আপনার চোখদুটো আটকে আছে স্তনে।
স্তনের সাদা জমিনে কালো একটা দাগ। ভালো করে সেটা দেখার জন্য দৃষ্টিকে বেশ প্রখর করে তুলেছেন আপনি। যুতমতো দেখা যাচ্ছে না তবু। তাই ছুটিয়ে দিয়েছেন কল্পনা। ওটা হয়তো নখের আঁচড়। ইশ! এমন জায়গায় নখবাজি! এত হিংস্র হয় কী করে মানুষ? দাগটা অবশ্য দাঁতেরও হতে পারে। তাহলে ভালো। ঘটনাটা ভাবতেও যেন পুলক জাগছে, আহ! তা সে চিমটিরই হোক, বা কামড়ের, সময়ে মুছে যায় এ ধরণের ক্ষত। কিন্তু আপনার চোখ যেভাবে আটকে আছে, তা সরাবে কে? সময়ের সাধ্য নেই। সাধ্য নেই আপনারও। থাকলে এতক্ষণ সরাতেন। আমি বলার পর তো সরাতেনই!
নিচে নামতেন।
একটু নিচে নামতেন।
আরেকটু নিচে নামতেন।
কাপড় সরে গিয়ে উরুসন্ধিকে বিশেষ ভাবে দর্শনীয় করে তুলেছে। ওখানে হয়তো থামার ইচ্ছে হতো আপনার। তবে তা পারতেন না। আরো খানিকটা নেমে হাঁটুর একটু উপরে এসে দাঁড়াতেন। দাঁড়াতেই চোখ পড়ত হাঁটুর নিচের দিকটায়। পড়তেই ঝালমুড়ি খাওয়ার পর কাগজটা যেভাবে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে মানুষ, অমন করে কুঁচকে যেত আপনার মুখ। আপনি হয়তো চোখ ঢাকতেন, বা সরিয়ে নিতেন। যতই সুডৌল এবং উত্তেজক এবং আহামরি হোক, পাশে পড়ে থাকা পা থেকে বিচ্ছিন্ন ওই উরুর দিকে তাকিয়ে থাকতে আপনি পারতেন না।
আমি জানি, কারণ আমিও পারিনি।
চোখ পড়তেই চমকে উঠেছি। গরম তেলে জলের ফোঁটা পড়লে যেমন চমকায়। বা খেজুরের ফুটন্ত গুড়ে পড়ে আঙুল যেমন। সাহস করে আরেকবার তাকিয়েছি কেটে পড়ে থাকা পার দিকে। বুকে তখন চমকে গেছে বর্ষার বাজ। হাঁটুর একটু উপর থেকে কেটেছে; অথচ পায়ে তার স্যান্ডেল আছে আগের মতোই। দেখে খুব খুশি হবে সমাজ। তার শিক্ষাটা তো এমনই। অঙ্গ ছেঁড়ে ছিঁড়ুক, তবু ডাঁট যেন না কমে!
আপনি হয়তো এসব ভাবতেন না। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন উরুর উপর। আর পিছলে যেতেন বারবার। লালচালের দুধক্ষীরের মতো পিচ্ছিল ঘন রক্তের উপর চোখ পড়লে পিছলে যাওয়ারই কথা। যেতে যেতে আপনি দেখতেন আরেকটা পা বহাল আছে মহিলার। কেটে পড়া পা’টার পাশেই শুয়ে আছে সেটা। নীরব নিথর। খিদে না মেটা কাতরানো হাতড়ানো জেগে থাকা সঙ্গিনীর পাশে নিদারুণ বৈপরীত্য এঁকে পড়ে থাকা নাক ডাকানো কমজোর ছেলে বা লোক বা বেটার মতো নিস্তেজ ঘুমুচ্ছে পা’টা। আস্ত পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কাপড়ঢাকা। তার মানে অর্ধেকটা পর্যন্ত দেখা যায়। সেটুকুও দর্শনীয় পর্যায়ের আকর্ষণীয়। দেখতে দেখতেই আপনি উপরে উঠতেন আবার।
