কবরস্থানের সাথেই লাগোয়া সাদা চুনকাম করা দোকান। সামনে লম্বা করে রাখা দুই তিনটা খাটিয়া। দোকানের ভেতরে তাকে সেলাই ছাড়া ধবধবে কাপড় একটা নির্ধারিত মাপে কেটে আলাদা করে পেঁচিয়ে রাখা। এছাড়াও কর্পূর , আগরবাতি, লোবান , চাপাতা বহুবিধ প্রস্থানের সরঞ্জাম।
মানুষের জীবনে দুই দুইবার যত্নকরে আয়োজন করা লাগে। একবার জন্ম নিতে । এবং আরেকবার জন্মান্তরে যেতে। একা এই জোগাড়যন্ত্র করা যায় না। প্রতিবারই অন্যের উপর ভরসা করে নিরাকার কারো ইচ্ছা মতো একেক জন যায় আসে।
ইমাদ আলি সারাদিন দোকানে বসে বেচাবিক্রি করে। দুইরকম ক্রেতা আছে। একরকম ক্রেতা খুব নিকট আত্মীয়র জন্য কাফনের কাপড় কেনাকাটা করতেও দরদাম করে। ছোটচাচা একটুও দাম কমান না। আর আরেক রকম ক্রেতা কোন কথা না বলেই বিনা তর্কে তাদের দাবী করা মূল্য পরিশোধ করে দেয়। অন্তিম ক্লান্ত মানুষের নাজুক মনের আবেগ উপেক্ষা করে বেশি দাম রাখে ছোট চাচা।
দোকানের নাম 'শেষ বিদায়'। বহুদিন পর্যন্ত এই নামের অর্থ সে বুঝতো না । দোকানের মালিক ছিলো তার আব্বা। টিনশেড বাসার সাথে বসার ঘরটাকেই দোকান করা হয়েছে। ছোটবেলায় কিছু ক্ষণ পর পর ভেতর থেকে দৌড়ে এসে আতর মেখে যেত আব্বার হাতে। আব্বা শুধু আতর দিতেন তা নয়, সুরমাদানীটা উল্টিয়ে চিকন করে চোখে সুরমাও লাগিয়ে দিতেন।
আমকাঠের খাটিয়া দোকানের সামনেই বানানো হতো। ফালি ফালি করে কাঠের তক্তা কেটে ডাঁই করা হতো। তার পর তক্তা মাপে মাপে জোড়া দিয়ে খাটিয়া। শিশু কালে খাটিয়া মাটিতে পাতা পেলেই সে দৌড়ে তার ভেতর বসে পড়তো ইমাদ। আব্বা টের পেলেই এমন ভাবে হুস হুস করে শব্দ করতেন যেন খাটিয়ায় বসা গুরুতর অন্যায় হয়েছে , সেখান থেকে আর কোনও দিন বেরুতে পারবে না ।
সন্ধ্যার পর ইমাদ কবরস্থানের কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করতো।
প্রতিটি কবরের কাছে যেয়ে কবরকে ঘিরে থাকা বেড়া ঠিক করে দিতো, আগাছা ফেলে দিয়ে ছোটছোট গাছের সাথে দায় দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতো।
এপিটাফ লেখা নাম ফলকের কোনা ভেঙ্গে গেলে ঠিক করাতো নিজেই। ঘুরে ঘুরে তাদের নিজের চোখের সীমানায় রাখে। যাদের কবর তাদের ছেলেমেরা দেখুক না দেখুক ইমাদ প্রতিদিনই এই কাজগুলো করে।
সন্ধ্যায় ধুপ জ্বালিয়ে দোকানের কোণায় রেখে দেয়। ধুপ ধীরে ধীরে সুগন্ধ বিলায়। চালের উপরে আগরবাতির ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া কাঠির দিকে তাকিয়ে থাকা তার নেশা।সে এসময় স্থির থাকে নিমগ্ন থাকে।সে এ সময়টুকু মায়ের কাছে থাকে।
আব্বা চলে যবার পরের বছর একই দিনে চলে গেল মা। আব্বা ছিলেন হোমিও ডাক্তার , পাড়ার সকল শিশুদের তিনি চিনি স্বাদের মিঠেল ছোট ছোট পুরিয়া খাওয়াতেন।। মহা আনন্দে বাচ্চারা এই মিষ্টি ওষুধ খেতে আসতো। সেই আব্বা ডিসপেন্সারি খোলা রেখেই টেবিলে মাথা পেতে ঘুমিয়ে গেলেন। অনেক দিন পর্যন্ত খোলা ছিলো তার ডিসপেন্সারি। যেন তিনি বসেই বাচ্চাদের হাঁক দিয়ে ডাক দিবেন।
