নাহার তৃণা'র গল্প: নিঃসঙ্গ নগরে দ্বিখণ্ডিত চাঁদ

১. 
এমন ভয়ানক যানজট ঠেলে, বাস লঞ্চ ভ্যানগাড়িতে আছাড় খেতে খেতে ঈদের ছুটিতে কোন পাগলে দেশের বাড়িতে যায়? বিশেষতঃ যার কেউ নেই দেশের বাড়িতে। ছুটি তিন দিন, যাওয়া আসা দেড় দিন। আসা যাওয়ার ধকল সামলে হাতে থাকে কী?
এবার আমি ঈদে দেশের বাড়ি যাবো না। 

দেশের বাড়িতে কেউ নেই পূর্বপুরুষের সমাধি ছাড়া। একটা বাড়ি আছে যেখানে জীবনের একাংশ কেটেছিল, এখন সেগুলো স্মৃতির অবশেষ। জমিজমা যা ছিল সব বেদখল করেছে শুভাকাংখী নিকটাত্মীরা। বাড়িটা বেদখল হয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য বছরে একবার ঈদের ছুটি মাটি করে এতদূর পাড়ি দেবার কোন মানে হয় না। প্রতিবছর গেলেও এবার যাবোই না ঠিক করেছি। যানজট মুক্ত ঢাকা শহর দেখি না বহুকাল। যানজট মুক্ত ঢাকায় ঈদ কাটাবার জন্য গ্রামের বাড়ির মায়া ত্যাগ করলাম এবার। 

ঢাকা শহরে আমি একা থাকি। একটা চাকরী করতাম সেটা চলে যাবার পর নতুন একটা পেশা নিয়েছি যা কাউকে বলা যায় না। যে দালানে থাকি সেটা অনেক পুরোনো দিনের জমিদারের কাচারি ঘর ছিল। এখন তার আসল মালিক কেউ নেই। স্থানীয় এক প্রভাবশালী দখল করে ভাড়া তুলে খাচ্ছে। একতলায় একটা অফিস ঘর আছে। ওখান থেকে হোটেলের মতো পরিচালিত হয় ভাড়ার ব্যবস্থাপনা। খোপ খোপ করে ভাগ করা অনেকগুলো ব্যাচেলর ঘর। তিন তলা দালানটিতে কতগুলো খোপ আছে গুনে দেখিনি কখনো। লম্বা টানা বারান্দাটি ইউ শেপ নিয়ে ঘুরে গেছে। প্রতিটি ঘরের সামনে বারান্দার একটি অংশ আছে। আছে পলেস্তরা খসা মোটা মোটা থাম। ব্যাচেলর ঘর হলেও এখানে অনেক ছোট পরিবার ভাড়া নিয়ে থাকে। বহুতল বস্তিঘর বলা চলে এটাকে। সারাদিন হরেক রকম মানুষের ক্যাচক্যাচিতে কান ঝালাপালা। দিনভর ঘরে থাকি না বলে রক্ষা। রাতে এসে স্টোভ জ্বালিয়ে ভাত রান্না করি সাথে একটা ডিম ভাজা আর কাঁচামরিচ। কখনো আলুভর্তা। এই আমার প্রতিদিনের আহার। 

ঢাকা শহরে আমার সাড়ে সাত বছরের বসবাস কিন্তু এখানে কারো সাথে সময় কাটানোর মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এই শহরটাকে আমার কিছুতে আপন মনে হয় না। 

এবার ঈদে বাড়ি না যাবার সিদ্ধান্তের পেছনে আরেকটি কারণ আছে। সেই কারণটির পেছনে এক রহস্যময়ী নারী। কয়েক সপ্তাহ আগে এক তুমুল বৃষ্টির দিনে আমার পাশের খুপড়িটা ভাড়া নিয়েছে সেই নারী। 

আমি এই দালানের পুরোনো ভাড়াটে। এখানে সারাবছরই তেমন কোন খুপরি খালি থাকে না। কিন্তু কী এক কারণে আমার পাশের খুপড়িটা প্রায়ই খালি পড়ে যায়। কেউ এক মাসের বেশী টিকতে পারে না। তাই নতুন মুখ দেখলে আমি অবাক হই না। আর অবাক হবার সময়ই বা কোথায়। ভোরে যাই, রাতে ফিরি। বন্ধের দিন হয়তো কখনো একটু মুখ দেখাদেখি প্রতিবেশীদের সাথে। ওটুকুই, কারো সাথে পরিচয় ঘটে না প্রায়শই। 

