সাগরিকা রায়ের গল্পঃ দুজনে

স্বাভাবিক কারণে নিজের ছায়াই দেখার কথা । আয়নায় । প্রতিচ্ছায়া ছায়া নয় । কিন্তু গোলমাল হল সেই ছায়া বা প্রতিচ্ছায়াকে দেখতে গিয়ে । গতকাল একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল । খাওয়া নয় । পান । এরকমটা হয়না কখনও । পান ফান ওর পছন্দের বিষয় নয় । তবে হয়ে গেল । সুতরাং ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ডবল ছায়া দেখে ফেলল ।
দুটো আশিস । দুটোই একরকম কিনা বুঝতে পারলনা ও । বুঝল না বলে বেশি চিন্তাও করল না । ধপাস করে শুয়ে পড়ল । তারপরেই গভীর ঘুম । ঘুম ভাঙল বেলা নটা নাগাদ । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল । বসতেই মাথা ভারি । শরীর ঝুলে পড়ছে । এখন এককাপ কড়া কফি চাই । তারপর স্নান । 

শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে অজস্র জলের ধারা শরীর বেয়ে নামতে দেখে ও । লিউফাতে সোপ জেল ঢালতে ঢালতে প্রশান্ত মামার মুখে শোনা গান গলায় খেলাতে থাকে –ভালবাসা কি কথার কথা সই / মন যার সনে বাঁধা...। নিধুবাবুর টপ্পা । কেউ এসেছে । ডোর বেল বাজছে জলের শব্দকে উপেক্ষা করে । কে এল অসময়ে ? ক্যানিং –মাসি । এখন ফটাফট কাচাকাচি , ঝাঁটপাট । বললে কফি করে দেবে । আর ডিম...ডিম কি আছে ফ্রিজে ? মাথা থেকে জল পড়ছে টপাস টপাস করে । কোমরে টাওয়েল জড়িয়ে দরজা খুলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল আশিস । মাসি নয় । সুনীত । সুনীত দত্ত । আশিসের অবস্থা দেখে হেসে ফেলল । 

- অফিস নেই ? এখন স্নান ! 

- আছে আছে , বস , চেঞ্জ করে আসি । 

চেঞ্জ করতে গিয়ে আর এক বিপত্তি । গতরাত থেকেই আয়নাটা বেদম বজ্জাতি শুরু করেছে । এর কারণ অ্যালকোহল হলে , সুনীতকেও ডবল দেখার কথা । তাতো হচ্ছেনা ! সুনীতের বেলা সিঙ্গল , আর আশিসের বেলায় ডবল ? ইয়ার্কি হচ্ছে ? 

-হচ্ছেটা কী ? লিপস্টিক ব্লাশার লাগাচ্ছিস নাকি ?আওয়াজ দিচ্ছে সুনীত । তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভাল করে বোঝা হলনা ব্যাপারটা । শার্টে একটা বোতাম নেই । লন্ড্রির কীর্তি । একদিন এমন ধোলাই ঝাড়তে হবে ওদের ...! ভি শেপের ব্ল্যাক টি গলিয়ে নিল আশিস ।এখন জিনসটা...ওই যে ! এহ! সোফার ওপরে নেতিয়ে পড়েছে যেন পোষা বেড়ালরানি ! 

-চুলে চিরুনি কি আউট অফ ফ্যাশন ? নাকি ফিদা ? ডাবল চাঁদের জন্য ?মুনমুন তোকে এই লুকে দেখলে জাস্ট ইয়াপ বলে উঠবে । বদমায়েশি হাসি সুনীতের মুখে । 

মুনমুন ? ধ্যাত , ওকে একটা লাইকও দেবেনা আশিস । কমেন্টের কথাই নেই । সবার সঙ্গেই গুপিচুপি চালায় মুনমুন । অনেকটা ওদের কাকদ্বীপের লহরী চন্দের মতো । পার্টির কোন নেতাকে পটিয়ে চাকরি জোগাড় করে নিয়েছে । কন্ট্রাক্টচুয়াল । তাতে কী ? ক’দিন পরেই পার্মানেন্ট হয়ে যাবে । মুনমুন ওই লাইনের মেয়ে । সুবিধেবাদী । 

-ওভাবে বলিসনা । 

এমন সুরে কথাটা বলল সুনীত , আশিস শব্দ করে হেসে উঠল । তারপরেই চমকে উঠল । ওর নিজের হাসিতেই একটা অন্যরকম শব্দ হচ্ছে ! খ্যা খ্যা ! শিট । এভাবে হাসে নাকি ও? তাহলে কি সুনীত হাসল ? 

