আটটি ছোটো গল্প: আহমেদ খান হীরক

১. দাম.

পাঁচ কেজি সাইজের পলিব্যাগের এক কেজির দাম ২০০ টাকা। আমি ১০০ টাকায় আধা কেজি নিয়ে ফিরছিলাম। ময়লা রাখার কাজে ব্যবহার করতে হয়। এরই মাঝে বৃষ্টি নামল। আমরা অনেক জন মিলে রাস্তার পাশের গ্যারাজে আশ্রয় নিলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন বলল, ভাই ১০ টাকা দিচ্ছি, একটা পলি দেন... আমি ইতস্তত করতে থাকলাম। লোকটা হাতে টাকা গুঁজে পলি নিয়ে মাথায় দিয়ে গেল গা। এরপর ভিড় লেগে গেল। সবাই পলি চায়--প্রথমে ১০ টাকায়, পরে ১৫, একটু পরেই ২০ টাকায়..

আধা কেজি ওজনে অনেক পলি ধরে। আমার পকেট উপচে এসেছে। পলি বাকি আছে একটা। লোক আমিসহ আরো একজন... লোকটা ৫০ টাকা হাঁকালে শেষ পলিটা দিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়।

বৃষ্টি হচ্ছে। মাথা ভিজে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা টাকাগুলো ভিজে যাচ্ছে। একটা পলি থাকলে ভালো হতো। কিন্তু পলির যা দাম...৫০ টাকা!


২. সম্রাট.

কেএফসিতে বাবা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন। কাউন্টারে গিয়ে বললেন, এই চিকেনগুলোর দাম কত? সেলসম্যান দাম বলতেই বাবা একবার পকেটে হাত দিয়ে মাথা নাড়ালেন। যেন একটু হিসেবই করে নিলেন। তারপর করলেন সেই অদ্ভুত অনুরোধ--আপনারা কি ডিসপ্লেতে একটা চিকেন রাখতে পারেন? এই পাঁচ মিনিটের জন্য? না না তিনটা মিনিটের জন্য? 

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাবা বেরিয়ে গেলেন। চার বছরের মেয়েটাকে নিয়ে বাবা যখন ফিরলেন তখন কিন্তু তত আর হন্তদন্ত নন তিনি। যেন নিজের রাজকন্যা নিয়ে রাজ্য ঘুরতে বেরিয়েছেন।

ডিসপ্লের সামনে গিয়ে দেখলেন একটাই চিকেন রাখা। বাবা হেসে পকেট থেকে টাকা বের করলেন। যা বের করলেন তার পুরোটাই দিয়ে দিলেন চিকেনটা কিনতে গিয়ে। মেয়েটা বলল, বাবা, তুমি খাবে না?
বাবা বললেন, আর তো চিকেনই নাই রে, আমি আর তুই এক সাথে আরেক দিন!

মেয়েটি চিকেনে কামড় দিলো। মুখে হাসি ফুটল তার। শূন্য ডিসপ্লের দিকে বাবা একবার কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে নিলেন। তারপর বেরিয়ে এলেন রাজকন্যাকে নিয়ে। বেরোনোর সময় অবশ্য বাবাকেও সম্রাটের মতোই মনে হচ্ছিল, বিজয়ী সম্রাট!


৩. মন্টুর ঈদ.

প্রত্যেক ঈদেই মন্টুর অন্য রকম খুশি। ঈদের দিন সকালে নামাজে যাওয়ার আগে মা তাকে বিশ টাকা দেয়। কড়কড়ে নোট। মা যে বাড়িতে কাজ করে সেই বাড়ির মালকিন মাকে কয়েকটা কড়কড়া নোট দেয়। যেদিন দেয়, মন্টু দেখেই বোঝে, মায়ের নাকফুল সেদিন বেশি ঝিলিক দেয়। 
নামাজ শেষে ফিরতি পথে বাজান দেয় দশ টাকা। দিয়ে বলে, যা, খরচা করগা!
মন্টুর সাড়ে নয় বছরের বুক হঠাৎই যুবকের মতো হয়ে যায়। পানি দিয়ে চুল উলটে নেয়। পকেটে হাত দিয়ে তিন বছর আগের ছোট হয়ে আসা পাঞ্জাবিটা উড়িয়ে সে বের হয়। 

