
থেকে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে রাস্তার ওপাশে আল মদিনা হোটেলের ক্যাশে বসা বশির মিয়া-বাহার, ওই বাহার, কি করস, কাস্টমার আয়া বয়া থাকে, দেখস না, জলদি জিগা কি খাইবো? হোটেল বয় বাহার তখন ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’র মতো দুলতে দুলতে কাস্টমারের টেবিলে গিয়ে বলবে-- খাসি, মুরগি, বিরানি, ভাত, মাংস, মাছ, পাঙ্গাস, ইলিশ, রুই, কাতল, দই -কী খাইবেন কন্ স্যার? সকালবেলা হলে বলবে- রুটি, পরোটা, বাজি, মুগডাল মুরগি, লটপটি, নেহারি, মিষ্টি-কি দিমু কন। তখন নিউ বিসমিল্লাহ ফল ভাণ্ডারে কাস্টমার এলে উঠে দাঁড়াবে দোকানের মালিক সুলতান মিয়া, মানুষ বুঝে কথা বলবে, বৃদ্ধ হলে তমিজের সঙ্গে বলবে --স্লামালেকুম চাচা, বহুতদিন দেখি না, বালা আছেন তো, মাশাল্লাহ বন, সাদা কাপড় দিয়ে কমলা-আপেল-নাশপাতি-বেদানা মুছতে মুছতে বলবে -এক্কেরে টাটকা, কন্ চাচা কি দিমু। বৃদ্ধ হয়তো ঝুলন্ত আঙুরের দিকে আঙুল তুলে বলবে-আঙ্গুর কি মিঠা হইবো?
--কন্ কি চাচা, মিঠা মানে! বহুত মিঠা হইবো, কাশ্মীরের আঙ্গুর না এইগুলি? এক্কেরে টাটকা। হাতে ছোট্ট কাচিটা নিয়ে বলবে--দুই কেজি দিয়া দেই, কি কন্ চাচা?
--আরে না না, করো কি, খাইবো কেঠাই অতো!
--ক্যান্ বালবাচ্চা ঘরে নাইক্কা? বলেই কাঁচি নিয়ে আঙ্গুরের বোঁটায় ধরে বলবে --এক কেজি দেই, কি কন্ চাচা, শুনেন আপনে কইলাম কুনু চিন্তা কইরেন না, এক্কেরে টাটকা মাল, বহুত মিঠা।
রাতে দোকান বন্ধ করতে দেরি হয়ে যায় ফল ভাণ্ডারের মালিক সুলতান মিয়ার। দ্রুত বাসায় ফিরছিল সে। জগন্নাথ সাহা স্ট্রিটের সঙ্গে লাগোয়া পুষ্পরাজ সাহার গলিতে দুই কামরার বাসায় থাকে সে। হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ফেরার সময় এলোমেলো নানান কথা মনে পড়ে। দু’বছর আগে বিয়ে করা বউ পেয়ারী বেগম এইটা কি কইলো কাইল রাইতে --বিয়ার আগে তোমার লাইন আছিল না?
প্রায়ই সুযোগ পেলে ওই কথাটা জিজ্ঞাসা করে পেয়ারী বেগম। জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে আগেই তৈরি করে রাখা উত্তরটা দিয়ে দেয় সুলতান -না না, ওই সব লাইনউইন আছিল না কারু লগে।
কেনো এই কথাটা তাকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছে তার বউ সেটা বুঝতে পারে না সুলতান। উত্তর দিলেই পেয়ারী বেগম খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ে --হাচাই কইতাছো, লাইন আছিল না?
