যোহরের নামাজের পর এই সময়টা বিষণ্ণ ইঞ্জিনের মতো ঝিমঝিম করে। নরোম তাপ ছড়ায়। মেঠোপথ দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া ধূসর ধুলোর ক্লান্তিকর গড়িয়ে যাওয়ার মতো নিরিবিলি। কোথাও সবুজ পাতার ফাঁকে বেজে ওঠা পাখির কণ্ঠে শ্রান্তি।
এটা সংরক্ষিত মসজিদ। শুধু ছাত্র আর হুজুররা এখানে নামাজ পড়ে, বাইরের লোকেরা আসে না। জেলখানার ভেতরে কয়েদিদের জন্য বানানো মসজিদের মতো।
তালেবুল এলেমরা এলাকার পাঞ্জেগানা মসজিদে যাওয়ার সুযোগ নেই , যেহেতু মাদ্রাসার প্রধান ফটক ধরে চব্বিশ ঘন্টা ঝুলে থাকে একটা ভারি লোহার তালা এবং একজন সদা চৌকান্না প্রহরী।
সুন্নত নামাজও শেষ হলো। ছাত্ররা নামাজের কাতারে বসে থেকেই যে যার মতো জিকির করছে মৃদুস্বরে। মাদ্রাসার ভবনের পাশে সেগুন বনে আট নয় বছর বয়সী দুটি বালক বালিকা সাপের জড়াজড়ি দেখে এসে সেই দৃশ্য আবার মঞ্চায়ন করার কসরত করছে দুজনে মিলে।
ছয়জন ছাত্রের একটি দল নীরবে নামাজের কাতার ছেড়ে বের হয়ে এলো। এরা আজকের খাদেমালি।
বোর্ডিং থেকে ডেগচি পাতিল বয়ে নিয়ে আসছে।
খাবার ঘরে দুপুরের খাবার সাজাবে। দোতলায় লম্বাচওড়ায় যথেষ্ট বড়ো একটা ঘর রয়েছে, সেখানে সোজা ঢালাও তিন সারি দস্তরখান বিছিয়ে প্লেট সাজিয়ে দেয়া হয়।
ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে দোতলার সিঁড়ি পাশে, আজকে সকালে এই হেফজখানা মাদ্রাসায় সে নতুন ভর্তি হয়েছে। আট ন বছর হবে বয়স। শহরে বেড়ে ওঠা ছেলে।
সে নামাজে যায়নি। মনখারাপ, ঘুরে ঘুরে সে দেখছে, আর চোখ মুচছে একটু পরপর। দু'চোখ ভর্তি দারুণ বিস্ময় আর কৌতুহল নিয়ে সে দেখছে সম্পূর্ণ আজনবি এই জগত, এইখানকার মানুষজন, নিয়মকানুন, যাপিত জীবনের বয়ে যাওয়া সব ছন্দোবদ্ধ ছবি। নাম ধরা যাক, মজিদ।
খেদমতের দুই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির পাশে, খাবার রুমের দরোজা ঘেঁষে, কী নিয়ে যেন তারা চাপাস্বরে আলাপ করছে আর মিটিমিটি হাসছে। আজকের খাদেমালিদের মধ্যে আরেকজন ছেলে, নিটোল ফরসা, সুশ্রী মতো দেখতে, সালাদের বাটি নিয়ে দ্রুত ঢুকছিল দরজা দিয়ে, সেই দুইজনের একজন ঠাস করে তাকে কুৎসিত ইঙ্গিতে বললো, কিরে আনাস, ক্বারীর কালিজিরার তেল এখনো লাইগা আছে নাকি তোর পাছায়...
এক পলকে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা দৃশ্যটা ছোট্ট ছেলে মজিদ, যে এই আনকোরা পরিবেশে আজই এসে পড়েছে প্রথম, তার চোখে পড়লো। তার সরল মন ভীষণ বিস্ময়ে চমকে উঠলো সেই অনভ্যস্ত নতুন ধরনের সংলাপে। ভয়ের মতো বাজতে লাগলো, ওই ছেলে দুটার কেমন কেমন চোখ করে বলা কালিজিরার তেল...
