কথা হচ্ছিল মেরুন পলা বাঁধানো নিয়ে। গায়ে কিছু চিকনচাকন ডিজাইন নেই। খালি দুটো মকর মুখ। সে মুখের গড়নও চমৎকার। ভাল কারিগরের করা। কিন্তু সেটাও কথা নয়। অনুদির রোগা ডান হাতে বেশ মানায়।
—অন্য চুড়ি পরেন না কেন অনুদি? আজকাল বাজারে কত কী সুন্দর সুন্দর ইমিটেশন বের হয়েছে। সিটি গোল্ডের বালা এমন যে সোনার নয় বলে বিশ্বাসই হয় না। উমা বলে।
-দুর, আমার কি আর সাজগোজের বয়েস আছে? সে এখন তোদের। ট্রেনের জানলার দিকে মুখ রেখে অনুদি বলেন। দুই রগের কাছে কাঁচাপাকা চুল ওড়ে অনুদির। উমা বিপরীত দিক থেকে দুই পা তুলে দেয় অপর দিকের সিটে, একেবারে অনুদির কোলের পাশটিতে।
-কী যে বলেন আপনি। আয়নায় নিজেকে দেখেন? আপনার যে পঞ্চাশ হল কেউ না বললে লোকে বিশ্বাসই করবে না।
অন্য কেউ হলে এ সব কথা উড়িয়েই দিতেন অনুপমা। আসলে উমার গলা শুনে বোঝা যায়, ও মিথ্যে মিথ্যে প্রবোধ দিচ্ছে না। ওর সঙ্গে তাই খানিক গল্প করেন তিনি। যাতায়াতের পথে খানিক খানিক হালকা হওয়া। নইলে অফিস যা হয়েছে, লোকজন নেওয়া বন্ধ হওয়ার পর শুধু কাজ তো কাজ। দম ফেলার অবসর নেই। আর বাড়িতে তিনি বোবা। কাজের মাসি তো একটা কালাবুড়ি। ওর সঙ্গে বকা আর পাথরের সঙ্গে বকা সমান। ট্রেনের এই ডেলি প্যাসেঞ্জারিতেই যা স্বস্তি। যেটুকু মনখোলা।
আজ বৃষ্টির দিন। আগের একটা লেট এক্সপ্রেস পেয়ে অনেকেই চলে গেছে। তাদের দুজনের যেমন গাঁ-গঞ্জে ঘর, লোকাল ট্রেন ছাড়া গতিই বা কী। কাজেই আজ তাঁরা দুজন। উমা টিফিনবক্স খুলে মুড়ি-বাদাম বের করল। একজন চেনা হকার ওদের শিঙাড়া দেয়। আজ সে নেই। উমা বলল, জানলা বন্ধ করে দিন অনুদি, ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। আমাদের আবার জ্বরটর এলে সি এল নিতে হবে।
-সত্যি একটু যে জুড়াব, তার উপায় নেই। যাক, মেরেকেটে আর দশ বছর। তারপর চাকরি শেষ। ঘরে বসে হাওয়া খাব। অনুদি হাসতে হাসতে বলেন।
—আপনার তো দশ বছর পর শেষ। আর আমার, ভেবে দেখুন তো। ইস, আপনি চলে গেলে কী করে যে এ পথে যাব? ভাবতেই পারছি না। আসলে অভ্যেস হয়ে গেছে।।
—সবই অভ্যেস হয়ে যায় উমা। তোরও হবে। অনুদি মুড়ি চিবোন। কয়েকদিন আগেই উনি দাঁতের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। বলেছিলেন, মনে হয় তুলতে হবে।
আগে কখনো দাঁত তোলেননি বলে ভয় পাচ্ছিলেন। উমা বলেছিল, দেখুন কী হয়। তেমন কিছু হলে, রবিবার করে ডেট করবেন, আমি সঙ্গে যাব। তারপর অবশ্য ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমে গেছে। আপাতত আর দাঁত তোলবার প্রসঙ্গ উঠছে না।
ভালোই হয়েছে। উমা নিয়ে যেত নিশ্চয় অনুদিকে। এটা তার দায়িত্ব, কর্তব্য। কিন্তু এ নিয়ে বাড়িতে মন কষাকষি হত। বাসুদেব, তার স্বামী চায় না উমা পাঁচজনের ব্যাপারে মাথা ঘামাক। বাসুদেবের ধারণা, উমার একেবারেই বাস্তববোধ নেই। ওকে সাধাসিধে মেয়ে দেখে সবাই খাটিয়ে নিচ্ছে।
সত্যিই, রবিবার একটাই ছুটির দিন। উমার সত্যিই ভালো লাগে না সে দিন কোথাও বের হতে। আত্মীয়স্বজনও ভালো লাগে না। উমা খানিকটা আনমনা, বিষণ্ণ বোধ করে। তারপর বলে, ‘একটা কথা অনুদি, অভ্যেস কোনও কিছুকেই মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব বড়ো জিনিস এ তো বুঝি। কিন্তু দেখুন বাসুদেবের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার পর তো বছর ঘুরে গেল। তারও আগে পাঁচ বছর আপনি জানেন আমরা কত ঘুরেছি। আমার স্বভাবচরিত্র ওর এখনও অভ্যেসে এল না কেন, কিংবা আমিই বা ওর সব ধরনধারন মেনে নিতে পারছি না কেন’?