-না , আমি না । সুনীত কনফেস করল । একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল- কী হল তোর ?মুনমুন ? 

-মুনমুনের পিঠে ডানা আছে ভাই । সেটা ওকে স্থির হতে দেয়না । সারাক্ষণ উড়ে বেড়াচ্ছে । ফর এভার । 

ফের ডোরবেল । এবারে মাসি ঠিক । দরজা খুলে দিল আশিস- দেরি করলে ! আজ কেউ নেই । সব বাড়িতে গেছে ।আজ শনিবার ভুলেছ ? মেস ফাঁকা । গজগজ করে আশিস - একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারনা ? 

-মোবাইল চেকিং হচ্ছিল ট্রেনে । কী করবো । 

কিছু বলতে পারেনা আশিস । এদের তো রেগুলার সোর্স অব ইনকাম নেই ! মনে হতেই হাসি পেল । বাবা টাকা পাঠালে মেসের ভাড়া চলবে । অবস্থাটা ক্যানিং মাসির থেকে খারাপ ওর । প্রাইভেট কোম্পানি খাটিয়ে নিচ্ছে ঘরের পয়সা নিয়ে । 

-কাল লেট নাইট পার্টি করে আজ লেট মার্ক । 

-পার্টি ? তুই পার্টিতে ? ড্রিঙ্ক করেছিস ?কিন্তু তুই এসব লাইক করিস বলে জানতাম না । মুনমুনের জন্য দেওদাস নাকি ? 

-এখন কেউ দেওদাস হয়না । সময় কোথায় ? লাইফ এনজয় কর । এই তো জীবন । মুনমুন ! কিতনা আয়েগা কিতনা জায়েগা । হাসল আশিস –রোজ আমার ইনবক্স পিঙ্ক হার্টে ভরে যায় , তা জানিস ? 

-লাকি চ্যাপ । আমার তো এক ম্যাডামকে খুব মনে লেগেছে । রক্তাক্ত হার্ট পাঠাচ্ছি । দেখি কতদিন ল্যাজে খেলান । 

কথা বলতে বলতে ওয়ালেট খুলে খুচরো টাকা দেখে নিছিল আশিস । সুনীতের কথাগুলো মাথায় ঘুরছে । সত্যি কি ও পার্টি করেছে ? ড্রিঙ্ক ?আশিস নামের ছেলেটা এসব পছন্দ করে ? বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতে গিয়ে পুরো আউট হয়ে গেল ? 

সুনীত ওকে লক্ষ্য করছিল । শ্যাওলা ধরা দেওয়ালের ভেতরটা যেমন ঢাকা পড়ে থাকে , আশিসকে অনেকটা সেরকম লাগছে । উপর থেকে ভেতরটা বোঝা যাচ্ছেনা । 

-তুই একটা গাড়ি কিনে নে । লেট হওয়ার ভয়ে ভ্রু তুলে আছিস । গাড়ি থাকলে ভু-উ-উ-স । 

গা-ড়ি? 

-হ্যাঁ , তাহলে আরও কত সুবিধে । মুনমুন হেসেখেলে গাড়িতে উঠে আসবে । তোর চেহারায় একটা মেসি লুক আছে । কেয়ারফুলি কেয়ারলেস লুক । সঙ্গে দামি ল্যাপি রাখ । ব্যস ! 