সুলতানের বাবার দোকান ছিল চকবাজারে, তার মৃত্যুর পর দুই ভাই দুটো দোকান করেছে। চকবাজারে বাবার দোকানটা দিয়েছে ছোট ভাই নবাব মিয়াকে আর সুলতান মিয়া নতুন দোকান করেছে লালবাগে। সে জন্যেই দোকানের নাম-- নিউ বিসমিল্লাহ ফল ভাণ্ডার। আবার পেয়ারী বেগম ঢুকে পড়ে তার ভাবনায় --শুনো, তুমি তো পোলাপান আর বংশ নিয়া ভাবো সবসুমে, আরে এইগুলি তো হইবোই, আগে লাইফটা ইনজয় কইরা লও, কি কও? মাইনষে বিয়ার পর হানিমুনে যায় লন্ডন-আমরিকিা-সিঙ্গাপুর, আমাগো কপালে তো ওইসব নাইক্কা, শুক্কুরবার একটা দিন তিনচাইর ঘন্টা দোকান বন্ধ থাহে, বাজার-সদাই কইরা টাইম যায়গা, আমারে তো ঘুরতে লও না, উই শিশুপার্ক আর এইখানে--ওইখানে বয়া বয়া ফুচকা আর চটপটি খাওন, এইসব ছাড়া আর কিছু নাই?
পেয়ারী বেগম অভিমান করলে সুলতান মিয়া বলে -আরে অস্থির হইতাছো ক্যালা, কোই যাইবা খুইলা কও। মাথা নিচু করে পেয়ারী বেগম বলে-- একদিন কইলাম চাইনিজে যামু, লইবা তো আমারে চাইনজে, কও?
সুলতান বলে- যাইবা, কি আছে, লমু, হাচাই কইতাছি লমু।
সুলতানের কথার রেশ ধরে সবকিছু পাকা করে নেয় পেয়ারী বেগম -যাওনের আগে কইলাম বিউটি পারলারে গিয়া সাজুম, কি কও? হারাদিন রান্নাঘরে বয়া ওই চুলার উপরে হাঁড়ি ঘাটাঘাটি আর টিবি দেখা, সবসুম এগুলা করতে কি বালা লাগে কও?
টিভিতে হিন্দি ছবি দেখেই হোক আর নিজের বুদ্ধিতেই হোক পেয়ারী বেগম এভাবে নানা কথা বলে স্বামীকে। থেকে থেকে তার কথা শুনে মাথা ঘুরে যায় সুলতানের, কখনো বুকটা ঢিপঢিপ করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য কথা বলে মেক আপ দিয়ে দেয় পেয়ারী বেগম।
ঘরের ভেতর সবসময় সেজেগুজে থাকে পেয়ারী, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক, দু’হাতে মিন্দি, পায়ে নূপুর আর হাল ফ্যাশনের সালোয়ার-কামিজ পরা তার অভ্যাস। একে তো ফরসা, তার ওপর সবসময় সেজেগুজে থাকে। একদিন তো সুলতানের বন্ধু মুন্তাজ মিয়া দওয়াত খেতে এসে বলেই ফেলল -সুলতান, তোমার মিয়া বহুত কপাল বালা, পাইছো তো একখান বিউটি কুইন!
মুন্তাজ মিয়ার দেয়া উপাধি শুনে গর্ববোধ করলেও বুকের ভেতর কোথায় যেন খচ্খচ্ করে ওঠে সুলতানের। মুন্তাজ বিয়ে করেনি, ফ্যাশন টেইলার্সের ম্যানেজার সে। পেয়ারী বেগম ঘরের ভেতর স্বামীর সঙ্গে যেভাবে কথা বলে চেয়ারের ওপর ঠ্যাঙ তুলে, সেভাবেই বসে হেসে হেসে কথা বলেছে মুন্তাজ মিয়ার সঙ্গে। তখনই বুকটা কেমন ক’রে ওঠে সুলতান মিয়ার। পেয়ারী বেগম কি করে আর না করে, তার কিছুই বুঝতে পারে না সে।
আজও রাতে দোকান বন্ধ করে ফিরতে দেরি হয় সুলতান মিয়ার। খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় বসে কথা বলতে বলতে কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই পেয়ারী বলল- -আইচ্ছা তুমি বাঘবন্দি খেলা জানো?