আগের সব ভাড়াটে পুরুষ হলেও এই প্রথম একজন নারীকে দেখলাম খুপরিটা ভাড়া নিতে। নারী বলেই বোধহয় একটু বেশী মনোযোগ দিলাম প্রথম দিন থেকেই। 

বন্ধের দিন ছিল সেটা। আমি বাড়ির গেটের বাইরে টং দোকানের সামনে দাড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টানছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল- এক হাতে ছাতা, আরেক হাতে সিগারেট। মাথার উপর টিপটিপ বৃষ্টির ছাট নিয়ে একটা টেক্সি এসে দাঁড়ালো গেটের মুখে। ঠিক আমার সামনেই। টেক্সির পর্দা উঁচিয়ে একটা নারীকন্ঠ আমাকে ডাকলো - ভাই, ছাতাটা একটু দেবেন? 

বৃষ্টি পড়লে অচেনা কেউ ছাতা ধার চাইতে পারে এই অভিজ্ঞতা প্রথম। অদ্ভুত লাগলেও প্রয়োজনের চেয়ে দ্রুতগতিতেই যেন আমি ছাতাটা বাড়িয়ে দিলাম এবং নিজে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলাম। মেয়েটা টেক্সি থেকে নেমে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে গেটের ভেতরে যেতে যেতে বললো, এখুনি দিয়ে যাবো, ভাববেন না। 

আমি টং দোকানের চালের নীচে আশ্রয় নিয়ে সিগারেটের বাকী অংশ শেষ করতে করতে ভাবছিলাম কাজটা ঠিক হলো কিনা। 

কিছুক্ষণ পর মেয়েটা বের হয়ে এল ছাতা নিয়ে। ধন্যবাদ দিয়ে ছাতা ফেরত দিলে আমি সেই ছাতা নিয়েই বাড়ির গেটে ঢুকে পড়াতে মেয়েটা অবাক হয়ে পিছুপিছু এসে আমার ছাতার নীচে মাথা পেতে দিল। 

-আপনি, এখানে থাকেন নাকি? 

- হ্যাঁ। 

- আমি আজ নতুন এসেছি, ওই ঘরটি নিয়েছি। 

ইঙ্গিতে যে ঘরটি দেখালো সেটা আমার ঘর। আমি চোখ বড় করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ওটায় তো আমি থাকি। মেয়েটা তখন আবারো জানালো, আমিই তো নিলাম ঘরটা। তালা খুলে ব্যাগ রেখে এলাম এইমাত্র। 

তারপর দুজনে দালানের বারান্দায় প্রবেশ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে যেখানে এলাম সেটা আমার ঘরের দরজা ঠিকই, কিন্তু তার পাশের দরোজাই মেয়েটার ঘর। এবার দুজনে হেসে দিলাম যেন এক মজার ব্যাপার। 

এভাবেই শুরু। 

আসলে কিছুই শুরু হয়নি। সবটাই আমার মনে মনে। সেদিন থেকে আমি ভীষণ কৌতুহলী হয়ে পড়লাম মেয়েটার ব্যাপারে। কী করে জানতে চাইলে মেয়েটা সাফ সাফ বলে দিল ব্যক্তিগত কোন প্রশ্ন করা যাবে না। শুধু নামটি জানালো - শায়লা। 

শায়লার সাথে মাঝে মাঝে আমার রাতেই দেখা হয় অফিস থেকে ফেরার পর। আমার ডিম ভাজার গন্ধ পেলে ঘরে উঁকি দেয় -আজকেও ডিম ভাজা? প্রতিদিন এক জিনিস কিভাবে হজম করেন? 

আমি হাসি। মেয়েটা আমার খাবারের দিকে নজর রেখেছে ভাবতে ভালো লাগে। আশা করতে থাকি প্রতিদিন ডিম খেতে দেখে সে নিশ্চয়ই কোন এক সুস্বাদু খাবার রান্না করে আমাকে দিয়ে যাবে। এভাবেই তো শুরু হয়। মনে মনে কিঞ্চিত সম্ভাবনার রোমাঞ্চ দেখা দেয়। খুব গোপনে প্রতীক্ষা করি কবে সেই খাবারের বাটি আসে। ডিম ভাজার সময় ইচ্ছে করেই দরোজা খুলে রাখি আজকাল। কিন্তু সেই বাটি আর আসে না। মেয়েটার সৌজন্য হাসি ছাড়া আর কিছুই আগায় না। 

