২০২০ সালের ২১ শে মে সকাল আটটা নয় বেজে আটান্ন সেকেন্ডে শেভ করার পর কাঁচি দিয়ে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চটজলদি নাকের লোম ছাঁটতে ছাঁটতে অয়ন আবিষ্কার করল তার ডানদিকের চে’ বাঁদিকের চোখটা ছোট।
কাঁচি নামিয়ে আয়নার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াল অয়ন। চোখে চোখ রেখে দাঁড়াল।
বাথরুমের ভেজানো দরজা ফাঁক করে বাইরের দিকে মুখ বের করে অয়ন ডাকল, “পায়েল… পায়েল…”
“কী…?” বহুদূরের ওপার হতে বার্তা আসে।
“আসবে একটু?”, বাথরুম আধা গমগম করে ওঠে।
পায়েল এসে পৌঁছোতে অয়ন তার দিকে ফিরে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকায়, বলে, “আমার চোখদুটো দেখ,”
“কী, কিছু পড়েছে?”
“না কিছু পড়েনি। ভালো করে দেখে বলো বাঁদিকের চোখটা অন্যরকম লাগছে কি না,”
পায়েল মন দিয়ে অয়নের বাঁচোখ দেখে, “কই একই তো...”
আরেকবার আয়নায় বাঁচোখটা দেখে নেয় অয়ন, “ঠিক করে দেখো,”
পায়েলের চোখ অয়নের এক চোখ থেকে অন্য চোখে ঘোরাফেরা করে। অয়ন অধৈর্য হয়ে ওঠে, “এত সময় লাগে?”
পায়েল বলে, “একটু লাল হয়েছে, তাই না?”
“ধুর…”, পায়েলকে বাথরুম থেকে বের করে দিয়ে অয়ন দরজা আটকে দেয়।
মিনিট ত্রিশ পর পায়েল বাসস্টপের দিকে চলে যেতে অয়ন একটু ছুটে একটা ট্রাম ধরে ফেলে। সিটের নিরাপত্তায় তার খেয়াল হয়, মোবাইল বের করে ফ্রন্ট ক্যামেরা মুখের সামনে তুলে ধরে অয়ন। চোখে চোখ রাখে। বাঁচোখ বেশ অনেকটাই ছোট ডানচোখের থেকে... কী করে এটা আগে নজর করেনি সে...
ফোনটা দূর থেকে একটু একটু করে কাছে আনে অয়ন। যত আনে চোখটা যেন ততই ছোট দেখায়। একটু পরে সে টের পায়, মুখ ভর্তি সাদাটে পুরোনো দাড়ি নিয়ে, ময়লা শার্ট আর পাজামা পরা কোলকাতা ট্রামের চেয়েও পুরোনো এক মানুষ ট্রামের যাবতীয় জান্তব আভাসের ভিতর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে অয়ন ধীরে ধীরে মোবাইলটা পাশে ফেলে রাখা ঝোলাব্যাগে চালান করে দেয়। কিছুক্ষণ পরে ট্রাম থেকে রাস্তায় পা রাখতে তার মনে হয়, “এতদিন তো নজরে পড়েনি... আজ কেন!”
