বাজার পেরিয়ে রজকবাড়ির পাশের গলিটা পর্যন্ত রাস্তাটা অত খারাপ নয়, সাইকেল চালানো যায়। মুশকিল হয় এরপর থেকে।কালিডোবার ধার দিয়ে গেলে। বর্ষায় সরু মাটির রাস্তাটা এমন কাদায় ভরে ওঠে যে হরিচরণ ভয় পান সাইকেল চালিয়ে যেতে। তিনি হাঁটিয়ে নিয়ে যান বাড়ি অবধি।বাড়িটা কালিডোবার গায়েই। ডোবা সবুজ পানায় ভরে গেছে। শুধু হরিচরণদের খিড়কির দরজা দিয়ে ডোবায় নামার জন্য যেখানে দুটো ধাপ নেমে গেছে সেখানটায় জলে পানা নেই।
এখানে বাসন ধুতে বাড়ির মেয়েরা নামে তাই পানা ধরেনি। হরিচরণদের বাড়ি বেশ বড়, অনেকটা জায়গা নিয়ে। বাউন্ডারি দেয়াল দেওয়া। বড় যে দোতলা বাড়ি তার শরিক হরিচরণের দুই দাদা আর ছোটভাই। মেজদাদা অবশ্য গত হয়েছেন অনেকদিন। আর বড়দা এই গ্রামেই মেয়েদের স্কুলের পেছনে বাড়ি বানিয়ে আলাদা থাকেন। হরিচরণ আলাদা বৈঠকখানার বড় ঘরকে নিজের জন্য একতলা বাড়ি করে নিয়েছেন। হরিচরণদের ছোটবেলাতেও এই ডোবায় গ্রামের কালি বিসর্জন হতো। নামে ডোবা তবে বেশি ছোট নয়। রাতের আঁধারে সেসব মা-কালিরা জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতেন ডোবার এদিক থেকে ওদিক। হরিচরণ রা ছোটতে রাত্তির বেলা কোন দরকারে বেরোতে হলে কখনো একা বেরোতেন না। দু তিনভাই মিলে লন্ঠন হাতে বেরোতেন। হরিচরণ নিজের চোখে কোনদিন দেখেননি আর এখন আর এখানে কালিঠাকুর বিসর্জনও হয় না। তালবাগানের বড় দিঘিতে সব পুজোর পর ঠাকুর ভাসান হয়। হরিচরণ সাইকেলটা নিয়ে আরেকটু এগোতেই ফটকে দাঁড়ানো ইতুকে দেখতে পেলেন। রোজ এত বোঝানো হয় তবু সেই আলুথালু কাপড়ের দশা মেয়ের।
সাইকেল রেখে উঠোনের একদিকে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে মেয়েকে বলেন হরিচরণ – “ কূঁয়ো থেকে একবালতি জল নিয়ে আয়”। হরিচরণের প্যান্ট হাঁটুর কাছে গুটিয়ে তোলা, স্যান্ডাকের স্যান্ডেল ধুয়ে দালানে উঠলেন। দড়িতে গামছা ঝুলছে, জামা প্যান্ট ওখানেই খুলে গামছা পরে ঘরে ঢুকে গেলেন। ইতু জানে এখন বাবা চা খাবেন তাই দালানের পাশের রান্নাঘরে ঢুকে গেল। মা থাকতেও সন্ধ্যের চা ইতুই করে। মা ছোটবোন রিতুকে নিয়ে ক’দিনের জন্য মামাবাড়ি গেছেন। তাই ইতু রান্নাও করছে কিন্তু বাবা মশলাপাতি এগুলো সব দিয়ে দেন। বাবা মুড়ি দিয়ে চা খাবেন তাই ইতু দালানের ছোট কাঠের টেবিলে একটা কাঁসি রাখে আর পাশে মুড়ির কৌটো। হরিচরণ লোকাল ট্রেনে কেনা একটা ছোলাভাজার প্যাকেট খুলে অর্ধেকটা মুড়িতে ঢেলে বাকিটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে বলেন, “ তোর মুড়ি কই? যা নিয়ে আয়”। ইতু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ কথা বলতে ভয় পাচ্ছিল। এবার ধাতস্থ হয়।
