“... আর চল্লিশদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে জলপ্লাবন হইল, তাহাতে জল বৃদ্ধি পাইয়া জাহাজ ভাসাইলে তাহা মৃত্তিকা ছাড়িয়া উঠিল। পরে জল প্রবল হইয়া পৃথিবীতে অতিশয় বৃদ্ধি পাইল; এবং জাহাজ জলের উপর ভাসিয়া গেল। আর পৃথিবীতে জল অত্যন্ত প্রবল হইল, আকাশমন্ডলের অধিস্থিত সকল মহাপর্বত মগ্ন হইল। তাহাতে ভূচর যাবতীয় প্রাণী-পক্ষী, গ্রাম্য ও বন্য পশু, ভূচর সরীসৃপসকল এবং মনুষ্যসকল মরিল। স্থলচর যত প্রাণীর নাসিকাতে প্রাণবায়ুর সঞ্চার ছিল, সকলে মরিল। এইরূপে ভূমন্ডলনিবাসী সমস্ত প্রাণী – মনুষ্য, পশু, সরীসৃপজীব ও আকাশীয় পক্ষীসকল উচ্ছিন্ন হইল; কেবল নোহ ও তাঁহার সঙ্গী জাহাজস্থ প্রাণীরা বাঁচিলেন।
বই বন্ধ করে জানালা দিয়ে খালের দিকে তাকাল মাইকেল মন্ডল। গির্জার ওপরে রঙিন কাগজের তারা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ভেতরে আলো জ্বলে। খালের জলে সেই তারার ছায়া পড়েছে। ছায়া ভেঙে যাওয়ার ফলে স্পষ্টই বোঝা যায় এই জল স্থির নয়। সামান্য ঢেউ আছে।
দিনের বেলা যে খাল খুব চেনা একটা নোংরা কালো জলের প্রবাহ, রাতে সেই জলপ্রবাহ কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে। নীল মলাটদেওয়া বই সামনের টেবিলে রেখে মাইকেল মন্ডল জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গির্জার ওপরের নীলতারার ছায়া পড়েছে জলে। সেই আলো ভেঙে যাওয়া দেখতে তার খুব ভালো লাগছিল। জল তো বয়ে চলেছে, কিন্তু আলোর টুকরোগুলো একটা জায়গাতেই নাচানাচি করছে। আচ্ছা, এখন এই জল হঠাৎ স্থির হয়ে যায়, তবে কি আলোর টুকরোগুলো জুড়ে গিয়ে আস্ত একটা তারা হয়ে যাবে। কে জানে এখন রাত ক’টা। বাড়িতে একটাই ঘড়ি। মায়ের হাতঘড়ি। মা সেটা হাতে দিয়ে ডিউটিতে যায়। দিন দশেক হল মাকে নির্মলা আয়া সেন্টার থেকে একটা নাইট ডিউটির কাজ দিয়েছে। তার খাবার রেডি করে রেখে গেছে মা।
পঁচিশে ডিসেম্বরের রাত। মাইকেল জানে হয়তো আর কিছুক্ষণ বাদেই গির্জা থেকে ঘন্টার আওয়াজ শোনা যাবে। এখান থেকে অবশ্য জলের ওপর তারার ছায়াটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আরও কিছুটা দূর হলে স্পষ্ট বোঝা যেত না। খুব ঘন না হলেও কুয়াশা রয়েছে। খালপারের ব্রিজের মাথায় আলোটার চারপাশে একটা সম্পূর্ণ গোল রামধনু অস্পষ্ট দেখতে পেল মাইকেল। সাদা ধোঁয়ার মত কুয়াশার ভেতরে আলোটা সামান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।