লাইব্রেরীতে মানুষ বলতে গেলে প্রায় আসেই না। তবু গৃহপালিত পশুর ঘরে ফেরার মত করে মাসের শুরুতে একটা মাইনে অয়নের স্যালারি একাউন্টে এসে ভেড়ে তাই রোজ লাইব্রেরীর দরজা খুলে ভিতরের আলো জ্বালে অয়ন। বইদের কোনো এককালে বৃহৎ এক গাছজন্ম ছিলো বলেই হয়তো পৃথিবীর সব লাইব্রেরীর ভিতরটা অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা। অয়ন নিশ্চিত মরুভুমির মাঝেও যদি কোনো লাইব্রেরী তৈরি করা যায়, কিছু সময় বাদে সঙ্গত কারণে তা মরুদ্যানে পরিণত হবে। সিলিং ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে নিজের টেবিলে এসে বসে অয়ন। বাঁ দিকে তাকিয়ে টেবিলে রাখা লেনিনের ছবিকে গুণে গুণে তিনবার প্রণাম করে নিয়ে কম্পিউটার অন করে কাজে ডুব দেয়।
“শব্দের না থাকা মানে নৈঃশব্দ নয়। নিস্তব্ধতায় শব্দ আছে, ভীষণ ভাবে আছে,- চুপ করে আছে। তাই আমরা কিছু শুনতে পাচ্ছি না।”- শব্দদের অনুসরণ করে অয়ন দেখে, ট্রামে দেখা ট্রামের চেয়েও পুরোনো মানুষটা লাইব্রেরীর দরজায় দাঁড়িয়ে।
লোকটা বলে চলে, “লাইব্রেরী এমন জায়গা যেখানে সহস্র কোটি শব্দ আছে অথচ... সেখানে শব্দ করা বারণ।”
অয়ন হাসে, “ভিতরে আসুন,”
লোকটার জুতো খসখসে মেঝেতে আওয়াজ তোলে। অয়নের টেবিলের কাছে এসে সে বলে, “আমার উনি এই লাইব্রেরীর মেম্বার ছিলেন। উনিই জোর করে ধরে আনতেন। আমি নিজে বই পড়ি না। উনি বলতেন যেমন গাছের, তেমন বইয়ের সংস্পর্ষেও মানুষ শান্তি পায়।”
“না পড়েও?”
অয়নের প্রশ্নের জবাব দেয় মানুষটা, “না পড়েও। আচ্ছা পড়লে কতটা বোঝা যায়? ছুঁয়ে যতটা বোঝো, পড়ে কি তার চেয়ে বেশি বোঝো? বা শুধু পড়লে, না ছুঁলে, বেশি বোঝা যায়? মানুষ দেখো, পড়ো, কিন্তু ছোঁয়াচ যতটা ধারণা দেয়, ততটা অন্যকিছু দেয় কি?”
অয়ন কিছু বলতে পারে না।
“আমার উনি বলতেন, অন্ধজন সর্বজ্ঞানী”,- লোকটা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের ওপারে অয়নের মুখোমুখি বসে এদিক ওদিক তাকায়। তারপর বলে, “সত্যি বলতে আমি আজ অবধি কোনো বই পড়িনি।”
“স্কুলেও না?”
“আমি নিরক্ষর”
“ও,” একটু থেমে অয়ন ফের বলে, “যদিও আপনার কথা শুনে তা মনে হয় না”
“নিরক্ষর মানেই অশিক্ষিত নয়...”
অয়ন বলে, “আমি তা বলতে চাইনি।”
“জানি”, লোকটা আবার এদিক ওদিক দেখতে থাকে।
“তা কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?” অয়ন নিস্তব্ধতা ভাঙে।
লোকটা অল্প হাসে অয়নের দিকে তাকিয়ে, তারপর বলে, “আমার নাম অমুক বিশ্বাস”
“অমুক?...” অয়ন বিস্ময় লোকাতে পারে না।
“...ওই যে, আমি গোটাটাই নিরক্ষর। অক্ষর থেকে শব্দ হয়... মা বাপ আমার জন্য কোনো শব্দ ভাবতে পারেনি, বুড়ো আঙুলের ছাপই আমার নাম।”
“কিন্তু আপনার পদবী যে মারাত্মক অস্তিত্ববাদী...”, অয়ন হাসে।
“হ্যাঁ, যার কেউ নেই তার বিশ্বাস আছে, ভগবানে, আল্লায় বা লেনিনে”, অমুক বিশ্বাস অয়নের টেবিলের ছবির দিকে ইঙ্গিত করে হাসল।
“আচ্ছা...” হেসে ফেলে অয়ন, তারপর আবার বলে, “আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি,”
লোকটা আবার হাসে, বলে, “আমার স্ত্রী এই লাইব্রেরীর মেম্বার ছিলেন। আপনি তখনো এখানে চাকরি করেন না। ”
“আচ্ছা”, আবার স্তব্ধতা ভেঙে অয়ন বলে, “আপনি বললেন না, আপনাকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি...”