আব্বা কে সারাদিন খুঁজে না পেলে মায়ের কাছে এসে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা যেত । মা চলে যাবার পর প্রকৃত অর্থেই ইমাদ অনাথ হয়। দিনভর কোথায় কোথায় হাঁটে, থেমে থেমে অবাক হয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে উদ্দেশ্যহীন। হঠাত হঠাৎ ঘিয়ে রঙ শাড়ি পরা মা’ কে দেখে। মা তাকে হাত নেড়ে ডাকে , তার অন্য হাতে থালা ভরা ভাত , তাতে উপুড় করা রুইমাছের মাথায় জড়ানো মুগডাল , শরবতি লেবুর ফালি ,কাচা সবুজ মরিচ । আয় দেখি দুই গাল খেয়ে যা ইমু। দিনের পর দিন উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে ছোটচাচা তাকে দোকানে বসায়। বলে এখানে কাছাকাছি মায়ের ঘর। এখানে থাক। মন বসে যাবে তোর।
সত্যি ইমাদের মন বসেছে।
বিকেলে আঞ্জুমান মফিদুলের লাশবাহী গাড়ি এসে থামে। কাচের এ পাশ থেকে অপেক্ষাকৃত কম লম্বা কারো আয়তন বোঝা যায়। আজ বাবা-মা কে রেখে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছে ১০ বছরের মেয়ে টিয়াপাখি। অনেক আদরে মা , পাখি ডাকতো তাকে। অসুখ ধরা পরার পর থেকে আর বালিশে মাথা দেয়নি মা। দিনে তবু মেয়ে কে ছেড়ে সংসারের কিছু কাজ করতো , দুটো চাল না ফুটালেই নয় , অন্য সন্তানের কিছু পড়াশুনা দেখা লাগে। দুধ্ওয়ালা কলিং বেল দেয় ,স্টেইনলেস স্টিলের হাড়িতে দুধ ঢেলে নিয়ে দুইটা বলক দেয়া লাগে । পেপারওয়ালা অবশ্য জ্বালায় না,দরজার নিচে দিয়ে সাঁই করে পেপার চেলে দিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে আপনের মা তার দোকানের নতুন শাড়ি, সালোয়ার কামিজ নিয়ে অসে দেখাতে। মৌলিক অধিকারের দ্বিতীয় নামটাই বস্ত্র। বেঁচে থাকার নামই জীবন, জীবনের সাথে আপোষ না করে জীবন কাটানো মুশকিল।
রাত হলেই টিয়ার মা মেয়ের কাছাকাছি । মেয়ে ঘুমালে ঠায় বসে থাকতো পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে। বসে বসেই ঝিমিয়ে নিতো,। ডাক্তার বলেছিলো হয়ত ঘুমের মধ্যেই চলে যাবে সে। এই ভয়ে কোটরে ঢূকে যাওয়া চোখ নিয়ে প্রায় সারারাত জেগে কাটাতো । পাখি যখন চলে যায় সত্যি তখন মায়ের চোখ লেগে গেছিলো। তিনি মেয়ের যাবার সময়টুকু বুঝতে পারেননি। যেন সৃষ্টিকর্তা সয়ং এভাবে মায়ের চোখের পরে মেয়েকে নিতে চাননি। ভোরের আজানের সাথে সাথে মা টের পায় পাখি ততোক্ষণে চলে গেছে।
এই শিশুর জন্য খাদেম কাকা কবর খুঁড়িয়ে রেখেছেন। ছোট্ট কবর। সারা কবরস্থান লোকে লোকারণ্য। একজন শিশুকে অসময়ে বিদায় দিতে কোনও পাষণ্ডও চায় না। সকলেই কাঁদছে। ইমাদ অপেক্ষা করছে সময়ের। দাফন শেষে একে একে ফিরে যাচ্ছে জীবিতরা। তাদের আরো কিছুদিন নিজেদের ভালোমন্দ কাজের হিসাব চুকানো বাকি।
ইমাদ কবরের উপরে সদ্য কেটে রাখা নারকেলের কচি পাতার ডাল বিছিয়ে দিলো। নারিকেল পাতার বাতাস শান্তির বাতাস।
ডাক্তার সাহেবের বাসার গ্যারেজটাতে আজ কোন গাড়ি নেই। সবার গাড়ি অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়েছে। পুরো গ্যারেজের মেঝেটা পানি ফেলে ধুলে রাখা । ডিসচার্জ সার্টিফিকেট সমেত ডাক্তার সাহেব কে এনে রাখা হয়েছে রাত দশটার দিকে। মাইকে সারা পাড়ায় তার অগস্ত্য যাত্রার খবর ঘোষনা করা হচ্ছে।।
তিনি আজ সবার স্পর্শের বাইরে চলে গেলেন। বিকেলেও ছিলেন । চেম্বারে গেছিলেন অল্প শরীর খারাপ নিয়ে। দূর থেকে আসা রোগীদের জন্য সময় দেয়া ছিলো। অন্যের চিন্তা করার যাদের অভ্যাস তারা নিজের জন্য সময় রাখে না।
