সেজান মাহমুদ'এর গল্প : আমি আছি আমি নেই


যে ঘরটার মধ্যে বসে আছি তার একটা দরজা এমনভাবে সেঁটে-বন্ধ-হওয়ার পর দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিশে যায় যে মনে হয় কোনো দরজাই নেই। একটা টেবিল লম্বা আর দুটো চেয়ার। একপাশে আমি চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে ঘণ্টাখানেক পর ক্লান্ত হয়ে এই ঘরের খুঁটিনাটি খেয়াল করা শুরু করেছি। অন্য চেয়ারটিতে এসে যিনি বসবেন তিনি বিনয়ের সঙ্গে ‘অপেক্ষা করুন এখানে।
চা বা কফি দেবো?’ জিজ্ঞেস ক’রে আমি ‘না’ বলার পর সেই যে চলে গেছেন। আমি যেদিকে বসে তার উল্টো দিকের দেয়ালে বড় একটা কালো কাঁচের দেয়ালই বলা যায় । হলিউডের সিনেমাগুলোতে এ রকম কাঁচের আড়ালে দাড়িয়ে আসামির অঙ্গভঙ্গি, মুখের রেখা ইত্যাদি পরখ করে অপরাধ বিশেষজ্ঞ আর মনোবিজ্ঞানীরা। আমার হঠাৎ মনে হলো এখনও হয়তো কেউ বা কারা ওদিকে দাঁড়িয়ে আমার প্রতিটি নড়াচড়ার বিশ্লেষণ করছে। একবার মনে হলো প্যান্টের জিপার খুলে মাস্টারবেশন শুরু করি, দেখবি তো দেখ বিনে পয়সায় পর্নোগ্রাফি । কিন্তু এ রকম চিন্তা শুধু মাথায় এসেই মুহুর্তে হারিয়ে যায়। আমি এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপক। কোনো যৌনরোগী বা মানসিক বিকারগ্রস্ত কেউ না। তারপরও চিন্তাটা মাথায় আসায় আর তা নিয়ে কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকায় দীর্ঘ অপেক্ষার ক্লান্তি, টেনশন কিছুটা কম মনে হয়। এরা আমাকে অফিস থেকে সরাসরি ধরে নিয়ে এসেছে। আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি, কোন ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি। বলেছে, এরা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির লোক, আমেরিকার জাতীয় নিরাপওা বিষয়ক ‘পারসন অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চায়। আমি ! অধিকার সম্পর্কে জানি।


বলেছি ল’ইয়ার ছাড়া কোনো কথা বলব না। কিন্তু ল’ইয়ারের জন্য পয়সাও খরচ করতে পারব না। এজন্যই এই দেরি ।

এবার ঘরের একমাত্র দরজাটি খুলল। ঘরে ঢুকলো সেই প্রথমে-দেখা ভদ্রলোক, কালো রঙের সুট-টাই পরা, পেছনে একজন হাফ-স্কার্ট, ড্রেস শার্টের ওপরে ম্যাচিং জ্যাকেট পরে ভয়ানক রকমের সুন্দরী ভদ্রমহিলা। তাকে দেখতে ইন্ডিয়ান বা ল্যাটিনা মনে হয়। গাঢ় কালো চুল, একটু লালচে আভা আছে চুলে, মনে হয় শেড দেয়া। হাতে ব্রিফকেস। এই অফিসিয়াল ব্রিফকেস একদম মানায় না এই সুন্দরীর হাতে। আমার মনে পরিমাপহীন বিরক্তি সত্ত্বেও আমি এসব খেয়াল ক’রে সময় পার করছি। কারণ, আমি বিরক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছানোর পর আর বিরক্তও হতে পারছি না।