অমুক বিশ্বাস অয়নের দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে বলে, “আমি আপনাকে সাহায্য করতে এলাম।”
“কী বিষয়ে?” অয়নের ভ্রূ কুঁচকে ওঠে।
“আজ আপনার জীবনের এক বিশেষ দিন, আপনার চোখ খুলেছে আজকে,- এই বিষয়ে।”
অয়ন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অমুক বিশ্বাসের দিকে। তারপর বলে, “আপনি জানলেন কী করে?! আপনি কি ট্রাম থেকে আমায় ফলো করছেন!”
“ফলো করতে চাইনি। কিন্তু তারপর মনে হল আপনার সাহায্য প্রয়োজন, তাই এলাম, আমার বাড়ি এই লাইব্রেরীর পিছনের গলিতেই...”
অয়ন চুপ করে অমুক বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অমুক বিশ্বাস বলে, “পুরনো হলে বইয়ের মলাটের মত মানুষও ধূসর হয়, চুল ধূসর, চাহনি ধূসর, চামড়া কুঁচকে ধূসর হয়ে যায়। আমায় দেখলে এখন আপনার মনে হবে না, অথচ একদিন আমারও আপনার মত চোখটা হঠাৎ খুলে গেছিল, আমিও আপনার মত অবাক হয়েছিলাম। আর দেখতে পেয়েছিলাম...” অমুক বিশ্বাস চুপ হয়ে যায়।
“কী দেখেছিলেন? আপনার চোখ দুটো তো সমান...”
অমুক বিশ্বাস চুপ করে অয়নের দিকে চেয়ে থাকে। কিছু বলে না।
অয়ন বলে, “আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না...”
অমুক বিশ্বাস বলে, “মানুষের চোখ দুরকমের, একটা চোখ দেখার, আরেকটা চোখ মনের, সেটা দিয়েও দেখা যায় বটে, কিন্তু সেই দেখা আপনার- আমার দেখা নয়।”
অয়ন তাকিয়ে থাকে পুরোন মানুষটার দিকে।
অমুক বিশ্বাস বলে চলে, “আপনি ভাগ্যবান, আপনার চোখ জলদি খুলেছে, আপনাকে হিরোশিমা- নাগাসাকির জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি”
“হিরোশিমা- নাগাসাকি?!”
“হ্যাঁ, ৬ই আর ৯ই অগষ্ট, ১৯৪৫ সাল”
“হিরোশিমা আর নাগাসাকি দিবস...”
“ওই দুটো দিন লেগেছিল এই পৃথিবীর দুটো চোখ খুলতে।” একটু থেমে অমুক বিশ্বাস বলে, “প্রতিটা মানুষের একটা ব্যক্তিগত হিরোশিমা- নাগাসাকি দিবস থাকা প্রয়োজন, নয়তো... নয়তো চোখ খোলে না।”
অমুক বিশ্বাস হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ায়। বলে, “চলি।”
অয়নকে নিশ্চুপ রেখে অমুক বিশ্বাস লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে যায়।
২
দুপুর ৩টেয় লাইব্রেরী থেকে বিভ্রান্ত অয়ন বেরিয়ে আসে। রাস্তা দিয়ে মানুষ, কুকুর, গাড়ি আর ট্রাম যাচ্ছে। ট্রাম দেখলে বরাবর জীবনানন্দ দাশ মনে পড়ে। অয়ন ভাবে মানুষের সুর্য মনে পড়ে না, চন্দ্র মনে পড়ে না। অথচ এদের ছাড়া মানুষ মানুষ নয়। জীবনের বৃহৎ সবকিছু মানুষের অবচেতনের এককোণে পড়ে থাকে সারাদিন। আর রাতের বেলা সেসব নিজের দানবিক চেহারা নিয়ে মাথা খেতে আসে। কে খায় অয়নের মাথা? কী খায় অয়নের মাথা? অয়ন গতকালও নির্বিঘ্নে ঘুমোতে যেতে পেরেছে। অয়ন গতকাল অবধি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিলো। আজ অয়ন জানতে পেরেছে তার বাঁ চোখ তার ডানচোখের থেকে ছোট, অনেকখানি ছোট। এবং অয়নের চোখ খুলে গেছে।
অয়ন পায়েলকে ফোন করে।
“তুমি কখনো আমায় বলোনি, আমার বাঁ চোখটা এত ছোট...”