তিরিশ টাকা তার, পুরা তিরিশ টাকা।

ঈদে মন্টুর বাঁধা হিসাব। 

পাঁচ টাকার সন পাঁপড়ি। এমন টেস্ট, উফ!

দশ টাকার গোলা বরফ। রঙিন রঙিন বরফে জাদু জাদু সুয়াদ।

আর থাকে পনের টাকা, তাতে সে শাকিব খানের সিনেমা দেখে। ইয়ালি ভিসুম। শাকিব খান যখন চুল ওল্টায় তখন মন্টুও চুল ওল্টায়। 

সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। ঈদ শেষ হয় তার। সব ঈদ একই রকম আনন্দে শেষ হয়। ঘুমের ভেতর শাকিব খানের সাথে গান গায় ঘাড় বাঁকা করে।

মায়ের দেয়া কড়কড়া বিশ টাকা পকেটে গুঁজে মন্টু নামাজের জন্য বেরিয়েছে। সন পাঁপড়ি খাবে এ খুশিতে এখনই মুখে হাসি আসি আসি করছে। মিজান্যাকে ডেকে নিয়ে খাবে নাকি একলা খাবে এরকম সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে মন্টু দেখে একটা কড়কড়া নোট। রাস্তায়। পাঁচশ টাকার। পড়ে আছে রাস্তায়।

মন্টু চট করে টাকাটা উঠিয়ে নেয়। বুকটা প্রথমে ধড়াস করে উঠলেও এখন শুধু ঢিবঢিব করছে। তার পকেটে পাঁচশ টাকা। পাঁচশ! সত্যিই কি পাঁচশ?

মন্টু মিজান্যাকে ডাকতে যায় না। চলে যায় ঝিলের একপাশে। লুকিয়ে টাকাটা বের করে। না, পাঁচশ!

পাঁচশ!!

বিশ্বাস হয় না মন্টুর। মন্টু ঝিলের পাশে কতকক্ষণ বসে থাকে। তারপর উঠে যায়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে। অকারণে ঢুকিয়ে রাখে। টাকাটা তার হাত স্পর্শ করে থাকলে মন্টুর ভালো লাগে।

মিজান্যা ডাকে, মন্টু শোনে না। মন্টু চলে যায়।

মন্টু চলে যায়, কোথায় যায় জানে না।

মন্টুর সন পাপড়ি খাওয়া হয় না। মন্টু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে।

মন্টুর গোলা বরফ খাওয়া হয় না। মন্টু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে।

মন্টুর সিনেমা দেখা হয় না। মন্টু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে।

সারাটা ঈদ মন্টু একলা একলা ঘোরে। মন্টু পকেট থেকে হাত বের করে না। মন্টুর কিছু করাই হয়ে ওঠে না ঈদে।

সন্ধ্যায় চোরের মতো ঘরে ফেরে। মায়ের দিকে তাকাতে পারে না, বাবার দিকেও তাকায় না। মন্টু শুয়ে যায়। সে স্বপ্ন দেখে হাজার হাজার কড়কড়া পাঁচশ টাকা সে রাস্তায় পড়ে পেয়েছে। সবগুলো নোট সে পকেটে ভরছে হাতড়ে পাতড়ে। নোট আর নোট। কড়কড়া নোট। কড়কড়া নোট।

একটা এমন ঈদ মন্টুর পার হয়ে যায় ঘুম, ঘোর আর স্বপ্নের ভেতর। এমন ঈদ, যে ঈদে মন্টু প্রথম, কোনো আনন্দ পায় না। মন্টু বুঝতে পারে না, নয় বছর বয়সেই মন্টু, তার শৈশব হারিয়ে ফেলেছে এই ঈদে।

আর একবার শৈশব হারিয়ে ফেললে, মানুষের আর কোনোদিনই, ঈদ ফিরে আসে না।


৪. ভাগ্য.