–কেন, আবার কী হল? অনুদি প্রশ্রয়ের চোখে তাকান।
–না, তেমন কিছু নয়। রবিবার দিনটা খিচিমিচি একটুও ভালো লাগে না। তবু কী করব, পাড়ার কতকগুলো বাচ্চা পনেরোই আগস্টে ফাংশন করবে। ওরা আসে আমার কাছে অনেক আশা নিয়ে। আমি ছাড়া আর কার কাছেই বা যাবে বলুন? সেখানেও বাসুর আপত্তি। আর এ দিকে ওদের বাড়ির লোক আসা দেখুন লেগেই আছে। এই ওর দিদি-জামাইবাবু গেল, আবার মাসি এসেছে।
-তোর শ্বশুরবাড়ির লোক বলে কথা। তাদের জন্যে করতে হবে না?
—আমি কী করি না অনুদি, আপনিই বলুন? বাসু তো আমার কত পরে চাকরি পেল। ওর ভাইকে আমিই তো পড়ালাম। দেখুন, ওর মায়ের শরীর খারাপ। ছেলেমেয়ে কেউ গ্রাহ্য করে না। আমি নিয়ে এলাম। ডাক্তার দেখালাম। ওষুধপত্র, ফি—সব আমি খরচা দিলাম। তার বেলায় ও চোখে চেয়ে দেখে না। যেন এগুলো কত স্বাভাবিক। এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে উমা হাঁফায়।
—হুঁ হুঁ বাবা, পুরুষমানুষ! অনুদি অভিজ্ঞের হাসি হাসেন। আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে রে উমা, এর বাইরে তো কই অন্য কিছু দেখলাম না।
—মেয়েরা চাকরি করে জানেন, আরও অসুবিধা হয়েছে। বাড়ির কাজ, বাইরের কাজ, টাকাপয়সা সবই সংসারে দরকার।
--আস্তে আস্তে সব সহ্য হয়ে যাবে উমা।
--আমার হবে না মনে হয় জানেন। কেন সহ্য হচ্ছে না বলুন তো?
--স্বামী ছাড়া মেয়েদের আর কে আপন আছে রে। শেষ পর্যন্ত ওই ভরসা।
আমার দেখ না, তিনি মারা গিয়েও কি আমাকে ছাড়ছেন? তাঁরই চাকরি করছি।
--সেটা তো অন্য ব্যাপার। এটা আপনার প্রাপ্য।
-কীসের প্রাপ্য রে উমা? আমার কে আছে তো বল দেখি? পুজোর সময় কাপড়চোপড় দিতে গিয়ে একবার ভাই-বোন, ভাইপো-বোনঝিদের সঙ্গে দেখা করি। মরলেটরলে শ্রাদ্ধ খেতে আসবে, নইলে কোথায় ?