আশা মন্ডল মনে করতে পারে না ছোটবেলায় মাইকেলকে পোলিও ড্রপ খাওয়ানো হয়েছিল কিনা। নিশ্চয় কোনও কারণে ভুল হয়ে গিয়েছিল। নইলে কী করে মাইকেলের একটা পা শুকনো কাঠির মত হয়। সদাপ্রভুর অন্তরে কী ইচ্ছা, কে জানে। খালপারের বস্তির স্কুলে মাইকেল আসাযাওয়া করত বটে, কিন্তু একপায়ে এতটা পথ শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে তার বেশ কষ্ট হত। ফালতু পা’টাকেও টানত ভালোপা। ক্লাস এইট পর্যন্ত এ রকম টানাটানির পর মাইকেল মন্ডল একদিন আর স্কুলে গেল না। মাকে বলল সে ছবি আঁকা শিখবে। আশাও ভেবে দেখল ঘরে বসে ছবি আঁকা খারাপ কাজ নয়। বিশেষত সেখানে পায়ের ভূমিকা প্রায় নেই বললেই চলে। হিজিবিজি ছবি মাইকেল নেহাত মন্দ আঁকে না। মাইকেল সপ্তাহে একদিন করে কাছাকাছি ‘রংতুলি’-তে যেতে শুরু করেছিল। এক বছর বাদে সেই মাস্টার মাঝে মাঝে তাদের এই ঘরে এসেও মাইকেলকে শিখিয়ে যেত। অবশ্য, আশা লক্ষ করছিল ক্রমে ছবি আঁকার খরচ বাড়ছে। রং-এর টিউব, নানা সাইজের ব্রাশতুলি, স্ট্যান্ডসহ বোর্ড। তা হোক। না হয় সে বেশি করে নাইট ডিউটি নেবে। মেজাজবিগড়ে থাকা মাইকেল কেমন যেন পালটে গেছে। ষোলোসতেরো বছরের ছেলে, ভাবগতিক দেখলে মনে হয় কত না বয়স হয়েছে তার।
আয়াদের লাইনে আশা মন্ডলের সুনাম আছে। এ পর্যন্ত তার নামে কোনও পার্টি কমপ্লেইন করেনি। পয়সা দিয়ে আয়া রাখলে পার্টি একদম পয়সা উসুল করে নেবার চেষ্টা করে। বাজে লোকজনও আছে। নাইট ডিউটতে মাঝবয়সি আয়ার গায়ে হাত দেওয়ার গল্পও আছে। সে সব নিয়ে ওরা খুব হাসাহাসি করে। আবার ডিউটিতে খুশি হয়ে বেশ ভালো ক্যাশ বা ভালো শাড়ি, অন্য কোনও গিফটের কথাও ওরা বলাবলি করে। ক্যাথিটার লাগানো রয়েছে, সেই অবস্থায় নাকি এক বুড়ো একবার ঊষার গায়ে হাত দিয়েছিল। বুড়োটা ঊষাকে বলেছিল একটু মালিশ করে দিতে, কিছুক্ষণ বাদে ঊষা নাকি অবাক হয়ে দেখল পার্টিই তাকে মালিশ দিচ্ছে। গল্প বলতে বলতে হি হি করে হাসছিল ঊষা মাইতি। আশা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
ডেলিভারির পরে মেয়েদের দেখাশোনার ডিউটিতে আশা মন্ডল বেশ খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছিল। পুরনো পার্টি ফের তাকেই চাইত। ফলে এ লাইনে তার বেশ পশার জমেছিল। এবং তার একটি অপোনেন্ট টিম অটোমেটিক গড়ে ওঠে। তারা একান্তে সহমত হয় যে মাগি আসলে দু’নম্বরি আছে। কপাল বুকে, দুই কাঁধে কথায় কথায় পেন্নাম ঠুকলেই কী আর তোর যিশুবাবা তোকে বাঁচাবে। আশা খবর পেয়েছিল এবার এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডিউটি। তাদের বাড়ির মেয়ের ডেলিভারির পরে দেখাশোনার কাজ। এ ধরণের কাজই সবাই পছন্দ করে।
