আনোয়ারা আল্পনার গল্প : নয় নয় নয়

সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে বোনের বাসায় যেতে যেতে ভাগ্নি জয়িতাকে ফোন করল নীপা। ফোন বন্ধ! এই ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাটের আগা-মাথা নাই। কতদূর যেতে কত সময় লাগবে, কেউ বলতে পারে না। মেয়েটা একা বাসায়। একটু চিন্তা হলো, ফোন কেন বন্ধ? ঘুমাচ্ছে? তাহলে সাইলেন্ট থাকবে, বন্ধ কেন থাকবে? 

কয়েকদিন ধরে অফিস থেকে একটু আগে আগেই বেরোচ্ছে সে। আপা-দুলাভাই হজ্বে গেছে বলে কয়েকদিন সে আপার বাসায় থাকছে। সকালে অফিসে আসার সময় জয়িতাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে এসেছে। কলেজ-কোচিং শেষ করে বাসায় যেতে যেতে বিকাল হয়। এখন ওর জন্য কিছু কিনবে বলে ফোন করেছে। আজকালকার বাচ্চাদের বাইরের খাবার এত পছন্দ, ভেবেছে চিকেন ফ্রাই বা পিজা কিনে নিয়ে যাবে। ফোন বন্ধ পেয়ে ফেসবুকে ঢুকল, ভাবল, ফেসবুকে নক করবে। অবাক হয়ে দেখল ফেসবুকে নাই সে। বিড়বিড়িয়ে বলল, আমাকে ব্লক করেছে? নাকি আইডিই ইনেক্টিভ করেছে?

নীপা আবার আজকালকার পোলাপানের দোহাই পেড়ে ভাবল, এদের এত মাথা গরম, মনেহয় বন্ধু বা ছেলেবন্ধু কারো সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, দিয়েছে সব বন্ধ করে। আমি যে কত চিন্তা করতেছি, সেটা হয়ত তার মাথায়ই আসে নাই। আর যদি এর মধ্যে ওর বাপ মা ফোন করে, তাহলে হজ টজ ফেলে কানতে বসবে না? আর এদিকে দেখ রাস্তা পুরা থেমে আছে, গাড়ির পাছায় গাড়ি লেগে আছে, এদের যেন রিমোট টিপে ফ্রিজ করে দিয়েছে কেউ, সঙ্গম যেন নিষেধ। সঙ্গমের কথা ভাবতে ভাবতে আসিফের ফোন, ‘কই তুমি?’ নিপা বিরক্ত হয়ে ভাবল, আর এই যে একজন ফোন করেই ব্যাকুল হয়ে বললেন কই আমি। আরে বাপু তুমি তো জান, এখন আমি এই রাস্তার উপরে বসে, দুইখান ডানা নাই বলে এমন কিছু ভাজতেছি, যেটা খাওয়া যাবে না কখনও। বলল, ‘চিন্তা করতেছি, জয়ী ফোন ধরতেছে না। তুমি কই?’

আসিফ, নীপার বর গত পাঁচ বছর ধরে। নীপা মাসখানেক বোনের বাসায় থাকবে বলে প্রথমে কিছুদিন খুব ফুর্তি লেগেছে তার। কিন্তু সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই বউয়ের জন্য বড় মায়া লাগে। আসিফের ফোন রাখতে না রাখতেই আপা ফোন করল, ‘বাসায় গেছিস?’ খুব দ্রুত চিন্তা করল সে, আপাকে কোনভাবেই বলা যাবে না, জয়ীর ফোন বন্ধ। বলল, ‘এইতো বাসার কাছাকাছি, তোমরা কেমন আছ?’ আসলে তো রিকশা চললে এতক্ষণে পৌঁছেই যেত। তাহলে হাজীকে মিথ্যা বলার জন্য এক্সট্রা পাপ হয় নাই। কিন্তু রিকশায় বসার পর থেকে এটা হেঁটেছে মাত্র কয়েক কদম। এর মধ্যে নেমে খাবার দাবারও কিনেছে, রিকশা নড়ে নাই। হেঁটে গেলেও এতক্ষণে পৌঁছে যেত। ক্লান্ত লাগছে বলে আর পাশের রিকশার হুড তুলে চুমাচুমি দেখার নেশায় হাঁটা ধরে নাই সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নেমে হাঁটা ধরাই ভালো। এমন সময় একদিকে কাত হয়ে সিট থেকে পাছা সামান্য নামিয়ে, সেটা চুলকাতে চুলকাতে রিকশাওয়ালা বলল, ‘আইজ আস্তাত আডা!’ সেটা শুনে পাশের রিকশাওয়ালা প্রবল সমর্থনের মাথা নেড়ে বলল, ‘হয় হয়!’ নীপার কয়েক মিনিট লাগল বুঝতে যে, রিকশাওয়ালা বলেছে, রাস্তায় আঠা বলে গাড়িঘোড়া আটকে আছে। রিকশাভাড়া দিয়ে নেমে যাবে বলে টাকার জন্য যেই ব্যাগে হাত দিয়েছে ওমনি নড়ে উঠল সব। তিন চারটা হর্ন বেজে উঠল, চলতে শুরু করল রিকশা। সে ছোট পার্সটা বড় ব্যাগে ঢুকিয়ে চেন লাগিয়ে শক্ত হয়ে বসল। আবার ফোন করল জয়িতাকে, এখনও বন্ধ! এবার অস্থির লাগতে শুরু করল তার, ভাবল, কী হয়েছে?