—আপনার যেরকম কথা অনুদি।
--ঠিকই কথা বলছি রে উমা। এ জগতে কেউ কারও নয়। আমার মেয়ের কথা তো তোক বলেছি, সে থেকেও নেই।
—সে কি আর মেয়ের দোষ অনুদি? জামাই দেয় না যোগাযোগ রাখতে, কী করবে।
—সেটা হলেই ভালো। অনুদি অন্য দিকে চোখ ফেরান। চোখের তারা জলে ভিজে চিকচিক করছে।
—অত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিতে নেই।।
--আমি কি দিয়েছি। সে নিজে করেছে না মেনে করব কী? মেয়েকে ছাড়তে পারব না বলে মানলাম, মেয়েই আমাকে মানতে পারল না।
—কী হয়েছিল কি অনুদি? কোনও ঝামেলাটামেলা?
—কিছু না হলে কী যায়? হয়েছিল কিছু বইকী!
অনুদি আনমনা। উমা আর প্রশ্ন করে না। কষ্ট তো কষ্টই, যে কারণেই হোক না কেন?
তারপর সব ঝেড়ে ফেলে অনুদি বললেন, ‘বাদ দে এ সব। যার যা ভালো লাগে, সে তা করুক বুঝলি’।
উমার খারাপ লাগে, এ সব প্রসঙ্গ উত্থাপনের জন্যে। কী লাভ মানুষকে দুঃখ দিয়ে।
মোটকা টিকিটচেকারটা আজ লোকালে উঠেছে। অনুদির সঙ্গে খুব ভাব ওর। গায়ে পড়ে কথা বলে লোকটা, উমার ভালো লাগে না। অনুদির সঙ্গে কবে একসঙ্গে স্টেশনে জিলিপি খেয়েছিল। দেখা হলে সব সময় সেই একই কথা।
—আবার কবে জিলিপি খাওয়া হচ্ছে দিদি?
অনুদি হা হা করে হেসে একই উত্তর দেন। আপনারা সব আর পি এফ দিয়ে হকার উচ্ছেদ করবেন, আর জিলিপি খেতে চাইবেন। তাই কখনও হয়?
--যাই বলুন, জিলিপি কিন্তু দারুণ করত। অমৃত।
লোকটা আড়চোখে একবার উমার দিকে চাইল। গা জ্বলে গেল উমার। অনুদি পারেন। ওঁর নয় বছরের ডেলি প্যাসেঞ্জারি জীবনে কত জনের সঙ্গেই যে আলাপ পরিচয়। তবে অনুদির ভরসায় উমার মতো অনেকেরই পথচলা। ঠিকঠাক হকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, বিপদ আপদে স্টেশনে নানা কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ, ভালোমন্দ লোক চেনানো, সবই অনুদির মাধ্যমে। অনুদিকে লিডার বলা যায় অনায়াসে। লিডার বললে অনুদি হাসেন।
একবার বলেছিলেন, 'আচ্ছা,আমার পর তবে লিডার হবে উমা।
যাই হোক, অনুদির পর উমা লিডার হোক, না হোক, অনুদিকে বড় ভালো লাগে উমার। একা একা স্বাধীনন জীবন ওঁর। সংসারের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে কত হাসি মুখে তা পারেন উনি। উমাকেও কত উপদেশ দেন ঠিক পথে চলার জন্যে। উমার যেন মনে হয়, অনুদি তাকে কতখানি ভালোবাসেন এমনটি আর কাউকে নয়। একদিন অনুদি ওর জন্মতারিখ জানতে চেয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, ওর মেয়ে উমার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোটো। হয়তো মেয়ের মতো দেখেন। আবার ঠিক মেয়ের মতো নয়, বন্ধুর মতো। অনুদিকে সবাই এত ভালোবাসে, ওঁর মেয়েজামাই এত অপমান করল কেন কে জানে? কোনও দিন যদি সুযোগ পায়, অনুদিকে সে দেখবে। খুব ভালো হত, যদি রিটায়ার করার পর অনুদিকে সে নিজের কাছে রাখতে পারত।
