
সদাশয় সরকার এইসব ছোটখাট ব্যবসায়ে গ্যারান্টার সহ টাকা ধার দিতে লাগলেন। পুনর্বাসন দপ্তর ও উদ্বাস্তু ত্রাণ বিভাগের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে উৎসাহদান শাখা এইসব দোকানের অনেকগুলিকে উপযুক্ত গ্যারান্টির বিনিময়ে টাকা যোগাতে আরম্ভ করলেন।
আমাদের পাড়ায় সবচেয়ে ঝকঝকে একটি দোকান দেখা দিল ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ। দোকানটির নাম পলস্ ট্রেডিং কোং। স্বত্বাধিকারী শ্রীবিদ্যুৎচন্দ্র পাল। সামান্য অনুসন্ধিৎসা থাকায় এবং স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে কয়েকদিনের আলাপ পরিচয়ে জানা গেল শ্রীপাল এই দোকানটি অথবা ব্যবসায় কোম্পানির ব্যাপারে কোনোরকম সরকারি সাহায্য নেননি। তিনি পূর্বে বরিশালে ব্রজমোহন কলেজের গেটের বিপরীতে সরবৎ, ডাব, বিস্কুট, দেশলাই, কেক ও সিগারেট বিক্রয় করতেন। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরেই একটি লম্বা কাপড়ের গাজিয়া ভর্তি দশটাকার নোট নিয়ে তিনি ভারতে চলে আসতে সমর্থ হন। সেই টাকাতেই এই ব্যবসায়ের পত্তন।
পলস্ ট্রেডিং কোম্পানির দ্বিবিধ উপযোগিতা থাকায় আমাকে সেখানে প্রায়ই যেতে হতো। একই দোকানে লন্ড্রি আর স্টেশনারি দুই-ই ছিল। কলকাতায় এরকম আর দুটি ছিল না, নেইও সম্ভবত। এখন আর কেন যাই না তা ক্রমশ প্রকাশ্য।
নিজে সরকারি টাকা না নিয়ে দোকান করলেও শ্রীপাল সরকারি সাহায্য গ্রহণের ব্যাপারে জড়িত ছিলেন। তাঁর ভগ্নীপতি পার্ক সার্কাসে ঐ একই সময়ে নাকি একটি স্টেশনারি দোকান দেন। সে দোকানের মূলধন ৮০০০ টাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে উৎসাহদান শাখা ধার দেয়। তার গ্যারান্টি দিয়েছিলেন বিদ্যুৎচন্দ্র পাল। সেকথা তিনিই কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন---তখন তিনি ঐ গ্যারান্টি সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন বলে আমার ধারণা হয়েছিল। তাঁর ভগ্নী, ভগ্নীপতি, ভগ্নীপতির দোকান ইত্যাদির কোনোটিই আমার বা আমার পরিচিত মহলের কারোও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাবে উল্লেখ্য, এই ভগ্নীপতিই তার নিয়তি হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
পরে ভুলে যেতে পারি তাই অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করছি শ্রীপাল অবিবাহিত, বয়স ৩৮/৩৯, দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং ঈষৎভাবে গঠিত। লক্ষণীয় বলতে প্রথমেই চোখ, চোয়াল, দাড়ির অসামঞ্জস্য ও অপসৃয়মাণ চুলের পলায়নপরতা উল্লেখ করতে হয়।
চোখের ওপরের ঢাকনা তুলে তিনি প্রায়ই ছেড়ে দিতেন। ছাড়বার সময় কান পেতে থেকে বলতেন, শব্দ পেলেন? পরে বুঝিয়ে বলেছেন : চোখ গর্তে এসে গেছে বলে ওপরের ঢাকনা টানতেই 'পট' নামক একটা শব্দ হচ্ছে। সুশরীরের লক্ষণ নাকি মুখের ওপর চোখ ভেসে থাকা। তিনি সব সময়েই চোখের নিচের কালির জন্যে অস্বস্তি প্রকাশ করতেন।
চোয়াল সম্পর্কে মুখে তিনি কোনোদিন কিছু বলেননি। কেবল হাড়ের সংস্থান ক্রমাগত দাঁত দিয়ে বিচ্যুত করে তিনি চোয়ালকে অবিশ্রান্তভাবে গালের চামড়ার নিচে উত্থিত পতিত করেছেন। ফলে, দুই এক সময় তার শীর্ণ হাড়সর্বস্ব মুখমণ্ডলের পার্শচিত্রকে কোনো মেশিনের সচল লিভার বা সকর্মক পিস্টন বলে কল্পনা করার অবকাশ ঘটেছে।
বাঁ-হাতের অগ্রভাগে দাড়ি ও ডান হাতের শীর্ষে মাথার চুল তিনি একই সঙ্গে বুলোতেন—তখন তার মুখভঙ্গি যা দাঁড়াত তার মানে—হায়! হায়! বুড়ো হয়ে গেলাম।
তিনি কতদূর পড়াশুনো করেছেন কিংবা আদৌ করেননি তা ভালো করে জানি না। জানবার চেষ্টাও করিনি। আমি ছিলাম ক্রেতা, তিনি বিক্রেতা। অবশ্য ক্রমে ক্রমে তিনি উত্তবর্ণ ও আমি অধমর্ণে পরিণত হই। তথাপি আমাদের সম্পর্ক বহুকাল টিকে ছিল। এখনো পুরোপুরি ছিঁড়ে যায়নি। তবে আমিই রাখি না। সে কারণও একে একে প্রকাশ্য।
আমি মোটামুটিভাবে তার ব্যক্তিগত প্রায় সব কিছুই জানার সুযোগ পাই। কারণ, তার ব্যক্তিগত সমস্যা, বিপদ-আপদে আমিই উপদেষ্টা ছিলাম। ষোল বছর হলো আমরা কাছাকাছিই আছি। তবে এখন আমাদের মধ্যে খুব কম কথা হয়। যখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তখন তিনি ছিলেন দোকানের মালিক। এখন তিনি সেই দোকানের কর্মচারী।
