ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়'র গল্প : রক্তপলাশ

মাছের চপ ভাজতে ভাজতেই মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে বাইরে চোখ চলে যাচ্ছিল সাহানার। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। বড় একটা চাঁদ উঠবে একটু পরেই। কাল পূর্ণিমা। দোলপূর্ণিমা। বছরের এ সময়টা মনটা কেমন উচাটন হয়ে থাকে সাহানার।

পাশেই এ বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট একটা বাড়ি। মাঝখানের কিছুটা অংশ ভাঙাচোরা ছোট পাঁচিল দিয়ে আলাদা করা। দুই বাড়ির পিছনেই এক চিলতে জমি, উঠোন বলা যেতে পারে। তবে সেখানে কোনও ভাগাভাগি নেই। এ বাড়ির উঠোন থেকে চাইলে স্বচ্ছন্দ ও বাড়ির উঠোনে চলে যাওয়া যায়। সাহানার দিকের অংশটার এক কোণে সে দড়ি টাঙিয়ে কাপড় শুকোনোর ব্যবস্থা করেছে। পাতিলেবু, কাচালঙ্কা বেলফুলের গাছ লাগিয়েছে। একপাশে একটা কাঁঠালিচাঁপার গাছ আগে থেকেই ছিল। সেটারও একটু যত্নআত্মি করে সাহানা। দুই বাড়িতেই দুঘর ভাড়াটে। এ বাড়িতে সাহানারা দুটি মানুষ। ও বাড়িতে আবির একাই। আবির নয়, সুহাস। 

ভাজা চপগুলো প্লেটে সাজিয়ে সালাড এবং সস সহযোগে বাইরের ঘরে দিয়ে এল সাহানা। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা একটা খেঁকুরে চেহারার লোকের সঙ্গে কথা বলছে সমীরণ। এ লোকটাকে ক’দিন ঘোরাফেরা করতে দেখছে সাহানা। মাছের চপ দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে যখন, এর থেকে মালকড়ি কিছু আশা করছে সমীরণ। নইলে তার মত মানুষের হাত থেকে মাছের চপ গলবে না কিছুতেই। যদিও তেমন দামি মাছ কিছু নয়। ভেটকির বদলে আজকাল বাচা মাছ। সেও এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে কিছু কম কথা নয়। 

তবু ভাল, সাহানাকে সেজেগুজে যেতে হচ্ছে না সামনে। তেমন তেমন মক্কেল হলে আগে থেকে বলে রাখে সমীরন। একটু সেজেগুজে, সামনে বসবে সাহানা। সমীরণ আলাপ করিয়ে দেবে, একটু হাসিমুখে গল্পগাছা করবে, এই আর কি। সাহানা আপত্তি করত প্রথম দিকে। অচেনা অজানা লোকেদের সঙ্গে সে অত গল্পটল্প করতে পারবে না। সমীরন বিরক্ত হয়ে বলেছিল, 

- তুমি মাইরি বহুত ইয়ে আছ! বাড়িতে লোকজন এলে তাদের সঙ্গে দু’চার কথা বলতে হয় বৈকি! এ তো সামান্য ভদ্রতা। 

- ভদ্রতাই যদি হত, তবে তো সবার সঙ্গেই করতে হত। বেছে বেছে দু’চারজনের সঙ্গে এ কিরকম ভদ্রতা! তাছাড়া, তোমার সঙ্গে তাদের কাজের সম্পর্ক। একটু চা’টা করে দিচ্ছি এই পর্যন্ত। তাদের সঙ্গে গল্প করতে যাব কোন সুবাদে? 

- বুঝছ না কেন? কেউ কেউ একটু হোমলি অ্যাটমোসফিয়ার পছন্দ করে। তাদের খুশি করতে...! মক্কেল তো আফটার অল! তোমার স্বামির জন্য তুমি এটুকুও পারবে না? 

