সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প : যদি

বাইরে বাচ্চাদের গলায় চ্যাঁচামেচির আওয়াজ শুনে বেগম জাহানারা ইমাম বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বেগমের বয়েস এখন সত্তর বছর, কিন্তু মুখে এখনও তেমন বার্ধক্যের ছাপ পড়েনি, শ্বেত কমলের মতন তার গায়ের রং, তাঁর মুখে সন্ধ্যা সূর্যের লাল আভা। আজ উৎসবের দিন বলে তিনি একটি সাদা সিল্কের শাড়ি পরেছেন।

হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে। উঠোনে তার নাতি-নাতনি ও পাড়ার ছেলেমেয়েরা বাজি পোড়াচ্ছিল, তারা উঠে এসেছে বারান্দায়। উঠোনে একটা ঝুড়িতে অনেক বাজি রাখা ছিল, হঠাৎ বৃষ্টিতে সেগুলো ভিজে গেছে, সেইজন্য ছেলে-মেয়েদের ক্ষোভ। 

সবচেয়ে ছোট নাতনি মিলি এসে জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, দাদিমা, আমার রংমশাল জ্বলছে না! বৃষ্টি খুব পাজি! বিচ্ছিরি!

জাহানারা বেগম হাসলেন। বৃষ্টি দেখে তার মন প্রসন্ন হয়েছে। সারাদিন অসহ্য গরম ছিল। শবে-বরাত-এর দিন বৃষ্টি না হলেই মনে অমঙ্গলের আশঙ্কা জাগে। আজ রাতে বেহেস্ত থেকে ফেরেস্তারা নেমে আসবেন, তার আগে বৃষ্টির জলে এই পৃথিবী পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হওয়া দরকার। জাহানারা বেগমের যতদূর মনে পড়ে, প্রত্যেক শবে-বরাত এর বিকেলেই তিনি বৃষ্টি হতে দেখেছেন।

তিনি মিলির মাথার চুলে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললেন, অনেক বাজি পুড়িয়েছিস মা। এবার চল সন্দেশ খাবি। খিদে পায়নি? 

মিলি বলল, না! রেহানা তিনটে রং-মশাল জ্বেলেছে। আমি মোটে একটা!

জাহানারা বেগম তাঁর আর এক নাতিকে ডেকে বললেন, ফিরোজ, মিলিকে আর দু'একটা বাজি দে!

ফিরোজ বলল, আর নেই, দাদিমা, পয়সা দাও, দোকান থেকে কিনে আনব। . 

--এই বৃষ্টির মধ্যে কী করে দোকানে যাবি?

--ছাতা নিয়ে যাব। পয়সা দাও, দাদিমা। 

আজকের দিনে বাচ্চারা আনন্দ করবেই। বৃষ্টিতে ভিজবে, কিছুটা অনিয়ম হবে, এই বয়সে সবই মানায়। আজ কেউ কিছু চাইলে না বলা যায় না। তিনি মিলিকে জোর করে কোলে তুলে নিলেন, মিলি ছটফট করতে লাগল, সেও ফিরোজদের সঙ্গে বাজি কিনতে দোকানে যেতে চায়। জাহানারা বেগম বললেন, তুই ভেতরে গিয়ে আমার পাশে বসে বাজি পোড়াবি। ফিরোজ, তুই কামরুদ্দীনের কাছ থেকে আমার নাম করে কুড়ি টাকা চেয়ে নিয়ে যা, অনেকগুলি বাজি মিলিকে দিবি।

বাতাসে ভেসে এল মাগরেবের আজানের ধ্বনি। নতুন মুয়াজ্জিনের গলাটি অতি সুরেলা, জাহানারা বেগম একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই আজান শুনলেন। আজকের দিনটি বড় সুন্দর। 

মিলিকে নিয়ে জাহানারা বেগম উঠে এলেন দোতলায়। সাদা রঙের বেশ বড় বাড়ি। এক সময় এই অঞ্চলটি বেশ ফাঁকা ছিল, এ বাড়ির পেছন দিকেই ছিল ধান জমি, বাঁদিকে পুকুর, ডানদিকে চৌধুরীদের আমবাগান। কিন্তু ইদানীং কলকাতা শহর লকলকে জিভ বার করে চারপাশের মফঃস্বল গ্রাস করতে করতে এগিয়ে আসছে। বারাসত পর্যন্ত চলে এসেছে পাতাল রেল, চৌধুরীদের আমবাগান ধ্বংস করে সেখানে তৈরি হয়েছে টেলিফোন-এর কারখানা। অন্যপাশের পুকুরটি ভরাট করে তৈরি হচ্ছে কর্মচারীদের কোয়ার্টাস। 