‘জানি, ক্যান্ জানমু না, যখন কুনু কামকাইজ থাকত না, আমাগো বাপ-দাদারা বয়া বয়া ওই খেলা করত। ছোটকালে দুই একবার খেলছি। ক্যান্ এই কথা জিগাইলা ক্যান্?’
শুনো, তুমার লগে কইলাম একদিন বাঘবন্দি খেলা করুম, বুজছো?
আইচ্ছা খেলমুনে, তুমি এই খেলা খেলছো কুনুসুমে?
হ খেলছিলাম, আমি তারে বাঘবন্দি করছি তিনবার।
কেঠাই, কার লগে খেলছো!
শুনো, তুমার দুকানের নাশপাতির বকসো আছে না ওইগুলার উপরে কলম দিয়া দাগ কাইটা নিমু, তারপর খাটের উপর বয়া বয়া খেলুম, কি কও?
কোথায় কার সঙ্গে বাঘবন্দি খেলেছিল পেয়ারী, সেটা সে এড়িয়ে গেল। এতে আহত হলেও সুলতান মিয়ার কিছুই করার নেই। আবার কথা বলতে বলতে কি সুন্দর সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে নেয়া অথবা স্থান ত্যাগ করে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়ার এক আশ্চর্য কৌশল জানে পেয়ারী বেগম। ইদানীং চায়ের দোকানের আড্ডায়ও পেয়ারী বেগমের প্রসঙ্গ চলে আসে,
‘বউ একখান পাইছে সুলতানে, কপালডা বহুত বালা!’
সুলতান মিয়ার কপাল ভালো না মন্দ, তা আজ প্রমাণিত হবে! বিকালে হাজীর বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে ঘরে ফিরছিল সে। সন্ধ্যার পর কি ঘটবে তা ক্রমেই জটিল এক বিষয়ে পরিণত হয়। দু’বছরের বিয়ে করা বউ কখন কোথায় কার সঙ্গে লাইন করেছিল তার রেশ ধরে তাকে দাওয়াত করে আবার স্বামীকেই পাঠিয়েছে হাজীর বিরিয়ানি আনতে, ব্যাপারটা রহস্যময়ও বটে! পেয়ারী কখন কিভাবে তাকে দাওয়াত করেছে, তার কিছুই জানে না সুলতান মিয়া, শুধু শাহ আলমের কথামতো সাহস নিয়ে সে সবকিছু করে যায়। তবে কথায় বা আচরণে পেয়ারীর ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখেনি। পেয়ারী নির্বিকার এবং স্বাভাবিক।
এক রাতে বিছানায় একান্ত নিবিড় হওয়া সেই মুহূর্তে সুলতানকে জড়িয়ে ধরে পেয়ারী বেগম বলে -আইচ্ছা, বিয়ার আগে তোমার কয়টা লাইন আছিল? ঠিক কইরা কইবা কইলাম।
--না, আমার কুনু লাইন আছিল না। বুকের মধ্যে পেয়ারীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুলতান বলে --আমার লাইন আছিল শুদু তোমার লগে, বুজছো পেয়ারী তোমার লগে, শুদু তোমার লগে।
পেয়ারী বেগম নিচ থেকে একটা প্রাণবন্ত সাড়া দিলে সুলতানও তাকে নিবিড় বন্ধনে বেঁধে ফেলে। সে চায় পেয়ারী পা থেকে মাথা অবধি সমস্ত শরীরে চরম পুলক অনুভব করুক। আর সে কারণেই সঙ্গমের পর সে দ্রুত জানতে চায় পেয়ারী তৃপ্ত কিনা? আলো-আঁধারির সেই রাতে সুলতান পেয়ারীর ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি দেখতে পায়, হ্যাঁ না কিছুই বলে না সে। বন্ধু শাহ আলম সুলতানের গুরু, তার কাছে মাঝে মাঝে দাম্পত্য জীবনের নানা বিষয় ছবক নেয় সুলতান। শাহ আলমের একটা বাচ্চা। সেও দু’বছর আগে বিয়ে করেছে, বাবা হওয়ার পর শাহ আলম বলে- -দোস্ত, আমি অহন একটা মাইয়ার বাপ, মাশাল্লাহ ময়মুরুব্বিগো দোয়ার আমার মাইয়া কইলাম বহুত খুবসুরত হইছে, আমার অহন বহুত বালা লাগে আর রোকাইয়াবি মাইয়া লইয়া বালা টাইম কাটায়, তুই কইলাম জলদি বাচ্চা লইয়া ফালা, ভাবিসাবে তাইলে উল্টাসিদা কওনের কিছু পাইবো না, কি কস্?