মাইকেলকে নিয়ে তার মা আশা মন্ডলের ইদানীং নতুন রকমের দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে। গির্জার বেহালাবাদক ইমানুয়েল নস্কর, যে কিনা সম্প্রতি খালের ওপারে শনিমন্দিরের পাশে হোমিওপ্যাথি চেম্বার খুলেছে, একদিন তার সঙ্গে পথে দেখা হওয়ায় ডেকে কথা বলেছিল। খোঁড়া পা নিয়েই মাইকেল নাকি নানা রকম শরীরের কায়দা-কসরৎ করে। ইমানুয়েল একদিন নিজের চোখে জানালা দিয়ে দেখেছে খাটে শুয়ে পাদুটো ওপরে দেয়ালে সাপোর্ট দিয়ে মাইকেল শীর্ষাসন করার চেষ্টা করছে। ইমানুয়েল তখন মনে মনে ‘প্রভু তোমার মহিমা’ প্রার্থনাগীতির সঙ্গে একটা কাউন্টার কর্ডের কথা ভাবছিল, ফলে একটা অন্য জগতে ছিল। জানালা দিয়ে মাইকেলকে ওই অবস্থায় দেখে তার মনে হয়েছিল ঘরে রহস্যময় কিছু রয়েছে। একটু ভয়ও পেয়েছিল। তারপর সদাপ্রভুর নাম স্মরণ করে সামনে গিয়ে দেখেছিল মাইকেল আসন করছে। তখন একটু কষ্টও হয়েছিল তার। আহারে, ছেলেটাকে কেউ হয়তো বলেছে এক্ষেত্রে পোলিওতে ভালো কাজ হয়। কিন্তু কথা সেটা নয়, কথা হল তখন ঘরে সামান্য আলো থাকলেও মাইকেলের চোখদুটো কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল তার।
শুনে এস্তক আশা মন্ডলের মনটা কেমন কু গাইছিল। প্রতিবন্ধী ছেলেটা একা একা ঘরে বসে থাকে। ওর বয়সী বস্তির ছেলেরা আজকাল ঘরে বউ নিয়ে আসছে। মাইকেল ঘরে বসে ছবি আঁকে। আগে তাও একটু আধটু বেরোতো। মাটিতে, খালপারের কাদার ওপর দেড়খানা পায়ের ছাপ ফেলে গির্জা পর্যন্ত যেত। এখন একদমই বেরোতে চায় না। একটু গম্ভীরও হয়েছে। দিনের বেলাতেও মায়ের সঙ্গে বেশি কথা বলতে চায় না। আর রাতে তো প্রায় দিনই তাকে একাই থাকতে হয়। তার মাস্টার ছবির বই এনে দিয়েছে, দিনে সেগুলো মনযোগ দিয়ে দ্যাখে। অনেক রাত অব্দি ছবি আঁকে। কিন্তু ছবির বইটা খুব একটা পছন্দ হয়নি তার। এই বয়সের ছেলেদের হাতে ও রকম বুকখোলা মেয়েদের ছবিওয়ালা বই – আশার মনটা একটু খুঁতখুঁত করেছিল। আশা নিজেই ইমানুয়েলকে বলেছিল দিনের বেলা সময় পেলে যেন মাঝে মাঝে গিয়ে মাইকেলের সঙ্গে গিয়ে একটু কথাটথা বলে আসে।
গত বাইশে ডিসেম্বর বেলা বারোটা নাগাদ ইমানুয়েল নস্কর মাইকেলের সঙ্গে গল্প করতে এসেছিল। সকালের দিকে বেশ কুয়াশা ছিল। ভোরে উঠে ছড়ে রজন ঘষে একটু বাজিয়েছে। কিন্তু একে তো বেশ ঠান্ডা, ফিঙ্গার-বোর্ডে আঙুল ঠিকঠাক চলে না, তার ওপর আজ দোকানটা একটু গোছগাছ করবে ভেবে রেখেছে – ঠিক করল আজ আর পেশেন্ট দেখবে না। আজ বরং মাইকেলের সঙ্গে কথা বলবে। সাইকেলের সিটে দুটো থাবড়া মেরে প্যাডেলে পা রাখল ইমানুয়েল নস্কর।
দুই