২.
কালিজিরার তৈল সর্বরোগের মহৌষধ। হাদীসে লেখা আছে। এইজন্য ক্বারী সাহেব হুজুরের টেবিলে সবসময় সরিষার তেলের পাশাপাশি কালিজিরার তেলের শিশি থাকে।
মাদ্রাসার মকতব বিভাগে বন্ধুত্ব হয়ে যায় আনাস আর মজিদের। রাতে একটা রুমে সবার ঢালাও বিছানা। দেড়হাত করে জায়গা বরাদ্দ একেকজনের জন্য। নতুন পরিবেশ, মা বাবা ছাড়া এতদূর এসে মজিদের ঘুম আসতে চায় না রাতে। দিনের বেলাও আয়েশ করে ঘুমানোর উপায় নেই, ফজরে উঠে ঠান্ডা পানি দিয়ে অজু করতে হয়।
শুয়ে শুয়ে দুজন গল্প করে। রঙবেরঙের গল্প। জীবনের স্তর স্তর ভাঁজ, খোলস তারা ছড়িয়ে দেখতে এগোয় নিষ্পাপ কৌতুহলে।
রুমে মর্গের নিস্তব্ধতা। মৃদু টিমটিমে হলুদ আলোর স্বপ্নবাতি জ্বলছে। মজিদের ঘুম আসছেনা। এক বড়ো ছাত্র তাকে শুধু শুধু লাত্থি মেরেছে। পেটের মধ্যে। কী অপরাধ বোঝার আগেই প্রচণ্ড যন্ত্রণাহ তার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এসেছে, সেই অন্ধকারের আকাশে জ্বলতে নিভতে সে দেখেছে অনেক দুর্বোধ্য তারা।
বাসার কথা মনে পড়ে। ওর ভাইবোন যারা বাসায় থাকে, পারবে তাদেরকে এমন কেউ এসে কষ্ট দিতে? ডুকরে কেঁদে উঠে। তার মনে হয় পৃথিবীর যাবতীয় আয়োজন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন এক অজানা শঙ্কার দ্বীপে এসে পড়েছে।
ঘুম আসছেনা। অনেকক্ষণ পর আনাসের হাত ধরে সে ঝাঁকুনি দেয়। আগের আলাপের অংশ ধরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,আচ্ছা, মানুষের বাচ্চা কীভাবে হয় রে? আনাস কিছুক্ষণ ভাবার ভাণ করে নিষিদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণের মতো স্বরে বলে, জামাই আর বউ নুনু লাগিয়ে বসে থাকলেই বাচ্চা হয়। মজিদের কল্পনায় দড়াম করে খুলে যায় বিস্ময় দরোজার আরেকটা পাল্লা। কী আজব তো।
আনাস বলে, জানিস, ছেলে ছেলেও কিন্তু করে। এখন মজিদের কেমন গা ঘিনঘিন করতে থাকে, আবার একটা আগ্রহ ও কেমন চুলকোতে থাকে। আনাস বলে, যার সাথে করবে তার প্যান্ট খুলে পাছুতে কালিজিরার তেল মাখাতে হবে। আর যে করবে তার নুনুতে। প্রথমে চাপ দিলে ব্যাথা লাগে, পিপড়ার কামড়ের মতোন, তারপর কেমন সুড়সুড়ি লাগতে থাকে।
— তুই এসব কীভাবে জানলি?
— আরে, ক্বারী সাহেব হুজুর তো আমারে এভাবেই করছিলো সেদিন রাতে...
মজিদের মাথায় সবটা ধরেনা। খালি মনে হতে থাকে, একটা খাঁচায় সে আটকা পড়ে গেছে, যার দেয়ালের অন্ধকারে হিংস্র বাঘের ছায়া।
৩.
