ওরা যখন কলেজ থেকে বার হয়ে গঙ্গার ঘাটমুখো হল তখনই হাওয়া খানিক এলোমেলো বইছে। ভাঁটিখানা থেকে সদ্য বেরনো মাতালের চলনের মতো, বাঁদিকে যেতে যেতে হঠাৎ টলে যাচ্ছে ডানদিকে, পড়তে পড়তে সামলে নিচ্ছে নিজেকে। এইরকম উল্টোপাল্টা হাওয়া এসে মীনাক্ষী ওরফে মিমুর ওড়নার ভেতর ঢুকে পড়তে ফুলে উঠল সস্তা সিন্থেটিকের ফুলছাপ, কিন্তু সমীর সে দিকে ফিরে তাকালই না। ফিচেল হাসা তো দূরের কথা।
তারা যখন পাশাপাশি বসে রইল নির্জন ঘাটে তখনও তারা একই রকম নিস্তব্ধ, যেন খুব কাছের মানুষকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ দুই তরুণ-তরুণী, কে কাকে সান্ত্বনা দেবে জানে না। কাশী মিত্র ঘাটে তারা ইচ্ছে করেই যায়নি, ওখানে বড় ভিড়। প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে শুরু করে মা-শেতলার চাঁদা পার্টিরা। একদিন দেখে এইটুকু পুঁচকে এক বাঁদরছানার গলায় শেকল জড়িয়ে হুটোপুটি করছে তার মালিক। ছানাটা কখনও মালিকের কনুই জড়িয়ে ঝুলছে, কখনও কাঁধের ওপর। মিমু আর সমীরের ছাতাপড়া মুখ আর সস্তা হাওয়াই চটি দেখে চাঁদাওয়ালারা বেশি ঘাঁটায়নি সেদিন, মনও এত খারাপ ছিল না দু’জনের। তাই সমীর মিমুর মোটা বিনুনিটা হাতে জড়িয়ে আস্তে আস্তে বলেছিল, ‘ভাল হয়ে যাবি। শংকর বলছিল, বজবজের দিকে এক কালীসাধক নাকি খুব জাগ্রত।’
মিমু উত্তর দেয়নি। যেমন সরকারি হাসপাতালে, তেমনই ঝাড়ফুঁকের আড্ডায়, কোথাওই তার অভিজ্ঞতা সুখের নয়। বরং এই যে সূর্য ডুবছে, হলুদ, কমলা, লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ছে লঞ্চের নিচে পেষাই হওয়া ঢেউগুলোর গায়ে, সেদিকে তাকিয়ে একটা শিরশিরে শান্তি তাকে এমনই অধিকার করে নেয় যে, বাঁদরওয়ালা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখেও সমীরের হাত সে সরিয়ে দিতে পারে না। সমীর তার বেণী ধরে আস্তে আস্তে টানে আর মিমুর মাথা নুয়ে পড়তে থাকে তার কাঁধে। ওপারের বেলুড় মঠ এইরকম একটা দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে। জলের ওপর গাঢ় ছায়া ফেলে ডিঙি নৌকোগুলো সাঁ-সাঁ করে সরে যায় অন্ধকারের দিকে। আজ যে নির্জন ঘাটে এসে বসেছে তারা, সেটার ঘাটলায় এক অচেনা দেবীর বারো-তেরো হাত মূর্তি। থেবড়ে বসার আগে সমীর ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে চেনার চেষ্টা করে। গঙ্গাদেবীই ইনি, মকরপৃষ্ঠে আসীন বিরাটস্তনী নারীটিকে দেখে সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। তারপর ব্যাগের আড়ালে বুকের কাছে হাত তুলে বিড়বিড় করে, ‘হে মা গঙ্গা, মিমুকে ভাল করে দাও।’ সময় নিয়ে করুণ একটু হাসি খেলতে দেয় সে নিজের ঠোঁটে, কারণ মিমু আস্তে আস্তে ভরে ওঠা নদীর দিকে চেয়ে সারাক্ষণই চুপ করে বসে আছে। এত চুপ যে, পেছন থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসের তালে তালে তার পিঠের ওঠানামাও টের পাওয়া দুষ্কর। শুধু ঠান্ডা হাওয়ায় কানের ওপর দিয়ে চুল ওড়ে।