ওরা তিনজন। বাবা, মেয়ে আর টিয়া। বাবার নাম জ্যোতিষশ্রেষ্ঠ মতি মিয়া। পিচ্চি মেয়েটার নাম পরী। অন্য একটা নাম তার মা রেখেছিল। মরে যাওয়ার পর ওই নামে আর কেউ ডাকে নাই। ছয় বছরের পরী টিয়াটার নাম দিয়েছে জরি। পরীর টিয়া জরি। জরি দারুণ কাজ করে। বাবার হয়ে সেই ভাগ্য গণনা করে দেয়। একটা একটা খাম উঠিয়ে দিলে বাবা সেই ভাগ্য বলে লোকজনদের।

পরী বলে, বাপজান, ভাগ্য সত্যই আছে?
বাবা বলে, আছে না আবার! মাইনষের হাতে যা নাই তাই ভাইগ্য!
পরী বলে, খালি আমগো ভাইগ্য জরির হাতে আছে, না?

বাবা হাসতে চায়, কিন্তু হাসতে পারে না। হাসির মতো অবস্থা তাদের নেই। ধানমণ্ডি লেকে তিন দিন কাটিয়েছে। লোকজন কেউ আসে না। দূর থেকে দেখে শুধু। হাসাহাসি করে। ভাগ্যের ওপর মানুষের বোধহয় আর বিশ্বাস নাই।

পরী বলে, অরা হাসে ক্যান বাপজান?
বাবা বলে, ভাগ্যের দোষে হাসে রে মা।
পরী বলে, কার ভাইগ্য?

বাবা উত্তর করে না। টিয়াটা ট্যা ট্যা করে। খাবার চায়। নিজেদের পেটেই কিছু নাই, টিয়াকে দেবে কী!

বনানী পার্কে একটা ভাগ্যবিড়ম্বিত লোক পায় তারা। কবে কানাডা যেতে পারবে জানতে চায়। টিয়া একটা খাম তোলে। খামে লেখা আপনার সুখ আসন্ন। লোকটা গালাগাল দিয়ে চলে যায়। সুখের ওপর মানুষ এত ক্ষিপ্ত ক্যান কে জানে?
সন্ধ্যার দিকে আরেকজন আসে। ভাগ্য জানতে না। চাঁদা ওঠাতে। শেষ ছাব্বিশ টাকা নিয়ে যায়। টিয়াটা ট্যা ট্যা করে।

পরী বলে, জরির খিদা লাগছে...
বাবা নিরুত্তর। 
পরী বলে, কাইল মেলা টাকা হইব না বাপজান? কাইল বেবাক শহরের ভাগ্য আমরা কমু, না বাপজান?
বাবা নিরুত্তর।
পরী বলে, কাইল মুগরি দিয়া ভাত খামু, না বাপজান?
বাবা নিরুত্তর।
পরী বলে, কাইল মেলা ভাত খামু, না বাপজান?
বাবা নিরুত্তর।

দিন বদলে যায়, কিন্তু দিন বদলায় না। ঢাকা ঘুরে ঘুরে শেষ হয়ে যায়। ঢাকা বদলায় না। পরী ঘুমের মধ্যে মুগরি মুগরি ভাত ভাত করে। টিয়াটা ট্যা ট্যা করে। টিয়াটা খিদায় কাঁদে।

পরের সকালে বাবা মুরগি খাওয়ায় পরীকে। পরী আরাম করে খায়। মুগরি পোড়া বড় মজা! এমন মজা কত দিন খায় নাই। খেয়ে তারা মানুষের ভাগ্য গুণতে বের হয়।

পরী বলে, জরি কই বাপজান?
বাবা বলে, উইড়া গেছে! এখন থেইকা তুই খাম তুলবি!