মজিদ ছেলেটা, বড়লোক ঘরের ছেলে। ঘিয়ে মাখনে দামি উপাদানে গড়ে ওঠা শরীর, চেহারায় আভিজাত্য।মনটা খুব সরল, কল্পনাপ্রবণ, কোমল ফুলের মতো গা, কোনদিন কাঁটার আঁচড়টি পড়েনি।
রোজ হাশরের মাঠে নূরের মুকুট পরিধানের লোভে অন্ধ বাবা মা জানেনা এই ফুলকে ঘিরে নিষ্পেষণের সমস্ত আয়োজন ঘনিয়ে আসছে কোথাও।
ছেলেটা পড়া পারেনা। সারাদিন কোরান শরিফ পড়ানো হয় তাদের, ঢুলে ঢুলে সে মুখ নাড়ে, কিন্তু তার মাথায় কিছুই ঢোকেনা। অন্যেরা এক দুই পৃষ্ঠা করে মুখস্থ শোনায় দেখে তার অবাক লাগে। একজন জোয়ান হুজুরের গ্রুপে সে পড়ে। হেফজখানায় নতুন জয়েন করেছেন তিনি। বডি বিল্ডারদের মতো শরীর। প্রতিদিন ভোরে ব্যায়াম করেন ছাদে উঠে। রাতে একটা গ্লাসে ভিজিয়ে রাখেন কাঁচা বুট, কিশমিশ। সকালে খালি পেটে সেগুলো পানিসহ চিবিয়ে খান। যৌনশক্তি বাড়ার মহৌষধ। শরীরও সজীব থাকে। মাঝেমধ্যে কীসব কালো কালো হালুয়া এনে টেবিল চামচে করে চেটে চেটে খান। ছাত্রদেরকে গাধার মতো পেটাতে হলে যে শরীরে গাধার মতো বলও প্রয়োজন।
অদ্ভুত কী কারণে, হুজুরের শাস্তিপ্রদানের নানাবিধ প্রক্রিয়া, নতুন নতুন পদ্ধতিতে শাস্তিদানের নিরীক্ষা সব এসে পড়ে মজিদেরই ওপরে।
ভোরে, ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই পড়া মুখস্ত করে শুনিয়ে দেয়ার নিয়ম। মজিদ পারেনি। সকাল আটটা বেজে গেছে। এখনো মুখস্ত হয়নি।
হুজুর তাকে এখনো কোন শাস্তি দেয়নি, শুধু বলেছেন নামাজে রুকু যেভাবে করে, সেরকম ভঙ্গিতে থেকে পড়া মুখস্ত কর। মজিদ একটু স্বস্তি পায়। এ আর এমন কী। অন্য অন্য দিন তো সবক্ব না পাড়ার দায়ে এমনকি জানালার গ্রিলে তাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে পায়ের পাতায় মারা হয়েছে৷
হঠাৎ মজিদ টের পায় তার পিঠে একটা ভারি জিনিস রাখা হলো। অন্য ছাত্ররাও সবাই পড়া থামিয়ে দিয়ে ভয় ও কৌতুহল মিশ্রিত চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। একটা ভারি লোহার ট্রাংক মজিদের পিঠে চাপানো হলো। মজিদ পা শক্ত করে রইলো, দাঁত কিড়মিড় করে। তার কপালের দুইপাশের শিরা ফুলে উঠেছে চাপে। একটুপর আরেকটা লোহার ট্রাংক চাপানো হলো। দুটো ট্রাংক পিঠে নিয়ে রুকু করার মতো উবুড় হয়ে আছে একটা আট বছর বয়সী বাচ্চা। সমস্ত শরীরের রক্ত তার মুখে এসে জমা হয়ে গেছে, মাছের কানকোর মতো লাল। তারপর আরো তিনটে ট্রাংক একসাথে করে যখন হুজুর তার পিঠে চাপিয়ে দিলেন , মজিদের আর কিছু মনে থাকলো না। শুধু মনে হলো অসহ্য যাতনা থেকে বেরিয়ে সে একটা অন্ধকার ঘুমের মতো নিবিড় আরামের জায়গায় পৌছে যাচ্ছে।
এই কি আর শাস্তি, শাস্তি আরো অনেক বাকি ছিলো।
৪.
