সম্ভবতঃ সব ভূতেরাই জানত যে ডুগ্গু ভান একজন রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার ছিল। ওরা তাকে ভয় পেত না কিন্তু মাঝরাতে সে যখন এক বিশেষ ক্ষণে তার কবরখানা থেকে বের হত, ওরা তাকে পথ করে দিত। তখন সে পুরোনো প্রাসাদের মধ্যে তার প্রিয় খাবার খুঁজতে যেত। ডুগ্গু ভানের মুখটা সুন্দর ছিল না। ১০৬০ সালে একটি শিশু মারা যাবার পরে হাতে হন্ডা ড্যাগার নিয়ে সে যে রক্ত চুষে ছিল, তার গা বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ত। কাঠ জলের তলায় অনেকক্ষণ ধরে ভিজলে যেমন হয়, তেমনই হাল্কা স্বচ্ছ তার ত্বক ফুঁড়ে সেই রক্ত যেন গড়িয়ে পড়ত। সে মুখে একমাত্র জীবন্ত ছিল তার চোখ। লেডি ভান্ডার শরীরে থাকা স্থির ঘুমন্ত চোখদুটো যেন বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা কোন শিশু যে তার হালকা শরীরটা ছাড়া কিছুই চেনে না।
হাঁটার সময় ডুগ্গু ভান কোন আওয়াজ করত না। জীবন মৃত্যুর মিশ্রণ কে সে তার মনে মনুষ্যোচিত ভাবে বিশ্লেষণ করত। গায়ে তার নীলরঙা পোশাক। গুমোট পচা গন্ধের একটা নিস্তব্ধ পরিমণ্ডল, জমাটবাঁধা রক্ত খুঁজতে প্রাসাদের দেহলির পাশ দিয়ে যেতে থাকার শীতল পরিশ্রম তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলত। ঘুমন্ত লেডি ভান্ডা, একটা হাত চোখের ওপরে যেন বিষাদের আগাম সংকেত, যেন কোন কবজ দুম করে ঢিমে আঁচের মত হয়ে গেছে, যেন কোন উঠোনে থাকা পাথরের এক মানানসই নারীমূর্তি।
তার ব্যবহার এতই প্রশংসনীয় ছিল যে কাজ সারার আগে ডুগ্গু ভানের সম্পর্কে এমন কিছু ভাবাই যেত না। ঘরের ভেতর লেডি ভান্ডার বিছানার ঠিক পাশে, তার পোকায় খাওয়া পাতলা হাত লেডির ছন্দময় স্থাপত্যের মত শরীর জুড়ে নগ্ন করতে করতে রক্তের তৃষ্ণা তার কমছিল। ভ্যাম্পায়ারেরাও যে প্রেমে পড়ে সে ব্যাপারটা উপকথায় লুকোনো থাকে। এ বিষয়টা যদি সে ভাবত তাহলে তার চিরাচরিত অভ্যাস সে ওখানেই থামিয়ে দিত। সেটা বোধহয় তাহলে ভালোবাসার সীমানায় এসে স্বাস্থ্যকর ও শক্তিবর্ধক রক্তপান বন্ধ করে দেওয়া হত। তার জন্য অন্য কোন লেডি ভান্ডা ছিল না যে ডুগ্গু ভানের একত্রীকরণের সিরিজের অন্তর্ভুক্ত কোন এক শিকার মাত্র। একটা লড়াই লেগে যাচ্ছিল। লেডির সৌন্দর্য ডুগ্গুর উপস্থিত না থাকা শরীরের ওপর ফেটে পড়ছিল। দারুণ ক্ষিধে দুটো শরীরকে আলাদা করতে দিচ্ছিল না।
ভালোবাসা আর ভালোবাসার প্রতি তীব্র আগ্রহ ডুগ্গু ভানের হতচকিত হয়ে যাওয়াটা অনুভব করার সময়ই দিল না। সেই মুহূর্তেই লেডি ভান্ডার জেগে ওঠার বিষয়টি তার প্রতিরোধের সম্ভাবনা থেকে তাকে পিছিয়ে দিল। তবে এটা নিশ্চিত যে লেডি ভান্ডা ভোরবেলা উঠে হাঁটতে যাবে যখন, তার ঠিক আগে কাস্তিলিয়ান ভ্যাম্পায়ারটি সরে যেতে যেতে মেয়েটার কাঁধে ছোট্ট কামড় বসিয়ে দেয়। পরে সে সম্বন্ধে ভাবতে বসে ডুগ্গু ভান নিজেকে সমর্থন করেছিল এই ভেবে যে যারা হৃদয় হারিয়ে ফেলে রক্ত চোষাটা তাদের পক্ষে খুবই যুক্তিযুক্ত কাজ। সব প্রাণীর মতই আসল কাজের চেয়ে তার ভাবনা অনেক কম মহৎ ছিল।