পরী মাথা নাড়ায়। তারপর হঠাৎ করেই বলে, এইবারও যদি লোক না আসে তাইলে কি আমিও উইড়া যাবো বাপজান?

জ্যোতিষশ্রেষ্ঠ মতি মিয়া কথা বলে না। আজকাল তার কথা বলতে ভালো লাগে না।


৫. এক্সট্রা.

সিনটা সিম্পল। মিজানুর পোলাও খাচ্ছে। পোলাও খেতে গিয়ে সে থমকে যাবে। একবার বউয়ের দিকে তাকাবে। তারপর বলবে, এইটা কী পোলাও রানছ? এত ত্যাল!

তবে ডিরেক্টর 'এত ত্যাল' ডায়লগটা বাদ দিয়েছেন। মিজানুর এক্সট্রা আর্টিস্ট। এত বড় সংলাপ সে দিতে পারবে না। ডিরেক্টর বলেছেন, তুমি শুধু বলবা, এইটা কী রানছ! তারপর খাবার রেখে উঠে চলে যাবা। বুঝছ না?

মিজানুর মাথা নাড়িয়েছে। এই শটটার পর একটা পাসিং আছে তার। হিরো হিরোইন গল্প করছে, সে পাশ দিয়ে চলে যাবে। তাহলেই তার আজকের কাজ শেষ। কিন্তু কাজ শেষ হলেও রাত পর্যন্ত স্পটে থাকতে হবে। প্যাকআপ না হলে টাকা পাওয়া যাবে না। টাকা বেশি না। ম্যানেজারের ভাগ কাটলে আড়াই শ।

ডিরেক্টর বলেন, অ্যাকশন!

মিজানুর পোলাও মুখে তুলে নিয়ে কী করতে হবে ভুলে যায়। খেয়ে ফেলে। ডিরেক্টর বলেন, কাট কাট! খাবা না। মুখে রাখো, তারপর ফেলে দাও...থু!... রোল ক্যামেরা এন্ড অ্যাকশন!

মিজানুর পোলাও মুখে তোলে এবং কী করতে হবে আবার ভুলে যায়। পোলাও খেয়ে ফেলে। রাগের বদলে তার চোখে পানি চলে আসে। ডিরেক্টরও অদ্ভুত। কাট বলেন না। মিজানুর পোলাও খেতে থাকে। খেতে খেতে বলে, খাইতে খুব টেস হইছে!


৬. লেখক.

বৃষ্টিতে আটকা পড়ে আছি। অত্যন্ত উশখুশ মুহূর্ত। উশখুশের কারণ সিগারেট। রক্ত নিকোটিন চায়। তার ওপর এমন বেহায়া বাতাবরণ। কোণার দিকে দেখলাম এক মাল্টিন্যাশনাল সিগারেট ধরাল। তামাকের গন্ধ। ভেজা। আহারে!

না পেরে পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাল্টিন্যাশনাল তীর্যক তাকিয়ে আবার সিগারেটে টান দিলো। বছর দশেক আগে হলেও দুজনের কেউ একজন বলে উঠতাম--কী বৃষ্টি, দেখেন তো!
এখন বলা গেল না। মানুষের মাঝে এখন সন্দেহের নদী, ফেসবুকের সাগর। আমরা সবাই তার মধ্যে আত্মমগ্ন।

কিন্তু, নিকোটিন? তার কী হবে?

মাল্টিন্যাশনালের সিগারেটটা প্রায় শেষ। উপায়ন্তর না দেখে বললাম, আরেকটা আছে নাকি?
মাল্টিন্যাশনাল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। আমার নাকে ধোঁয়া।
মাল্টিন্যাশনাল বলল, হবে।
প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো। আমি একটা নিয়ে ফেরত দিলাম প্যাকেটটা।
বলল, কী করেন?
বললাম, লিখি।
: মানে লেখক?
: বলা যায়।
: কী নাম?
নাম বললাম। তার মুখে অপরাধীর ছায়া। বলল, শুনি নি কখনো।
: কথাও না। আমি পরিচিত কেউ না।
: আমাকে নিয়ে লিখবেন কখনো?