দীর্ঘ ষোল বছরের মধ্যে তাঁর অনেক পরিবর্তন আমার চোখের সামনেই হয়। এই দীর্ঘকালের মধ্যে তাঁর তিনটি উপসর্গ জোটে।
১. আমি তাঁকে একটি ডায়েরি উপহার দিয়েছিলাম। টাটা কোম্পানির। একদিকে রোজনামচা লেখার জায়গা। অন্যদিকে ভারতবিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের একখানি করে বিখ্যাত ছবির রঙিন অনুলিপি। ডায়েরির শেষদিকে ভারতে ও বিদেশে টাটা কোম্পানির ব্যবসায় উদ্যোগের বিবরণ ও মূলধনী অর্থের পরিমাণের একটা হিসেব ছিল।
এই ছবি তাকে শিল্পবোধে জাগরিত করে এবং অপরদিকে ডায়েরির প্রান্তভাগের ব্যবসায়ী-উদ্যোগে টাটার ক্রমবিস্তারের বিবরণ তাকে ব্যবসায় সম্পর্কে সচেতন ও উদ্যোগী করে তোলে। এই ডায়েরিতে তিনি দীর্ঘকাল তার জীবনযাত্রার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তবে, তারবার্তার ভাষায়। ডায়েরিটি বর্তমানে আমার কাছে আছে। সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে কিয়দংশ আমি এখানে উদ্ধৃত করব। কেননা, তাঁর সঙ্গে যারা আগে ব্যবসায় সম্পর্কে এসেছেন এবং ভবিষ্যতে আর যাঁরা আসবেন এই বিবরণ তাদের পক্ষে উপকারী হবে।
২. একটি দুধেল ছাগল। আকার বৃহৎ ও কিঞ্চিৎ উষ্ণ স্বভাবের। এই ছাগল বা রামছাগল ক্রয়ের পিছনেও আমি ছিলাম। মৌখিকভাবে কোনোদিন ছাগল কিনতে আমি তাঁকে বলিনি। টাটার ব্যবসায় উদ্যোগ——অর্থাৎ আমার উপহার দেওয়া ডায়েরি তাকে এই ছাগল সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ছাগলটিকে দোকানের সামনে ট্রামের তার লাগানো খুঁটিতে বেঁধে রাখতেন। স্বল্প পরিসর রাস্তা দিয়ে ট্রাম, বাস, প্রাইভেট গাড়ি যাতায়াতের পরেও যেটুকু চলাচলের পথ কোনোমতে থাকত তা দিয়ে লরি এলে দোকানের সামনে বা কাছাকাছি দুর্ঘটনা ঘটত। কারণ, ছাগলটি বাঁচানোর জন্যে সকল লরিচালককেই একবার দুবার গাড়ি নিয়ে ড্রেনের দিকে নেমে যেতে দেখা গেছে।
এই ছাগলের জন্যে তিনি তাজা ঘাস সংগ্রহ করতেন। একবার তাকে পাল খাওয়ানোর জন্যে তিনি প্রকাশ্য রাস্তায় সুগন্ধিযুক্ত একটি বৃহৎ বোকা পাঁঠাও আমদানি করেন। ফলে, কিছুদিন পরে অনেকদিনের জন্যে তার কোলে আমরা সর্বক্ষণ একটি চঞ্চল চুকচুকে কালো শিশু-রামপাঁঠি দেখতে পেয়েছিলাম।
এখানে একটি জিনিস বলা দরকার। পালেরা দুই ভাই। তিনিই বড়। ছোট ভাই রাইটার্স বিল্ডিং-এ কোনো মন্ত্রীর ঘর পাহারায় নিযুক্ত পুলিশ ছিলেন। এখনো আছেন।
একবার আমাদের প্ররোচনায় শ্রীপালের বিবাহেচ্ছা হয়। কনে দেখতে গিয়ে ছোট ভাই কনেকেই বিয়ে করে ফিরে আসেন। এসে, পৃথক বাসায় ওঠেন। সেই থেকে দুই ভাইয়ের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ছোট ভাইয়ের তিনটি সন্তান। তিনি অফ টাইমে অর্ডার সাপ্লাই করেন। দাদার কথা উঠলে বলেন, অপদার্থ।
ঐ ছোট সন্তান ক’টির প্রতি শ্রীপালের আকর্ষণ ছিল। কিন্তু তিনি কখনো তাদের কোলে নেননি! ছাগলের দুধ নিয়ে সূর্যদেব ওঠার পূর্বে তিনি নির্দিষ্ট বাড়ি দিয়ে আসতেন। কোনো সন্তানসন্ততি না থাকায় শিশু রামপাঁঠিকে তিনি বহুদিন আদরে আদরে কোলেই রাখতেন। পরে, পাড়ার মাংসলোলুপ দুর্বিনীত গুণ্ডাশ্রেণীর যুবকেরা সেটি কিভাবে হস্তগত করে তা আমি জানি না।
৩, হারমোনিয়াম। এটি বাজনা হিসেবে করায়ত্ত করার পক্ষে সুবিধের বলে শ্রীপাল তার দোকানের পাশবর্তী হিজড়েদের আড্ডা থেকে সস্তায় কেনেন। গভীর দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় ক্রেতার ভিড়ের পূর্বে তিনি এটি নিয়ে বসতেন। দীর্ঘকাল তিনি একটি গানকে ঐ হারমোনিয়ামে ধরবার সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। হারমোনিয়মটা কোত্থেকে কেনা হয় তা আমরা জানতে পারি একটি কারণে। হিজড়েদের আড্ডা ও শ্রীপালের দোকানের মধ্যে একটি গলিতে আমরা প্রায়ই পেচ্ছাব করতাম! আশেপাশে কোনো জায়গা না থাকায় এখানেই যেতে হতো। ফলে, হিজড়েদের আড্ডাতেও দু-একবার যেতে হয়েছে। প্রথমবার ঢুকেই দেখতে পাই কলকাতায় সহজে-বহনীয়-চুরি-যাওয়া প্রায় সব কিছুই সেখানে বিক্রয়ের জন্য মজুত। সেলাইকল, গ্রামোফোন, রেকর্ড, এনসাইক্লোপিডিয়া, ফেলমারা ব্যাঙ্কের প্রায় দুইমণ ওজনের গাদা নতুন চেক বই থেকে আরম্ভ করে টেবিল ফ্যান মায় বড়ুয়ার প্লে-করা পুরো ষোল রিলের একখানা পুরোনো বাঙলা ছবি। অর্থাভাবে সেখানে আমাকে তিন জোড়া পাম্পসু ও প্রায়ই সের দরে খবরের কাগজ বেচতে হয়েছে।