দুপুরে কলেজ থেকে বেরিয়ে কোচিঙয়ে যাওয়ার সময়ও কথা হয়েছে। জয়ী জানতে চেয়েছে, সে বাসায় পৌঁছে গাড়ি নীপার অফিসে পাঠাবে কিনা। নীপা জানিয়েছে, দরকার নাই। দশ মিনিট চলার পর আবারও দাঁড়িয়ে পড়ল রিকশা। সামনে যতদূর চোখ যায়, সব থেমে আছে। আজ অফিস থেকে বেরোনোর সময় কিছু ফাইল নিয়ে এসেছে সে। কয়েকদিন আগে আগে অফিস থেকে বেরোচ্ছে বলে, কাজ জমে গেছে। ভেবেছে, বাসায় বসে করে ফেলবে। আবার খাবার দাবারও কিনেছে অনেক, রাতে রান্নার ঝামেলা এড়াতে। এতসব নিয়ে হাঁটা মুশকিলই। তবু এবার নেমে গেল নীপা। কাঁধের ব্যাগ সামলে দুইহাতে ফাইল আর খাবারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে কষ্টই হচ্ছে। আজ আবার একটু ফ্যাশানের জুতাও পরেছে। তবু প্রত্যেক কদমে বাসার দিকে এগোনো হচ্ছে বলে মেনে নিচ্ছে কষ্ট।

দশ মিনিট হেঁটেছে কি হাঁটে নাই ফুরফুর করে সব চলতে শুরু করল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গেল সে। দুই মিনিটে তাকে পেরিয়ে গেল গোটা পঞ্চাশেক রিকশা। এবার সরু চোখে তাকালো সে, খালি রিকশা পেলেই উঠে পড়বে। যতক্ষণ হাঁটছিল গরম লাগে নাই, দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর বিনবিনিয়ে ঘামছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম পিঠ বেয়ে কোমরের দিকে নেমে যাচ্ছে। জুলাই মাসের শেষ, আকাশে কালিদাশের মেঘ ছাড়া বর্ষার আর কোনো লক্ষণ নাই। একটা খালি রিকশা পেয়ে দরদাম না করেই উঠে পড়লো সে। রিকশাওয়ালার ঘামেভেজা পিঠের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আবার সব আটকায়া যাওয়ার আগে ঝড়ের বেগে যান দেখি!’ ঝড় বাঁধানোর কোনো চেষ্টা দেখা গেল না ড্রাইভার সাহেবের পায়ে। আবার ফোন করলো সে। আবারও বন্ধই! চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলালো সে। হুড়মুড় করে যতরকম খারাপ সম্ভাবনার চিন্তা আসতে লাগলো, দুইহাতে জোর করে সেসব ঠেকাল। তবুও নিঃশ্বাস আটকে যেতে চায়।

