নাকমুখ এঁটে দাঁড়িয়ে আছে সলিমুদ্দি । একটা বিড়ি ধরাই, নাহলে দুর্গন্ধে নাড়িভুঁড়ি হাংলে উঠে পড়ছে, বিড়ির গন্ধে যদি এই বিটকেল গন্ধটা কিছুটা কমে,বলে একটা বিড়ি ধরাল সলিমুদ্দি । যদুকে জিজ্ঞেস করল, “বিড়ি খাবা নাকি ?”
“হাত এখুন ফাঁকা নাই গ । কী করি টানব । আপনিই খান, আমি পরে ধরাচ্ছি ।“ কাঁপা গলা হাঁপিয়ে আপন কাজে খেয়াল দিল যদু দাস । সলিমুদ্দি মনে মনে বিড়বিড় করল, এখানে আসা মানে দুর্গন্ধ খেতে আসা । কিন্তু কী আর করা যাবে ! এমনি এমনি সাধ করে তো এখানে কেউ আসে না । ঠেলায় পরেই আসতে হয়েছে । অন্য দিন যখন এদিকটা দিয়ে যাই নাকে রুমাল ঠেসে যাই, যাতে দুর্গন্ধটা নাকের চুল ছুঁতে না পারে । আজ আর পগার পেরোনো গেল না । বাড়ির খেসেল বৌটা ‘লিয়ি যাও গ লিয়ি যাও গ’ বলে ঘ্যানর ঘ্যানর করে মাথাটা খেয়ে ফেলল । মাগি ছাগলটাও আর একদন্ড সবুর করতে পারল না ! ভেবিয়ে ভেবিয়ে কান মাথা ঝালাফালা করে দিল । ভ্যাবানির জ্বালায় সারারাত একদণ্ড ঘুমোতে দেয়নি ! এই হয়েছে এক জাত, একবার খরালে কারও বাপের মুরোদ নেই যে তাকে একবার থামায় । হিড়হিড় করে টেনে এই বতুর কাছে আনলে তবেই শান্তি । বিড়ির একটা লম্বা টান দিল লম্বা ঠ্যাঙঠেঙে সলিমুদ্দি । সূর্য না ফুটতেই ঝুঝকি সাথে করে খড়ানি ছাগলটাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে এখানে নিয়ে এসেছে । দু বিহেনের ধাড়ি ছাগল । এবার পোয়াতি হলে তিন বিহেনে পড়বে । ছাগলটার পেটের ফলন ভালো । এক বিহেনে চারটে পাঁচটা বাচ্চা দেয় । তারমধ্যে গত দু বিহেনেই তিনটে তিনটে করে মোট ছ টা গাট্টাগোট্টা খাসি বিহিয়েছে ! পরপর পাঠি বিহোলে মন খারাপ হয়ে যায় সলিমুদ্দির । তখন মনে হয়, এতদিনের খাটুনি, ভরণপোষণ, আদরযত্ন সব যেন মাঠে মারা পড়ল ! টালির দুচালার ঝুপড়ি ঘরটার দেওয়াল ঘেঁষে তল্লা বাঁশের খুঁটির মতো ঠাই দাঁড়িয়ে মন মিনমিন করে গাহাচ্ছে সলিমুদ্দি । কুসুম ফোটা সকালের সদ্য বিহেন রোদ কাঁচা হলুদ মেখে তার চুল ওঠা টাকের ওপর এসে তেরছা করে পড়ছে । ‘ভ্যা’ ‘ভ্যা’ করে পাশে দাঁড় করানো আরও দুটো ছাগল থুতনি ফেড়ে খরাচ্ছে । সকাল পড়তে না পড়তেই লম্বা লাইন পড়ে যায় । এই চত্বরে “যদুর বতু”ই হল একমাত্র ছাগল পাল দেওয়ার ঠেক । আশপাশের গা গেরাম থেকে খরানি ছাগল এখানে এসেই তার ভ্যা ভ্যা থামায় । কিন্তু বতু একটা দেখছি কেন ! ছোটখাট ষাঁড়ের মতো দু দুটো তাগড়া বতু যদুর ! গায়ে ঘাসের ঝোপের মতো কটা হলুদ লোম ! খরানি ছাগল দেখলেই মুখটা ভেংচে ঠোঁট নেড়ে অদ্ভুত ধরণের ভ্রূরু ভ্রূরু আওয়াজ করে ওঠে । ওপরের দিকে ধনুকের মতো বাঁকানো লেজ দুলিয়ে পিছনের ঠ্যাঙ জোড়া ছ্যাৎ করে ছুড়ে । কাছাকাছি থাকলে দুজনে শিঙাশিঙি লেগে যেত । একজন আরেকজনকে শিং উঁচিয়ে তেড়ে যেত । দেখে মনে হত, দুটো ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের লড়াই হচ্ছে । বাঁকা শিঙের বতুটাকে চারপাশ তন্য তন্য করে খুঁজেও সলিমুদ্দির চোখে সুজল না ! মনে প্রশ্নটা ধোঁয়া দিতেই সলিমুদ্দি জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার গ যদু, তুমার আরেকটা বতু দেখছি ন্যা !”