ছোটখাটো দালালির কাজ করে সমীরণ। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট এইসব। আরও হয়ত কিছু কিছু ধান্দা আছে, সে সব খবর অত রাখে না সাহানা। মোটের ওপর চলে যায় তাদের। ছোট্ট ভাড়া বাড়ি তাদের এই শহরতলিতে। খেটে মরে রাতদিন, কিন্তু জাগতিক সুখ-সুবিধার ব্যাপারে বিশেষ কিছু করতে পারেনি এখনও। 

মাছের চপ, জলের গ্লাস, জাগ, সব দিয়ে এসেছে বাইরের ঘরের টেবিলে। ছোট একটা পাঁইট রাখা ছিল টেবিলের ওপর। তার মানে এখন আর অনেকক্ষণ ডাক পড়বেনা সাহানার। রান্নাঘরটা গোছাতে এসে জানলা দিয়ে পাশের বাড়িটার দিকে তাকাল সাহানা। এদিকের জানলাটা খোলা। পর্দা ফেলা। বাড়ির মানুষটি বাড়িতেই আছে তার মানে। মুখেচোখে জল দিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিল সাহানা। আঁচলটা গুছিয়ে উঠোনে নেমে এল। এখন যে কোনও সময় আবির এসে দাঁড়াবে ওই বাড়ির বারান্দায়। আবির নয়, সুহাস। 

সন্ধ্যে হয়ে গেছে। চাঁদ উঠেছে। প্রাক-পূর্ণিমার গরবিনী চাঁদ। সেবার, একমুঠো পলাশ কোথা থেকে জানি কুড়িয়ে এনেছিল আবির। বলেছিল, তোর জন্যেও পারবনা ফাগ, গাছের ডাল ভেঙে ফুল নিয়ে আসতে! সাহানাকে ‘ফাগ’ বলে ডাকত আবির! ছোট থেকে একসাথে খেলাধুলো করে বড় হতে হতে বহতা নদীর মত কুল ভাসানো কৈশোরে দুজনেই দুজনকে বিশেষ চোখে দেখতে শুরু করেছিল। ছোটতেই বাপ-মা মরা সাহানা কাকার আশ্রয়ে বড় হচ্ছিল। একই পাড়ায় বসবাস হলেও আবিরদের পরিবারের সঙ্গে তাদের আর্থিক, সামাজিক ব্যাবধান বড় কম ছিল না । তবে, তুমুল কৈশোর আর কবেই বা সে ব্যাবধানকে মান্যতা দিয়েছে! সময় যে কোন জাদুদণ্ড বুলিয়ে গিয়েছিল চোখে! 

সেসব কথা মনে পড়লেই বুকের ডান দিকের ওই বিশেষ জায়গাটা চিনচিন করে ওঠে সাহানার। ডান স্তনবৃন্তের নিচেই যে ঢালু জ্যোৎস্নারঙা জমি নেমে গেছে খাদের দিকে, সেইখানে চেরি রঙের ছোট মটরদানার মত যে একটা আঁচিল আছে, তা অনেকদিন পর্যন্ত নিজের কাছেই অজানা ছিল সাহানার। তাদের বাড়ির টালির ছাদওয়ালা বাথরুমে কোনও আয়না ছিল না। কাকিমনির ঘরের দেওয়ালে বড় আয়নায় প্রসাধন সেরে নিত বটে, তবে নিজের অনাবৃত প্রতিচ্ছবি দেখার সুযোগ হয়নি কখনো। কাকিমনি বাপের বাড়ি গেলে দুপুরগুলো কখনো কখনো রূপকথা হয়ে উঠত। তেমনই একদিন ওই আঁচিলটা হঠাৎ খুঁজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল আবির। নিজেকে কলম্বাস, ভাস্কো-ডা-গামা কিছু বলতে বাকি রাখেনি। আদর করে নাম দিয়েছিল, রক্তপলাশ। সেই রক্তপলাশকে বুকের গভীরে লুকিয়েই রেখে দিয়েছে সাহানা। এমনকি সমীরণকেও টের পেতে দেয় নি। তাদের নিভৃত ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে আলো নিভিয়ে রাখে সাহানা। ইদানীং সেই রক্তপলাশ যেন আকারে সামান্য বড় হয়েছে। ফুল্লকুসুমিত। 

কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ ছাপিয়ে তামাকপোড়ার কটু গন্ধ নাকে এসে লাগতেই সচেতন হল সাহানা। সুহাস এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। হাঁফ ছাড়তে সাহানা বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে উঠোনে নেমে এলেই বারান্দায় এসে সিগারেট খাওয়ার দরকার হয় তারও। কখনো দু’একটা বাক্য বিনিময়, কখনো তাও না। 

সিগারেট ঠোঁটে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে সুহাস বলল, 

- বছরের এ সময়টা একটু ভোরের দিকে মিল্কি ওয়েকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, দেখেছেন কখনো? 