পায়েল চুপ করে থাকে। তারপর ফিসফিস করে বলে, “মানুষের ওরকম হয়, এতে বলার কিছু নেই”
“ফিসফিস করে কথা বলছো কেন?”
“একটা মিটিঙে আছি”
“আচ্ছা, তবু আমায় বলতে পারতে, রাখলাম।”
“দাঁড়াও...” আরো চাপা স্বরে পায়েল বলে, “আমার ডানদিকের বুকটা বাঁদিকের বুকের থেকে বড়, এটা আমরা দুজনেই জানি...”
“হ্যাঁ, এবং সেই কারণে আমার বেশি প্রিয়ও, এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি, অথচ তুমি আমায় আমার বাঁ চোখের ব্যাপারে কিছু জানাওনি”
“আমি ভাবতাম তুমি জানো...” ফিসফিস করে জবাব দেয় পায়েল, “মানুষের ওরকম হয়, ডানহাতিদের ডান হাত বাঁ হাতের চেয়ে বড় হয়, ডানহাতের নখ বাঁ হাতের নখের চেয়ে জলদি বাড়ে।”
অয়ন চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “সরি, মিটিঙের মধ্যে বিরক্ত করলাম”, ফোন রেখে একটা চলমান ট্রামে ছুটে উঠে আসে অয়ন। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাস খুঁজে দেখে, অমুক বিশ্বাস নেই।
কলকাতা সাপলুডোর ট্রামগুলো সব সাপ। জীবনানন্দ সেই সাপে কাটা পড়েছিলেন, কী ভাবে? কী ভাবে একজন কবি তলিয়ে যায় শব্দের অন্ধকারের ভিতরে? অয়ন ভাবে, ভাবতে থাকে। যেন এতদিন সে কিছুই ভাবেনি। ভাবতে পারেনি। এমন ভাবে একের পর এক ভাবনা, ভাবনার ঢেউ, ভাবনাসুনামি আছড়ে পড়ে অয়নের মাথায়। ভাবতে ভাবতে মাতালের মত টলে ওঠে অয়ন। কখন যেন ছোট বাঁচোখ সমেত টলতে টলতে সাপট্রামের পেট থেকে হেঁটে নেমে পড়ে সে। যখন হুশ ফেরে, ছোট বাঁচোখ দিয়ে সে দেখে শহরের সবচেয়ে পুরোন কবরখানার সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে।
পাঁচিলের ওপারে একের পর এক ঘুমিয়ে আছে মৃত মানুষেরা। কবরগুলো বাইরে থেকে দেখতে কেমন বইয়ের মত, চৌকো চৌকো। অয়নের করবখানাকে বিরাট এক লাইব্রেরী বলে মনে হয়,- ঘুমিয়ে আছে। আরেকটু ভাবার পর নিজের লাইব্রেরীটাকেও তার একটা কবরখানা বলে মনে হয়,- ঘুমিয়ে থাকে।
সমাধিক্ষেত্রের পাঁচিলের বাইরে রকে বসে অয়ন ছোট চোখটা দিয়ে ভাবতে থাকে। কী মনে হতে আবার ঝোলাব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে মুখের সামনে তুলে ধরে, তারপর বাঁ চোখটা আস্তে আস্তে বিস্ফারিত করে ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে দেখে। কিছুক্ষণ পর গোটা মুখটা বিকৃত দেখালে হাল ছেড়ে দেয় অয়ন। হঠাৎ মনে হয়... ঠান্ডাও তো লাগতে পারে?! ঠাণ্ডা লেগে অনেক সময় মানুষের চোখ ছোট হয়ে যায়। কিন্তু অয়ন জানে তার ঠাণ্ডা লাগেনি,- চোখ খুলে গেছে।
অয়নের খেয়াল হল, অমুক বিশ্বাস বলেছে, সব মানুষের একটা ব্যক্তিগত হিরোশিমা- নাগাসাকি দিবস থাকা প্রয়োজন। অমুক বিশ্বাসের আছে। অয়নের খুব ইচ্ছে করে অমুক বিশ্বাসের হিরোশিমা নাগাসাকি দিবস সম্পর্কে জানতে। অয়ন পায়েলকে আরেকবার ফোন করে,
“মিটিং হল?”