বিরক্তি লাগছিল মাইকেলের। এখন মনে হচ্ছে নস্করডাক্তারের সঙ্গে অত খোলাখুলি আলোচনা না করলেই হত। লোকটা পারেও। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার পেটের ভেতর থেকে সব কথা ঝানু উকিলের মত টেনে বার করেছে। মাঝে মাঝে মাইকেল একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পায়। তার শরীরটা খন্ড খন্ড হয়ে আকাশের বিভিন্ন জায়গায় দোল খাচ্ছে। পরিষ্কার দেখতে পায়। তখন কিন্তু খুব আরাম লাগে তার। শেষে মুন্ডুটা উত্তর-পশ্চিম কোণে মৃদুমন্দ দুলতে শুরু করলে সে টের পায় পাজামার নীচে তার পুরুষাঙ্গ অসম্ভব শক্ত হয়ে উঠেছে। তখন সেই পাপ কাজ করা ছাড়া আর কোনও পরিত্রাণ থাকে না।
নস্করডাক্তার তার জিভ দেখল, নখ দেখল, চোখের পাতা টেনে দেখল, তারপর ফিসফিস করে ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে কানের কাছে মুখ নিয়ে জানতে চেয়েছিল তাদের বংশে কারও সিফিলিস ছিল কিনা। প্রথমে মাইকেল ভেবেছিল ডাক্তার জানতে চাইছে তাদের বংশে কেউ গুপ্তধন পেয়েছিল কিনা। মাইকেল পরে ভেবে দেখেছিল কথাটি গুপ্ত বটে। কিন্তু ডাক্তার তার সমস্যা কিছুই বোঝেনি। নিজের চোখে সে স্পষ্ট দেখতে পায় তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে আকাশের এখানে ওখানে ভেসে বেড়াচ্ছে, আর ডাক্তার বলছে গুপ্তধনের কথা।
কথা ঘোরানোর জন্য মাইকেল বেহালার প্রসঙ্গ তুলেছিল, ডাক্তার সেদিকে না গিয়ে তার ছবি আঁকার বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখ থেকে চশমা খুলে দু’বার চোখের পিচুটি মুছল। ছবিতে এখনও রং চাপানো হয়নি। শুধু হালকা স্ট্রোক দিয়েছে মাইকেল। এখনও অনেক বাকি। এই ছবিটা তার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আইডিয়াটা অবশ্য চুরি করা, একটু নিজের মত করে পালটে নিয়েছে। একটা মেয়ের পেট খুবলে খাচ্ছে হিংস্র একটা কুকুর। পেটের ভেতরে একটা কাজুবাদামের আকৃতির কিছু রয়েছে, ভ্রূণও হতে পারে। সেটা থেকে একটা লতা ওপরে উঠে মেয়েটার মাথার কাছে সূর্যমুখী ফুল হয়ে গেছে। ভাবনাটা তার মাথায় আছে বলেই মাইকেল এগুলো দেখতে পায়, কিন্তু ইমানুয়েল নস্কর শুধু অস্পষ্ট একটা নগ্ন নারী-শরীরের অবয়ব আর কুকুর বা শেয়ালজাতীয় কিছু দেখতে পাচ্ছিল।
মাইকেল, তোমাদের ঘরে বাইবেল নেই ?
আছে, এই যে নীলমলাটের বইটা।
মাইকেল, তখন ঈশ্বর কহিলেন দীপ্তি হউক, দীপ্তি হইল। আর ঈশ্বর আলোকের নাম দিবস ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন।
জানি
খুব মুশকিল মাইকেল। বুঝতে পারছি না।
কী বুঝতে পারছেন না ? ছবিটা ?
মানসিক চিত্তচাঞ্চল্য। যৌনতাড়নার আধিক্য। হায়োসায়েমাস থ্রি এক্স, না কি স্ট্রমোনিয়াম সিক্স ? ভোরের দিকে খুব গ্যাস হয়, তাই না ?
