প্রলয় নাগ'এর গল্প : ফড়িং

ফড়িং। ছেলেটার ডাক নাম। একটা মুরগি পোষে। রোজ সকালে একটা করে ডিম সেদ্ধ খায়। মুরগিটা সকালে ডিম দেওয়ার সময় হলেই উঠান জুড়ে কক্- কক্কক্কক্ -কক্ করতে থাকে। 

ডিম দিয়ে বেরিয়ে এলে ফড়িংয়ের মা এক মুঠি খুদ হাতে নিয়ে ডাকে: 

-টি টি টি টি, আয় আয় টি টি টি টি।

তারপর উঠানে ছিটিয়ে দেয়। মুরগিটি মনের আনন্দে খেয়ে দেয়ে ইয়াকুবদের বাড়ির মুরগিগুলোর সাথে ঘুরে বেড়ায়। 

ইয়াকুব-রা পাড়ায় একমাত্র মুসলিম পরিবার। ইয়াকুবের বাবা ভুটান খাটে, দুই বিয়ে করেছে। ওদের বাড়িতে অনেক মুরগি। প্রত্যেকবার বাচ্চা ফোঁটায়। বাড়ির উঠান গিজগিজ করে। ইয়াকুব খেতে বসলে ভাতের থালায় এসেও ঠোকর মারে। মুরগি বড় হতে হতে আর একটাও থাকে না। সব খেয়ে ফেলে ইয়াকুব-রা। 

ফড়িংয়ের মা ফড়িংকে শিখিয়ে দিয়েছে: 

- অগো বাড়ি কিচ্ছু খাবি না। 

ফড়িং প্রশ্ন করে মার কাছে কারণ জানতে চায়। ফড়িংয়ের মা বলে: 

- কারণ আমরা হইলাম হিন্দু। অরা হইল মুসুরমান। 

- তাইলে যে আঙ্গর মুরগি সারাদিন অগো বাড়িত ভাত খায় আর আমরা যে অই মুরগির ডিম খাই? 

-ডিম খাইলে কিসু হয় না। 

- তাইলে তো ভাত খাইলেও কিসু হইতো না। 

- তর্ক করিস না। যেইডা কইছি মনে থাহে য্যাতে। 

ফড়িংয়ের খেলার সাথী ইয়াকুব। তার চেয়ে বয়সে বেশ বড়ই হবে। তোর্সা নদীর লাগোয়া একটি গ্রামে ওদের বাড়ি। বছর বছর নদী ভাঙনে এই গ্রামের বাড়িসহ জমি তোর্ষার তলায় চলে গেছে। যেমন নদীর এপার ভাঙে ওপার গড়ে তেমনি করে নদীর মাঝখানে বিশাল চর জেগে উঠেছে। এই চরের দখল নিয়েছে গ্রামবাসীরা। ইয়াকুব ইস্কুলে পড়ে না। একপাল গোরু নিয়ে সারাদিন নদীর চরে কাটিয়ে দেয়। ছোট্টট বেলায় এক-দুই গুনতে শিখেছিল, এইটুকুই। যাতে করে চরে গোরুগুলি গুনে বাড়ি নিয়ে আসতে পারে। ইয়াকুবের সঙ্গে তোর্ষার চরে মাঝে মাঝে ফড়িংও যায়। তারা দুজনে কাশ বনের ভেতর লুকোচুরি খেলে। কখনও মাথায় জঙ্গলি পাতার মুকুট বেঁধে ইয়াকুব বলে: 

- আমি হইলাম রাজা। 

আর যখন ক্লান্ত হয়ে পরে তখন তোর্ষার শীতল জল চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়ে বলে: 

-ইস কি ঠান্ডা রে! 

আবার ইয়াকুব যখন পকেট থেকে ডাসা পেয়ারা বের করে ফড়িংকে দিয়ে বলে, 

- নে খা। 

ফড়িং তখন খেতে চায় না। মায়ের নিষেধ মনে পড়ে। বলে: 

-শবরী খাইলে পেট বেদনা করে। তুই খা! 

তখন ইয়াকুব চালাকি করে বলে: 

- আরে এইটা আঙ্গর গাছের না। শম্ভুর গাছ থেইক্যা চুরি করছি। 

- ক সে মা কালী! 

ইয়াকুব বলে: 

-মা কালী। 

এবার ফড়িং পেয়ারা খায়। 


নদীর ওপাড়ে মধুপুর ধাম। তারপর রাজার হাট। তারপর কোচবিহার শহর। কোচবিহার শহরে ইয়াকুব কখনও যায় নি। শুনেছে সেই শহরে বড় একখানি রাজপ্রাসাদ আছে। একখানি বিশাল বড় দীঘি আছে। যার জল শীত গ্রীষ্ম কোন কালেই শুকোয় না। আর আছে একখানি সুন্দর ধপধপে সাদা মদনমোহন মন্দির। সেখানে বছর বছর রাসমেলা হয়। ইয়াকুব নদী সাঁতরে ওপাড়ে গিয়ে মধুপুর ধাম দেখে এসেছে। তার ইচ্ছে একবার ফড়িংকে সঙ্গে নিয়ে রাজপ্রাসাদ দেখতে যাবে। ফড়িংকে বলেছেও, কিন্তু ফড়িং রাজি হয় না। বলে: 

