সুবন্ত যায়েদ'এর গল্প : একটি রাতের আখ্যান

শহরের সামান্য এক মোড়ে, রাত যখন বারোটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই তখন গোটা বিশেক দোকানের ভেতরে শেষ দোকানটার সাটার নামলে, মোহাম্মদ কাজলের বাঁশিতে প্রথমবারের মতো ফুঁৎকার ওঠে। বাঁশির শব্দ মোড়ের চতুর্দিকে বিল্ডিংয়ের জানালা গলে বুড়ো বুড়ি আর তরুণ তরুণীদের কানে পশলে তারা গভীর রাত সম্পর্কে সজাগ হয়, তখন তারা বিছানায় যাবার তাড়া অনুভব করে।

তখন গলির আঁধার থেকে লোম ওঠা দুটো কুত্তা স্ট্রিট লাইটের আলোয় এসে প্রথমে পরস্পরে মুখ ঘষাঘষি করে, তারপর মোহাম্মদ কাজলের পুনরায় বাঁশির শব্দে তারা ভূতের কান্নার মতো চিকন স্বরে দীর্ঘ বিলাপ করে ওঠে। আর কুত্তাদের দীর্ঘ বিলাপে মোহাম্মদ কাজলের মনে প্রাচীন ভয় উঁকি দিলে ডাণ্ডা হাতে সে কাঁপা গলায় ধমকাতে ধমকাতে এগিয়ে আসে। কিন্তু কুত্তাদুটো তাতে সামান্য বিচলিত হয় না বরং প্রভুভক্তির মতো লেজ নাড়ায়, আর মুখ উঁচিয়ে কুঁই কুঁই করতে থাকলে মোহাম্মদ কাজলের মন থেকে প্রাচীন ভয় কাটে। তখন সে চারিদিকে তাকিয়ে নিজের একাকিত্ব বিষয়ে সজাগ হয়ে উঠলে কুত্তাদুটোর সঙ্গ পাবার কথা মাথায় আসে। 

কুত্তার জাত প্রভুভক্ত হয় বটে। রাতের এই মরা সময়টাতে সবাই যখন নিরাপদ ঘুমে মগ্ন হয়েছে তখন সে একলা একা বাঁশি ফুঁকে শহর নিরাপদ রাখার ডিউটি করছে। কে জানে, উড়ো বাতাসে কখন কোন বিপদ ঘাড়ের উপরে ঝুলে পড়ে। ভেবে, মোহাম্মদ কাজল তার কাঁধে ঝোলানো মোটা কাপড়ের ব্যাগ হাতড়ে রুটি ভাজির কৌটাটা বের করে। আর খাবারের গন্ধে কুত্তাদুটো লেজ নাড়তে নাড়তে তার আরো কাছে এসে পড়ে। মোহাম্মদ কাজল তার ভাগের পাঁচখানা রুটির দুটো রুটি চার খ- করে চকচকে কালো পিচ রাস্তায় ছুঁড়ে দেয় আর বিলু বাম্বি (মোহাম্মদ কাজল সে রাতে কুকুরদুটোর নাম রেখে থাকবে যথাক্রমে বিলু আর বাম্বি) হুটপাট করে তাতে মুখ লাগায়। মোহাম্মদ কাজল মায়া চোখে সে দৃশ্য দেখে শব্দ করে কয়, কইলজাটা ভরিয়া খা। 