শাহ আলমের কথা শুনে বিব্রত বোধ করে সুলতান মিয়া। কিছুই করার নেই তার, সে তো আর জোর করে বাচ্চার বাবা হতে পারে না, পেয়ারীর সহযোগিতা ছাড়া!
সুলতান রিকশাতে, হাতে তার বিরানির প্যাকেট, সে আসছে। পেয়ারী বেগম তখন ঘর গোছগাছে ব্যস্ত। নতুন চাদর পেরেছে খাটে। নতুন বালিশের কভার, গোলাপি গ্লাডিওলাসের চারটা স্টিকের সঙ্গে ছয়-সাতটা গোলাপ মিলিয়ে একটা ফুলের গুচ্ছ এখন শোভা পায় ফুলদানিতে। ফুলগুলো কিনতে যাওয়ার সময় সুলতান বলেছিল --ফুল কার লেইগা? ফুলউল তো কিনি নাই আগে?
--আরে আগে কিনোনাই দেইখাকি অহন কিনবার পারবা না, ফুল ঘরে থাকলে মাইনষের মন ভালা থাকে, পুরুষ পোলারা বউরে মহব্বত করে, এইটা বুজলা না মিয়া?
পেয়ারী বেগমের জবাব শুনে সুলতানের দিলটা ছিঁড়েখুঁড়ে যায়, রক্তাক্ত হয়। সে মনে মনে বলে -কার লেইগা আমারে দিয়া ফুল আনাইতাছো, কিয়ের মহব্বত! আমি মরি আমার নিজের জ্বালায়, সে কয় ফুলে মন ভালা থাকে! মহব্বত হইবো! আজিব কারবার!
পুরাতন ছোট্ট ডাইনিং টেবিলে যে অয়েল ক্লথটা ছিল সেটা উঠিয়ে নতুন সুন্দর একটা লাগিয়েছে। রাস্তার ধারেই তাদের ছোট্ট ঘর, যেটা এখন ড্রইং কাম ডাইনিং রুম, সেখানে এখন লোহার শিকলের বদলে কলিং বেল শোভা পাচ্ছে, একটু চাপ দিলেই পাখি ডাকা মিষ্টি সুর ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত ঘরে। এককোণে আজমিরি আগরবাতি জ্বালানো, একটু ধোঁয়া হলেও সুগন্ধে ভাসছে সমস্ত ঘর। সুলতান ঘরে ঢুকতেই পেয়ারী বেগম চিৎকার করে ওঠে --আরে আরে করো কি, করো কি, জুতা খুলো, জুতা খুলো! আইজ থেইকা নতুন নিয়ম, বুজছো, জুতা পইরা ঘরের ভিতরে হাঁটবা না। সুন্দর করে সেজেছে পেয়ারী, তাকে এখন ফিল্মের নায়িকা মীনা কুমারীর মতো দেখাচ্ছে, সে এখন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছে--জুতা খুলে এসো, বিছানার চাদর ভাঁজ কোরো না, বুঝতে পেরেছো?