আমি সিগারেটের দিকে তাকিয়ে একটা টান দিয়ে বললাম, না।


৭. অফার.

গত তিন দিন থেকে আব্দুল আজিজের শরীরটা ভালো নেই। আশি ছুঁইছুঁই বয়সে শরীর নিয়ে আশাও বেশি নেই অবশ্য; তবে জীবন নিয়ে আছে। ছোট মেয়েটার বিয়ে দিতে না পারলে ওর মা নিশ্চয়ই ওপারে খুব বকাঝকা করবেন। মহিলার বকাঝকা খাওয়া হয় না তাও প্রায় নয় বছর। মানুষজন স্ত্রীর বকাঝকা কখনো মিস করতে পারে আব্দুল আজিজের ধারণারও বাইরে ছিল। বয়স তাকে কত কিছু দেখাচ্ছে।

মিতু কল সেন্টারে কাজ করে। লাঞ্চ শেষে কল করে বাবার খাওয়া হয়েছে কিনা খোঁজ নেয়। আব্দুল আজিজ রাগারাগি করেন বিষয়টাতে। কাজের সময় এসব কী! মিতু বলে, কাজের সময় তো না আব্বু, এখন লাঞ্চব্রেক... তুমি মিষ্টি খাইছ নাকি?
: না তো। মাথা খারাপ! আমার না ডায়বেটিস...
: মিষ্টি সপ্তাহে একটা, মনে থাকে যেন!
: ফেরার সময় কাচকি নিয়া ফিরব। তোমার না প্রিয়!
: প্রিয়ই তো। ফিরিস। কিন্তু যে দাম...
: সামনে মাস থেকে স্যালারি বাড়বে আব্বু, অত চিন্তা কইরো না তো!

মিতু চিন্তা করতে নিষেধ করে। কিন্তু আব্দুল আজিজের চিন্তা হয়। চিন্তা হতে হতেই শরীর খারাপ করে। তিনি চলে গেলে মিতু একা, এমনকি মিতু চলে গেলেও তিনি একা। মিতুর ভাইবোনেরা কে কোথায় আছে আব্দুল আজিজ এখন ঠিক করে ঠাহরও করতে পারেন না। মেজোটা অস্ট্রেলিয়া থেকে নিউজিল্যান্ড শিফট হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে কিনা কে জানে!

আব্দুল আজিজের ঘাড়ব্যথাটা তীব্র হতে থাকে। কপাল ঘামছে অনেকক্ষণ থেকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মিতু বলেছে সামনে মাসেই তাকে নিয়ে ভালো ডাক্তারের কাজে যাবে! পুরনো ডাক্তার নাকি কিছু বোঝেই না। আব্দুল আজিজ হাসির মতো করেন। ওই ডাক্তারের অসুধই তো খাচ্ছেন। রাতে একটা, সকালে একটা। সকালের অসুধটা খেয়েছেন। ডাক্তার বলেছিল হঠাৎ শরীর খারাপ হলে যেন ইমার্জেন্সি অসুধ খেয়ে নেয়। সকালের পাতাটা শেষ হয়ে গেছে। অব্য একটা পাতা থাকার কথা। এ ঘরেই থাকার কথা। কিন্তু আব্দুল আজিজ খুঁযে পাচ্ছেন না। মিতু থাকলে এক ঝলকে পেয়ে যেত। বমি বমি লাগছে আব্দুল আজিজের। মিতুকে ফোন দেয়া দরকার। আব্দুল আজিজ ফোন ওঠালেন। দ্বিধান্বিত তিনি। এই অসময়ে ফোন করা কি ঠিক হবে? হাত ঘামাচ্ছে আব্দুল আজিজের। চোখের দৃষ্টিও কি ঝাপসা হয়ে আসছে?

