছে ন্যাকামি ট্যাকামি ! সত্যি কথাই বলে বাবুলাল। এই যে একটা মানুষ এতক্ষণ এখানে বসে আছে,পঞ্চি বোঝে না ? নারীর নাকি শত চোখ ?

শীতে কাঁপছিল পঞ্চি। আঁচল টেনে জড়সড় হয়ে পড়ছিল। আহা রে ! চিত্রর ইচ্ছে করে কাকিমার সবুজ রঙের ফুলপাতা আঁকা মেলা থেকে কেনা চাদরটা দিয়ে পঞ্চিকে জড়িয়ে ধরে। ভাবতে ভাবতে গরম শ্বাস ফেলে চিত্র। যে শরীর এমন আগুন তৈরি করে, সেই শরীর এমন শীতল হয় কেন ? শীতে কাঁপে কেন ? আগুনের কি শীত করে ?

মন্তর পড়তে পড়তে ঘটি থেকে সরু ধারায় জল ঢালছিল পঞ্চবটী। হঠাৎ-ই ওর চোখ পড়ে চিত্রর ওপর।

-‘তুমি ! একি গো ! কখন আসছ ?’ নাকের গোলাপি কাচ চকচক করে উঠল।

অভিমানে চিত্রর গলা বুজে আসে।পঞ্চি জানে না কত রাত পর্যন্ত প্রাইমারি স্কুলের সিঁড়িতে বসে থাকে চিত্র পঞ্চির জন্য ! একবারও ঘরের বাইরে আসতে পারে না পঞ্চি ? ইচ্ছে করে না ওর চিত্রকে দেখতে ?

চিত্র বলে-‘আসছি অনেকক্ষণ।তোমার তো কোনদিকেই মন নাই।‘ চিত্রর গলা কাঁপল।

পঞ্চির নাকের পাটা হাসির দমকে ফুলে ওঠে। যৌবন টলমল করে উথাল পাথাল হাসিতে। বুকের ভাঁজে সরষে দানার মত তিল দেখে ফেলে চিত্র।

-‘তোমার দিকে মন দেব ক্যান ? তুমি কে আমার ?’

-‘ আমি কে তোমার ?’ চিত্র ব্যাকুল চোখে তাকায়।

-‘কিচ্ছু না। এই ঠান্ডায় কী কর এইখানে ? পাগল নাকি ?’ পঞ্চির ভ্রু কুঁচকে ওঠে।

-‘তুমি এত সকালে আসো ক্যান পঞ্চি ? বর্ডার সামাল দেয় জওয়ানরা। তোমারে সামাল দিব কে ? ওই দ্যাখো।‘ আঙুল তুলে দেখায় চিত্র। দূরে কাঁটাতারের বেড়ার সামনে অস্পষ্ট ছায়াশরীর নড়াচড়া করে। চিত্র বলে-‘ভয় করে না তোমার ? ওরা নাকি পাথরের।হাসতে জানেনা। তা জানো ? এই সকালে একলা আসো।আমার ভয় করে পঞ্চি ।’

-‘হাসে না ? ওমা সে কি !’ পঞ্চি ফের হাসতে থাকে শরীর কাঁপিয়ে।

-‘খলিল বলতেছিল। সারাদিন নজরে রাখছিল খলিল। তাও হাসি দেখে নাই ওদের। তুমি ক্যান এইসময়ে আসো ? যদি কিছু হয় ?’

-‘তুমি যেন কী! ওরা সরকারের লোক। বর্ডার পাহারা দেয়। দাদা বলছে আমারে। ভূত নাকি ?...একটা কাজ করবা ? কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় পঞ্চি-‘ওদের সঙ্গে ভাব করবা ? তারপর ওই পারে যাই ? গিয়া আমার জ্যাঠার বাসায় ঘুইরা আসি গা। যাবা ?’ ফের হাসে পঞ্চি, চিত্রর রাগী অথচ হাবলা মুখটা দেখতে দেখতে। হাসতে হাসতে হঠাৎ চুপ হয়ে যায় ও। মুখ গোমড়া করে কী ভাবে। চোখ দুটো অনেক দূরের দিকে। যেন কুয়াশার দেওয়াল ভেদ করে চলে গেছে দৃষ্টি। শ্বাস ফেলে ও।

-‘তোমার কথা কী ভাবব বল ? একটা কাজ হয়না তোমার ? সমুদ্দরের মত ? বিপিন মন্ডলের ছেলে সমুদ্দর ! কত টাকা ওই চ্যাংড়ার, তা জান? বাইক কিনছে।হলুদ রঙ !’ বলতে বলতে সেই রঙ গালে মাখে যেন পঞ্চি।

চিত্র বুঝতে পারে না ঠিকঠাক-‘ সমুদ্দরের কথা এখন কেন ?’