পাঁচ বছর আগে জাহানারা বেগমের স্বামীর ইন্তেকাল হয়েছে। কাজী হাসান হাবিব রিটায়ার করেছিলেন বেঙ্গল পুলিশের ডি আই জি হিসেবে। তারপরেও তিনি কয়েকটি প্রাইভেট ফার্ম থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েও নেননি, সারাজীবন পুলিশের চাকরি করার পর তার খুব শখ হয়েছিল বাগান করার। বাড়ির সামনের ছোট্ট জমিটিতে নানারকম ফুলগাছ লাগিয়ে তিনি তাই নিয়েই মেতে থাকতেন, চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল তার, ভোরবেলা উঠে এক হাতে একটি শবল ও অন্য হাতে জলের বালতি নিয়ে চলে আসতেন বাগানে। একদিন সকালে তার সেই প্রিয় ফুলগাছগুলির ওপরেই তিনি হঠাৎ হার্টঅ্যাটাকে ঢলে পড়লেন।

তারপর থেকে জাহানারা বেগমই এতবড় সংসারটির হাল ধরে রেখেছেন। তার চার ছেলে আর তিন মেয়ে, সবাই এখন বিবাহিত। বড়ছেলে চাকরি করে লাহোরে, সম্প্রতি সেখানে সে একটি বাড়ি কিনেছে, তার খুব ইচ্ছে আম্মাকে সেখানে একবার নিয়ে যাওয়ার। এ বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট বেশি দূর নয়, প্লেনে দু'ঘণ্টায় লাহোরে পৌঁছানো যায়। কিন্তু জাহানারা বেগম জীবনে একবারই মাত্র প্লেনে চেপেছেন, স্বামীর সঙ্গে আজমীর শরীফ-এ তীর্থ করতে গিয়েছিলেন, সেই প্লেন-যাত্রা তার পছন্দ হয়নি, কানে খুব চাপ লেগেছিল, সেইজন্য প্লেনে চাপতে তার ইছে হয় না। লাহোরে ট্রেনে যেতে দেড়দিন লেগে যায়...আসলে এই বাড়ি, এই সংসার ফেলে জাহানারা বেগমের কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না।

মেজমেয়ে সেলিনা থাকে লন্ডনে, সেখানেই সে সিলেটের এক ডাক্তারকে বিয়ে করেছে। বাচ্চাদের নিয়ে তারা এখানে এসে পৌঁছেছে পরশুদিন। ছোটমেয়ে নীলুফার গত বছর বিধবা হবার পর দুটি বাচ্চা নিয়ে ফিরে এসেছে মায়ের কাছে। বড়মেয়ে হামিদা থাকে বেনারসে, সে এ বছর আসতে পারবে না। তার শরীর খারাপ। অন্য ছেলে ও ছেলের বউরা সবাই এসেছে, বাড়ি ভর্তি এখন অনেক লোকজন।

ছোটছেলে সিরাজ একটি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। এই ছেলেটিকে নিয়ে জাহানারা বেগমকে অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছে। সিরাজ যখন স্কুলের ছাত্র, তখনই সে একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায় হরিদ্বারে, সে নাকি একা একা হিমালয়ের কোনও চূড়ায় উঠবে ঠিক করেছিল। কলেজ জীবনে সে যোগ দেয় উগ্রপন্থী রাজনীতিতে। যার বাবা পুলিশের বড় অফিসার, সে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে বেড়ায়। কাজী হাসান হাবিব একদিন তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, জাহানারা বেগম, একদিন আমাকেই হয়তো তোমার ছেলেকে অ্যারেস্ট করে জেলে ভরতে হবে। বাবার হাতে অবশ্য গ্রেফতার হতে হয়নি সিরাজকে, কিন্তু বিহারে কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে গুণ্ডাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে তিনমাস হাসপাতালে কাটিয়ে প্রাণে বেঁচেছে। 

বিয়ের পর অনেকটা ঠাণ্ডা হয়েছে সিরাজ। এখনও সে রাজনীতি করে বটে কিন্তু একটা চাকরিও করে। তার স্ত্রী দীপা বারাসত কলেজে পড়ায়। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী আলাদা বাড়িতে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু জাহানারা বেগম এক ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ওসব চলবে না। এ বাড়িতে এত ঘর খালি পড়ে আছে, তবু তোদের অন্য বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে কেন? 

সিরাজ ও দীপার একমাত্র মেয়ে এই মিলি, ভাল নাম মিলিতা। এই নাতনিটি জাহানারা বেগমের বড় প্রিয়। অতি দুরন্ত মেয়ে, কিন্তু বকুনি খেয়ে খিলখিল করে হাসে। কয়েকদিন ধরে একটু একটু সর্দি কাশিতে ভুগছে, আজ বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাৎ অসুখে পড়বে মেয়েটা, তাই জাহানারা বেগম ওকে নিজের কাছে রাখতে চান। মিলির মা একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে ঢাকা গেছে, ফিরবে দুদিন বাদে।

নিজের ঘরে এসে জাহানারা বেগম মিলির দু'হাতে দুটো নারকোলের সন্দেশ ধরিয়ে দিলেন। মেয়েটা এমনি সন্দেশ রসগোল্লা খেতে চায় না, কিন্তু নারকোলের মিষ্টি খুব ভালবাসে।