অগোছালো ছেলে মজিদ। উপস্থিত বুদ্ধি কম, ব্যবহারিক বুদ্ধিও। নিজের ট্রাংকটা গুছিয়ে রাখতে পারেনা।বাসায় তো নিজে পানিটাও নিজ হাতে খেতে হতো না।
ধোয়া ময়লা শুকনা ভেজা কাপড়ের স্তুপ জট পাকিয়ে থাকে। ট্রাংক খুললেই সেখানে তেলাপোকার হুলুস্থুল প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তিন মাস পরপর একটা ছুটি হয়, সাত আট দিনের। তখন বাসা থেকে ডিব্বায় করে এক প্যাকেট বিস্কুট তার ব্যাগে গুজে দিয়ে বাবা মা বাচ্চার তিনমাসের টিফিনের দায় সেরে ফেলেন। বড়ো আদরের ছেলে, প্রথম সন্তান কিনা, হাফেজ হচ্ছে। হাতে একটা টাকাও দিয়ে দেন না। বলে যেকোনো প্রয়োজন হলে বড়ো হুজুরকে বললেই তিনি কিনে দেবেন। তারা নিশ্চিন্ত। অথচ বাস্তবতা হলো, এত এত বাচ্চাকাচ্চা , হুজুরের কীসের ঠ্যাকা এত সবার আবদারে কান করা ? আর কারই বা এত সাহস যে প্রতিদিনের চকোলেটটা চিপসটা বিস্কুটটার জন্য রাশভারি আর কড়া মেজাজের ব্যস্ত বড়ো হুজুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়?
ওই ট্রাংকে রাখা বিস্কুটের ডিবেটা থেকে মাঝেমধ্যে বিস্কুট নিয়ে খাওয়া চলে, সপ্তা তিনেক যায় একঘেয়ে সে খাবারে, তারপর থেকে ক্ষুধা লাগলেও কিছু করার নেই। মাঝেমধ্যে সেই ডিবেটা বড়ো ভাইদের হাতে চলে গেলে তো আর রক্ষে!
এক ছুটির পর মাদ্রাসা খুলেছে। আবার খাঁচার দিন। বিষণ্ণ বিকেলবেলা। কী সহজ সরল এক মাটির ময়না এই মজিদ। তার ট্রাংকে বিস্কুট ভরা একটা ডিবে। সে ডিবেটা খুলেছে বসেছে সবে, অমনি কে এক বন্ধু কিছু একটা খেলার জন্য তাড়া দিলো। মজিদ হুটোপুটির মধ্যে বয়ামের মুখ না লাগিয়েই ট্রাংক বন্ধ করে চলে গেলে খেলতে। পরদিন বিকেলে আবার ট্রাংক খুলতে গিয়ে দেখে সব বিস্কুট নেতিয়ে গেছে, মুখে দিয়ে বিস্বাদে মুখ চোখ বিকৃত হয়ে গেলো। সে কী করে বুঝবে বয়ামে থাকা বিস্কুটের ধর্ম ও যত্ন! তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া দায়সারা একঘেয়ে টিফিনের দায়িত্ব শেষ হলো। আগামী তিনমাস বিকেলে তার খাওয়ার কিছুই থাকবেনা, ভাবতেই একটা অঝোর কান্নার গমক বুক থেকে উথলে উঠে গলায় এসে আটকে গেলো— মাগরিবের আজান পড়েছে। হুজুর বেত নিয়ে সবাইকে মসজিদে যাওয়ার জন্য তাড়া করছে। আরামে কাঁদতে বসার অবসরও নেই।
৫.