যদু বতুটার গলার দড়ি হাত দিয়ে পোক্ত করে ধরে ঝটকা দিয়ে এদিক ওদিক করছে । একবার হুক করে টানছে তো একবার ঘুঁত করে হ্যাঁচকা মারছে । পরনের নীল রঙের লুঙ্গিটা গুটিয়ে নেঙটি মেরে বাঁধা । গায়ে কালো চিটচিটে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি । হ্যাঁচড়াপ্যাঁচড়ায় হাঁপিয়ে উঠেছে যদু । কার্তিকের হিম সকালেই তার কপালে ছোপ ছোপ ঘাম । লেপের জ্বাড় ঝেঁপে না নামলেও চাদরের জ্বাড় গা শিরশির করছে । যদু হাঁসফাঁস করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বেচি দিইচি ।“
“বেচি দিয়চ ! ক্যানে গ !” ঠ্যাঙঠেঙে সলিমুদ্দি ভ্রূ টান করল । ভক করে মুখ দিয়ে একগাল ধোঁয়া বেরিয়ে গেল । তার থ হয়ে থাকা গতরটা হলবল করে উঠল ! যদু আলগা করে বলল, “অ মেল্লা ফ্যাচাং গ ! ইডাও মুনে হয় বেচি দিতে হবে ।“
“অ আবার কী অলুক্ষনে কথা বুলচ গ !” সলিমুদ্দি যেন আসমান থেকে পড়ল । যদু বতুর দড়িটাকে হাতে আরও একপাক দুমড়ে পোক্ত করে ধরে বিড়বিড় করল, “অ্যা চালি যাতে হলে গুষ্টির পিন্ডি হয়ি যাবে ! আমরা নাকি মানুষ লই ! বতু পুষি পুষি আমাধের জাত ধম্ম নাকি মরি গেলছে ! ই কারবার মানুষ ভালো চোখে লেয় না গ । দিনের দিন আমরা একঘরে হয়ি পড়চি । আমাধের গায়েও নাকি বতুর গন্ধ !”
“তুমি ই কাজ বন্ধ করি দিলে আমরা কইত যাব ? এট্টুখানি কাছে পিঠে পাই বুলি দু একটা ছাগল পুষি । ছাগল পাল দিতে গিয়িই যদি গুটা দিন চলি যায় তাহলে ছাগল পুষা হারাম করি দিতে হবে । তুমি অমন সব্বনেশে কথা আর মাথাতে আনো না । দরকার হলে দু-দশ টাকা দর বাড়হাও ।“ দাম বাড়ানোর ফন্দি দিল সলিমুদ্দি । তারপর একটা লম্বা সুখ টান দিয়ে চোখ টেনে ফড়ফড় করল, “আমাধের না হয় দুএকটা ছাগল কিন্তু যারা পাল পাল ছাগল পুষে তাধের কী হবে, একবার ভেবি দেখিচ ? না খেতি পেয়ি মরবে ! আমাধের পূবপাড়ার আসরা বেওয়ার কথাই ভাবো, একপাল ছাগল ! ছাগলপুষিই তার অভাব অনটনের সংসারডা চলে । সে যদি তার খরানি ছাগলগুলানকে পাল দিতে না পারে, তাহলে তার ছাগল বাড়বে কী করে ! এরম তো এই চত্বরে মেল্লা আসরা বেওয়া আছে । তাধের দিন আনা দিন ফুরানে সংসারডা যে লাটে উঠি যাবে ! এমনিতেই আচট চটান বুলি আর কিচ্ছু পড়ি নাই খ । সব আগার পাগার ঝেটি আবাদ হচ্চে । ছাগল গরু চড়ানোর জাগা নাই । তারপরেও যদি তুমি বুলো আমি ই কারবার তুলি দিব । তাহলে তো ছাগল পুষাই তওবা করি দিতে হয় !”