একটা মোপেড কিনলে কিন্তু আপনার অনেক সুবিধে হত। ভেড়ির ওদিকে শুনেছি নতুন ঘরবাড়ি হচ্ছে। আপনাকে এত প্যাডেল মারতে হত না।
ইমানুয়েল নস্কর চলে গেছে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখল মাইকেল মন্ডল। বিরক্তি লাগছে এখন। তার অসুখটা ডাক্তার কিছুই ধরতে পারেনি। আকাশজুড়ে তার খন্ডশরীর ভাসে, এক কোণে হাওয়ায় মৃদুমন্দ দোল খায় মুন্ডু, সমস্ত আকাশ ক্রমে ধূসর হয়ে আসে – আর ডাক্তারবাবু বলছেন সিফিলিসের কথা।
ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়াল মাইকেল। অন্য দিন এ সময়ে মা বাড়িতে থাকে। ক’দিন ধরেই মা বলছে এই শুক্রবারে বেরোবে। কোথায় টাকা জমা দেবার অফিস আছে, প্রত্যেক মাসের তৃতীয় শুক্রবারে গিয়ে টাকা জমা রসিদ নিয়ে আসে মা। আজ সকালে চা, রুটি খেয়েই মা বেরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে খালপাড়ের নতুন বাজার থেকে একেবারে বাজার করে ফিরবে।
রং-এর টিউবগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল মাইকেল। ছবিটা দেখল। ভাবল পেটের ভেতরের বীজটার রং দেবে সিপিয়া। সূর্যমুখীটা খুব উজ্জ্বল করবে। কিন্তু কুকুরটার রং বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছিল না। বাইরে তাকিয়ে দেখল সকালের কুয়াশা কেটে গিয়ে এখন বেশ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ইমানুয়েল ডাক্তার একটা নীল কোট পরে এসেছিল। গলামাথায় একটা মাফলার জড়ানো ছিল। ঘরে ঢুকে অবশ্য মাফলারটা সে খুলে ফেলেছিল। ইমানুয়েল নস্যি নেয়। এ ঘরে ঢুকে অবশ্য একবারও নেয়নি।, কিন্তু তার শরীরে সব সময় নস্যির গন্ধ পাচ্ছিল মাইকেল। বেশ ক’বার সে ডাক্তারের নাকের ফুটোর দিকে তাকিয়েছে। ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু হালকা গন্ধটা ছিল।
তিন
কালো জলে তারার ছায়াটা ভাঙছিল, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না যে, সেটা নীলতারা। মাইকেলের খিদে পাচ্ছিল, কিন্তু খাবার বেড়ে নিয়ে বসতে এক রকম আলস্য লাগছিল তার। খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা এলেও ভালো লাগছিল তার। খালের ব্রিজের মাথায় আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ঘোর লেগে গেল তার। আলোর চারপাশের হলদে কুয়াশার বৃত্তটা তার মাথার ভেতরের সমস্ত জায়গা অধিকার করে নিচ্ছিল। তার ফলে মনে হচ্ছিল তার চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে-পড়া সব আলোই কুয়াশামাখা। ব্রিজের মাথার আলো থেকে দৃষ্টি সরালেও আকাশজোড়া হালকাহলুদ চাদর দেখতে পাচ্ছিল সে।
বুঝতে পারছিল মাইকেল এখন আবার সেই আক্রমণটা আসবে। তার ভালো এবং ল্যাগবেগে ঠ্যাংদুটো আলাদা হয়ে একটা উত্তরে, একটা আকাশের দক্ষিণকোণে ভাসবে। হাত, বুক, পেট – সব জোড় খুলে আলাদা আলাদা হয়ে যাবে। সব শেষে তার মুন্ডু উত্তর-পশ্চিম কোণে দোল খাবে। সে নিজের চোখেই স্পষ্ট দেখতে পায়। অথচ ইমানুয়েল জানতে চায় তাদের বংশে কারও সিফিলিস ছিল কিনা।
