নাসরীন জাহানের গল্প : আমাকে আসলে কেমন দেখায়

আমাকে কি খুব উদ্ভট দেখায় ? 

চক্রাকারে বাসটা মোচড় দিয়ে উঠতেই এমন একটা ভাবনা আমাকে অবশ করে তোলে। লোকজন কী রকম চোখ টেপে, টিপ্পনী কাটে, সন্ধ্যায় একা বেরোলে খারাপ মেয়ে ভেবে ইশারায় কেউ প্রস্তাবও দেয়। 

আমার পরিচিত কয়েকজনকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেছি, তাদের মতে ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে যে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না, তা নয়, তবে সবক্ষেত্রে নয়। 

আমার প্রায় সবক্ষেত্রেই ঘটে।

আজও ঘটছে। 

পাশ ঘেঁষে বসা লোকটা ছোঁকছোঁক করে ঘাড় নিচের দিকে নামিয়ে তাকাচ্ছে। তা তাকিয়ে আমার রূপ দেখছে, দেখুক। কিন্তু তার ভঙ্গি এত অশ্লীল হবে কেন ? তাতেও আপত্তি ছিল না, কেন বলল, ভিড়ের মধ্যে আমার ঘড়িটা খোয়া গেছে ! 

কী যে, শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! আমি বাতাস খুঁজি। তন্নতন্ন করে খুঁজি কেন আমাকে কেউ ভালোবাসে না? জীবনে প্রেম এসেছে, সে সবই আমার একতরফা। কেউ কেউ মৌজ করে কেটে পড়েছে। 

না, না আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র শঠতা ছিল না। একজন শুধু বলেছিল, তোমাকে ভদ্র দেখায় না। 

সে কি এজন্যই যে আমি অত্যন্ত দরিদ্র ? একাধিকবার পাল্টানোর জন্য আমার কোনো কাপড় নেই ? সে তো অনেকেরই নেই। তবে ? আমি গাঢ় রঙ পরি যাতে বারবার ধুলেও উজ্জ্বলতা থাকে। একজন গরিব মেয়েকে অবশ্য হালকা রঙেই মানায়। আয়নায় মুখ ফেলে দেখেছি, কোথায় অসংগতি ? কোথায় আমার রুচির সমস্যা? 

ভুরু প্ল্যাক করা ঠিক হয় নি ? একপাল ভাইবোনের সংসারে এটা সম্ভবত মানানসই নয়। 

কিন্তু আমি যখন রাস্তায়, তখনো কি আমার পিঠে আমার সংসারের লেবেল আঁটা থাকে ? তবে যে পদে পদে ধরা খাচ্ছি ? 

ভীষণ দামি ঘড়ি, লোকটা আফসোসমাখা গলায় চোরের গোষ্ঠী উদ্ধার করছে, জানেন! গাড়িতে যখন উঠেছি, তখনো হাতে ছিল! 

ও ব্যাটার ঘড়ি চুরি হয়েছে, কার বাপের কী ? 

কিন্তু কেউ কেউ মুখ খুলছে, পড়ে যায় নি তো ? কোথায় ? কীভাবে ? নানারকম গুঞ্জরণ। 

হেলেদুলে বাসটা থামতেই একঝাঁক দমকা ঘাম আমার শ্বাসনালি আগলে ধরে। 

কী বাহারি ডিপার্টমেন্ট স্টোর, চেয়ে থাকি। একসময় আমারও স্বপ্ন ছিল, আমারও থাকবে, বসে বসে দুধের টিন, লিপস্টিক, গরুর মাংস বেচব। আরও অনেক স্বপ্ন ছিল, বিয়ে করব, যে ছেলে আমার স্বামী হবে, সেও হবে আলিশান, তার সঙ্গে বিছানায় কতইনা মৌজ করব। 

বিয়ে কি শুধু ওইটুকু সম্পর্কের ? না, আমাকে তার একদম অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে হবে। যদি না বোঝে ? বিয়ে যখন এ দেশের, না বুঝে কতদিন যাবে ? স্বপ্ন যখন আমি বানাচ্ছি, তখন আমাকে তার বুঝতেই হবে। আমি ওর সঙ্গে দিনভর দৌড়াদৌড়ি খেলব। 

আপনি কোথায় নামবেন ? 