আরও কতক সিঁড়ি ডিঙোয় সমীর, সাবধানে পাশ কাটায় ঘাটলায় পড়ে থাকা কুষ্ঠরোগীর মতো অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তির। রোদজল কাউকে নগ্ন করে দিয়েছে, কারও শরীর গলে গলে পড়ছে, কেউবা কাত হয়ে পড়ে আছে অকথ্য জঞ্জালের ওপর। কেন এইগুলিকে জোয়ারের জলে ভাসিয়ে দেয় না কে জানে। তা হলে হয়তো ঘাটে এত গন্ধ হত না।
এই পূতিগন্ধময়তার মধ্যে এসে বসবার গূঢ় কারণটি মনে পড়তেই সমীরের প্রচণ্ড শীত করে ওঠে। যেন তার গায়ের প্রত্যেকটি রোম দাঁড়িয়ে যায়, দাঁতে দাঁত লেগে মৃদু আওয়াজ ওঠে। দুই হাত কনুই থেকে ভেঙে নিজেকে আঁকড়ে ধরে সে, যেন এখনই হুমড়ি খেয়ে এতগুলো ধাপ গড়িয়ে তার সলিলসমাধি হবে। কোনওরকমে গড়িয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে মিমুর পাশে। তার বসার ধরনে মিমু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘ভয় করছে সমুদা ?’ তার জিজ্ঞাসা করবার ভঙ্গি এমন নিস্পৃহ, ভয় না করে উপায় নেই। তবু প্রাণপণ অস্বীকারের মধ্যেই মিমু আবার বলে, ‘সমুদা, তুমি বাড়ি যাও। আমি তো আগেই বলেছিলাম।’ ‘তোকে এইখানে একা ফেলে আমি বাড়ি যাব! তুই কি পাগল হয়েছিস! যা হয় দু’জনের একরকম হবে।’
‘একরকম সবসময় হয় না, সমুদা। আমরা ছোটবেলা থেকেই একসাথে থাকতে চেয়েছি, এক কলেজে ভর্তি হয়েছি, তুমি আগের বছর, আমি পরের। লাগোয়া ঘর বলে এক খাবার ভাগ করে খেয়েছি প্রায়ই। এক সিনেমা দেখেছি, এক গান শুনেছি, এক ইয়ারফোন শেয়ার করেছি। একদিকটা তুমি, অন্যদিকে আমি। অথচ…’
মিমুর মুখের কথাগুলো কেড়ে নেয় সমীর, ‘অথচ তোর একার হল এই মারণ রোগ, ব্লাড ক্যান্সার, লিউকেমিয়া। কই আমার তো হল না! কেন হল না মিমু!’
নিজের আর্তস্বরে নিজেই চমকে ওঠে সমীর। কী পাখি এইগুলো জানে না সে, চমকে জল ছুঁয়েই ওপরে উঠে যায় যেন সমীরের কান্নাকে ভয় পেয়ে। এদের কালো লম্বা পাখা, মসৃণ আর উজ্জ্বল। পড়ন্ত সূর্যের ছোঁয়ায় আরও উজ্জ্বল সেইসব ডানার ঝাপটায় জল ছিটকায়, স্লো মোশনে অশ্রুবর্ষণের মতো নদীর গাল গড়িয়ে নামে পালকচ্যুত শীকরবিন্দু। তারপর বিন্দু আর সিন্ধু এক হয়ে বয়ে চলে।
আসলে জীবনের এই ধাপে আবেগ বড় টাটকা, প্রাণবন্ত। অল্প আঁচেই উথলে ওঠে। তার আর মিমুর বাবা হাতিবাগানের পাশাপাশি হকার, বস্তিতে জল নেবার লাইনে আগেপিছে দাঁড়ায় তাদের মায়েরা, এসবের মধ্যেই বড় হয়ে ওঠা ছেলেমেয়ে দুটো কখন মোবাইলে গান শুনতে শুনতে, নাকি ছোটখাট রান্না আদানপ্রদানকালে ঠান্ডা স্টিলের বাটির নিচে অতর্কিতে আঙুলে আঙুল জড়িয়ে গেলে পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায়। সেই