এক মহিলার ডাকে চোখ খুলে দেখল রিকশা আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে। আগুন্তুকা বলল, ‘আপা একটাও খালি রিকশা পাইতেছি না, আপনের রিকশায় সামনে একটু নামায়া দিবেন?’ মুহূর্তের মধ্যে মলমপার্টিসহ নানারকম ঝামেলার কথা উঁকি মেরে গেল নীপার মাথায়। তবু একপাশে সরে তাকে বসতে দিল, যেন এটা একলার রিকশা নয়, পাবলিক বাস। মহিলা পাশে বসে একদমে বলল, ‘আমার মেয়ে আপা ফেসবুক প্রোফাইলে রেনুর ছবি দিছে! ওইটা দেইখাই অফিস থিকা দৌড়ায়া বাইর হইছি, আর দেখেন আজকাই কেমুন জ্যাম। এতক্ষণ দৌড়াইছি, এখন আর পারতেছি না!’ ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মহিলাকে দিল নীপা। এতক্ষণ পরে রিকশাওয়ালা বলল, ‘কিয়ামতের আর দেরি নাই, বাংলাদেশ দিয়াই আরাম্ব অইবো!’ পানি খেয়ে একটু স্থির হয়ে মহিলা বলল, ‘বাসায় ফোন করছিলাম আপা, মেয়ে চিৎকার করে কানতে কানতে কয়, কেউ নয়শো নিরানব্বইয়ে একটা ফোন করলো না, আম্মা? একটা ফোন করলেই বাইচা যাইত, না আম্মা?’ নীপা মহিলার হাত ধরল। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মহিলা বলল, ‘ছোট একটা চাকরি করি আপা, একটাই মাইয়া। অর বাপ নাই। এত নরম ক্যান অর মন!’

নীপা আবার ফোন করল জয়িতাকে- বন্ধ।

দুপুরবেলা ফেসবুকেই প্রথম দেখেছিল নীপা, রেনুকে মেরে ফেলেছে। একটুও বাকি রাখে নাই, মেরেই ফেলেছে। মুহূর্তে ফেসবুক ভেসে গেছে রেনুর রক্তাক্ত মুখের ছবিতে। খানিক পরেই ভিডিও এসে গেছে। সেই ভিডিও দেখার সাহস হয় নাই তার। কিন্তু রেনুর রক্তাক্ত মুখের ছবিটা ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার বানিয়েছে নীপাও। বিকাল নাগাদ একটা পোস্ট এল আবার, গুজবে কান না দিয়ে নাইন নাইন নাইন এ ফোন করতে। সেই পোস্টারও কভার পিকচার বানিয়েছে সে।

এই ঢাকা শহর কিলবিল করে মানুষে, তাদের হাতে কিলবিল করে মোবাইল ফোন। স্যাটেলাইট ভাসে আকাশে, আর এখানে লোকের মুখে মুখে কিলবিল করে পোকাঃ মানুষের মাথা লাগবে পদ্মা সেতুতে। যেন কাপালিক হয়ে গেছে সবাই। নিখুঁত করে কাটবে গলা, এত শানদার হবে তলোয়ার, গলা টেরও পাবে না। তারপর কাটা মাথা ইট হবে।

সকালে রেনু বাসা থেকে বেরোনোর সময় হয়তো গলায় হালকা করে পাউডার বুলিয়েছিল, তার ছোট্ট মেয়ে কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে হয়তো বলেছিল, কি সুন্দর গন্ধ মা তোমার গলায়। রেনুর গলা কাটে নাই ওরা। রেনু গলা কাটতে পেরে, ভেবেছে। রেনুর গলার পাউডার ভেসে গেছে রক্তে। আরো কত কী ভেসে গেছে কে জানে!

হঠাৎ কথা বলল পাশের মহিলা, ‘আমি নাইমা যাই আপা, বাসা সামনেই।’ মহিলা নেমে গেলে ভীষণ একা লাগতে লাগল তার। হাজার হাজার মানুষ আশেপাশে, তবু। বাসার কাছাকাছি এসেই গেছে প্রায়। এবার ভয় করতে লাগল। বাসায় গিয়ে যদি দেখে মেয়ে ফেরে নাই!