“ জানো বাবা তোমায় আমি সেই কালিডোবার গোড়ার বাঁক থেকেই দেখতে পেয়েছি”। হরিচরণ একগাল মুড়ি খেয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। তাকালেন মেয়ের দিকে। তিন মেয়ের মধ্যে ইতু বড়। মেজমেয়ে মিতু থাকে পানাগড়ে স্বামীর সাথে।দুজনেই ওরা সরকারি স্কুলের টিচার। বর্ধমানে এম এ পড়ত দুজনে তারপরে চাকরি পেয়ে বিয়ে করে। ইতুর তখনো বিয়ে হয়নি। হরিচরণ হন্যে হয়ে পাত্র দেখছেন অনেকদিন ধরে কিন্তু মেয়ে দেখে যাবার পর কোনো ছেলেই রাজি হয় না। ইতু মাধ্যমিক পাশ করতে পারেনি কিন্তু গাঁ-গঞ্জে এমনতো কতই আছে। এমন সময়ে মেজমেয়ের বিয়ের প্রস্তাবে হরিচরণ না বলেন নি। ছেলে নেই , তিনটিই মেয়ে সবাইকেই তো পার করতে হবে। তাছাড়া ভাব-ভালবাসার বিয়ে হরিচরণকে খরচও তেমন কিছু করতে হয়নি। মেয়ে চাকরি করছে সেও টাকা দিয়েছিল বাবাকে। শেষপর্যন্ত আরো বছর দুয়েক পর ইতুর বিয়ে দিতে পারেন হরিচরণ। ছেলে বেকার , বদ্যিপুরে বাড়ি। একটা স্টেশনারি দোকান করে দিয়েছিলেন হরিচরণই। কিন্তু জামাই ছমাস হল ইতুকে বসিয়ে রেখে চলে গেছে। বলেছে নেবে না এই পাগল মেয়েকে। হরিচরণ এই বছরেই রিটায়ার করবেন। এখনো ছোটমেয়ের বিয়ে বাকি, সবে কলেজে উঠেছে।
রাতে হরিচরণ রুটি খান তাই ইতু রুটি বেলছে। মেয়েটা ঘরের কাজ সবই পারে কিন্তু একটার পর একটা বলে দিতে হয়। ওর পাঁচ-ছয় বছর থেকে বুঝেছিলেন এ মেয়ে খানিক হাবা ধরণের। হ্যালবেলিয়ে কথা বলে। এখন রুটি বেলছে হরিচরণ দেখলেন ঢোলা জামার মাঝখানে দুটো বোতাম খুলে গেছে কিন্তু কোনো হুঁশ নেই মেয়ের। অন্যদিন হলে স্ত্রীর ওপর হরিচরণ রাগা-রাগি করতেন, “ মেয়েকে বোঝাতে পারো না শাড়ি জামা ঠিক রাখতে? অন্তর্বাস পরে না কেন ইতু? সায়ার দড়ি আলগা বলতে পারো না?” এখন স্ত্রী নেই, বাপেরবাড়ি গেছে এক সপ্তাহের জন্য। হরিচরণ মেয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে গ্যাসের তরকারিটা খুন্তি দিয়ে নেড়ে দিলেন।
বাবা অফিস বেরিয়ে গেলে ইতু বড়বাড়ির ওদিকটায় ঘুরঘুর করে। মা-বোন থাকলে, ও দালানে ওঠে না। বাবার সাথে ছোটকাকার সদ্ভাব নেই। ছোটমাও জানি কেমন, তবে মেজমাকে ইতুর খুব ভাল লাগে। মেজজ্যাঠা নেই, এক মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। মেজমা সারাদিন কাজ করেন। ছোটমাদের সাথে একসাথে থাকেন তো। খুড়তুতো বোন বিন্দু ইতুকে দেখে ডাকলো – “এই ইতুদি এদিকে আয়”। বিন্দুর সাথে ওর বন্ধু পাশেরবাড়ির ক্ষমাও আছে। ইতুর সাথে কেউ কথা বললে ও সবচাইতে খুশি হয়, হাসিমুখে এগিয়ে যায় ওদের দিকে।
“ এই ব্লাউজের বোতাম লাগা, সব তো তোর ঝুলে গেল রে ইতু দি। জামাইবাবু তো সত্যিই আর নেবে না”। এই কথা বলে দুই বন্ধু হেসে কুটোপাটি। বিন্দুর সামনের অঘ্রানে বিয়ে, ও সুযোগ পেলেই ইতুকে বৈবাহিক আদিরসাত্মক কথা জিজ্ঞেস করে। এখন সাথে ক্ষমা আছে তাই করছে না। ইতুরও ভাল লাগে নিজের বরের কথা বলতে। কিন্তু এখানে রেখে সেই যে বর চলে গেল আর আসেনি। মা আর বাবা কত যে মুখ করেন ইতুকে ওর বুদ্ধি না কি কম।ইতু খিড়কি দরজা দিয়ে কালিডোবার ঘাটে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকার হয়ে গেলে এখানটায় একা এসে দাঁড়াতে সবাই ভয় পায় কিন্তু ইতুর দিনরাত সবসময় এই ঘাটে এসে দাঁড়াতে ভাল লাগে।