- মা যাবার দিব না-রে। বকা দিবো। 

ইয়াকুব আশ্বাস দিয়ে বলে: 

-তর মা টের পাইলে সে বকা দিব। সকালে গোরু চরে বাইন্ধ্যা দিয়া রওনা দিমু আর তাড়াতাড়ি চইলা আমু। কেও টেরও পাইতো না। 

- না রে আমার ডর করে। 

- কিয়ের ডর। আমি আছি না! কিছু পইসা থাকলে লইয়া লইস লগে। 


চৈত্র মাস। তোর্ষার জল কমেছে। ইয়াকুব আড়াই টাকা আর ফড়িং বারো আনা পকেটে নিয়ে চর ধরে হেঁটে হেঁটে নদী পাড় হল। তারপর জমির আল ধরে হাঁটতে শুরু করল। অনেকটা পথ পেরিয়ে বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। ইয়াকুব আগে আগে, ফড়িং চলছে পেছনে পেছনে। 

ইয়াকুব একবার পেছন ফিরে ফড়িংকে জিজ্ঞেস করল: 

-ভয় পাইতাছস? 

ফড়িং মাথা নেড়ে 'না'। 

-তাড়াতাড়ি পা ফালা! 

ক্রমেই রাস্তার পাশে পাকা বাড়ি ঘর চোখে পড়ছে। একতলা দুতলা হঠাৎ কোথাও তিন তলা। আরও খানিকটা চলল। 

- উই যে রাজবাড়ির চূড়া দেহা যায়। চল তাড়াতাড়ি। 

রাজবাড়ির সিংহদ্বারে এসে উপস্থিত দুজনে। দূরে বিশাল আকারের রাজপ্রাসাদ। গম্বুজটা আকাশ ছুঁয়েছে। 

ছোট্ট একটা দরজার ভেতর দিয়ে রাজবাড়ির সীমনায় প্রবেশ করল দুজনে। ফড়িং একটু ভয়ও পাচ্ছে। দু'একজন সন্দেহের চোখেও দেখছে। ইয়াকুব ফড়িংয়ের কানে কানে বলল, 

- ভয় পাইস না। আমি আছি। 

এই অচেনা শহরে ফড়িংয়ের ভরসা ইয়াকুব-ই। একা ছেড়ে দিলে সে বাড়ি পযর্ন্ত যেতে পারবে না। ফড়িং আরও শক্ত করে ধরে ইয়াকুবের আঙুল। 

পোড়া ইঁটের রঙে রাঙানো রাজবাড়ি ঘুরে ফিরে দেখে দুই বন্ধু। ভেতরে যাওয়ার সাহস হয় না। পোড়া ইঁট গুলি ছুঁয়ে দেখে ফড়িং। এত বড় বাড়ি সে কোনও দিন দেখেনি। বিস্ময়ের চোখে চেয়ে দেখে। ফড়িং জিজ্ঞেস করে: 

- রাজ বাড়ির রঙ লাল ক্যা? মানুষের রক্তের লাহান। 

- কিবায় কমু? রাজ বাড়ির রঙ লাল-ই হয়। 


রাজবাড়ির চারপাশ কয়েক বার ঘুরে দেখল। এরপর বাইরে বেড়িয়ে এসে এক রিকশাওয়ালাকে ইয়াকুব জিজ্ঞেস করে: সাগর দীঘি ডা কুন দিগে? 

রিকশাওয়ালা বলে: রিশকায় বও, নিয়া যাই। 

-ট্যাহা নাই। 

রিকশাওয়ালা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, 

- ট্যাহা নাই? 

ইয়াকুব আবার জিজ্ঞেস করল -কুন দিগে? 

- এই দিগে সুজা যায়া পাঁচটা গলি পাড় হইয়া বায় দিগে যাবা। 

রিকশাওয়াার দেখানো পথে ওরা চলতে লাগল। অনেক হেঁটেছে আজ। আর পা চলছে না।ইয়াকুব বলল, 

-চল কিছু খায়া লই! 

-কি খাবি? 

-আরে চল না! 

দুজনে একটি মিষ্টির দোকানে ঢুকে পড়ল। ইয়াকুব অর্ডার করে, 

একটা কইরা বন আর একটা কইরা রস গুল্লা দেন। সিরা এট্টু বেশি কইরা দিয়েন। 

-পইসা আছে তো লগে? 

ব্যঙ্গের সুরে দোকানদার জিজ্ঞেস করলে ইয়াকুবের সপাট জবাব, 

-নাইলে কি মাগনা খাইতে আইছি? 

ক্ষিদের পেটে ঝপাঝপ খেয়ে ইয়াকুব পকেট থেকে পয়সা বের করল। ফড়িংকেও পয়সা বের করতে দেখে বলল, 

-তুই রাখ আমি দিতাছি। 

আবার চলতে লাগল।কিন্তু সাগরদীঘি কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। চলতে চলতে শহরের নিষিদ্ধ গলিটাতে ঢুকে পড়েছে। চোখের পড়ল কতগুলো অর্ধউলঙ্গ মেয়ে বসে আছে ঘরের বারান্দাগুলিতে। ইয়াকুব বুঝে গেছে ভুল পথে চলে এসেছে ওরা। রিকশাওয়ালা ভুল ঠিকানা দিয়েছে ওদের। একটি মেয়ে এগিয়ে এসে ইয়াকুবের হাত ধরে বলল, 

-দেখতে এসেছিস? 