“হ্যাঁ, বলো”
“আজ ফিরতে রাত হবে আমার”
“কেন? কোথায় যাবে,”, পায়েল অবোক হয়।
“একজনের বাড়ি যেতে হবে, কাজ আছে,” গড়গড় করে বলে অয়ন।
“কার বাড়ি?”
“বিশ্বাসবাবু, লাইব্রেরীর কাছেই থাকেন,”
“অয়ন তুমি ঠিক আছো তো? শরীর ঠিক আছে?”
“কেন?”
“এমনি, শরীর খারাপ লাগলে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিও”
“আচ্ছা”
ফোন ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়ায় অয়ন। একটু হেঁটে ট্রাম ধরতে যাবে এমন সময় ডক্টর রায়ের চেম্বার চোখে পড়ে যায় তার। হেঁটে হেঁটে চেম্বারে চলে আসে অয়ন। পেশেন্টের ভিড় না থাকায় তাকে অপেক্ষা করতে হয় না।
“বলুন,”
“তেমন কিছু না, আজ সকালে খেয়াল করলাম আমার বাঁ চোখটা ডানচোখের থেকে বেশ ছোট”
“আচ্ছা, আপনার কি ঠাণ্ডা লেগেছে?”
“না,”
“দেখতে অসুবিধা হয় কোনো?”
“না”
“মাথা ব্যথা বা জল ঝরা এজাতীয় সমস্যা আছে?”
“তাও নেই”
“তবে?”
“মানে, কেন ছোট এটা জানতে ইচ্ছে হল”
“আচ্ছা, চোখটা কি জন্ম থেকেই এরকম?”
“কে জানে, আমি তো আজ সকালে খেয়াল করলাম এটা, আমার স্ত্রী যদিও আগে থেকেই জানে, তাই ধরে নেওয়া যায় আজন্মই চোখটা এমন।”
“আচ্ছা আজ সকালে কী মনে হল?”
“মনে হল একটা চোখ আরেকটা চোখের থেকে কতটা ছোট! কেমন বেখাপ্পা তাকিয়ে আছে,”
“আচ্ছা, আগে আপনার নিজের মুখ বেমানান লাগেনি কোনোদিন?”
“না তো...”
“তাহলে আজকে কেন, না কি এর আগে কোনোদিন নিজের দিকে তাকাননি, চোখে চোখ রেখে?”
অয়ন চুপ করে বসে থাকে।
ডক্টর রায় বলেন, “দেখুন সব প্রশ্নের তৎক্ষণাৎ জবাব আমরা সবসময় পাই না। আর এমনো তো হতে পারে, যে আপনার বাঁ চোখটা ছোট নয়,- ডানচোখটা আসলে বড়,- এভাবে ভেবে দেখেছেন কি?”
ডক্টর রায় ফিস নিলেন না। অয়ন বেরিয়ে এসে একটা ছিমছাম ট্রাম ধরে নেয়।
৩
“আপনিও কম্যুনিস্ট!?”, অয়ন যে ঘরে বসে আছে তার চার দেওয়ালে কম্যুনিস্ট পার্টির পোস্টার সাটানো। এমনকি সিলিঙয়েও পোস্টার। যেন পোস্টারের আড়ালে থেকে ঘরের বাসিন্দা বাইরের পৃথিবী থেকে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা করেছে। পোস্টারে পোস্টারে ঘরের দেওয়ালের রঙ লাল বলে মনে হচ্ছে।
অমুক বিশ্বাস জবাব দেয়, “একজীবনে ছিলাম, পোস্টারগুলো শীতকালে ঘরটা গরম রাখে, তাই আর সরাইনি।”
অয়ন ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে কোথাও কোনো মহিলার চিহ্ন পায় না, “আপনার স্ত্রী...?”