সন্দিহান দৃষ্টিতে সুনীতকে দেখল আশিস । ইয়ার্কি মারছে সুনীত । অথচ মুখ একেবারে সিরিয়াস । 

অফিস কামাই হল । সুনীত মাথার মধ্যে পোকা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে । পোকাটা বারবার একটা কথাই বলে যাচ্ছে । গাড়ি…মুনমুন…মেসি লুক…। অবিরাম ভাঙা রেকর্ড বেজে যাচ্ছে । কিন্তু এরকমটা ওর মোটেই পছন্দ নয় । এরকম হচ্ছে কিছুদিন ধরে । মাঝে মাঝেই ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে চারপাশে । কালিঘাট থেকে হাজরার দিকে যাচ্ছে , তখনই দেখতে পেল । হুবহু ওরই মতো দেখতে একজনের পাশে বসে আছে মুনমুন । ওটা কী গাড়ি ? ইনোভা ?আই টেন ? হুস করে চলে গেল ওরা । ভাল করে দেখা হলনা গাড়িটা …। অথচ অনেক কিছুই ভাল করেই দেখা হল । ওরই মতো দেখতে , অথচ ও নয় … ছেলেটির পরনে ব্লু ফুল স্লীভ টি । । দারুণ স্মার্ট । স্মার্ট দেখালেও আশিস নিজে কখনও এই রকম টি শার্ট পছন্দ করেনা । 

এই পছন্দ-অপছন্দগুলো সবসময় তাড়া করে । যেমন আয়নার প্রতিচ্ছায়া । সেটাও হুবহু ওরই মতো দেখতে । ক্লোন কি ? নাঃ , সেসব তো হয়নি ! যমজ ভাইও নেই ওর ! । মুনমুনকে জিজ্ঞাসা করবে ? কিন্তু কী জানতে চাইবে ? 

প্রাণ সিঁড়ি বেয়ে নামছে , ও উঠছে । মাঝামাঝি ধাপে এসে থমকে দাঁড়াল প্রাণ – আরে , গাড়ি কিনলে নাকি ? বাবার গিফট ? 

বিরক্ত হল আশিস – ধেত তেরি ! ওটা আমি নই । ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বর সাক্ষী ওটা আমি নই । সাপ , ব্যাঙ মাছ সাক্ষী ওটা আমি নই । বায়ু পিত্ত কফ সাক্ষী ওটা আমি নই । লজ্জিত হল প্রাণ- দাঁড়াও , আমি ভুল দেখেছি । কিন্তু কী বলবো , হুবহু তোমার মতই দেখতে । তুমি নও তাহলে ! 

-না , আমি নই । কে এক আহাম্মক আমার মতো চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ! আমি গাড়ি কিনবো টাকা কোথায় ? বাবা গিফট দেবে ? গাড়ি ? 

-কেন ? সেকেন্ড হ্যান্ড কেন ! 

-ধুত , ওসবে খুব ঝামেলা ! 

হতাশাব্যঞ্জক বাক্যটি খপ করে ধরে ফেলল প্রাণ- গাড়ি কিনবে ? চল , আমার একজন পরিচিত আছে । গাড়ি তার নখদর্পণে । 

কী হল , তালেগোলে আশিস চলে গেল প্রাণের সঙ্গে । কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি করতে করতে আড়ে আড়ে দেখল রথীন ভদ্র । প্রাণের খুব পরিচিত সেই একজন । মুখের পেশিতে কোনভাবে প্রকাশ পেলনা প্রাণকে চিনতে পেরেছে কিনা । মানসম্মান নিয়ে বড্ড ভাবে আশিস । ফালতু এলনা তো এখানে ? প্রাণের কথায় চলে এল । গাড়ি কি কেনার ক্ষমতা আছে ওর ? কোন মানে হয় ? মান সম্মান শরীরে আটকে থাকে চামচিকের মতো । অপমানিত হতে পারে ভাবলে সেগুলো চুলবুল করতে থাকে । ওর অস্বস্তি বুঝে চোখ টিপল প্রাণ । এই এক ঝামেলা । চোখ টেপাটেপি বোঝেনা আশিস । বরাবর সেকেন্ড বেঞ্চের ছাত্র । এসব বুঝবে , এমন দিন কি হবে মা তারা ! 

-বলুন কী করতে পারি । চেয়ার ছেড়ে ওঠা দূর , চোখ তুলে তাকাল না পর্যন্ত । ঘাড়টা জাস্ট নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়েছে মাত্র । আশিসের ইচ্ছে হল কোমরে হাত দিয়ে ঠোঁট সূঁচোলো করে সিইইইইক করে সিটি মারে । তোলাবাজ লালুর মতো করে । কিন্তু পারলনা । শালীনতা ফতাগুলো এয়সা ঝামেলা করে ! 