আরও কয়েকটি মেয়ে এসে দুজনকে ঘিরে ধরল। ইয়াকুব ভয় পেয়েছে। থতমত খেয়ে বলল, 

- আমরা সাগরদীঘি দেকতে আইছি। 

-সাগরদীঘি! 

বলে মেয়েগুলো একসাথে হেসে উঠল। ফড়িং ভয়ে কাঁপছে। 

-এই বয়সেই সাগরদীঘি দেখার সখ হয়েছে। পয়সা আছে? সাগরদীঘি দেখতে পয়সা লাগে। 

বলে একটি মেয়ে দুজনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একজনের পকেট থেকে একটাকা আর একজনের পকেট থেকে পাঁচ সিকে বের করে আনল। 

-এই টাকায় তো সাগর দীঘি দেখা যাবে না। 

-আমরা দেখমু না। আমাদের ছাইড়া দ্যান! 

ইয়াকুব বলল। 

এদিকে ফড়িং ইয়াকুবকে ঈশারায় কিছু বোঝাতে চাইছে তখন একটি মেয়ে ফড়িংয়ের হাত ধরে কাছে টানতে গেলে ফড়িং সোজা হাতে কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল, 

-ভাগ ইয়াকুব। 

বলে দৌড়। ইয়াকুবও এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে ফড়িংয়ের পেছন পেছন দৌড়। দৌড় দৌড় আরও দৌড়।ডান দিক বাঁদিক। আরও দৌড়। দৌড়তে দৌড়তে এক বিশাল বড় দীঘির সামনে এসে দাঁড়ায়। ফড়িং থামে দীঘির পাড়ে।ইয়াকুব বলে, 

-এইডাই সাগরদীঘি বুজলি। 

দুজনে সাগরদীঘির জলে তাকিয়ে রইল। জলের ওপর পোড়া ইঁটের ল্যান্সডাউন হল, রাজার বিচারশালার ছায়া পড়েছে। তারপর দু'জনে সাগরদীঘির জলে মুখ ধুয়ে নিল। ইয়াকুব বলল, 

-চল কিছু খাই। 

-পইসা কই পাবি? 

-আছে। 

বলে চোরাই পকেট থেকে দুটাকা বের করে বলল, 

-বিপদের সম্বল রাহুন লাগে, বুজলি! 

ইয়াকুব একটা দোকান থেকে মুড়ি আর কিছু চানাচুর কিনে আনল। সাগরদীঘির পাড়েই একটা গাছের নীচে বসেই চারপাশে গাড়ি, মানুষজন দেখতে দেখতে খাওয়া শেষ করল। 

ফড়িংদের কামরাঙা গাছটায় খুব কামরাঙা হয়েছে। তাতে দুটো ঘুঘু অনেকক্ষণ থেকে বসে লাফালাফি করছে। ফড়িং বসে বসে তা দেখছে। আর দূরে ইয়াকুব মাথায় গামছা বেঁধে ছোট্ট একটা ডেকচিতে মাছের খাবার নিয়ে বৈরালী মাছের বাচ্চা ধরতে ফাঁদ বসাচ্ছে তোর্সার কিনারাটায়। এরই মধ্যে দু'একবার ইয়াকুব ইশারা করে ফেলেছে। কিন্তু ফড়িং দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ। আজ সে কোনও ভাবেই যাবে না। 

সে দিনের পর থেকে ইয়াকুবের সঙ্গে ফড়িংয়ের মেলা মেশা প্রায় একরকম বন্ধ। সে দিন মহা ঝামেলা হয়ে গেছে। ফড়িংয়ের মা ইয়াকুবের মায়ের কাছে নালিশ জানিয়ে এসেছে। ফড়িং এখন শুধু স্কুলে যায় আর বাকি সময় কামরাঙা গাছের তলায় বসে একা একাই খেলে। 

ইয়াকুব কিছুক্ষণ পরে এসে ফড়িংয়ের সামনে ডেকচির মুখটি খুলে দিয়ে বলে, 

-দ্যাক, কত্তগুলা পাইছি! 

বৈরালী মাছের বাচ্চাগুলো ঝলঝলে। কতগুলো লাফাচ্ছে। তার মধ্যে থেকে এক খামচা তুলে কচুপাতা মুড়ে দিয়ে বলে, 

-নে বাড়িত লইয়া যা! 

ফড়িংয়ের মাছগুলি মনে ধরেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। না-ও বলতে পারছে না। 

- আমি নিতাম না। মা বকব। 

- আরে বকত না, তুই লইয়া যা। 

ইয়াকুব জোর করে মাছের টোপলাটা গুজে দিল। ফড়িং শেষমেষ মাছগুলি বাড়ি নিয়ে গেল। 

ফড়িংয়ের মা মাছগুলি দেখে খুশিতে গদগদ। 

-মাছ তুই মারসস? 

-না! 

-তাইলে? 

-ইয়াকুব দিয়া দিল জোর কইরা। 

ফড়িংয়ের মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বটি নিয়ে মাছ কাটতে বসল। 

-অনেকগুলা পাইছে তাই না-রে? 

-হ, প্রায় এক ডেকচি। 

-তাইলে তো অনেক। ছেড়াডার মনডা বালা আছে বুজলি! 