মজিদের মাথায় আরবি ভাষার কুরান শরিফ ঢোকেনা। এই বয়সে তার মুখস্ত হয় না কিছুই, হলেও মনে থাকেনা। কিছু না বুঝেই শব্দের পর শব্দ পঙক্তির পর পঙক্তি তার ক্রমবিকাশমান মগজে দেয়াল বেঁধে উঠতে পারেনা। আজও সে সবক শোনাতে পারেনি। এই নিয়ে পরপর তিনদিন সে সবক পারলো না। কিন্তু হুজুর তাকে কিচ্ছু বলছেনা। মিটিমিটি হেসে শুধু বলছে, যা আবার পড়ে আয়। মজিদ মনেমনে কেমন নিশ্চিন্ত বোধ করছে। হুজুরের মনে বুঝি দয়া হলো। ক্রমাগত ক্ষমার কারণে মনে মনে কিছুটা সুস্থ হতে থাকলো সে। আজও যখন সবক পারছেনা, এক আয়াতের পরের আয়াত কিছুতেই মনে আসছেনা , হুজুর অকস্মাৎ ঠেলে কুরান শরিফ সরিয়ে দিলেন। মজিদের কপালটা ডেস্কের সাথে ঠুসে দিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে করে বললেন, এরে আর কতো মারমু তোরা ক তো! তারপর মজিদের মুখটা নিজের উরুর মধ্যে চাপ দিয়ে পিঠে দড়াম করে একটা কিল পাড়লেন। হুজুরের পাজামার ঘামের বিশ্রী উৎকট গন্ধে মজিদের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। হুজুর ছেড়ে দিলেন তাকে। বললেন যাহ, এখানে বসে সূরা গাশিয়াটা মুখস্থ করতে থাক। একটুপর সকালের নাস্তার ছুটি হলে ছাত্ররা সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো। মজিদও যাচ্ছিলো, হুজুর তাকে ধরে বসালেন। বললেন, পড়া মুখস্ত না হলে কোন খাওয়া নাই। এক ছাত্রকে পাঠালেন মজিদের নাস্তাটা নিয়ে আসতে। পেটে ক্ষুধা, পড়ার ভাণ করে সে ঢুলছে, ঠোঁট নাড়াচ্ছে, আর আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে তার সামনেই রেখে দেওয়া প্লেটের হলুদ ভুনা খিচুড়ির দিকে। খাবার সামনে, হাত বাড়ালেই খেতে পারা যাবেনা, অথচ বাসায় সকালের নাস্তাটা আম্মু তাকে খাইয়ে দিতো, সে খেতে চাইতো না।
ছাত্ররা খেয়েদেয়ে আবার ক্লাসে বসলো। সকাল দশটা নাগাদ সময়। মজিদ এখনো মিনমিন করে পড়ছে। হুজুর তাকে বললেন, আয় সবক নিয়ে। হুজুরের সামনে কুরান শরীফ পাতা। মজিদ একটু তফাতে বসে মুখস্ত বলছে পড়া। হঠাৎ ভুলে গেলে, মগজের মধ্যে যেন কী পোকা নড়লো, মাথা পুরো শূন্য হয়ে পড়লো হঠাৎ। স্মরণশক্তিতে চাপ দিয়েও যখন আর একটা অক্ষরও মনে পড়ছেনা, সে মার থেকে বাঁচার জন্যে আড়চোখে কুরানের দিকে দেখে দেখে পড়া বলছিলো।
হুজুর সহসা ধরে ফেললেন, একটা চাপা উল্লাস তার চেহারায় ঝিকিয়ে উঠলো, খপ করে ধরলেন —কিরে চোরা! পড়া চোর! চুরি করে দেখে দেখে মুখস্ত বলিস! দাঁড়া, তুই যে পড়া পারোস না আর পড়া চুরি করিস এইটা আজকে তোর পাছার মধ্যে লাল কালি দিয়ে লিখে দিবো। তারপর মাদ্রাসার সাইনবোর্ডের পাশে তোরে ল্যাংটা করে ঝুলায় রাখবো। মানুষ যাইতে আসতে পড়া চোর দেখবে।
হুজুর তাকে টানতে টানতে একটা খালি কক্ষে নিয়ে ফেললো, মেঝেতে হুজুরের বিছানা পাতা। গেটটা সশব্দে লাগিয়ে আসলেন।
মজিদের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন , এই চোর পায়জামা খোল।
মজিদ হতভম্ব হয়ে গেলো, এইরকম অদ্ভুত শাস্তির ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা। হুজুর ধমকে উঠে আবার বললেন, পাজামা খোল হারামজাদা। একটা লাল কলম ডেস্ক থেকে বের করে বললেন, তোর পাছায় আজকে পড়া চোর লিখে দেব।
মজিদের ভেতরটা আবার কেমন উধাও হয়ে গেলো।
সে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। হুজুর আশ্চর্য রকম নীরব। কিছুই লিখছেনা তবে কিছু একটা যেন করছে। একটুপর মনে হলো যে তার পায়ুপথে পিচ্ছিল কিছু একটা পড়ছে। তারপর কিছু একটা আঙুলের মতো, আচমকা ওখানের রগে টান পড়ার অসহ্য ব্যাথা... আর কী আশ্চর্য, হুজুর তার পিঠের ওপর শুয়ে পড়ে এরকম হ্যাহ হা করছে কেন!