সুতলি দিয়ে বেকার পা’টাকে ভালো পায়ের সঙ্গে বেশ করে জড়িয়ে বাঁধল মাইকেল। তারপর মাথা নীচে রেখে দেয়ালের সাপোর্ট নিয়ে পাদুটো আস্তে আস্তে ওপরে তুলল। অনেকটা গ্যাস বেরিয়ে গেলে যেমন, পেটটা তেমন হালকা লাগছে। শুধু পেট নয়, মাইকেল দেখল শরীরটাও বেশ হালকা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে জানালা দিয়ে এখনই সে ভেসে যেতে পারে। আর, তার সম্পূর্ণ শরীর দিব্যি আকাশে উড়ছে ( পোলিওর সেখানে কোনও ভূমিকা নেই), এই চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে সে টের পেল তার শরীরের পেশিগুলো মোচড় খেতে শুরু করেছে। শরীরের ভেতরে ফুঁসে উঠছে পাতাল নদীর দুরন্ত স্রোত।
বিছানায় শুয়ে প্রায় সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে বোর্ড থেকে বাঘের মত থাবা বাড়িয়ে ছবিটা ছিঁড়ে আনল মাইকেল। বিছানায় পেতে দিল। তারপর পাজামা খুলে তীব্র আসঙ্গ লিপ্সায় উন্মাদ একটা বাঘের মত ছবির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মাইকেল মন্ডল। পাদুটো তখনও বাঁধা ছিল, ফলে আসনটা নতুন হয় বটে।
চার
মেয়েটা বলছিল কপাল টিপে দিতে। টুলটা মাথার কাছে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে কপাল টিপে দিচ্ছিল আশা। অবাঙালি, কিন্তু খুব পরিষ্কার বাংলা বলে মেয়েটি। পেশেন্ট যে আসলে একটি অবিবাহিত মেয়ে, সেটা আশা প্রথমে বুঝতেই পারেনি। পেটে বাচ্চা এসে যাওয়ার পর বাড়ির কেউ কিছু বুঝতে পারেনি, মেয়েটাও কিছু জানায়নি। ফাঁকা বাড়িতে সারাদিন একা একা ঘরে বসে টিভি দেখত, না হয় কম্প্যুটারে গেম খেলত। পাঁচমাস পরে তার মাসি একদিন বেড়াতে এসে কেসটা ধরে ফেলেছে। কিন্তু তখন খালাস করায় বিপদ আছে বুঝে কোনও ক্লিনিকই রাজি হয়নি।
জানো মাসি, দ্যাট ওয়াজ আ বেবিগার্ল। ওরা আমার থেকে বাচ্চাটাকে দূরে সরিয়ে নিল, পরে বলল কি দ্যাট ওয়াজ স্টিলবর্ন বেবি। মিথ্যে কথা মাসি। আমার বাচ্চাটাকে ওরা মেরে ফেলেছে।
দিদি, কোমরের নীচে হট-ওয়াটারের ব্যাগটা দেব ? আরাম লাগবে।
কোমরে নয়, পায়ের তলায় দাও। আমার পায়ের নীচে খুব ঠান্ডা হচ্ছে। আর একটা কাজ করবে মাসি, খিড়কির পর্দা সরিয়ে দাও। সিসা আছে, ঠান্ডা আসবে না। মাসি, আজ ক্রিসমাস ডে আছে, তাই না ?
গরম জলের ব্যাগ মেয়েটার পায়ের নীচে রাখল আশা। দামি কম্বল দিয়ে পা দুটো ঢেকে দিল। বিছানার বাঁ দিকে, রাস্তার দিকের জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। ভবানীপুরের পূর্ণ সিনেমার পাশ দিয়ে পথটা সোজা গঙ্গার দিকে চলে গেছে। কলকাতার পুরনো অঞ্চল। বলরাম বোস ঘাট রোড আর হরি সিং রোডের ক্রসিং পেরিয়েই বাড়িটা। আটটা নাগাদ এ বাড়িতে ঢোকার সময়ই আশা দেখেছে অনেক বাড়িতেই লালনীল আলো দিয়ে সাজিয়েছে। একটা দুটো বাড়িতে নীলতারাও জ্বলছে।