ফড়িং বুঝে উঠতে পারে না, তার মা আসলে কি চায়। কখনও ইয়াকুবের সাথে মিশতে বারণ করে কখনও ইয়াকুবদের বাড়ি থেকে খুদকুড়া চেয়ে এনে গোরুকে খাওয়ায় আবার কখনও বলে, 

-এত পেডে পেডে বন্দু বালা না। ওরা ভিন জাইত্যা। একটু দূরেই থাক! 

ঝামেলা বাঁধলো একদিন ইয়াকুবকে নিয়েই। তোর্সার কিনারাটায় ফড়িয়ের জ্যাঠার একটি ভাঙা নৌকো বাঁধা থাকতো। এই নৌকো করেই বর্ষায় মধুপুর হাটে যাতায়াত করত ফড়িংয়ের বাবা-কাকারা। ছোটোখাটো দুএকটা মালের বোঝাও এপার ওপার করত। একদিন ভরদুপুরে ইয়াকুব ফড়িংকে নিয়ে নৌকোয় খেলছিল। আর খেলতে খেলতে কখন নৌকো মাঝ নদীর স্রোতে পড়ে গেছে ফড়িং টের পায় নি। নৌকো সামলাতে না পেরে দুজনে জলে ঝাঁপদিয়ে কোন রকমে ডাঙায় এসেছে। আর নৌকো ভেসে গেছে জলে। আর এ ঘটনা নিয়ে মহা-ধুন্ধুমার ফড়িংয়ের বাড়িতে। ইয়াকুবকে কামরাঙা গাছের সাথে বেঁধে বেদম পিটিয়েছে ফড়িংয়ের কাকা। ফড়িংও বাদ যায়নি। ইয়াকুব আরেক দফা খেলো তার বাবার হাতে। ঠিক হল কিছুতে আর ইয়াকুবকে বাড়িতে রাখবে না। হয় বাবার সঙ্গে ভুটান নয় সিরাজ মিঞায় চায়ের দোকান। যেকোনও এক জায়গায় তাকে যেতেই হবে। শেষে সিরাজ মিঞার চায়ের দোকানই বেছে নেয় ইয়াকুব। 

ফড়িংয়ের স্কুলের সামনেই সিরাজ মিঞার দোকান। সিরাজ মিঞা বিখ্যাত মন্ডা মিঠাইয়ের কারিগড়। এক ডাকে সবাই চেনে। ফড়িং জল খাওয়ার বাহানায় ইয়াকুবের সঙ্গে দেখা করে রোজ। আর জল খেতে এলে একটা রসগোল্লা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, 

-- খালি জল খায়ুন লাগে না। এইডা খায়া খা! 

আবার কোনও কোনও দিন হাতে একটা আধুলি ধরিয়ে দিয়ে বলে, 

-- বন রুটি কিন্না খাইস। 

একদিন ইয়াকুবকে হাতে নাতে পাকড়াও করল সিরাজ মিঞা। ফড়িংকে রসগোল্লা দিতে যাচ্ছিল ইয়াকুব। আর ধরেই বলল, 

--রস গোল্লা কী তর বাপে বানায়া থুইয়া গেছে? কমজাত! বাইর হ দোকান থেইক্যা! 

ইয়াকুবের বাবার কাছে এসে সিরাজ নালিশ জানিয়ে গেছে। 

-- তর ছেড়ারে আমি রাখতাম না। অর স্বভাব বালা না। পয়সা এদিক ওদিক করে। 

ইয়াকুবের মা এসব কথা বিশ্বাস করে না। তার ছেলে এসব করতেই পারে না। সিরাজ মিঞার মুখের ওপর বলে দেয়, 

-- ছেড়া আমার বদমাসি করে মানলাম কিন্তু চুরি করে তে-মাথাত দাঁড়ায়া কইলেও বিশ্বাস করতাম না!.... আফনে বাড়িত যাইন, কাইল থেইক্যা ও আর যাইতো না। 

সৎ মা ইয়াকুবকে ঠিকঠাক খেতে দেয় না। ইয়াকুব মাঝে মাঝে রাজমিস্ত্রির কাজে বাবাকে সাহায্য করে। সৎমা চোখের সামনে বড় মাছ, ভালো মন্দ তার সৎ ভাই বোনদের পাতে তুলে দেয়। কিন্তু এসবেও ইয়াকুবের কিছু মনে হয় না। সে মনের আনন্দে ছোট ভাইবোনেদের সাথে খেলা করে। তবে সব থেকে খারাপ হল একটি ঘরেই সারাদিন বন্দি হয়ে থাকতে হয় তাদের। আসলে এটা তো তার গ্রাম নয়, এখানে তোর্সা নেই, নৌকো নেই, কাশবন নেই। এটা ভুটান দেশ, রাজার দেশ। চারিদিকে শুধু উঁচু উঁচু পাহাড়, পাথর আর বর্জ্রপাত। প্রথম প্রথম এসব দেখে দেখে ইয়াকুবের সময় কেটে গেলেও এখন আর এসব ভালোলাগে না। বার বার তোর্সা নদী তাকে ডাকে। বৈরালি মাছের রঙ তার চোখ ঝলসে দেয়।একদিন বাবাকে বলে বসে, 

--আমারে বাড়িত দিয়াও! 

--ক্যা! 

-- আমার ভাল লাগে না! 