জোর পূর্বক জরুরী তলব করে তাকে পরপারে নিয়ে গেলেন পরম উদ্ধার কর্তা। যিনি সারাজীবন অন্যকে উদ্ধার করেছেন আজ তাকে হঠাৎ করেই প্রিয় কারো মুখ দেখার সুযোগ না দিয়েই সাথে নিয়ে গেলো অনন্তের পথে। মৃত্যু হলো মানুষের জীবনের সেই দিক যাকে অনিবার্য জেনেও অনায়াসে মেনে নিতে পারে না। মৃত্যু হলো সেই ভয় যাকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায় না।
কতজনে বেঁচে থাকে নিজের জন্য , নিজেকে বাড়ায় খ্যাতিতে, পরিধিতে। তিনি ছিলেন অনেকের মাঝে একা। বিনা পয়সায় মানুষের সেবা দিয়ে গেছেন দিনের পর দিন, , নিজের পকেট থেকে মাঠপর্যায়ের রোগীদের ওষূধ কিনে দিতেন বিনা সুপারিশে। নিজের দিকে তাকানোর সময় হওয়া মাত্রই দোর গোড়ায় পালকি চলে এলো ‘হুম না হুম না’ করতে করতে।
ছিনতাইকারীরা মুহুর্তে চাকু বসিয়ে সামান্য মোবাইল এবং অল্প কিছুটাকা সমেত ওয়ালেটটা নিয়ে অনায়াসেই পালিয়ে যায় । ডাক্তার কাকা পড়ে থাকেন বিকেলের পিচ ঢালা পথে। অল্প দূরেই তার চেম্বার । চেম্বার পর্যন্ত আর পৌছানো হয়নি তার।
তার কাছে চাইলে তিনি এমনিতেই সব দিয়ে দিতেন। লোভী ক্ষুধার্থ মানুষ শুধু কেড়ে নিতে শিখেছে। জীবনের ব্যস্ততম এ প্রান্ত থেকে মৃত্যুকে দেখে না মানুষ। তারা আগাম জানে না কার কখন কি কারণে এই আচমকা থেমে যাওয়া ।
দূর থেকে খাটিয়ার দিকে তাকাতেই চুপ হয়ে যায় কথা বলা সবাই। সেখানে একজন আস্ত মানুষকে শুইয়ে রাখা হয়েছে বলে বিশ্বাস হয়না। শরীর থেকে প্রাণ চলে যাবার সাথে সাথেই ছোট হয়ে আসছে দেহ। তাকে আর পূর্ণ বয়স্ক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।
ভোরের আলোর দিকে একঠায় তাকিয়ে আছে ইমাদ। আলোটা প্রথমে চিকন উজ্জ্বল রেখা ছিলো। কমলা রঙ ধীরে ধীরে বাড়ে রেখা গাঢ হয়। একসময় সমস্ত আকাশে এই আহ্লাদি কমলা ছড়িয়ে গিয়ে আকাশ ফর্সা হয়। । ছোট বেলায় আব্বা একবার বছর খানেক নিরুদ্দেশ ছিলেন। কোন খোঁজ নেই ঠিকানা নেই, ।আম্মা চিন্তায় চিন্তায় বিছানা নিলেন। সেই বিপদে উদ্ধার করেছিলেন এই ডাক্তার কাকাই। তাদের অতি দরিদ্র অবস্থায় মাসে মাসে খাবার এবং দুধের কৌটাসহ টাকা বরাদ্দ করেছলেন তিনি। ইমাদ কিছুই ভোলে না।
তাকে শেষ গোসল দেবার জন্য কাফনের কাপড় সহ সব উপকরণ সাথে করে নিয়ে এসেছে।
ছোটচাচা মুফতে দিতে চাচ্ছিলো না। ইমাদ বলে চাচা ইনি আমার মুখে দুধের যোগাড় দেয়া মানুষ। আজ তার এই এই মাপের কাপড়ের টাকা আমি দেবো। আপনি আমার নামে লাভ সহই লিখ রাখেন।
ছোটচাচা চমকে তাকালো। বলল আমি সবা সময় লাভ রাখি নাকি।
ইমাদ আর কিছু বলে না। জায়গা শুদ্ধ বাড়ির আয়োজনে যেতে হবে তাকে। হাতে তসবীহ এবং গোলাপ জলের ঝাঁঝরি নিয়ে সে রওনা করে করে। নতুন কিছু চারা কিনেছে কাকার কবরঘরের জন্য। টাটকা সবুজ তিরতির চারা । মৃত্যু যতই ভয়ংকর হোক সবুজ পাতা ফের সকালকে আলিঙ্গন করে। বাঁচতে কাছে টানে। সবার যাওয়াই যাওয়া নয় ।
কারো কারো যাওয়া আরো ঘন করে রয়ে যাওয়া।
3 মন্তব্যসমূহ
সুমী সিকান্দার আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তার লেখায় যেমন সমসাময়িক বাস্তবতা থাকে তেমনি থাকে নিজেকে অজানা এক জগতের মাঝে খুঁজে পাওয়ার উপকরণ। এই গল্পটিও তেমনি হয়েছে। ইমাদ আলির বিষন্ন জগতের মাঝে নবজীবনের পথচলার গল্প। জয়তু লেখক।
উত্তরমুছুনসুমী, গল্প ভাল লাগলো। কলমকে কুর্ণিশ!
উত্তরমুছুনভিন্নস্বাদের একটা গল্প পড়লা। যদিও একটু ভয় ভয় করছিল। অসাধারণ সুমী।
উত্তরমুছুন