তারপর আবার জ্ঞানহারা, তার আর কিছু মনে নেই। অন্ধকার। মজিদ আর কিছু বলতেও চায়নি। তার সাথে এটা কী ঘটলো তার নিজেরই ঠাহর হচ্ছেনা। হুজুরও এখন তার ব্যাপারে অদ্ভুত রকম নীরব, শান্ত। তাকে এখন আর পড়াই জিজ্ঞেস করছেনা! ব্যাপার কী! আ@
একদিন কথাচ্ছলে, যেন খুব মজার দুষ্টমির কিছু ঘটেছে, দুই বড়ো বয়সী ছাত্রের কাছে বলে ফেললো ঘটনাটা।
তারা শিউরে উঠলো। চোখেমুখে উত্তপ্ত পুকুরের ভাপ। কেন তারা চমকালো কীইবা প্রতিক্রিয়া হলো, মজিদ কিছু বুঝলো না।
এরপর কিছুদিন মনে হলো মাদ্রাসা প্রশাসনে নীরবে একটা ঝড় বয়ে চলছে। শিক্ষকদের মধ্যে কানাঘুষা। লুকোচুরি। পড়াশোনায় ঢিমেতাল।
একদিন বিকেলে দেখা গেলো সেই হুজুর নতমুখে মাদ্রাসার গেট দিয়ে একটা স্যুটকেস নিয়ে ক্ষীপ্র গতি গটগট করে হেঁটে বেড়িয়ে যাচ্ছেন।
এরবেশি আর কিছু ঘটলো না। আবার সব আগের মতো সচল হলো। সব স্বাভাবিক।
সেবার গ্রীষ্মের বন্ধে মজিদ বাসায় গিয়ে আর মাদ্রাসায় ফিরতে চাইলো না। মেরে বকে ধাক্কিয়ে তাকে নেয়া যায়না আর।
আম্মু একদিন বলে, ঠিক আছে বাবা তোমায় আর তোমার মাদ্রাসায় যেতে হবেনা। আম্মুর সাথে ঘুমাও আজকে। সে নিজের বাসার খাটে আম্মুর পাশে প্রশান্তভমনে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে সে নিজেকে আবিষ্কার করলো মাদ্রাসায়, নিজের বেডে শুয়ে আছে, একটা আকাট বিভীষিকা মাকড়সার মতো কিলবিলিয়ে উঠলো তার মনে।
সিন্দাবাদের অচেনা সমুদ্দুর থেকে ভেদে আসা শঙখধনির হাওয়ার ঝাপটা এসে নাড়িয়ে গেলো সমস্ত বুক— এইপ্রথম সে, তার প্রাণের ভেতর একটা দ্রোহী ময়নাপাখির ছটফট ডানা ঝাপ্টানির আওয়াজ শুনলো। সে মুক্তি মুক্তি বলে কাকে যে ডাকে!