উমা নেমে যায়। অনুদির আগেই তাকে নামতে হয় প্রতিদিন। প্রতিদিন যাওয়ার সময়ই মাথাটা একটু এগিয়ে দেয় অনুদির কাছে, অনুদি তার গালে হাত দিয়ে আদর করেন। নামার সময় একটা কষ্ট হয় উমার। অনুদিকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। কিন্তু কতক্ষণ আর। মেরেকেটে তেরো ঘণ্টা। তার মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ যায় ঘুমাতে। স্বপ্নেও তারা ট্রেনের ছবি দেখে। নইলে উমার স্কুল আর অনুদির অফিসের মতো বিরক্তিকর কিছু আছে! কী হিংসে, কী হিংসে চারদিকে। উমা বলে, ‘মেয়েদের ইস্কুলে পড়াই। মেয়েদের মতো হিংসুটে কেউ হয় নাকি।’ অনুদি তক্ষুনি বলেন, “কী যে বলিস! আমি জানি, ছেলেরা যদি হিংসুটে হয়, তার কাছে মেয়েরা লাগে না’।
উমা চলে গেলে ফাঁকা জায়গায় অনুপমা টানটান শুয়ে পড়েন। আজ রান্নার দিদিকে বড়ি-পোস্ত করতে বলে এসেছেন। পরে মনে পড়েছে বাড়িতে বড়ি নেই। ও বুদ্ধি করে অন্য কিছু করলে হয়। নইলে আবার নিজে গিয়ে রান্না চাপাতে হবে।
উমা মেয়েটি বেশ পরিষ্কার। ভালো লাগে অনুপমার। সংসারে কত মেয়েই তো দেখলেন তিনি। ট্রেনে সহযাত্রিণী তো কম নেই। উমার মতো দরদি মেয়ে বড়ো একটা দেখা যায় না। বাসুদেবকে যে অবস্থা থেকে টেনে তুলল মেয়েটা, শাবাশ বলতেই হয়। এরকম যদি মেয়ে হত তাঁর।
কে আর কার মতো হয়। তুলনা করছেন কেন তিনি ? ছিঃ। নিজের মনকে শাসন করেন অনুপমা। যে যেমন পেয়েছে ভাগ্যে, তাকে তিনি মানবেন না কোন শক্তিতে?
রাতে হাতের বালাটা দেখছিলেন অনুপমা। এটা খুলে কি অন্য কিছু পরবেন? উমা অত করে বলছিল। উমাকে বলা হয়নি, এটা কার দেওয়া। বলতে ভয় হয়। মেয়ের মতো উমাও যদি...। কিন্তু উমা তো পর। পর এলেই বা কী, গেলেই বা কী?
আর একটা গয়না আছে হাতে, উমা লক্ষ করেনি। একটা ঘোড়ার নালের আংটি। অনুপমার স্বামীর অসুখ তখন সবেমাত্র জানান দিচ্ছে। তার স্বামী দুজনের জন্যে দুটো ওই আংটি কিনেছিল। শরীর ভালো থাকবে। ওই আংটি ধারণ করে পাঁচ মাসের মধ্যে স্বামী চলে গেল, আর সে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। স্বামীর মৃত্যুর পর লাগানো সবেদা গাছে প্রচুর ফল এসেছে। উমাদের জন্যে নিয়ে যাবেন বলে অনুপমা রাত্রিবেলাতেই টর্চের আলোয় হাতের কাছের ফলগুলো পেড়ে রাখেন। নইলে যা বাদুড়ের উৎপাত।।
উমাকে একদিন নিজের বাড়িতে নেমত্ত্নন করবে অনুপমা। একসঙ্গে দু-তিনদিন ছুটি হোক, মাঝে যদি একটা বন্ধ-টন্ধ হয়ে যায় আরও ভালো। উমাকে সারাদিন রাখবেন অনুপমা। বাসুদেবকেও আনবেন। জামাই বলে কথা। উমা ওর নামে যাই বলুক না কেন, ওর অযত্ন করলে উমার নিশ্চয় রাগ হবে।
ট্রেন থেকেই উমা আর বাসুকে স্টেশনে দাড়িয়ে ঝগড়া করতে দেখেছেন অনুপমা। উমা তো মুখটা থমথমে করে ট্রেনে উঠল। কিছু জিজ্ঞাসা করাতে ও ফোঁস ফোঁস করে খানিকটা কেঁদে নিল। আর এমন মুখ করে রইল, যেন কিছু বলবেই না।
--কী হল রে তোর ?