বিলু বাম্বি রুটি দুটো ছিঁড়ে খুবলে খেতে থাকে, আর মোহাম্মাদ কাজল চওড়া রাস্তার এমাথা ওমাথা পায়চারি করতে করতে ছোটো দুটো ফুঁৎকার ছাড়ে কিন্তু বিলু বাম্বি এবার আর তাতে যোগ দেয় না, বরং রুটিদুটো সাবাড় করে রাস্তার ওপারে গিয়ে পড়ে থাকা ডিমের খোসা হাদলায়। মোহাম্মদ কাজল মনে মনে খিস্তি ছাড়ে, মান্দার পো কুত্তা তো কুত্তাই, ওকে পোলাও দে আর কোরমাই দে ও ঘু’তেই মুখ ডুবাইয়া আবে হায়াত উটকায়। কিন্তু সে খিস্তি ছেড়েই হোঁচট খায়। দুটো রুটিতে কাঁহাতক আর উদরপূর্তি হয় আর তাছাড়া আজকাল ওরাই বা কতোটুকু খাবার পায়, এখন শহরের গিন্নি বউদের ফেলনা আঙিনায় ধর্না দেবার সুযোগ নাই। ব্যক্তিমালিকানার চরম উৎকর্ষের এই দিনে ফেলনা আঙিনাও এখন চার দেয়ালের ঘেরাটোপে। অবশ্য ডাস্টবিন বেড়েছে কিন্তু কুত্তাও বেড়েছে বেশুমার আর ততোটাই দখলদারিত্বের ঘেয়ো কামড়াকামড়ি। বিলু বাম্বি তো কংকালসার লোম ওঠা নাক কুচকানো কুত্তা। আবার ভিন্ন জাতও শহরে সংখ্যালঘু নয়। সেকেলে লেঠেলদের মতো মাংস দুলিয়ে চলে আর বিলু বাম্বিদের জাত দেখলে বিক্রমাদিত্যের মতো হুংকার ছাড়ে। সেই পুরনো আমলের রাজবাড়ির পেছনের যে দিক দিয়ে চলে গেছে প্রশস্ত জংলি পথ, তার মাথায় মুরগি ফার্মের পেছনে ভাঙ্গা আর নষ্ট ডিমের নর্দমা ঘিরে পাঁচটা কুত্তা নেকড়ের মতো দেহ নিয়ে রাজ্য শাসন করে। মাঝে মাঝে চোরা পথে বিলু বাম্বির জাত হামলা দেয় বটে কিন্তু গা থেকে তাদের আরো লোম খসে গিয়ে চামড়া ভেদ করে ছোপ ছোপ রক্ত বাতাস পেয়ে কটকটে হয়। 

কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না’ এই সব মন্ত্র অন্তত কুত্তার জাত জানে না। 

