তানবীরা তালুকদার'এর গল্প : বকুলকথা

বকুল একবার উঠছেতো আবার বসছে বিছানায়। অস্থির লাগছে প্রচণ্ড কিন্তু কিছু করার নেই তার, জানে না কি করলে অস্থিরতা কমবে। টেবিলের ওপরে থাকা বইগুলো উল্টাচ্ছে, বাণী বসু’র লেখা ইদানীং খুব টানে তাকে। বহুবার পড়া “একুশে পা” আবারো খুলে বসলো, যদি মনটাকে ব্যস্ত রাখা যায়। কিছুক্ষণ অক্ষরগুলো চোখের পরে নাচানাচি করলো, অক্ষরগুলোকেই চিনতে পারছে না সে। পড়ার বৃথা চেষ্টা বন্ধ করে আবার বসলো। আজ ছুটির দিন হয়েছে বলেই জ্বালা। কোথাও যাওয়ার নেই তার, বন্ধু নেই বান্ধবী নেই। পার্লার আর বাড়ি আর বাড়ি আর পার্লার এইই জীবন প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বকুলের।
কর্মঠ মেদহীন শরীর দেখে কেউ ধারণাই করতে পারবে না আটত্রিশ কাটাচ্ছে বকুল এখন। সবাই ভাবে বড়জোর ত্রিশ। যদিও আজকাল কেশে রূপালী রেখে দেখা দিতে শুরু করেছে। সেদিন ঝর্ণাদিকে বলে মেহেদী রঙে ডাই করেছে নিয়েছে চুল সে। পরিচ্ছন্ন থাকতে বকুল খুবই ভালোবাসে। ছোটবেলার অভ্যাস, রাঙা কাকিমা করিয়ে দিয়েছেন। মুখে মেকাপ লাগিয়ে সাজে না সে খুব একটা কিন্তু সবসময় ম্যাচিং শাড়ি – ব্লাউজ – জুতো। হাতে কানে রঙ মিলিয়ে সামান্য পলার চুড়ি আর দুল। এতেই অন্যদের থেকে আলাদা দেখায় তাকে। মাঝারি গড়নের বকুল যে খুব আহামরি কিছু সুন্দরী নয় তা সে নিজেও জানে। কিন্তু তার ছোট চোখের সাথে মিলিয়ে কিভাবে মোটা করে কাজল পড়তে হবে আর মোটা গড়নের ভুরু প্লাক করতে হবে, মোটা ঠোঁটটাকে কি করে আঁকলে বিশ্রী দেখাবে না সেটাতো সে জানে আর তাতেই প্রায় কালো ঘেষা গায়ের রঙ, আর প্রায় ছোটর দিকের মাঝারী গড়নের বকুল, মোটামুটি দেখতে ভালো এই বিশেষণ পায় অন্যদের কাছে। 

প্রিন্টেড জর্জেটের শাড়িটা আবারো ভালো করে পিঠের ওপর দিয়ে এনে শরীরের মাঝে ঠিকঠাক জড়ালো সে। বসে বসে নখ দিয়ে মেঝের ওপর নানা রকম আল্পনা কাটছিলো। ঠাণ্ডা মেঝেতে পা রেখে এই আল্পনা আঁকা খেলাতে তার অনেক অবসর সময় কাটে। তার জীবনের যেমন কোন অবয়ব নেই, নেই এই আল্পনাগুলোরও কোন আকৃতি প্রকৃতি। নেহাত জন্মেছে বলেই যেমন তার বেঁচে থাকা তেমনিই এই আল্পনার অস্তিত্ব, কেটে যাওয়ার জন্যই যাওয়া। মাঝে একবার উঠে পাশের ঘরের সবাইকে আর এক দফা চা নাস্তা দিয়ে এসেছে সে। বাড়িটা খুব বড় নয়, না চাইলেও পাশের ঘরের কথা অনায়াসে এ ঘরে বসে শোনা যায়। আর পাশের ঘরেতো রাখ ঢাক করে কথা বলা হচ্ছে না। সবাই যার যার মতামত জোর গলায় দিচ্ছেন। শুধু বকুল অনাহুত সেখানে, সামনে দিয়ে অনেকবার যাওয়া আসা করলো, কেউ একবার তাকে বললো না বকুল তুইও বোস, গুরুত্বপূর্ন কথা হচ্ছে এখানে, তোর থাকাটা জরুরী। সে যে একটা মানুষ তারও কষ্ট হতে পারে, কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে সেটা তাদের হিসেবের মধ্যেই নেই? কিন্তু সে যে হিসেবের মধ্যে পরে না সেটাতো সে অনেকদিন ধরেই জানে, জানে না? তারপরও তার মনের মধ্যে কীসের ক্ষীণ আশা সে এতোদিন লালন করেছিল? 