দুয়েকদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প হয়েছে ঘুমোবার আগ পর্যন্ত। যখন অন্য খুপড়ির সবাই ঘরে ঢুকে যায়, বারান্দাটা একলা হলেই মেয়েটা বাইরে আসে। বারান্দায় কোন আলো নেই, কখনো ছিল না। দূরের রাস্তার বাতি যতটা আসে। নিঝুম বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা আকাশ দেখে। আমাকে দেখে বললো, অরিয়ন চেনেন আপনি? ওই দেখেন ওই পিলারের ডানদিকে একটু উঁচুতে। 

আমি আকাশের গ্রহনক্ষত্র কিছুই চিনি না। তবু এমন ভাব করি যেন সব জানা। যা করলে মেয়েটা খুশী হয় তাই করি। মনে মনে মন গলানোর চেষ্টা। 

ঈদের ছুটির কয়েকদিন আগে শায়লা হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো, ঈদের ছুটিতে আপনার প্ল্যান কী? আমি দেশে যাবার কথা বললে সে উদাস হয়ে বললো, আমার কোন দেশ নেই। আমি এখানেই থাকবো। এ..কা। 

একা কথাটি একটি টেনে জোর দিয়ে বললো যেন। তারপর চুপ হয়ে গেল। মেয়েটা একা, এই কথাটা আমার বুকের কোথাও বিঁধলো। আমি মনে মনে বললাম, আমিও একা। শায়লা হঠাৎ করে আমাকে প্রস্তাব দিয়ে বসলো, যদি ছুটিতে দেশের বাড়িতে না যান তাহলে কী খুব অসুবিধা হবে? 

যেন এই কথাটি শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। বললাম, আমি আসলে গ্রামে যেতে পছন্দ করি না। আমার কেউ নেই সেখানে। 

বেশ! তাহলে আপনিও থাকুন, আমিও থাকি। দুজনের ভাল সময় কাটবে। 

আসন্ন রোমাঞ্চের সম্ভাবনায় আমি অতিমাত্রায় শিহরিত হয়ে উঠলাম। সেটাকে চেপে রাখার জন্য সিগারেট ধরালাম। শায়লার কথা শুনে আমি ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাবার কথা একেবারেই বাতিল করে দিলাম। 

এরপরের দিনগুলো ফুরফুর করে উড়ে চললো। ঈদের ছুটিতে ঢাকাবাসী সব গ্রামের দিকে ছুটলো। এক এক করে আমাদের আশেপাশের প্রায় সবগুলো খুপড়ি খালি হয়ে গেল। ঈদের আগের সন্ধ্যায় নতুন চাঁদ ডুবে যাবার পর নিঝুম নিস্তব্ধতা নামলো বাড়ির চত্বর জুড়ে। গেটের কাছে যে টং দোকান ছিল তাও বন্ধ করে গ্রামে চলে গেছে দোকানী। আশেপাশে আর কোন দোকানপাট নেই তেমন। গলির মুখে যেতে হবে কিছু কিনতে হলে। শায়লা বলেছে ঈদের রান্নার সব কেনাকাটা সেরে ফেলেছে সে। আমার কিছুই করতে হবে না। 

দু কাপ চা বানিয়ে আনলো শায়লা। অন্ধকার বারান্দায় বসে দুজনে আকাশের তারা দেখছি। কী অপূর্ব একটা সময়। আমার জীবনে আর কখনো এত সুন্দর রাত আসেনি। শায়লা ওর জীবনের গল্প বলতে শুরু করে নিজ থেকেই। 

গল্প শুনতে শুনতে আমার কেমন একটা ঝিম ধরে যায়। আমি চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শায়লা আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। এরপর আমার আর কিছু মনে থাকে না। 

২. 
পরদিন ঘুম থেকে উঠে আমি রাতের ঘটনাটা বুঝতে চেষ্টা করলাম। শায়লা কোথায়? আমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল মেয়েটা চায়ের সাথে। মেজাজ খারাপ করে দরোজা খুলতে গেলাম, দরোজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ। আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত মেয়েটা আমাকে আটকে রেখে সব নিয়ে পালিয়ে গেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে আমার জিনিসপত্র চেক করতে লাগলাম। টাকাপয়সা খোয়া গেছে কিনা। সেদিনের জিনিসটা তোষকে নীচে একটা বাক্সে রাখা, ওটা ঠিক আছে কিনা। না, সবই ঠিক আছে। কিছুই খোয়া যায়নি। তাহলে আমাকে আটকে রাখার মানে কী? 