“ডক্টর হোসেন, দিজ ইজ মারিয়েলা হাবার্ট, ইউর অ্যাটর্নি ফ্রম দ্য ইউ এস গভর্নমেন্ট।’ বললেন আগের ভদ্রলোক। এই মাত্র আবার আমার তার নামটা মনে পড়ল যা শোনার পর থেকে আর মনে করতে পারছিলাম না- ল্যারি ডেভিডসন। আমি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলাম। মারিয়েলা শুনেই বোঝা গেল আসলেও ল্যাটিনা। আর ‘নাইস টু মিট ইউ’ বলাতে উচ্চারণ আরও স্পষ্ট ক’রে দেয় সম্ভবত পুয়ের্তোরিকান বা পেরুভিয়ান । প্রাথমিক আইনগত দিক নিয়ে কথাবার্তার পর ল্যারি, যদিও ওকে আমার ল্যাংড়া নামে ডাকতে ইচ্ছে করছে, সে একটি ফাইল খুলল, আমার অনুমতি নিয়ে একটা ডিজিটাল রেকর্ডারে চাপ দিয়ে রেকর্ডিং শুরু করল।

‘আপনার নামটা বলুন ডক্টর।‘ 

‘মুহম্মদ আহমেদ হোসেন।‘ আমার এ নামটা নিয়ে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই বিব্রত। আমার জন্মের পর আকিকার সময় বাড়িতে আমন্ত্রিত মওলানা সাহেব এ নামটা নাকি দিয়েছিলেন। বাবা সেই মওলানার প্রতি সম্মান রাখতে এটাই আমার অফিসিয়াল নাম ক’রে দিয়েছেন। আমি বিব্রত কোনো ধর্মীয় কারণে না, আমি বাংলাদেশের মানুষ তাই নামটাও বাংলা থাকবে এ রকম চাওয়াটা অন্যায় নয়, কিন্তু অনেক অ্যারাবিক নামও তো সুন্দর হয়। আমার নামটায় যেন সব ঠেসে দেয়া হয়েছে কোনো শ্রুতির মাধুর্য বিবেচনা না ক’রে।

‘ইউ এস সিটিজেন? 

‘হ্যা।‘ আমি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম। 

‘কী বিষয়ে পড়ান?’ 

‘পলিটিক্যাল ইকোনমি।‘

এসব মামুলি প্রশ্নের পর তিনি আসল কথা পাড়লেন। আমার সামনে একটা পত্রিকায় ছাপা আর্টিকেলের কপি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এটা কি আপনার লেখা?' আমি বিরক্তির চোখে তাকালাম ল্যাংড়া মানে ল্যারির দিকে। বললাম,

‘আমার নাম তো আছেই, এর প্রতিটি অক্ষর আমার লেখা।‘

‘টাইটেলটা পড়ুন প্লিজ, ফর দ্য রেকর্ড।' আমি নিরাসক্ত কণ্ঠে পড়লাম, ‘আমেরিকান ডিনায়েল : ইস দিজ দ্য এন্ড অব নিও ইম্পেরিয়ালিজম?’

‘আপনি কি এন্টি আমেরিকান? এই আর্টিকেলে যা লেখা হয়েছে তা তো আমেরিকার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু না।‘ 

আমি উত্তরে ঠিক আগের মতো উত্তেজনাহীন কণ্ঠে বললাম,

‘আমি আমার প্রফেশনাল অবস্থান থেকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে আমেরিকার রাজনৈতিক নীতি আর তার পরিণতি নিয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরেছি। এর মধ্যে এন্টি আমেরিকানের কিছু নেই।‘ 

‘আপনি কি এন্টি ইসলামিক? এই আর্টিকেলে যা লেখা হয়েছে তা তো ইসলামের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু না।‘ 

‘আমি শুধু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইসলামের সমস্যা ও সংকট আর তার পরিণতির কথা তুলে ধরেছি। এর মধ্যে এন্টি ইসলামের কিছু নেই।‘ 