আজো সেদিনটার স্মৃতি তার চোখে মনে জ্বলজ্বল করে। বোস বাড়ির রাঙাকাকু বিয়ে করে ফুটফুটে রাঙা কাকিমাকে বোস বাড়ি নিয়ে এলেন। বকুল তার জীবনে কখনো এতো সুন্দর মানুষ দেখেনি, মনে হচ্ছে সাক্ষাত দুর্গা প্রতিমা। দুর্গা ঠাকুরের মতো বড় বড় মায়াভরা চোখ, লাল টুকটুক ঠোঁট আর পিঠ ভর্তি একরাশ কালো কোঁকড়ানো চুল। সারা পাড়ায় বলাবলি হতে লাগলো বউ এসেছে বটে বোস বাড়ি উজ্জ্বল করে। বকুল রোজ মায়ের সাথে আসে, মা যখন বাড়ির কাজ করে বকুল তখন রাঙা কাকিমার পাশে পাশে ঘুর ঘুর করে। হাসি হাসি মুখের রাঙা কাকিমাকে দেখে তার মনের আশ মেটে না। রাঙা কাকিমা যদি তাকে কিছু করতে বলেন সে কৃতার্থ হয়ে যেতো। এভাবে দিন যায় রাত আসে আবার রাত কেটে দিন আসে। রাঙা কাকিমার সাথে বকুলের খুব ভাব হয়ে গেলো। কাকিমা তাকে ছবির বই কিনে দিলেন, অ আ ক খ পড়াতে লাগলেন। বকুলের মা অন্য বাড়িতেও যখন কাজে যায়, বকুল এ বাড়িতেই থাকতে লাগলো। শয়নে স্বপনে বকুলের পৃথিবীর ভরে রইল শুধু রাঙা কাকিমা। বছরের পর বছর ঘুরেও যখন রাঙা কাকিমার ঘর উজ্জ্বল করে কেউ এলো না তখন রাঙা কাকু মা’কে বললেন বকুল আমাদের কাছেই থেকে যাক। আমরা ওকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করবো। একথায় বকুল আর শুধু বকুলের মা নয় বকুলের পুরো পরিবার খুশিতে নেচে ওঠেছিল। বকুলদের বস্তির অনেকেই বকুলের ভাগ্য দেখে হিংসা করেছিল, কেউ কেউ হয়তো নিঃশব্দে দুঃখের নিঃশ্বাসও ফেলেছিলো। 

সেই থেকে রয়ে গেলো বকুল বোস বাড়ি। বয়স বেশি বলে সে প্রথমেই স্কুলে ভর্তি হতে পারলো না। কাকু কাকিমার কাছে পড়াশোনা করতে লাগলো। দুপুরে কাকিমার সাথে ঘুমোতো, টিভিতে সিরিয়াল দেখতো। কাকিমা কতো গল্প করতো, বই - সিনেমার ম্যাগাজিন পড়ে শোনাত, রবীন্দ্র সংগীত থেকে আরতি মুখার্জী, লালনের গান থেকে কিশোর সব কাকিমার পাশে থেকে জেনেছে সে। স্যান্ডউইচ বানানো কিংবা জিরা পানি, ইকেবোনা থেকে ঝাড়দানি, কাকিমা পাশে থেকে হাত ধরে ধরে বাড়ির মেয়ের মতো করে শিখিয়ে দিলো তাকে । হাঁটতে, চলতে, বলতে বোস বাড়ির মেয়েদের মতো হয়ে গেলো সে দ্রুত। মাঝে মাঝে মা ভাইবোনদের সাথে দেখা করতে নিজেদের বাড়িতে যায় বকুল, নিজেকে তার সেখানে খুবই বেমানান লাগে। কি চিৎকার করে মুখ খিচিয়ে খিচিয়ে কথা বলে তার মা বাবা, ছিঃ। দুজনের প্রতি দুজনের কোন ভালোবাসাতো নেই, শ্রদ্ধা ভক্তিও নেই। এ ভাষায় কেউ কাউকে কথা বলে। ভাই বোনদের মুখের ভাষা শুনলেতো দুহাতে কান ঢেকে লজ্জায় নুইয়ে পড়তে লাগলো। দাদা দিদিকে কিছু শিখাতে গেলে কিংবা বলতে গেলে তারা তাকে উলটো বিদ্রূপ করে হেসেই খুন হতো। বকুলের ভদ্দরলোকপনা তখন ভাই বোনদের কাছে একটা হাসির উপাদান। সহ্য করতে পারে না, কখন বোস বাড়িতে ফেরত চলে আসবে সেজন্য অস্থির হয়ে ওঠে সে । আর এখানের ইলেক্ট্রিকের পাখা ছেড়ে, ঐ ঘুপচি ঘরে আলো ছাড়া, বাতাস ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসতো। চারধারে আবর্জনার দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ করে আর কতোক্ষণই বা থাকা যায়। 