এত কিছু ঘটনার পেছনে রয়েছে দু’দিনের ইতহাস। গভীর রাতে যখন সুলতানের একটা হাত এসে পড়ে পেয়ারীর বুকের ওপর তখন পেয়ারী বেগম হাতটা ধরে সোহাগ করলে সুলতান বলে--
কি ব্যাপার ঘুম আহে না তোমার?
হ আহে, তোমারে একখান কতা জিগাই?
কি মুশকিল, এত রাইতে কিয়ের কতা?
আহা, জিগামু কিনা কও?
কাইল সকালে জিগাইও, অহন ঘুমাও।
আরে সকালে উইঠা নাস্তা খাইয়া তুমি তো দোকানে যাইবাগা, অহন জিগাইলে ক্ষতি কি?
উঠে বসে সুলতান মিয়া--কি জিগাইবা জিগাও।
পেয়ারী বেগম সুলতানকে টেনে শুইয়ে দিলে ওরা মুখোমুখি হয়। সবুজবাতির আলোয় পেয়ারী বেগমকে তখন অচেনা নারীর মতো মনে হয়। হঠাৎ সে বলে--
বিয়ার আগে তুমি কোনো মাইয়ার লগে লাইন করো নাই?
আইচ্ছা সবসুমে তুমি এইগুলি জিগাও ক্যান?
আহা কও না, না কইলে কইলাম ক্ষতি হয়া যাইবো, সাবধান!
সুলতান মিয়া বলে--অল্প বয়সে সক্কলেই তো ফিল্ডিং মারে, কি কও? লাইন তো সক্কলের হয় না।
আরে এইগুলা কি কও, এবার উঠে বসে পেয়ারী বেগম--
আমি জিগাইতাছি তোমার লাইন আছিল কিনা, কয়টা ফিল্ডিং মারছো ওইটা তো জিগাই নাই, বুঝছো?
হ বুঝছি তো, বুজুম না ক্যালা। বাধ্য হয়ে সুলতান মিয়া বলেন--শুনো যখন কেলাস টেনে পড়তাম তখন এক মাইয়ার লগে আমার লাইন হইছিলো, উই আমারে চিটি দিছিল।
গুড বয়, এলা কও তুমি তারে চিটি দাও নাই?
হ দিছিলাম একটা, কি লিখছিলাম অহন তো মনে করবার পারিনা।
আইচ্ছা তুমি তো আমারে কিছু জিগাইলা না?
পেয়ারীর এই কথা শুনে বোকা বনে যায় সুলতান মিয়া, তার মনের গভীরে তখন ভয়-সংশয় তোলপাড় করে, এবার না জানি কি বলবে! গভীর রাতে কি সব উল্টা-পাল্টা বলে চলেছে পেয়ারী? পাগলের পাল্লায় পড়ে গেল নাকি? কী খেলা খেলছে পেয়ারী বেগম তাকে নিয়ে! এখন তো সুলতান মিয়া প্যাঁচে পড়ে গেছে জিজ্ঞাসা করতেই হয়। প্রকৃতপক্ষে সুলতান উদার-নীতিবাদী এবং সে কারণেই বিয়ের রাতে বিড়াল মারেনি, সে চেয়েছে স্ত্রীর সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা করেই সংসার চালাবে। এমনকি বাচ্চা কখন নেবে না-- নেবে সে ব্যাপারে স্ত্রীর চাওয়া-পাওয়াটাকেই বড় করে দেখতে চেয়েছে। সে বন্ধু শাহ আলমের কথামতো সাহসীর মতো বলে-ঠিক আছে কও, তোমার কুনু লাইন আছিল? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পেয়ারী বেগম বলে--
এক পোলার লগে আমার লাইন আছিল, নীল কাগজে সে হাত-চিটি পাঠাইছিল।
কি লিখছিল সেই পোলা?
লিখছিল--মেরী জান জানের জান, আই লাব ইউ।
তুমি তার চিটির উত্তর দিছিলা?