এবারে জাহানারা বেগম একটি ছোট জলচৌকির সামনে কোরান শরীফ খুলে বসলেন। শবে-বরাতের দিনে বারবার কোরান শরীফ পাঠ করে মনটাকে শুদ্ধ রাখতে হয়। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে খুব জোরে, আজ ছেলে-মেয়েদের বাজি পোড়াবার আনন্দটাই নষ্ট।

এক পাতা পড়তেই জাহানারা বেগমের মন নিবিষ্ট হয়ে গেল। ছেলেবেলা থেকেই তিনি বাপ-দাদার মুখে কোরান শরীফ পাঠ শুনেছেন। তিনি নিজেও পড়েছেন। অধিকাংশ সুরা-ই তাঁর মুখস্থ। তবু যতবার পড়েন, ততবার ভাল লাগে।

এই কোরান শরীফটি তাঁর বাবা তাঁকে দিয়েছেন। ছাপা বই নয়, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, প্রত্যেক পাতায় সোনার জলের বর্ডার।

নারকোলের মিষ্টি দুটি শেষ করে মিলি তার পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, দাদিমা, কী পড়ছ তুমি?

জাহানারা বেগম বললেন, আমি কোরান শরীফ পড়ছি মা। তুমি ততক্ষণ একটু খেলনাপাতি নিয়ে খেলা কর, আমি আর একটু পড়ে নিই..

মিলি আদুরে সুরে বলল, ওরা এখনও বাজি নিয়ে এল না। দাদিমা, তুমি আমাকে গল্প বলো।

--আচ্ছা গল্প বলছি! চুপ করে বোস!

—ওইটা কী বই, ওতে কী রাজা-রানির গল্প আছে? 

—হ্যাঁ, তাও আছে। আমার পিঠ থেকে নেমে পাশে এসে বোস। এই তো ভাল মেয়ে! এক দেশে নোম্‌রুদ নামে এক রাজা ছিল। সেই রাজা খুব অহংকারী, সে ছিল ঈশ্বরদ্রোহী।

--ঈশ্বরদ্রোহী কী দাদিমা ?

—ঈশ্বর হলেন আল্লা, ভগবান। যে ঈশ্বরের সঙ্গে শত্রুতা করে, সে হল ঈশ্বরদ্রোহী। এই রাজা নোম্‌রুদ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে না মেনে নিজেকেই ঈশ্বর বলে ঘোষণা করেছিল। তার প্রজারা তাকেই ঈশ্বর বলে পুজো করত, কিংবা তার মূর্তি গড়িয়ে পুজো করত। সেটা খুব খারাপ কাজ।

-কেন, খারাপ কেন?

—রাজা তো আর ঈশ্বর নয়। তারপর শোন, এব্রাহিম বলে সেই রাজ্যে একজন প্রজা ছিল। সে কিন্তু রাজাকে মানেনি, সে রাজাকে পুজোও করেনি। রাজা একদিন তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন আমার পুজো কর না? এব্রাহিম বলল, আমি নিজের ঈশ্বর ছাড়া আর কারুকেই পুজো করি না। রাজা তখন খুব গর্বের সঙ্গে বলল, আমিই তো ঈশ্বর! তখন এব্রাহিম বলল...

দরজার কাছে জুতোর শব্দ হল। জাহানারা বেগম মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, তাঁর ছেলে সিরাজের সঙ্গে একটি দম্পতি এদিকেই আসছে। বই পড়তে চশমা লাগে, সেই চশমায় দূরের মানুষদের চেনা যায় না। চশমা খুলে জাহানারা বেগম চিনলেন, সিরাজের সঙ্গে এসেছে দীপার দাদা আর বউদি, জয় ও ভাস্বতী।

জাহানারা বেগম তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতেই জয়-ভাস্বতী এসে তার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন, মাসিমা?

জাহানারা বেগম দু’জনের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সিরাজ কিন্তু তার মাকে প্রণাম করল না, সে দাঁড়িয়ে রইল একটু দূরে, সে এসব আদিখ্যেতা পছন্দ করেন না। দীপার দাদা জয় একজন নামকরা নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট, গত বছর চীনের সরকার তাকে মাও জে ডং স্মৃতি পুরস্কার দিয়েছে, কিন্তু তার চালচলনে একটুও অহংকার নেই। এ বাড়িতে এলেই সে জাহানারা বেগমকে প্রণাম করে।

জাহানা বেগম নিজের হাতে তাদের মিষ্টি পরিবেশন করে বাড়ির সকলের কুশল সংবাদ নিলেন। ভাস্বতী বলল, মাসিমা, আপনি কোরান পড়ছিলেন? ইস, আমরা এসে আপনাকে ডিস্টার্ব করলুম। এই চল, আমরা অন্য ঘরে গিয়ে বসি।

জয় বলল, মাসিমা, আপনি তো জানেনই, প্রতি বছর এই সময় আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়। অনেক কালের পারিবারিক ব্যাপার, চলে আসছে। দীপা তো এখানে নেই, মিলিকে আর অন্যান্য বাচ্চাদের, মানে, মা আপনাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করেছেন, কিন্তু আপনাকে তো আর যেতে বলতে পারি না...