-‘আমার বাবা সমুদ্দরের কথা ভাবে। ওদের ঘরে কালার টিভি,ডিভিডি আছে। মোবাইল ফোন আছে। জমি আছে। দিনহাটায় আরও জমি কিনতেছে ওরা। এইখানে পাকা ঘর তুলবে। তুমি হইলা ধনেশ মন্ডলের বাগাল। তোমার কথা কে ভাবে?’পঞ্চি কেমন যেন ক্যাট ক্যাট করে কথা বলছে।

শীতের বুড়িবাসরার ওপর পাথরের টুকরো হয়ে পড়ে চিত্র। জল ছাড়া নদী।প্রাণ ছাড়া শরীর।

-‘সমুদ্দর রাখাল। নিজেও রাখাল পোষে। গোরু পাচার করে ওই পারে,’ চিত্র বলে ওঠে-‘তুমি দেখ নাই রাখালির কাজ করতে গিয়া কত মানুষ মরতেছে ? কালু মরল।তোতলা বাকু মরল। সমুদ্দর মরবে পঞ্চি। এই কাজ কি ভাল কাজ ? তুমি বল তো আমার জান দিয়া দিব। খারাপ কাজ করব ? মরতে বল ?’

পঞ্চি স্টিলের ঘটিটা দেখে-‘ও ক্যান মরবে ? ও কি নিজে করে নাকি ? আগে করত। এখন ওর পোষা রাখাল আছে।‘ চিত্র দিকে সরাসরি তাকায় না পঞ্চি। ঘটিটা দেখে।কত প্রার্থনা জমা আছে এই ঘটির ভেতরে।

-‘লোক ? পোষা রাখাল ? আমি পাব কই ?’ চিত্র পঞ্চির কাছেই সমাধান চায়।

পঞ্চবটী সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। চিত্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে পঞ্চি চলে যাচ্ছে। হলুদ-লাল ছাপা শাড়ির নীচে ওর হলুদ সায়া কুয়াশায় ভেজা মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ওর পা ভেজা মাটি মেখে শীতল হয়ে আছে। ঘটির অবশিশ্ত জল আনমনে ফেলে দিতে দিতে চলে যাচ্ছিল ও। চিত্রর ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করে দিল আজ পঞ্চবটী। ওকে রাখাল হতে হবে। এই রাখাল গোরু মোষ চরায় না। রাতের অন্ধকারে বর্ডারের ফৌজিদের লুকিয়ে গোরু মোষ পাচার করে ওপারে। সমুদ্দরের বাপ-কাকা এই কাজ করে। আগে এদের বলতো ক্যারিয়ার। এখন বলে রাখাল। জানে চিত্র। ধনেশ মন্ডল রাতে শুয়ে এসব বলেছে কতদিন।

কী করবে চিত্র? ধলি,মনুয়া গোরুদুটোকে নিজে হাতে খাওয়ায়। মশা মেরে দেয় ওদের গা থেকে। এই রকম প্রাণীগুলোকে কী করে জবাইখানায় পাঠাবে চিত্র ? শেষ পর্যন্ত রাখাল হবে ও ? যদি না হয় ? ধনেশের বাগাল হয়ে থাকবে। পঞ্চি চলে যাবে সমুদ্দরের নাও হয়ে। আর যদি রাখাল হয় ? সংসার হবে চিত্রর। দিনাজপুরের মেলায় যাবে সংসারের জিনিসপত্র কিনতে। মধু বর্মন তাই করেছিল। অ্যাত্তো বড় খাট বিছানা কিনবে ও। পঞ্চি,ছেলে,মেয়ে সবাইকে নিয়ে ওই খাটে ঘুমোবে। কালার টিভির শখ পঞ্চির। তা-ও কিনবে চিত্র। বাইকও। হলুদ রঙের। কিন্তু নিজের বাসা,সংসার...এত সব করতে করতে কত সময় লাগে ! ততদিন পঞ্চি থাকবে তো ? ভেসে যাবে নাতো সমুদ্দরে ?