সাহানা দেখে আবির তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে। মনে মনে আকুল হয়ে ডাকে, আবির! আবির! চিনতে পারছ না আমাকে? তোমার সেই রক্তপলাশ? মনে আছে তাকে? 

উত্তর না পেয়ে সুহাস আর একটু সরে আসে তার বারান্দার রেলিং ঘেসে। 

- আপনার খুব খাটনি হয় সারাদিন, না বউদি? 

বউদি বোলো না আমাকে। ফাগ বল, ফাগ। সব ভুলে গেছ, আবির? 

এ যেন নিজের সঙ্গে নিজেরই একটা খেলা। সুহাসকে আবির ভেবে মনে মনে অনেক কথা বলে চলা। আবির! আবির! তুমি কি বিশ্বাস করেছিলে ওসব কথা? আমাকে কি একবারও জিগ্যেস করতে পারতে না? তোমার চোখে ঘৃণা দেখেছি যে আবির! প্রেম না দেখে যে আমি মরতেও পারব না! 

তার কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে সুহাস মুখ ফিরিয়ে নেয়। আবার সেই আকাশের দিকে চোখ। কি জানি কি ভাবল ছেলেটা। সাহানা এগিয়ে যায় একটু, 

- কি দেখছ আজ আকাশে? 

- এমনিই। আজ মঙ্গলকে খুঁজছিলাম, বোধহয় আর একটু পরে দেখা যাবে। 

- মঙ্গল? 

- মঙ্গলগ্রহ। মার্স। এই সময়টা মঙ্গল পৃথিবীর অনেক কাছে। খুব উজ্বল লাল রঙের গ্রহ। এখন তো খালি চোখেও দেখা যাচ্ছে। দেখেননি? 

আবিরের জিজ্ঞাসু চোখে কি অর্থহীন প্রশ্ন! আমি তোমাকে দেখছি আবির! রোজ দেখছি! সাহানার বুকের ডানদিকের লাল মটরদানাটা আবার চিনচিন করে উঠল। 

- তুমি পলাশ দেখেছ, সুহাস, এবছর? 

- পলাশ? 

- রক্তপলাশ? এখনি তো পলাশ ফোটার সময়। কাছাকাছি কোথাও আছে কি না জান? আমি তো দেখিনি। 

- কি জানি! আপনার চাই? খুঁজে দেখব তবে। 

চাই, আবির, চাই! সেই সঙ্গে তোমাকেও চাই। একবার, আর একবার! আমার সত্যি কোনও দোষ ছিল না জানো! কাকু আর কাকিমনি যে আমাদের লক্ষ্য রাখছে, এরকম ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র করেছে, আমি একটুও টের পাই নি। অথচ তুমি ভেবেছিলে, তোমাকে বোঝানো হয়েছিল, আমি সব জেনেশুনেই... 

সেদিনও কাকা, কাকিমনি দুজনের কেউই বাড়িতে ছিল না। তাদের ফেরার কথা ছিল বিকেলে। খুড়তুতো ভাইবোনেরা তখন স্কুলে। সাহানার কলেজ কি কারণে যেন ছুটি ছিল। ছাদের ঘরে কখন যে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়ে গেছে টের পায়নি দুজনের কেউই। ঘোর ভেঙেছিল কাকার সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বরে, 

- বিমলবাবু, আসুন, দেখুন আপনার কীর্তিমান ছেলের কাণ্ড! আপনারা বড় মানুষ, সমাজের মাথা। আমরা ছোটখাটো মানুষ। তবে এত নিচু নজর কেন আপনার ছেলের? 

কাকিমার খ্যানখ্যানে স্বর, 

- এ মেয়েকে এখন আমরা বিয়ে দেব কেমন করে? এ মেয়েকে ঘরে তুলতে হবে আপনাকেই। 

শেষ অব্ধি পঞ্চাশ হাজারে রফা হয়েছিল। পুনা না ব্যাঙ্গালোর কোথায় যেন পাঠিয়ে দিয়েছিল আবিরকে তার বাবা। সাহানাকেও কালনায় তার মাসির বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। মাসি দায় নিতেও চায় নি, আবার মরে যাওয়া দিদির কথা ভেবে ফেলতেও পারেনি। উঠতে বসতে গাল দিত। আর তার মরে যাওয়া মায়ের কথা ভেবে মড়াকান্না জুড়ত মাঝে মাঝে। মেসোমশাই বেড়াল পার করার মত করে সমীরণের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন একদিন। সমীরণের বাপ-মা ভাই-বোন কেউ ছিল না। থাকলে হয়ত বিয়েটা হত না। কলকাতার বদনামের ঢেউ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কালনা পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিল। 