জাহানারা বেগম বললেন, তোমরা কিন্তু রাত্তিরে খেয়ে যাবে। শবে-বরাতের দিন অতিথিদের না খেয়ে যেতে নেই।

জয় বলল, খেয়ে যাব তো নিশ্চয়ই, একতলায় যা সুন্দর মাংস রান্নার গন্ধ পেলাম।

ভাস্বতী বলল, আপনাদের বাড়িতে চালের গুড়ো দিয়ে যা চমৎকার রুটি হয়... সিরাজ মেয়েকে ডেকে বলল, এই মিলি, আয়, আমাদের ঘরে আয়। 

মিলি বলল, আমি এখন যাব না। দাদিমা আমাকে বই পড়ে গল্প বলছে। 

ওরা চেলে যেতে না যেতেই মিলি জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল? 

নাতনির উৎসাহ দেখে খুশি হয়ে জাহানারা বেগম আবার গল্প শুরু করলেন।

--হ্যাঁ, কতদূর যেন বলেছি? নোম্‌রুদ রাজা আর এব্রাহিম। নোম্‌রুদ রাজার সেই অহংকারের কথা শুনে এব্রাহিম বলল, আমি কোনও রাজাকে ঈশ্বর বলি না। তিনিই ঈশ্বর, যিনি মানুষের প্রাণ দিতে পারেন আর প্রাণ নিতে পারেন! রাজা বলল, এ তো আমিও পারি। দেখবে? তিনি কয়েদখানা থেকে দু’জন বন্দিকে আনালেন। তাদের একজনের পরদিনই ফাঁসি হবার কথা। রাজা তাকে মুক্তি দিয়ে দিল, আর এব্রাহিমকে বলল, দেখলে, আমি প্রাণ দিতে পারি? আর অন্য যে বন্দিটির পরের দিনই মুক্তি পাবার কথা, এক কোপে তার মুণ্ডু কেটে নিয়ে বলল, দেখলে, আমি প্রাণ নিতেও পারি।

--তখন ওই প্রজাটা কী বলল? 

--এব্রাহিম এবার আসল কথাটা বলল, সে বললে রাজা আমার ঈশ্বর প্রত্যেকদিন সূর্যকে আকাশের পূর্ব দিক থেকে নিয়ে আসেন। তুমি কি সকালবেলা সূর্যকে পশ্চিম দিক থেকে আনতে পারবে? সেই কথায় রাজা হেরে গিয়ে মুখ নিচু করল। বুঝলি মা, আল্লার শক্তিকে যারা প্রশ্ন করে... 

আবার দরজার কাছে জুতোর শব্দ। দীপার দাদা ও বউদিকে নিজের ঘরে বসিয়ে একা ফিরে এসেছে সিরাজ। প্যান্টের ওপর টি-শার্ট পরা, সুপুরুষ দীর্ঘদেহী সিরাজের মুখখানা এখন দারুণ গম্ভীর

ঘরের মধ্যে এসে সে হুকুমের সুরে বলল, মিলি, তোর মামাবাবু তোকে ডাকছে, একবার শুনে আয়।

গল্প শোনা শেষ হয়ে গেছে, তাছাড়া বাবার এই ধরনের গলার আওয়াজ শুনে সে ভয় পায়, মিলি তাই দৌঁড়ে চলে গেল। ময়ের একেবারে মুখখামুখি দাঁড়িয়ে সিরাজ কঠিন গলায় বললো, আম্মা, তুমি মিলিকে কোরান শরীফ পাঠ করাচ্ছিলে?

জাহানারা বেগম বেশ অবাক হয়ে বললেন, না তো। মিলির বাজি বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে, নানারকম আবদার করছিল, তাই আমি ওকে গল্প শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখছিলাম। কেন, কী হয়েছে?

মাকে প্রায় ধমক দেবার ভঙ্গিতে সিরাজ বলল, কী হয়েছে মানে? দীপার দাদাবউদি এসে দেখে গেল, তুমি মিলিকে কোরান শরীফ শেখাচ্ছ। দীপা বাড়ি নেই, সেই সুযোগে তুমি ওকে ইসলামি শিক্ষা দিচ্ছো! ছি ছি ছি আম্মা, তোমাকে আমি কতবার বলেছি, এসব চলবে না।

জাহানারা বেগম এবারও খানিকটা সরল বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, তুই কি বলছিস সিজু? মিলি তো এ বাড়িরই মেয়ে, বাপ-দাদার ধর্মকথা একটু আধটু জানবে না? ও নিজেই আমাকে গল্প বলতে বলছিল। 

--আম্মা, দীপার সঙ্গে আমার বিয়েতে প্রথম শর্তই ছিল, কেউ কারুর ধর্ম বিশ্বাস পরস্পরের ওপর চাপিয়ে দেব না। দীপাকে বিয়ে করে আমি যেমন হিন্দু হইনি, তেমনি দীপাও মুসলমান হবে না। আর ছেলেমেয়েরাও সাবালক না হওয়া পর্যন্ত... 

—আমি কি দীপাকে কখনও মুসলমান হবার জন্য জোর করেছি?

--দীপাকে করনি, কিন্তু মিলিকে তুমি...আম্মা, কেন তুমি মনে রাখতে পার না যে ধর্মান্তর করা এখন সারা দেশে বে-আইনি?