সদ্য ঝাড়– দেয়া চকচকে রাস্তায় মোহাম্মদ কাজল পায়চারি করে। সময় সময় বাঁশিতে ফুঁৎকার করে ঘুমন্ত রাজ্যে শব্দের ঝড় তোলে। তখন শোনাশুনি প্রক্রিয়ায় অন্য মহল্লা-মোড় থেকে আরো বাঁশির শব্দ ভেসে এলে মনের অস্বচ্ছলতা কাটে। সে তো আসলে একা না বরং পর পর এভাবে বাঁশির ফুঁৎকারে যখন রাতের ছমছমে নীরবতা সস্তা কাঁচের মতো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে, তখন কেমন সংখ্যালঘু থেকে গরিষ্ঠের স্বাদ লাগে। কিন্তু মনের এই আধেক মিছে সন্তুষ্টি দীর্ঘক্ষণ সতেজ থাকে না। যদিও মিছে না এসব, কতো কাছেই শয়ে শয়ে প্রাণ আছে কিন্তু সত্য হলো সেসব অসাড় মৃতের মতো, এসমস্ত প্রাণের কোনো নৈকট্য হয় না। তারচে বরং কুত্তাই ঢের ভালো, তারা নৈকট্যের ইতিবৃত্ত বোঝে। কিন্তু কোথায় যে গেলো শালার নেমকহারাম কুত্তার দল, মোহাম্মদ কাজল সার সার দোকানের সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে বসে প্রথমে মনে মনে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে বিলু বাম্বির তালাশ করতে থাকলে টের পায়, দূরে একটি গলির মুখে ঘন পাতার গাছের নিচে জমে ওঠা আঁধার চোখে উস্কানি দিচ্ছে। জায়গাটায় স্ট্রিট লাইটের আলো পৌঁছে নাই বলে কেমন চোখ সরে না সত্যিই, আর মন কয়ে যায় ওখানে বুঝি কিছু ঘটে চলছে। কিন্তু মনে তো এমন কতোই ফাল পাড়ানি কথা আসে, এসব আসলেই কিছু না, ভেবে অন্যদিকে মন ঘোরানোর চেষ্টা চালায়। আর চেষ্টা চালায় বলে সে ফুরফুরে চুলে পাঁচ আঙ্গুলে চুলকায়, যদিও সেখানে তার কোনো চুলকানি নাই। কিংবা একভাবে খানিকক্ষণ বসে থেকেছে বলে পা ধরে এসেছে ভাব করে পাদুটো দক্ষিণ বরাবর ছড়িয়ে দেয়। বুঝি গানও ধরে, কিন্তু কন্ঠে পুরনো কফ আটকে থাকে বলে সুরেলা কোনো স্বর কন্ঠে ধরে না। তখন সে হতাশ হতে হতে নগ্নভাবে টের পায়, তার মনে পাথুরে ঘাই খাবার মতো বড্ড খুঁতখুঁত করে চলেছে। তার মানে এই ফাল পাড়ানি কথা থেকে বুঝি এই রাতে আর মুক্তি নাই। তাই আর আড়াল করার চেষ্টা না করে সে টর্চ জ্বালিয়ে বন্দুকের নলের মতো নিশানা করে সুইচ চেপে ধরে, কিন্তু ব্যাটারি যে ডাউন মেরে গেছে বহু আগে ততোক্ষণে মনে পড়লে মুখভরে খিস্তি করে। অথচ কয়েক পা আগালেই যাবতীয় খুঁতখুঁতানি থেকে নিস্তার মেলে কিন্তু কে আর ওঠে, আদতেই কি ওখানে কিছু ঘটছে? আসলে মন একবার কিছু কয়ে ফেললেই যতো গোল বাঁধে। এই গোল নিয়ে মনের ভেতরে মহা গোলমাল সৃষ্টি হচ্ছে বলে মোহাম্মদ কাজল এবার মুখে বাঁশি তাক করে কেয়ামতের ফেরেস্তা ইসরাফিলের স্মরণে বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস জমা করে দীর্ঘ ফুঁৎকার তোলে। কিন্তু তাতে আঁধার একটু কেঁপে উঠলো কি? নাহ, আঁধার আদতেই কাঁপে নাই কিংবা বিচলিত হয় নাই সামান্য। সে না হোক আরকি, এই নিষ্প্রাণ রাতে সে সত্যিই এমনসব উড়ো ভাবনা আমলে আনতে চায় না। তাই তার মনে সংসারের খুঁটিনাটি অনুসঙ্গ তখন তার চিন্তার প্রধান আসন জুড়ে বসে, আর এভাবে একাধিক অনুসঙ্গে ভ্রমণ করতে করতে তার ক্লান্ত মগজে হঠাৎ কখন ঘুমের ঘোর বাসা বাঁধতে শুরু করেছিলো, সে ঘোর থেকে সজাগ হতেই তার মনে হয় কালব্যাপী কোথাও কোনো বাঁশির শব্দ শোনা যায় না। তবে কি রাতের এই ঘনিষ্ঠ প্রহরে সবাই ঘোর আচ্ছন্নতায় ডুবলো? বিলু বাম্বির জাত নাকি রাত জাগে কিন্তু তাদেরও তো কোনো হদিস মেলে না। ক্ষুধার মুখেও দুটো রুটি তাদের বিলিয়ে দিলো যাতে তারা নিঃসঙ্গ সময়ের সঙ্গী হয়, আর বিপদাপদের হেল্পার না হোক দুটো প্রাণ অন্তত সাক্ষি থেকে যাক, কিন্তু কুত্তাও আজকাল নেমকহারাম, অথবা, গোলামের ভাগ্যে কোনোরূপ মালিকানা সয় না আদতে। 