মহিলার পেছনে যে লোকটা বসে আছে বিপরীত পানে শরীর রেখে, তার দিকে তাকাতেন। মেরুদ-টা ছাড়া শরীরের আর সবই নাকি তার আছে! লোকটার গ্রামের লোকেদের অন্তত তা-ই ধারণা। ভুল বললাম। তারা মনে করে মেরুদ- লোকটার ছিল, কিন্তু সামনে পড়ে থাকা মহিলা সেটা চিবিয়ে খেয়েছে। লোকটা তাই দৌড়ায়, হাঁটে, কিন্তু দাঁড়াতে পারে না নিজের পায়ে! মহিলাকে দেখতেন আবার। পা কেটে পড়ে আছে যার, তার মুখটা সংকুচিত হওয়ার কথা, পায়ে হাজার খানেক বেলকাঁটা বেঁধার যন্ত্রণায় মুচড়ে থাকার কথা। কিন্তু এই মহিলা বেশ নির্ভার। মুখে যেন একটু হাসিরও আভা! এত বড় আঘাত নিয়েও যে মহিলা এমন স্বাভাবিক, তার পক্ষে কয়েকটা মেরুদ- চিবিয়ে খাওয়া খুবই সম্ভব! ভাবতে ভাবতে আপনি সাঁয় দিতেন লোকটার পরিবারের লোকদের কথায়। এবং অজান্তেই আবার লোকটার দিকে চোখ যেত আপনার। ঘাড় ঘুরিয়ে সে তাকিয়ে আছে মহিলার স্তনের দিকে। যেটার দিকে চোখ রেখেছেন আপনিও। কিন্তু পুরোটা দেখতে পাচ্ছেন না বলে মন খারাপ। অথবা মহিলার হুঁশহীন আলুথালু ভাব দেখে একটু বিরক্ত।
বিরক্তিটা দূর করতে আপনি আঙুল চালাতেন। এসে দাঁড়াত পরের ছবিটা।
মাঝারি উচ্চতার কোনো চাকুরের বসার ঘর। ঘরে কেউ নেই। ঘরের মাথায় দেয়ালজোড়া একটা জানলা। আলো ঢুকবে ঢুকবে করছে। কিন্তু মোটা রঙচটা কাপড়ের পর্দার নজর এড়িয়ে ঢুকতে পারছে না। তবে তার আভা একটা পড়েছে ঘরে। দেয়ালের মিষ্টি রঙটা খোলতাই হয়েছে তাতে। হেসে উঠেছে বেতের সোফা, কাঠের টেবিল, নকশী কুশন। ভালো লাগছে দেখতে। কিন্তু প্রথম ছবির লাল নীল হলুদ বাস্তবতা দেখার পর যে প্রশ্নগুলো ঘুরছে আপনার মাথায়, তার উত্তর দিতে পারে এমন কিছু এই ছবিতে নেই, নেই বিশেষ কোনো বিশেষত্বও। আপনি তাই চোখ চালাতেন পরের ছবিটার জন্য। তখনই হয়তো আপনার চোখ যেত সুমো কুস্তিগীরের মতো মোটাসোটা জাপানি টিভিসেটের উপরের দেয়ালে। ছবি ঝুলছে কিছু। ছবির মধ্যে ছবি, দেখতে হলে কসরত করতে হয়। কসরত করেই ওগুলো দেখতে থাকতেন। একা একজন বৃদ্ধ, বৃদ্ধা একজন একা, আর একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ের ছবি। বাচ্চাগুলোর সাথে তাদের চেয়ে একটু বড় এক মেয়েকে হয়তো প্রথম ছবির মহিলা হিসেবে সনাক্ত করতে পারতেন আপনি। তখন নিশ্চিত হতেন তার চেহারার সাথে ছবির সবারই সুক্ষ্ম-স্থূল কিছু মিল আছে। মন উদাস করা কোনো ঝিঁঝিঁডাকাসন্ধ্যায় এমন কোনো ছবি দেখে আপনারও বুক কাঁপে। আপনিও ভাবেন অস্রোতে জমা দাম সরিয়ে নদীগুলো যদি সচল হতো আবার, যদি এসে মিশত এ ওর বুকে! এত বড় দেয়াল, মাঝে ওই ছবিগুলো ছাড়া সব ফাঁকা, ওই বিশাল ফাঁকটুকু জমে থাকে আপনার বুকেও। ভাবতেই আপনি আবার তাকাতেন দেয়ালটার দিকে। মহিলার জমজমাট পরিবারের পাশে একা দাঁড়িয়ে মুখগোমড়া বরটাও। কিন্তু একা কেন সে? তার কি আর কেউ নেই? প্রশ্নটা ভাবতে ভাবতেই দেখা যেত আপনি পরের ছবির মুখোমুখি।
শোবার ঘর। ঘরটার অর্ধেক জুড়ে খাট, বাকি অর্ধেকের অর্ধেকে আলমারি আর ড্রেসিং টেবিল। একটা ছোট র্যাক, এটা সেটা দিয়ে ভরা। বাকিটুকু ফাঁকা, উঠোনের মতো। মাঝ-উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, মহিলা বসা খাটের বারান্দায়। লোকটার খালি গা, পরনে অর্ধেক লুঙ্গি আর আধখোলা প্যান্ট। জামাটা পড়ে আছে খাটের উপর, মেঝেতে ব্যাগ। পাশেই জুতো। অফিস থেকে ফিরেছে হয়তো। মহিলার পরনে ঘরোয়া শাড়ি। মুখে বিরক্তিমাখা রাগ। কথা বলছে। লোকটার মুখে অপরাধী ভাব।