—পাগলের মতন চঁচামেচি করছিস কেন, সিজু? আমি তোকিছুই করিনি।

—আলবাৎ করেছ। তুমি চুপিচুপি ওই টুকু মেয়েকে কোরান মুখস্ত করাচ্ছো। ওই যে, ওই যে তুমি দেওয়ালে জিন্নার ছবি টাঙিয়ে রেখেছো...সাতচল্লিশ সালের পনেরই অগাস্ট জিন্না যখন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন, সেদিন তিনি কী বলেছিলেন মনে নেই, তোমার? লালকেল্লায় পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন জিন্না আর গান্ধী, একটু দুরে জওহরলাল, মৌলানা আজাদ আর অন্যরা, গান্ধী যখন জিন্নাকে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করলেন, তখন জিন্না সাহেব কী অপূর্ব ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজ থেকে হিন্দু শুধু হিন্দু নয়, মুসলমান শুধু মুসলমান নয়, সবাই স্বাধীন ভারতের সমান অধিকার সম্পন্ন নাগরিক। এখন থেকে যে-যার নিজস্ব ধর্মমত, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান শুধু পালন করবে নিজের নিজের বাড়িতে, যদি কেউ অনন্যর ধর্মে হস্তক্ষেপ করে...

সিরাজের কথার মধ্যে একটা বক্তৃতার তোড় এসে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে এবারে জাহানারা বেগম কঠোরভাবে বললেন, তুই চুপ করত। খুব সবজান্তা হয়ে গেছিস, তাই না? মাঠে ময়দানে চ্যাঁচামেচি করে তুই ভেবেছিস এসব কথা আমাকেও শোনাবি? দীপা বউমাকে আমি কোনওদিন কোনও ব্যাপারে জোর করেছি? এ বাড়িতে থেকেও সে যদি হিন্দু মতে পুজো আচ্চা করতে চাইত... 

--দীপা কোনওরকম পুজো টুজোয় বিশ্বাস করে না, তা তুমি ভালই জানো।

--না করলেও, দীপাদের বাড়িতে লক্ষ্মী ঠাকুর, সরস্বতী ঠাকুরের পুজো হয়, সেইসব ঠাকুর দেবতা বিষয়ে কী সে জানে না? সে কি মেয়েকে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প শোনায় না। আমিও তো রামায়ণ, মহাভারতের গল্প জানি। তা হলে মিলিই বা কেন কোরান শরীফের গল্প, বিষাদ সিন্ধুর গল্প জানবে না? ধর্ম বদল না করেও বুঝি অন্য ধর্মের কথা জানতে নেই! সিজু, হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে তুই কি শেষ পর্যন্ত জরুর গোলাম হয়ে গেলি?

—আম্মা, আম্মা, তুমি আমাকে এমন কথা বলতে পারলে?

জাহানারা বেগমেরও হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল। তিনি সিরাজের বিহবল মুখ দেখে এবার থমকে গেলেন। না, সিরাজ সম্পর্কে এ কথা খাটে না। দীপাকে বিয়ে করলেও সিরাজ তার শ্বশুরবাড়িতে প্রায় যেতেই চায় না। সে একেবারেই হিন্দু ঘেঁষা হয়নি। ছাত্র বয়েস থেকেই এ ছেলেটা নাস্তিক, সে রোজা রাখে না, নামাজ পড়ে না, আবার দীপাদের বাড়ির পুজো টুজোতেও কক্ষণো যায় না। 

উঠে এসে ছেলের মাথায় হাত রেখে জাহানারা বেগম বললেন, কেন মাথা গরম করছিস, সিজু? শবে-বরাতের দিনে এমন করতে নেই। তোর মেয়েকে আমি রাজ-রাজড়ার গল্প শোনাচ্ছিলুম শুধু। 

—জয় আর ভাস্বতী দেখে গেল, তুমি মিলিকে কোরান শরীফ পড়তে শেখাচ্ছো। 

—ওরা বলেছে সে কথা? 

--না, বলেনি। কিন্তু ওরা নিজের চোখে তো দেখল!

-দেখলেই বা, মিলি যদি কোরান শরীফ পড়তে শেখে, তার মধ্যেই বা দোষের কী আছে? সবই পড়ুক, শিখুক, জানুক।

--আম্মা, তুমি ওদের আজ শবেবরাতের জন্য দাওয়াত করলে। ওরা খেয়ে যেতে রাজিও হয়েছে। আজ বাড়িতে রান্না হয়েছে বড় গোস্ত, ওরা খাবেও ঠিক। কিন্তু তুমি কি ওদের বাড়িতে গিয়ে কোনওদিন লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদ খেতে পারবে। যেখানে মূর্তি পুজো হয়, সেখানে তুমি কোনওদিন ভুলেও পা দেবে না। তবে কেন তুমি আমাদের বাড়ির ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দোহাই দিয়ে ওদের খেয়ে যেতে বললে? 