আস্তে আস্তে স্কুলে যেতে শুরু করলো। স্কুলের খাতায় তার বাবা মায়ের নাম এলো আর লোকাল গার্জিয়ান হিসেবে নাম এলো রাঙা কাকুর। পড়াশোনায় বকুলের তেমন মাথা ছিলো না আর পড়াশোনা করার তেমন ইচ্ছেও ছিলো না। ভবিষ্যতের কতোটুকুই কেউ বুঝে সে বয়সে। বোস বাড়ি থাকতে পেয়েই সে বর্তে ছিলো। অনেক কষ্টে কোন রকমে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করলো বকুল। কাকা কাকিমা তার উচ্চতর পড়াশোনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন না। তারা বললেন, স্কুল ফাইন্যালতো হলো, ঠিকাছে, এখন বরং কাজ কিছু কর। বকুলের নিজের পড়াশোনায় আগ্রহ কম থাকলেও সে এক কথায় খুবই অবাক হয়েছিল। তখনো বোস কাকুরা সব যৌথ পরিবারে থাকেন। বাড়ির অন্য ছেলে কিংবা মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে সবারই খুব কড়া দৃষ্টি। এই রাঙা কাকিমাই সেজ কাকুর ছোট মেয়ের ইংরেজি ট্রান্সলেশন নিয়ে প্রত্যেক দুপুর পরে থাকেন। কিন্তু বকুলের পড়া কিংবা পরীক্ষা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথাই সে দেখলো না। হলেও ভালো না হলেও ভালো। 

বকুল কি করবে কি করবে। তাই নিয়ে বকুলও ভাবছে, বোস বাড়ির কেউ কেউ ভাবছেন আর ভাবছেন বকুলের বাবা মা। বকুলের মা – ভাইয়ের ইচ্ছে, তারা যদি দেখে শুনে বকুলকে পাত্রস্থ করে দেন তাহলেতো একটা হিল্লে হয়ে যায়, একটা বোঝাও নেমে যায়। স্কুল ফাইন্যাল পাশ মেয়েই বা কম কী। তারা ইশারা ইঙ্গিতে বোস বাড়িতে একথাটা অনেকভাবে পাড়ল কিন্তু বোস বাড়ির কেউ তাতে গা করলো না। বোসরা তখন সবাই যার যার অংশ গুছিয়ে আলাদা হওয়ার তালে আছেন, সেই ব্যস্ততায় বকুলের ভবিষ্যত চিন্তা পাথর চাপা পড়ে গেলো। রাঙা কাকিমাতো বকুলকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকার কথা ভাবতেই পারেন না, বিয়ে দিবেন কি? রাঙা কাকিমার বাতের ওষুধ কি মাথা টিপে দেয়া, রাঙা কাকুর অফিসের ভাত বাড়া তো ব্যাংকে গিয়ে বিদ্যুতের বিল দেয়া বকুল ছাড়া সবই অচল। যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে কাকু কাকিমা বকুলকে আরো আঁকড়ে ধরলেন। বকুলের কাঁধে তখন রাঙা কাকিমার সংসারের চাবি, এই কতৃর্ত্ব হাতে পেয়ে বকুল তখন দিশেহারা। ছাদে যেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তরুণী সে গুন গুন গান গায়। কতো শতো স্বপ্ন তার দুচোখ বেয়ে অর্হনিশি উপচে পড়ছে। নিজের সৌভাগ্যে নিজেই ইর্ষান্বিত সে। ছোট বাগানঘেরা মায়া ভরা এই বাড়ির একজন সে। যাকে ছাড়া এবাড়ির কেউ কিছু ভাবতে পারে না। 

আস্তে আস্তে বকুল অনুভব করতে লাগলো তার ওপর কাকু-কাকিমার এ নির্ভরতা নিতান্তই স্বার্থ নির্ভর, ভালোবাসা নির্ভর নয়। আগে পাড়ার কেউ যদি বকুলকে ডেকে জিজ্ঞেস করতো, ও বকুল কি খবর তোর? এভাবে বোস বাড়ি পড়ে থাকলেই চলবে? পরের সেবা করেই যাবি? বিয়ে থা, চাকরি কিছুই করবি না? বকুল খুব বিরক্ত হতো। তোদের অতো দরকার কী বাপু, সে হবে যখন সময় হবে। কিন্তু সময়তো বয়ে যাচ্ছে, ষোড়শী বকুল এখন বাইশের তন্বী। কঁচি শরীর এখন অনেক পরিনত। কাকু-কাকিমা তাকে নিয়ে কোন কথা বলছেন না। কাকিমা নিজে যখন কাঁচা হলুদ, মুলতানী মাটি, চন্দন কাঠের গুঁড়োর ফেসপ্যাক বানিয়ে মুখে লাগান তখন যত্ন করে তা বকুলের গায়ে মুখেও লাগিয়ে দেন। পেয়াজের রস, মসুরের ডাল, নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে তার মাথায় লাগিয়ে চুলের যত্ন করা শেখান। তাকে সাথে নিয়ে পরিনীতা দেখতে যান, বইয়ের সাথে সিনেমার চিত্রনাট্যের তুলনামূলক আলোচনাও করেন। কিন্তু এসবের বাইরে তার আর কোন অস্তিত্ব কোথাও নেই। কাকিমার সাথে শাড়ি কিনতে কিংবা ফুঁচকা চটপটি খেতে গেলে কিছু আগ্রহী লোভী চোখ তাকে ঘিরে ঘুরঘুর করে, নতুন হিট ফিল্মের গান গেয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, কারণে অকারণে শিস দেয়, বকুল খুব আশায় থাকে কাকিমার চোখে পড়বে সেসব, কাকিমা নিশ্চয় কিছু বলবেন। এতো দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা কাকিমার নজরে শুধু বকুলই কেনো এড়িয়ে যায় তাই ভেবে সে হয়রান। 