“আগে লিজে বাঁচি, তারপরে পরের কথা ভাবব ।“ আলগোছে বলল যদু । যদুর কথায় অন্য কিছু একটার ইঙ্গিত পেল সলিমুদ্দি । নিশ্চয় বড় কিছু অঘটন ঘটেছে । যদুর বৌ কি ব্যাগড়া বাঁধাচ্ছে ! যদুর বৌ হেমলতাকে যতটা চিনি তাতে মনে হয় না সে এ কারবারে ব্যাগড়া বাঁধাবে । কারবারটা তো বলতে গেলে হেমলতায় চালায় । সেইই তো রাতদিন এই চটানে বতুগুলোর সেবাশুশ্রূষা নিয়েই পড়ে থাকে । এই দেখি বতুর গা ধোয়াচ্ছে তো এই দেখি ঘাস খাওয়াচ্ছে । মনের ভেতর হাজার খুঁতখুঁত তোলা দিয়ে ওঠে সলিমুদ্দির । বিটকেল গন্ধটা নাকে ঝেঁপে আসতেই ঘন ঘন ফুঁক ফুঁক করে বিড়ি ফুঁকছে সে, যাতে করে দুর্গন্ধটা কম লাগে । মনে কলি হয়ে ওঠা একটা প্রশ্ন ফট করে পেড়ে বসে, “তুমার বৌ কি ছিনবিন কচ্চে ?”
সলিমুদ্দির প্রশ্নটা কানে খট করে বাজতেই যদু চোখ ঢেলা পাকিয়ে তুলল । ভাবল, ঘরের কথা পথে পাড়া কি ঠিক হবে ! সংসারের কথা হাট করা কী দরকার । তোলা চোখ নামিয়ে মিনমিন করে বলল, “না গ না ।“
কথাটা মিহি স্বরে বলেই আচমকা কন্ঠটায় হাতুর পিটে উঠল যদু, “লে লে লে, হিই হিই, হুড় হুড়, উঠ উঠ……।“ বতুটা ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো হ্যাঁচকা টান মেরে খরানি ছাগলটার ওপর ওঠার জন্যে তিড়বিড় তিড়বিড় করছে । যদু শক্ত হাতে বতুটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে । এই সময়টাই তাকে খুউব সতর্ক থাকতে হয় । যাতে এক চড়হাতেই কাজ হাসিল হয়ে যায় । যাতে ভুল করে বতুটা ছাগলটার ওপর দুবার চড়হা না মারে । আরও তো ছাগল লাইনে আছে । এক ছাগলেই সব দোম ফুরিয়ে গেলে ব্যবসা যে লাটে উঠবে । বতুটা একেবারে লাল হয়ে উঠেছে । শরীরের ক্ষিদে আর বাগ মানছে না । তার গায়ের বিটকেল গন্ধটাও উন্মাদ হয়ে উঠছে । সকালের মিঠে বাতাসে ভর করে আরও মাতাল হয়ে উঠছে । একটা শক্ত বাঁশের খুঁটিতে সলিমুদ্দির ধাড়ি ছাগলটা বাঁধা আছে । বতুটা নাক দিয়ে ধাড়ি ছাগলটার সারা শরীরের গন্ধ শুঁকছে আর ছাগলটার চারপাশে ঘুঁত ঘুঁত করে ঘুরঘুর করছে । খরানি ছাগলের গায়ের গন্ধে বতুটা আরও ক্ষুধার্ত হয়ে উঠছে । আরও কামুক হয়ে উঠছে । বতুটা একআধবার ঝটকা দিয়ে এমন পাকসিটে টান মারছে যদুর হুমড়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে । যদুর শরীর দুমড়ানো দড়ির মতো দুবলাপাতলা হলেও হাড় মাংসে পাড়িমোষের জোর । শরীরের গাঁটে গাঁটে কাদান টানা বলদের দোম ।
“পাড়া পশশি কি খিজিবিজি কচ্চে ?” একটা উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে মুখের ধোঁয়াটা মিহি করে ছেড়ে দিয়ে মনের খুঁতখুঁতানিটার ফাংড়ি টানল সলিমুদ্দি । সে শুনেছে, যদুর পাড়াপড়শি মাঝে সাজেই লাঠিসাটা নিয়ে তেড়ে আসে, বতুর গন্ধে তাদের আর থাকা যাচ্ছে না নাকি । এ নিয়ে কম খিটকেল হয়নি । থানা কেস পর্যন্ত হয়েছে । যদু বলতেই পারত, আমার বাপের ভিটেতে আমি বতু পুষি শুয়োর পুষি লোকের বাপের কী ? বতু পোষা কি শাস্ত্রে নিষেধ ? আমি তো লোকের তিন সিমনায় যাচ্ছি ন্যা ? কিন্তু লোকে এমন হাবভাব করেছিল যেন যদু তাদের পাকা ধানে মই দিয়েছে ! যদু অত ঝোরঝামেলাই যায়নি । বাস্তু ঘরের চালাটা তুলে নিয়ে এসে এই মাঠের ধার লাগোয়া একওরের উঁচু ডিহিটায় ঝুপড়ি ঘরটা বানিয়েছে । সেসবের চোঁয়া ঢেঁকুর জাবর কেটে প্রশ্নটা করল সলিমুদ্দি । যদু কুঁত পেরে বলল, “সে ঝামেলা কি কম পুহাতে হয় ! এই মাঠপানে উঠি এসেও সেসব গা জ্বলা কথা কম শুনতে হয় না । তবে সেসব শুনি শুনি হজম হয়ি গেলচে । এখুন ক্যাচালডা অন্য দিক থেকি পেকি উঠচে ।“
“সেসব তুমি ঠিক উৎড়ে যাবা । তুমার হাড়ের সে ধক আচে । এত্ত ঝোরঝামেলাতেও যখুন পিঠ খাড়া করি থেকিচ । ইবারও খাড়া থাকবা, আমি লিশ্চিত ।“
“খাড়া আর থাকতে পাচ্চি কই ? সব লড়বড়ে হয়ি যাচ্চে !”