-অনেক কিছু পারেন । আগে আলাপ করিয়ে দিই । প্রাণ অনেক কথা বলতে থাকে । আশিসের ইচ্ছের কথা । আশিস মন দিয়ে প্রাণের মুখ থেকে নিজের ইচ্ছের কথা শুনতে থাকে । 

-গাড়ি ? চারচাকা ? বাহ , প্রথম কাজটা করে ফেলেছেন । রথীন ভদ্র মন দিয়ে আশিসকে দেখে । 

প্রথম কাজ মানে ? বুঝতে না পেরে গঙ্গারামের মতো মুখ করে তাকিয়ে থাকে আশিস । গাড়ি কিনতে হলে কি সরল অঙ্ক কষে এগোতে হবে ? প্রথমে ভাগের কাজ , তারপরে গুণ ? তো ভাগটা করবে কী ? কাকে ? 

-অসুবিধে নেই । বলছি । প্রথম কাজ হল গাড়ি যে কিনবেন , সেটা ভেবেছেন । কোন মডেল কিনবেন ? সেটা ভাবুন । পরের কাজ পছন্দের দাম জেনে নেওয়া । 

-ব্যস ? হয়ে গেল গাড়ি কেনা ? আশিস ইয়ার্কির সুর আনতে চায়নি । কিন্তু হয়ে গেল । 

-এখনই নয় । পকেটে কত আছে ? তিন থেকে বিশের মধ্যে পাবেন । 

-বাপরে !মুখ থেকে আতঙ্কটা বেরিয়ে পড়ল । 

-জানা কথা । তাই পরের কাজটা করে ফেলুন । ব্যাঙ্কে যান । লোন নিন । 

-লোন ? 

-অসুবিধে কী ? মান্থলি স্কিমে শোধ করছেন তো !সেটাও খুব বেশি নয় । লোন কত নিচ্ছেন , তার উপরে নির্ভর করবে । ধরুন সুদের হার সেভেন পয়েন্ট সিক্স পার্সেন্ট । তাহলে লাখে হচ্ছে…,ঠোঁট নড়ছে ,কথা বলে চলেছে লোকটা । বোদ্ধার মতো তাকিয়ে প্রাণ । আশিসের মধ্যে সেই উসখুস ভাবটা ফিরে এসেছে । ধেত্তেরি ! কে চায় গাড়ি কিনতে ! বাস ট্রাম থাকতে কেনই বা শুধু মুদু গাড়ি কেনা ? 

বাসে উঠতে গিয়ে ভ্রু তুলে তাকাল প্রাণ- হল কী ? সুদটুদ শুনে ব্যোম মেরে গেলে যে ! 

-হ্যাঁ ভাই । বাবা জানে না । আমি কোথা থেকে গাড়ি …? ওসব আমার পোষাবেও না । 

প্রাণকে ঝেড়ে দিলেও সুনীতকে পারলনা । ও বড় ঘ্যান ঘ্যানে –সেকেন্ড হ্যান্ড কিনে নে ! 

-ধুর , লঝঝড়ে জিনিস গছিয়ে দেবে । 

-তা কেন ! সুনীত বোঝাতে চেষ্টা করে – কিছু নিয়ম মনে রাখতে হবে । ব্লু বুক আছে কিনা খোঁজ নিবি । কাগজপত্র , ট্যাক্স ঠিকঠাক দেওয়া আছে কিনা…! যার গাড়ি নিচ্ছিস , গাড়ি তার নামেই আছে কিনা , এসব খোঁজ নিবি । 

-নারে , কী দরকার আমার গাড়ি দিয়ে বলতো ? 