ভাবল, আসিফকে ফোন করে আসতে বলবে। আসিফের ফোন ফোন বেজে বেজে কেটে গেল, কেউ ধরল না। রাগ, বিরক্তি এসব আর হচ্ছে না এখন। সারা শারীর জুড়ে এখন একটাই অনুভুতি- ভয়! আসিফের ফোন কেটে শাশুড়িকে ফোন করল নীপা- ‘আম্মা, আসিফ কই?’ ফোনের ও পাশে শুধু ফোঁস ফোঁস শব্দ! নীপা অস্থির হয়ে বলল, ‘কী হইছে, আম্মা?’ শাশুড়ি কাঁদতে কাঁদতে যা বলল সেটা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। সন্ধ্যাবেলা আসিফকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, রেনুকে মারার সময় আসিফ নাকি ছিল সেখানে! ভিডিও দেখে আসিফকে চিনেছে পুলিশ। এবার মাথা হ্যাং হয়ে গেল নীপার। তবু শাশুড়িকে বলল, ‘আমি খোঁজ নিতেছি, আম্মা শান্ত থাকেন।’

ফোন রাখতে রাখতে বাসার গলিতে ঢুকে গেল রিকশা। ভাড়া মিটিয়ে সব ব্যাগ সামলে গ্যারাজে ঢুকেই প্রথমে দেখলো গাড়িটা আছে কি না! হ্যাঁ গাড়ি আছে। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হল, আমি তো ড্রাইভারকে ফোন করতে পারতাম অথবা বুয়াকে ফোন করে বাসায় আসতে বলতে পারতাম। এদের নম্বর যদিও ফোনে সেফ করা নাই, কিন্তু জোগাড় তো করা যেত।

সাত তলায় উঠে বেল বাজাতে গিয়ে খেয়াল করল, হাত কাঁপছে। সুইচ না টিপেই হাত সরিয়ে নিল সে। ব্যাগগুলা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলো, বড় বড় করে দম নিল। এবার আর বেল না বাজানোর অজুহাত নেই কোনো। একবার টিপেই হাত সরিয়ে নিল। সময় যেন থেমে আছে, কতক্ষণ হল বেল বাজিয়েছে সে? দুই সেকেন্ড, দুই মিনিট নাকি দুই ঘণ্টা? জয়ী বাথরুমে থাকতে পারে, বেল না শুনতে পারে। আরেকবার বাজাবে? বারবার বাজাবে?

হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনলো সে। খুব ধীরে জয়িতার গলা শোনা গেল, ‘কে?’

নীপার গলা ব্যাথা করে উঠল ভীষণ! চিৎকার করতে চাইল, পারল না, স্বাভাবিক গলায়ই বল্ল, ‘আমি রে মা, দরজা খোল!’ খুট করে শব্দ হল, দরজা খুলে গেল, নীপা দরজার দিকে পা দেওয়ার আগেই জয়িতা ঝাপ দিল খালার গায়ে! মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পড়ে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে সামলাতে পারল নীপা। ছোটবেলায়ও এভাবে ঝাপ দিত মেয়েটা। পাখির মতো একটা মেয়ে ছিল, শূন্যে তুলে নিজের ঘাড়ে বাসিয়ে দিত পারত নীপা। আজ কোলে নিতে দিয়ে দেখল, অনেক বড় হয়ে গেছে। তবু শক্ত করে জড়িয়ে উঁচু করে তুলে নিয়ে বাসায় ঢুকল। ব্যাগগুলি এনে দরজা বন্ধ করার কথা মাথায় এল না নীপার। মেয়েকে দুই হাতের মধ্যে পেয়ে সে বুঝতে পারছে কি ভীষণ অমঙ্গল আশঙ্কা করেছে এতক্ষণ! গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা জয়ীকে নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। আস্তে আস্তে সে নিজে এবং জয়িতা দুজনেই শান্ত হয়ে এল। এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে নাই, এবার নীপা বলল, ‘কী হইছে রে মা? ফোন বন্ধ কেন?’ জয়িতা এবার আরো মিশে গেল খালার বুকের সঙ্গে। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমার মুখে রক্ত দেখে ভয় পাইছি! মনে হচ্ছিল ফোন খোলা থাকলেই কেউ ফোন করে বলবে তোমাকে মেরে ফেলছে!’ নীপা পাথর হয়ে গেল শুনে, কেন যে ওই ছবিটা সে নিজের মুখের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে, উফ!