“তা তুমার বতুরও অসুখবিসুকের ফারা লাগল নাকি ?” গত পরশুরাতে পাশের বাড়ির আলামতচাচার একটা ধাংড়া খাসি আচমকা পেটফুলে মারা গেছে ! খাসিটা জবাই করার ফুরসতটুকু পর্যন্ত পায়নি । খাসিটা কুরবানি ছিল । তার ক-দিন আগেই মণ্ডলপাড়ায় দুটো পাঠি ছাগল মরে যাচ্ছিল বলে সবাই হাতেপাতে ধরে জবাই করেছে । সবাই গাহাগাহি করছে, ছাগলের নাকি মোরগ লেগছে ! কে না বলতে পারে, এই মোরগ যদুর বতুটাকেও খামচে ধরেছে ! মাথায় জিইয়ে থাকা আপদটা সলিমুদ্দি জিজ্ঞেস করল ।
“সেসব কিছু না ।“ আলগা করে বলে যদু হাতের দড়িটা ঢিলা দিয়ে দিল । বতুটা ধাড়ি ছাগলটার ওপর ধামড়েকামড়ে উঠে পড়েছে । ঠাপে পড়ে ধাড়ি ছাগলটা কুঁকড়ে ঠোঙা হয়ে যাচ্ছে ! বতুটা মুখে অদ্ভুত ধরণের একটা শব্দ করছে । সে শব্দটা বিটকেল গন্ধ মেখে চত্বরটাকে উড়নচন্ডি করে তুলছে । ধাড়ি ছাগলটার শরীরের ক্ষিদে একটু একটু করে মিটে যাচ্ছে । দমে যাচ্ছে শরীরের জ্বালা । সলিমুদ্দির মাথার ঘেলু ঘোল পেকে যাচ্ছে । বাড়িওয়ালির ব্যাগড়া নয়, পাড়াপড়শি ঠুক্মুক করছে না, বতুর অসুখ বিসুখও হয়নি, দরদামও ঠিক পুষিয়ে যাচ্ছে বলছে তাহলে যদুর হলটা কী ! আবার বলছে কোন পুরুত মোল্লারাও ফতোয়া দেননি । তাহলে যদু হুট করে এ কারবারটা তুলে দেবে বলছে কেন ! সলিমুদ্দির আগ্রহের ক্ষিদে আরও বেড়ে গেল । গলায় একটা শুকনো ঢেকুর তুলে খোঁচা দেওয়ার মতো জিজ্ঞেস করল, “লিশ্চয় অ্যার চেহেও বেশি উজগারের হদিস পেয়ি গেলচ ?“
“হ্যাঁ হ্যাঁ উজগার তো এক্কেবারে থলে ভরে দজ্জায় দাড়ি আচে ! সলিমভাই কী যে বুলেন না ! আকালের দ্যাশে কাজ কই ? ঝুলা ভরি উজগার কত্তে হলে ভিন দ্যাশ যাতে হবে । আমাধের দ্যাশে লেতাদের শুদু বাতলিং । বুলার মুতন কাজ বুলতে গ্যালে রাজমিস্তিরির জুগাল খাটা ছাড়া কুনু গরজ নাই ।“ বতুটাকে শক্তিভর টেনে নামাতে নামাতে দাঁত চিবিয়ে বলল যদু । যদু বতু পোষার আগে গেরামে গেরামে জুতো সেলাই করে বেড়াত। কিন্তু আজকাল মানুষ সেলাই করা তাপ্তি মারা জুতো আর পরছে কই? ফলে সে দিন আনা দিন খায় রোজগারে দিন চলল না যদুর। বউ হেমলতার কথাতেই সে জুতো সেলাইয়ের কাজ ছেড়ে এই বতু পোষা শুরু তার। যদু ছমুর খুটিটায় ফাঁস গিঁট দিয়ে এঁটে বেঁধে মনটাকে কিছুটা থির করে বলল, “আসলে একটা জিনিস লিয়ে গত ক-বচ্ছর ধরি ফ্যাসাদে পড়ি আচি । এই বতুর লেগি মাথার ওপর একটা বুঝা দিনের দিন চেপি ধচ্চে । বুঝাডার একটা বিহিত করা বড্ড দরকার হয়ি পড়িচে ।“
