শেখ লুৎফর'এর গল্প : কাশু হাঁটছে


টানা মাইল তিনেক হাঁটার পর কাশু টের পায়, কী একটা কথা যেন মনে পড়েও পড়ছে না। এই জন্যই বোধ করি তার সকাল থেকে এমন দমফাটা লাগছে। আকন্দ বাড়ির বড় পোলা কাশু শত চেষ্টা করেও কথাটার কোনো দিশা ধরতে পারে না। বুকের মাঝে খালি ছাৎ ছাৎ করে। আছকা আছকা মনে একটা পুকুরঘাট ভেসে ওঠে। শাওন মাসের শেষ দিকে বাঁশঝাড় ঘেরা পুকুরঘাট যেমন হয়। ছায়া ছায়া। নিরালা। আসমান ঠাসা কালা কালা মেঘে। ঘোমটা দেওয়া বউয়ের মতো পুকুরের ওপর হেলেপড়া বাঁশগুলো আউল-ঝাউল বাতাসে একটু একটু দুলছে।
মেলা দিন আগে দেখা সিনেমার মতো কাশুর চোখে আবছা আবছা এখনও ভাসে : ঠোঁটের ওপর গোঁফজোড়া তেজিয়ে উঠছে এমন এক তরুণ-চাষা ঘাটে একলা দাঁড়িয়ে। তার চনচনা নাকটা সামনের দিকে একটু বাঁকা। কাশুর মন কয়, সে-ই তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার মরা মায়ের কথা ভাবছিল। নাকি অন্য কেউ? তার সন্দেহের ঘোর কাটে না! মা, ভাই-বোন ছাড়া একলা একলা উক্কিলা পাখির মতো ঠোক্কর খেতে খেতে বড় হয়েছে সে। পাঁজরের গোপে-গাপে পুরানা কষ্ট দিনে দিনে আরও পোক্ত হয়েছে। তাই দুনিয়াটা কাশুর কাছে ছিল দুপুরবেলার শনির আখড়া। একটুতেই ডরে গা ছমছম করত। আজও কোথাও টন করে উঠলে তার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এই যে সব কিছুতেই কাশুর সন্দেহ, তা কী আর এম্নি এম্নি। বলতে গেলে সারাটা জীবন তার একলা কেটেছে। বউ না এলো এই সে-দিন। এর আগের স্মৃতি বলতে তো সৎ মায়ের ঝন্নাৎ ঝন্নাৎ। খনখনানি। আর সৎ মায়ের ঘরে সে কী কোনোদিন শান্তিতে একবার দম ফেলতে পেরেছে, না একবেলা দুধভাতে আঙুল ভেজাতে পেরেছে? তাই একটু ফাঁক পেলেই সে আজও হয়ে ওঠে আনমনা। জানপ্রাণে চেষ্টা করে তার মায়ের মুখটা মনে করতে। গত দশ বছর ধরে তার এই তত্ত্ব-তালাপির কোনো ক্ষ্যামতি ছিল না। তবু শেষতক তার মায়ের মুখের গড়ন একবারও তার মনে আসেনি। কাশুর কাছে এই না পাওয়ার বেদন্ মরণের মতো ক্ষমাহীন। 


তড়িৎ হাঁটার মাঝেই কাশুর মনে কিছু জিনিস ছায়ার মতো আনাগোনা করে। বিচিত্র রঙের নকশা তোলে। হাঁটতে হাঁটতেই সে দেখে; তেজাল গোঁফের এক তরুণ আকন্দ বাড়ির পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে কালা কালা মেঘের বাহার একমনে পড়ছে। এত দেখেও তরুণের নিজের মায়ের মুখ একটুও চোখে পড়ে না। আর দ্যাখো কপালের ফের কাকে বলে : ঠিক তখনি তরুণের একমাত্র সৎ ভাইটা নাকের সিকনি টানতে টানতে ঘাটে এসে দাঁড়ায়। চট-করে তার চোখে ভেসে ওঠে মাঠে মাঠে তাদের বড় বড় ক্ষেতগুলো, পুকুর বাগানসহ মস্ত বাড়ি। এইসব কিছুই তরুণের একার হওয়ার কথা। কিন্তু এই বিচ্চুটাও এখন সমান সমান পাবে। তার মানে সব সবকিছু দুই টুকরো হয়ে যাবে! 

