সাজ্জাদ আলী'র গল্প : গোরস্থানে প্রহর গণনা!

সেদিন পিকারিং গোরস্থানে গিয়েছিলাম। টরন্টো শহরের নিকটস্থ এই শেষ ঠিকানায় আমাদের ঈশিতার বাবা শায়িত। আমার অনুরোধেই ওরা আমাকে সাথে নিয়েছিলেন। স্থানটির ঠিকানা ৫৪১ ট্যানটন রোড। এই স্ট্রীট এড্রেসটির মস্ত পরিসরে ইতিমধ্যেই সহস্রজনের অন্তিম ঠিকানা নির্ণীত হয়েছে। আরো অযুতজন যেন অপেক্ষায় আছেন এখানটায় পৌঁছুতে। সমাধিক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ রাস্তা দিয়ে দক্ষ হাতে গাড়ী চালাচ্ছেন ঈশিতার প্রিয়জন শামস্। দুপাশে সারি সারি গোর, মাঝে মাঝে বৃক্ষ, খানিক বাদে বাদেই বেঞ্চি পাতা। চারিদিকের সুনসান নীরবতার মধ্যে আমাদের গাড়ীখানির ইঞ্চিনের শব্দ যেন অবিবেচকের মতো সবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলো। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সমাধি আর সমাধি। বাউন্ডারির ভেতরের রাস্তাঘাট, হাঁটবার পথ থেকে শুরু করে বৃহদায়তনের এই সমাধি-ময়দান একেবারে ঝকঝকে তকতকে। কোথাও একটি গাছের পাতাও পড়ে নেই, শতভাগ পরিচ্ছন্ন। অনিন্দ্য স্বস্তির অবলোকন চারিদিকে।

রাস্তার পার্শ্বে গাড়ী দাঁড় করিয়ে শামস্ বললেন, নামুন। কবরটা এদিকটায় কোথাও হবে, আঙ্গুল উচিয়ে উত্তরের দিকটা দেখালো। আমি কখনও এ ধরণের পরিকল্পিত কবরস্থানে যাইনি। এ সম্পর্কে আমার দৌঁড় দাদীবাড়ীর “ঘুনার ভিটা” পর্যন্তই। ওটি আমাদের পারিবারিক কবরস্থান। বাড়ীর পশ্চিম-উত্তর কোণ লাগোয়া সে ভিটাটি সব সময়ই আমাদের কাছে ভয়ের আধার ছিলো। শৈশব, কৈশোরে রাতে ভিটাটার দিকে চোখ পড়লেই চমকে উঠতাম। এমন ভয় ধরে যাবার কারণও অবশ্য ছিলো। এক বছর ভরাভাদ্রে কলেরায় মৃত আমাদের বৃহত্তর পরিবারের এক কনিষ্ঠ সদস্যকে ওই ভিটার আধোডোবা জলে কবর খুঁড়ে দাফন করতে হয়েছিলো। পরের রাতেই গাঁয়ের শেয়াল-কুকুরেরা পানি ডোবা কবর থেকে সেই মৃত শিশুটির দেহ তুলে খাবলে খাবলে খেয়েছিলো। কি বিভৎস সে দৃশ্য! সেই থেকে কবরস্থান নিয়ে এক ধরণের ‘ডর’ আমার মধ্যে কাজ করে।

কিন্তু সেদিন পিকারিং কবরস্থানটিতে গিয়ে একদমই ভয় লাগেনি। বরং জায়গাটি আপন আপন লেগেছে। অন্তরের অন্তস্থলে কেমনতর যেন একটা স্বস্তিকর সুবাতাস বইছিলো। হঠাৎই যেন উপলব্ধি হয়েছিলো যে, বসন্তে বিকশিত প্রতিটি পাতাকেই তো হেমন্তে ঝরতে হয়। তাহলে ঝরে পড়ার জন্য প্রস্তুত থাকাইতো ভাল। সেদিন যেন এমন সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছিলাম যে, আমি এক অমরাত্মা, এই নশ্বর শরীরের মধ্যে কিছু কাল দোল খেলাম। এর পরে হয়তো অন্য কোন অজানা গন্তব্যের নতুন দোলনার দিকে ছুটবো।