“বুঝা ! কী বুঝা যদু ? মাথার বুঝার সাথে বতু পুষার কি সাথ ?” চোখ কপালে উঠে গেল সলিমুদ্দির । ঘুল ঘুল করে যদুকে দেখতে লাগল । যদু বলল, “আপনারডা হয়ি গেলচে সলিমভাই । লিয়ি যান ।“
“সে লিয়ি যাচ্চি । কিন্তু বুঝাডা কী বুল্লা না ত ?” একগাল ধোঁয়ার সাথে কথাটা ভক করে বেরিয়ে এল সলিমুদ্দির । তার এড়িয়ে যাওয়া প্রশ্নটাকে একেবারে কান ধরে ঘুরিয়ে আনল । যদু বুঝতে পারল সলিমুদ্দি তাকে ব্যাড়ে ফেলে তার ঘরের কথা লিতে চায়ছে । সে লিক গা । ই কথা চাপা থাকবে না খ । আর চেপে রাখারই বা কী আছে । জানলে জানুক । সলিমুদ্দি হিতাকাঙ্ক্ষী লোক । দায়েদি না হলেও আপদ বিপদের খোঁজ লেয় । ভিনগাঁয়ের লোক হলেও কুটুমের মুতন ব্যবহার করে । তাকে মুনের কষ্টের কথাডা বুললে বুকটা তাও তো একটুখানি হালকা হবে । দুঃখের কথা কষ্টের কথা কাউকে বুললে মুনটা হালকা হয় ।
“সব কথা মুখ পেতি বুলা যায় না গ । অ্যা শুদু বুঝা লয় খ, বাপের কর্তব্য বুলতে পারেন । গাধা বাপ সে কর্তব্য অ্যাতদিনেও করি উঠতে পারেনি । ভগবান ক্যানে যে আমাকে বিটির বাপ বানিছিল !” আচমকা ডুকরে ওঠে যদু । সকালের আঁতুড় রোদ তার চোখে চিকচিক করছে । তার হলহলে ছায়াটা ডিহিটার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে মাটি শুঁকছে । বাড়ির ছঞ্চে ঘেঁষা ঝাঁকড়া পেয়ারা গাছটা চালার মটকা ভেদ করে সটান উঠে গেছে আসমানে । পেয়ারা গাছের মগডাল ধরে নেমে আসছে সদ্য ভুমিষ্ঠ হওয়া দিন । ভোরের মিহি নিহরে আধ ভেজা পেয়ারার পাতাগুলোয় দিনের আইঘোর রোদ পড়ে রুপোর মতো চিকনাই মারছে । কিন্তু এত হলুদ বাটা মিঠে রোদ পড়েও যদুর হাঁড়া মুখটায় এক চিলতে হাসিও খেলছে না ! মুখটায় কে যেন গাবের আঠা ধেবড়ে লাগিয়ে দিয়েছে । সলিমুদ্দি গডগড করে এগিয়ে এসে বিড়িটা মুখে পুরে তার ধাড়ি ছাগলটার দড়ি ধরে ঠোঁট চেপে বলল, “অমন কথা বুলতে হয় না খ । আল্লা ব্যাজার হয় ।“ তারপর ছাগলটাকে পেয়ারাগাছটার ছায়ার আড়ালে হিড়হিড় করে টেনে আনতে আনতে বলল, “তুমার দুই ব্যাটার বড়ডা তো রাজমিস্তিরির জুগাল খাটে । নামলাডা তো এখনুও হাফ পেন্টুল ছাড়েনি । তা বাপের কর্তব্য পালন করা না করার কথা আসচে কোত্থেকে, যদু !”