চারপাশটা এক নজর দেখে। এখন বুঝি নিশুতি রাত চলছে! জনমানবের কোনো সাড়া নাই। সে খপ্ করে ছ'বছর বয়সি সৎ ভাইটার ঘাড় খাবলে ধরে। বালক চমক চোখে তার দিকে তাকায়। এবার সে অন্য হাতে বালকের মুখটাও খিঁচে ধরে পানির নিচে ঠেঁসে রাখে। বারকয় ভুরুঙ্গি তুলে বালকের গোলগাল শরীরটা নেতিয়ে আসে। তরুণ আবার চারপাশটা পরখ করে। নাঃ, কেউ নেই। বালকের মরা শরীরটা ধীরে ধীরে পানির নিচের দিকে নামতে থাকলে সে গামছায় হাত-মুখ মুছে মাঠের দিকে ফের হাঁটে। 

এই মাঝ দুপুরে হাঁটা থামিয়ে কাশুও বুঝি 'স্টার জলসা'র ছোট্ট একটা সিরিয়াল দেখে নিল। 

পথের মাঝে দাঁড়িয়েই কাশু এক নজরে তার হাত-পায়ের বর্তমান অবস্থা যাচাই করে। না, এখন আর পানি নেই। পানিতে ঢুলঢোলা হাত-পা মেলা চিমসা হয়ে এসেছে। তারপর ঝন্নাৎ করে মাথা ঘুরিয়ে দেখে- তেজাল রোদে দুনিয়াটা জ্বলছে তো জ্বলছেই। কোথাও এক ফোঁটা ক্ষমা নেই। 

কাশু নিবিড় চোখে দেখে- পথের পাশে মাঝারি বহেড়া গাছটা, কাঁধে ডিশলাইনের তার নিয়ে ঝিমধরা রোদনে ভেঙে পড়তে পড়তেও দাঁড়িয়ে থাকে! এই দেখাদেখির মাঝেই সে আবার পুরানা দিনের ভাবনায় ফিরে যায়। মনে পড়ে, বুড়ো বয়সে তার বাবা একটু ক্ষ্যাপে গেলেই গলা ফাটিয়ে বলতো, শালার জীবনে কোনো আছান নাই। 

এবার কাশু বহেড়া তলার ছায়াটাকে মন দিয়ে পরখ করে। এই ভরা দুপুরে কারা যেন ছায়াটাকে হাত-পা বেঁধে আটকে রেখেছে। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম নাই। পালিয়ে যাওয়ার খায়েসে, ছায়াটা ভাঙতে ভাঙতেও কুঁকড়ে এসে ফের জমাট বাঁধে। যুক্তিহীন আচাভুয়া কষ্টে বুঝি দিল-কলিজা ফেটে মরে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। 

গাছতলায় বসতেই কাশুর দু-চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসে। হেই ভোর-বিহানেই পাঁচ মাইল হেঁটে, কয় খাবলা ভাত মুখে দিয়ে ফের সে বেরিয়েছিল। খাল-বাল ছাড়া ঘোড়ার মতো এখনও সে ছুটছেই। একটু ঢিলা দিলেই কোত্থেকে যে খল খল করে পানি এসে তার হাত-পা, মুখে জমে জমে ঢোল বানিয়ে ফেলে! ফোলা বেলুনের মতো শরীরটা তখন টনটন করে। মনে হয় এই বুঝি তার গতরটা পটাশ করে ফাঁটল! 