বিয়ের আগে সমীরণ এসব কথা শুনেছিল কিনা জানে না সাহানা। কোনোদিন কোনও প্রশ্ন করেনি তাকে। কখনো জিগ্যেস করলে সত্যি কথাই বলবে ভেবে রেখেছিল সাহানা। কিন্তু সে প্রসঙ্গ ওঠেনি। বিয়ের পরপরই দমদম স্টেশনের কাছাকাছি এই ছোট্ট বাসা ভাড়া করে চলে এসেছিল তারা। 

সমীরণের বলার মত গুণ ছিল না যেমন, তেমনি বড়সর দোষও ছিল না কিছু। দোষের মধ্যে অপোগণ্ড বন্ধুবান্ধব ছিল গাদাখানেক, তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে নেশাভাং করে বাড়ি ফিরত। কখনো তেমন আদিখ্যেতাও করেনি বউ নিয়ে, অত্যাচারও করেনি। ছেলেপুলে হয়নি বলে পাড়াপড়শি দুঃখ প্রকাশ করলে সটান বলে দিত, নিজেরা কি খাব তার ঠিক নেই, তার মধ্যে আর একটা মুখ! ভগবান বুঝেশুনেই দেননি। 

মানুষ খারাপ নয় সমীরণ, কিন্তু কোথায় যেন ফাঁকা, ফাঁপা! সাহানা মানিয়ে নিয়েছিল। তার এই কুটনো-বাটনা, রান্নাবাড়ি, ঘর গোছানো, এক টুকরো উঠোন, এইসব নিয়ে কেটেই যাচ্ছিল একরকম। আবিরের সম্পর্কে সেই উন্মাদনা, দিশেহারা ভাব অনেকটা থিতিয়ে এসেছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। শুধু মাঝে মাঝে মনে পড়ত তার চোখের ওই ঘৃণার দৃষ্টি। কখনো কি হবে না এমন, আবির আবার ফিরে এল তার সামনে সেই প্রেমময় দৃষ্টি নিয়ে! 

তারপর একদিন পাশের বাড়িতেই থাকতে এলো সুহাস। স্কুলে চাকরি নিয়ে। দেশের বাড়ি মেদনিপুরের কোথায় যেন। বয়সে তার থেকে কিছু ছোটোই হবে। প্রথম দিন তাকে দেখেই ভয়ানক চমকে গিয়েছিল সাহানা। আবিরের সঙ্গে খুব মিল। তেমনি একহারা চেহারা, উস্কোখুস্কো চুল, স্বপ্নিল চোখ। শুধু চেহারায় নয়, স্বভাবেও বেশ মিল। স্মিতহাস্য, মিতবাক। 

কিন্তু এ আবির নয়। তবুও, একে দেখলেই সাহানা আবিরকে দেখতে পায়! শুরু হল সাহানার আবিরকে ফিরে ফিরে দেখা। আরও অবাক কাণ্ড, সন্ধ্যায় সাহানা উঠোনে নামলে সুহাসও বারান্দায় বেরিয়ে আসে। দেখেও দেখে না সাহানাকে, যেন কোনোদিকে চোখ নেই তার, মন নেই, শুধু আকাশের দিকে চেয়ে থাকবে বলেই সে বারান্দায় বেড়িয়ে এসেছে এই সন্ধ্যেয়। কখনও দু’একটা কথা হয়, কখনও হয়না। সত্যিই কি এমন উদাসীন সে, সাহানার প্রতি? দিন কয়েক সন্ধ্যেবেলা উঠোনে নামা বন্ধ করেছিল সাহানা। তারপর সুহাস একদিন বাড়িতে এসে হাজির। বাইরের একচিলতে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে সমীরণের সঙ্গে হাবিজাবি গল্প জুড়েছিল খানিক। সাহানা চা নিয়ে গেলে খুব উদাসীন গলায় প্রশ্ন করেছিল, 

- বউদি, শরীর ভাল তো? আপনাকে দেখছিনা অনেকদিন! 