আর যায় কোথায় যদু । কথার প্যাঁচে পড়ে যায় সে । বাড়ির দিকে একবার চোরের মতো দৃষ্টি ফেলে থড়বড় করে বলল, “মেয়িডা লটকে লটকে দিনের দিন ধাংড়ি হয়ি উঠচে ! ই বচ্ছর ওর একটা বিহিত না কল্লে আর কুনুদিন হিল্লে কততে পারব ন্যা । বাড়িতে আইবুড়ো বিহেতিযোগ্য মেয়ি থাকা যে কত্ত বড় বুঝা তা লিশ্চয় আপনাকে বুঝাতে হবে না খ ?”
“সে আর বুলচ, চেহারা পাকতে লাগলে ট্যাঙের দড়ি গলায় উঠি যায় ! তিন তিনডে মেয়িকে পার কত্তে হয়িচে ! সে কি চাড্ডেখানি খিটকেল ! পাছার কাপড় উদেম হয়ি গেলচে । কিন্তু উপায় নাই । বিটির বাপ যখুন হয়িচি , বিটিদের একটা হিল্লে তো করি যাতেই হবে ।“ ঢোক গিলল সলিমুদ্দি । শেষ হয়ে আসা বিড়িটা পড়পড় করে ফুঁকল । একটা জোর শ্বাস ফেলে বলল, “তা মেয়ির বিহে দিবা সে তো খুব ভালো কথা । ফরজ কাজ । সমস্যাটা কী ?”
“সমস্যাটা বিহি লয়, সমস্যাটা হল বতু ।“ কন্ঠ ভারি হয়ে উঠল যদুর ।
“বতু !” ভ্রূ কুঁচকে গেল সলিমুদ্দির । যেন দুনিয়ার সব বিস্ময় তার চোখে ।
“আমারডা আগাড়ি আগাড়ি দিয়ি ফদফদ কর । আমার তাড়া আচে । মাঠে লিড়ানির মুনিষ যাব । লেট করি গ্যালে গেরস্ত খিচিবিচি করে ।“ ঘুটঘুটে বাটুল লোকটা তাড়াহুড়ো লাগাল । তার বলার সাথে সাথে তার হাতে ধরে থাকা এতক্ষণ ভ্যা ভ্যা করে ভ্যাবানো খরানি পাঠি ছাগলটাও আরও জিভ বার করে ভ্যা করে উঠল । “দিচ্চি গ দিচ্চি, এট্টুখানি জানে ধর ধচ্চে না !”
“আমার জান ধর ধল্লে হবে । জানে ধর ধরাতে হবে ছাগলডার । পয়লাবার খরিচে, একদন্ড থামচে না ।“ বেঁটে লোকটা ঠোঁটে চিরিক করে মশকরার হাসি হাসল । “এট্টুখানি দাঁড়ান, দুটে কথা কহি লিয়িই দিচ্চি ।“ বলেই সলিমুদ্দির দিকে মুখ বাড়িয়ে যদু বলল, “হ্যাঁ, বতু, জানেন, ওই বতুর লেগি বিটির চিন্তায় রাতে দুচোখ এক কত্তে পাচ্চি ন্যা !”
“তা এতদিন বিহি দ্যাওনি ক্যানে ? তুমার তো উজগারপাতি ভালোই হয় । বাপ ব্যাটাতে পাল্লা দিয়ি খাটচ । বতুর ইনকামও কম লয় ।“ ভড়ভড় করে আয়ের ফিরিস্তি শোনাল সলিমুদ্দি । যদু বলল, “টাকাপয়সার সমস্যা লয় । সে অ্যাত বচ্চর ধরি যা গুছিয়েচি, হাতে পাতে বিহিডা ঠিক উৎরে যাবে ।“
“তাহলে আর ব্যাগড়া কীসের ? একটাই তো বিটি । ধুমধাম করি বিহি লাগি দাও ।“ সুখটানের ধোঁয়াটা লম্বা করে ছাড়ল সলিমুদ্দি ।