দুইজনে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিল। খেতে খেতে টুকটুক করে গল্প করতে করতে জয়িতাকে স্বাভাবিকই লাগল তার। খেয়ে দেয়ে জয়িতা নিজের রুমে গেলে নীপা ভাবতে বসল পুলিশে কেউ পরিচিত কেউ আছে কিনা। কিংবা এমন কেউ যাকে সে ফোন করে বলতে পারে, আসিফ খুব নরম মনের ছেলে, কোরবানির সময় গরু কাটাও দেখতে পারে না। হঠাৎ মনে পড়ল এক সাংবাদিক বন্ধুর কথা, তাকেই ফোন করল। রাত বেশি হয় নাই তবু বিরক্ত হয়েই হ্যালো বললেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহেব। নীপার এখন কারো বিরক্ত গলা শুনে দমে যাওয়ার সময় নয়। নীপা নিজেকে নীপা দাবী করে বলল, ‘চিনতে পেরেছেন?’ ফোনের ওপাশ এবার খানিক নরম হল বলে মনে হল, বলল, ‘হ্যাঁ নীপা, কী খবর? ভালো আছ?’ খুচরা আলাপের অবস্থা নয় এখন, নীপা সরাসরি মূল আলাপেই যেতে চাইল, বলল, ‘একটা সমস্যা হয়েছে মিরাজ ভাই, আমার হ্যাজবেন্ডকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, একটু হেল্প করেন, প্লিজ।’ মিরাজ নামের সাংবাদিক বলল, ‘আমিও থানায়, আমাকেও ধরে নিয়ে এসেছে পুলিশ!’ নীপা প্রায় মুখ ফসকেই বলে ফেলল, ‘আপনিও ছিলেন ওখানে, রেনুকে মেরে ফেলার সময়?’ কেটে গেল ফোন।

এরপর নীপা ফোন করল আসিফের বন্ধু রুবেলকে, ফোন ধরল তার বউ, বলল, ‘বাচ্চাদের আম্মার বাসায় দিয়ে থানায় যাচ্ছি ভাবী, রুবেলকে…’

নীপা এবার নিজের বন্ধু বান্ধবকে ফোন করবে ঠিক করল। তার আগে জয়িতার রুমে ঢুকল দেখতে যে ঘুমিয়েছে কিনা। দেখল লাইট জ্বলছে, চোখ বন্ধ জয়ীর, বলল, ‘মশারি টানাবি না?’ কথা বলল না জয়ী। ঘুমিয়েই পড়েছে ভেবে নিজেই মশারি টানিয়ে দিল নীপা। অনেক সময় লাগল, বারবার ভুল পেরেকে ভুল কোনা লাগিয়ে ফেলছিল। মাশারি গুঁজে দেওয়ার সময় মেয়ের কপালে হাত রাখল সে, একটু যেন গরম, জ্বর আসছে? লাইট অফ করে বেরিয়ে এল সে।

এবার ফোন করল তানিয়াকে, ফোন ধরল তানিয়ার ভাই! বলল, নীপা আপা, ‘আপাকে তো পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, আপা নাকি রেনুকে মারার সময় ওখানে ছিল!’ পরের একঘণ্টায় এক উকিলসহ আরো চার পাঁচজনকে ফোন করল সে, কাউকেই পেল না, সবাইকেই পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। তাহলে কাল সকালের আগে কোনোভাবেই আসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না? একটা শহরের সকলেই একটা খুনের ঘটনায় জড়িত!

ফোন রেখে মুখে চোখে পানি দিল সে, ভাবল শুয়ে পড়ি, সকালে দেখা যাবে। আবার জয়িতার ঘরে ঢুকে হাত রাখল মেয়ের কপালে, জ্বর এসে গেছে পুরাদমে! নিজের কানেই হাহাকারের মতো শোনাল গলা- ‘জ্বর তো রে মা! জ্বর কেন আইলো?’ উঠে বসে জয়ীতা বলল, ‘অত চিন্তা কইরো না, একটা নাপা দাও, খাই। চলে যাবে জ্বর।’ নীপা জ্বর মাপলো, একশো তিন!

নাপা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে গেল জয়িতা, রুমাল ভিজিয়ে মেয়ের কপালে দিয়ে বসে রইলো নীপা। কি করবে এখন, আবার ভয় করতে লাগলো তার। ধীরে ধীরে জ্বর কমে গেল, সকাল হল। এইরকম রাতও এক সময় সকাল হয়, দিনের আলোতে কোনো আশ্বাস না থাকলেও, এইরকম রাতের পর একটা সকাল আসা খুব দরকার হয়।

চোখ খুলে হাসল মেয়ে, বলল, ‘তুমি যে এত ভিতু আগে বুঝি নাই!’ নীপা রাগ করে বলল, ‘আমি ভিতু? আর তুই কী? আমি ভাবছিলাম আজকালকার পোলাপান সব শক্তপোক্ত, একটা ছবি দেখেই তোমার এই অবস্থা!’