‘তাহলে অন্য কোনো ধর্মের কথা লেখেন না কেন?’ আমার উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছামসুল আলম, যাকে আমার একটি গৃহপালিত প্রাণীর নামে ডাকতে ইচ্ছে করছে, ঝাঁঝিয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘আমি অন্য ধর্মের কথা লিখি নাই। কারণ আমি এই দেশে জন্ম নিয়েছি, এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মুসলমান, আমার অধিকার আছে এই ধর্ম নিয়ে কথা বলার। যদিও আমার ভবিষ্যত্বাণী অন্য ধর্মের বেলায়ও প্রযোজ্য।‘ 

‘আপনি লিখেছেন, মুসলমানেরা হারাম খেয়ে খেয়ে ডিনায়েলে আছে বলেই এত হারাম-হালাল নিয়ে বাড়াবাড়ি করে।‘ কেন লিখেছেন?

‘আমি কি ভুল লিখেছি? ইসলামে ঘুষ খাওয়া হারাম, পৃথিবীর সব মুসলিম দেশেই ঘুষ খাওয়ার মাত্রা আরও বেশি, ইসলামে গীবত গাওয়া হারাম, সেটাও বেশি, ইসলামে রাজতন্ত্র প্রায় হারাম কিন্তু সব চেয়ে ধনী মুসলিম দেশ সৌদি আরবে রাজতন্ত্র আর সারা দুনিয়ার মানুষ সেই হারামের দেশে গিয়ে হজ করছে, আরও বলতে বলেন?'

আপনে একটা মুনাফেক। রাগে কাঁপতে কাঁপতে ছামসুল আলম সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

‘আপনে এবার যাইতে পারেন।‘ 

আমি ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে এলাম।

ল্যারি নামের লোকটি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবার ফিরে এলো ঠিক দু’মিনিট পর। আমি এখন এতোটাই উত্তেজনায় টান টান যে প্রতিটি সেকেন্ডের হিসাব রাখছি। আমার ল’ইয়ার মারিয়েলা আমাকে এর মধ্যে ফিসফিস ক’রে বলে দিয়েছে, যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে না চাই যেন সোজা বলে দিই আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই। আমি বলেছি, না আমি সব প্রশ্নের উত্তরই দেবো, কারণ আমার ভয়ের কিছু নেই। ল্যারি ফিরে এসে আমার সামনে আরেকটা ফাইল রেখে বলল,

‘এই অ্যাপ্লিকেশনটা কি তোমার?’ 

আমি চোখ বুলিয়েই চিনতে পারলাম। বললাম, 

‘হ্যা আমার।‘ 

‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে পাইলটের ট্রেনিং নিতে চেয়েছিলে কেন?’ 

‘আমার ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল প্লেন চালানোর। আমাদের দেশে মাসুদ রানা নামের একটা ক্যারেক্টার আছে, জেমস বন্ডের মতো, সে সব করতে পারত, ছোটবেলায় সে ছিল আমার হিরো। এদেশে এসে একই ক্যাম্পাসে এভিয়েশন স্কুল দেখে অ্যাপ্লাই করেছিলাম, শিক্ষক হিসেবে আমি ফ্রি ট্রেনিং পাওয়ার কথা।‘ 

‘ডিড ইউ লার্ন হাউ টু ফ্লাই?

‘আই টুক অনলি ফোর লেসেনস, তার পরেই তো নাইন-ইলেভেন ঘটে গেল। আই থিঙ্ক স্টিল আই ক্যান ফ্লাই।‘ 

ল্যারি ভ্রু কুঁচকে আমাকে কিছুক্ষণ পরখ করে বলল, 

‘ইউ নো হাউ টু ফ্লাই অনলি, ডু ইয়ু নো হাউ টু ল্যান্ড?’ 

আমি কোনো রাগ না দেখিয়ে আগের মতোই বললাম, 

‘আমি প্লেন ল্যান্ড করানোর সুযোগ পাইনি। আমি কী করে জানব সেটা?’ 