“শুদু টাকা থাকলেই কি আর বিটি পার করা যায়, সলিমভাই ? ব্যাগড়া কি আর শুদু পকেট ফতুর হলিই বান্ধে ? ইখানে ফ্যাকড়াডা প্যাটের রুজিতে লাথি মেরি বেন্ধিচে !” বাড়ির ঝাঁপিটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিচু গলায় বিড়বিড় করল যদু । চোরা দৃষ্টিতে দেখে নিল, ঋতুর মা এদিকে কান পেতে আছে কি না । ও আবার এসব কথা শুনলে পরে চ্যাটাংপ্যাটাং করবে । তেড়ে এসে চোখ পাকিয়ে বলবে, কাজের সুমায় অত্ত ফদর ফদর করি বকো ক্যানে ? মিনষ্যের বকি বকি প্যাট ভরে না ! সকালের রোদটা পাটকাঠির বেড়ার আড়াল দিয়ে ঢুঁ মারছে বাড়ির ভেতরে । হাঁটুর বয়সের দিন হামু টেনে ঢুকছে উঠোনে । ইটের দেওয়াল । টালির ছাদের দু-কুঠরি ছোট্ট ছোট্ট ঘর । লম্বা সিতেনের উশরা । ঢালু উঠোনের ছমু দিকটা পাটকাঠির বেড়া দিয়ে ঘেরা । ভিটেটা একটা ঢিপির ওপর । নাহ, হেমলতাকে চোখে দেখচি ন্যা, মুনে হয় পাড়া চক্কর কাটতে গেলচে । টইটই করি পাড়া ঘুরা অর চিরদিনের অভ্যাস । এত্ত বুলি বুলি অর পাড়াঘুরানি কাটল না ! ঝাঁপির ফাঁক দিয়ে চোখ ফেড়ে তাকিয়ে কথাগুলো বিড়বিড় করে চিবোল যদু ।
“কই গ, দাও ।“ বেঁটে লোকটা তাড়া দিল । নাক এঁটে বিড়বিড় করল, “যা বিটকেল গন্ধ, আর কিছুক্ষণ থাকলে অজ্ঞান হইয়ি যাব ! একবার দুবার যা দিবা দিয়ি দাও, কেটি পরি । তারপরে আসমোড়া বেঁধি পেট ভরি গপ্প করো । আমার আর দাঁড়াবার অত্ত সুমায় নাই খ ।“
“অ্যা তো আচ্ছা খিটকেলি লোক রে বাবা ! মানুষের সাথে দুটি সুখ করি কথা বুলতে দ্যায় না খ !” চোখ ট্যাঁরা পাকিয়ে মুখ ভেংচে উঠল যদু । গলা খ্যারখ্যার করে বলল, “কই, আনো, তুমার ছাগল আনো ।“ বলে বতুটার দড়ি খুলে হাতে ধরল যদু । মনে মনে বলল, থামো, ধৈয্য থাকে কি না দেখচি । আমি ই কারবার তুলি দিলে কতি ছাগল পাল দিবা তাও দেখচি । হয় গাড়ি ভাড়া করি সেই সাত কিমি দূরের জগন্নাথপুরে লিয়ি যাতে হবে আর তানাহলে ছাগল পুষা বন্ধ করি দিতে হবে । তখন বুঝবা, জানে ধর ধরা কাকে বুলে !
বেঁটে লোকটা তার খরানি ছাগলটাকে গডগড করে বতুর কাছে নিয়ে গেল । ছাগলটাকে কাছে যেতেই বতুটা মুখ দিয়ে ভুড় ভুড় করে শব্দ করে শুসে এল । হাতের দড়িটা ঢিলা দিয়ে যদু বলল, “এই একটা জিনিসের লেগি কট্টা বিহি ভাঙল জানেন, সলিমভাই ?”
সলিমুদ্দি মুখে কিছু বলল না । বিড়িটায় শেষ টান দিয়ে বিড়ির পুক্টিটা ছুড়ে ফেলল । তারপর একটা কুটুমদায়েদির মতো সহানুভূতির দৃষ্টি ফেলল যদুর মুখের দিকে । যদু গলায় অশ্রু মিশিয়ে বলল, “ভেবিছুনু, ঋতুর ভালো সম্বন্ধ দেখি বিহি দিব । কিন্তু বারে বারে সেই একই ফ্যাকড়া বেন্ধি যাচ্চে ! ঘুরি ফিরি সেই প্যাটের রুজিটার ওপরই করাঘাত ! সবার এক কথা, বতু বাড়িতে থাকলে বিহি দিবে না !”