বুক ভরা অভিমান নিয়ে একদিন বকুল কাকু-কাকিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাবা মায়ের কাছে চলে গেলো। কাকু-কাকিমা অনেক বাঁধা দিলেন, বোঝালেন তাদের কে দেখবে, তাদের কি হবে, বকুল ছাড়া আর কে আছে তাদের ঘুরে ফিরে সেই কথা। বকুলের কিছু চাই কীনা, তার ভবিষ্যতের কী হবে সেটা কাকু-কাকিমা একবারের জন্যও বলেন না। বাবা মা তার জন্যে বিয়ের চেষ্টা করতে লাগলেন। এদিক সেদিক থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগলো। শুক্রবার শুক্রবার করে ছুটির দিনে, তাদের বস্তির ঘুঁপচি ঘরে তাকে নানা পদের পুরুষ মানুষ দেখতে আসতে লাগলো। সুন্দর করে সেজেগুঁজে তাদের সামনে মাথা নুইয়ে দাঁড়ায় সে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যথাসম্ভব নম্র গলায় জবাব দেয়। দাদা বাবা সাধ্য মতো মিষ্টি চা খাইয়ে তাদের আপ্যায়ন করতে লাগলেন। কেউ কোন বাড়ির দারোয়ান, কেউ কোন রেষ্টুরেন্টের বয় কিংবা কেউ বা ফুটপাতের হকার। তাদের সাজ পোষাক, হাবভাব দেখে বকুল ভেতরে ভেতরে সিঁটিয়ে যেতে লাগলো। কোন কোন পাত্র বকুলের সাথে একান্তে কথাও বললো। বকুলের কি পছন্দ, কি চায় সে এধরনের কোন কথা নয়। বিয়ের পর সে কাজ করবে কীনা, সাহেবদের বাড়ি থেকে হঠাৎ চলে এলো কেনো, কোন লটঘটের ব্যাপার আছে কীনা ইত্যাদি জাতীয় প্রশ্ন। 

বিয়ে নিয়ে বকুলের দেখা স্বপ্ন ঝনঝন শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ভাঙতে লাগলো। বুকের নিঃশব্দ কান্না রক্ত হয়ে ঝরতে লাগলো যেটা পৃথিবীর কেউ টের পেলো না। সেই ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রক্তের ওপর পা দিয়ে, পণের টাকার পরিমান নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে দরাদরি চলতে লাগলো। এতোদিন সাহেবদের বাড়ি থেকে বকুল খালি হাতে ফিরেছে, সেটা পাত্র পক্ষ মানতেই নারাজ। এ কী করে হয়। নিশ্চয়ই সাহেবদের বাড়ি থেকে দেয়া টাকা পয়সা বকুলের বাবা মা রেখে দিতে চাচ্ছেন। বোস বাড়ির পরিবেশের আলোকে বকুলের দেখা চেনা পুরুষদের সাথে এ পুরুষদের কোন মিল ছিলো না। কিন্তু বকুলের নিজেরই বা কী আছে? মা বাড়ির ঝি, তাকে বোসরা তাদের বাড়িতে রেখেছিল মাত্র তার বেশি কিছুতো নয়। দেখতেও তেমন আহামরি নয় আবার বিদ্যের দৌড়ও সেই স্কুল ফাইন্যাল পাশ। সে কতো রকমের কেক বানাতে জানে, কতো সূক্ষ্ণ কুরুশের ঘর তুলতে পারে, সোয়েটার বুনতে পারে, শুনে শুনে সুনীলের কবিতা বলতে পারে কিংবা রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে এসব কথা জানতে এই পরিবেশের কোন লোক আগ্রহী নয়। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিত, সুচিত্রা মিত্র এরা এ পরিবেশে অপরিচিত আর বেমানান। বস্তির ঘরে প্রায়ই দাদা বৌদি, কিংবা বাবা মায়ের সাথে বকুলের ছোট ছোট জিনিস নিয়ে মতান্তর হয়ে যেতো। প্রাথমিক উচ্ছাস কেটে যেতেই দেখা গেলো বকুলকে ফিরে পেয়ে তারাও আনন্দিত নন, ফিরে এসে বকুলও আর সুখী নয়। 