সংসারে শান্তি আসে বৌয়ের মুখে হাসি থাকলএরহাসি দেবে চিত্র বৌকে। হাসিখুশির সংসার হবে ওর। পঞ্চি হেসে হেসে পাশে এসে বসবে-‘তুমি যেন কী !’ লজ্জায় লাল লাল মুখ।

উফ! উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় চিত্র। সমুদ্দরের কাছে পঞ্চিকে যেতে দেবে না চিত্র। নিজেই যাবে। সমুদ্দরের সঙ্গে দেখা করতে হবে,-‘কাজ চাই সমুদ্দর। কাজ দে।’বলে দাঁড়াবে ওদের উঠোনে। কিসের লজ্জা ? লজা করলে চলবে না চিত্র ! পুরুষ না তুই ?

অস্থির চিত্র একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। শেষরাতে শীত করছিল। যেন অথৈ জলের শীতলতায় ডুবে যাচ্ছে ও। গোঙানি শুনে আদুল ধাক্কা দিল-‘ওঠ। ব্যাটা হাম্বা হাম্বা করে ! য্যান গোরু। বোবায় ধরছে তোরে।’

জেগে উঠে বোবা হয়ে থাকে চিত্র। আজ সমুদ্দরের কাছে যাবে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে হবে। নইলে সংসার হবেনা। পঞ্চি হবেনা। বুদ্ধি নেই সত্যি।নাহলে সহজ কথাটা বুঝতে এতদিন লাগে ? কিন্তু শরীরের কোথায় যেন ধ্বস নামছে,টের পায় ও। সব ভেঙে পড়ার শব্দ। অথচ অনিচ্ছুক শরীর উঠে দাঁড়ায়। সমুদ্দরের বাড়ির উঠোনে পৌঁছে যায় সকাল হওয়ার আগেই। মাটির কোঠা চারখানা। পিছনে সারবাধা ঘর। হাঁস মুরগির খাঁচা। সমুদ্দরের মা দানা দিচ্ছিল হাঁস মুরগিকে। এত ভোরে ওকে দেখে চমকে ওঠে,-‘কে?’

সমুদ্দরের মা ওকে বর্ডারের রক্ষী ভেবে চমকেছে ঠিক। মেয়েছেলেদের রক্ষীরা ঘাঁটায় না বলে এদিকের অনেকের বউ-ঝিরা গোরুগুলোকে লুকিয়ে রাখার জন্য টাকা পায়। সমুদ্দরের মা-ও এই কাজ করে। এইবার চিত্রকে চিনতে পেরে সহজ হয়-‘চিত্তর নাকি ? এই বিহানে কী কাম ? সাতসকালে আইছস ক্যান ? কী দরকার ?’

-‘সমুদ্দর কই কাকি ?’ চিত্র চোখ ঘুরিয়ে সমুদ্দরের টিপকল দেখে। নোংরা চেহারার দু চারজন লোক চিত্রর সাড়া পেয়ে গা চুলকোতে চুলকোতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল।এরা সমুদ্দরের রাখাল। জলে থাকে। চুলকনি হয়েছে। গা চুলকোয়। খসখস ! সন্দেহভরে তাকায়।

-‘সমুদ্দর তো বাসায় নাই। তুফানগঞ্জ গেছে।কাইল,নয় পরশু ফিরবে।‘ সমুদ্দরের মা পিছন ফিরে চলে যাচ্ছে।

কথাটা মিথ্যা নাকি ? চিত্রকে বিশ্বাস করল না বোধহয়। ফিরে আসছিল চিত্র। খালেকের সঙ্গে দেখা। সকাল সকাল চোলাই খেয়েছে। ঘোর ঘোর চোখ। চিত্রকে দেখে হাত উলটে দিল-‘কী রে ? আছিস ক্যামন রে ? শুকনা জীবন তোর।’

চিত্র কথা বলবে না ভেবেও দাঁড়াল।খালেক রাখালির হালহদিশ জানে। চিত্রকে জানাতে পারবে।

প্রথমে মুখ খোলে না খালেক। গালাগালি দিল। তারপর হাসে-‘টাকা লাগবে তোর ? অনেক টাকা পাবি। শুদু হ্যাঁ বইলা ফ্যাল।’

-‘কিন্তু,রক্ষীরা আটকায় না? গুলি ছোঁড়ে। ভয় করে খালেক !’