ছবিটা দেখেই খুব চেনা মনে হতো আপনার। চেনা মনে হতো মহিলার কথাটাও।
‘এইটুক মাত্র সংসার। দুজন আমরা মানুষ। ঘরদোর ঠিকমতো রাখার দায়িত্ব দুজনেরই। না, ঘর তুমারে গুছাতে বলছি নে। কিন্তু অগোছালো কোরো না অন্তত। খাওয়ার পরে প্লেটটা ধোয়া, অফিসফেরত এটা সেটা গুছায়ে রাখা, নিজের খুটিনাটি জায়গা মতো রাখা কি কষ্টের খুব? অন্য পুরুষদের তো বাড়ির কাজ করতে করতে ঘুমই হয় না দেখি। অথচ তোমার অফিস শেষ হলো, তো উড়ালপঙ্খি তুমি। আর আমার ঘুম হয় না কাজের ঠেলায়। ভোর থেকে রাত খাটতেই আছি বান্দীর মতো!’
হাজার বছর ধরে ঘরের কাজ না করার যত অজুহাত পুরুষের, লোকটা তখন তা-ই তুলেছে। মহিলার গলায় তখন উঠে এসেছে নারীর চিরায়ত ঝগড়ার স্বর, কান্নার সুর। এরপর আর বাকি থাকেনি কিছুই। এর দোষ ও টেনেছে, এ টেনেছে ওর ভুল। ওর কাঁটা এ ভেঙেছে, ও দলেছে এর ফুল।
বিপর্যস্ত আরেক রাতের দুটো ছবি আছে এরপর। পাশাপাশি সাজানো। সময়টা হয়তো আলাদা, তবে ছবির নিচের তারিখ বলছে রাতটা একই।
ছবিদুটো আপনাকে জানাবে যে, রাতটা সে রাতে প্রসন্নই ছিল।
জানালায় ছাতিম গাছ। তার গাঢ় সবুজ চুলের উপর থোকা থোকা সাদা ফুলের নকশা আঁকা। তাতে জোছনা পড়ছে গলে। চারপাশে হালকা কুয়াশা। কুয়াশায় নিশ্চয় ভেসে বেড়াচ্ছে ছাতিম ফুলের মাদকঘ্রাণ। অর্থাৎ রাতটা ভীষণ প্রেমের। রাতটা আয়েশী কামের। আর অমল কোমল ঘোরের। এমন রাতে আপনি হয়তো আপনার হৃদয়টাই ছুড়ে দিতে চাইবেন প্রিয় মানুষটার দিকে। কিন্তু এরা ছুড়ল কাদা।
একজন হয়তো বলেছে গরিব চাচার অসুখ, কিছু টাকা দিতে হবে। বা বলেছে তার ছোটভাইয়ের ব্যবসায়ে দুর্দিন, সাহায্য দরকার। অথবা ছোটবোনটা এখন থেকে এখানেই থাকবে। কিংবা বাবা মায়ের দেখাশোনার জন্য লোক রাখা দরকার। শুনেই অন্যজনের মুখ বেজার। মনে আছে, তার বাবামায়ের জন্য খরচ দেওয়ার অপরাধে কী লঙ্কাকা-ই না বেধেছিল ঘরে! বা তার ছোটভাইয়ের দুর্দিনে পাশে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি তাকে। অথবা তার বোন গর্ভবতী, একবার খোঁজও নেয় না অন্যজন। কিংবা বিয়ের দিন থেকেই সে বুঝেছে বিয়েটা করা পাপ হয়েছে তার। শুনে ক্ষেপে গেছে অন্যজন।
তারপর বজ্রপাত।
তারপর ঝড়।
তারপর মুষলধার।
ভীষণ সেই কান্নাভেজা রাতের প্রথম ছবিটা মহিলার।
খাটে ঠেস দিয়ে মেঝেয় বসে আছে সে। চোখে মরা নদীর চোরা স্রোতে। সন্ধ্যারাতের ঝড়ের পর ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেছে বর। সেও বেরিয়েছে। একরিকশাদূরত্বে সবচে’ আপন ঘর। এসে ভাবছে ফিরবে না আর। শেষ পর্যন্ত হাত তুলল গায়ে! বিয়ের পর সে নাকি এই সংসারের লোক, বাপ মা ভাই বোনের সংসার পরের সংসার। এ সংসারে তাদের সমস্যা টেনে আনা যাবে না। শুনেই জ্বলে উঠেছিল মহিলা।
‘কেন? তুমি তাহলে মুখে মুখেই সুশীল শুধু! ভেতরজোড়া শীল, তাই নোড়া পড়লেই বাজে! তুমিই বলো, আমার জায়গায় তুমি হলে করতে এ সংসার?’