ঈশিতার ছেলেমেয়ে দুটো ছুটোছুটি করে কবরগুলোর উপরে লিখিত ফলকে ওদের নানার নামটি খুঁজছে। শাম্সই খুঁজে পেলেন কবরটি, ইশারায় কাছে ডাকলেন আমাদের। কোন সমাধিই এখানে বাঁধানো নয়, সবই দূর্বা ঘাসের চাদরে মোড়ানো। শুধু শায়িত মৃতের মাথা বরাবর তাম্রপাতে ইংরেজী হরফে খোদাই করা ব্যক্তির নাম ও পরিচয় লেখা। নামফলকগুলো সব একই মাপের, অলংকরণেও কোন ভেদ নেই। “গাউসুল হোসেন মির্জা”, (অব:) উইং কমান্ডার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা। মির্জা সাহেবের নাম ও পরিচয় এভাবেই লেখা।

ফলকের লেখা পড়ে খানিকটা আশ্চর্যই হলাম! এতগুলো বছর ঈশিতার সাথে কাজ করছি, অথচ সে যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এ তথ্যটি জানতে আমাকে যোদ্ধার সমাধি অব্দি পৌঁছুতে হলো? বীর পিতার বিনয়ী কন্যা! সাথে আনা ফুলের স্তবকটি ওর সন্তানেরা নানার শিয়রে রাখলো। তো মৃত্যুদিনে বাবার গোরের সামনে কন্যা দাঁড়িয়ে! নীরব, নিস্তব্ধ, নিশ্চল ঈশিতা! দিনের মধ্যভাগে তীব্র সূর্যালোকে ঈশিতার চোখের কোণে চিকচিকে অশ্রুবিন্দু! পরিবারের বাইরের একজন মানুষ উপস্থিত না থাকলে হয়তো বা সে বাবার নামফলকের পাশে বসে খানিকক্ষণ কাঁদতো!

বিবেচনা করলাম পরিবারটিকে সমাধিতে কিছুটা সময় একান্তে কাটাতে দেওয়া উচিৎ। চেয়ে দেখি, খানিক দূরেই গোরস্থানের খনন কর্মীরা একজন মৃতের সমাধির জন্য গর্ত খুঁড়ছে। স্বজনেরা দুচারজন দাঁড়িয়ে সে প্রস্তুতি দেখছে। ঘাসের মধ্যকার আপনাজালা বুনোফুলগুলো পায়ে মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি সেদিকটায় এগুলাম। খোড়া গর্তের তলাটি যেন ঝুরো মাটির তুলতুলে বিছানা। দেখে মনে হচ্ছিল ওখানটায় খানিকক্ষণ শুয়ে জীবনের কান্তি জুড়িয়ে নিই।

পেশাদার শ্রমিকরা আধুনিক খননযন্ত্র ব্যবহার করে গর্তটি খুঁড়েছে। কিন্তু সাইজে তা বেশ ছোট। পরিণত একজন মানুষকে সেখানটায় শোয়ানো চলে না। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে, চাইনিজ বংশোদ্ভুত একজন মৃতের শুধু দেহভষ্ম সেখানটায় পুতে রাখা হবে। কিছুক্ষণ ওখানটায় থেকে ৫০০ মিটার দূরবর্তী একটি গাছের তলায় পাতানো বেঞ্চিতে একাকী গিয়ে বসলাম। নানামুখি বিয়োগান্তক চিন্তারাজি মাথায় এসে যেন ভীড় করলো। হঠাৎই মনে প্রশ্ন জাগলো, কি কারণে আজ আমি কবরস্থানে এসেছি? আমি কি তবে আমার শেষ ঠিকানা দেখতে এলাম? অন্তিম ডাকের অনুরণন শুনতে পেয়েছি কি?

ধরণী ছেড়ে চলে যাবার সময় বুঝি এলো! কিন্তু এত শীঘ্র কেন? সবই তো বাকি! কিছুইতো এখনও করা হোল না? আর “যাবার সময় হয়েছে কি না” দাদীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে তো এখনও তা জিজ্ঞাসাই করা হয়নি? তাঁর অনুমোদন বিনা তো যাওয়া হবে না কোথাও! তাহলে কোন সে অজ্ঞাত পিপাসায় আজ আমি গোরস্থানে পৌঁছেছি? তবে কি অন্তরের প্রিয়তম চাওয়াগুলো না পওয়া রেখেই আমার তিরোধান হবে?