তার মন বুঝি নিদারুণ বিষিয়ে ওঠে, তাই সে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়াতে শুরু করে যেনো মৃতদেহ জেগে উঠতে শুরু করেছে কিংবা পঞ্চাশ বছরকালের ক্লান্তি তার দেহ মনে ভর করেছে। তবু সে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে প্রথমে উত্তরের রাস্তায় এবং তারপর দক্ষিণের রাস্তায় কিছুদূর পায়চারি করে বাঁশিতে ফুঁৎকার তোলে। কিন্তু হায়, কইলজার তলায় চাপা পড়া আশঙ্কা ভুস্ করে ভেসে ওঠে। কেউ তার বাঁশির প্রত্যুত্তর করে না আর। সবাই কি তবে আচ্ছন্নতায় ডুবেছে আর সে একাই খোলা আকাশের তলে দাঁড়িয়ে দুনিয়া রক্ষার খেল্ শুরু করেছে। তখন হঠাৎ দূরে একটি ধারালো আলো তার চোখে এসে জ্বালা ধরিয়ে দিলে মুহূর্ত কয়েকের ভেতরে একটি মটরবাইক সশব্দে তার পাশ কেটে দক্ষিণের রাস্তায় মিলিয়ে যায়। মোহাম্মদ কাজলের মনে হয়, নীরব রাইতে মৃত্যুর ঘোড়া যন্ত্রের শব্দ নিয়া উড়িয়া যায়। তার পিঠে বসা আছে আস্ত সে আযরাইল, আর আযরাইল বুঝি মাটি ঘেঁষেই ওড়ে এবং শস্যের মতো মরণের দানা ছিটায়, মানুষেরা ধুলায় লুটায়। কখনো কখনো আযরাইল উপর পানেও ওড়ে, তখন বালাখানার পাথর খসি খসি পড়ে এবং তাদের নিয়ে আবার ঝিলিমিলি আলোকের তলায় একশ একটা মোম জ্বালিয়ে শোকগাঁথা তৈরি হয়। হায় রঙের দুনিয়ায় কতো শতো লীলা। 

মোহাম্মদ কাজল এবার দক্ষিণ মুখো হয় কিন্তু অন্যবারের চেয়ে ভিন্ন সুরে, সেই গলির মুখে ঘন পাতার গাছটার নিচে যেখানে আঁধার জমে উঠেছে আর তার মনে অশুভ বাজিমাত তিরতিরিয়ে কেঁপে চলেছে, সত্যিই বুঝি সেখানে কিছু ঘটছে, নয়তো এমন টান টানবে কেনো কিংবা মনের ভেতরে এমন কু ডাকবে কেনো ও আঁধার। হায় হায়, রুইতনের মায়ের মনেও নাকি এমন কু ডাকতো তার ঘরের পেছনের অশ্বত্থ গাছের অশুভ ছায়ায়। খোলা মাঠ থেকে ধেয়ে আসা বাতাসে যখন সে গাছে উদ্দাম নূপুরের নৃত্যের মতো ঝনঝন করে বাজনা বাজাতো, তখন রুইতনের মায়ের মুখখিস্তি শুনে পারলে বাতাস চির আবসরে যায়। অশ্বত্থের ছায়ায় নাকি সে তার আত্মার শত্রুকে দেখতো, শুনে শিক্ষিতরা বাড়তি বিনোদনে দাঁত ক্যালাইয়া হাসতো। 

কিন্তু একদিন, অশ্বত্থের পাতায় ঝনঝনানো বাজনা বাজার রাইতে রুইতনের মায়ের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হলো, তখন আর শিক্ষিতরা দাঁত ক্যালাইয়া হাসে না। মনে কি এমনি এমনিই কু ডাকে! শিক্ষিতরা দু’চার লাইন পড়া শিখে ভাব বাড়িয়ে মনের দরজায় খিল এঁটে দেয়, কু ডাকলে তার ওরা কি বুঝবে ছাই। 