প্রশ্নটাকে আপনি ঘুরপাক খেতে দেখতেন পাশের ছবিতেও।
নগর উদ্যানে জেগে থাকা রাত, ঘুমভাঙা ভোর। চারপাশে আলো আর আঁধারের দোটানা। পুরোনো একটা বেঞ্চে বসে আছে লোকটা। বেঞ্চে ‘অমুক প্লাস তমুক’; এ ছেলের নাম, সে মেয়ের নম্বর। এটা সেটা উল্টোপাল্টা কথা। গোপন অঙ্গ গোপন প্রত্যঙ্গের ছবি। প্রাচীরে দেয়ালে দরজায় টয়লেটে ওসব দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেছে আপনার। কাঁচা হাতে আঁকা অমনই একটা ছবি তাকিয়ে আছে লোকটার বাঁ পাঁজরের পাশ থেকে। যেন ভেংচি কাটছে সভ্য আপনাকে! সেদিকে তাকিয়ে সমাজের অসুস্থতার কথা ভাবতেন কিছুক্ষণ। বা চোখ রাখতেন সোজা লোকটার মুখে। সেখানে তীব্র ব্যথার ছাপ। কিংবা অনুশোচনার। অথবা আক্ষেপের।
কী দারুণ মেয়ে ছিল মেয়েটা! অথচ যেই না ঘরের চাবি পেয়েছে, হয়ে গেছে অবিবেচক, একচোখা। প্রাপ্যটুকুই চায়; দেওয়ারও যে আছে, ভাবে না। ‘ভুলটা হইছে বেশি পিরিত মারাতে যায়ে। বিষ যত বেশি, ঝাড়ানিও তো ততটাই দিতে হয়! কারণে অকারণে তাই অন্য পুরুষের মতো ধরতে হইতো ছাই দিয়ে! কিন্তু আমি প্রগতিশীল, তোমারে সম-অধিকার দিবো, মাথায় তুলে রাখব। তা, সেটা পাওয়ার জন্য তোমারও তো আগাতে হবে দুই পা, নাকি? কিন্তু তুমি পড়ে রইছো মুদ্রার এক পিঠ হয়ে। উঠতে বাপভাই, বসতে মা-বোন! শ্বশুরবাড়ির দিকে তাকাওও না, আবার তালিকা করো তারা কী কী দিতে পারলো না! আরে বাবা, চোখ খোলো, তাকায়ে এটটু দ্যাখো সমাজের দিকে! ’
তারস্বরে বউ তখন অস্বীকারই করল সমাজটাকে।
ঠিক আছে, লোকটা ভাবে, সমাজ না মানলে না মানুক। কিন্তু সেই সমাজই তো ঠিক করেছে বিয়ের পর বউয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব বরের, এই কথাটা মানে কেন? সংসারের জোয়াল কেন বরকেই একা টানতে হয়? কেন বউটাও এক কাঁধ বাড়ায় না?
কী একটা মোক্ষম কথা বলে ফেলেছিল বউটা তখন।
তাই চড়।
তাই নীরবতা অদ্ভূত।
তাই কান্নার ঢেউ।
নিচে কালিপড়া দুচোখের পানি তখন বিদ্রুপ করছিল লোকটাকে। বলছিল, ‘এ-ই তোমার শিক্ষা তাহলে! এই তোমার রোকেয়াভক্তি!’ দুঃখভরা সেই চেহারাটা পোড়াচ্ছে খুব। মুখে কেমন ক্রোধের ছাপ লোকটার। বেঞ্চের কিনারে রাখা হাত। হাতের পাশে লাল লাল ছোপ। বেরিয়ে থাকা পেরেক বা অমন কিছুতে কি হাত ঘষছিল সে? অনুশোচনায় কিংবা ভাগ্যরেখা মুছে ফেলার চেষ্টায়?