এই উপসর্গ তিনটির কোনোটিই এখন আর তাঁর নেই। তাঁর ক্রেতাসাধারণের উপকার হবে এই বিবেচনায় সেই ডায়েরি থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু কিছু অংশ এখানে উপহার দেওয়া হলো।
পরে সর্বসাধারণের কথা চিন্তা করেই পলস্ ট্রেডিং কোং-এর একদা স্বত্বাধিকারী ও অধুনা কর্মচারী শ্রীযুক্ত বিদ্যুৎচন্দ্র পাল সম্পর্কে একটি নিয়মাবলি দেওয়ার চেষ্ট করব।
যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন—সে ক্রেতাই হোন কিংবা ব্যক্তিগত উপদেষ্টাই হোন--তাঁদের সকলের পক্ষেই এটা উপকারী হবে বলে আশা করি। কারণ, আমরা যাঁরা একাধারে তাঁর উপদেষ্টা ও ক্রেতা হিসেবে সুদীর্ঘ ষোল বছর আগে তার দোকানে দেখা দিয়েছিলাম তারা নিজেদের মধ্যে নিজেদের সুবিধের জন্যই তাঁর সম্পর্কে একটা খসড়া নিয়মাবলি তৈরি করে নিয়েছিলাম। এতে আমাদের সময়ও বাঁচত এবং তার সঙ্গে দেখা হলে যেসব সুবিধে-অসুবিধের অবকাশ ছিল সেগুলিও এই নিয়মাবলির সাহায্যে আয়তনে অনেক হ্রস্ব করে নিতে পেরেছিলাম। সে খসড়া উপস্থিত আমার হাতে নেই---সন্ধান করে কারও কাছে পাইওনি। তাই স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে নেওয়ার ফলে কিছু অসম্পূর্ণতা-দোষ থেকে যেতে পারে।
উপস্থিত ডায়েরিতে যাচ্ছি। মনে রাখতে হবে এই সময়েই শ্রীযুক্ত পাল স্বত্বাধিকারীর পদ থেকে স্বেচ্ছায় কর্মচারীর ভূমিকায় নেমে আসার উদ্যোগ করছেন। কারণ, তাঁর নিয়তি তাঁর ভগ্নীপতি। তাঁকে আমরা কোনোদিন দেখিনি। ডায়েরিতে তিনি ভোম্বল নামে উল্লেখিত আছেন।
মনে রাখতে হবে A.M. এবং P.M. সম্পর্কে শ্রীযুক্ত পালের নিগূঢ় সন্দেহ বা দ্বিধা ছিল। ফলে, যিনি এই ডায়েরির কাছাকাছি হবেন তাঁকে নিজের সুবিধেমত A.M, এবং P.M. সাজিয়ে নিতে অনুরোধ করছি।
ডায়ারির সাদা রোজনামচার জায়গায় তিনি দিনলিপি লিখেছেন। মনে রাখতে হবে তার বিপরীত পৃষ্ঠায় টাটা কোম্পানি ভারতবিখ্যাত ও দু'-একজন জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর একখানি করে ছবির রঙিন অনুলিপিও উপহার দিয়েছেন।
এই ডায়েরি রচনার সময় শ্রীযুক্ত পাল ডায়েরির উপান্তে টাটা কোম্পানির ব্যবসায় সাফল্যের পরিমাণ সম্পর্কে প্রায়ই ওয়াকিবহাল হয়েছেন। ফলে সেখান থেকেও দুএকটি বিবরণ তুলে না দিয়ে উপায় নেই। উপরন্তু, চিত্রশিল্পীদের পরিচয়ও শেষে দেওয়া আছে। এগুলিও নিশ্চয় শ্রীযুক্ত পালের মনে রেখাপাত করেছিল। ফলে, তারও কিছু কিছু প্রসঙ্গ এই ডায়েরিতে আসবে। মনে রাখতে হবে ডায়েরিটি ১৯৫৬ সালের শেষ থেকে ৫৭ সালের শেষ অব্দি।।
প্রথমেই বাঁ-হাতে কে,এচ, আরা অঙ্কিত ‘মিডনাইট’ ছবিটি রয়েছে। একটা টেবিলে ফুলের টবে কিছু ফুল ও উদ্বাস্তু বাহারি পাতা। টেবিলটি চকচকে বলে তার প্রতিবিম্ব পড়েছে। ঘরের জানলা হলুদ--দেওয়াল গিরি মাটির। একটা লাল দরজা। মৌলিক গবেষণা-সংক্রান্ত টাটা ইন্সটিট্যুট কর্তৃক এই নিস্তব্ধ ছবিটি সংগৃহীত। পাশে ২৬শে ডিসেম্বরের পৃষ্ঠায় সোমবার থেকে আরম্ভ করে ১লা জানুয়ারি অব্দি শ্রীযুক্ত বিদ্যুৎচন্দ্র পাল সম্ভবত মধ্যরাত্রির সঙ্কল্প হিসেবে লিখেছেন—
28, 11,56, হইতে আমার Pland হইয়াছে এবার যাহা টাকা জামাইবো সব টাকা খাতা ও লজেন্স কোম্পানির জন্য খরজ করিব। এছাড়া Holsell Business করিব--এই আমার Pland,
ইতিঃ-
বি, সি, পাল
২৮,১১.৫৬
PAUL'S TRADING CO.
BIDYUT CHANDRA PAUL
29/1/2B, TOLLYGUNGE CENTRAL ROAD
CALCUTTA-3
এই মধ্যরাত্রির সঙ্কল্পের উৎস সম্ভবত ডায়েরির উপাত্তের বিবরণ। যে রকম—
TATA SONS LIMITED
(Established in 1971)
TATA INDUSTRIES LIMITED
(Established in 1945)
Successor to a small trading farm founded by Jamsetji Tata in 1857, Tata Sons Limited, a Private Limited Company, which owns Tata Industries Limited, has built up the largest single aggregation of Indian Industry, with a total financial investment of Rs. 136 crores (£102,000,000). 116,600 employees and annual output of goods and services valued at Rs. 61 crores (£ 45,750,000).
About 85 Per cent of Tate Sons Capital is held by Philanthrophic trusts endowed by members of Tata Family.