রাগ করে চলে এসেছে বটে কিন্তু এখন প্রতি মুহূর্তে সে টের পাচ্ছে তার পৃথিবী আর এ পৃথিবী পুরোই আলাদা হয়ে গেছে। এ পৃথিবীর সে আর কেউ নয়। জাগতিক আরাম আয়েশ যা রাগের মাথায় তুচ্ছ মনে হয়েছিলো সে সমস্ত যে জীবনে অতি প্রয়োজনীয় বিষয়, তা প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে ধরা পড়তে লাগলো। গা মোছার জন্যে পরিস্কার বাথরুম, চা খাওয়ার জন্যে গ্যাস বার্নার, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার খোলা বারান্দা তাকে প্রতি মুহূর্তে হাতছানি দিতে লাগলো। কিছুদিন পর বকুলের রাগ পড়েছে কীনা দেখতে কাকু-কাকিমা একদিন এলেন তাদের বস্তির ঘরে। রাঙা কাকিমা এসে বকুলকে জড়িয়ে ধরতেই সব অভিমান ভুলে কেঁদে আকুল হলো সে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে অভিমান ভাঙিয়ে তারা বকুলকে সাথে নিয়ে এলেন। এতোদিনে বকুল টের পেয়ে গেছে সে স্বাবলম্বী হলে তাদের ছেড়ে যদি চলে যায় সেজন্য তারা তার কাজ, পড়া কিংবা বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী নন। যা করতে হবে নিজেকেই করতে হবে। ফিরে এসে বকুল এবার কোন একটা কাজের কথা ভাবতে লাগলো। পত্রিকার বিজ্ঞাপণ দেখে দেখে সে ভাবলো পার্লারে কাজ শিখবে। স্কুল ফাইন্যাল পাশ দিয়ে এর চেয়ে ভালো আর কীই বা পাবে সে। তার মতো মেয়েদের বাইরে সব জায়গায় কাজ ততো নিরাপদ কিছু নয় এখনো এদেশে। 

পাশের ঘরের হৈ চৈ’তে তার ভাবনার জাল ছিন্ন হলো। কাকুর বাড়ির লোক আর কাকিমার বাড়ির লোকের মাঝে চলছে আলোচনা। দুপক্ষই নিঃসন্তান কাকু-কাকিমার সম্পত্তির হিসাবের চুলচেরা নিয়ে বসেছে। তাদের অবর্তমানে কার কতোটুকু অধিকার, কে কাকু-কাকিমার কতো কাছের, কতো আদরের তার ওপরতো নির্ভর করছে কে কতোটুকু পাবে। মানুষের নিষ্ঠুরতায় এ ক’বছরে পুড়ে পুড়ে অনেক শক্ত হয়েছে বকুল, না কাঁদবে না কিছুতেই সে। চোখ জ্বালা করে আসলেও সে শক্ত হয়ে থাকবে। চোখের পানিকে সে মনের জ্বলুনিতে বাস্প করে চারধারে উড়িয়ে দিবে। কার জন্যে কাঁদবে বকুল? কার কি হয় সে? সবাই কাকু-কাকিমার অনেক কাছের লোক বটেইতো, শুধু বকুল ছাড়া। এই দূরের বকুল সকালে ঘুম থেকে ওঠে কাকু-কাকিমার নাস্তা বানায়, ওষুধ দেয়, দুপুরে তারা কি খাবেন তা রান্না ঝি’কে বুঝিয়ে দিয়ে পার্লারে যায়। সারাদিন কাজ শেষে ফেরার পথে ঘরের বাজার, ওষুধ আর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে তবে ফিরে। ছুটির দিনে তাদের নিয়ে হাটতে বেরোয়, নাটক দেখতে নিয়ে যায়, কাকিমার অনেক দিনের না দেখা মাসিকে মনে পড়লে তার বাড়ি খুঁজে বের করে সেখানে নিয়ে যায়। অসুখ বিসুখে দৌড়ে ডাক্তার ডেকে আনে। এহেন দূরের বকুলের মনে পাশের ঘরের আপাত রুক্ষ আলোচনা যেমন কোন ছায়া ফেলে না, তেমনি উল্লসিত ধ্বনিও কোন রেখাপাত করে না। 