যখন কাশুর ঘুমটা সারা শরীর জুড়ে ক্ষিরের মতো জমে উঠতে থাকে, ঠিক তখনি গাছের মগডালে একটা কাক কা...কা করতে করতে বিশাল ডানাদু'টোতে যমের জাপটানি তোলে। আচমকা হামলায় সে ধড়ফড়িয়ে ওঠে। চেয়ে দেখে কাকটা তার দিকে ধারালো ছোঁ নিয়ে তেড়ে আসছে। সে কাঁধের গামছাটাই দলা পাকিয়ে কাকের দিকে ছোঁড়ে মারে। কাকটাও বুঝি তৈরি ছিল। সে ছোঁ মেরে গামছাটা নিয়ে উড়াল দেয়। নিরাপদ উঁচুতে বসে, কাশুর গামছাটা ঠোঁটে, নখে টেনে টেনে ছিঁড়ে রুই রুই করে ফেলে! কাকটার কাণ্ড দেখে সে বোবা বনে যায়। তার ওপর এত রোষ! 

ফানা ফানা করে ছেঁড়া গামছাটা এখন ডালের ফাঁক-ফোক্করে তিরতির করে ঝুলছে। কাশু নিজের পায়ের নলি টিপে পরখ করে। একটু জিরিয়ে নিতে না নিতেই ফের পানি জমতে শুরু করছে। সে মনে মনে আবার হাঁটা শুরু করার তাগিদ বোধ করে। কিন্তু ঘুমের দায়ে চোখ খুলতে পারে না। এর মাঝেই কাকটা আবার ঠোঁট বাগিয়ে তার দিকে তেড়ে আসে। পাশ থেকে একটা মরা ডাল খাবলা দিয়ে তুলে সে নিজেকে কোনোমতে রক্ষা করে। বেগতি দেখে কাকটাও ফিরে গিয়ে একটা ডালে বসে। ঠিক তার মাথার ওপর। কিছু আন্দাজ করার আগেই জীবটা ছেড়ৎ করে তার ওপর হেগে দেয়। 

কাশুর মনে পড়ে, তার সৎভাইটার ঘাড়ে লালটি বর্ণের একটা জন্ম দাগ ছিল। চকচকে লাল। কাকটার ঘারের রোয়াগুলোও ঘন লাল। এই নিয়ে সে কমপক্ষে হাজার বার কাকটার গর্দনাটা পরখ করে দেখেছে। যতবার দেখে ততবারই সে নিচ্চিত হয়, তার আর নিষকিতি নাই। গত দশ বছর ধরে এই কাক আর কাশুর দিনগুলো এভাবেই কাটছে। মাঝে মাঝে দিশেহারা কাশু কাকটার দিকে জোড়হাত করে মিনতি মাগে, তুই আমার মার পেটের ভাই, এইবার আমারে মাফ কর...। তখন কাশুর গলা জমে আসে। দু'চোখ উপচে হড়হড় করে পানি গড়ায়। তার মাথার ওপর পাক-খাওয়া কাকটাও বুঝি ঠা ঠা হাসিতে উসটে পড়ে। 

পিতলের থালার মতো আকাশটা দাউ দাউ জ্বলছে। এর মাঝেই কাশু ফের পথে নামে। খালবাল ছাড়া টাট্টু ঘোড়ার বেগে হাঁটে। কাঁধে বুঝি একটা একশ-মনি বোঝা নিয়ে সে গত দশ বছর ধরে এভাবেই ছুটছে। এখন নিজেকে তার কিছুটা ক্ষ্যাপাটেও লাগে। দূর গাঁয়ের বাচ্চারা তাকে দেখলেই পাগল...পাগল বলে ছুটে আসে। কেউ কেউ ঢেলা মারে। সে একটুও ক্ষ্যাপে না। জানে, ক্ষ্যাপলে আর রক্ষা নেই। পথেই বেরোতে পারবে না। জংলার ভীমরুলের মতো বাচ্চারা চেপে ধরবে। পিজির ডাক্তার তাকে শেষ নিদান বলে দিয়েছে, এ রোগের কোনো অষুধ নাই। অবশ্য একটা উপায় আছে, বেশি বেশি হাঁটো। যতদিন হাঁটবে ততদিন বাঁচবে। 

কাশুর পেছনে পাঁচখানা গ্রাম। তারপর তাদের ঘর, তিরিশ বিঘা জমিনের গেরস্থালি। এখন বউটাই তার সংসার সামাল দেয়। চাষবাস, হাট-বাজার সব...সব। বেচারি শুধু জমিতে হাল-মই দেওয়াটাই বাকি রেখেছে। আর কাশু এখন বেঁচে থাকার দায় পথে পথেই শোধ করে। 