প্রাসাদে ডাক্তার বৈদ্যের দল, মহান বিশেষজ্ঞ ও তাঁদের রিপোর্ট ছিল, অ্যানাটমি আর বিপদের সম্ভাবনা- ইত্যাদি সবই ছিল। তাছাড়াও একজন ইংরেজ নার্স নাম তার মিস উইলকিনসন, সেও ছিল। সে অবশ্য বেশ স্বাভাবিক আগ্রহেই জিন খেয়ে চলছিল। ওদিকে লেডি ভান্ডা জীবন মৃত্যুর সন্ধিতে দীর্ঘ সময় ঝুলে ছিলেন। একটা দুঃস্বপ্নের হাইপোথিসিস জ্বলজ্বলে সত্যের মত রয়ে গিয়েছিল। নির্দিষ্ট কোন একজোড়া চোখের জরিপের সামনে, আর তারপর... যথেষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে মহিলার নিশ্চিত প্রত্যয় হল তিনি গর্ভবতী।
দরজার ইয়েল তালাটা ডুগ্গু ভানের চেষ্টাতেই আটকে ছিল। ভ্যাম্পায়ারকে তো খেতে হত- বাচ্চাদের, ভ্যাড়াদের, এমনকি জঘন্য শুয়োর দেরও! কিন্তু লেডি ভান্ডার পাশে সব রক্ত ঠিক যেন জলের মত লাগছিল। একটা সাদাসিধে সঙ্গ, যার ফলে তার ভ্যাম্পায়ারের চরিত্রটি থেকে সে মুক্তি পেত না। রক্তের স্বাদের স্মৃতিতে যে সেও স্নান করেছে... সে মিষ্টি স্বাদ... তার জিভের নিজস্ব মাছ।
দিনের বেলাটায় ডুগ্গু ভান তার অনড় অচল কবরখানায় থাকত। অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় প্রতিশোধ নেবার জন্য মুরগীর ডাক পাহারা দেওয়াটা দারুন কঠিন ব্যাপার। অপেক্ষা করতে করতে খিদেয় পাগল হয়ে যেত সে। তবে সে লেডি ভান্ডাকে দেখবার জন্য ঘুরে ঘুরেই যেতে চায় নি। কিন্তু তার পা তাকে টেনে নিয়ে যেত বারবার সেই খোলা জায়গায় যেখানে ওই হলদে গোল ইয়েল তালাটা আসলে একটা রসিকতা। ডুগ্গু ভানের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। আর সেটা সবার চোখে পড়ে যাচ্ছিল।
খাড়া আর ভেজা পাথরের মত থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে সে ভাবত লেডি ভান্ডা হয়ত অন্য কোন ছেলেকে পেতে চাইছিল। খিদের চেয়েও প্রেম তাকে তাতিয়ে তুলছিল। মায়ের একটা নতুন খাড়াই কফিন সঙ্গে নিয়ে ভয়ঙ্কর জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখত সে।
লেডি ভান্ডার পেটে ছেলেটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল। একদিন বিকেলে সে শুনতে পেল মিস উইলকিনসন তার ওপর চিৎকার করছে। লেডি ভান্ডা ফ্যাকাশে চেহারা, একা বসে ছিল তখন। রেশমের কাপড় দিয়ে ঢাকা পেটটা ছুঁল। ডুগ্গু শুনতে পেল, লেডি বললঃ-ঠিক বাবার মত, একদম বাবার মত।