পেয়ারী হেসে গড়িয়ে পড়ে--পাগলে পাইছে তুমারে, চিটির উত্তর দিয়া মরুম নিকি?
তুমি তারে বিয়া না কইরা আমারে বিয়া করলা ক্যান?
তোমার তো বিজনিস আছে, উই পোলা তো বেকার, বিয়া করলে খাওয়াইবো কি?
ক্যান, তুমি তার লাব-মহব্বত খাইতা, বেকার দেইখা বিয়া কর নাই, নাকি অইন্য কিছু?
হাচাই কইতাছি, ঈমানে।
পরদিন রাতে বিছানায় শুয়ে বালিশের নিচে হাত যেতেই সুলতান অবাক হয়। সে বস্তুটা নিয়ে বাথরুমে যায়। কাগজের রঙচঙা প্যাকেটের ভেতর ধারালো একটা ছুরি। দিন সাতেক আগে দোকানের ফল কাটার প্রয়োজনে ছুরিটা কিনেছিল। বাথরুমের আলোয় সে ছুরিটা দেখে, চকচক করছে ধারালো ছুরিটা। বালিশের নিচে ছুরি রেখেছে কেন? বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে! এত জায়গা থাকতে ছুরিটা বালিশের নিচে কেন? সে ঘরে এসে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে বলে--
পেয়ারী বেগম, বালিশের নিচে চাক্কু আইল কেমনে, এই চাক্কু রাখছে কে? পেয়ারী ঘুমাচ্ছিল, সে উঠে বসে বলে--
ও চাক্কু? আমি রাখছি, ক্যান কি হইছে?
সুলতান বলে-- নয়া চাক্কু, চকমক করতাছে, আমারে খুন করবার চাও পেয়ারী বেগম?
তুমি দেখতাছি আস্তা পাগল, তোমারে আমি খুন করবার পারি?
সুলতান বলে-- তাইলে বালিশের নিচে চাক্কু ক্যালা!
--চাক্কু নিয়া আমার সামনে খাড়াইয়া খুব জোরে চিক্কুর দিয়া কইবা--আর এক পাও আওগাইলে তোমারে কইলাম শ্যাষ কইরা ফালামু! আমি তখন ডরে কাঁপতে কাঁপতে কমু--তুমি আমার স্বামী, তোমারে ফালাইয়া আমি কই যামু জান, ধরো, এমতে ধরো, এই চাক্কু দিয়া আমারে শাসন করবা বুজছো, পারবা না, পুরুষ পোলা না তুমি? স্রেফে বোকার মতো ছুরি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সুলতান মিয়া। বিছানায় শুয়ে পড়ে পেয়ারী। নিজের বিয়ে করা বউয়ের মুখে এইসব কি শুনছে সে--আস্তা পাগলের পাল্লায় পড়ছি দেহি!
সকালে দোকান খোলার সময় শাহ আলম এসে উপস্থিত,
কিরে সুলতান ক্যামন আছোস?
ভালা।
তোরে দুই দিন ধইরা বহুত পেরেশান মনে হইতাছে, কি হইছে? শরীল খরাপ?
না না, শরীল-উরিল খরাপ না, কিছু অয় নাই।
আরে কি হইছে ক না?
দোস্, মাইয়া মানুষ যে আল্লায় কি দিয়া বানাইছে, কিছুই বুজতাছি না কি করুম।
কি হইছে আমারে খুইলা ক!
আরে রাইতে কি সব উল্টা-সিদা কয়, কিছু বুঝি না।
বেবাক খুইলা কুনো অসুবিদা নাই।
আরে, আমারে কইছে হাজীর বিরিয়ানি আনতে, বিয়ার আগে যার লগে হের লাইন আছিল, আইজকা রাইতে তারে দাওয়াত দিছে, আমারে বাজার-সদাই করতে কইছিল, কইরা দিছি, কত কিছু কিনছি হিসাব নাই।
কস্ কি? কি কিনতে কইছিল?