ল্যারি যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা পেয়েছে এ রকম ভঙ্গি করে আমার ফাইলের দিকে তাকিয়ে থাকল- 

‘ইয়া, আই থট সো। দ্যাটস হোয়াট ইউ নিড। আই ক্যান্ট হেল্প ইউ।‘ 

ছামসুল আলম সাহেব আমার অফিস ঘরে এসে রাগত স্বরে বললেন,

‘আহমেদ সাহেব, আপনাকে আমি কোনো হেল্প করতে পারব না। আপনি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলেন। আপনার রিপোর্ট এডুকেশন মিনিস্ট্রিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। এই তার একটা কপি।‘ 

আমি কপিটা হাতে নিয়ে টেবিলে রাখলাম। জানতে ইচ্ছা করছে না রিপোর্টে কী লেখা আছে। ছামসুল আলম সাহেব চেয়ারটা টেনে আমার কাছাকাছি এনে অযথা ফিসফিস করে বললেন,

‘আপনার জান নিয়া টানাটানি আহমেদ সাহেব। বাইরের দুনিয়ার খবর রাখেন? পত্রিকায় আপনার বিরুদ্ধে লেখা, রাস্তায় মানুষ মিছিল কইরা আপনার ফাঁসির দাবি জানাচ্ছে। আপনার কোনো হুশ নাই।'

আমি শীতল কণ্ঠে বললাম,

‘আপনিও তো আমার বিরুদ্ধে। আপনাকে এই তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বানালো কে?’

‘আমি আপনার বিরুদ্ধে কে বলল? আমি আপনাকে বাঁচাতে চেষ্টা করলাম। আপনি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেই তো রিপোর্টে দিতে পারতাম। ক্ষমা করা তো মানব ধর্ম।‘ 

‘কিসের জন্য ক্ষমা চাইব? সত্যি কথা বলার জন্য? নাকি আপনাদের থেকে আলাদাভাবে ভাবার জন্য?’ 

‘সব সত্যি কথা বলতে হয় না। জাহিরি-বাতেনি বলে কথা আছে। সীমা লঙ্ঘন করা ভালো না। আপনি খালি একটা কথার উত্তর আমাকে দেন।‘ 

“কী কথা?” আমি জিজ্ঞেস করি।

‘আপনে লিখছেন, ঈশ্বরের ধারণা বোধকরি মানুষের সবচেয়ে বড় ডেলুউশন-- এত বড় কুফরি কথা বলতে পারলেন? আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, কিন্তু আল্লাহ আপনাকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন ভালো কাজে ব্যবহারের জন্য। কুফরি করার জন্য না।‘ 

আমি জানি এই মানুষের সঙ্গে আমার আলোচনা-তর্ক কোনোটাই করা ঠিক হবে না। কীভাবে বোঝাব আমার অবস্থান একে? তাই জিজ্ঞেস করি,

‘আচ্ছা ছামসুল আলম সাহেব, আপনি কি মনে করেন আমি ভুল করেছি?’ ‘অবশ্যই।‘ 

‘তাহলে আমার জন্য একটু দোয়া করবেন। ‘ 

এ কথায় ছামসুল আলম সাহেব ক্ষেপে গেলেন,

‘আমার সঙ্গে মশকরা করেন? আপনার পাপের ক্ষমা আপনে কোথাও পাবেন না। স্বয়ং খোদাতায়ালাও আপনাকে বাচাবে না।‘ 

‘ইভেন গড ক্যান নট সেভ ইউ, ইফ ইউ ডোন্ট টেল দ্য ট্রুথ।‘ 

ল্যারি নামের লোকটার এই আক্রমণাত্মক কথায় আমার ল’ইয়ার মারিয়েলা মুখ খুলল,

“অবজেকশন, ইউ আর থ্রেটেনিং মাই ক্লায়েন্ট।‘

‘সরি’ রোবটের মতো বলে আমার শুরু করল ল্যারি,

‘আমার কাছে লাস্ট ফাইল আছে, এই ছবিতে যে লোকটি দেখা যাচ্ছে তাকে কি চেন?’ 