মিস উইলকিনসন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে এলেন যে গর্ভে থাকা ছোট্ট ভ্যাম্পায়ারটি খুব সূক্ষ্ম নিষ্ঠুরতায় মার গায়ে কামড়ে রক্ত ঝরাত। ডাক্তারেরা যখন গর্ভপাতের ধরণের ব্যাথা সম্পর্কে জানাল লেডি ভান্ডা কিন্তু তা অস্বীকার করল। পেটের ওপর দিয়ে জেগে ওঠা গাবলু গুবলু একটা ভালুক পুতুলের মত মাথাটায় হাত বোলাতে লাগল। - ঠিক বাবার মত।- একদম বাবার মত।
ডুগ্গু ভানের ছেলে দ্রুত বড় হয়ে উঠছিল। শুধু যে সে লেডি ভান্ডার শরীর দখল করে রেখেছিল তাই না, লেডি ভান্ডা কথা খুব কমই বলতে পারত। তার শরীরে রক্তও থাকত না আর। আদৌ যদি তা থাকতও তবে সে রক্ত তার ছেলের শরীরে থাকত।
নির্দিষ্ট দিন এলে স্মৃতি জড়ানো ঝলমলে হয়ে উঠেছিল তার মুখ। ডাক্তারেরা বলেছিল – এই ছেলে এক অদ্ভূত অচেনা জন্ম নিতে চলেছে। আতুড়ের বিছানার চারপাশে ঘরের সংখ্যারা ঘুরতে থাকল আর বিছানার পাশে, ডুগ্গু ভানের মুখ দেখলে হাসির উদ্রেক হচ্ছিল না। মাটিরঙা মুখটা বদলে গেছিল বেগুনী রঙে, একইই রকম কোন রেহাই পাওয়া অনুভূতি। জট পাকানো চুলের নিচে বিশাল বড় বড় দুটো চোখে কান্নামাখা প্রশ্ন দোল খাচ্ছিল।
- ও নিশ্চিত ভাবেই আমার- ডুগ্গু ভান তাঁদের গোষ্ঠীর নিজস্ব খামখেয়ালী ভাষায় বিড়বিড় করে উঠল। - আমার ভালবাসা আর ওর সত্তার মধ্যে কেউ এসে দাঁড়াতে পারবে না।
ছেলে হয়েছে সেকথা বলে মিস উইলকিনসন থামলেন।
বিছানার এক কোণে ডাক্তারবাবুরা জড় হয়ে একে অন্যকে দেখাতে চাইছিলেন যে তাঁরা ভয় পান নি। লেডি ভান্ডার শরীরে বদলের কথাটা তাঁরা স্বীকার করতে শুরু করলেন। লেডির চামড়ার রঙ দ্রুত কালচে হয়ে গিয়েছিল। তার পা দুটো থলথলে মাংসপেশিতে ভরে উঠছিল। পেট মসৃণভাবে ভরে উঠছিল। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই চেনা চেনা ঠেকছিল। তার লিঙ্গ বিপরীত লিঙ্গে বদলে যাচ্ছিল। মুখখানা আর লেডি ভান্ডার মত থাকছিল না। হাতগুলো আর লেডি ভান্ডার মত থাকছিল না। ডাক্তারেরা বীভৎস ভয় পাচ্ছিল।
ঠিক যখন বারোটার ঘন্টা পড়ল যে শরীর লেডি ভান্ডার ছিল সেটা বদলে গেল তার ছেলের শরীরে। শরীর বিছানার ওপরে মসৃণ ভাবে টানটান হয়ে গেল। সে দরজার দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিল।
ডুগ্গু ভান ড্রইংরুমে ঢুকল। ডাক্তারদের দিকে না চেয়েই পাশ কাটিয়ে গেল বিছানার কাছে আর ছেলের মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
যেন অনন্তকাল ধরে দুজনে দুজনকে চেনে এমন ভাবে তারা পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বিছানাটা একটু কুঁচকে রইল। ডাক্তাররা তখন তার দিকে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারচ্ছিল। টেবিলের ওপরে রাখা অফিসের জিনিসপত্র, সদ্যোজাত জন্মাবার ওজন যন্ত্র দেখতে দেখতে দরজায় দাঁড়ানো মিস উইলকিনসন অবাক হয়ে হাঁ করে হাত কচলিয়েই যাচ্ছিল।

অনুবাদক
জয়া চৌধুরী

অনুবাদক
জয়া চৌধুরী
0 মন্তব্যসমূহ