“তা ছেলির বাপ মা কে বুঝাচ্চ না ক্যানে, এই বতুই হচ্চে ই বাড়ির আসল উজগারে । ই কারবার করিই তো সংসারডা চলে । অ্যা তুলি দিয়ি কি ভিক্ষের থলে হাতে লিবো ?” সলিমুদ্দি দাঁত কটমট করে কথাগুলো বলল । তখনও তার মুখ থেকে হালকা ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে । তারপর চোখ লাল করে কন্ঠ চড়িয়ে বলল, “অ্যা কি হারামের রুজগার নাকি ? চুরি ডাকাতি করি তো ইনকাম কচ্চ না ? সৎ পথে কামাচ্চ । তা ব্যাটার বাপদের অত ব্যাগড়া ক্যানে ? এসব ফুটেনিগিরি ।“
রোদের তেজ বাড়ার সাথে সাথে কথার তেজও চড়তে লাগল চিড়বিড় করে । সলিমুদ্দির ছুড়ে দেওয়া বিড়ির পুক্টিটার আগুন তখনও নেভেনি । উত্তরে হাওয়া লেগে গনগন করে আচাচ্ছে । সূর্যটা পেয়ারাগাছের মটকায় উঠে লুকোচুরি করে টহল দিচ্ছে । বেলা হামু টানা থেকে এবার গডগড করে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে ।
“তা পাত্র কতিকার ?” জিজ্ঞেস করল সলিমুদ্দি । “নশিপুর দাসপাড়ার ।“ বলল যদু । তারপর মনে মনে বিড়বিড় করে জাবর কাটল, শালারা জাতে তো মুচি, তার আবার বতু লিয়ে ফ্যাচাং বাঁধাচ্চে ! ইরকম চশমখোর লোকদের সাথে বিহি দিয়ি কুটুম বানান্যের কুনু ইচ্ছে আমার ছিল না । যাক, বিটিটা তো পার হোক । মুনিষ টুনিষ খেটি ঠিকই দিন চলি যাবে । প্যাটের মালিক তো ভগবান । কিন্তু বতুডা যে আমার কাছে শুদুই একটা উজগারের যন্ত্র লয় ? আর পাঁচটা পশুর মুতন পশুও লয় ? বতুটা যে আমার আরও একটা ব্যাটা ! এত্ত বচ্ছর ধরি এতগুলান মানুষের প্যাটের ভাত দিয়ি যাচ্চে ! কত্ত ঝড়ঝঞ্ঝা, ওইদ-পানি মাথায় করি কাটি দিল । সংসারের এত্ত অভাব অনটনেও কুনুদিন ভুল কইরি বিক্রি করব বুলিনি ! বতুর লেগি আমি ভিটে পালঠিচি তবু বতু বেচিনি ! বিটির ফ্যারে পড়ি আমাকে সেই সংসারের সব চেহি বেশি উজগেরে বতুডাকেই বিক্রি কত্তে হচ্চে ! অ্যা দ্যাখার আগে আমার মরণ হল না ক্যানে ! দাঁত চিবোনো মনটা এবার মোমের মতো গলে ডুকরে উঠল যদুর । বতুটার দিকে কেমন একটা মায়াবি দৃষ্টিতে তাকাল । বতুহীন এই ভিটেটার শূন্য ছবিটা মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠল । মুহূর্তে ভারাক্রান্ত খাঁ খাঁ মনটা হু হু করে উঠল ! হাড় মাংস নাড়ি ভুঁড়ির ভেতরের মানুষটা গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল । কিন্তু সে কাঁদনের স্বর মুখ ফুটে বাইরে বেরিয়ে এল না । শুধু চোখের তটরেখায় সে যন্ত্রণার মিহি স্রোত আলতো করে আছড়ে পড়ল । ছলছল করে উঠল চোখের কোণাগুলো ।
“ভেবি দ্যাখো কী করবা । বিটির বাপ যেখুন হয়িচ বিটির বিহি তো দিতেই হবে । ।“ বলল সলিমুদ্দি । দায়সারা কথা বলে আপদটা যার তার কোর্টেই ঠেলে দিল ।
“কিন্তু সলিমভাই, আপনি তো ভালোভাবেই জানেন, বতুডা আমার জানের সাতে লেগি আচে । আমি কী করি জান থেকি আলাদা করব ?” ডুকরে উঠল যদু । তার ছলছল চোখের ওপর তেরছা করে পড়ল পেয়ারা পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে পড়া লাল-হলুদ রোদ ।
বতুটা সামনের পা দুটো তুলে ছাগলটার ওপর যেই চড়হা মেরেছে, অমনি কোত্থেকে হনহন করে ছুটে এসে হেমলতা কোমরে আঁচল গুঁজে বলল, “ঘোড়ামারায় একটা গাহাক পেয়িচি । যে দামই হাকুক, এবার বতুটাকে বেচি দিব । তুমার আর কুনু কথা শুনব না । ছেলির পক্ষ বুলি পাঠিচে, আসচে মাসের আট তারিখে ঋতুকে দেখতে আসবে ।"
2 মন্তব্যসমূহ
খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনমাটির গল্প। মায়ার কষ্ট মাখানো।
উত্তরমুছুন