প্রেম থেকে আর ওঠা নেই। কালিদহে ঘূর্ণির টানে শুধু তলিয়ে যাওয়া। যদিও এ শহরে প্রেম লালনপালনের কোনও জায়গা নেই। সবখানে চোখ, মাস্তান আর পুলিশ। তবু চরাচরে নদীর ঘাট থাকে, গ্রীষ্মে ছাতার আড়াল আর পুরনো সিনেমা হলগুলোর অন্ধকার। মীনাক্ষী আর সমীর অবিচ্ছেদ্য হয়ে এই সব জায়গায় ক্লাসের পর লেপটে বসে থাকে। যতদিন না রক্তে কর্কটের দাঁড়ার বিষ মিমুকে নীল করে দেয়।
চিত্তরঞ্জনে একটা কেমোর জন্য যে লাইন, তাতে মিমুর পালা আসতে আসতে ছ’মাস। রাজারহাটে ছুটেছিল সমু টাটা ক্যান্সার হাসপাতালে। খরচ কয়েক লক্ষ টাকা। মিমুর মা-কাকিমা চোখে আঁচল চাপা দেয়, ‘তোর যা যা করার পচুর করেছিস বাপ। এখন মিমুর কপাল। তোর কাকু আর আমাকে বিক্কিরি করে দিলেও ওই টাকা উঠবে না। একটাই সন্তান! দেখি, হেলাবটতলার দিকে নাকি এক ফকির তাবিজ দেন। তার কাছেই…’
হাতেপায়ে জোর ছিল না, তাই শনি মন্দিরের চাতালে ধপ করে বসে পড়েছিল সমীর। শনিবার বলে সাপের মতো ভিড় এঁকেবেঁকে গেছে বড় রাস্তা অব্দি। কত কিসিমের মানুষ। গাঁদা আর অপরাজিতার মালা কালো মূর্তির গলায়। সামনেই ঢাউশ প্রণামীর বাক্স। গিলে নিচ্ছে যে যা দিচ্ছে। দশ বিশ হরদম, একশোও ঢোকাতে দেখল সমীর। হলই বা বস্তির শনি, এ দেবতার দাপট খুব। মনস্কামনা পূর্ণ, বশীকরণ, শত্রুনিধন সব কিছুই অল্পবিস্তর করে থাকেন ইনি। শুরু শুরুতেই মানসিক রেখেছিল দু’-দুটো ফ্যামিলি মিমুর আরোগ্য চেয়ে। কিছুই হল না, তবু মিমুর মা-কাকিমা দু’বেলা মাথা খোঁড়েন এখনও। প্রণামীর বাক্সে যা পড়বে তা নেবে কাউন্সিলরের কাছের ছেলেপুলেরা। কিছু ডাইরেক্ট ভাগ হয়, ব্যাঙ্কে কিছু জমা পড়ে, তাই দিয়ে বাৎসরিক হল্লার মাইক, ডেকোরেশন আইটেম, মায় থেকে থেকে বিরিয়ানি আর বোতলের খরচ আপসে উঠে যায়। সমীরের মা ঢাউস পেতলের ভোগ-বাসন মাজে আর দিনান্তে মোজাইক করা মেঝেতে ছিটকানো খুচরো পয়সা কুড়িয়ে আঁচলে বাঁধে। ওগুলো পুজোর যোগাড় দেওয়া, বাসন সাফা করবার বাবদে তারই পাওনা। পার্টির ছেলেরাও কখনও পয়সার হিসেব চায় না। এদের দিল-দিমাগ খুব চওড়া। ঠাকুরদেবতাকেও মান্যি করে। আর তাই ফুটপাত সুন্দর করার জন্য সব হকার ভ্যানিশ হয়ে গেলেও, শনি মন্দিরগুলি থেকেই যায়, এক থেকে দুই, দশ থেকে বিশ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা মহল্লায়। যত কাঁচাখেগো, তত প্রণামী। তত টুনি আর মাইক। আর মদ, কখনও মেয়েমানুষ।
মায়ের আঁচলের গেরোটা কত ভারি হয়ে ঝুলে পড়ে মেনির বাচ্চাভরা পেটের মতো, সেদিন তা দেখার ইচ্ছে চলে গেছিল সমীরের। সে একদৃষ্টে দেখছিল ওপচানো প্রণামীর বাক্স। আর তাকে দেখছিল বাঘা আর রামুয়ার লাল চোখ। রাত ন’টা নাগাদ ভিড় একটু কমলে তারা ঘিরে ধরল সমীরকে। ‘কী বে, এতক্ষণ হল ঠায় বসে আচিস কেন একেনে ?’