-‘ ধুর,সব জানে সবাই। যে ঘাট দিয়া গোরু পাচার করবি,সেই ঘাট ঘাটআলারা কিনা রাখে। বুঝছস? তখন তো ভয় নাই। সোজা চইলা যাবি বর্ডার পার কইরা অনেক ভিতরে। হাতে হাতে টাকা। আর ঘাট কিনা না থাকলে সাবধানে পাচার করতে হয়। ভয় নাই। ভয় থাকলে খাবি কী?’ খালেক হাসতে থাকে। মাতালের হাসি,’গেরামে কাজ আছে নাকি ? বিবি আর ছাওয়া পাওয়াদের খাওয়াই কী বল ? কী করব ? বাঁচতে তো হবে !’

কোথায় কাজ পাবে চিত্র ? ভিন রাজ্যে নাকি কাজ মেলে। মধুরা তিন ভাই আর মামু শেখের দুই ছেলে গেল। একজনেরও কোনও খবর নাই। একশো দিনের কাজও মেলে না। তার জন্য ঘাঁতঘোত জানা চাই। চিত্র কিছুই জানে না। প্রধানের সঙ্গে কথা বলবে ? বকবে না তো ? চিত্র ঘাড় ঘুরিয়ে দূরের কাঁটা তারের বেড়া দেখে। ছয়জন জওয়ান সবসময় পাহারা দেয়। এদের ইচ্ছেতেও নাকি কাজ হয়। অনিচ্ছে থাকলে গুলি। কে জানে সত্যি না মিথ্যে কথা ! এই গ্রামের আটজন মরেছে গুলিতে গত এক বছরে। তবু মানুষ মরতে যায় বাঁচবে বলে।

রথখোলায় মধুর পান-বিড়ির দোকানের পাশে সুকুমারের মুদি দোকানের ঝাঁপ খোলা। মোটা বাঁশ বেঞ্চের বদলে পুঁতে রাখা আছে। খালেক সেখানে ছিল। চিত্র বসল বাঁশের একপাশে। ওকে দেখে মধু খ্যালখ্যাল করে হেসে উঠল। চিত্র দেখল মধুর সামনের চওড়া একটা দাঁত নেই। নড়বড় করছিল কদিন থেকেই। মধুর হাসিটা ভয়ঙ্কর লাগল চিত্রর।

-‘কী রে চিত্তির ? তুই নাকি ঘুমের মধ্যে গোরু হইয়া যাস ? আদুল বলল। সত্যি নাকি? ঘাস খুঁজিস ?’

আদুল ? ও আবার কখন এল এখানে ? চিত্র কোন প্রশ্নটা করবে বুঝতে পারে না। আদুল কখন এল ? নাকি চিত্র গোরুতে পরিণত হওয়ার খবর কে দিল ? কোনটা আগে জানতে হবে ওর ?

খালেকও হাসে-‘হাম্বা করস? নাকি বলদ খুঁজিস ?

চিত্র বিরক্ত হয়। আদুল এখানে আসে। অথচ মিথ্যে খাটায় চিত্রকে সিগারেট নিতে পাঠিয়ে।ঠিকই বলে পঞ্চি। ও ধনেশ মন্ডলের বাগাল হয়েই থাকবে। এরপর আদুল-উমনের বাগাল। তারপর ওদের ছাওয়াদের বাগাল। বুড়ো হাবড়া হয়ে ল্যাড় ল্যাড় করবে,তবু বাগালগিরি ছাড়তে পারবে না চিত্র। চিত্রর নিজের কেউ থাকবে না ? কোনদিনও? কখনও ? যাঃ ! তাই হয় নাকি ?

গুম হয়ে থাকতে থাকতে নিজের ওপরে রাগ হয় চিত্রর। বুড়িবাসরার ওপর রাগ হয়। মনে হয় ধনেশ মন্ডলকে ধরে পাচার করে দিয়ে আসে ওপারে। ওরা চিত্রর আজকের অবস্থার জন্য দায়ী। বুড়ির শরীরে অত জল না থাকলে চিত্র পড়তে পারতো স্কুলে। ধনেশ ওকে বাগাল না বানালে চিত্র নিজের মত করে বাঁচতে পারত। কেউ গোরু ভাবত ? মধু ফোকলা মুখে ঠাট্টা করত? পঞ্চি সমুদ্দরের ঘরে যেতে চাইত? রাত জেগে কাকার গোরু পাহারা দিতে হত ?