সুনীত কথা না বাড়িয়ে একসময় বিদায় নিল । প্রাণের মতো । রথীন ভদ্রের মতো । শেষ অব্দি গাড়ি কেনা হলনা । টিভির পর্দায় গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখে আশিস । দুর্দান্ত সব গাড়ি হুস হুস করে চলে যেতে থাকে দুর্গম রাস্তায় । কখনই তাদের পা মানে চাকা হড়কায় না । দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশিস । ঠিক ওই রকম গাড়ি চেপে পাশে মুনমুনকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই হুবহু লোকটা ! দেখতে দেখতে রাশি রাশি চিপস শেষ করে ফেলে আশিস । 

কিন্তু মুনমুনকে মোট্টে পছন্দ নয় ওর ! মুনমুনের শরীরের নির্যাসে গা গোলায় । অথচ ওই লোকটা ঘেন্নাপিত্তিহীন ! আবার দেখ , ওরই নামে আশিসের জীবন চলছে । 

একদিন ফের এল প্রাণ । একটু যেন রাগত স্বর – কী ব্যাপার ? কতবার ডাকলাম ! তাকালে না পর্যন্ত ! তা ফোর্ড কিনলে কবে ? 

অবাক আশিস প্রাণের লম্বাটে মুখে বিকেলের ছায়া দেখে । সন্ধেবেলায় ভ্রমণরত এক ভ্যাম্পায়ারকে দেখে । ব্যাপারটা তখনকার মতো মিটলেও সুনীতকে বোঝানো গেলনা - কিনব না , কিনব না করেও কিনে ফেললি ? বেশ করেছিস । রথীন ভদ্র ধরল নন্দন চত্বরে – মাঁতিজ কিনেছেন তাহলে ! আমাকে বললেই পারতেন ! একটু নামতো দরটা !জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে আশিস । এভাবে বাঁচা যায়না । অন্যের কীর্তি নিজের বলে চালানোর মতো বদলোক তো আশিস নয় ! লোকটার সঙ্গে একবার মুখোমুখি হওয়া দরকার । 

দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে ওকে । ঘুম হয়না ইদানিং । ভানুপিসি বলতো আত্মা নাকি পরলোকে শান্তি না পেয়ে জ্যান্ত মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় । এই সব দুষ্ট আত্মাকে তাড়াবার মন্ত্র জানে ভানুপিসি । ব্যাটাকে জব্দ করতে হলে অমাবস্যায় শ্মশানে যাবে আশিস । তাবিজ টাবিজ যদি লাগে তো তাতেও আপত্তি নেই ! 

মাথাটা গরম ছিল । এর উপরে পালাজো এলিয়ে এসে কাছে দাঁড়াল মুনমুন – দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছিল তোমাকে । 

-মানে ?আশিস ঠিকঠাক বুঝতে পারেনা । 

-লজ্জা পাচ্ছ ? তেরছা চোখে তাকাল মুনমুন- সেদিন কিন্তু অন্যরকম ছিলে । দাঁত না দেখিয়ে হাসে মুনমুন । ওয়াটারপ্রুফ লিপস্টিক দাঁতের প্রক্সি দিয়ে ঝিলিক তুলল । 

এসব কথার কোন অর্থ নেই । সবাই মিলে একটা লোককে পাগল বানিয়ে ছাড়বে । পুরো ষড়যন্ত্র । দেশপ্রিয় পার্কের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আশিস । চব্বিশ পরগণার গ্রাম থেকে সদ্য আসা আশিস মন খারাপ হলে এখানে চলে আসতো । মন থেকে ভাবনাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে এখানে আসতো । 

রাত ভারি হচ্ছে । মেস বাড়িতে ফিরে যেতে যেতে একটা সবুজ গাছ খোঁজে ও। রাস্তায় কত লোক । মাথার উপরে দাঁত বের করে ঝুলছে ল্যাম্প পোস্ট । কী রে বাবা ! সুইসাইড কেস নাকি ? ল্যাম্প পোস্টের আলোয় নিজের ছায়া দেখে আশিস । ছায়া দেখে বাবাকে মনে পড়ে । ক্লান্ত ছায়া একটা ! গ্রামের পুরোহিত বাবা ভাবে খুব বড়লোক হতে হবে । টাকা থাকলে লোকে মান্য করে । কত টাকার স্বপ্ন দেখে বাবা ? বংশগত জিন প্যাটার্ন কি আশিসে বর্তালো ? মাথা নাড়ে আশিস । ও টাকা চায়না । ওর দেখাদেখি ছায়া মাথা নাড়ে । রাস্তার নোংরা মেখে পড়ে থাকা ছায়াটা । 