“ ইতু শোন এদিকে” ইতু তাকিয়ে দেখে গোয়ালঘরের কোনায় ফুটিকাকা দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে। “ না বাবা বকবে” বলে ইতু নিজেদের ঘরের দিকে ফিরে আসে। ক’দিন আগের এক রবিবারে ইতু ডোবার এদিক ওদিক ঘুরছিল, হঠাৎ খুব জোরে বৃষ্টি এসে যাওয়ায় গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে, সেদিনও ফুটিকাকা বিকেলের দুধ দুইতে এসেছিল। ইতুর কাছে এসে কথা বলছিল আর ঠিক তখনই হরিচরণ প্রতি রবিবারের মত সেইসময় জমি-জমার কাজ দেখে বাড়ি ফিরছিলেন।প্রথমে বৃষ্টিতে খেয়াল করেননি, তারপরেই মেয়েকে ফুটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে বাড়ি আসতে নির্দেশ দেন। ইতু ভাবে গোয়ালটা ছোটকাদের বলে বাবা রাগ করলেন।
*****
ট্রেনটা এতক্ষণ ঠিকমতই আসছিল খন্যানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, হরিচরণ একটু অধৈর্য হলেন।যদিও তিনি বসে আছেন।আগে হাওড়াতে উঠেই চোখ বুঁজতেন, নিত্যযাত্রীদের অভ্যস্ত একটা সজাগ ঘুমও দিতেন। ট্রেন বৈঁচীগ্রামে ঢুকলে ব্যাগ কাঁধে পরের স্টেশনের জন্য অপেক্ষা করতেন। মেয়েটার চিন্তায় আজকাল ঘুম আসতে চায় না হরিচরণের। এতদিনের চেষ্টায় বিয়ে দিলেন তাও টিঁকলো না। জামাই এখানে বসিয়ে চলে গেল। গাঁয়ের লোকেরা আড়ালে হাসে। হরিচরণ জানলা দিয়ে এক হকারকে জিজ্ঞেস করলেন “ কি হয়েছে ভাই? কখন ছাড়বে ট্রেন?” দীর্ঘদিনের যাতায়াতে সব মুখচেনা। হেসে জানালে, “ কি করে বলব কাকু, সিগন্যাল নেই দেখছি”। হরিচরণ পাশের যাত্রীর কাছ থেকে খবরেরকাগজ চেয়ে চোখ রাখেন তাতে। ভেতরের পাতায় দুটি ধর্ষণের খবর। হরিচরণ বন্ধ করে কাগজ ফেরত দিয়ে দেন। ট্রেনও ছাড়ে। হরিচরণ বসে থাকতে পারেন না। বাঁদিকে বালির খাদ দেখা দিতে স্বস্তি পান। পাঁচটা পাঁচের লোকালে অফিস যাত্রী বেশি থাকে না। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীই বেশি। হরিচরণ এই সপ্তাহটা এই ট্রেনে ফিরছেন বাড়িতে মেয়ে একা বলে। রেলের অফিস থেকে টিফিন করেই বেরিয়ে পড়ছেন ফেয়ারলি ঘাটে লঞ্চ ধরতে। স্টেশনে নেমে সাইকেল নিয়ে হরিচরণ কোনোদিকে না তাকিয়ে প্যাডেলে পা দেন। কে যেন ডাক দেয় – “ হরিচরণ দা এত সকাল সকাল যে” জবাব দেন না । একটু এগিয়ে রাস্তা দুদিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে, হরিচরণ বাঁদিকের রাস্তা ধরেন। বাজারের কাছে এসে দেখেন একটা দুটো করে দোকান দিয়ে ঝাঁপানের মেলা বসতে শুরু করেছে। খেয়ালই ছিল না যে ঝাঁপান দোর গোড়ায়। ছোটবেলায় ঝাঁপান নিয়ে কি উন্মাদনাই না ছিল। সেই মা জগৎগৌরিকে এনে বাড়ি বাড়ি ঘোরানো থেকে সয়লার বাজী পোড়ানো। তিনদিন পর কি মনখারাপ যখন বদ্যিপুরের ছেলেরা কোমরে লাল গামছা বেঁধে ঝাঁপানতলায় মায়ের দোলা তাদের গ্রামে নিয়ে যেতে আসত। এ ঠাকুর তো ভাসান হয় না। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান, দোলায় চড়ে। হরিচরণ সাইকেল থেকে নেমে দুটো চপ কিনলেন, কি ভেবে দুটো বেগুনিও নেন। কালিডোবার পাশে আজ কাদা নেই, আগে দুদিন কালবোশেখীর সাথে বৃষ্টি হয়েছে তুমুল। কালিডোবার জল স্থির হয়ে আছে, একটু এগিয়ে ঝুপ করে একটা আওয়াজে হরিচরণ ঘুরে তাকান। ডোবার ওপর গাবগাছের ঝুলে থালা অন্ধকার জায়গায় তরঙ্গ উঠেছে।এই গাছের গাব সব ডোবার জলেই পড়ে। নারকেল জলে পড়লে অল্পবয়েসি ছেলেরা ঠিক জলে নেমে খুঁজে আনে কিন্তু গাবের দিকে কারো নজর নেই। যা ভেবেছেন ঠিক তাই আজও ইতু গোয়ালঘরের দিক থেকে বেরিয়ে এলো হরিচরণের ডাকে। পাশে ফুটি দুধের খালি বালতি হাতে। বাড়িতে ঢুকে আজ আর হরিচরণ মেয়ে কে কিছু বললেন না। খেয়াল করেন মেয়ে চুপ করে আছে, মুখে অপরাধীর ভাব। অন্যান্য দিন হরিচরণ বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই মেয়ের বকবক শুরু হয়ে যায়। গম্ভীর মুখে হরিচরণ তেলেভাজার ঠোঙ্গাটি মেয়ের হাতে দিলেন – ‘এটা রাখ, মুড়ি আমি মাখছি’।
মুড়ি মুখে পড়তেই ইতু বলে- “ বাবা, মুড়িতে কেমন গন্ধ, ঝাঁঝ ঝাঁঝ লাগে”।
সাথে সাথেই হরিচরণ উত্তর দেন – “ ফেলবি না, পয়সা দিয়ে কেনা জিনিস”। মরিয়া ইতু আবার বলে ওঠে – “ দু’গাল খেয়েছি বাবা, আর পারছি না”। কিন্তু বাবার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে ইতু আবার খেতে শুরু করে।
*********
জামাইকে খবর দিয়েছিলেন হরিচরণ। খবর পেয়েও সে আসেনি। সব মিটে যাওয়ার কদিন পরে হরিচরণ জামাইকে বেশ কড়া ভাবে লিখে একটা পোস্টকার্ড দেন। যৌতুকের জিনিস-পত্র কিছু ফেরৎ দাও নয়ত তোমার নামে কেস করব। তোমার জন্যে আমার মেয়ে বিষ খেলো। এ চিঠিরও কোনো জবাব আসে না। হরিচরণ এবার খানিক নিশ্চিন্ত হলেন। স্ত্রী আর ছোট মেয়ে বাড়ি ফিরে কান্নাকাটি করে। মেজ মেয়ে আসতে পারে না কাজের চাপে। গ্রামে দুদিন খানিক ফিশফিশিনি চলে আবার জগৎগৌরি ঠাকুরের আগমনে তা নিমেষে বন্ধও হয়ে যায়। ফুটি দুধ দুইতে তিনদিন আসে না। হরিচরণ সপ্তাহ খানেক অফিস কামাই করে আজ আবার কাজে যোগ দিলেন। কাজও করলেন মন দিয়ে অনেকক্ষণ। রাতে ফেরার ট্রেনে ভীড় কম, ক্ষিধে পেতে হরিচরণ ঝালমুড়ি কেনেন। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে প্রথমে দু’ঢোক জল খেয়ে ঠোঙ্গার মুড়ি মুখে দেন। মুখে দিতেই ঝাঁঝে মুখ একেবারে পুড়ে গেল, মুড়িবালা তখনো সামনেই আর একজনের মুড়িতে মশলা মেশাচ্ছে।
“ কি দিয়েছো মুখ একেবারে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে”। মুড়িবালা অবাক হয় সঙ্গে ট্রেনের যাত্রীরাও। হরিচরণ হাত বাড়িয়ে জানলা দিয়ে মুড়ির ঠোঙ্গা ছুঁড়ে ফেলে দেন। ব্যাজার মুখে বসে থাকেন। ট্রেন ধীরে ধীরে পৌঁছয় তাঁর গন্তব্যে।
0 মন্তব্যসমূহ