-- মন দিয়া কাম শিখ, বাড়ির কথা মুখে আনিস না। বড় হইয়া হেড মিস্ত্রি হবি। 

ইয়াকুব হেড মিস্ত্রি হতে চায় না। সে চায় তার অনেক গোরু থাকবে, তোর্সার চরে ঘুরে বেড়াবে, তোর্সার চরের রাজা হতে চায়। তার মায়ের পাশে শুয়ে আঠারো কাঠার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। 

ঈদের সময় ইয়াকুব বাড়ি আসে। মায়ের জন্য শাড়ি আর ফড়িংয়ের জন্য এনেছে একটা পেট মোটা বুদ্ধের মূর্তি। ফড়িংয়ের হাতে দিয়ে বলে, 

--- নে এইডা ঘরের এক কুনাত বহায়া রাহিস। আর সকালে ঘুম থেইক্যা উইঠ্যাই পন্নাম করিস। আর আমি ভুটান যাইতাম না। বালা লাগে না, সারাদিন দমফুটার লাহান ঘরে বইয়া থাকুন লাগে। 

--- তর বাপে তরে ঘাড় ধইরা নিয়া যাব দেহিস। 

--- না না, আমি যাইতামই না। 

শেষপর্যন্ত ফড়িংয়ের কথাই সত্য হল। ইয়াকুবকে জোর করেই নিয়ে গেল তার বাপ। কিন্তু তারপর যেটা ঘটল কেউ তা আশা করেনি। ইয়াকুব মাঝপথেই পালিয়ে গেল। কোথায় গেল কেউ তা জানে না। বাড়িতেও আসেনি। 

বাপ বাড়িতে এসে দু'একদিন এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে একদিন প্রচণ্ড রাগে ইয়াকুবের মাকে ধরে লাঠিপেটা করল। 

-- কমজ্জাত মাগি, তুই লাই দিয়া ছেড়ারে বদমাস বানাইছস। এহন মরগা। - তালাক! তালাক তালাক! বলে ইয়াকুবের বাপ চলে গেল। 

সকাল থেকে ফড়িংয়ের মন ভালো নেই। আজ তাদের স্কুল ছুটি। গতকাল তার স্কুলের এক ছাত্র জ্বরে ভুগে মারা গেছে। আর এদিকে ইয়াকুবেরও কোনও পাত্তা নেই। ফড়িংও দুএক জায়গায় ইয়াকুবের মায়ের সাথে খুঁজতে গিয়েছিল। কোথাও খুঁজে পায়নি। হাতে ইয়াকুবের দেওয়া বুদ্ধ মূর্তিখানি নিয়ে কামরাঙা গাছ তলে বসে বসে দূরে তোর্সা চরের দিকে তাকিয়ে আছে। 

আজ মধুপুর হাট বার। কত লোক এপার ওপার হচ্ছে! দূরে ওপারে মন্দিরের চূড়াখানি দেখা যাচ্ছে। লাল নিশান উড়ছে। বহু প্রাচীন মন্দির। ইয়াকুব তাকে এই মন্দির দেখিয়ে এনেছে। হঠাৎ দুটো ছোটো হাত পেছন থেকে ফড়িংয়ের চোখ ঘিরে ধরল। এই হাত ফড়িংয়ের বহুকাল চেনা। হাতের গন্ধও চেনা। 

--- ইয়াকুব! কই আছিলি তুই এত্তদিন? ফড়িং চমকে ওঠার মতো চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল। 

--- আছিলাম! পরে কই আগে ইট্টু জল দে! 

ফড়িং বাড়ি থেকে গেলাসে করে জল এনে দিল। 

--- কী-রে মুখ লাগায়া খামু তো? 

অন্যদিন হলে ফড়িং বলত 'মুখ লাগাইস না, মা বকব!' কিন্তু আজ ইয়াকুব-কে ফিরে পাওয়ার আনন্দে বলল: 

---খা-না! কিছু হইত না! 

---আইচ্ছা! 

ইয়াকুব জল খেয়ে বলল, 

--- রেল স্টেশনে আছিলাম। একটা চায়ের দোকানে কাম করছি। কত রেল গাড়ি দেখছি। দৈনিক খাওয়া দিত আর পাঁচ টেহা কইরা নগদ। দোকানের বেডাডা খুব বালা আছিল। আদর করত। 

---তাইলে আইলি যে? 

--- আইলাম আর-কি। দোকানে থাকতে বালা লাগে না। সারাদিন খালি মাইনসের ফরমাইস খাটো! 

---বালা করছস। যা বাড়িত যা! তর মায়ে খুব খোঁজাখুঁজি করছে! 

--- হ! মারে ছাইড়াই তো থাকতে বালা লাগে না। বলে পকেট থেকে একটা সাজের ঘোড়া বের করে ফড়িংয়ের হাতে দিয়ে বলল, 

---এইডা তর লেইগা আনছি!খা! আর শোন আর একটা জিনিস আনছি, পরে দেহামু! বলে ইয়াকুব চলে গেল। 

ইয়াকুবের মায়ের মনে বড় অশান্তি। ইয়াকুবের বাপ তালাক দিয়ে গেছে। সংসার কীভাবে চলবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ইয়াকুবকে দেখেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল: 

---নির্বংশা, মরতে পারলি না! কারে মুখ দেহাবার আইছস। গেছস তো আবার আইছস ক্যা? ইত্যাদি ইত্যাদি। 

ঘন্টা খানেক চলল এরকম। তারপর লবণ লঙ্কা সহ এক গামলা পান্তা ভাত সামনে দিয়ে বলল, 

নে, খায়া মর! 