শেষের কথাটাই আসল কথা, বুঝেছিল সাহানা। ঘাড় নেড়ে হেসে জানিয়েছিল, ভালই আছে সে। তারপর, কে জানে কেন, খুব কান্না পেয়েছিল তার। সারাদিন ঘুরেফিরে কথাটা কানে বাজছিল, ...আপনাকে দেখছিনা অনেকদিন... আপনাকে ...তোমাকে ... দেখছিনা অনেকদিন... অনেকদিন দেখছিনা ! ...আবির! আবির! কতদিন দেখিনা তোমাকে! 

সুহাসের মুখ এখন অন্যদিকে ফেরানো। রেলিঙে ঠেস দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। চোখ মাটির দিকে। উঠোনের ধুলোবালি, লাউলতা, টিপকলের দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে দৃষ্টি। সাহানা একটু এগিয়ে গিয়ে ডাকল তাকে, 

- দোল খেলবেন কাল? 

- দোল? 

- কালই তো! আসবেন? 

- আমি তো দোল খেলি না। আপনি ... আপনারা খেলেন? 

- কাল আসুন। ভোরবেলা। এইখানে। এই উঠোনে। 

- আপনি রক্তপলাশের কথা বলছিলেন? হলুদ রঙের পলাশ দেখেছেন? আমাদের দেশে দুটোই পাওয়া যায়। কিন্তু, এখানে তো... 

মটরডালটায় চিনচিনে ব্যাথা। আবির! মনে আছে, সেই দোল? সেই রক্তপলাশ মনে আছে আবির? সাহানার হৃৎপিণ্ড কেন যেন লাফিয়ে উঠে দ্রুত চলতে শুরু করল। আবির! সেদিন আমার সত্যি কোনও দোষ ছিল না। আমি কিছুই জানতাম না! আবির! একবার তাকিয়ে দেখ! 

- কি হল বউদি? শরীর খারাপ লাগছে? 

সুহাস নেমে এল উঠোনে। কাছে এসে সাহানার মুখের ভাব পড়ার চেষ্টা করল। কেমন পাথরের মত মুখ এখন সাহানার। 

- বউদি? 

কেন তুমি চলে গেলে আবির! কেন একবারও আমাকে কিছু জিগ্যেস করলে না! 

- বউদি? কিছু বলছেন না! শরীর খারাপ লাগছে আপনার! 

আহ শরীর! শরীর! রক্তপলাশ! দেখবে আবির! দেখ! তোমার মঙ্গলগ্রহর চেয়ে আরও অনেক বেশি লাল, আরও দপদপে! 

একটানে বুকের আঁচল সরিয়ে ব্লাউজের বোতাম পটপট করে খুলে ফেলল সাহানা। ভুলে গেছ! আবির! দেখ! দেখ! 

সুহাস চোখ ঢেকে ফেলেছে দুহাতে। 

- ছি বউদি! আপনি এই? আপনাকে অন্যরকম ভাবতাম! ছি! 

সাহানা প্রেতের মত দাঁড়িয়ে রইল উঠোনে। আঁচল লুটোচ্ছে ধুলোয়। উন্মুক্ত ডানস্তন। স্তনবৃন্তের নীচে দপদপ করছে লাল আঁচিল। রক্তপলাশ। 

কতক্ষণ কে জানে! সুহাস কখন দৌড়ে ঢুকে গেছে তার ঘরে। সপাটে বন্ধ করেছে বারান্দার দিকের দরজা। অবিকল সেই ঘৃণার দৃষ্টি আজ সে দেখেছে সুহাসের চোখে। 

সেদিন রাতে, চাঁদ তখন অনেকটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে, সাহানা তার ডানস্তন উন্মুক্ত করে দিল সমীরণের কাছে। আলোটা জ্বেলে দিল। 

- দেখেছ? দেখ! 

- ইস! এটা কবে হল? ব্যাথা আছে? 

- অল্প, চিনচিনে। 

- ভাল কথা নয়। চল, যাই একদিন ডাক্তারের কাছে। 

- একটা পলাশের মালা এনে দেবে কাল? 

- কাল তো দোল! কচি পাঁঠা আনব ভাবছি কাল। কিছু টাকা পেলাম আজ। … কি বললে? পলাশের মালা? বাজারে পাওয়া যাবে? দেখব এখন! 

সাহানা পাশ ফিরে শুলো। ফাগুনের হিম হাওয়ায়, চাঁদের আলোয় চরাচর জুড়ে ভিজতে লাগল ঝরে পড়া যত রক্তপলাশ। কাল দোল। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