ঘড়ি-হারানো লোকটার ধূর্ত চোখ পিটপিট করছে। 

আমি কোথায় নামব-না-নামব ও ব্যাটার তাতে দরকার কী ? আমি মিথ্যে ঝেড়ে দিই। বলি, এই রাস্তার শেষ স্টপেজের কথা। 

আসলে নামি আগের স্টপেজে। সুড়ুৎ করে সবার অলক্ষে বিস্তৃত রাস্তায় নামতেই বুক ফাঁকা হয়ে আসে। যতবার চোখ তুলি, বিভ্রান্ত করে রোদ। কাঙিক্ষত বাড়িটি খুঁজে পাই না। 

কেমন ঘুম পাচ্ছে। জিভ দিয়ে ছুঁয়ে দেখি, ঠোঁটে ধুলো, সাত সাগরের নুন। 

অনেক খুঁজেছি চাকরি। মাকড়সার গল্প পড়েছিলাম। কীভাবে বারংবার চেষ্টা করে দালানের মাথায় ওঠার অধ্যবসায়ে জয়ী হয়েছিল। নিজের জীবনে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রয়োগ ঘটিয়েছি। 

এসব কারণে কি আমাকে অসংলগ্ন দেখায় ? সুস্থ, সভ্য দেখায় না ? হাঁটতে হাঁটতে প্রায়শ নেতিয়ে পড়ি, লোভী চোখে চেয়ে থাকি দামি আসবাবপত্রের দিকে এ কারণেই কি ? 

জলে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। ছায়াসিঁড়ি টপকে অভিজাত ড্রয়িংরুমে। তিনি ম্যাগনিফাইং গ্লাসে স্থির একাগ্রতায় খুদে অক্ষরগুলো আবিষ্কার করছেন। 

আমাকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনেন না। 

আমি বলি, এটা বুঝি কাকাতুয়া ? ভারি সুন্দর! 

হুম! 

খুব শৌখিন আপনি। আমি এমন দেখি নি। 

হুম! 

তরঙ্গ তুলতে বলি, যা একটা দুর্ঘটনা দেখলাম আসার পথে, যা রক্ত! জানেন, একদম মরে গেছে! 

তিনি বলেন, তুমি কম্পিউটারটা শিখে নাও, তারপর দেখি। 

বিশাল রাজপথ হাঁ হয়ে আছে। ওর মুখে ঢুকে পড়ি। রাতের বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। দেহ কি ভাঙার বস্তু? নিজেকে একটু নামানো আর কী! একবার নেমে গেলে আর ওঠা সম্ভব ? না উঠলেই বা কী ? 

কী করব তাল খুঁজে পাই না। বাসস্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকি। 

সামনে গর্জমান গাড়িগুলো। মাঝেমধ্যে কুচকুচে ধোঁয়া। 

হঠাৎ চমকে উঠি। বাসের সেই অনুসরণকারী লোকটা। ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী রকম কৌতূহলী চোখ। না, কোনো লাম্পট্য নেই। যেন বিচলিত। সে কি টের পাচ্ছে আমি বিপদগ্রস্ত ? 

তাহলে কোনো মহান ভূমিকায় সে দাঁড়াতে চাইছে ? কেমন ঘামতে থাকি। পায়ের তলা ঠান্ডা হয়ে আসছে। নিজেকে লক্ষ করি, কী রঙের শাড়ি পরেছি ? কমলা ? কালো চামড়ায় মানাচ্ছে না ? আমার কি রুচিবিভ্রাট আছে ? কী করে একজন মানুষের মধ্যে সুরুচি নির্মিত হয় ? অমন ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে আছে যে! 

বাসের ভিড়ে নিজেকে সেঁধিয়ে দিই। 

আমার কিচ্ছু হবে না। স্রেফ মরা কাক হয়ে ঝুলব। 

সেই অনুসরণকারী লোকটা বাসে উঠেছে। আহারে বেচারার ঘড়ি! যা হোক, চোখ টিপছে না, থাবা বাড়াচ্ছে না, শিস দিচ্ছে না, স্রেফ লক্ষ করছে। নিজেকে দামি করতে ভাবলেশহীন থাকি। 

ইতিমধ্যে নিঃশব্দে কায়দা করে আমার পাশেই লোকটি জায়গা করে নিয়েছে। 

জানালা দিয়ে বহু কষ্টে চোখ বের করি। একটি ছেলে বুদ্বুদ ওড়াচ্ছে। আমার এমন বুক ধড়ফড় করছে কেন ? ওই ডুমো ডুমো বুদ্বুদের মতো ? 

না, ভেতরে আবার শুরু হয়ে গেছে, এখুনি ফুরিয়ে আসতে থাকবে বাঁচবার সাধ। মেরুদণ্ডের সব রস সুড়সুড় নেমে যাবে পাতালে। 

অথচ, স্বপ্নে সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করি। আমি যেন বেজি, উটকো লেজ গজিয়ে যায় পেছনে, মুখটা ছুঁচালো, প্রবল যুদ্ধ করি, সাপের মুখে রক্ত না ওঠা পর্যন্ত। 

কেবল কারও বাড়িতে গেলে কেউ যখন সন্তর্পণে এড়াতে থাকে আমাকে, যখন আমার উপস্থিতি তুচ্ছ করতে অহেতুক কাজ খুঁজে বের করে, তখন সব হারিয়ে ফেলি। 

ওই বেহেড ফাজিল লোকটা গা-ঘেঁষা হয়ে আমার মেরুদণ্ডে আঙুল ঢুকিয়েছে। টের পাচ্ছি, ক্রমশ ফুটো হয়ে যাচ্ছি। 

ও কি আমার প্রতি আসক্ত ? কী চাইছে ও ? আমার শেষ ? 