--বলাটা কি আমার ভুল হয়েছে? আজকের দিনে অতিথিকে না খাইয়ে ছাড়তে নেই। 

—ওরাও ওদের পুজোর দিনে হয়তো সেরকমই বিশ্বাস করে।

--ঠিক আছে, তুই জয় আর ভাস্বতীকে বলে দে, ওদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর দিন আমি যাব। দীপা এখানে নেই, মিলিকে আমিই সঙ্গে নিয়ে যাব। 

লক্ষ্মীপুজো ঠিক ন’দিন পর। বাড়ির সাতটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে নিয়ে রওনা হলেন জাহানারা বেগম। অনেকদিন পর তিনি বাড়ি থেকে বেরুচ্ছেন। বেশি দূর অবশ্য যেতে হবে না। দীপার বাপের বাড়ি যশোরের সাতক্ষিরা শহরে। সিরাজুল একটা স্টেশন ওয়াগন জোগাড় করে এনেছে, বারাসত থেকে সাতক্ষিরা মাত্র ঘণ্টা দু'একের পথ। 

মাঝখানে পড়ে ইছামতী নদী। সদ্য সেখানে একটি অত্যাধুনিক সেতু তৈরি হয়েছে। সেতুটির দুপাশে ঝুলছে সারি সারি দেশি-বিদেশি ক্যাকটাসের টব, মাঝখানে রয়েছে পথচারীদের জন্য কমনভেয়ার বেল্ট। উনিশ শো সাতান্ন সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হবার পরেও অনেক বছর সেটা অসমাপ্ত হয়ে পড়েছিল। তার কারণ আছে। চীন এবং ভারত দু'ধরনের সমাজতন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা করছে বলে এই দুই দেশের রেষারেষি চলছিল বেশ কয়েক বছর। প্রতিবেশী দুই বিশাল দেশ, প্রায় সমান সমান জনসংখ্যা, এই দুই দেশের রেষারেষিতে ইন্ধন জুগিয়েছে পৃথিবীর অন্য দু'একটি বিরাট শক্তি। এর মধ্যে একবার ভারত-চীন যুদ্ধও হয়ে গেছে। মাত্র চার বছর আগে এই দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা কাশ্মীরে এক আলোচনা সভায় এমন এক সিদ্ধান্তে এসেছেন, যা শিশুরাও বোঝে। এই দুটো দেশ যদি আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য একটা সন্ধি চুক্তি করে, সীমান্ত থেকে সমস্ত সৈন্য সরিয়ে নেয়, তা হলে প্রতিরক্ষা বাজেটে হাজার হাজার কোটি টাকা বেঁচে যায়। চীন আর ভারত যদি সমান তালে পাশাপাশি পা ফেলে চলে, তা হলে রাশিয়া-আমেরিকাও ভয়ে কাঁপবে।

সেই সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতে শুরু হয়েছে রাস্তা বানানো ও সেতু নির্মাণের ব্যাপক তোড়জোড়। কলকাতার কাছে গঙ্গার ওপর এখন তিনটে ব্রিজ, সিন্ধুব্রহ্মপুত্রের ওপর প্রতি কুড়ি মাইল অন্তর ব্রিজ, তৈরি হয়েছে বম্বে করাচি সুপার হাইওয়ে, এদিকে কলকাতা থেকে ঢাকা পৌঁছতে গাড়িতে লাগে মাত্র চার ঘণ্টা!

ইচ্ছামতী সেতুর ওপর দিয়ে যখন স্টেশান ওয়াগনটা চলছে, তখন ফজল বলল, দাদিমা, দ্যাখো, দ্যাখো, এখানে মানুষজন হাঁটছে না, রাস্তাটাই চলছে!

জাহানারা বেগমও এই চলন্ত রাস্তা দেখে অবাক হয়েছেন। এই সত্তর বছরের জীবনে তিনি কত পরিবর্তনই তো দেখলেন। তার নিজের বড় ভাই ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে। সেই সময় তারা ভেবেছিলেন ভারত ভাগ হবেই। কলকাতায় কিংবা বারাসতে আর থাকা যাবে না। চলে যেতে হবে কোথায়! স্ট্যাফোর্ড ক্রিস কমিশন ব্যর্থ হল। তারপর মাউন্টব্যাটন এল...জাহানারা বেগম তখন একান্নবর্তী পরিবারের গৃহবধু হলেও লেখাপড়া জানতেন, খবরের কাগজ পড়তেন, একদিকে কংগ্রেস হিন্দু মহাসভা, অন্যদিকে মুসলিম লীগের আস্ফালন দেখে তার রক্ত গরম হতো, হিন্দুদের তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন, হঠাৎ গান্ধী-জিন্নার সমঝোতা হয়ে গেল, দু'জনে এক যোগে ঘোষণা করলেন, ব্রিটিশের ফোঁপর দালালি মানব না, দেশ বিভাগ হতে দেব না...প্রথম কয়েকটা বছর কিছু দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়েছিল বটে, কিন্তু আস্তে আস্তে তা থেমে গেল, গান্ধীজিন্না, একসঙ্গে শপথ করেছিলেন যে কোনও রাজনৈতিক বক্তৃতায় কিংবা ভোটর সময় কেউ গুণাক্ষরেও ধর্মের কথা উচ্চারণ করতে পারবে না, সংবিধানেও সেই ধারা যুক্ত হয়েছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে, মন্দির, মসজিদ, গীর্জাগুলো খালি পড়ে থাকে, বিশেষ কেউ যায় না, সরকার থেকে বলা হচ্ছে, ওগুলোকে ন্যাশনাল মনুমেন্ট হিসেবে ডিক্লেয়ার করা হবে...