কিন্তু সে দেখে, ঘন পাতার গাছের ছায়ায় খোলা ডাস্টবিন আর সারা দিনের জমানো ময়লায় ছুঁচোরা দল বেঁধে মহা উল্লাসে চরে। মোহাম্মদ কাজল হতাশ হতে হতে আবারো ডাস্টবিনের দিকে তাকালে প্রথমে কেমন মাছের কাঁটার মতো খটকা কইলজায় বেঁধে, তাই ভালো করে তাকিয়ে দেখে আঁধারের ভেতরে আরো কড়া আঁধার ফুটে আছে। এবার সে চট করে ডাস্টবিনের উপরে ঝুঁকে পড়ে শকুনের মতো তীক্ষ্ণ চোখে কড়া আঁধারের রহস্য খোঁজে। দেখে ডানা ছড়িয়ে বড়ো জাতের কোনো পাখি ময়লায় ঠোঁট ডুবিয়ে লুটিয়ে আছে। সে চোখ আরো ধারালো করে ঠাওর করতে গেলে সহজেই ধরা পড়ে দাঁড়কাক-ই হবে, কিন্তু এ শহরে বহুকাল হয় দাঁড়কাক নাই। 

পদ্মার ধারে যেখানে শহর রক্ষার বাঁধের উপরে বটবৃক্ষের ছায়া তরুণ তরুণীদের মনোযোগের কারণ হয়েছে, সে গাছের ডালপালায় দু’চারটা দাঁড়কাকের বসতি ছিলো, এছাড়া শহরে কোথাও আর দাঁড়কাকের দেখা মিলেছে কিনা এ নিয়ে কারো কোনো ভাষ্য শোনা যায় নাই। এখন ঘন পাতার এই গাছের আঁধারে বাসি ময়লায় মুখ ডুবানো মরা দাঁড়কাক তো ভুল কিছু না। টিকে থাকার লড়াইয়ে জয় পাওয়া সহজ না। এবং তার মনে হয়, এটাই বুঝি এই শহরের শেষ সদস্য দাঁড়কাকের কিন্তু শহরবাসী তা টের পাবে না। 

মোহাম্মদ কাজল উপরে বালাখানার শার্শির আড়ালে ভূতের আলোর মতো জ্বলতে থাকা লাল নীল আলোর লীলা দেখতে দেখতে আবারো পায়চারি করে যেনো মরা মানুষ দৈবগুণে হাঁটে। শহরে রাতের রাস্তায় নাকি ভূত চরে আর তার ঘাড়েও বুঝি কিছু চড়াও হয়, যেনো দাঁড়কাকের আত্মা, তখন তার বাঁশিতে আর ফুঁৎকার ওঠে না। তার মাথার ভেতরে আসলে কী এক রক্ত গরমের খেলা যেনো খেলে যায়। সে অস্থির বাঁশি নাড়তে নাড়তে এলোমেলো পায়চারি করে আর সেই সাথে তার গা বেয়ে দরদরাইয়া ঘামের তরল ছোটে। ভাবে, কেয়ামতের ফেরেস্তা ইসরাফিলের বাঁশিখানা যদি অধিকারে পাওয়া যেতো, একবার যদি যেতো, এই রাতে দুনিয়াটা আর এইসব বালাখানা কি ঝড়ের রাতের শিমুল তুলার লাহান উড়তো? 

উড়তো বৈকি, মানুষেরা যে কতো সুখে ঘুমায়। দাঁড়কাকেরা চিরঘুমের পাশ পেয়ে যায়, সত্যিই পায় কি? দাঁড়কাকেরা তো আজন্ম ডাস্টবিনে মুখ ডুবিয়ে জেগে থাকে, দাঁড়কাকেরা পরাণ নিয়ে বাঁচবার পাশ পায় না। 