ইয়াকুব ভাত খেতে খেতে বলল, 

-- মা, তুমি রাগ করছো? কি করমু, আমার ভুটান যাইতে ভালা লাগে না। 

--যাবি না তো খাবি কি? মাইনসে খাবার দিবো? 

-- তুমারে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না। 

মায়ের মন গলতে আর কতক্ষণ। ইয়াকুবের বয়স বা কতটুকু। এখনও তার খেলে বেড়ানোর সময়। স্কুলে যাওয়ার সময়। ইয়াকুবের মা বলে, 

-- তাইলে স্কুলে ভর্তি হ! কাইল থেইক্যা স্কুলে যা। 

-- পড়া শুনা ভাল লাগে না। তাছাড়া পইড়্যা কেডা বড় লুক হইছে? 

-- ভুটান ভালা না,পড়া ভালা না, তাইলে তুই কী করবি? 

--চরে গোরু চরামু। ইয়াকুবের সটান জবাব। 

--ওই কর! বাপের মতো সারাজীবন মাইসের কামলা খাট। 

শেষ পান্তা ভাতের জলটুকু চুমুক দিয়ে খেয়ে গামলাটা কলপাড় থেকে ধুয়ে এনে রান্না ঘরের দুয়ারে রেখে বলল: 

--ফড়িংয়ের লগে একটু দেহা কইরা আহি! 

-- এই তো, বাড়িত পা না দিতেই শুরু হইয়া গেল! 

মায়ের কথা পাত্তা না দিয়ে ইয়াকুব গামছাখানা টান দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল। 

ফড়িং তখনও কামরাঙা গাছে নিচে বসে আছে। ইয়াকুব এসে বলল, 

-- চল, রেল ব্রিজের নীচে যাই। 

-- ক্যা? 

--আ-রে চল না! 

দুজনে তোর্সার ওপর নতুন রেল ব্রিজটার তলে গিয়ে দাঁড়াল। 

রেল ব্রিজের কাজ সবে শেষ হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই গাড়ি চলবে। ইঞ্জিন চলা শুরু হয়েছে। ইয়াকুব নদীর পাশে বাঁধানো পাথরগুলোর ওপর বসে পকেট থেকে একখানি চটি রঙিন বই বের করল। ফড়িংকে ডেকে বলল, 

-- এদিগে আয়। 

ফড়িং পাশে বসতেই তার সামনে বইয়ের পাতাগুলো মেলে ধরে বলল, 

--দ্যাখ! 

ফড়িং জীবনের প্রথম এসব দেখছে। নগ্ন নারীর দেহ, পাতার পর পাতা। ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমায়। সমস্ত পাতা উল্টে দুজনে দেখল। 

-- তুই কই পাইলি? 

ইয়াকুব মাথা নেড়ে নেড়ে বলল, 

--পাইছি! এক ফেরিওয়ালা দোকানে চা খাইতে আইত। হেই বেডায় দিয়া কইল চুপ কইরা দেইখ্য। বালা জিনিস! 

--পয়সা নেয় নাই? 

--না! 

-- এহন কী করবি বই-ডা? 

-- বাড়ি নিয়ুন যাইতো না! বালির নিচে কুইপ্যা থুমু। আর কি করমু এইডা দিয়া! তরে দেহানির লেইগ্যা রাখছিলাম। 

ইয়াকুব কথা মতো বালির নিচে পুঁতেই রাখল বইখানি। তারপর দু'জনে নতুন রেল ব্রিজে ওঠে ইঞ্জিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। 

তোর্সায় নতুন চর জেগেছে। এবারে চরের আয়তন আরও বেশি বড়। ইয়াকুব জল থাকতেই সাঁতরে সাঁতরে নদীর বুকে বিঘা চারেক জমিতে খু্টি পুঁতে রেখেছিল। সবচেয়ে বেশি জমিতে খুঁটি পুতেছে ফড়িংয়ের কাকা। জল কমতেই চরের বুকে নতুন জংলা ঘাস, শন, কাশিয়া গজিয়ে উঠেছে। সবাই যে যার চর তদারকির জন্য নৌকো করে চরের মধ্যে হাজির। যথারীতি ইয়াকুবও। কোদাল নিয়ে সবাই উঁচু করে আল বাঁধছে জমির সীমানায়। ইয়াকুব গিয়েছে কতগুলো বাঁশের খুটি নিয়ে সীমানার চারপাশে পুঁততে। কিন্তু কোথায় তার জমি? যে খু্টি সে পুঁতে রেখেছিল তার চিহ্ন কোথাও নেই। ফড়িংয়ের কাকা উঁচু করে আল বেঁধেছে তার জমি বরাবর। 

---আমার জমির ওপর মাল্লি বাঁনছো ক্যা? ফড়িংয়ের কাকার কাছে জানতে চায় ইয়াকুব। 

---কুনডা তর জমি? 

---এইডাই! 

---চিহ্ন কই? 

---চিহ্ন আমি দিছিলাম। কয়দিন আগেও ছিল। 

---চিহ্ন নাই তাইলে কেমনে কস এইডা তর জমি! 