জাহানারা বেগম একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন, ফজলের কথা শুনে বললেন, তোরা তোদের জীবনে আরও কত কী দেখবি। এখন তো দেখছিস মানুষ থেমে আছে রাস্তা চলছে, একদিন হয়তো দেখবি, মানুষ আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জাদু কার্পেটে, আরব্য উপন্যাসে যেমন ছিল... 

একটু পরে তিনি আবার বললেন, ওরে ছেলেমেয়েরা, শোন। আমরা তো মিলির মামাবাড়িতে যাচ্ছি লক্ষ্মীপুজোর দাওয়াত খেতে। লক্ষ্মীপুজোটা কী জানিস তো? ও মিলি, তুই একটু বলে দে না, মা! মিলি তার কোলের কাছে মাথা রেখে বলল, তুমি গল্প বলল, দাদিমা! 

অগত্যা জাহানারা বেগমই শুরু করলেন। তিনি বললেন, হিন্দু ধর্মে শিবঠাকুর নামে একজন দেবতা আছেন। তার চার ছেলেমেয়ে। গণেশ-কার্তিক আর লক্ষ্মীসরস্বতী!

ফজল বলল, ও দাদিমা, একটা শুঁড়ওয়ালা হাতির মতন লোককে হিন্দুরা বলে গণেশ ভগবান, তাই না? হি-হি-হি! 

জাহানারা বেগম চোখ গরম করে বললেন, ফজল চুপ কর, বোকার মতন কথা বলিস না। কুটুমবাড়িতে গিয়ে বেয়াদপি করবি না! 

সিরাজ বসে আছে ড্রাইভারের পাশে। সে সব শুনছে ও মজা পাচ্ছে। ফজলের কথায় সে দোষের কিছু পেল না। প্রকৃত ধর্মীয় স্বাধীনতা তখনই আসবে, যখন এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মেরও খোলাখুলি সমালোচনা করতে পারবে! একটা শুঁড়ওয়ালা দেবতা সম্পর্কে যদি ফজলের হাসি পায়, তা হলে জোর করে তার হাসি থামিয়ে দেবার তো কোনও কারণ নেই। যেমন শবে-বরাতের সেই গল্প শোনার পর রাত্তিরবেলা বাবার কাছে শুয়ে মিলি জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা, একটা দুষ্ট রাজা যখন একটা লোকের মাথা কেটে ফেলল, তখন ভগবান কেন তাকে বাঁচিয়ে দিল না? সিরাজ বলেছিল, মানুষ যখন মানুষকে মারে, তখন তাতে বাধা দেবার ক্ষমতা ভগবান বা আল্লার নেই রে, মামণি। মানুষকেই শিখতে হবে যে অন্য মানুষদের এমনভাবে বিনা দোষে মারতে নেই।

সিরাজ ভাবল, দীপার বাড়িতে গিয়ে ফজল বা অন্য বাচ্চারা যদি লক্ষ্মীপুজোর ধুমধাড়াক্কা দেখে হাসি ঠাট্টা করে, তাতে বেশ একটা মজাই হবে। দেখাই যাক, তাতে ওদের কী প্রতিক্রিয়া হয়। যদি ওরা রেগে যায় বা বিরক্ত হয়, তা হলে সিরাজ নিজেই বলবে, আপনারা মুসলমানবাড়ির ছেলেমেয়েদের নেমন্তন্ন করেছিলেন কেন? কে আপনাদের মাথার দিব্যি দিয়েছিল? দীপা তো কখনও এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।

ঢাকায় সেমিনার শেষ করে দীপা সোজা চলে আসবে সাতক্ষিরা, সে কথা জাহানারা বেগম এখনও জানেন না। শাশুড়ি আসছেন শুনে দীপা রাঙামাটি, কক্সবাজার ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসছে।

সাতক্ষিরায় দীপাদের বাপের বাড়িটি বেশ কয়েক পুরুষের পুরনো। বাড়ি তো নয়, প্রায় প্রাসাদ। সামনের নহবত খানায় সানাই বাজছে।

জাহানারা বেগমের বুকটা ঢিপঢিপ করছে। মূর্তি পূজা তিনি মনে প্রাণে অপছন্দ করেন। ছেলের কথার পিঠে কথা রাখতে গিয়ে তিনি এখানে আসতে রাজি হয়েছেন। খুব অল্প বয়েসে তিনি হিন্দু পাড়ার পুজো-টুজো দেখেছেন বটে, স্কুলের হিন্দু মেয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প শুনেছেন, কিন্তু সতেরো বছর বয়েসে জ্ঞান হবার পর আর কখনও যাননি। এদের নিয়ম কানুন কীরকম কে জানে! একটা মাটির প্রতিমার সামনে প্রণাম করতে হবে। মরে গেলেও তিনি তা পারবেন না। এই বয়সে তিনি তার বিশ্বাসকে বলি দিতে পারবেন না।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই জয় এগিয়ে এসে বলল, আসুন, আসুন মাসিমা আপনি আসবেন শুনে এমন অবাক হয়েছি।

সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় জয়, তখন সে সাহেবি পোশাক পরে, আজ সে পরে আছে কুঁচোনো ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি, কপালে চন্দনের ফোঁটা। এতবড় বৈজ্ঞানিক সে, কিন্তু পারিবারিক প্রথা ঠিক ঠিক মেনে চলে। সিরাজের মতন তিরিক্ষি স্বভাবের নয়।

সাদা শাড়ির আঁচলটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে, বাচ্চাদের নিয়ে তিনি পায়ে পায়ে এগোলেন। হিন্দুদের পুজোর একটা মণ্ডপ থাকে। সেখানে মাটির ঠাকুর থাকে। কোথায় সে মণ্ডপ?

জাহানারা বেগমের মুখের দিকে চেয়ে, যেন তার চোখের ভাষা বুঝেই জয় বলল, মাসিমা এ বছর আমরা ঠাকুর আনিনি। আমরা ভাইরা সব বাইরে থাকি, বাড়িতে আসার সময় পাই না, সামনের বছর থেকে আর পুজো হবে কি না ঠিক নেই। এ বছর তাই শুধু ঘট পুজো করে কোনওরকমে নমো নমো করে সারা হয়েছে।

কথা নেই বার্তা নেই, জাহানারা বেগম প্রথমে বসে পড়লেন সেখানে, তারপর শুয়ে পড়লেন মাটিতে। পর মুহূর্তেই অজ্ঞান। হঠাৎ ইসকিমিয়ার ব্যথা মাথা চাড়া দিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বিরাট চ্যাঁচামেচি, হইচই, ডাক্তার ডাকার আবেদন। জাহানারা বেগমকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হল ভেতরের ঘরে। সিরাজই ব্যস্ত হয়ে পড়ল বেশি। তার শ্বশুরবাড়িতে তার মা কোনওদিন আসেন না। আজই প্রথম এলেন, তাও একটা উৎসবের দিনে, আজই যদি তার একটা ভালমন্দ ঘটে যায়....

জাহানারা বেগমের জ্ঞান ফিরল আধ ঘন্টার মধ্যেই। তিনি লজ্জায় প্রায় অবশ হয়ে গেলেন। কুটুম বাড়িতে এসে...উৎসবের বাড়ি...ইসকিমিয়ার ব্যথা ওঠার আর কি সময় হল না? তার জন্য যদি উৎসব পণ্ড হয়ে যায়, ছি ছি ছি, এরকম নাটকীয় ঘটনা কোনওদিন তাঁর জীবনে ঘটেনি....

ভাল করে চোখ মেলার পর তিনি দেখতে পেলেন তার কনিষ্ঠ পুত্রবধু দীপাকে। একটা লাল পাড় সিল্কের শাড়ি পরা, মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, কপালে একটা টিপ...। জাহানারা বেগমের মনে পড়ল, ছেলেবেলায় তিনি হিন্দু পাড়ায় গিয়ে লক্ষ্মীসরস্বতীর মূর্তি দেখেছিলেন, বাঙালি মেয়েদেরই মতন গড়ন, জরিপাড় শাড়ি পরানো, মাথার চুল দীপার মতন, অর্ধেকটা ঘোমটা টানা, ঠাকুর দেবতার মতন নয়, ঠিক বাঙালি মেয়েদের মতনই দেখতে, বেশ লাগত কিন্তু...

দীপা ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, এখন কী রকম ফিল করছেন, মা? কষ্ট হচ্ছে? জাহানারা বেগম দুদিকে মাথা নাড়লেন।

দীপা তাঁর পায়ের তলা ঘষতে বলল, আপনার কিছু হয়নি, ভয় পাবেন না, ডাক্তার এসে দেখে গেছে।

জাহানারা বেগম ফিসফিস করে বললেন, মিলি কোথায়? 

দীপা বলল, মিলি এতক্ষণ আপনারা মাথার কাছে বসেছিল। এইমাত্র উঠে গেল। ডাকছি, মিলিকে ডাকছি। মা আপনি কিছু খাবেন? একটু গরম দুধ এনে দেব? দুধ খেলে ভাল লাগবে। 

জাহানারা বেগম আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। এটা কার বিছানা কে জানে! তিনি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন দীপার মুখের দিকে। তার ঠোঁটে একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠল। তিনি প্রায় ফিসফিস করে, লাজুক গলায় বললেন, তোমাদের পুজো ঠিকঠাক শেষ হয়েছে তো? আতপ চাল, কলা আর বাতাসা দিয়ে তোমাদের একটা পুজোর প্রসাদ হয় না? ছেলেবেলায় খেয়েছি, খুব ভাল লাগত, সেই প্রসাদ একটু এনে দিতে পার? 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