ডায়াল করতে নেন আব্দুল আজিজ। কিন্তু তার আগেই একটা অদ্ভুত নাম্বার থেকে আসে। আব্দুল আজিজ সেটা কাটতে গিয়ে রিসিভ করে ফেলেন।

প্রিয় গ্রাহক, আসসালামুয়ালাইকুম। আমরা নিয়ে এসেছি আপনার জন্য দুর্দান্ত প্যাকেজ অফার। মাত্র তিন শ পনের টাকায় আপনি পাচ্ছেন এক জোড়া হাতি। কিন্তু এখানেই অফারটা শেষ না। আমরা আপনাকে সবসময়ই বেশি দিতে প্রস্তুত। তিন শ পনের টাকার সাথে মাত্র উনপঞ্চাশ টাকা রিচার্জ করলেই এক মাস ধরে পাচ্ছেন কলাগাছ। আপনার হাতি আপনার কলাগাছ। এক সাথে এই প্যাকেজ পেতে আপনার ফোনের ডায়াল অপশনে গিয়ে ডায়াল করুন স্টার নাইন জিরো জিরো স্টার ওয়ান হ্যাশ...
প্রিয় গ্রাহক, আসসালামু আলাইকুম...

আব্দুল আজিজ চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। মোবাইলে অফার বেজেই চলল। আব্দুল আজিজের মনে হলো তিনি মিতুর কণ্ঠ শুনছেন। মিতুই তাকে বারবার সালাম দিয়ে একটা প্যাকেজ অফার শুনিয়ে যাচ্ছে। আব্দুল আজিজের মনে হলো মিতুর রেকোর্ডেড কণ্ঠ একদম তার মায়ের মতো। মায়ের মতো মেয়েটা যদি একটু-আধটু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত...


৮. ফেক আইডি.

প্রোফাইল দেখেই বোঝা যায় আইডিটি ফেক। কী যে উল্টাপাল্টা লেখা আছে তার ভেতর। আর নামটা কী বাহারি--নীল অপরাজিতা। থ্রিডি কোনো এক অ্যানিমেশনের মুখ তাতে। মুখটা সুন্দর অবশ্য। সুন্দর। বেশ সুন্দর। তাই কথা হয় আমাদের। ছোট ছোট শব্দে। ম্যাসেঞ্জারে। নিজেদের কথা লিখি। লিখি কী কী ভাল্লাগে না আর! লিখি চলে যাবো গ্রামে। লিখি বেতন আটকে আছে অফিসে।

একদিন ফোন হয়—ম্যাসেঞ্জারে। ওপারে পুরুষ কণ্ঠ। ওপারে ফিসফিস ভীতি। আমি ফোন রেখে দিই—জানি, জানতাম, তবু কষ্ট হয়।

আমি অন্য আইডিতে ঘুরি। আসল আসল আইডিতে ঘুরি। সবকেই ফেক মনে হয়। প্রতিটা প্রোফাইলে মনে হয় মুখোশ সাঁটা। আমি কাউকেই আর কল দিই না।

আমি অনেক দিন নিঃসঙ্গ ঘুমাই। তারপর এক দিন কল দিই ম্যাসেঞ্জারে। বলি, চলো দেখা করি নীল!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. ছোট গল্প হলেও প্রতিটি লেখাই পাঠকদের কাছে ভাল লাগবে। সবগুলো গল্পই দারুণ লেগেছে আমার। আহমেদ খান হীরক তোর কাছে জাতীর প্রত্যাশা অনেক বেশী তাই আরো বেশি করে লিখালিখি চালিয়ে যাও বন্ধু। শুভেচছান্তে মাকারিম

    উত্তরমুছুন
  2. সব গল্প গুলোই মন ছুঁয়ে গেল না

    উত্তরমুছুন