যা-ই হোক, পরের ছবিটা অন্যরকম।
কোনো এক ডায়গনস্টিক সেন্টারের অভ্যর্থনার সামনে থেকে তোলা। লোকটার হাতে একটা খাম। পাশাপাশি বেরিয়ে আসছে বরবউ। নির্ভার চোখ, নিশ্চিন্ত ভুরু। বুক থেকে পাহাড় নামার স্বস্তি দুজনেরই মুখে। ঠোঁটে হাসির দাগ। নাকে আহ্লাদী ঘাম। চোখে আনন্দ চিকচিক।
পরের ছবিটা গর্ভবতী। পেটটা ফুলে উঠেছে মহিলার।
পরের ছবিটা আরো গর্ভবতী। পেটটা আরো ফুলেছে।
খুশিমনে তাই আপনি গিয়ে দাঁড়াতেন পরের ছবির গাছতলায়।
গাছটার নাম শহুরে মানুষ জানে না। বনে বাদাড়ে হয়। ভুঁইফোঁড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কৈশোরে যেমন হঠাৎ বেড়ে ওঠে ছেলেরা মেয়েরা, বোঝাও যায় না কবে লম্বা হয়ে গেল কবে মোটা, গাছটাও তেমন। ঢ্যাঙা। ডালপালা কম। সোজা দাঁড়িয়ে থাকে। কারো সাথেও নেই পাছেও নেই। তার দেওয়া অক্সিজেনই মানুষ নেয় শুধু, তাকেও কিছু দিতে হবে, ভাবে না। এমনই সে একা, ফুঁ দিলেও নড়ে ওঠে যেন; জোর হাওয়ায় মটাশ। ভেঙে পড়ে কোমরসমান উচ্চতায়। তখন ত্রিকোণমিতির সমস্যার মতো করে মাথাটা ছুঁয়ে থাকে ভূমি। এই শহরেও তার অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। দাঁড়িয়ে আছে শহরবাসী গ্রাম্য অভিবাসীর মতো। বেড়ে উঠছিল পাশের ভবনের সাথে পাল্লা দিয়ে, কিন্তু টাকার সাথে তার জোরের তুলনা হয় না বুঝে থেমে গেছে। তাতেও যে বাড় বেড়েছে, মহল্লার কোনো উঠতি তরুণের চেয়ে কম না। তাদের মতো সে হেলেও পড়েছে পাশের বাড়ির দোতলা বারান্দায়, যেখানে ওড়না বা সালোয়ার বা জামার আড়ালে শুকোয় ষোড়শীর লাজুক ভেজা ব্রা-পেন্টি। তারই গন্ধ যেন দিনরাত নিচ্ছে গাছটা নাক টেনে টেনে। তা ছোকড়াই হোক বা গাছ, মেয়ের দিকে চোখ দিলে বাপ তা মেনে নেবেন কেন? সকালে উঠেই তিনি লেগে পড়েছেন আপদ সরাতে। এবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে তা দেখছেন এক বৃদ্ধ। তার ঠিক পেছন থেকে ছবিটা তোলা।
কান্না পাচ্ছে বৃদ্ধের। মনে হচ্ছে, গাছটা অবিকল তার ছেলে। শিকড় ভুলে শহর ধরেছে সে। মায়াবি আলোয় পড়ে ভুলে গেছে গ্রামীণ ছায়া। অথচ এই কুটিল শহর কেটে নিয়েছে মাথাটা তার। হ্যাঁ, তা-ই হবে। না হলে, যা হচ্ছে তাদের সাথে, মুখবুজে তা কি হতে দিতে পারত ছেলেটা?
পরের ছবিতে দুইটা ঘর। দুই ঘরে তিনজন। বামে ডাইনিং। পা ছড়িয়ে বসে আছে মহিলা। সামনে খাবার। খাচ্ছে বোধহয়। তৃপ্তিতে বুজে আছে চোখ। মুখ বরাবর দরজা। দরজার ওপাশে রান্নাঘর। রুটি বেলছেন মহিলার মা। ক্লিকের সময় তিনি কিছু একটা বলছিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখের উপর এসে পড়া জুলফি সরাচ্ছেন এক হাতে, আর হাত সামনে রাখা খামিরের গামলায়। পোয়াতি মেয়ের জন্য রুটি করছেন। ঠোঁটে ভাসছে নিজের গর্ভকালীন স্মৃতি। খুব সুখের আর তৃপ্তির আর গর্বের ছায়া মুখে।
কোনো কোনো সুন্দর মুখে যেমন বেঢপ ব্রণের দাগ থাকে, এই ছবিতেও তেমন মা মেয়ের সুখের পাশে লোকটার ভীষণ বেমানান মুখটা চোখে জ্বালা ধরাচ্ছে। রান্নাঘরে ঢোকার আগেই ডানদিকে বেসিন। শেভ করছে লোকটা। পেছন থেকে তোলা ছবি। আয়নায় তার বিরক্ত মুখের ছায়া। কী সব ছাইপাশ খেতে হচ্ছে ইদানীং, এ কি মানুষ খায়! গলা দিয়ে নামে না তার। তবে সে তো আর গর্ভবতী না, যে খেতে না পারার ভাণ করে শাশুড়ি তাড়িয়ে মাকে এনে রাখবে!