মোহাম্মদ কাজল যখন রাতের শেষ প্রহরের বাঁশি ফোঁকে, তখন তার রক্তের গতিতে রাত জাগার ক্লান্তি শীতের নালার ক্ষীণ করে দেয়। কিন্তু হঠাৎ আসমান বরাবর থেকে বেগে বাতাস নাজিল হলে রাস্তার ধুলোয় জগত সংসার ধুলোটে আঁধারে হাবুডুবু খায়। মোহাম্মদ কাজল দুচোখ চেপে ধরে হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে টালমাটাল বনে যায়। সে আসলে এতোটাই বেখবর ছিলো যে কিচ্ছু টের পায় নাই। কখন যে ভাদ্র মাসের তারা ফোঁটা ঝকঝকে আকাশে বুনো হাতির পালের মতো মেঘ এসেছে, তারাগুলি আড়াল পড়ে গেছে আর অমাবস্যার মতো আঁধার রাতে ঘোর অমবস্যার বান ডেকেছে। রাত যে ক্রমেই সাদা হয়ে উঠতে লেগেছিলো এবং পাখিরা পালক ফুলিয়ে বিশ্রাম শেষের আলস্য ছাড়তে শুরু করেছিলো। আর মোহাম্মদ কাজল, ভোরের আশায় বুক পেতে পেতে রাতের আঁধারের দিকে চেয়ে ছিলো। কিন্তু সময় যেনো ঘুরে দাঁড়ায়, ভোর যেনো আবার সন্ধের দিকে ছুট লাগায়, এই রাত যেনো আর শেষ হবার নয়। 

যদিও আকাশ কালো মেঘে শামিয়ানার মতো ছেয়ে থাকে, বার কয়েক দমকে দমকে বাতাস গায়ে মুখে ঝাপটা মেরে শান্ত হয়ে বয়ে চলে, কিন্তু এক ফোঁটা বৃষ্টি পর্যন্ত হয় না। কিন্তু এ বড়ো মন উত্লা করা বাতাস। ছোটো ছোটো ঢেউয়ের মতো বয়ে এসে আদুরে শীতল ছুঁয়ে যায়। সারা রাত না ঘুমানো মোহাম্মদ কাজলের কইলজার ভেতরে ধুকপুক করে তড়পায় কিন্তু ভোর তো দূরে সরে যায়। তখন সে আরো বার দুয়েক বাঁশি ফোঁকে, তারপর হোমিওপ্যাথির ডিসপেন্সারির চুনকামহীন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে হাঁটি হাঁটি পায়ে খুব কাছে চলে আসা ভোরের অপেক্ষা করে। বাতাস এসে তার ফুরফুরে চুলে আদুরে বিলি কাটে আর মধুর মন্ত্রণায় বশ করলে, মোহাম্মদ কাজলের মাথা ডান দিকে কাত হয়ে দেয়ালে ঠেকে যায়। 

কোথায় যেনো বিলু বাম্বি ডাক ছাড়ে যেনো স্বপ্নের ওপার থেকে। কুয়াশার নদীর এপার-ওপারের মতো ঝাপসা কিছু শোনা যায় বটে দেখা যায় না। বিলু বাম্বিই হবে, হারামজাদা দুটো তবে ফিরে আসতে লেগেছে সারা রাত কোথায় মৌজ মেরে শেষে। কিন্তু শালার কাণ্ড হলো অন্য। দুটো তিনটে ঘেয়ো কুত্তার পাগলা ডাক শুনে মোহাম্মদ কাজল ধড়্ফড়্ করে ওঠে এবং উঠেই তার মনে হয় বুঝি ভোর হয়ে গেছে। কিন্তু তখনো ঘোর আঁধার তার চোখে জলের মতো গড়িয়ে এসে ভুল ভাঙ্গায়। তারপর ঘেয়ো কুত্তাগুলোর পাগলা ডাকের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখে সেই ঘন পাতার গাছের তলায় আঁধারের ভেতরে দুটো তিনটে ছায়া নড়ে চড়ে। ওই গলিপথ দিয়ে কোনো ছিচ্কে চোর ঢুকেছে কিনা ভেবে পা চালিয়ে সেখানে গিয়ে দেখে ছেঁড়া চট পরা পাগল একটা ডাস্টবিনের উপরে উপুড় হয়ে বুঝি খাবার টোকাচ্ছে। কাছেই দাঁড়িয়ে তখনো বিলু বাম্বিই ওমন পাগলা হয়ে জান কাঁপানো ডাক ছাড়ছে। 