ঠিক এই সময়েই শ্রীযুক্ত পালের কাছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে উৎসাহদান শাখা থেকে একটি চিঠি আসে। শ্রীযুক্ত পাল আমাকে চিঠিটি দেখান। তার ভগ্নীপতি যে ৮০০০ টাকা নিয়ে ব্যবসায় আরম্ভ করেন তা খুঁজে না পেয়ে সরকার ইন্সপেকসন করে জানেন যে, ভগ্নীপতিটি দোকান বেচে দিয়ে সেই টাকায় নির্বিঘ্ন সংসার করছেন। অতএব শ্রীযুক্ত পাল, আপনি যখন গ্যারান্টার তখন অবিলম্বে ঐ ৮০০০ টাকা সরকারি তহবিলে জমা দিন। নতুবা সরকারকে বিভাগীয় আদেশবলে সম্পত্তি ক্রোকের পথ দেখতে হবে।
আমার উপদেশ ছিল : দোকানটি আমার নামে বেনামা করুন। শ্রীযুক্ত পাল তা করেননি। কারণ, তখনো নানা কারণে আমাদের ব্যাডমিন্টন ক্লাবের নামে তার দোকানে দু-ডজন ফেদারের দাম বাকি ছিল—সঙ্গে, হিসেবের দেওয়ালে কিছু সিগারেটের উল্লেখ ছিল।
Directors of Tata Sons and of Tata Industries : Lady Ratan Tata, Mr. J. R. D. Tata (Chairman), Sir Homi Mody, Mr. N. H. Tata, Mr. A. D. Shroff, Mr. J. D. Choksi, Mr.T. V. Baddeley, Sir Jebengir Gandhy, Mr. D. R. Tata, Mr. A. P. Narielwala, Mr. S. Moolgaokar, Mr. K. A. D. Naoroji, K C. Bakhle and Mr. M K. Powvala.
কিন্তু বলে রাখা দরকার ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে পলস্ ট্রেডিং কোং-এর লন্ড্রি বিভাগটি তুলে দিতে হয়।
প্রধান কারণ, পাড়ার থানার ওসি'র ইউনিফর্মটি দোকানের ইস্ত্রি-বিভাগে অর্ধদগ্ধ হয়।
গৌণ কারণ, মাসকাবারি পরিশোধযোগী তাড়া তাড়া লন্ড্রির বিল শ্রীযুক্ত পালের সহাযোগী ব্যবসায় ও পোষ্যদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছাগলটি একদা উদরসাতের চেষ্টা করে বিফল হলেও লালা ও চর্বণ উদ্যোগে তার লেখাগুলির মর্মোদ্ধারে বাধা জন্মায় ।
শ্রীযুক্ত পাল স্মৃতি থেকে যেসব দাবি উত্থাপন করেন তার মধ্যে দুটি পাজামা একাদিক্রমে দু-মাস কাচানো বাবদ আমার নামও ছিল। কিন্তু উপদেষ্টা পদে আসীন থাকায় আমি নির্বিবাদে রেহাই পাই।
Address : Bombay House, Fort Bombay-1
Telegrams : TATASONS, Bombay,
TATIND. Bombay.
এই সময়েই তিনি ভগ্নিপতির সন্ধানে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
শ্রীযুক্ত পালের মধ্যরাত্রির সঙ্কল্পের পাশে ‘মধ্যরাত্রি' ছবিটির শিল্পী-পরিচিতিতে বলা হয়েছে--
K.H. ARA, though he displays such Versatility in his paintings, did not study at any Art School.
১৯শে জানুয়ারি থেকে ২২শে জানুয়ারি শ্রীযুক্ত পালের লিপিবদ্ধ ডায়েরিতে লেখা আছে দেখছি
6 P. M. to 7 P. M. প্রথমে খাতা লেখা।
7 PM to 12 P.M. প্রথমে দেবতা পূজা, তারপর Business, বাজারও ভালো নয়।
3 P. M. to 7 A.M. বাজারে যাওয়া, দেবতা পূজা, তারপর Busines।
5-30 to 7-15 P.M. প্রথমে exercise, তারপর বাজনা বাজান, তারপর মাখন ঠিক করা, তারপর হাতমুখ ধোওয়া ও খাওয়া।
7-15 to 12-30 A, M, আজগে বাজার ভালো।
4 A. M. to 10 A. M. 2207 Business, দুধ বিক্রয়, তারপর বাড়ি আসা।
পাশের ছবিটি ডঃ টি. সিঞ্জেশ-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত ভি, এস্, গাইতোণ্ডে অঙ্কিত ‘দি রেড রিবন।'
একটি রঙীন যুবতী বাঁ হাতের আঙুলে একটি মুদ্রাবৃত অবস্থায় স্তব্দ-- মাথায় একটি লাল রিবন। মুখের বিবরণ নিষ্প্রয়োজন। দিনলিপির তারিখ দৃষ্টে বিবেচনা হয় এই সময় শ্রীযুক্ত পালের বিবাহেচ্ছা হয়। কিছু দিন আগে ছাগল আমদানি করা হয়। শিল্পীর পরিচয়ে বলা হয়েছে তিনি shed the traditional style on 1951 for a lostract painting
সম্ভবত এই সময়ে শ্রীযুক্ত পালের বয়ানে জানতে পারি তিনি ভগ্নীপতির সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু যেখানে আছে সেখান থেকে টাকা উদ্ধার করা অসম্ভব। ভগ্নী ও ভগ্নীপতি একই সঙ্গে তাঁকে মারধোর ও মৃত্যু-ভয় দেখিয়েছে। ফলে, একা সে মুখে হওয়া বিপজ্জনক।
মাঝে একটি ছবি আছে। এস, জি, নিকমের আঁকা লাল রঙের গণেশ। তারপর (তারিখ উল্লেখ অর্থহীন)
5-30 P.M. to 10 A. M
(P.M. এবং A.M, শ্রীযুক্ত পালের পক্ষে বিড়ম্বনা)
বাজনা+ খাতালেখা+Business+ মাল আনা+গান (বাজার ভালো)।
এই সময়ে সম্ভবত সবাই তার দোকানের ধার শোধ করছিল। আমাকে তিনি কোনোদিন তাগাদা দেননি। অসম্ভব বিশ্বাস করতেন।
5-30 PM, to--বাজনা+খাতা
লেখা+Business+বিশ্রাম+গান। আজগে বাদলার দিন (বাজার ভালো নয়)।
তারিখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ঐ সময়ে আমরা তাঁর ভাইয়ের বিয়েতে নৈহাটি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে বৃষ্টি ভিজে ফিরছি।
মাঝে এই ছবিটি আছে—ছবিটি কৃষ্ণ বর্ণের। নাম, দিবাস্বপ্ন। শিল্পী শ্রীরাবাল।
মূল ছবিতে এখানকার রেখাগুলো শাদা, শাদা জায়গাটুকু ঘোর কালো। তারপর কয়েকটি পাতা একেবারে শাদা! মাঝে Poughing, Ayahs in Marine Drive, Bhopal Road Beggar Woman, Faded Flower, Lady with a bird Huts and Poplars witos!