পরের ছবিতে হাসপাতাল।
পাঁচকোনা ফ্লোরের উপর ইয়া বড় প্রসূতি ওয়ার্ড। একের পর এক বেড। প্রতিটাতেই মানুষ। কেউ রোগী। কেউ নার্স। কেউ আত্মীয়। কেউ ঘুমোচ্ছে, গল্প করছে কেউ। কেউ কিছুই করছে না, মুখে সন্ধ্যার বিষাদ। জেগে থাকা প্রতিজনই তাকিয়ে আছে এই কোনার বেডের দিকে। বেডের একপাশে একটা পুঁটলি। পুঁটলির ভেতর সোনামানিক। গায়ে বাদামের রঙ মেখে, দুচোখে দুই সমুদ্র এঁকে তাকিয়ে আছে সে। দৃষ্টি তার পাশে শোয়া মায়ের দিকে। মায়ের চোখে অসহায়ত্ব। তাকিয়ে আছে সে পাশে দাঁড়ানো বরের দিকে। বরটার চোখে আগুন, আর হাতে চড়। চড়টা উঠানো, তাক করা শ্যালিকার দিকে। শ্যালিকার চোখ দুলাভাইয়ের দিকে, সে চোখেও আগুন। সাথে ভয়। ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা এক মোড়া বেডের পাশে। মোড়ায় আগের ছবির বৃদ্ধা। পাশে একটা চেয়ার। চেয়ারে তার স্বামী। তাদের চোখে অবিশ্বাস।
মারমুখী এই ছবি পার হলে কয়েকটা নির্বিচার ক্লিক। কিছু ছবি ঘটনার আগের, কিছু ছবি পরের। এলোমেলো, অগোছালো। তবে মন দিয়ে দেখলে পরম্পরা বেশ বুঝতে পারা যায়।
খোলা জানলায় নরম রোদের রঙ। বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল চাপছে লোকটা। শ্বশুর শাশুড়ি গল্প করছে। পিচ্চির ময়লা কাপড় পরিষ্কার করছে খালা। আর তাকে ক্ষেপাচ্ছে আধো উচ্চারণে। এই যে এত কষ্ট করছে খালা, রাত জাগছে নানি, সেবা করছে মামা, খরচ করছে নানা- সবাই তো পর হবে সে বড় হলে। ‘খরচের ভয়ে’ যারা দেখতে এল না, খোঁজ নিল না পর্যন্ত, আপন করবে সেই দাদা দাদি চাচা ফুফুকেই! এই ছিল সারমর্ম। কথাগুলো লোকটার কানে গলেছে গরম শিশা হয়ে। এমন কথা হয়তো আগেও সে শুনেছে। জমানো ক্ষোভের খাতা থেকে তাই বের করেছে গনগনে গোলাবারুদ। তার বাপ মা এলেই তো অপমানের চূড়ান্ত। তাদের এ ভালো না, সে ভালো না। তাদের পায়ে দোষ, হাতে ভুল। কথায় কথায় আগুন জ্বলে ঘরে। তারা তাহলে আসবে কোন মুখে? আর ছেলের বাড়ি এসে যদি বউয়ের লাথিগুঁতো খেতে হয়, তারা তবে আসবেই বা কেন?