উমা বড় বড় চোখে তাকায়—সবাই আমাকে ভুল বুঝবে। আপনিও হয়তো দোষ দেবেন, কিন্তু আমি কী করি বলুন তো? এক সময় বাপন, মানে আমার পিসির জায়ের ছেলে আমার পিছু পিছু ঘুরত। আমাকে ভালোবাসত। কার্ডটার্ড দিত। সেটাই বাসুর রাগ।
--সে তো চুকেবুকে গেছে।
—চুকেবুকে—মানে ছেলেটা তো খারাপ নয়। টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কাজ করে। এখন এ দিকে বদলি হয়েছে বলে ট্রেনে যাতায়াত করে। তো তার সঙ্গে কথা বললে এমন কী দোষ হয়েছে? বাসু কাল দেখেছে, ওর সঙ্গে কথা বলেছি। তারপর থেকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। তারপর উমা বলল, ও বিবাহিত, আমিও বিবাহিত। বলুন তো, আমরা কি প্রেম করছি?
অনুদি খানিক চুপ। তারপর বললেন, বাসুদেবকে সব কথা খুলে বলার দরকার কী? ছেলেদের সব কথা বলতে নেই। ওরাও সব কথা বলে না জানবি।
--বোকা তো আমি, অনুদি! নইলে যার জন্যে এত করেছি সে কখনও এত কষ্ট দেয়?
--এত করেছি করেছি বলছিস কেন উমা? মানুষ মানুষকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই করে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ভালোবেসেছিস, করেছিস। বাস, চুকে গেল। আবার যাকে ভালোবাসবি, তাকে করবি।।
—আর কাউকে ভালোবাসব না অনুদি। অনেক শিক্ষা হয়েছে।
অনুদি হাসলেন। ‘তোকেবলি উমা। কে জানে কেন, তোকে বলতে ইচ্ছে করছে। আমার স্বামীকে তো আমি যথেষ্ট ভালবাসতাম, তুই জানিস। একবার রেগে আমার গায়ে গরম চা ছুড়ে দিয়েছিল। এই দেখ।' অনুদি তার ঘাড়ের কাছে দাগটা দেখলেন। ‘কতদিন চিৎ হয়ে ঘুমোতে পারিনি। এটা রাগের মাথায় করা। এটাকে ভালোবাসার অভাব আমি বলি না।'
--সে কী অনুদি, আপনাকে পুড়িয়ে দিল, আর আপনি এ কথা বলছেন।
-বলছি, ওকে জেনেছি বলেই। একদিনের কাজ দিয়েই তো বিচার হয় না। তখন রাগ হয়েছিল খুব। ছ মাস বাপেরবাড়িতে ছিলাম। ফিরিনি। পরে দেখেছি, ওর থেকে অনেক অনেক খারাপ মানু্ষ চারদিকে। উমা এই আংটিটা ওই জন্যেই ফেলতে পারিনি। ওর অসুখ হওয়ার সময় কেনা। সত্যি বলতে কি জানিস, যদি কখনও প্রেম হয়েই থাকে আমাদের মধ্যে, তা হয়েছে ওর অসুখের সময়ই। ও তখন আমার ওপর ভীষণ নির্ভরশীল। আর আমিও ভাবছি ও চলে গেলে আমার কী হবে। সে আমার এক আশ্চর্য অবস্থা। আর কদিন পর মরে যাবে শুনে তার পাশে শুচ্ছি, তার মুখের দিকে তাকাচ্ছি, তাকে বলতে হচ্ছে, তুমি বাঁচবে—সে যে কী অবস্থা, যে জানে না, সে বুঝবে না।
উমা হাঁ করে শুনছে। হঠাৎই বলল, ‘আপনার খুব শক্তি অনুদি। একা একা এতটা সামলেছেন। এ একটা বিরাট লড়াই।’
--লড়াই আমার খুবই ছিল উমা। কিন্তু তোকে মিথ্যে বলব না, তুই কী মনে করবি জানি না, সেই সময় আমি শান্তিদার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। শান্তিদা ওর সহকর্মী, আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন দুঃসময়ে। ওঁরও সংসার ছিল। কিন্তু ও না থাকলে আমার স্বামীকে আমি মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার সাহস করতাম না। উমা, তুই বিশ্বাস করবি না, শান্তিদাকে আমি আমার সবটুকু দিয়েছি। তিনি চেয়েছেন, আমার অবস্থার সুযোগ নিয়েছেন বলে নয়, আমি দিতে চেয়েছি। আমি ওকে আঁকড়ে ধরেছি। অথচ স্বামীর প্রতি এত ভালোবাসাও আমার আর কখনও তেমনটি ছিল না। আমি এ সব কাকে বোঝাব? আমি নিজেই নিজেকে বুঝতাম না উমা। আমি পাগল না বিকৃত, কিছুই মাথায় আসত না। এই বালা দুখানা তাঁর দেওয়া। কারও কিছু নিইনি উমা। তাঁকে ভালোবাসতাম বলেই এটা নিয়েছিলাম, দাবির সঙ্গে।
অনুদির চোখে জলে ভরে এল। বালাগুলোতে হাত বোলালেন খানিক। উমা স্তব্ধচোখে তাকে দেখছে। তারপরই অনুদি চোখটোখ মুছে ঠিকঠাক হয়ে বসলেন যেন। জোর করে একচিলতে হাসি নিয়ে এলেন মুখে।
উমা শুধু বলল, তার পর ?