--হ, এইডাই আমার জমি! 

--- ভেজাল বাজাইস না! বাড়িত যা। 

ইয়াকুব কিছুতেই জমি ছাড়বে না। সে অনেক কষ্টে নদীতে সাঁতরে সাঁতরে খুটি পু্ঁতে ছিল। সে আরও দশজন মানুষ ডেকে আনে। সবার একই প্রশ্ন: 

--- তর যে জমি তার চিহ্ন কই? 

চিহ্ন সে দেখাতে পারে না বলে তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। দশজন মানুষের রায় - যেহেতু ইয়াকুব কোন চিহ্ন দেখাতে পারেনি অতএব জমি সবটুকুই ফড়িংয়ের কাকার। 

কিন্তু ইয়াকুব কিভাবে মানবে এ জমি তার নয়! সে তো নিজে সাঁতরে এসে জমিতে বাঁশের কঞ্চি পু্ঁতে রেখে গেছে। আর কঞ্চির ওপর লাল নিশান। দূর থেকে দেখা যেত, হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। রাতারাতি তাহলে কী হল! ইয়াকুবের মা ইয়াকুবকে বোঝায়, 

---দুঃখ করিস না। নদীর জমি আইজ আছে কাইল নাই! তাছাড়া বুজবি না আরও অনেক কিছু আছে! মাইসে চায় না আমরা এই গ্রামে থাহি। তাই এত কিছু। 

ইয়াকুব মায়ের কথা শোনে অনেক রাত পর্যন্ত না খেয়ে চুপ করে বসে থাকে। রাত বাড়তে থাকে। এক সময় ইয়াকুব ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অন্ধকারে মিশে যায়। 

চরে তরমুজ ফেলেছে জবর। ইয়াকুব সারাদিন গোরু চরায়, একদিন গোরু ছেড়ে দিয়ে নদীর শীতল হাওয়ায় শনের চালার নিচে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম ভাঙে ফড়িংয়ের কাকার লাথি খেয়ে। গোরু গিয়ে লেগেছে তরমুজ ক্ষেতে, অনেক গাছ নষ্ট করে ফেলেছে। ফড়িংয়ের কাকা হুমকির সুরে বলে, 

--- কাইল থেইক্যা গোরু এদিগে আইলে তরে সুদ্দা খুয়ারে দিমু! 

ইয়াকুব পরের দিন আবার গোরু নিয়ে সেখানেই যায়। একদিন ফড়িংয়ের কাকা একটা আধপাকা তরমুজ খেতে দিলে ইয়াকুব বলে, 

---আমি তরমুজ খাই না! 

চর জুড়ে কেবল তরমুজ, আর তরমুজ। গাছগুলি মরে গেছে। গোরুর গাড়ি ভর্তি করে করে প্রতিদিন তরমুজের চালান যায় শহরে। সেখান থেকে আসাম-বিহারে। ফড়িংও আসে তাদের জমিতে তরমুজ তুলতে। সে-ও একদিন ইয়াকুবকে ডেকে তরমুজ দিলে ইয়াকুব বলে, 

--- আমি তরমুজ খাই না। 

--- ঢং মারিস না। খা! 

--- না! আমি খাই না। 

---ঠিক আছে, আমারে কোন জিনিস আরেকদিন দিস খালি! বলে ফড়িং তরমুজ ঢিল মেরে তোর্সার জলে ফেলে দিল। 

আবার বর্ষা এল। তোর্সা জল এপার ওপার সমান। ফড়িং কামরাঙা গাছের নিচে বসে বসে নদীর জল দেখে। ইয়াকুব এদিকে আর আসে না আজকাল। সারাদিন গোরু ছাগল নিয়ে বাড়িতেই পরে থাকে। হাঁস মুরগিতে বাড়িখানা গিজগিজ করে। ডিমদুধ বিক্রি করেই চলে তাদের সংসার চলে। তবে মিঞা বাড়ির দুধ পাড়াতে কেউ কেনে না। ইয়াকুব সিরাজ মিঞায় মিষ্টির দোকানে দিয়ে আসে। সিরাজ মিঞা যে দাম দেয় তাতেই সন্তষ্ট থাকতে হয়। ইয়াকুবের বাপও কোন খোঁজ খবর নেয় না আর। 

নদীর জল কমে এলে ইয়াকুব আবার সাঁতার লাগায় জলে। বিঘার পর বিঘা জমিতে খুঁটি পুঁতে দেয়। এবার সমস্ত চর প্রায় সে একাই দখল করে। ইয়াকুবের আগে কেউ খুঁটি পুঁততে পারে নি। আর যারা পুঁতেছে খুব কম জমিই তারা পেয়েছে। জল কমে এলে সবাই কোদাল কাঁধে নিয়ে আল দিতে চলে চরে। এবার সমস্ত জমি ইয়াকুব শক্ত করে সীমানা দিয়ে রেখেছে। দু একজন ছাড়া আর কেউ পায়নি। ফড়িংয়ের কাকা আগের জমিতেই আল বাঁধা শুরু করে দিল। আর তাকে দেখেই সবাই ইয়াকুবের জমির ওপর আল দিতে শুরু করল। ইয়াকুব চিৎকার করে বলে, 

--- খবরদার! আমার জমির উপরে কেউ মাল্লি বানবেন না। 

--- কই তর জমি? ফড়িংয়ের কাকা ভেংচে ওঠে। 

--- ওই দেহেন নিশান দেওয়া! 