রথখোলায় গিয়ে দুপুরবেলা বসে থাকে চিত্র। বাবুল আর সমসের তাস পিটছিল। ওকে দেখে বাবুল খবর ফাঁস করে। গতরাতে রাখালি করতে গিয়ে নলিন মরেছে। বিএস এফএর গুলি নির্ভুল নিশানা বেছে নিয়েছে। কাল ঘাট বন্ধের খবরটা জানত না নলিনরা।

-‘টাকার খেলা হয় রে!’ সমসের বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে-‘এজেনরা সব জানে।যে ঘাট দিয়ে রাখাল যাবে,সেই ঘাটয়ালার সঙ্গে টাকার খেলা হয়। কে জানে,সত্যি না মিথ্যা !’

চিত্র সব কথা স্পষ্টাস্পষ্টি বোঝে না। এ এক আজব দুনিয়া।

বাবুল গুহ্য খবর দেয়-‘গোরু রে গোরু ! কত কত হাত যে আছে রে ! কত হাত থিকা কত গোরু যে আসে ! টেরাক তেড়াক গোরু আসে হাটে। সেই গোরু কেনে এজেনরা। রাখাল দিয়া তাইতো পাচার হয় ! আমরাই তো পাচার করি। রিকস আছে !’

-‘কত টাকা ?’চিত্র গলা বারায়। এই কথাটা জানতে হবে ওর।

-‘ঘাট খোলা থাকলে ওই পারে গিয়া এজেনের কাছে গোরু দিতে পারা যায়। অসুবিধা নাই।তখন অনেক বেশি টাকা। ঘাট বন্ধ থাকলে রাত্তিরে কাজ। তখন বাঁচা-মরা ওপর আলার হাতে।’

-‘সমুদ্দরের কি অনেক তাকা ?’চিত্র জানতে চায়।

-‘আছে। ওর মা-ও কাজ করে। বাপও। কালুর বৌও এই কাজ করে। সেইদিন তো হইহই। কালুর বৌ গোরু লুকায় রাখছে। বর্ডার রক্ষীরা খবর পাইছে। বলে,গোরু বাইর কর। কী দশা !’

চিত্র কল্পনা করে। পঞ্চি কি পারবে এই কাজ ? কিন্তু ধরা পড়লে ? ঘর থেকে চোরাই মাল বের হলে বর্ডারের জওয়ানরা কী করে ?

-‘ তখন মজা ! কালুর বাসায় লুকানো গোরু ধরা পড়ল। এই সুযোগে রাখালরা ওদের গাড়িতে আগুন দিয়ে দিল। ওরা গুলি চালায়…! এই সময় কিন্তু বর্ডার ফাঁকা ! আরামে পাচার চলে। তুই এত সব জানতে চাইস ক্যান ? রাখাল হবি ?’

জানে না চিত্র। ও মেন্দাবাড়ির তিনদিক ঘেরা বন দেখতে পায়। বাপের মত কাঠুরে হতে চায়নি। কিন্তু বুড়িবাসরার গন্ধ,বনের গন্ধ ভুলতে পারে না। ওর মন কেমন কেমন করে।

-‘রাখাল হবি চিত্র ? টাকা আছে। রিকসও। এখন সবাই এই কাজে আসতে চায়।কাজ পাবে কোথায় ? টাকা কার লাগে না ?’ বাবুলের গলা উসকে দিতে চায় চিত্রকে। একশো দিনের কাজের জন্য প্রধানের কাছে গিয়েছিল চিত্র। পঞ্চায়েতের প্রধান।কত ক্ষমতা তাঁর। কিন্তু সে ভাল করে শুনল না সমস্যা। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ফেনা বানাচ্ছিল মুখে। থুক করে ফেনা ফেলে খ্যঁচখ্যাঁচ করে উঠল-‘আবেদনপত্র আছে ? একশো দিনের কাজ কি গাছের আম নাকি রে ? পদ্ধতিমত আগাইতে হবে। তখন ভাবব। এখন যা।‘মন খারাপ করে ফিরে আসতে আসতে চিত্র ভেবেছিল অন্য রাজ্যে কাজের কথা বলেছিল সিরাজুল, যাবে ? ভয় হয় যে। খুব ভয় !

-‘অত ভাবিস না। রাইতে আসিস।‘সমসের চোখ নাচায়। একটা সিগারেট দেয় সমসের-‘খা। খাইস নাই কখুনও?