শ্যালিকা তখন আরেকটু চড়েছে। দুলাভাই আরো একটু।
তাতে ডালপালা ছড়িয়েছে কথা।
আর কে না জানে কথার চেয়ে ছোঁয়াচে কিছু নেই? মেয়েটার সাথে যোগ দিয়েছে তার বাবা মা। প্রসূতি বোনও। জোর পেয়ে হয়তো আরো বেফাঁস কিছু বলেছে শ্যালিকা। তাই আর হুঁশ ধরে রাখতে পারেনি দুলাভাই। নইলে সোমত্ত মেয়েটার দিকে হাত তোলার আগে নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বার ভাবত।
ভাবেনি বলেই কালবোশেখি। তার পরে এক মাইক্রোবাস।
চালকের সামনে থেকে তোলা ছবি।
মহিলার কোলে বাচ্চা। লোকটা বসা পাশে। তার মুখ বিকৃত- ভীষণ ক্রোধে বেঁকে আছে। দুজনের গায়েই আগের ছবির পোশাক। বোঝা যাচ্ছে ঝগড়ার ঝড়ই তাদের বের করে এনেছে। সদ্যোজাত সন্তান নিয়ে এত দূরের যাত্রা, নিজের শরীরও যাচ্ছেতাই- ধকল সইবে না, যেতেই যদি হয় কদিন পরে যাওয়া যাবে, এখন ঠাণ্ডা হোক সে- অনুরোধ করেছিল মহিলা। কিন্তু শোনেনি বর। সে কি ফকির, না পথে পড়ে থাকা লোক, যে পরের খোটা শুনবে? তার সন্তান তার বাড়িতেই থাকবে। গরিব বাবা মা যেমন করে তাকে মানুষ করেছে, তেমন করেই গড়ে তুলবে নাতিকে। অসুরের শক্তিতে ছিনিয়ে এনেছে বাচ্চাটাকে। কাঁদতে কাঁদতে মহিলাও তাই উঠে বসেছে গাড়িতে।
এখন এই মাঝরাস্তা, এখনো বাজছে তাদের বিগত ঝগড়ার ঢোল। মাঝে মাঝে গলা সাধছে বাচ্চাটা।
ড্রাইভারের মুখ দেখা যাচ্ছে ছবিতে। চোখ তার পেছনমুখী গ্লাসে। চেহারায় বিব্রত অস্বস্তি। এই মুখভঙ্গি আর আগের ছবিগুলো দেখে সহজেই আপনি অনুমান করতে পারবেন যাত্রীদের কথোপকথন।
একজন হয়তো বলেছে ‘বাপমা মানুষ হলে তোমারেও মানুষ করত। তাইলে তুমি বুঝতা, স্বামীই শুধু না, তার পরিবারও আপন।’
উত্তর আসে ‘তোমারে তো খুব শিখাইছে, তাইলে বোঝো না ক্যান, নিজের হোক পরের হোক, বাপ মা মানেই বাপ মা? আর প্রতিজন বাপ মা-ই শ্রদ্ধেয়! অমন যন্তুর মতো ব্যবহার করলা কী করে তাদের সাথে?’
‘ফালতু কথা বলবা না। আমার বাপমাকে তুমি অপবাদ দিতে পারো হেনস্থা করতে পারো তাড়ায়ে দিতে পারো, আর আমার দুটো যুক্তির কথায় দোষ!’
এরপর হয়তো কোন পবিত্র পানিতে কতভাবে ধোয়া নিষ্কলুষ তুলসি পাতা একেকজন, বর্ণনা করছিল সেটাই। আর দিচ্ছিল অপরপক্ষের দোষের ফিরিস্তি।
মুখ দেখেই বোঝা যায়, খারাপ লাগছে চালকের। অথচ কত কূটকাব্য কটুদৃশ্য রচিত হয় পেছনের ছিটদুটোয়। প্রায়ই তার পেছনদেখাআয়না হয়ে ওঠে নীলপর্দা। কত নারী পুরুষ কত ছুড়ি ছোকড়া কত কা-কীর্তি করে শুয়ে বসে! তার মনে হয় চলতে থাকুক। গাড়ি আর থামে না যেন। আজ হচ্ছে উল্টো। মনে হচ্ছে, পথটা যদি চকস্লেটে আঁকা রেখা হতো, মুছে তাকে ছোট করা যেত। দ্রুত নামানো যেত এদের। সে তাই দ্রুত চালায়। আরো দ্রুত যায়। তার যেন কত তাড়া।
এই তাড়াহুড়োর কারণেই পরের ছবিটা।
রেলক্রসিংয়ে আটকে পড়েছে গাড়ি। ছবিটা গাড়ির ভেতরের। বাচ্চাটা কাঁদছে। লোকটা বাইরে। বউকে সে টানছে ব্যাকুল হয়ে। চোখে মুখে আতঙ্ক। দরজা খোলা। সেদিকে তাকালেই দেখা যায় পালাচ্ছে ড্রাইভার। এবং তখনই চোখ যায় ছবিটার উপরের কোণে, কিছুদূরেই আগন্তুক ট্রেন!