আর কইস না দোস্, অয়েল ক্লথ, বিছানার চাদুর, কলিংবেল, আগরবাত্তি, বিকালে আনতে কইছে বিরিয়ানি, আমার ভিতরে যে কি হইতাছে কইতে পারুম না তরে।
ভাবির লগে ঝড়গা করছোস্?
না না, কিয়ের ঝড়গা, হারাদিন তো সংসারের কাম-কাইজ করে আর হিন্দি ফিলিম দ্যাহে, সাইজ্যা থাকে আর কয়--হানিমুনে তো নিলা না, আমারে কইলাম চাইনিজ খাওয়াইবা। উইদিন কইল, আমার লগে বাঘবন্দি খেলব, এগুলি লইয়া বহুত ভেজালে আছি দোস্?
কথাগুলো শুনে বোকা বনে যায় শাহ আলম, কি বলবে বন্ধুকে? তবুও সে সুলতানকে পরামর্শ দেয়,
দোস্ ঘাবড়াইস না, বুকের ভিতরে সাহস রাখ্, আমার মনে হয় ভাবিসাব তোরে খেলাইতাছে, টেস করতাছে। অসুবিদা নাই, যা যা কইছে তা তা কইরা যা, খবর দিস্।
পেয়ারী বেগমের চাহিদা অনুযায়ী সব জিনিস কিনে দিয়েছে সুলতান। সন্ধ্যার আগেই বিরিয়ানির প্যাকেট এনেছে। এখন গম্ভীর হয়ে বসে আছে খাটের ওপর। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুসছে সে, যে কোনো সময় সব ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। এসব ঘটনায় পেয়ারী বেগমের ভেতরে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না, সে নির্বিকার চিত্ত, একটা একটা করে কাজ করে যায়! চায়ের কাপ-পিরিচ, সিরামিকের দুটো সুন্দর প্লেট, বিয়ের সময় ওরা উপহার পেয়েছিল ওসব, ও দুটো ভালো করে ধোয়। রাত সাড়ে ন’টার মধ্যে তার সব কাজ কমপ্লিট। এখন ছোট্ট গোল ডাইনিং টেবিল, যেটা বিয়ের পর পুরনো ফার্নিচারের দোকান থেকে কিনেছিল ওরা দুজন, সেটা সুন্দর করে সাজায়। নতুন অয়েল ক্লথ দেয়ার পর টেবিলটা এখন একটা অন্যরকম মাত্রা পেয়েছে। ঘরে আগরবাতির সুগন্ধ ভুরভুর করে। বিছানায় নতুন চাদর, ছোট্ট ফুলদানিতে ফুল। সুলতান যখন হাহাকার করছে তখন পেয়ারী বেগম নিষ্ঠুর মানুষের মতো নির্বিকার।
রাত দশটা বাজলে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সুলতান,
কই তোমার লাইনের লোক তো অহনো আইল না?
অস্থির হইতাছো কেলা, আইসা পড়ব ঠিকসুমে, টাইম দিছে রাইত সাড়ে নয়টা।
কিয়ের সাড়ে নয়টা, ঘড়ি দেইখা কথা কও, রাইত দশটা বাজে, কি শুরু করলা তুমি?