--তার পর আবার কী! যা হওয়ার তাই হল। তিনি মারা গেলেন। আমার যে এমনটা হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার সব শূন্য হয়ে গেল। শান্তিদাকেও আর নিতে পারছি না। মরা কাঠের মতো যেন জলে ভাসছি। সব দিক থেকে মন চলে গেল। শান্তদার পক্ষে কি আর সেই আমাকে নেওয়া সম্ভব? আমি ওঁকে দোষ দিই না জানিস। এই চাকরিটা যাতে পাই, তার ব্যবস্থা উনি করে দিয়েছেন, আর সম্পর্ক রাখেননি। মেয়ের বিয়েতেও আসেননি। আর কোনও যোগাযোগ নেই। নারে, উমা, ওর কাছ থেকে যা পেয়েছি তা অনেক।
উমা আবার বলল, 'মেয়ে কি তবে এই কারণেই...?’
--হ্যাঁ । মেয়ে শান্তিদার সঙ্গে আমাকে দেখেছিল। তখন কিছু বলেনি। ছোটে। ও। কী বুঝবে, কী বলবে। ও কিছু বললে, হয়তো আমারও কিছু বলার ছিল। আমাকে বলল না, নিজের স্বামীকে বলল। ওরা সবাইকে বলল, আমার স্বভাব খারাপ।
অনুদি হাসলেন, 'ঠিকই বলেছে। যা আমি তাই বলেছে। কী বলিস উমা উমা?’
উমা স্থির। এরপর কী কথাই বা বলা যায়। কোনও কথাই মুখ দিয়ে বের হয় না।
অনুদি সহজ হতে চাইলেন। ‘তোর কী মত বল রে উমা? অনুদি এরকম , অনুদি সেরকম, এবার দেখলি তো অনুদি কীরকম! বাড়ি গিয়ে বাসুকে গল্পটা ব্লিস। বাসু বলবে, তুমি এরপর থেকে লেডিসে আর যেয়ো না। ওই যে ছেলেটার কথা বললি, কে যেন, তোর আত্মীয় না কী, দরকার হলে যেন ওর সঙ্গে যেয়ো, তবু অনুদির সঙ্গে কক্ষণও নয়। ওরে বাবা, কী মারাত্মক মেয়েছেলে’।
উমা ম্লান হেসে অনুদির দিকে তাকিয়ে আছে, আর তার কথা শুনছে। কিন্তু সেটা যে হাসি, তা কেউ বলবে না।
সে দিন যাওয়ার সময় আর কোনও কথা হল না। অন্য মেয়েরা উঠল। অনুদি ওদের সঙ্গে যথারীতি স্বাভাবিক হাসিঠাট্টায় মাতলেন। উমা সবার থেকে পাশ কাটিয়ে চুপ হয়ে বসে রইল। সবাই উমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, তার কী হয়েছে? কিছু হয়নি—বার বার বলেও উমা রেহাই পাচ্ছিল না। অনুদিও কৌতুকের চোখে তাকে দেখছিলেন। শেষে অন্য মেয়েদের নিবৃত্ত করার জন্যে বললেন, ‘ওর কী হয়েছে জানিস? ওর একটা প্রিয় কাচের গেলাস ছিল, আজ সকালে সেটা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।’
উমার মনে হল, অনুদি খুব নিষ্ঠুর। হয়তো এত নিষ্ঠুর বলেই এরকম একা একা দিন কাটাতে পারছেন, আত্মীয়স্বজনের এত অপবাদ মাথায় করে। যাই হোক, যাওয়ার সময় হইহই করে সবাই নেমে গেল। ফেরার সময়ও হইহই। মীনাক্ষীর বাচ্চার অন্নপ্রশনে কেউ যায়নি বলে ও ট্রেনের সহযাত্রীদের খাওয়াল। সবাই নেমে গেলে, আবার অনুদি আর উমা একা।
অনুদি নিজের থেকেই বললেন, “আজ খুব ধাক্কা খেয়েছিস, না?'