খোঁজ নিয়ে কাকিমার অনুমতি নিয়ে বকুল পাড়ার কাছাকাছি একটা পার্লারে ঢুকলো কাজ শেখার জন্য। মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে বকুল কাজ শিখতে লাগলো। ভুরু প্লাক দিয়ে শুরু করে খুব দ্রুতই স্কীন কেয়ারে পৌঁছে গেলো সে। কাজের জায়গায় আস্তে আস্তে অনেকের সাথে তার বেশ ভাব হলো। ভাগ্য বিড়ম্বিত অনেকেই আছে এ পৃথিবীতে তাহলে সে শুধু একা নয়। দুর্ভাগিনীরা দায়িত্ব নিয়েছে সুখী মানুষদের সুন্দর করে সাজিয়ে গুজিয়ে তোলার। অন্যদের দুঃখের কথা শুনে, নিজের দুঃখ ভাগ করে এক রকম দিন কেটে যাচ্ছিলো। সেখানে একটা আলাদা পরিবার তৈরী হলো তার। সবচেয়ে বেশি ভাব হলো ঝর্ণাদির সাথে। গোপন থেকে গোপন দুঃখও দুজন দুজনের মধ্যে ভাগ করে নিতে লাগলো। স্বামী সন্তান নিয়ে ঝর্ণাদিকেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় দৈনন্দিন জীবনে। একদিন ঝর্ণাদি বকুলকে বললো, এতো ভালো কাজ শিখে এখানে কেনো পড়ে থাকবি তুই? আমি চলে যাচ্ছি ভালো পার্লারে, তুই যাবি সাথে? অনেক ভেবে বকুলও ঝর্ণাদির সাথে যাবে ঠিক করলো। মোটা বেতনে বকুল শহরের নামকরা পার্লারে এখন কাজ করছে। সকালে পার্লারে কাজে যায় সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে বাড়ির কাজ করে, কাকু-কাকিমার দেখাশোনা করে। মাঝে মাঝে বস্তিতে গিয়ে মা বাবাকে দেখে আসে। তাদের ওষুধ পথ্য, সংসারের কি প্রয়োজন দেখে শুনে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যথাসাধ্য পূরণ করার চেষ্টা করে। বকুলের ভবিষ্যৎ ভেবে মা বাবা দুঃখিত হন, তাদের সাধ্য সীমিত এই বলে বকুলকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন। বকুলের মাঝে মাঝে কেনো জানি বিশ্বাস হতে চায় না। তার মনে হয়, বিয়ে হলে সে যদি পর হয়ে যায়, মা বাবাকে না দেখে, এ ভয়েই কি মা বাবা তার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পিছিয়ে থাকেন। এভাবেই ঘুরছিলো ঘড়ির কাটা, ক্যালেন্ডার তার পাতায় রঙিন ছবির সাথে বছরের সংখ্যা বদলে যাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে মাথার ঘন চুল পাতলা হতে শুরু করেছে, চোখের কোলে ভাঁজ জমতে শুরু করেছে। 

রাতে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। দু চোখের পাতা জুড়ে থাকে হতাশা, বিষাদ আর ক্লান্তি। জানালার বাইরের অন্ধকার আর তার দু চোখের অন্ধকার এক সাথে মিশে যায়। বাইরের অন্ধকার ক্ষণস্থায়ী, আহ্নিক গতিতে ভোরের আলো রাতের অন্ধকারকে খেয়ে নিবে কিন্তু তার জীবনের অন্ধকারের কি হবে? আজকাল ঝর্ণাদি বলছেন বাবা মা, কাকু-কাকিমার আশা ছেড়ে দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিতে, ঝর্ণাদি সাহায্য করবেন। সেদিন ষ্টুডিওতে গিয়ে তিন / চার রকমের পোজে ফটো তুলে এসেছে সে, পাত্র পক্ষকে পাঠাবার জন্যে। ভয়ও লাগে, পত্রিকা দেখে একদম অচেনা অজানা লোক আসবেন, তারা মানুষ কেমন হবেন। যদি ঠকে যায়, তাহলে কার দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে সে। তারপরও মরিয়া হয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিল পাত্র চাই শিরোনামে। খুব বেশি কিছু নিজের সম্পর্কে বলারতো ছিল না, খুব বেশি সাড়া পড়েওনি। যারাও বা বিজ্ঞাপণ পড়ে এসেছিল তারাও তার আশ্রিত অবস্থা জানার পরে আর তেমন আগ্রহী হননি। বোস বাড়ির আশ্রিতা না হয়ে যদি দত্তক মেয়ে হতো সে তাহলে হয়তো সাধারণ একটা আটপৌড়ে ঘরের, শিক্ষিত মার্জিত একটা ছেলেকে সে স্বামী হিসেবে পেতে পারতো। রাজপুত্র কিংবা ধনী কিংবা বিরাট কোন চাকুরীজীবির আশাতো সে রাখেনি মনে। তাকে শুধু একটু বুঝবে, শিক্ষিত, মার্জিত এইটুকু স্বপ্ন দেখে সে তার কাঙ্খিত স্বামী নিয়ে। দু একজন বয়স্ক বিপত্নীক সামান্য আগ্রহ প্রকাশ করলেও বকুল নিজেই কেনো যেন তার মন থেকে সাড়া পেলো না। 