তখন পাগলটা দু’হাতে কী সব বস্তু তুলে নিয়ে ডাস্টবিনের উপরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মোহাম্মদ কাজলের মনে হয় সেই দাঁড়কাকই বুঝি কিন্তু চোখের পর্দা আরো পরিস্কার হলে দেখা যায় সাদা সাদা কিছু। পাগলটা যে আবার কী সব বস্তু আবিষ্কার করে বসে, ভেবে আরো কাছে এগিয়ে দেখে, যাকে সে দাঁড়কাক ভেবেছিলো আদতে সেটা একটা আধেক ফোটা মানবের বাচ্চা। 

হায় হায়, এখানে কখন যে কার গর্ভ থেকে আধেক ফোটা মানবের বাচ্চা নাজিল হলো আর তার ভার পড়লো পাগলটার উপরে, এটাও তবে ঘটলো! বিলু বাম্বি তখনো কোরাসে ডেকে চলে। পাগলটা মানবের বাচ্চাটাকে মমতাভরে বুকে আঁকড়ে মোড়ের দিকে যাত্রা করলে সেও তার পিছু পিছু হাঁটে। কিন্তু পাগলটা মোড়ের উপরেই যাত্রা বিরতি দিয়ে হোমিওপ্যাথির ডিসপেন্সারি বরাবর কালো রাস্তায় বসলে মোহাম্মদ কাজল বাচ্চাটা পরিষ্কার আলোয় দেখে টের পায় তার বুকের ভেতরে মায়া নড়ে চড়ে। বিলু বাম্বিও সোনাবরণ বাচ্চাটা দেখে ঘেয়ো ডাক থামিয়ে লেজ নাড়িয়ে কুঁই কুঁই করে। তখন হুট করে সব স্ট্রিট লাইট নিভে গেলে শহরটা রাতের শেষে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে। ততোক্ষণে আঁধার গা ঝাড়া দিয়ে প্রস্থানের আয়োজন করতে লেগেছে কিন্তু দূরের জিনিসটি তখনো ঝাপসা। হঠাৎ মোহাম্মদ কাজলের মনে তখন আবার কু ডাকতে শুরু করে। রাতের শেষে যখন ঠান্ডা হাওয়ায় সবার ঘুম জমে উঠেছে তখন সে দুটো কুত্তা আর পাগলের সাথে আধেক ফোটা মানবের বাচ্চা নিয়ে আঁধারে মুখোমুখি হয়েছে। 

মোহাম্মদ কাজলের মনে ধুকপুক করে কু ডাকে। আধেক ফোটা এক মানবের বাচ্চা যেনো এই আঁধারে দাঁড়কাক হয়ে যাবে, না ওটা দাঁড়কাকই ছিলো যেনো চোখ মিথ্যে রায় দিয়েছে। তখন সরল হয়ে আসা আঁধারে পাগলটার চোখে চোখ পড়লে কইলজার ভেতরে তার আগুন জলের মতো ছ্যাৎ করে ওঠে। সেখানে যেনো ভৌতিকতা নয়, জ্বলজ্বলে পরিহাস ফুটে আছে। 




পরিচিতি
সুবন্ত যায়েদ
গদ্য ও গল্পলেখক
জন্ম : ২৯ নভেম্বর, কুষ্টিয়া

প্রকাশিত গ্রন্থ :
কতিপয় মৃত্যুপ্রকল্পের প্রাণ (গল্পগ্রন্থ, ঐতিহ্য)
মনোদৈহিক স্মৃতিবেদনারা (গল্পগ্রন্থ, ঐহিক)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