সমীরের হুঁশ ফেরে। রামুয়ার হাতেপায়ে ধরে সব বলে, নানা টিটকিরি সয়ে কাউন্সিলরের কাছে পৌঁছানো গেলেও খুব সুবিধে হয় না। সরকারি হাসপাতালে তদবিরের চিঠিও ফাইলের তলে চাপা পড়ে থাকে। এত অসুস্থ মানুষ লাইনে!
ওরা যদি দু’হপ্তার প্রণামী তাকে দিত, হয়তো কিছু হত। সমীর অনেকদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ভেবেছে। কিম্বা কিছুই হত না। কত টাকা পড়ে শনিবার করে, পার্টির ছেলে ছাড়া কেইবা জানে! মা দেদার নাক ডাকে, মিমুদের ঘরের দিক থেকে খুটখাট আওয়াজ আসে। মেয়েটা যন্ত্রণায় সারারাত ঘুমোতে পারে না। হয়তো সেইই উঠে পড়েছে। আর ঘুম আসে না সমীরের। সকালের প্রথম ট্রাম ডিপো থেকে বেরোচ্ছে, তন্তুজের ছাদে হেলান দেওয়া নিমডালে বসে কাকের ঘুমভাঙা গলায় ডাক, এইসব আওয়াজ কানে যেতে সে শেকল খুলে সাইকেল বার করে উল্টোডাঙায় খবরের কাগজের বান্ডিল তুলবে বলে। ভোরের হাওয়া কানের লতিতে খুব একচোট আদর করে। তাই কয়েকদিনের মধ্যে এই প্রথম সমীর প্রণামীর বাক্স, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, কেমোথেরাপির কথা ভুলে বাঁই-বাঁই সাইকেল চালায়। উল্টোডাঙায় ক্যাপিটালের সামনে এখন ঢেলে পড়ে আছে তাজা খবরের কাগজের স্তূপ।
মিমু ওরফে মীনাক্ষীর গায়ের রং চাপা, কোঁকড়া চুলে পানপাতা মুখের পাশগুলো ঢাকা আর চোখদুটো শান্ত কিন্তু উজ্জ্বল। সমীরের লম্বা পেটা শরীর, লোহা হজম করে দিতে পারে বলে তার বারফট্টাই। কেউ তাদের বলে থাকবে, তোদের দু’জনকে পাশাপাশি ভারি মানায় রে, সেই আহ্লাদে ডগমগ হয়ে তারা বহুদিন ক্লাস পালিয়ে পাশাপাশি বসে থেকেছে গঙ্গার নানা ঘাটে। উত্তর কলকাতার এই কলেজ থেকে গঙ্গা হাঁটাপথ। শীতের রোদে চারদিক ঝলমল করে যেদিন, পরস্পরকে মুখফুটে কিছু বলবার আগেই তারা দেখে দু’জনে ঘন হয়ে বসে আছে নদীর ধারে সিঁড়ির কয়েক ধাপ নিচে। যেদিন ভিড়, সেদিনও গিটার নিয়ে কেউ গান গায়, গাঞ্জার নৌকা শহরতলি যায়, ‘ও মীরা বাঈ…’
মিমু বাইরে শান্ত হাসে, কিন্তু সমীরের শক্ত পাঞ্জায় তার ঘেমো হাত ছটফট করতে থাকে। কিন্তু আজকের মতো নির্জন বিকেল তাদের স্বল্পায়ু যৌথ জীবনে কখনও আসেনি। মিমুর চোখের দিকে তাকিয়ে সমীরের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠেছে। সেখানে কী গভীর প্রতিজ্ঞার আগুন। এই ব্যথায় বিকল শরীর নিয়ে আর সে ফিরতে চায় না। আজই সব শেষ হোক। এই প্রিয় নদীতে, প্রিয় মানুষের সামনে জরাভার ফেলে দেওয়া, নতুন হয়ে ওঠা আদৌ হবে কি না সঠিক না জেনেও তার হননেচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। ভয়টয় যা ছিল অনবরত ঝাঁকুনি মেরে তাকে গাঞ্জার নৌকোয় ভাসিয়ে দাও, সোনা। ও মিমুবাঈ, তোমার মনে এই ছিল!