পার্লারের অনেকেই বলে তুই কেনো কারো সাথে ভাব করার চেষ্টা করিস না? কিন্তু ভাবটা কখন করবে বকুল আর কার সাথে? সেতো অফিসে কাজ করে না, কোন ছেলের সাথে যোগাযোগ হওয়ার সুযোগ কোথায় তার জীবনে? রাস্তায় হাটার মাঝে কতো জনকেইতো দেখে কাকে বলবে এসো ভাব করি? আর বলবেইবা কোন মুখে, আশ্রিতার প্রতি কেবা আগ্রহী হবেন? আর ভাবের কান্ড নিয়ে পাড়া থেকে মাঝে মাঝে যে ধরনের ঘটনা কানে আসে তাতে তার সাহসেও কুলায় না। এগুলো বড়লোকের ছেলে মেয়েকে মানায়, তাদেরকে না। কাকু-কাকিমাকে গোপন করে পাড়া থেকে দু একজন চেষ্টা করেছিল তার বিয়ের জন্য কিন্তু কোন শিক্ষিত ছেলে, সে যতো ছোট চাকরীই করুক, কারো বাড়িতে আশ্রিত থাকে এমন মেয়েকে বিয়ে করলে সমাজে লোকে কি বলবে সে কথা ভেবে বকুলের দিকে মুখ তুলে চাইলো না। আজকাল বকুল ভাবে তাহলে সে কোন শ্রেণীতে রইলো? ভদ্রলোকের সমাজে সে গৃহিত নয়, আর ছোটলোকদের সমাজে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। বোস বাড়িতে এসে আজ সে কূল হারা। কীইবা ক্ষতি হতো যদি সে রাঙা কাকিমার মতো ছোট টিপ না আঁকতে জানতো কপালে কিংবা চিকন পাড়ের ডুরেশাড়ি না পরতো। কপালে আজ থ্যাবড়ানো সিঁদুর নিয়ে কোন সস্তার শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে, কারো আদরে সোহাগে দিনতো কাটিয়ে দিতে পারতো। তার কোল জুড়ে কেউ থাকতো যে হয়তো কারণে অকারণে তাকে মা বলে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতো। 

আজ মনে হয় বৃথাই এই রবীন্দ্র সদনে যাওয়া, এই রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া। বৃথা এই রান্নার বই দেখে নানা রকম স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করা। মার্জিত দেখানোর জন্য নিজের প্রতি এতো যত্ন নেয়া। বাবা মাকে দেখতে বস্তিতে যখন যায়, ছোট বেলার খেলার সাথিদের সাথে দেখা হয়ে যায় কখনো সখনো। এক পলক দাঁড়িয়ে কুশল সংবাদ আদান প্রদানের ফাঁকে তৃষিত নয়নে সে তাদের ভিতরটা কেটে কেটে দেখে নিতে চায়। সস্তার শাড়ি, অমার্জিত সাজগোজ, তেল চুপচুপে চুল কিন্তু মুখে অন্যরকম একটা লাবন্য। এর নাম কি সুখ? কোলে ছেলে নিয়ে যখন সংসার সম্বন্ধে হাজারটা অনুযোগ করে, গলার স্বরটা ওদের কেমন যেনো পালটে যায়, এটাই কি আনন্দ? তারা যখন তাকে বলে ঘর বর হয়নি তার, বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে, তার ভিতরটা কাঁপতে থাকে। সে কম্পনে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কাকে বলবে এ কষ্টের কথা। কি হতো বোস বাড়িতে না থেকে যদি দিদিদের মতো মায়ের কাছেই থেকে যেতো। যা জানতো না কোনদিন সেটা হারাতো না। এখন মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, সুনীল, হেমন্ত, মান্নার চেয়ে এই বস্তির আকাশে ভেসে যাওয়া হিন্দী গান প্যায়ার কা তোফা তেরা, পাড়ার ছেলেদের খিস্তি গালি, বারোয়ারী পূজার মন্ডপ এগুলোও একটা জীবন চালিয়ে নিতে কম কিছু না। বড় কিছু পেতে গিয়ে আজ সে নিঃস্ব হয়ে গেলো। 

