নোরা বলল, যাবেন?
আমি বেকায়দায় পড়ে গেলাম। যেতে আমি চাই নোরা তা জানে। জানে মানে আমি যে কখনো বলেছি তা কিন্তু না। তবে পুরুষের না-বলা কথা, না-বলা ইচ্ছা নারীদের জানতে খুব বেশি শার্লক হতে হয় না।
কেবলই লাঞ্চ শেষ করেছি। ঢেকুরে ঢেকুরে ভাজা সরপুঁটি বেরিয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। আমি নিকোটিন ধোঁয়ায় সেটা চাপা দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এখন দুপুর। গেলে যেতে হবে সন্ধ্যায়। নোরার ডিউটি আমার থেকে দুই ঘণ্টা পরে। ফলে দুই ঘণ্টা পরেই তার বের হওয়া। মানে সাতটা! নাহ! খুব দেরি হয়ে যায়! নোরা যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছে তা বুঝতে পারছি। আর আমি. অযথা, ঘাড় গুঁজে আছি, মোবাইলে।
'কী হলো ভাই, হ্যাঁ না কিছু বলেন!'
আমি সিগারেট ফেলে দিই। তিতকুটে লাগছে। বলি, না। যাওয়া হবে না। কাজ আছে।
'আপনার ভাই খালি হুদাহুদি কাজ। বৃহস্পতিবার কেউ কাজ রাখে? বৃহস্পতিবার হলো হইচইবার...জানেন না!'
নোরা খুব হইচই করতে পারে অবশ্য। মাতিয়ে রাখে সারা অফিস। একে তো সাত দিনে সাতরঙা শাড়ি পরে আসে। সাথে বাহুমূল কামড়ে থাকা স্লিভলেস ব্লাউজ। ভাবতেই বাহুমূল শব্দটা বেশ কয়েকবার ঘোরে মাথায়। কী দারুণ একটা শব্দ! সায়েরা বলেছিল শব্দটা। ও আবার কবিতা-টবিতা পড়ে! জীবনানন্দ খুব পড়ত এক সময়। এখন নতুন কোন এক কবির বলতে গেলে প্রেমে পড়েছে। এই কবি ফেসবুকে লেখে। সায়েরা সারাদিন ফেসবুকে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে টেক্সট করে অবশ্য আমায়—নতুন কিছু না অবশ্য! লাঞ্চ করেছো? কখন আসবা? রাতে কী খাবা? আমারও গতানুগতিক উত্তর থাকে। বিয়ের আট বছর পর নতুন নতুন উত্তর দেয়া মুশকিল! জীবন একটা ছকের ভেতর আটকে গেছে। আমরা দুজন তা জানি...বা হয়তো কেবল আমিই জানি...সায়েরা ব্যস্ত থাকে কবিতা নিয়ে। জীবনের মতো ক্ষুদে জিনিসের দিকে তার খেয়াল প্রায়শ থাকে না।
আমাদের সিগারেট খাওয়া শেষ হয়ে যায়। বারান্দা থেকে নোরা নোরার টেবিলে, আমি আমার।
নোরা আজকে বারে যাবে। আমি সাথে না গেলেও তার সাথে যাওয়ার মানুষের অভাব হবে না। বার থেকে নোরা রাতের ঢাকায় ঘুরে বেড়াবে উদ্দাম। সেলফি দেবে ফেসবুকে। লিখবে লাইফ ইজ বিউটিফুল! আমি তাতে বড়জোর লাইক দিবো। বা, হয়তো, দেবো না। কখনো কখনো নোরার স্ট্যাটাসে লাইক কমেন্ট করতে ভয় হয়। সায়েরার জন্য না অবশ্য। ও এসবে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু অফিসেরই আরো কলিগেরা আছে--এরা একেকটা বান...সব কিছুতেই রহস্য রহস্য ভাব করে! একেকটা অবদমনের ভাণ্ডার!
পাঁচটা বেজে যায়। এখন যাবো। যেতে ইচ্ছা করে না। কারওয়ান বাজার যেতে হবে। কলা কিনতে হবে কাঁচা...পেঁয়াজও। নেয়ার মতো কোনো মাছ পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। আর হ্যাঁ, দুধ কিনতে হবে! তিনটা বেড়াল পালে সায়েরা। একটা অন্যটার চেয়ে দেখতে সুন্দর। মায়াকাড়া চেহারা। ঘরে ঢোকা মাত্র মিউমিউ করে পা জড়িয়ে ধরে। ডিনারে তাদের দুধ লাগে।
বেরোনোর সময় নোরা আরেকবার তাকিয়ে হাসে। হাসিটা সুন্দর। হাসিটা আহ্বানেরও। মদ সহনীয় খেলে শরীরের কোনো ক্ষতিও তো করে না!
বাজারে ঢোকার আগেই সায়েরার ফোন আসে। গলা থমথমে। আমি উৎকণ্ঠা দেখাই—কী হয়েছে?
ও বলে, মাইগ্রেন!
আমি আফসোস করি। সে বলে তার পায়ের ওপর দিয়ে আজ দুপুরে একটা ধেড়ে ইঁদুর চলে গেছে। আমি অবাক হই। বাসায় তিন তিনটা বেড়াল থাকতে ইঁদুর হয় কীভাবে! মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়েই ধমকায় সায়েরা--এরা কি শিকারী বেড়াল নাকি যে ইঁদুর খেতে যাবে!