ঘরে ঢুকে দমচাপা পরিবেশে দম বন্ধ হয়ে আসে । মা বলতো – শরীরের তাপ জুড়োয় মনের তাপ জুড়োলে । সত্যি আশিসের মনে শান্তি নেই । শুয়ে শুয়ে প্ল্যান কষতে থাকে । সুপারিকিলার দাসুকে ধরতে হবে । হুবহুটাকে গুম করে দিতে হবে । 

প্ল্যান কষে মাথা ঠান্ডা হয় । ধীরে ধীরে একটা ছবি ফুটে উঠতে থাকে । সমস্ত দুনিয়া জুড়ে মাত্র একটি আশিস , যার কোনও হুবহু থাকবেনা । 

ওহ ! হাই উঠছে ! জোর করে জেগে থাকে ও । প্রশস্ত রাস্তায় গাড়ি ছুটতে থাকে । চারপাশে থিকথিক করছে গাড়ি । বেকবাগান , পার্ক সার্কাস …ময়দান…গাড়ি ছুটে চলে । বাতাস সনসন । মুনমুন এলোমেলো । বহুতল বাড়ি আর ফ্লাইওভারের বেল্টের তলায় ল্যান্সডাউন রোড । সেখান থেকে আইনক্স ফোরাম । 

মধুর তৃপ্তি নিয়ে ঘুম ভাঙল । রাত এখন হাল্কা । শিশির পড়ছে কোথাও ! শরতকাল চলে এল ? টুপটাপ শব্দে শিউলি পড়ছে ? ওয়াইন খেতে ইচ্ছে করছে । 

আরামে দুহাত তুলে আঃ শব্দ উচ্চারণ করে ও । শ্বাসবায়ু ছেড়ে দিতে গিয়ে বাস্তবে ফেরে আশিস । কোথায় ওয়াইন ? কোথায় গাড়ি…মুনমুন …ফোরাম…? 

অ্যাঃ ! ছি ছি ! লজ্জায় জিভ বের করে ও । আয়নার ডবল প্রতিচ্ছায়া ভেঙচি কাটে ওকে । সাদাসিদে ছায়াটাকে ও স্বয়ং বলে দাবি করে । পাশের ছায়ার দিকে তাকিয়ে আঙুল তোলে আশিস –এটা সেই হুবহুটা । বিশ্বাস কর । আমি নই । আমার চুলে কি বার্গান্ডির আভা ? চোখে কি কন্ট্র্যাক্ট লেন্স ? মাকালী ,ওটাই মুনমুনকে নিয়ে সারারাত ঘুরে বেরিয়েছে , মজা লুটেছে ! আমি ওরকম নাকি ? ছিঃ ! 

এসব শুনে টুনে আয়নার কাচ থেকে আলগা হয়ে বেরিয়ে আসছিল দুজন । দুজন আশিস। ত্রাসে গলা বুজে আসে । হুবহু দুজনকে দেখে আঁতকে ওঠে ও । 

ভীষণ ক্রুর দৃষ্টি মেলে দুজনেই আশিসকে দেখছিল । দুজনেই দুহাত তুলে ডাকল –আয় , আমার কাছে আয় । 

নিরাকার একটি মানুষ কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে দুটি ছায়ার দিকে । কাকে বেছে নেবে , সেটাই ভাবছিল। সম্ভবত । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. দারুণ গল্প। চরিত্র অনুযায়ী ক্রিসপি ভাষা। সুরুটাতেই দারুণ চমক কিন্তু গল্পের মাঝখানটা কেমন যেন খেই হারিয়েছে বলে মনে হল। একটা লোকের দুটো ব্যাক্তিত্ব অনুযায়ী তাঁর একটা অতিরিক্ত ভারচুয়াল ছায়া হয়েছে কিন্তু সেটা শনিবারের মুডে এগিয়ে যেতে পারত। একজন খুব সাধারণ লোক, গ্রাম্য পুরোহিতের ছেলে। আর একজন আছে যে গাড়ি ইত্যাদি কিনতে চায়। কিন্তু তারা যে একই সত্তা থেকে জন্ম নিয়েছে সেটা আরও একটু পরিস্কার হতে পারত।

    উত্তরমুছুন