কী কী অন্যায় করেছে এ জীবনে? কী কী খারাপ কাজ করেছে? জ্ঞানত কার কার ক্ষতি করেছে? কার দুঃসময়ে হেসেছে, কার দুর্ভাগ্যে খুশি হয়েছে? ছোটবেলায় কত পাখির সংসার ভেঙে দিয়েছে গাছের ডাল থেকে, সেই কি ঘোর পাপ হল? সিনেমায় দেখা নায়ককে মনে মনে তার নিজের বলে কল্পনা করতো তাতেই কি তার চিত্ত অশুদ্ধ হল? তাই কি বিশেষ কারো ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো? কিন্তু সজ্ঞানে বড় কিছুর প্রতি হাত বাড়িয়েছিল কি? কি পাওয়ার জন্য আজ সব হারালো বকুল? কার কাছে এর প্রতিকার চাইবে? আজকে তার এই নিয়তির জন্য তার কি অপরাধ? কেন পৃথিবী তাকে তার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করলো? দিনটা কাজের মধ্যে কেটে যায়। ভয়াবহ লাগে একলা থাকা রাতগুলোকে। একাকিত্বকে চেনা যায় এই দুঃসহ দীর্ঘ রাতের দিকে তাকিয়ে। তারায় তারায় খুঁজে বেড়ায় সেই মুখ যা শুধু তার একান্তই নিজের। একাকিত্ব ফালা ফালা করে কাঁটে তাকে। দেহের তাপ তবুও সহ্য করে নেয়, মনের চাপ বয়ে বেড়ানোই দায় এখন। 

নিজের ভাবনা থেকে হঠাৎ করে বাস্তবে ফিরে এলো। সকালে এসেছিল সবাই কিন্তু প্রায় দুপুর হয়ে এলো। দুপুরে কি সবাই এখানে খাবে? খাবার তাহলে বাইরে থেকে আনতে হবে, এতো লোকের খাওয়ার যোগাড়তো করেনি বকুল। কি আনবে মোগলাই না চায়নীজ? কাকিমাকে ডেকে জেনে নিতে হবে। বকুল সবসময় সব ম্যানেজ করে নেয় তাই হয়তো কাকিমা এসব নিয়ে ভাবছেন না। অভ্যাসবশতঃ নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে চুলে সামান্য চিরুনি বুলালো, শাড়িটা গুছিয়ে আঁচল ঠিকঠাক করল, মুখটায় ভালো করে পাউডার পাফ করে পায়ে পায়ে বসার ঘরের দিকে এগুলো। মনে যতো কষ্টই থাকুক, তার ছায়া মুখে পড়তে দিবে না। কালো মুখে পাউডার ঘষে ঘষে সুখের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসবে। বকুল এখনো খাবার ব্যবস্থা করেনি শুনে কাকিমা অবাক হলেন। বললেন শীগগীর খাবার নিয়ে আসতে। খাবার এনে বকুল টেবিল রেডী করে সবাইকে ডাকতেই হই হই সবাই এলেন খেতে। খাওয়ার টেবিলে বেশ খুঁনসুটি করে আনন্দময় পরিবেশে খাওয়া হলো। বকুলও সবার সাথে হাসি আনন্দে যোগ দিল, হ্যা হ্যা করে হেসে গড়িয়েও পড়ল মজার সব কথায়। বিকেলে সবাই বিদায় নিলেন আলোচনা যা হলো তা উকিল ডেকে শীঘ্রই উইল করে ফেলবেন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে। 

ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে থালা বাটি গোছাতে গোছাতে অনেক কথা শুনেছে বকুল। কিন্তু আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সন্ধ্যেবেলা ক্লান্ত গলায় রাঙা কাকিমা জানালেন, কাকুর প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা, ব্যাঙ্কে জমানো টাকা, কাকিমার পারিবারিক গয়না সব কাকু আর কাকিমার ভাই বোনের ছেলেমেয়েরা সমান ভাগে পাবে। যতোদিন তাদের দুজনের কেউ বেঁচে থাকবেন, ততোদিন বকুল এ বাড়িতে থাকতে পাবে। আরো কি কি যেন বলেই যাচ্ছিলেন কাকিমা কিন্তু বকুলের কান দিয়ে সেসব কথা আর ঢুকছে না। তার পৃথিবী টলছিল তখন। মনে মনে ক্ষীণ আশা ছিল তার, এ বাড়িতে জীবনের বত্রিশ তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলো, আপনজনের সামান্য স্বীকৃতি হয়তো পাবে সে তাদের কাছে। কিন্তু একি শুনলো, কাকু-কাকিমা না থাকলে তারপর তারপর তারপর তাকে কে জানে তারপর ............। মনে মনে চিৎকার করে ভগবানকে বললো, তুমিতো জানতে ঠাকুর কাকু-কাকিমা আমি তাদের মন থেকে ডেকেছি, মন থেকে মেনেছি, মনে কোন পাপ, লোভ ছিল না ভগবান। আমার এ সমস্ত ভক্তি ভালোবাসার বদলে আমি সামান্য স্বীকৃতি কেনো পেলাম না ? কি পাপে তুমি আমায় এই সাজা দিলে? আমি এই পৃথিবীতে কেন কারো আপন হলাম না। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