বাসটা যেন অনন্তের পথে পা বাড়িয়েছে, আমি কিছুতেই হাতড়ে পাচ্ছি না আমার গন্তব্য। এর মধ্যে কত যে কথা হচ্ছে! একজন হ্যান্ডেলে হাত চেপে শ্বাসরুদ্ধকর জাতাজাতির মধ্যেও ফটাস করে করে মুখ বাড়িয়ে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে বলছে। কে যে শুনছে তার কথা! 

পড়াতে যেতাম এক মেয়েকে। কী আলো ঝলমল মুখ তার! ছায়া গলিটা পার হয়ে তার উজ্জ্বলতায় বসে হাঁপ ছাড়তাম। 

একদিন বলল, আসবেন না। 

আমি বললাম, কেন ? 

বাবা একটি বাজে ছেলের সঙ্গে আপনাকে রিকশায় যেতে দেখেছে। 

না, ও যা ইঙ্গিত করছে, এখনো সে জায়গায় নিজেকে নামাই নি। 

পুরো রাতের নিদ্রার মধ্যে ঢুকেছিল বিষ। কী অসহ্য রাত, কুয়াশা পতনের শব্দটি পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলাম। এরপর গা ঝেড়ে দাঁড়িয়েছিলাম, প্যান্টশার্ট পরে গটগট হাঁটব। গলির মুখে দাঁড়িয়ে সবার মুখে সিগ্রেটের ধোঁয়া ছুড়ে ছুড়ে মারব। 

কিন্তু এ আমার প্রকৃতি নয়। জন্মাবধি একটা মিনমিনে ভাব আমার মাথা নিচের দিকে নামিয়ে রাখে। চিন্তার মধ্যে আমি যত বেশি মারকুটে, প্রকাশ্যে ততটাই শিথিল। এ জন্যই দুই সত্তার যুদ্ধ মাঝেমধ্যে প্রাণান্তকর হয়ে ওঠে। 

ফিল্মের নেশা আমার রক্তের মধ্যে। লুকিয়ে কত যে সিনেমা দেখেছি! নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বছরের পর বছর বিভোর থেকেছি। পথঘাট খুঁজেছি অনেক। শেষে একজন বলল, তোমাকে নায়িকা করার কোনো যুক্তি নেই। 

কেঁদেছিলাম খুব। এ জাতীয় অসংখ্য স্বপ্নভঙ্গ আমার জীবনকে অসম্পূর্ণ করে রেখেছে। আমি সুস্থিরমতো কোনো গন্তব্য তৈরি করতে পারি না। শেষমেশ খুঁজছি এমন একটা হ্যাবলা মার্কা ছেলে, যে একইসঙ্গে হবে দুর্দান্ত কুৎসিত। ওর ঘাড়ে চড়ে বনবন লাঠি ঘোরাব। 

ছুঁচোর কেত্তন ভরা ঘর থেকে পালাব। 

বাসটা ঝাঁকুনি দিতেই সেই লোকটা কানের কাছে মুখ এনে নিঃশব্দে বলে, ঘড়িটা দিয়ে দিন। 

ধড়াস শব্দে কেঁপে উঠি। তার দিকে এমন চোখে তাকাই যেন সাক্ষাৎ বেজি। 

মিশ্র অনুভূতিতে মাথার মধ্যে উল্টোপাল্টা লেগে যায়। লোকটা যেন গল্প করছে এমন ভঙ্গিতে বলে, এই ব্যবসা কবে থেকে ? যেন জানে, এর আগে আমি অন্য কোনো ব্যবসা করতাম। 

আমার দাদার নাকি বিশাল সম্পত্তি ছিল। ঘোড়া ছিল হাতি ছিল। তিনি যদি জানতেন তার উত্তরসূরিকে এই রকম কুৎসিত সন্দেহে...। 

দেখুন, গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করতে যাই। 

লোকটি নম্রকণ্ঠে বলে, আপনার ব্যাগে সেটা আছে। আমার সঙ্গে বাড়বেন না। সঙ্গে আরও লোক আছে। পরিস্থিতি ভালো হবে না। এসবই লোকটি বলছিল গলা নামিয়ে। যেন প্রেমিকাকে নতুন কিছু শোনাচ্ছে, এরকমই হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে। 

ব্যাগ খুলে নিঃশব্দে দিয়ে দিই। 

লক্ষ করি, অপার্থিব কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে। 

অন্ধকার গলি ধরে যখন বাড়ি ফিরছি, দেখি, গলির মোড়ে কুকুর। কী সুন্দর তার চন্দ্রবিন্দু লেজ নাড়ছে! 

নির্জন পথে ওর সঙ্গেই গল্প করি, ঠিক আছে, আমাকে ভদ্র দেখায় না, রুচিবান দেখায় না, ঠিক আছে, দুই নম্বরি মেয়ের মতোই দেখায়। 

কিন্তু চোরের মতো ? 

তা নিশ্চয়ই দেখায় না! 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