এমন নয়, তারা দু’জনে অনেক ঝগড়াঝাটি করেছে, একজন আরেকজনকে বোঝাবার তুমুল চেষ্টা করেছে। তবু চোখের ঘূর্ণন, ঘাড় কাত হওয়া বা হাতের আঙুলের নড়াচড়া দেখে একজন বুঝে নিয়েছে আরেকজনকে। সমীর বুঝে নিল তার মিনতি ফুৎকারে উড়িয়ে মিমু তৈরি হচ্ছে জোয়ারের জন্য। আর সমীরের ভেতরটা থিরথির করে কাঁপছে, যেমন কাঁপে ছিঁড়ে যাওয়া প্রজাপতির পাখা। ‘প্লিজ মিমু… ’ ‘আর ছ’মাস পরে কী করবে! সেই তো আমাকে কাঁধে তুলতেই হবে হে সমীরচন্দ্র!’ ‘সে যখন হবে হবে। ছ’মাসে কত কী ঘটে।’ ‘কী ঘটে, কী ঘটে ? হেলাবটতলা সাধুবাবার তাবিজের এত জোর বুঝি ? ব্লাড ক্যান্সার ভাল হয়ে যায় ?’ ‘তবু…’ ‘কোনও তবু নেই গবুচন্দ্র। তুমি ফিরে যাও হে শ্যাম। আমি এই বিজনে দু’কূল হারাব।’ বৈষ্ণব পদাবলির টুকরোটাকরা গুঁজে যাচ্ছিল এই নিঃশব্দ বাক্যালাপে। কলেজে প্রথম বর্ষের সযত্ন চয়ন।
কিন্তু সমীরের শুনতে ভুল হল না পায়ের নিচের সিঁড়িতে ছলাৎছল। জোয়ারের জল উঠে এসেছে, ঢেউ ক্রমে চঞ্চল হচ্ছে। সূর্য গাঢ় কমলা রঙের মেকআপ বক্স উপুড় করে দিয়েছে জলের গায়ে। যেদিন ভুল করে দুর্গাচরণ মিত্র লেনে ঢুকে পড়েছিল কলেজফেরত তারা, সেইদিন দেখেছিল অল্প আলোয় পরমাসুন্দরী মেয়েরা ওইরকম কমলা রঙে সেজে কেমন গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এদিক-সেদিক। ঝলমল করছে তাদের নাকের ফুল, কানের অলংকার, মোবাইলের কেস। পালিয়ে বাঁচার আগে চপের দোকানের সামনের লম্বা মেয়েটা তাদের গালি দিয়েছিল। ফুলে উঠেছিল তার নাকের পাটা, কুঁজো হয়ে জুতো ঠিক করবার সময় তার বুকের গাঢ় খাঁজ দেখে কেঁপে উঠে মিমুর হাত চেপে ধরেছিল সমীর। আজ এত কমলা রং জলে ছড়ানো দেখে কেন সেই কথা তার মনে এল কে জানে। যেন কমলা রঙে আঁকা দুই ছবি, এই নদী আর নদীর মতো মুখর, সুন্দর সেই মেয়েরা!
কিন্তু নদী ক্রমশ আরও দুর্বোধ্য, আরও স্ফীত, আরও নাদময়ী হয়ে উঠছে। চঞ্চল হচ্ছে মিমুও। আরও অসুস্থ লাগছে তাকে। পানপাতা ভেঙেচুরে যাচ্ছে কান্নার দমকে। বড় অসহায় এই কান্না, চূড়ান্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই অর্থহীন বিলাপ ! সমীরের মতো এক বিশ বছুরের সাধ্য কী এই বিশুদ্ধ শোককে ধারণ করে!