আমি ভালো করে তাকালাম প্রিন্ট করা ছবিটার দিকে। যে কোনো আফ্রিকান দেশের একেবারে সাধারণ একটা মুখ। তারপরও চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না। বললাম,

‘না ঠিক চিনতে পারছি না।‘ 

‘নামটা দেখে চেনা যায়?’ বলে ল্যারি আরেকটা ছবি এগিয়ে দিল যার নিচে লেখা “ইউসুফ ইরাস্তো। এবার নাম আর চেহারা মিলে আমি ঠিক চিনতে পারি। বললাম,

হ্যা, এবার চিনতে পারছি। ইউসুফ, আমাদের ছাত্র ছিল, সোমালিয়ান।‘ 

‘তুমি তাকে স্পন্সর করেছিলে তোমাদের প্রোগ্রামে?’ 

“ঠিক আমি স্পনসর করা বলব না। আমাদের সোমালিয়ার সঙ্গে গ্লোবাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম আছে। আমি সিলেকশন কমিটির চেয়ার ছিলাম।‘ 

‘বাট, ইউ রিকমেন্ডেড হিম স্পেশিয়ালি!’ 

‘হ্যাঁ, কারণ সবগুলো ক্যান্ডিডেটের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে কোয়ালিফাইড এবং বেটার জি আর ই স্কোরার। তোমার পয়েন্টটা কি বলবে?’ 

‘ডু ইয়ু নো দ্যাট হি ওয়াজ অ্যারেস্টেড ফর দ্য কানেকশন উইথ নাইন ইলেভেন হাইজ্যাকারস?’ 

‘অ্যাম আই সাপোজড টু নো?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করি।

‘ইউ টেল মি’, বলেই ল্যারি গলার স্বর পরিবর্তন করে। তার কণ্ঠের রুক্ষ্মতা আমাকে আহত করলেও আমি কিছু বলি না। ল্যারি আবার বলে,

‘ডক্টর হোসেইন, তুমি এন্টি আমেরিকান আর্টিকেল লিখেছো, নাইন ইলেভেনের আগে প্লেন চালানোর ট্রেনিং নিয়েছো, স্পনসর করেছো এমন ছাত্রকে যে একজন ফান্ডামেন্টালিস্ট, টেরোরিস্ট। ডু ইয়ু থিঙ্ক অল দিজ আর কোইনসিডেন্টাল?’ 

‘টোটালি সারকামস্ট্যানশিয়াল। তোমাদের কোনো কেস নেই।‘ আমার ল’ইয়ার মারিয়েলা মুখ খোলে এবার। উত্তরে অনেকটা সিনেমার ভিলেনের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে ল্যারি বলে,

‘আমরা এখন ভিন্ন এক সময়ে বাস করছি। লাথিং ইজ সারকামস্ট্যানশিয়াল। উই নেভার থট পিপল উড গেট অন এ প্লেন, হাইজ্যাক ইট অ্যান্ড স্ল্যাম ইন টু আ বিল্ডিং।‘ 

‘এর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’ আমি এবার গলার স্বর উঁচু করে বলি। 

‘সেটাই তো আমরা জানার চেষ্টা করছি। হোয়াট ইজ দি রিলেশনশিপ উইথ ইউ অ্যান্ড হু আর ইউ ওয়ার্কিং ফর?’

‘আপনে কার হইয়া কাজ করছেন?’

একজন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী যে কোনোদিন এই বাংলায় কথা বলতে পারেন আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলি,

‘আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি তো কারো হয়ে কাজ করছি না। আপনি ঠিক কী বুঝাতে চেয়েছেন?

‘বুঝাইতে চাইলাম, আপনে কি ইন্ডিয়ার ট্যাকা খেয়ে কাজ করছেন, নাকি আমেরিকার, না কার? ট্যাকা না খাইলে বা কিছু পাওয়ার না থাকলে কেউ এগুলান লেখে না।‘ 

‘আপনার ধারণা ভুল, আমি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য লিখিনি।' 

‘পেপার দেখেন? 

‘মানে?’ 