--- নিশান দিলেই তর হইয়া গেল? 

---গতবার নিশান আছিল না, তাই জমি পাই নাই! এইবার শক্ত কইরা দিছি। 

--- জমি তর বাপে কামাই কইরা থুয়া গেছিল। 

---বাপে কিছু থয় নাই। আমি কষ্ট কইরা দহল করছি। 

ইয়াকুবের চিৎকারে আবার দশ জন এল। দশ জনের রায় গত বছরের যার জমি -- এবারও তারাই পাবে। ইয়াকুব রায় মেনে নিতে পারে না, 

--- আমি মানতাম না! একফুডা জমিও দিতাম না। ইয়াকুব রুখে দাঁড়ায় বাঁশ হাতে। 

--- দিতি না তর বাপে দিব! বলে ফড়িংয়ের কাকা কোদাল নিয়ে তেড়ে আসে। 

ইয়াকুবও সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করে ফড়িংয়ের কাকার মাথায়। আর পেছন পেছন আরেক আঘাত পড়ে ইয়াকুবের মাথায়। তারপর এক দুই তিন..করে বাঁশের বারি পড়ে ইয়াকুবের মাথায়। ইয়াকুবের মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যায়, চরের জমি লাল হয়ে ওঠে। 

ইয়াকুবের মা এসে চিৎকার করে করে ডাকল ইয়াকুবকে, ইয়াকুব আর জাগল না। ফড়িং এসে ডাকল হাজার বার, 

--ইয়াকুব...! ইয়াকুব....! ইয়াকুব..! 

ইয়াকুব আর জাগলো না। 

খুনের অপরাধে সাত জনের জেল হল। তিন মাস জেল খেটে একে একে সবাই ফিরে এল। ইয়াকুবের মা নিকা করে সিরাজ মিঞার কাছে চলে গেছে। ইয়াকুবদের বাড়িটা এখনও পড়ে আছে। ইয়াকুবের কবরের মাটি বসে গিয়ে সমান হয়ে গেছে। ফড়িং কামরাঙা গাছটার নিচে বসেই খেলা করে। আর তোর্সার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

আবার বর্ষা এল। এবার তোর্সার গতিক ভালো নয়। আগে থেকে ফুঁসছে। জল দিন দিন ওপরে ওঠছে। নদীর বাঁধ ভাঙছে এক এক করে। বাড়ি ছেড়ে স্কুল ঘরে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে। ফড়িংরা ইয়াকুবদের পুরনো বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে গোরু বাছুর সহ। তাদের বাড়িখানা নদী ভাঙনে তলিয়ে গেছে। থাকার মধ্যে শুধু কামরাঙা গাছটাই আছে। তাও হেলে পড়েছে নদীর ওপর। 

জল কমে এলে এক এক করে সবাই ফিরে এলো গ্রামে। তোর্সা চলে এসেছে এপারে। ফড়িংদের পাড়ার একটি বাড়িরও চিহ্ন নেই। নদীর স্রোত সব গিলে খেয়েছে। ইয়াকুবদের বাড়িতে ফড়িংরা স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করল। ইয়াকুবের ঘরখানা ফড়িংয়ের বরাদ্দ। আরও দুটো টিনে চালাও উঠল উঠানে তুলসীর চারা। মিঞা বাড়ি হল হিন্দু বাড়ি। 

এপারে এবার কোন চরের চিহ্ন নেই। চর জাগবে ওপারে। ওপারে চর দখলের চিহ্ন বাঁশের আগায় লাল নিশান উড়ছে- পত্পত্ করে। ফড়িং হেলে পড়া কামরাঙা গাছটাতে বসে লাল নিশানের দিকে চেয়ে থাকে। তোর্সার ফেরি ঘাটের দিকে হাটবারে দিনে লোকের পারাপার দেখে। স্কুলে গিয়ে সিরাজ মিঞার দোকানে মিষ্টি কিনে খায়। বাকি সময় ইয়াকুবের দেওয়া বুদ্ধ মূর্তিখানি হাতে নিয়ে হেলে পড়া কামরাঙা গাছের ওপর বসে থাকে। একদিন দুটু হাত ফড়িংয়ের চোখ ঘিরে ধরে। আবার সেই চেনা গন্ধ। ফড়িং চিৎকার করে ওঠে: 

--- ইয়াকুব! কই আছিলি এত্তদিন? 

ফড়িং পেছন ফিরে দেখে কিছুই নেই। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

7 মন্তব্যসমূহ

  1. আমি মুগ্ধ প্রলয় দা ।চেনা মানুষের গন্ধ ।খুব ভালো লেগেছে ।

    উত্তরমুছুন
  2. সবকিছু ঠিক আছে । কিন্তু ভাষা তো বাংলাদেশের ! কোচবিহারের লোকেরা কি এই ডায়লেক্টে কথা বলে ?

    উত্তরমুছুন
  3. বলে। কোচবিহারের বসবাসকারী অনেক লোকের আদি বাড়ি তো এখনকার বাংলাদেশেই ছিল। ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  4. ভালো লাগলো স্যার গল্পটা পড়ে । ধন্যবাদ এত সুন্দর একটি গল্প লেখার জন্য ।

    উত্তরমুছুন