পাশে লেখা Dull market falls in this month. লেখাটি ধরে ধরে মক্স করে সাজান। বোধহয় আমিই ডায়েরি দেখে মন্তব্য করেছিলাম তখন।
6 a.m, to 7 aa.m. দাড়ি কামান—তার পর দোকানে আসা। দোকানে আসিয়া ঝাড়ু দেওয়া-দেবতা পূজা। তারপর ঠোঙ্গা করা। তারপর বাজনা।
আর এক জায়গায় 4-30 pm Business, তারপর পড়া।
তারপর Business, তারপর লেখাপড়া, তারপর ঠোঙ্গা, তারপর Business, উপান্তে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলির টাকার অঙ্কের নীচে শ্রীযুক্ত পালের নীল পেন্সিলের গভীর দাগ ।
TATA TRON AND STEEL COMPANY LIMITED
Subscribed Capital Rs. 17,33,76,013
অপর তিনটি কোম্পানির Subscribed Capital Rs. 12,83,72,000, নীচে শ্রীযুক্ত পালের দাগ। অন্য কয়েকটি কোম্পানির মূলধন ইত্যাদি শ্রীযুক্ত পাল ২৬শে ফেব্রুয়ারি একজায়গায় পর পর সাজিয়ে একটা যোগ অঙ্ক রেখেছেন।
৮,৮,০০,২৫০ + ১,০০,০০,০০০+ ২,০০,০০,০০০ + ৫,০০,০০,০০০+ ৭,০০,০০,০০০ + ৩৫,০০,০০০
১,২৫,০০,০০০
১১,৬৮,০০,০০০
১,০৬,২,০০০
১,২৭,৫৮,৭৮১
২,৩৫,৬৭,০০০
----------------
০০০০০০০০০৮১
শ্রীযুক্ত পাল এই যোগটি অসমাপ্ত রেখেছেন।
তিনি ঐ সময় পথ খরচ দিয়ে আমাকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে উৎসাহদান শাখায় পাঠান। আমি দুপুর রৌদ্রে দেখা করতে গিয়ে জানি যে, কার্ড ছাড়া ও আগে থেকে ঠিক না করে দেখা হয় না। তবু চেষ্টা করে ভেতরে ঢুকে বকা খাই। বাইরে এসে আমি একটি ঠাণ্ডা ঘরে সিনেমা দেখি। এক মাসে পর পর তিন দিনই একই ঘটনা ঘটে।
তারপর কয়েক পৃষ্ঠা ঘন ডায়েরি --
5-:30 a.m. প্রথমে উঠিয়া exercise তারপর দাড়ি কামান। 6-40 a.m, দোকানে আসিয়া ঝাড়ুদান ও দেবতা পূজা।
এরপর সব কয়দিনই ক্রমাগত দেবতা পূজা। মাঝে মাঝে –
তারপর খিদিরপুর যাওয়া। ভোম্বল তর্ক করিল।
তারপর সঙ্গীত।
তারপর কাপড় কাচা ও istri।
তারপর বাঁশি বাজানো।
তারপর cinema
তারপর পড়া ও অঙ্ক।
Business
তারপর ঠোঙ্গা করা।
ঘাস ক্রয়।
5 A.M., প্রথমে উঠিয়া ‘রামকে' লইয়া মনিংওয়ার্ক।
5:30 A, M, প্রথমে উঠিয়া exercise, তারপর কিছুক্ষণ বিছানায় ঘুম, কারণ-আমার শরীরটা ভালো নয়।
তারপর অঙ্ক+তারপর ঠোঙ্গা+তারপর হাত মুখ ধোওয়া+তারপর Business+ তারপর খিদিরপুর যাওয়া+তারপর সঙ্গীত, হারমোনিয়ামটিতে ভালো বাঁশি হয় +আজগে শরীরটা খুব ভালো নয়+সঙ্গীত করা+5 A.M. প্রথমে উঠিয়া ইংরাজি কাগজ পড়া+Business ও Account করা--শরীরটা ভালো নয় কারণ, সর্দি ও কাশি হইয়াছে+ 5,500 A. M.-- আকাশের আবহাওয়া খুব ভালো নয়—সারাদিনই বৃষ্টি হইয়াছে। সন্ধ্যায় খিদিরপুর যাওন+ফিরিবার পথে বাজার প্রমাণ ভোম্বল নাই।
ভগ্নিপতি সম্ভবতঃ খিদিরপুর পলায়ন করে। শ্রীযুক্ত পাল শেষ দিকে তাঁর হারমোনিয়মে সি সার্পে শেষের রিডটি চেপে ধরে বাঁশি বাজাতেন।
রাম তাঁর ছাগলের আদরের নাম। ঘাস তারই জন্যে।
এই সময়ে সরকারি নোটিশ এসে গেছে। এক বছর সময় পাওয়া গেছে। শ্রীযুক্ত পাল তখন অভ্যেস বজায় রাখলেও ছাগলের দুধের ব্যবসায়ের আয়েতেই জীবনধারণ চলছিল। দোকানের লাভ কিস্তিবন্দীতে সরকারি ধার শোধে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
মাঝে দুখানি ছবি Coloured Windows এবং Washing Day | একটি মারাঠি মেয়ে মালকোছা মেরে শাড়ি ধুতি শুকোতে দিচ্ছে। শিল্পী ভজুভাই ভগৎ।
তারপরেই পাওয়া যাচ্ছে—
‘এছাড়া ব্যাঞ্জো বাজান ও কয়লা ভাঙ্গা।'
এই সময় পাশের চায়ের দোকানে শ্রীযুক্ত পালের ভাত হতো। কিছুদিন পরে তাকে উনুন নিকোতেও দেখা যায়। হারমোনিয়মের একটি রিডের তার ওপরে তুলে দিয়ে তখন তিনি ব্যাঞ্জো বাজাতেন। এই সর্বার্থসাধক হারমোনিয়মটি তখন তার মনের মতো আওয়াজ সরবরাহ করত। আমি তখন যন্ত্রটির জন্যে পর পর দুদিন খদ্দের এনেছি। তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন, দুঃখের দিনে সাথী বলে।
এর কিছু দিন পরেই ছাগলটি নিরুদ্দেশ হয়। দোকানে দুপুরবেলা হাত টান ছোট ছেলেমেয়ে লজেন্স বিস্কুট চুরি করতে আরম্ভ করে। একটি ছোট মেয়ে ধরা পড়ে। কিন্তু শ্রীযুক্ত পাল তাকে বাবার হাতে দিয়ে নিজেই বকা খেলেন, সাবধানে রাখেন না কেনো?