‘মানে হইল নিউজ দেখেন কি-না, আপনার ফাঁসির দাবি, মিছিল ইত্যাদি দেখেন কি-না। আপনার নিরাপত্তা দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।‘ 

‘তাহলে সরকারে আছেন কেন? একজন শিক্ষককে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব না হলে?’ 

‘শিক্ষক ছিলেন শিক্ষকের মতো থাকেন, এগুলান লেইখা খালি নাম কামানোর ইচ্ছা। শোনেন, সরকারের উঁচু লেভেল থেইকা বলা হয়েছে। আপনাকে আর নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব না। আপনি চাইলে আমি উঁচু লেভেল থেইকা আপনার আমেরিকায় পাড়ি জমানোর ব্যবস্থা করব। এছাড়া কিন্তু আপনার কোনো ক্ষতি হলে আমাদের কিছু করার নাই।‘ 

‘আমি আমেরিকা যাব কেন? এটা আমার দেশ! আমার দেশ নিয়ে আমি লিখতে পারব না?’ 

‘দেশ নিয়া লেখেন। লিখলেন ধর্ম নিয়া, আপনি অগণিত মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়াছেন।‘ 

আমি কণ্ঠ যথাসম্ভব শান্ত ও নিচু রেখে উত্তর দিলাম,

‘ধর্ম কি দেশের বাইরের জিনিস? আমি যদি বলি আপনারা আমার নাস্তিকানুভূতিতে আঘাত দিয়াছেন। অনুভূতি তো সবার সমান।‘ 

‘ইউ শাট আপ। ইউ সো কলড ইন্টেলেকচুয়ালস আর ফর ক্রিয়েটিং কেওয়াস অনলি, ইউ ডোন্ট নো হাউ টু রান দ্য কান্ট্রি, অল আর অপরচুনিস্টস। আই উইল মেক সিউর ইউ লিভ দ্য কান্ট্রি এএসএপি।‘ 

যে মানুষটি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে না সেই মানুষটি বিশুদ্ধ ইংরেজিতে গালি দিতে দিতে লাফিয়ে উঠল চেয়ার থেকে। আমি নিঃশব্দে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

“আমরা খুব দুঃখিত ডক্টর হোসেইন। তোমার এ বছরের কন্ট্রাক্ট আমরা রিনিউ করতে পারছি না। উই রিয়েলি আপ্রিসিয়েটেড ইউর কন্ট্রিবিউশন টু আওয়ার ফ্যাকাল্টি।‘ 

কথাগুলো বললেন আমেরিকায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেসের ডিন, প্রফেসর মার্টিন। আমি জানি, আমি যা জিজ্ঞেস করব তার উত্তরে এর চেয়েও মোলায়েম সুরে, সহমর্মিতার ভাষায় উত্তর দেয়া হবে, কোনো লাভ হবে না। জেনেও বলি, 

‘কিন্তু তোমরা তো আমাকে তিন বছরের কথা বলে নিয়েছিলে। এখনও তো এক বছর বাকি!’ 

‘তা ঠিক, কিন্তু আমাদের বাজেটে টান পড়েছে। তাই নন-টেনিউর পজিশনগুলো কাটতে হচ্ছে। উই আর ভেরি সরি । প্লিজ ডোন্ট হেজিটেড টু লেট মে নো ইফ আই কুড বি অব এনি অ্যাসিস্ট্যান্স।‘ 