জয়িতার হাসি হাসি মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে ফেলল, ঠোঁট কাঁপতে লাগলো, ফিসফিস করে বলল, ‘মুখ ধুয়ে আসো, তোমার মুখে রক্ত লেগে আছে!’

অথচ রাতেই ফেসবুকের প্রোফাইল থেকে রেনুর ছবি সরিয়েছে সে! নীপা রাগ করে জয়িতাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে তুলে বসিয়ে দিল, ‘ভালো করে দ্যাখ, আমি মোটেই রেনু না, রেনুর খুনিও না!’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গলা স্বাভাবিক করে বলল, ‘যা হাত মুখ ধুয়ে আয়, নাস্তা খাই, আজ কলেজে যাস না, আমিও অফিসে যাব না, থানায় যাব, আসিফকে কাল রাতে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।’

নাস্তা খেতে খেতে নীপা বলল, ‘তোদের ড্রাইভারকে ফোন দে, গাড়ি নিয়েই বের হই, কত জায়গায় যে যেতে হবে, ঠিক নাই। তোকে আমার শ্বাশুড়ির কাছে রেখে তারপর যাব। আচ্ছা?’ জয়িতা বলল, ‘আমিও যাব তোমার সঙ্গে সঙ্গে।’ নীপার একবার মনে হল, ভালই হয় ও সঙ্গে থাকলে, পরক্ষণেই বাতিল করে দিল সে চিন্তা। বলল, ‘না তোর জ্বর।’ না শুনে জয়িতাকে একটু রাগী দেখালেও পাত্তা দিল না। দুজনে রেডি হয়ে গেলে ড্রাইভারকে ফোন করল জয়িতা, ড্রাইভারের ফোনও বন্ধ!

লম্বা করে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিল নীপা। বলল, কি আর করা ‘চল, সিএনজি নাহলে উবার টুবার নিয়া যাই।’ নীচে নেমে দেখল, গলির মোড়ে সারাক্ষণ রিকশা, সিএনজি দাঁড়িয়ে থাকে, আর কিছু নেই। জায়গাটা খা খা করছে। খানিক হেঁটে হেঁটে সামনে গিয়ে একটা সিএনজি পেল, যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে খেয়াল করল, হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ড্রাইভার, মনে হচ্ছে দম নিতে পারছে না। রঙ জ্বলা নেভি ব্লু শার্টের ভেতরে ভীষণ হলুদ দেখাচ্ছে লোকটাকে, নীপার মনে হল, লোকটার জন্ডিস। জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘আপনার জন্ডিস?’ লোকটা বলল, ‘কি জানি আপা, শরীলে যুত পাই না।’ এবার নীপাকে প্রশ্ন করতে হয়, ‘পেসাব হলুদ?’ লোকটা যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, ‘হ আপা।’ নীপা রাগ করে বলল, ‘বাসায় যান, রেস্ট নেন, বেশি বেশি ডাব খান।’ বলেই আর দাঁড়াল না, জয়িতার হাত ধরে হন হন করে হাঁটতে শুরু করল। তীব্র রোদ উঠেছে, হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠল নীপার, একটা মার্কেটের শিড়িতে বসে পড়ল, জয়িতা ব্যাকুল হয়ে খালাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কী হল?’ নীপা বলল, ‘বসি একটু, রাতে আর সকালে দোকানের খাবার খেয়ে মনে হয় পেট খারাপ হইছে। রাতে দুইবার গেছি, সকালেও দুইবার গেছি।’ তারপর হঠাৎ ফোন বের করে নয় নয় নয় এ ফোন করল, বলল, ‘আমার হাজবেন্ডকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, প্লিজ হেল্প মি।’ নয় নয় নয় বলল, ‘আরে আপা এটা নিরীহ জনগণকে সাহায্য করার জন্য, ক্রিমিনালদের জন্য না।’

চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এল, নীপা বুঝতে পারল অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে সে, ভাবল, এই শহরের সবাই মরার জন্য ধুঁকছে, কেউ অসুখ হয়ে মরবে, কেউ খুন হবে আর কেউ খুন করবে।



গল্পকার পরিচিতি
আনোয়ারা আল্পনা
জন্মস্থানঃ উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ।
লেখাপড়াঃ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান বাসঃ ঢাকা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