তখন পলস্ ট্রেডিং কোং-এর আশেপাশে অনেকগুলো দোকান দাঁড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যে একজন বিত্তশালী লোক ক’দিনই সন্ধের দিকে ঘুরে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য : গুডউইল সুদ্ধ ভালো পোজিশনের এই দোকানটি তিনি কিনবেন। শ্রীযুক্ত পাল দোকানেই থাকবেন। উদ্দেশ্য সফল হলে আমাকে ১০০ টাকা দালালি দেবেন বলায় আমি ঠিক এই সময়েই কিছুটা উদ্যোগী হই।
5 P, M. প্রথমে উঠিয়াই সূর্য উদয় দেখন। একমাস হইল রাম নিরুদ্দেশ।
4-30 pm, Busines—আজ শরীরটা ভালো নয়--তারপরেও দোকানে আসিতে হইয়াছে! দোকান ইন্সপেক্টরবাবু রাত আটটার পর দোকান খোলা রাখায় ফাহিন করিবেন বলিলেন। ৫ টাকার একখানি নোট দিতে ক্ষমা করিলেন। কিন্তু সার শোধ দিব কিরূপে?
2 P.m., হারমোনিয়নটি বেহালার মতো বাজিতেছে ।
কলিকাতায় ভীষণ দুর্ঘটনা হইয়াছে—পূজা করিয়া Busingtss আর তারপর অঙ্ক করিয়া বাড়ি যাওয়া।
এখানে দেখা যাচ্ছে সেই বড় যোগ অঙ্কটি শেষ করা হয়েছে।
5 a.m.—তাহা হইলে টাটার মোটি কত টাকা ব্যবসায়ে খাটিতেছে ?-- আজ কাগজে সংবাদ Bus Accident-এ ২ জন নিহত ও ৩৮ জন আহত-- কিন্তু ইহারা সত্য ঘটনা দেয় নাই।
5-40 a. সকালে উঠিয়া লেবু চা। আজ exercise করি নাই। কারণ, আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ। পেটের শিরায় টান ধরিয়াছে---সেইজন্য শরীরটা ভালো নয়।
5 a.m. প্রথমে উঠিয়া বেহালা। কালই হারমোনিয়ম কিনিতে লোক আসিবে। শ্যামলবাবু এত খরিদ্দার কোথায় পায়? দোকান কিনিবার লোকও তিনিই আনিতেছেন। তিনি আমার বড় বন্ধু। আমি তো আজকাল খদ্দের পাই না।
5 am. বাঁশি বাজান। 5 p.m, বেহালা বাজান। 7 p.m. হারমোনিয়ম বাজান।
বাড়ি যাওয়া, বাঁশি বাজান, ঠোঙ্গা করা, বাড়ি আর যাব না। Business করিয়া ঠোঙ্গা করা। Account লেখা করিয়া ঝাড়ু দেওয়া। শ্যামলবাবুর সঙ্গে সেই লোকটি আসিবে। দোকান কিনিতে চায়। শরীরের অবস্থা ভালো নয়।
5 a.m--7p.m, Business, হারমোনিয়ম বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। ২৫ টাকা দাম ঠিক হইল। Advance 5 টাকা হাতে পাইয়াছি। শ্যামলবাবুর এত পরিশ্রম গেল এই ভাঙা হারমোনিয়ামটির জন্যে। তিনি উহার মধ্যে ৩ টাকা লইলেন। ৩৫ টাকায় তিনিই হারমোনিয়মটি কিনাইয়াছিলেন। তখন নিয়াছিলেন ১০ টাকা।
এখানে ব্লু ও কালো রঙের একটি ছবি। নাম, 'The Dark Lady, শিল্পী, লক্ষ্মণ পাই। শ্রী জে, কাফিলিনের সৌজন্যে ছবিটি পাওয়া গেছে। উপান্তে শিল্পী পরিচিতিতে লেখা আছে he loves to paint all that surrounds me'.
এইখানে শ্রীযুক্ত পালের অব্যবহৃত একটি ডকিটিকিট পাওয়া গেল।
৭ই জুলাই শনিবার লেখা আছে—9-30 p.m. আজ হরতাল সেইজন্য সারা সকালদুপুর আমোদ-আহ্লাদে কাটিয়াছে। শ্যামলবাবুর লোকটি আগামী মাসে দোকান কিনিবার টাকা আনিবে।
১৬ই জুলাই- Business আরম্ভ করিয়া বাড়ি যাওয়া 9-30 a.m. মন ভালো নাই।
10-45 a.m. ইংরাজি কাগজ পড়া। একটি পিয়ানো বিক্রয় হইবে। মূল্য ১১০০ টাকা।
দেবতা পূজা। বিকালে ঘুম হইতে উঠিয়া কোনো কাজ হয় নাই। কারণ, শরীরটা ভীষণ খারাপ। যাই হোক খালি গলায় সঙ্গীত করিয়া ঠোঙ্গা করা।
12 a.m. (২২শে জুলাই)--'তারপর বাজার যাওয়া'। 430 a.m, প্রথমে উঠিয়া কোনো কাজ হয় নাই। কারণ শরীরটা ভীষণ দুর্বল। সেইজন্য কাজ হয় নাই। যাই হোক। Account লেখা--ঠোঙ্গা করিয়া পশম কাটা তারপর বাড়ি যাওয়া।
অঙ্ক ও সঙ্গীত। পশম কাটা। খালি গলায় গান ও ইংরাজি কাগজ পড়া। আরও একটি ছাগল দোকানের সম্মুখে আসিয়াছিল। রাম নয়। রামের বংশধর কিনা কে বলিতে পারে। সেও তো অনেক দিন হইল নাই। দেবতা পূজা, Business আরম্ভ।
আজ স্বাধীনতা দিবস। শ্যামলবাবুর লোকটি দর কমাইবার চেষ্টায় আছে। শ্যামলবাবু বলিতেছে—ছাড়িয়া দিন—এরপর দর কিন্তু আরও নামিয়া যাইবে। ঠোঙ্গা করিয়া বাড়ি যাওয়া।
মাঝে একটি ছবি ছিল। নাম ফিশারমেন?