গভীর রাতে চুপচাপ খড়ের বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় চিত্র। হু হু ঠান্ডায় শরীর ঠক ঠক। অন্ধকার মাঠের ভেতর দিয়ে সমসেরের বাসার পিছনের খড়ের ঘরে ঢোকে ও। নতুন কাজ। নতুন জীবন। উত্তেজনায় ধুপ ধুপ করে বুক। জামা ছেড়ে জবজবে করে তেল মাখে সমসের আর চিত্র। রিকস না নিলে ব্যাটাছেলে বাঁচে কী করে ? পঞ্চি তো ওর জন্য বসে থাকবে না চিরদিন ! পঞ্চির সঙ্গে তিনদিন দেখা করেনি চিত্র। কাল চমকে দেবে পঞ্চিকে।কেউ জানেনা আজ চিত্র কাজ করবে।

ঘন কুয়াশার মধ্যে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সমসেরের তাড়া খেয়ে হাঁটতে থাকে চিত্র। মোটা প্লাস্টিকে মোবাইল ফোন জড়িয়ে নিয়েছে সমসের-‘এইসব দেইখা রাখ। মাল পৌঁছানোর খবর,ঘাট খোলা থাকার খবর ফোন কইরা দিতে হইব।’

-‘কারে ?’ অন্ধকারে নেংটি পরা চিত্র নিজেকে দেখতে পায়না।সমসেরকেও না। ভূতের মত অন্ধকারে মিশে থাকে ওরা।

-‘এজেনকে !’চাপা স্বরে ধমক দেয় সমসের-‘গোরু!’

কাজে নামতে হবে।পঞ্চি কী করতেছে এহন ? মন যে আমার ক্যামন করে পঞ্চি ! যদি গুলি খাই ? ভাববা আমার কথা ? কনুইয়ে খোঁচা দিয়ে জলে নেমে পড়ে সমসের। দেখাদেখি চিত্রও। উফ ! কী ঠান্ডা জল ! মুখটুকু বের করে নিঃশব্দে সাঁতরে যেতে হবে। জল থেকে কয়েক হাত দূরে জওয়ানরা ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পাটকাঠির বেড়া দেওয়া ঘরে ঢুকে পড়ল। সমসের সাবধানে প্লাস্টিক খুলে ফোন করে। চিত্র অবাক হয়ে দেখে খবরটুকু পাওয়ামাত্র পাড় থেকে পঁচিশ জোড়া গোরুকে জলে নামিয়ে দিল খালেক,বাবুল। অন্ধকারে এতগুলো গোরু এল ! শব্দ করেনি ! নিয়তিকে মেনে নিয়েছে চিত্রর মত। চিত্র গোরু গুনতে যাচ্ছিল। ধলি-মনুয়া নাইতো বাবুল ? ভুল কইরা ওদের আনিস নাই তো ? আইজ আমি নাই। কাকা,আদুল,উমন আরামে ঘুমায়। ওরা জানে না আমি খড়ের ভিতর থিকা বাইর হইয়া আসছি। তোরা ধলি, মনুয়ারে আনিস নাই তো ?

চিত্রর কথা গলার ভিতরে আটকে থাকে জমাট কুয়াশার মত। ওর কথা শুনতে পায়না বাবুল। চটের চাদর গায়ে দিয়ে বাবুল খোঁচা দেয়-‘পঁচিশ জোড়া গোরু আছে। সাবধানে নিবি। ইমানুল ভাল টাকা দেয়।সব দেইখা রাখ। শিখা রাখ। পরে তো একলা করবি।’ চিত্রর খালি গায়ে তেল গড়িয়ে পড়ছিল। কখন কাজ হবে ? চিত্র উদ্বিগ্ন হচ্ছিল। ধনাশ মন্ডল যদি জেগে যায় ? কাশতে কাশতে উঠে বসে ? কাশির বেগ বাড়লে উঠে থাবড়া দিতে হয় চিত্রর। গরম জল দিতে হয় খাওয়ার জন্য। বসে বসে হাঁপাবে খানিকক্ষণ। হাঁপাতে হাঁপাতে গোরু গুনবে-‘এক,দুই...ওইটা ধলি তো ? পাশেরটা মনুয়া তো ? ‘

চিত্র সায় দেবে-‘ওই তো ধলি,ওই তো মনুয়া। সবডি আছে কাকা ! অহন ঘুমান।’

চিত্র ওর অবস্থাটা বোঝাতে গিয়ে শুদুমুদু ধমক খেল।‘ চুপ যা ! শব্দ করস ক্যান ?’সমসের রাগলে জ্ঞান থাকে না মাথায়। চিত্রর ব্যাকুলতা টের পেলে সমসের ওর মাথাটা জলের ভেতরে চেপে ধরবে-‘মর। জল খা। মর।তারপর কথা বল।‘

চিত্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। আদুল আজ সকালে খবরের কাগজ দেখে বলছিল-‘অ মা,ঠান্ডা কত নামছে জান ? চাইর ডিগরি !’