আজ ঈদের দিন। এভাবে ঈদের যাত্রা শুরু হবে কে ভেবেছিল। কী ফাঁদেই না পা দিয়েছিলাম আমি। এখন তো এখানে কেউ নেই। চিৎকার দিলেও কেউ আসবে না। আমি দরোজায় লাথি মেরে ভাঙতে চেষ্টা করলাম। কয়েকটা লাথি দিতেই দরোজার কবজা একটু নড়ে উঠলো। কিন্তু পুরোনো আমলের শক্ত কাঠের দরোজা। ভাঙ্গা সহজ নয়। হঠাৎ বাইরে শায়লার গলা। 

-কী হলো, দরোজা ভেঙ্গে ফেলবেন নাকি? 

মনে মনে গালি দিয়ে উঠলাম। দরোজা না আজকে তোকেই খুন করে ফেলবো। তুই আমাকে বোকা পেয়েছিস? 

-জলদি খোলেন দরোজা। চিৎকার করে বললাম আমি। আতংকে আমার গলা আরো বেড়ে গেছে যেন। 

শায়লা দরোজা খুলে দিলে আমি এক লাফে বাইরে গিয়ে গলা টিপে ধরলাম ওর। আজকে তোকে খুনই করে ফেলবো শয়তান। তুই আমাকে আটকে রেখেছিস কেন? 

শায়লা এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল কী এক কৌশলে। 

তারপর বললো, আপনি পাগল হয়েছেন নাকি। রাতে ওভাবে ঘুমিয়ে পড়বেন কে জানতো। আপনাকে রুমে রেখে আমি তো বিপদেই পড়লাম। দরোজা বন্ধ করি কী করে। পরে বুদ্ধি করে আমার তালাটা আপনার দরোজায় লাগিয়ে আমি ঘরে গিয়ে ঘুমালাম। কী সব প্ল্যান করে রেখেছিলাম। দিলেন তো সব মাটি করে? আমার সাথে এমন ব্যবহার করার জন্য আমি এখনি আপনার সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করলাম। আপনি আর কখনো আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না। 

তখনো আমি রাগে কাঁপছি। ওর কোন কথাই মাথায় ঢুকছে না। রাগ আর ভয়ে আমার বুকের ভেতরটা ঢুকপুক করছে ভীষণভাবে। 

ঘরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিলাম। ঈদটাই মাটি হয়ে গেল এই বজ্জাত মেয়েটার জন্য। ঢাকা শহরে আগামী দুদিন কিভাবে কাটাবো সেটা ভাবছিলাম। বাজার সদাই কিছুই করিনি। দোকানপাট সব বন্ধ। ঈদের সময় খাবার হোটেলও থাকবে না হয়তো। 

খানিক পর ঘরের দরোজা খুলে বের হলাম। শায়লার ঘরের দরোজা খোলা। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি মেঝেতে বসে বিছানায় মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অবাক হলাম। এমন দৃশ্য কল্পনাও করিনি। তাহলে কী আমি ভুল করলাম মেয়েটাকে সন্দেহ করে? এবার আমার সন্দেহের জন্য দুঃখিত হতে শুরু করলাম কিছুটা। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কাছে গিয়ে সরি বলবো? 

আমার পায়ের শব্দ শুনে শায়লা চোখ তুলে তাকালো। খুব মায়া লাগছে ওকে দেখে। গলায় দাগ বসে গেছে আমার আঙুলের। বেচারী সত্যিই হয়তো আমার উপকারই করতে গিয়েছিল দরজায় তালা দিয়ে। কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কেন? 

৩. 
আমি শায়লা। আমাকে এই শহরে কেউ চেনে না। আমার পেশা কাউকে বলি না। আমাকে পেশাগত কাজে জুয়েলারী মার্কেটে ঘুরতে হয়। দামী জুয়েলারী সংগ্রহ আমার নেশা। বড়লোকেরা আমার সহজ টার্গেট। তবে কখনো কখনো দোকান থেকেও সংগ্রহ করেছি। সেদিন এক বড়লোকের বউয়ের কাছ থেকে একটা জুয়েলারী সংগ্রহ করার জন্য পিছু নিয়েছিলাম। মোটামুটি যখন সব গুছিয়ে এনেছি, তখন এই লোকটা কোথা থেকে উদয় হলো, তারপর আমার সহজ টার্গেটকে সে শিকার করে নিল। 

তখন আমি বাধ্য হলাম শিকারীর পিছু নিতে। পিছু পিছু গিয়ে আমি শিকারীর ঠিকানা বের করে ফেলি। তারপর মাসখানেক পর কায়দা করে ওর পাশের ঘরটি ভাড়া নেই। শিকারীকে শিকার করার সব আয়োজন সম্পন্ন হবার পর রাতের ঘটনাটি ঘটলো। আমি চায়ের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অজ্ঞান করে ফেললাম। তারপর ঘরে গিয়ে সব তল্লাশী করে সেই হীরের আংটির সন্ধান পাই। আংটি নিয়ে তখনই সটকে পড়তে পারতাম। কিন্তু আংটির বাক্সটা বগলদাবা করে বেরিয়ে আসার সময় শিকারের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। 