12 a. m, শোকেস রং করিয়া বাড়ি যাওয়া। কাল টিনের কৌটায় রং দিব। 4 p.m. ভাইপোদের জামাকাপড় কেনা। তার পর কাঠ কিনিতে যাওয়া--কয়লা পাওয়া যাইতেছে না।
সন্ধ্যায় Business করিয়া দেবতা পূজা। শ্রীকৃষ্ণের মালা গাঁথা--তারপর ঠোঙ্গা করিয়া বাড়ি যাওয়া।
আরেকদিন—
দুপুরবেলায় শো কেস রং করিয়া বাড়ি যাওয়া।
5-35 p.m, প্রথমে ঐ কাজ হইয়াছে।
5-50 p.m.. প্রথমে ঐ কাজ হইয়াছে।
শ্যামলবাবুর ডায়েরির ছবিগুলি ভাল। একটি মেয়ে ব্লাউজ পরে নাই-- ডান হাতে দড়িতে একটি নধর ছাগল। ছবির নিচে লেখা ডি.ডি. দালাল। ছবির নাম বোঝা যায় না।
পরে ডায়েরির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, ছবিটির নাম 'মুগ্ধ'।
5-30 a.m, প্রথমে উঠিয়া exercise ও ঐ কাজ।
5-43 a. m প্রথমে উঠিয়া কোনো কাজ হয় নাই কারণ আমার শরীর খুব ভালো নয়। যাই হোক। 7 a. m. Business আরম্ভ ও চায়ের টিন রং করা ও তারপর বাড়ি যাওয়া।
5-50 p.m. প্রথমে উঠিয়া exercise এবং ঐ কাজ।
6 P.M. প্রথমে উঠিয়া দাড়ি কামান ও ঐ কাজ।
২৫ শে সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার-- 5 a.m, প্রথমে উঠিয়া গল্পের বই পড়িয়াছি কারণ সারাদিন বৃষ্টি এবং হরতাল হইয়াছে। যাই হোক্।
২৮শে সেপ্টেম্বর-5 a. m প্রথমে উঠিয়া রান্নাঘরে টিন-দেওয়া করিয়া খালি গলায় গান। শ্যামলবাবুর লোক অবনী দত্ত দোকানটি কিনিতেছে। দর এক হাজার নামিয়া গিয়াছে। পাশের ছবিতে একটি অল্পবয়সী ঘোড়া বড় ঘোড়ার পেটে ঢুসাইয়া টুসাইয়া দুধ খাইতেছে। শ্যামলবাবু ছবিটি দেখিয়া বলিয়াছিলেন, ঘোড়ার দুধে দৈ পড়ে না। এইবেলা দোকানটা বেচে দিন।
১২ই অক্টোবর শুক্রবার-4-15 am, প্রথমে উঠিয়া কালীঘাটে পূজা দেওয়া। আজ হইতে অবনীবাবু মালিক। তিনি আমাকে শ্যামলবাবুর সঙ্গে মিশিতে নিষেধ করিয়াছেন। অথচ কাল দুপুরে দুই প্যাকেট সিগারেট বাকি দিয়া ফেলিয়াছি। |
6 p.m.- আজ Translation আরম্ভ করিলাম। টানা করিয়া গেলে ইংরাজি বশ হইবে।
১৯শে অক্টোবর শুক্রবার-- 5-10 a.m. প্রথমে উঠিয়া ইংরাজি কাগজ-পড়া। অবনীবাবু ভিতরে বসেন। আমি পান-সিগারেটের কাছে টুলে বসি। আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা--সেইজন্য আজ বিকালে দোকান বন্ধ থাকিবে। দোকানে প্রথমবার লক্ষ্মীপূজায় পূজা হইয়াছিল।
২০শে অক্টোবর- 5-10 am. প্রথমে উঠিয়া কুকুরের সেবা করা। তারপর কিছু ঘুম। সরকারি ধার শোধ হইতে চলিয়াছে। শ্যামলবাবু পরশু অবনীর নিন্দা করিলেন। লোকটা চামার।
১৫ই নভেম্বর—আজ সম্পূর্ণ বন্ধ ।
২৪শে-ডাকঘরে গিয়া টাকা রাখার নিয়ম জানা--৩০০০ টাকায় ৪২ টাকা সুদ। অবনী জানিতে বলিয়াছিল। আমার যদি থাকত—দোকান করিতাম ।
২৫শে অক্টোবর--আজ ভাইপোদের দেখিতে যাইব। Business করা ও Stockনেয়া করিয়া বাড়ি যাওয়া।
ডায়েরিতে এরূপ আঁকা আছে। আমি আঁকিলাম। ছবিটির নিচে লেখা Birds.