শব্দটার মানে না বুঝলেও ঠান্ডার মানটা বুঝতে পেরেছে চিত্র। চাইর ডিগরি ঠান্ডায় আমি খালি গায়ে নদীর পাড়ে। বুঝতে পারতেছ পঞ্চি ? আমি তুমার জন্য কত কষ্ট সহ্য করতে পারি ? ঠান্ডা তো ঠান্ডা ! আমি জলের ভিতরে ...মানে এক্কেরে ভিতরে ডুইবা থাকতে পারি ! দেখবা ? আসো।দেইখা যাও। আমার শরীরে প্রেমাগুণ আছে না ? সেই তো তাপ দেয়। তুমি পরের ঘরে যাইও না।আমার মন ক্যামন ক্যামন করবে পঞ্চি !

-‘ওই ব্যাটা, চুপ কইরা ভিডিও দেখস নাকি ?’ সমসের গালি দেয়-‘শালার বাচ্চা ! ভিডিও দেখস ? টাকা লাগবে তোর ? কাম করব কি তোর শালায় ?’

চিত্র থতমত খায়। কী কাজ করতে হবে বুঝতে না পেরে হাবার মত তাকায়-‘কী করব বল !’

সমসের ইশারা করে পিঠে খোঁচা দিয়ে।তারপরে জলে নামে দুইজনে।

-‘সাবধান ! হাইচা কাইশা একাকার করিস না ! কোন শব্দ য্যান পাটকাঠির বেড়ার ভিতরে না পৌঁছায় ! ‘বলে দিয়েছিল বাবুলরা।পায়ের শীর্ণ পাতা ঠান্ডা জলের নীচে মাটি খোঁজে। দাঁড়ানোর জন্য মাটি চাই। নাহলে চিত্র সবদিক সামলায় কী করে ? আজ সকালে যখন রাখালির কাজ নেবে বলে ভেবেছিল চিত্র,তখন বাবুল,সমসের ভরসা দিয়েছে। তবু ভয় কাটে না।জিজ্ঞাসা করেছিল-‘যদি ধরা পড়ি ? সঙ্গে সঙ্গে কি গুলি মারে ?’

-‘না। সবসময় সঙ্গে সঙ্গে মারে না। সিলিন্ডার করবি। বলবি সিলিন্ডার,সিলিন্ডার ! তারপর অনেক সময় সুযোগ দেয় বুঝলি ? একবার খালেক ধরা পড়ছিল। ঘাট বন্ধ ও জানত না। এইসব ভিতরের কথা তো রাখালরা জানতে পারে না ! জানে কিছু জওয়ান আর এজেনরা। খালেক গোরু নিয়া তো জলে নামছে। গোরুগুলা জলে নাইমা এমন বজ্জাতি শুরু করছে ! সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার-‘কোন হ্যায় ?’ খালেক,কী করছিলি বলনা চিত্ররে।’বাবুল হাত মুঠো করে সিগারেট খায়। গেলাসে চোলাই ছিল।খালি পেটে চোলাই খেয়ে ভ্যাক করে ঢেকুর তোলে।

খালেক নোংরা মুখে হাসি ছিটিয়ে বলে-‘আমি ভাবতেছি,আমি এখন শ্যাষ ! বললাম,সিলিন্ডার,সিলিন্ডার ! দুই হাত এমনি কইরা উঁচা কইরা দাঁড়াইছি। মারছিল খুব।তবে,ছাইড়া দিছে।’

সিলিন্ডার ! সিলিন্ডার ! বললে গুলি করবে না ? চিত্র মনে মনে উচ্চারণ করে-সিলিন্ডার,সিলিন্ডার ! এই কথা মনে রাখবে চিত্র।বাঁচবে ও। দিনাজপুরের মেলা থেকে খাট,আয়না,আলমারি। আর দিনহাটা থেকে শাড়ি,ব্লাউজ ! ছোট ব্লাউজও। পঞ্চি পরে যেমন। আর চটি। জুতা। গেঞ্জি...সংসারে কত কিছু লাগে !