‘থাঙ্ক ইউ।' বলেই আমি ডিনের ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

মারিয়েলা তার অফিসে যেতে বলেছে জরুরিভাবে। চাকরিটা হারালেও এতদিন আমি তার প্রচেষ্টায় আংশিক স্বাধীন মানুষ হিসেবে ঘোরাফেরার সুযোগ পেয়েছি। দেশ ছাড়তে বা স্টেটের বাইরে যেতে অনুমতি নিতে হবে, এই যা। আমি খুব ভালো করে জানি এরা চাইলে আমার প্রতিটি গতিবিধি নখদর্পণে রাখতে এদের কোনো বেগ পেতে হবে না। এখন স্যাটেলাইটের কল্যাণে পৃথিবীর কোন প্রান্তে একটা পিন পতন হলো তা পর্যন্ত নজরে রাখা সম্ভব, আর আমি তো কোন ছার। ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পাতাল রেল ধরে মারিয়েলার আফিসে পৌছে জানলাম, সে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অফিসে চলে আসবে। সেক্রেটারি আমাকে মারিয়েলার অফিসে বসিয়ে রেখে চলে গেল। আমি বসে বসে মারিয়েলার আফিসের খুঁটিনাটি দেখতে থাকি। এদেশে ডাক্তার আর ল’ইয়ারদের টাকার ছড়াছড়ি। আফিসের জৌলুস থেকে তা আরও বোঝা যায়। একপাশে গোল একটা টেবিলের চারপাশে চারটা চেয়ার। তার একটায় আমি বসে বসে দেয়ালে টানানো মারিয়েলার একাডেমিক আর নন-একাডেমিক স্বীকৃতির সনদ দেখতে থাকি, নানা রকমের ছবি দেখতে থাকি। মনে মনে ভাবি আমিও ছোট্ট একটি দেশের সেরা ছাত্রদের একজন ছিলাম। একদিকের দেয়ালে অদ্ভুত কিছু ছবি- একটা গুহামানব তার দলবল থেকে আলাদা একাকী দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ভয়াবহ শূন্য চরাচর। কার ছবি এটা? প্রকৃতি আর মানুষের কাছাকাছি থেকেও এই দলছুট গুহামানবের একাকিত্ব যেন ছবিটাকে এক দিগন্ত বিলীন ক্যানভাস বানিয়ে দিয়েছে।

‘সরি ডক্টর হোসেইন ফর বিয়িং লেট। আই এম কামিং ফ্রম হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অফিস।‘ 

‘ইটস ওকে।‘ আমি বলি। 

‘তোমার জন্য খুব ভালো খবর আমি আনতে পারিনি। ওরা বলছে যদিও তোমার টেরোরিজমের সঙ্গে কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ প্রমাণ করা যায়নি, কিন্তু তোমার আটিকেল, পাইলট ট্রেনিং আর সোমালিয়ান স্টুডেন্টকে স্পন্সর করা- এ তিনটি ঘটনা এক সঙ্গে তোমাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলেছে।‘ 

আমি বুদ্ধিমান প্রাণী বলেই নিজেকে জানি। তাই বুঝতে পারি এদের সঙ্গে তর্ক করেও লাভ নেই । মারিয়েলা আমার জন্য যে চেষ্টা করছে তা বোঝা যায়। মারিয়েলা আবার বলে,

‘তুমি তো এদেশে পলিটিক্যাল এসাইলাম নিয়ে ইমিগ্রেশন চেয়েছিলে, ইন ফ্যাক্ট তোমার দেশ থেকে তোমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় । তাই না?’ 

‘হ্যা।'

‘আমি তোমাদের ইউ এস অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বর্তমান পলিটিক্যাল সিচুয়েশনে তোমাকে দেশে ফেরত নিতে পারবে না বলেছে। এখানে তোমার ইমিগ্রেশন হবেও বলে মনে হয় না। এরা এমনকি কোনো প্রমাণ ছাড়া শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে ইউ এস সিটিজেনদের পর্যন্ত ডেপোর্ট করে দিয়েছে। বুঝতে পারছো অবস্থাটা?’ 

‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি।

‘আমি এটুকু আদায় করেছি যে, তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাখিল করবে না হোমল্যান্ড সিকিউরিটি । তুমি স্বেচ্ছায় এদেশ ছেড়ে চলে যাবে তোমার যেখানে খুশি। আমেরিকান সরকার তোমার যাওয়ার খরচ বহন করবে। তোমার যা ডিগ্রি তাতে তুমি অনেক ভালো ভালো দেশে ইমিগ্রেশন নিতে পার। আমি তোমাকে আমার এক ইমিগ্রেশন লইয়ার বন্ধুর নম্বর দেবো। হি উইল হেল্প’ 

“থ্যাঙ্কস মারিয়েলা।‘ বলেই আমি অনেকটা আপনমনে বলি,

‘মারিয়েলা তুমি কি জানো আমি কেন আমার দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলাম?’ 