অনেকক্ষণ ছটফট করে ঘুমিয়েছে মেয়েটা। মনটা একটু খচখচ করছিল আশা মন্ডলের। অসুস্থ মানুষদের পাশে বসেই তো সময় পার হয়ে যায় তার। কত রকমের পেশেন্ট দেখা হল তার। অনেকে আছে পয়সা দিয়ে আয়া রাখা হয়েছে বলে তাকে প্রায় বাড়ির ঝি মনে করে। অনেক বয়স্ক পুরুষ অসুস্থতার দোহাই দিয়ে গায়ে হাত দেওয়ারও চেষ্টা করে। এক বুড়ো তো সে বিধবা শুনে তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। রাজি হলে আশা কী কী পাবে, তার লিস্টও শুনিয়েছিল। হরি ঘোষ স্ট্রিটে, পুরনো বনেদি ফ্যামিলি। মুখ খারাপ ছিল বুড়োটার। তার সঙ্গে তুইতোকারি করত। বউবাজারে সোনার দোকান আছে। উঠতে বসতে ছেলেদের আর ছেলের বউদের নামে খেউড় করত। ছেলেদের সম্পর্কে বলত – পুত্র নয়, ও দুটো আমার মূত্রের সমান। একই পথ দিয়ে বেরোয় তো। আশারানী, রাজি আছিস তো বল। তোকে বড় ভালো লেগেছে রে। বিডন স্ট্রিটের বাড়িটা তোর নামে লিকে দোব। তবে বুড়ো গায়ে হাত দেয়নি কোনও দিন। ও বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছিল আশা।
নীনা কানোরিয়া নামের মেয়েটার দিকে তাকাল আশা। উজ্জ্বল আলো নিভিয়ে খুব কম উজ্জ্বলতার নীল আলোটা জ্বালিয়ে দিল। পথের সমস্ত রঙিন আলোর আভা জানালার কাচ পার হয়ে কিছুটা ঘরে এসেছে। হঠাৎ বেলের শব্দ কানে যেতেই চমকে উঠল আশা। মেয়েটা ডাকছে তাকে। তার হাতের সামনে কলিং বেলের সুইচের ব্যবস্থা করা আছে। বাথরুমে যাবে হয়তো।
টয়লেটে যাবেন ? আমাকে ধরে আস্তে নামুন।
না মাসি। একটা কাজ করে দাও না প্লিজ। এই চাবিটা দিয়ে টেবিলের লেফট্ সাইডের ড্রয়ার খুলো। একটা ছোট লেদার ব্যাগ আছে। ওটা আমাকে দিবে।
ড্রয়ার খুলে ছোট্ট চামড়ার ব্যাগ বার করল আশা। এনে নীনার হাতে দিল। ব্যাগের মুখ খুলে একটা কাগজ বার করে, অল্প আলোয় আশার মনে হল কোনও চিঠি – ভাঁজ করে করে ছিঁড়ে ফেলল মেয়েটা। সব কুচিগুলো আশার হাতে তুলে দিল। মাসি, এগুলো বাইরে ফেলে দাও। হাত বাড়িয়ে কাগজের টুকরোগুলো নিল আশা। মেয়েটা আবার শুয়ে পড়েছে। একটা কাগজ ছিঁড়তেই যেন তার অনেক পরিশ্রম হয়েছে।
ঘুমোচ্ছে নীনা কানোরিয়া। কলকাতার কুমারী মাতা। ঘড়ি দেখল আশা মন্ডল। একটু বাদেই বারোটা বাজবে। ন্যাজারেথের শিশু জন্মেছিল বলে নিশ্চয় এদিকেও কোথাও ঘন্টা বাজবে। জানালার সামনে গিয়ে একটা পাল্লা খুলে দিল সে। লালনীল আলোর মালা, উলটো দিকের একটা বাড়ির বারান্দায় নীলতারা ঝুলছে। মুঠো খুলে কাগজের কুচিগুলো বাতাসে ভাসিয়ে দিল আশা। তখনই পৃথিবীজুড়ে বেজে উঠল – জিঙ্গল্ বেল জিঙ্গল্ বেল ...। আকাশ থেকে কতগুলো নতুন নক্ষত্রের মত টুকরোগুলো ভেসে যাচ্ছে মাটির পৃথিবীর দিকে।
“ পরে ঈশ্বর কহিলেন দীপ্তি হউক। তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন, এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম আলোক ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে প্রথম দিবস হইল”।
ঘন্টা বাজছে কোথাও। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আশা মন্ডল। কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে সব আলো। কুয়াশার মত বরফের ওপর দিয়ে যে স্লেজগাড়িটা ক্রমে এদিকে আসছে, তার সামনে একটা বলগা হরিণ কেমন যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। বুকের ওপর হাত রাখল আশা।
“তোমার জন্য আমরা সমস্ত দিন
নিহত হইতেছি;
আমরা বধ্য মেষের ন্যায় গণিত হইলাম”।
0 মন্তব্যসমূহ