'খাবে না? বেড়ালের কর্তব্য ইঁদুর খাওয়া!'
সায়েরা মিষ্টি হাসে। বলে, সবাই তোমার মতো না...কর্তব্য বোঝে না!
খুশি হওয়ার বদলে আমার বেদনা হয়। কর্তব্যে অবহেলাপ্রবণ বেড়ালগুলোকে ঈর্ষা হয়। সুখ আছে তাদের...যা কিছু করার আছে স্বাধীনতাও।
সায়েরা বলে, শোনো, মাথা নাড়াতে পারছি না...চোখ খুলতেও পারছি না! এর মধ্যে ইঁদুর নিয়ে পেরেশান হতে পারব না! তুমি একটা ব্যবস্থা করো!
'কী ব্যবস্থা! আমি তো বেড়াল না যে ইঁদুরগুলো খপাখপ করে ধরে খেয়ে ফেলব!'
'ছি! অ্যায়ায়ায়াক! তুমি যে কী! পনের বছর ঢাকায় আছো... মফস্বল তোমার শরীর থেকে গেলই না!'
আমি হাসি। বলি, না তুমি শহর খুলতে পারলে...না আমি মফস্বল!
সায়েরাও হাসে। বেদনাজর্জরিত হাসি। বলে, ছাড়ো! এক প্যাকেট ভালো দেখে ইঁদুর মারার বিষ এনো। আর আলু কিন্তু নেই!
আমি আলু কিনি। শিম এখনই উঠে গেছে বাজারে। কিনতে গিয়ে কিনি না। সায়েরার পছন্দ না।
বাসায় ঢোকার মুখে নোরার ফোন আসে--ভাই আপনি কই?
'এই তো! এই তো!'
'আরে এই তো আবার কী! কই আছেন? বাসায় ঢুকে গেছেন?'
'না না। ঢুকিনি। ঢুকিনি এখনো।'
'আমি কিন্তু বেরিয়েছি। আসবেন?'
চাবি ঘুরিয়ে বাসায় ঢুকি। সায়েরা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। লাইট জ্বালিয়ে দিই। সে কোনোমতে চোখ তুলে বলে, আসছো! ডিম আনছো?
ডিমের কথা সায়েরা বলেনি। আজ বলেনি। তবে তার দাবি কাল বলেছিল। আমি বলি, বাদ দাও না! চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি। আজ তো বৃহস্পতিবার!
সায়েরার চোখ লাল। কোনোমতে বলে, তোমার কোনো আক্কেল আছে! দেখছ না আমার অবস্থা?
আমি বাজার গুছিয়ে রাখি। বেড়ালগুলো ম্যাওম্যাও করে আমার পায়ে লেজ ঘষে। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম আছে--আমি মনে করতে পারি না।
অল্প সাউন্ডে টিভি দেখি কিছুক্ষণ। খেলা হচ্ছে। বাংলাদেশ হেরে যাচ্ছে। সায়েরা টলতে টলতে ভাত চাপিয়েছে। ডাল পরশুর। গরম করে নিতে হবে। বেড়ালগুলোর খিদা পেয়েছে। টিভিতে খেলা নিয়ে একটানা কেউ বকর-বকর করে যাচ্ছে এরই মধ্যে। সায়েরা বলছে--আলু সিদ্ধ দিচ্ছি...ভর্তা করে খেয়ে নিও। ভাত গড় দিও। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
'প্যারাসিটামল খেয়েছ?'
'ওতে কোনোদিন কাজ হয়েছে?'
'তা ঠিক। মাশরাফি উইকেট পেল একটা!'
'মশারি টাঙিয়ে নিও।'
'একটু কিছু খেয়ে নাও...রাতে খিদা লাগবে!'
'ওদের একটু দুধ দিও বাটিতে... দেখছ না খিদায় কাতরাচ্ছে!
মাশরাফি আরেকটা উইকেট পেলে আমি উঠে যাই। বাংলাদেশ এখন জিতেও যেতে পারে। ম্যাসেঞ্জারে নোরা ছবি পাঠায়... খেয়ে পুরো টং! নাচ হচ্ছে খুব। লিখেছে মিস ইউ ভাই...
আমি দুধ দিই বাটিতে। বেড়ালগুলো তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কৃতজ্ঞতায় ঘড়ঘড় করে শব্দ তোলে গলায়। আমি সরে গেলে খেতে থাকে চুকচুক করে। আমার ঘুম আসে না। ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। নোরা ফেসবুকে ভিডিও আপ করে। ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় তার টলোমলো পা। লিখেছে--লাইফ ইজ বিউটিফুল!
সায়েরা সকালে বেড়ালগুলো খুঁজে পায় না। হয়তো কোনো এক ফাঁকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। আমাকে অভিযুক্ত করে সে। নিশ্চয়ই রাতে দরজা খুলে রেখেছিলাম।
দুপুরে সায়েরার টেক্সট আসে। পাশের গলিতে তিনটা বেড়ালকেই মৃত পাওয়া গেছে। তাদের মুখে সাবানের মতো অনেক অনেক ফেনা। বারান্দায় সিগারেট খেতে গিয়ে নোরার সাথে দেখা হয়ে যায়। আমি তাকে হেসে বলি, লাইফ ইজ বিউটিফুল!
0 মন্তব্যসমূহ