এ কথায় মারিয়েলা কেমন চোখে আমার দিকে তাকায়। বলে, 

‘তা জানি, আমাকে তোমার ফাইলের সবকিছু পড়তে হয়েছে।‘ 

‘তোমরা এই যুদ্ধ শুরু করেছো আজ, আর আমরা করেছি অনেক আগেই।‘ 

‘জানি।' 

বলেই মারিয়েলা একেবারে তার প্রফেশনাল আদব-কানুনের বাইরে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, 

‘আই এম সো সরি ডক্টর হোসেইন । আমার বাবা-মাও তো এদেশে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এসেছিলেন, পলিটিক্যাল এসাইলাম। তারা ছিল উঁচু সরকারি কর্মকর্তা। ওদেরকে আমেরিকান সরকার আমাদের মিলিটারি জান্তার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। দে ওয়ার এক্সিকিউটেড। চলে যাওয়ার সময় শুধু আমাকে রেখে গিয়েছিল ফস্টার হোমে। আই নো দ্য পেইন।‘ 

মারিয়েলার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। এবার চোখে পড়ে দেয়ালে টাঙানো অনেক ছবির মধ্যে বাবা-মার সঙ্গে কিশোরী মারিয়েলার একটা ছবি। আমি কাগজপত্র তুলে বিদায় নিয়ে আসি মারিয়েলার অফিস থেকে। ট্রেনে চেপে চলে আসি শহরতলিতে যেখানে আমার অ্যাপার্টমেন্ট। সেখানে আমার স্ত্রী আর ছ’বছরের মেয়ে, ‘স্বাধীনা’। এটুকু পথ হাঁটতে হবে আমাকে। রাতের অন্ধকার নেমে এলেও নিয়নের আলোতে পথঘাট পরিষ্কার দেখা যায়। তবে শহরতলির নীরবতা, নিমগ্নতা চারপাশে টের পাওয়া যায়। আমি একাকী হাটতে হাটতে ভাবি, আজ থেকে আমার কোনো দেশ নেই, ঠাই নেই। নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছি, অন্য দেশেও আমি এলিয়েন, ভিন গ্রহের মানুষের মতো। আমি যেন সেই আদিম গুহামানব যে দল ছেড়ে একলা হয়ে গিয়েছিল কী এক অজানার অন্বেষায়। আমি কি আসলে আছি এই পৃথিবীতে? এই জনসমুদ্রে? একদিন আমার কন্যা, যাকে বড় সাধ করে নাম দিয়েছিলাম স্বাধীনা, কোনো এক দেশে, কোনো এক দলছুট, বিতাড়িত কারো কাঁধে হাত রেখে চোখের জল ফেলে বলবে,

‘আই নো দ্য পেইন?’



------------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি
সেজান মাহমুদ
কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, ছড়াকার, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার, গবেষক।

চিকিৎসা বিজ্ঞানী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ
উপন্যাস : অগ্নিবালক।
গল্প : হারাম ও অন্যান্য গল্প।

শিশুসাহিত্য : মুক্তিযুদ্ধের কিশোর রচনা সমগ্র।
বিজ্ঞাননির্ভর এ্যাডভেঞ্চার সমগ্র, কিশোর রহস্য গল্প, তুষার মানব, দ্বীপ পাহাড়ে আতঙ্ক।
ছড়ায় ছপড়ায় ফিকশন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. চমৎকার একটি গল্প পড়লাম। চলচ্চিত্র হওয়ার মতন সব উপাদান যেন রয়েছে গল্পটিতে। লেখকের অন্য লেখাগুলি পড়ার জন্যও আগ্রহ বোধ করছি।

    উত্তরমুছুন