মিমু এবার উঠে নদীর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। যেন তার চোখ জুড়ে থাকে প্রেমিকের অবয়ব। সেই সমুদা, তার সমস্ত আনন্দবেদনার সঙ্গী। তার প্রতিমুহূর্তের বন্ধু, প্রেমিক। সব কষ্টযন্ত্রণার সমুদ্র পার হয়ে এই দ্বীপেই ফিরে আসতে চেয়ে একটি পা সে নামিয়ে দিল পরের ধাপে। হিমজল মুহূর্তে পায়ের পাতা কামড়ে ধরল। তবু মিমুর ভাল লাগছিল। শরীরে তার এত জ্বালা! কুর্তার লম্বা হাতার নিচে যেন পুড়ে গেছে এমন দুটো কালো হাত, নখগুলো সব নীল হয়ে গেছে। জলের গ্রাসে না গেলে এই জ্বালা যেন কমার নয়।
কপালে ঘাম বিনবিন করছিল সমীরের। মিমুর পেছন পেছন নিশিডাকের মতো এসেছে সে। এত নির্জন ঘাটে এসে বসা ঠিক হয়নি। চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। তাকে তো ঝাঁপ দিতে হবেই। সাঁতারে সে খুবই পটু। শুধু ভরা গঙ্গা তাকে কতটা লড়াই করবার সুযোগ দেবে এই নিয়ে একটু সন্দেহ। তারা মাঝনদীতে তলিয়ে গেলে ঘাটে পড়ে থাকবে এই ব্যাগ দুটো, বইখাতা, দুটো সস্তা মোবাইল।
মিমু এবার দুটো পা নামিয়ে দিয়েছে পরের পরের ধাপে। জল প্রায় কোমর হয়ে এল। খুব শান্ত তার দৃষ্টি সমীরের মুখের ওপর স্থির হয়ে আছে। একটা পাথুরে জেদ সারাশরীরকে শক্ত করে রেখেছে। মিমুর দিকে সতর্ক দৃষ্টি গেঁথে রেখে সমীর তার মাথার পেছনে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল। নদীর ফুলে ওঠা পেটে গোল ঘূর্ণির মতো চক্র ফেটে ফেটে যাচ্ছে। কচুরিপানার হেলতেদুলতে ভেসে যাওয়া আর দূর থেকে ভেসে আসা কোনও জলযান।
কী ভেবে পকেট থেকে সাদা রুমালটা বের করে মাথার ওপর ঘোরাতে থাকে সমীর। হয়তো মিমুকে অন্যমনস্ক করে দেবার অছিলা। এইবার দুটো হাত বাড়িয়ে সাবধানে এগিয়ে আসে মিমুর দিকে, ‘মিম, দাঁড়া দাঁড়া। দু’জনে একসাথে ঝাঁপ দেব। আর একপাও পেছোবি না। যা হবে আমাদের সওব একসাথে। এ-ক-সা-থে।’ কেটে কেটে উচ্চারণ করে সমীর। ঝটিতি দুই হাতে বেঁধে ফেলে ভুগতে থাকা দুবলা জেদি মেয়েটার অবশ শরীরটাকে। জল মিমুকে আরও হাল্কা করে দিয়েছে। তাকে একহাতেই বুকে লেপ্টে রাখা যায় এখন। মিমুর পায়ের পাতা ল্যাতপ্যাত করে জলের ওপর আর তার কোঁকড়া চুলে ঢাকা মাথার পেছনে এলোমেলো হাওয়ায় সমীরের হাতে ওড়ে সাদা রুমাল। ডেনজার, হেল্প, আরজেন্ট। মিমুকে আঁকড়াবার আগেই জল পুলিশের লঞ্চটা তার চোখে পড়েছিল। নদীতে ঝাঁপ দেবার কেস খুব বেড়ে গেলে এদের টহলও বেড়ে যায়। বিশেষ করে জোয়ারের সময়। রুমালি ইশারায় সেটা এখন জল কেটে তরতর করে মিমু-সমুর দিকেই আসছে।ছ’মাস লড়াই করবার জন্য অনেক সময়।
0 মন্তব্যসমূহ