খেলার তো কিছু দেখ নাইক্কা, আইজ রাইতে টের পাইবা বুজছো চান্দু? মাথা নিচু করে বিড় বিড় করে এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে ওঠে সুলতান, ‘কি কইলা, কি কইলা তুমি, পরিষ্কার কইরা কও।
চেত্তাছো কেলা, কিছুই কই নাই--পেয়ারী আগের মতোই নির্বিকার।
ওইসব বিতলামি আর বালা লাগে না, তারে জলদি খবর দাও।
পেয়ারী বেগম টেবিলের ওপর বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে দুটো প্লেটে বাড়ে, সালাদ সাজায় হাফ প্লেটে, পানির জগ, গ্লাস, সব সুন্দর করে সাজিয়ে বলে,
আহো, খানা খামু।
মেহমান ফালাইয়া আমি খাই কেমনে, তুমি খাও, আমি খামু না।
পেয়ারী বেগম উঠে গিয়ে সুলতান মিয়াকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমো দেয় নিবিড়ভাবে, চুমো দিয়ে সে গান গায়--আসি আসি বলে তুমি আর এলে না....।
কি পাগলে পাইল আমারে, বিয়া করা বউয়ে এগুলি কি করতাছে! সুলতান মিয়ার কাছে এখন সব অসহ্য মনে হয়।
ডাইনিং চিয়ারে বহো, খানা খাইবা-- পেয়ারী বেগম বলে।
কইতাছি আমি খামু না, কতা বুজ না তুমি?
সুলতান মিয়াকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে জোর করে টেবিলে বসায় পেয়ারী বেগম। জগ থেকে পরিষ্কার কাচের গ্লাসে পানি ঢেলে একটা বাটি এনে সামনে ধরে--লন্ দুলা মিয়া, এইবার আতটা ধুইয়া ফালান। সুলতান হাত ধুয়ে টেবিলে বসে। সে মনে মনে একটা সমীকরণ করে--ভয়ের কিছু নেই, এটাই হয়তো পেয়ারী বেগমের সেই খেলা! হঠাৎ মনে হলো, পেয়ারী এভাবে সাজলো কেন? পেয়ারী বেগমের আসলেই কোনো ছেলের সঙ্গে লাইন ছিল, যার আসার কথা ছিল কিন্তু সে আসতে ব্যর্থ হয়েছে? সুলতান মিয়া দ্রুত ঢক্ঢক্ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে পেয়ারীর দিকে। পেয়ারী বিরিয়ানির প্যাকেট খুলে প্লেটে ঢালতে ঢালতে একটা রহস্যময় হাসি হাসে। সুলতানের আঙুলগুলো বিরানির ভেতর ডুবে যায় কিন্তু ফিরে আসে না মুখের কাছে। কি অদ্ভুত, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে পেয়ারী বেগম মোমবাতি না খুঁজে সুলতানকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় আর অন্ধকারের ভেতরেই নিজ হাতে সুলতানকে বিরানি খাইয়ে দিতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু সুলতান নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মোমবাতির খোঁজ করে। মোমবাতির মৃদু আলোয় ফের সুলতান মিয়ার বিরিয়ানি খাওয়ার আয়োজন চলে, কিন্তু এবার সুলতান দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ায়। সুলতান মিয়া যে কোথায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়, পেয়ারী বেগম বুঝতে পারে না! বলে--খাওন থুইয়া কোই যান দুলা মিয়া?
সুলতান বলে--দরজা ধাক্কায় কেঠা! খুইলা দেই?
পেয়ারী বেগম বিস্ময়ে ফেটে পড়ে--দরজায় ধাক্কায়! কি কও তুমি!
--হ আমি নিজের কানে হুনছি, দরজায় ধাক্কা দিছে, কেঠাই ধাক্কা দিল, দেহি তুমি সইরা খাড়াও, আমি দরজা খুলি।
সুলতান মিয়া পেয়ারীকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলে পেয়ারী বেগম নিশ্চিন্ত হয়ে বলে-- আরে ভুল শুনছো তুমি, তুমি খাও কেউ আহে নাই। সুলতান মোমবাতির আলোয় পেয়ারী বেগমের দিকে তাকালে তাকে রহস্যময়ী নারী মনে হয়। পেয়ারী বলে-- ভুল শুনছো, তুমি খাও, কেউ আহে নাই।
তারপর তাদের খাওয়া শেষ হয়। রাতে পাশাপাশি শুয়ে থাকলেও সুলতান মিয়ার নির্ঘুম রাত কাটে।
0 মন্তব্যসমূহ