“সাত বছর আগে ট্রামে চাপা পড়ল...”
“জীবনানন্দের মত!...”
“হ্যাঁ, একমাত্র ওদের দুজনকেই আজ অবধি ট্রামে কেটেছে।”
অয়ন চুপ করে থাকে।
“চা খাবে?”
“না... আপনি কিছু মনে করবেন, যদি আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি?”
অমুক বিশ্বাস অল্প হাসে, “করো,”
অয়ন বলে, “আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে আপনার হিরোশিমা নাগাসাকি দিবসটা কেমন ছিল,”
অমুক বিশ্বাস কিছুক্ষণ অয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে আরম্ভ করল, “তখন উনি সদ্য মারা গেছেন, আমার বুকে টিবি। এই বিপ্লবের ঘরে পড়ে আছি দিন- রাত ঠিক নেই। গলির চায়ের দোকান থেকে সকাল সন্ধ্যে খাবার দিয়ে যায়। ওষুধ একদিন পড়ে, আরেকদিন নিজেই নিখোঁজ থাকি। তারপর একদিন রোদ এল। পায়ে পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম পাঁচিলের ওপরে একটা শামুক, ধীর লয়ে কোথাও চলেছে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী?”
অয়ন গুম হয়ে যায়।
অমুক বিশ্বাস বলে, “তুমি কি একটা বিস্ফোরণ আশা করেছিলে?”
কাঁধ ঝাকিয়ে অয়ন বলে, “বোধ হয়, কিন্তু এতে আপনার চোখ খুলল কি করে বুঝলাম না।”
অমুক বিশ্বাস বলে, “শামুকটাকে দেখে আমার মনে পড়ল আমার স্ত্রী আমায় একবার বলেছিল,- কবি বলেছেন,- This is the way the world ends. Not with a bang but a whimper”
ঘরে পোস্টারগুলো ছাড়া আর কোনো সোচ্চার নেই। দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যাচ্ছে না।
অয়ন বলে, “আজ উঠি,”
অমুক বিশ্বাস বলে, “একটু বসে যাও, গলির দোকানটা দারুণ রুটি মাংস করে, দুটো বলেছি আমাদের জন্য।”
রাত এগারোটায় ঘরে ফেরে অয়ন। দেখে পায়েল ঘুমিয়ে পড়েছে। জামা প্যান্ট ছেড়ে বিছানায় এসে একহাতে পায়েলের কোমর জড়িয়ে সে তাকে কাছে টেনে নেয়। হিরোশিমা নাগাসাকি দিবসের শেষে অয়নের চোখে বুজে আসছে। পৃথিবীর সুখীতম মানুষের মত বিছানায় শুতেই আবার তার চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে। ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে অয়ন বুঝতে পারে চোখদুটো একবার বুজে ফেললে বাইরে থেকে কোনটা ছোট কোনটা বড় আর বোঝা যাবে না।
অলোকপর্ণা
কোলকাতায় জন্ম। এই মুহূর্তে বাস ব্যাঙ্গালোরে। পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। প্রকাশিত বই- ঝিঁঝিরা (২০১৫), হাওয়াশহরের উপকথা (২০১৮), দাস্তানগো (২০১৯) এবং রণ বিশ্বাস কারো নাম নয় (২০১৯)।
2 মন্তব্যসমূহ
ভালো লাগলো গল্পটি।
উত্তরমুছুনএকটা এপিফ্যানি থেকে আর একটার দিকে এগিয়ে যাওয়া এই মুহূর্তটুকুই সত্য।
আর কিছু নয়।
ধন্যবাদ
মুছুন-অলোকপর্ণা