আশ্চর্য এক ছায়া ওর ঘুমন্ত মুখটিতে। ওই মুখে আমার ভবিষ্যত যেন আটকে আছে। আমি পারলাম না। আবার ঘুরে আংটির বাক্সটা যথাস্থানে রেখে শিকারকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাইরে তালা দিয়ে চলে এলাম ঘরে। 

জীবনে প্রথম এমন ঘটনা ঘটলো আমি শিকার হাতছাড়া করলাম। এরপর সকালে যখন সে আমার গলা টিপে ধরেছিল তখন আমি মৃত্যুর ঘ্রাণের বদলে অন্য একটা ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম যেটার জন্য বহুকাল আমার প্রতীক্ষা করছিলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম জীবন বদলে ফেলবো। সিদ্ধান্ত নেবার সাথে সাথে আমার বহুকালের জড়ো করা ব্যথা বেদনা বঞ্চনা প্রতারণার কষ্ট একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি কান্না রোধ করতে পারলাম না। আমার অনেকদিনের সঞ্চিত কান্না বাধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসছে। 

আমি জানি না সে কতটা ক্ষমাশীল। তাই দরোজা খোলা রেখেছি। যদি কাছে এসে আমাকে শান্ত্বনা দেয় তাহলে আমি আবার সবচেয়ে বড় শিকারটিকে জীবনের সাথে জড়িয়ে নিতে পারবো। 

৪. 
আমি ঘরে ঢুকে শায়লার পাশে বসে পড়লাম মেঝেতে। নিঃসংকোচে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, - 'দুঃখিত শায়লা। আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। রাগের মাথায় অমন করেছিলাম। আজ তো আমাদের আনন্দ করার কথা ছিল। আপনি ঈদের রান্না করবেন। তারপর দুজনে একসাথে খেতে বসবো। তারপর.....' 

আমি মন ভোলানোর কায়দা করে বলছিলাম। যদিও তাতে আন্তরিকতার ছোঁয়া কম ছিল না। মেয়েটাকে কতটা বিশ্বাস করা যায় সেটা পরখ করার চেষ্টা। কিন্তু ইতিমধ্যে মেয়েটার জন্য আমার বুকের ভেতরে একটা জায়গা তৈরী হয়ে গেছে। সকালে গলা টিপে ধরার পর আমার হাতটা একটু অপরাধী হয়ে আছে। এখন ইচ্ছে করছে গলার পাশে চিবুকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেই। কিন্তু সেই সম্পর্ক আমাদের এখনো হয়নি। 

অশ্রুসজল চোখ তুলে শায়লা বললো - 'আমিও দুঃখিত জনাব। আসলে আমি গতকাল বাজারটাজার কিছু করিনি। আপনাকে মিথ্যে বলেছিলাম। আজকেই আমার চলে যাবার কথা ছিল এখান থেকে। ঘরে আজকে খাবার মতো কিছুই নেই। একটা পাউরুটির আধখানা আছে। আপনি চাইলে ওটা গরম করে চায়ে চুবিয়ে খাওয়া যায় দুজনে মিলে'। 

দমে গেলাম কথা শুনে। ঈদের দিনে বাসী পাউরুটি। তার উপর আবার চা? আমি তাড়াতাড়ি বললাম, - 'না না ঠিক আছে। আমার তেমন খিদে নেই। দোকান থেকে কিছু আনিয়ে নেবো। ঘরে কষ্ট করার দরকার নাই'। 

এবার শায়লা হেসে দিল- 'ভয় নেই। এবার ঘুমের ওষুধ দেবো না। আমি আপনার সাথে সন্ধি করেছি। অমন করে গলা টিপে ধরার পর আপনার বন্ধু না হয়ে উপায় ছিল না'। 

আমি শায়লার চোখে তাকিয়ে ভাবছি কোনটা সত্যি। হাসিটা নাকি কান্নাটা? মানুষ চেনা খুব দায়। শায়লাও আমার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। হয়তো একই কথা ভাবছে সেও। 

অবিশ্বাসের দেয়াল নগরজুড়ে তৈরী হওয়া ছুটির নিঃস্তব্ধতাকে যেন দ্বিগুণ ভারী করে তুললো।

---------------




লেখক পরিচিতি
নাহার তৃণা
গল্পকার। প্রবন্ধকার। অনুবাদক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