দুপাশ থেকে গোরুগুলোকে আগলে নিয়ে যাচ্ছিল দুজন রাখাল। পিছনে আছে আরও দুজন। চিত্র নতুন।সামাল দিতে না পারলে ঝামেলা। ঘাট দুই ঘন্টা খোলা থাকবে। কাজ যা করার এই সময়ের মধ্যে করতে হবে। দেরি করা চলবে না।

ঠান্ডা জলের ভিতরে জমে যাচ্ছিল চিত্র। কী ঠান্ডা জল ! রক্ত মাংস বরফ হয়ে যাচ্ছিল যেন। গোরুগুলো ঠান্ডায় চিৎকার করে ওঠে-হাম্বা আ ! সেই চিৎকার পাটকাঠির ঘরের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। চারপাশ থেকে গোরু তাড়িয়ে নিতে থাকে ওরা। আজ ঘাট খোলা।নাহলে এতক্ষণ ঘাটে পাহারা নেই কেন !

দু ঘন্টার আগেই গোরু পাচার হয়ে যায়।কেউ কোন শব্দ পায়না।

পাড়ে উঠে অনেকদূর পর্যন্ত যায় ওরা। গুচ্ছের গোরু তাড়াতে তাড়াতে ছোট একটা মাঠ পার হয়। আম কাঁঠালের ঝুপসি বাগানের ভেতরে লম্বা টিনের শেড দেওয়া মাটির ঘর। এজেন্ট খবর পেয়েছে সেলফোন মারফৎ।হাতে হাতে পাঁচহাজার টাকা তুলে দিল সে-‘ বসবা না ?’

মাথা নাড়ে সমসের-‘ বসার সময় নাই।‘ চিত্রকে দেখিয়ে বলে-‘দেইখা রাখ,নতুন।’কিছু টাকা চিত্রর হাতে দেয় সমসের-‘নে। তোর আইজ বউনি হইল।’ হে হে হাসে সমসের।

ফিরে আসতে আসতে শীতল জলধারার পুষ্ট জলে চিত্র কম্পমান ভবিষ্যতকে দেখে। বর অস্থির ভবিষ্যৎ। ধরা যায় তো ছোঁয়া যায় না।

দুদিন পরে ফের তেল মাখে চিত্র। এখন অনেক কিছু জানে ও। ওর ওপর অনেক দায়। সমসের সঙ্গে আছে। প্লাস্টিকে জড়ানো মোবাইল ফোনও আছে। একদিনেই চিত্রর হাতে মোবাইল ফোন এসেছে। এরপর ও ক্যামেরাওলা ফোন কিনবে। সমসেরের মত। তেল মেখে গামছা পরে নেয়। হাত থেকে ট্রাক ট্রাক গোরু কিনে আনে এজেন্টরা। তারই গোটা তিরিশেক আজ পাচার হবে চিত্রর মারফৎ। আজ এক ঘন্টা ঘাট খোলা থাকবে।

কনকনে জলে পা ডুবিয়ে দিতে দিতে চিত্র কল্পনা করে পঞ্চির স্টিলের ঘটি থেকে জলের ধারা নেমে এসেছে নদীতে। ‘ক্যামন ক্যামন’করা মনকে ঠান্ডা করার আশায় শরীর ডুবিয়ে দিতে থাকে চিত্র জলের ভিতরে। ঠান্দায় গোরুগুলো চিৎকার করে উঠল-হাম বা বা !

সেই আর্তস্বর কাঁপতে কাঁপতে জলে মিশে যায়। সাড়হীন শরীর নিয়ে রি রি কাঁপতে থাকে চিত্র। চিৎকার করে ওঠেও-‘পঞ্চি…ই…ই ! সমুদ্দরে নাও হইও না ! আমি তুমারে সব দিব !’

সেই চিৎকার কেউ শোনে না। জলের ভেতরের শব্দ জলের বাইরে যায় না। ভেতরেই মরে যায়। কাকা ধনেশ মন্ডলের ছেলে আদুল থাকলে বলত-‘তোরে বোবায় ধরছে ! হাম্বা হাম্বা করস ক্যান ?

‘তুই গোরু নাকি ?’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