হাঁটার মাঝেই কাশু টের পায়, পানির তিড়াসে কলিজাটা বুঝি ধাক্ ধাক্ করছে। আর একটু হলেই চন্ করে ফেঁটে যাবে। তার মনে কয়, পথের পাশের ডোবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ডাক্তার চব্বিশ ঘন্টায় তার জন্য মাত্র এক লিটার পানি বরাদ্দ করে দিয়েছে! তিন বেলা খাওয়ার পরে তিন গেলাস। এর মাঝে খুব দায়ে পড়লে মাত্র এক চুমুক। সে ভাবে, এখন যদি সেই তেজাল গোঁফের পোলাটা আসত। তাকে ডোবার টলটলা পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে মেরে ফেলত! আঃ...তবু তো সে মন-দিল উজার করে পানি খেতে পারত। 

মাঝে মাঝে কাশুর ঘুম ভেঙে গেলে দেখে, বউ তার পায়ে তেল ডলছে। দিনমান হাঁটার দাবারে পায়ের হাড়-মাস ফানা ফানা হয়ে যায়। তাই বিষ-বেদ্নায় সে ঘুমের মাঝেই উঁ...উঁ...করে রোদন পাড়ে। বউ তেল-রসুন গরম করে পৈথানে বসে বসে মাঝ রাততক ঢলে। আজাবে কাশুর ঠোঁটের দুই কশে জমে ওঠে ফেনা। একটু পর পর বউ উঠে এসে কষের ফেনা আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয়। তখন তার ঘুম ভেঙে গেলেও সে টালমেরে পড়ে থাকে। কাশুর বুকটা তখন নীরব রোদনে ধড়াস ধড়াস করে ভাঙতে থাকে। ইচ্ছা করে লাফ দিয়ে ওঠে বউকে জড়িয়ে ধরে; বুইনরে...আগের জনমে তুই আমার মা আছিলে, আমারে তুই মাফ কইরা দিছ। আমি বড় চিক্কন প্যাচে পইড়া গ্যাছি। 

দূর গেরামের মসজিদের মাইক ফজরের আজান দেওয়ার ছলে ক্ষয়ে আসা রাতটাকে ধামকি মারে। সারা রাত ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে কাশুর শরীরটা এখন আলুর বস্তা। জানপ্রাণ চেষ্টায় কোনোমতে সে চোখ দুটো মেলে বউকে ডাকে, আমারে ধর...। দুই জনের চার হাত-পায়ের আছাড়ি-পাছাড়িতে কাশু আদিম কোনো প্রাণির মতো হামা দিয়ে দাঁড়ায়। 

দেউড়ির ডেফল গাছে বসা কাকটাও জেগে ওঠে। অসহ্য অপেক্ষার শেষ পহরে এসে সেও ডুঝি রোষে কাতরায়। ডেফলের ডালে ঠোঁট ঘষে ঘষে নতুন দিনটার সম্ভাবনায় তৈরি হয়। প্রায় কালো অথচ করমচা রাঙা চোখে কাশুর বন্ধ কপাট জোড়ার দিকে সে ঘন ঘন নজর ফেলে। একটু পর পর ঘাড়ের লাল রোয়া খুঁটতে খুঁটতে আচমকা কা কা করে ওঠে। তার দীর্ঘ আর কঠিন চিৎকারে কাশুর তড়তড়া চিকন কিন্তু সামনের দিকে একটু বাঁকা নাকটা ঘনঘন কাঁপে। সে তামড়ানি খেতে খেতে দরজার বাইরে নয়, যেন যমের মুখেই পা ফালায়। ওদিকে অধৈর্য্য কাকটার কা কা চিৎকারে একটু একটু করে মেলতে থাকা কাঁচা সকালটা বুঝি ফালা ফালা হয়ে কাশুর কানে নিয়তির পয়গামের মতো আগাম কিছু বার্তা পৌঁছে দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