কত কথা মনে পড়ছে। ওই যে প্রিয় সেই রবীন্দ্রগানটি, “যদি তারে নাই চিনি গো সে কি” দ্বৈতকন্ঠে তুলী’র সাথে আরেকবার কি তবে গাইবো না? খুব যে ইচ্ছা ছিলো, আমার চম্পা যখন মাথা ব্যথায় কাতর হয়, তখন পাশে বসে একদিন ওর কপালটা টিপে দেবো; তাতো এখনও করতে পারিনি? আমি চলে গেলে আমার শেলী কাকে ফোন করে বলবে, “দাদু কেমন আছেন, কবে আসবেন আমার কাছে?” কলিটা গাল ফুলাবে কার উপরে? ওই সেই যে আমার আঞ্চলিক উচ্চারণের কবিতা বলা শুনে বিরক্ত হয়ে বুড়ি বলেছিলো, দাদু তোমাকে রবি ঠাকুরের “হঠাৎ দেখা” কবিতাটা ভাল ভাবে আবৃত্তি করতে শিখিয়ে দেবো; তা তো এখনও শেখা হয় নি? আলভীটার মাত্র দুমাস বয়সে আব্বা চলে গেলেন; কিন্তু আমি তো ওকে এতিম হতে দিই নি। আমি চলে গেলে তার তো আশ্রয়ের আর কোন জায়গাই রইলো না! এত কিছু পেছনে ফেলে কেমনে যাবো আমি?

চাওয়ার কি আর শেষ আছে? কোনটা রেখে কোনটা বলি? গত দুই দশক ধরেই ভাবছি যে, দাদীর বাড়িতে গিয়ে হাসান, মিলন, জাসিদ ভাই, এসকেন কাকাদের সাথে সারাটা রাত তাস খেলে কাটাবো। আর সেই রাতেই প্রতিবেশী কারো খোপ থেকে মর্দা হাস চুরি করে কেরোসিনের চুলায় নিজেরাই রেঁধে খাবো। এ সুকর্মটি (!) তো করা হয়ে উঠেনি এখনও। সেই কবে থেকে ইচ্ছা যে, নোয়াকাকার সাথে চান্দার বিলে বন্দুক নিয়ে আরো একবার পাখি শিকারে যাবো; আর ফেরার পথে বিল থেকে এক তোড়া শাপলাও তুলবো। সেও তো বাকি!

আবার এখনই যদি আমি শেষ ঠিকানায় বসবাস শুরু করি তবে বাড়ীতে রত্নাতো একা! কার সাথে সে তাঁর অনুযোগগুলো নিয়ে নিত্য খটরমটর বাঁধাবে? মাঝেমধ্যেই দু:স্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরে যখন তাঁর পা বাঁকিয়ে যায়, তখন কে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে, কিচ্ছুটি হয়নি, তুমি স্বপ্ন দেখেছো; আবার ঘুমাও। কার বুকে হাত রেখে সে আবার পাশ ফিরে শুবে? ওদিকে আমার ছেলেটাকে তো এখনও বুঝানোই হয় নি যে, আমি ওকে অনেক ভালবাসি! এই আমি, গত চারটি দশক ধরে আমার আম্মার জীবনরথের সারথী। আমি না থাকলে তিনি যে বড় সঙ্গহীন হয়ে পড়বেন। সংসার-সংটের পরামর্শগুলো তিনি তবে কার সাথে করবেন? ওনাকে বোঝবার শেষ মানুষটি যে আমিই! তাঁর রথখানি তখন চলবে তো?

জীবনের এমনি আরো কতশত চাওয়া-পাওয়া, ভালবাসা-ভাললাগা, জপ, তপ, নিয়ম, সংযম, শিহরণ, আবেদন, অনুভব, -সবই তো এখনও বাকি। তবু কেন আমি শেষ ঠিকানা দেখতে এসেছি? অবচেতন মনে চলে যাবার এ তাড়না কেন তবে? এ কেমনতর পরিবর্তন আমার? কোন সে অদৃশ্য শক্তি যে আমার নেপথ্য নিয়ন্ত্রক? এত সব প্রশ্নের জবাব অজানা। তবে একটি সত্য খুবই জানি যে, নিয়তি কখনও নিমন্ত্রণের অপেক্ষা করে না!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