কিছুই বলল না উমা।।
-ধাক্কা খাওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমি কেবল ভাবছি, তোকে বলতে গেলাম কেন? অথচ তুই আমাকে না চিনে ভালোবাসবি, এটাও সহ্য হচ্ছিল না। হয়তো ভিতরে ভিতরে একতা অনুমোদন চাইছিলাম। থাকগে, ও সব নিয়ে ভাবিস না। তোর মন খারাপ করে দিলাম। নে কাগজ পড়। আর দুটো স্টেশন বাকি। একতা লেখা খুব ভালো বের হয়েছে। পড়ে দেখ তো।
উমা সত্যি কাগজটার আড়ালে মুখ লুকাল। তার কান্না আসছে। ঝেঁপে বৃষ্টি নামতে চাইছে, শুধু উমা তা আটকে রেখেছে। চোখ উঠিয়ে দেখল অনুদি নির্বিকার। চশমাখানা পরে নিয়েছেন, তারপর পেন বের করে শব্দছক করছেন।
সময় আর রাস্তা যেন তাদের দু পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। উমা মাঝে মাঝে অনুদির প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে। কিন্তু তিনি একই রকম। ওঠ, তোর স্টেশন এসে গেল। অনুদি তাড়া লাগালেন। আর একটু দেরি আছে, উমা বলে। অনুদি, আমি যে আপনার মতো নই।
—আমার মতো তুই হতে যাবি কেন বোকা? কোন দুঃখে হবি?
—আপনার মতো হতে চেয়েছি আমি বিশ্বাস করুন। যে ছেলেটার কথা আমি বললাম, তার সঙ্গে আমার আগে কোনও সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু এখন হয়েছে। আমি দু দিন স্কুল কামাই করে ওর সঙ্গে...। উমা কাঁদতে লাগল। অনুদি বিস্মিত হয়ে ওর হাত ধরলেন।।
—কিন্তু অনুদি, আমি আপনার মতো নই, আমি বাসুকে সহ্য করতে পারছি না। আর এর বউয়ের সবে বাচ্চা হয়েছে। আমার কী হবে অনুদি! আমি যে আপনার মতো একা থাকতে পারব না। রুমাল-টুমাল দিয়ে চোখমুখ মুছে উমা যখন ট্রেন থেকে নামল, তখন অনুদি দেখলেন, বাসুদেব বাইক নিয়ে ওর জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
অনুদি ফের টানটান হয়ে শুলেন। এবার তার স্বামীর যৌবনের মুখখানা মনে পড়ল। স্বামীর বাড়িতেই তিনি ফিরছেন। হঠাৎই মনে পড়ল সবেদাগুলো উমাকে দেওয়া হল না। সকালেও কথায় কথায় ভুলেছিলেন, বিকেলেও ভুললেন।
3 মন্তব্যসমূহ
সত্যিই চমৎকার একটা গল্প। গল্পের গড়ানোটা ভীষণ পছন্দ হলো। আরো লিখবেন আশা করি। শুভেচ্ছা জানবেন।
উত্তরমুছুনভাল লাগল ৷ মানুষ বড় জটিল ৷
উত্তরমুছুনগল্পটা মন ছুঁয়ে গেল ।
উত্তরমুছুন