আতঙ্কিত চোখে আপনি পরের ছবিটার খোঁজ করতেন।
সেখানে অবশ্য আরো আতঙ্ক।
তাড়াহুড়ো করে সরতে গিয়েই হয়তো, রেললাইনে পা বেধে গেছে মহিলার। একহাতে সে শাড়ি সামলাচ্ছে, আর হাতে ওই পা। বিষ্ফারিত চোখদুটো পড়ে আছে আরো কাছিয়ে আসা ট্রেনের দিকে। বাচ্চা এখন লোকটার হাতে। সাবধানে সে জড়িয়ে ধরেছে কাপড়ের পুটলিটা। ত্রস্ত অপর হাতটা রাখা বউয়ের পায়ে। মুখজুড়ে এক নিবিড় একাগ্রতা। যেভাবেই হোক, পা’টা সে তুলবেই টেনে।
সেটা যে সে পারেনি, তা বলার জন্যই আবার আপনার সামনে আসত প্রথম ছবিটা।
এবারের দেখায় আপনি বুঝতেন, যে কাপড় আড়াল করেছে মহিলার স্তনের অর্ধেক, সেটা আসলে তার বাচ্চা জড়ানো পুঁটলি। ওই তো ক্যানোলা বাধা কবজির আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে বাচ্চার মাথাটা! মুখে অদ্ভূত একটা তৃপ্তির ছাপ এঁকে সেদিকেই তাকিয়ে আছে মহিলা। আচ্ছা, বাচ্চাটা কি দুধ টানছে? হ্যাঁ, তা-ই তো! তার হয়তো খিদে পেয়েছিল, কাঁদছিল খুব। ঘটনাস্থলেই এভাবে খাওয়ানো ছাড়া আর পথ ছিল না। কী মারাত্মক, কেটে পড়া পা ফেলে রেখেও বাচ্চা খাওয়াচ্ছে মহিলা! আহা। একজন মা-ই কেবল পারে এমন! শিশির জমত আপনার চোখে। সিক্ত চোখেই আপনি বরটার দিকে তাকাতেন। রাগের তাপে তখন শুকিয়ে যেত চোখ, আগুন যেন পুড়িয়ে মারত লোকটাকে- শালা পাষণ্ড, তার ত্যাড়ামির জন্যই এই দুর্ভোগ!
আনমনেই আপনি আবার ঘাটতেন এ্যলবামটা। একটার পর একটা ছবি দেখতেন। দেখা ছবি খুঁটিয়ে দেখলে নতুন দৃশ্য ধরা পড়ে। ধরতে ধরতে এগিয়ে যেতেন। যেতে যেতে দেখতেন দুর্ঘটনার ছবিতে কজন দর্শকও আছে। কেউ ছবি তুলছে তারা, কেউ নির্বিকার দাঁড়ানো। এমনকি হাসছেও দুই একজন। আপনার মনে হতো, ওরা কি কেউ ডাক্তার না? এম্বুলেন্স না? মানুষ না? কেউ কি এগিয়ে আসতে পারত না মহিলার সাহায্যে? মানুষ কেমন অমানুষ হয়ে গেছে দিন দিন, ভাবতেন।
ভাবতে ভাবতে দেখতেন এই ছবিটা দুইবার আছে। একই ছবি দুইবার না ঠিক, তবে একই জায়গা, ঘটনাও এক। তবে দ্বিতীয় ছবিটা তোলা হয়েছে লোকটার পাশ থেকে। বউয়ের কাঁধ ডিঙিয়ে সে তাকিয়ে আছে উল্টোদিকে। ফলে ছবিতে তার মুখ দেখা যায় না। রাগটা আবার বাড়তো আপনার। শালা কুঁড়ে! বউটার চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে, তাকে একটু নির্ভার হতে সুযোগ না দিয়ে, ঢেমনার মতো বসে আছে হাত পা ছেড়ে! তখনই কেন যেন দ্বিতীয় চিন্তা আসত আপনার মনে। বউয়ের বুকে না, লোকটা হয়তো তাকিয়ে আছে বাচ্চার মুখে। আর তখনই বদলে যেত আপনার দৃষ্টিভঙ্গিও। খেয়াল করতেন, তার পিঠে হেলান দিয়েই মহিলা জোর পেয়েছে বসার। আর বসে লোকটাকে থাকতে হয়েছে। তার উরুর পাশেও পড়ে আছে একটা কাটা পা।
কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি। কারণ আপনি প্রথম ছবি থেকেই চোখ সরাতে পারেননি। পারেননি মানুষ হয়ে উঠতে।
লেখক পরিচিতি
আশান উজ জামান
খামারপাড়া গ্রাম, যশোর জেলার শার্শা উপজেলায় জন্ম। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশা শিক্ষকতা। পড়ান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে। ছোটগল্প লেখেন। ২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম বই ‘অন্যচোখে’। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে লেখা একটা নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস সেটা।
2 মন্তব্যসমূহ
আশান ভাই, গল্পটা ভয়ংকর। গল্পপাঠে আপনার প্রথম লেখা পড়ছি...স্বাগতম।
উত্তরমুছুনছেঁড়া নয় যেন জীবন্ত ছবি।
উত্তরমুছুনমুগ্ধতা একরাশ।