মাদ্রাসার লোহার কলাপসিবল গেট সবসময় বন্ধ, কড়া দারোয়ান গেটের সামনেই দাড়াতে দেয় না। পুরা বিল্ডিংয়ের আর কোথাও কোন বিন্দুমাত্র ফাঁকফোকর নেই। ছাদও বন্ধ। ছাত্র পলায় হেতু।
তিনতলার বারান্দার গ্রিল ধরে মজিদ দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে দেখা যায় শহর, কত গাড়িঘোড়া চলছে, মানুষজন হাঁটছে, একটা চড়ুই পাখি গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভেতরে এসে আবার বাইরে চলে গেলো, আহা, কী স্বাধীন... সবাই! এবার ছুটিতে বাসায় গিয়ে সে একশোটা কাগজের নৌকা বানিয়ে রেখে এসেছে। তার মনে হচ্ছে, এক রূপালি নদীর তীরে এখন সে এসে দাঁড়িয়েছে, ঘাটে সেই নৌকাগুলো বাঁধা। কাগজের নৌকারা মৃদু স্রোতে দুলছে, তাকে ডাকছে।
রডের গ্রিলের একপাশে একটা ছোট্ট দুইফিট বাই দুইফিট জানালা আছে, সেটা হাট করে খোলাই থাকে সবসময়। তার নীচেই দোতলার জানালার সানশেড, সানশেডের পাশে বাথরুমের লম্বা পাইপ একেবারে নেমে গেছে নীচতলায়, গেটের বাইরে। মজিদ অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো জানালাটার দিকে।
তার বিষাদগ্রস্হ মেঘময় চোখে তখন ঝিকমিকিয়ে উঠছে মহাজগতের রোদ।
৬.
মাদ্রাসার প্রধান ফটকের বাইরে সাদাকাপড়ে ঢাকা একটা খাটিয়া বিছানো। কয়েকজন সাদা পাঞ্জাবি জুব্বা টুপি পড়া মধ্যবয়সী মানুষ দাঁড়িয়ে খাটিয়াকে ঘিরে। ভবনের সব জানালা দিয়ে ছাত্ররা তাকিয়ে আছে এদিকে, বিষণ্ণ চোখে। একজন খাটিয়ার কাপড়টা আলতো করে সরাতেই একটা বাচ্চাছেলের মুখ বেরিয়ে এলো। ফুটফুটে, কী পরম তৃপ্তি ঠোঁটে ঝুলে আছে তার।
আজ শেষ রাতে মাদ্রাসার জনৈক ছাত্র পালাবার উদ্দেশ্যে বাথরুমের পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে তিনতলা থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে নিহত। পুলিশের লোক ডায়রি করতে এসে লিখলো।
ছাত্রটির বাবা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমার কোন আফসোস নেই, থানা পুলিশ আমি করবো না, আমার ছেলে এলম শিখতে এসে আল্লাহর রাস্তায় মারা গিয়েছে , এই পবিত্র মৃত্যুতে আমরা গর্বিত।
ঠিক তখন, অঝোর কান্নায় মাটিতে ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকলো আকাশ।
লেখক পরিচিতি
সালমান সাদ
জন্ম ১১ জানুয়ারি, ২০০০; পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা : ১২১৭।
পেশা : পাঠ, ধেয়ান, লেখালেখি।
লেখক পরিচিতি
সালমান সাদ
জন্ম ১১ জানুয়ারি, ২০০০; পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা : ১২১৭।
পেশা : পাঠ, ধেয়ান, লেখালেখি।
5 মন্তব্যসমূহ
ব্যাস্তবতা ফুটে উঠেছে....
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুনবাস্তবতা বানানটা ভুল হয়েছে। শব্দ থেকে বুঝে আসে আসলে এটা বাস্তবতা নয়। বাস্তবতা অন্য কিছু।
উত্তরমুছুনঅপ্রীতিকর কিছু ঘটনা ঘটে ।তাই বলে তা পত্রিকায় প্রকাশ করার মতো না। আসলে মূলত এটা বাস্তবতা না। সামান্য একটি ঘটনা দিয়ে একটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিচার পাওয়া যায় না।এটি বিচ্ছিন্ন একটা দুর্ঘটনা।
গল্পকে সংবাদ হিসেবে পড়ার কী দরকার
মুছুনগল্পটি পড়ে খুব বাজে মেসেজ পাওয়া যাচ্ছে হেফজখানা সম্পর্কে। ব্যাপারটা দুঃখজনক!! লেখকের প্রতি সমবেদনা মানবমনে এই বাজে ধারণা ছড়াবার জন্য! গভীর সমবেদনা...
উত্তরমুছুন