১লা নভেম্বর—আজ দোকানের জন্মদিন। তাং ১৯৫৭ সাল। 5 a.m. প্রথমে উঠিয়া কালীঘাটে যাওয়া—তারপর খাতা লেখা। অবনীবাবু বিশ্বাস করে আমাকে। কিন্তু কালীঘাটে যাওয়ায় বকিল। তার মতে দোকানের জন্মদিন সেইদিন, যেইদিন সে কিনিয়াছে। ভোম্বলের দুরবস্থা যাইতেছে। কিছু টাকা লইয়া গিয়াছে কাল। এখন খিদিরপুর ছাড়িয়া উহারা বেহালায় আসিয়াছে।
Nov. 4 আজ ভাইফোঁটা। প্রথমে উঠিয়া টাকা গোনা। দুপুরে অবনীকে বুঝাইয়া জমা দিতে হইবে।
Nov. ৪, মাখনের জন্য কেস ফাইল হইয়াছে। অবনী নিজে চর্বি মিশাইল—এখন আমার নাম নিজেই পুলিশকে দিতেছে। 9-11-57 কেসের দিন।
6 p.m. আজ মাখনের লাইসেন্স দেওয়ার কথা ছিল। দেয় নাই। আজ চুড়ামণিযোগ ও সূর্যগ্রহণ। শ্যামলবাবুর ডায়েরি শ্যামলবাবুকে দিয়া দিব। 9-30 p.m. শুনিলাম দেশে আমার বুড়া দাদু মারা গেছে।
পরদিন 6•15 p.m, প্রথমে উঠিয়া কোনো কাজ হয় নাই। কারণ আমার পেটে বেৎনা করিতেছিল। অবনীবাবুর জামাইবাবুর কাছে লাইসেন্সের খবর নিব। আমি এখন ৪০ টাকা মাহিয়ানা পাই। অবনীবাবু দেয়। অবনী কোষ্ঠের বেৎনা সম্বন্ধে আলোচনা করিল।
শরীর খুব ভালো নয়। টাটা কোম্পানি বড় কোম্পানি।
মোটামুটিভাবে কয়েকবছর আগের শ্রীযুক্ত বিদুৎচন্দ্র পাল এরকম ছিলেন। এখনও তিনি সেরকম কিনা তা এইবার বলার মতো অবস্থা হয়েছে। এখনও তিনি দোকানে বসেন। বেতন এখন মাসিক ৫০ টাকা। পলস্ ট্রেডিং কোং নাম এখনও আছে। মালিক অবনী ।
শ্রীযুক্ত পালকে জানার জন্যে-- যারা তার কাছে যেতে পারেন বা যাদের যেতে হতে পারে তাদের জন্যে পাড়ার ক'জনে মিলে আমরা একটা খসড়া নিয়মাবলি তৈরি করি : ‘বিদ্যুৎচন্দ্র পাল সম্পর্কে কয়েকটি জ্ঞাতব্য বিষয়।' সাইক্লোস্টাইল করে তার কপিও বিতরণ করা হয়। মূলত এ-পাড়ায় যারা নতুন আসবেন তাদের জন্যেই এটি লেখা হয়। কিন্তু আমার আশঙ্কা, যার ওপর ওগুলো বিলোবার ভার ছিল তিনি শেষ অব্দি তা করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে।
যদিও এখানে সেই নিয়মাবলী অবিকল উদ্ধৃত করতে পারছি না তবু আমার মনে হয়, তার থেকে কিছু মনে করে এখানে প্রকাশ করলে জনসাধারণের উপকার হবে। যেমন—
1. বিদ্যুৎচন্দ্র পাল কে? শ্রীযুক্ত বিদ্যুৎচন্দ্র পাল একজন দোকানদার। তিনি যে কোনো জিনিস একই দামে বেচেন। মোটামুটিভাবে খুচরো সম্পর্কে ক্রেতাকে ব্যতিব্যস্ত করেন না। এ পাড়ায় যিনি নতুন আসবেন তার কোনো না কোনো সময় শ্রীযুক্ত পালের মুখোমুখি হতে হবে। সেই জন্যে যথাবিহিত কারণেই তাদের প্রত্যেককে নিচের প্রশ্নোত্তরগুলোতে মনোনিবেশ করতে বলা হচ্ছে।
Il. বিদ্যুৎচন্দ্র পালকে কি করে চেনা যাবে?
Il. বিদ্যুৎচন্দ্র পালকে কি করে চেনা যাবে?
শ্রীযুক্ত পালের ধুতি মিল-এ তৈরি, কিন্তু গায়ের ফতুয়া নয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে-- ধরেই নেওয়া যেতে পারে, তার মতো তিনজনের পক্ষে মানানসই হলুদ রঙের একটা ফতুয়া পরে থাকবেন। এই জামাটি তার বিভিন্ন কাজে আসে। বার্ষিক দোল উৎসবে সেটি পুনর্জন্মলাভ করে থাকে। এমনও দেখা গেছে, একদিক ভিজে যাওয়াতে তিনি অন্যদিক গায়ে দিয়ে আছেন। আমাদের পাড়ায় ঐ জামা গায়ে কাউকে যদি দেখা যায় তাহলে তিনিই তিনি কিনা সেজন্যে সনাক্তকরণের অন্যান্য পরীক্ষা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
যেমন, মাথার পেছনের চুল পালকের মতো খাড়া খাড়া হলে (ইতিপূর্বে বর্ণিত) মাথা ন্যাড়ার পর সদ্য চুল গজানো কোনো পেসেন্টের সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি, শ্রীযুক্ত পালকেই আপনি খুঁজে পেয়েছেন। এবারে তিনি চোখে হাত দিয়ে চোখের ওপরের দিক্কার ঢাকনায় যদি টান দেন তাহলে তিনিই নির্ঘাৎ তিনি।
III. ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে উৎসাহদান শাখা ও বিদ্যুৎ চন্দ্র পাল।
এই শাখার কর্তা থেকে কর্মচারী সকলেরই সব ব্যাপারে বিভাগীয় নাম অনুয়ায়ী উৎসাহী হওয়ার কথা না। কোনো বৃহস্পতিবার এই বিভাগের লোকজনের কাছে গ্যারান্টার ছাড়াই লজেন্স-বিস্কুট ইত্যাদির দোকান করার জন্যে মৌখিক প্রতিশ্রুতির ওপর ধার চাইতে যদি কাউকে দেখা যায়--যদি দেখা যায় যে, তাকে বসতেও বলা হচ্ছে না-- অফিস-ছুটির সময় যদি তিনি অফিসের সিঁড়ির ওপর বসে থাকেন তবে তিনিই তিনি। দোকান-আইন অনুয়ায়ী পলস্ ট্রেডিং কোং বৃহস্পতিবার পূর্ণ দিবস বন্ধ।
IV. বিদ্যুৎচন্দ্র পাল কোথায়?
তাকে যদি দেখতে পাওয়া না যায় তবে তিনি হারিয়ে গেছেন। কোথায় কোথায় তিনি যেতে পারেন আগে সে সব জায়গা খুঁজে নেওয়াই ভালো। হিজড়েদের আড্ডায় চোরাই জিনিসপত্রের আড়তে কিংবা মেটেবুরুজে পাঁঠা-খাসির কেন্দ্রীয় গোলায় তার মতো দেখতে কাউকে যদি দর-দামও করতে না দেখা যায় তাহলে পলস্ ট্রেডিং কোং-এর উল্টোদিকে তাকে দাঁড়ান অবস্থায় পাওয়া যেতে পারে।
উল্টোদিকে এক ডাক্তারখানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে যদি কেউ একমনে পলস্ ট্রেডিং কোং-কে দেখে যদি তার চোখে গোলাপ বাগান দেখার ছাপ পড়ে তবে তিনি শ্রীযুক্ত বিদ্যুৎচন্দ্র পাল। সেই অবস্থায় তাকে একটু ধাক্কা দিয়ে চালিয়ে দিতে হয়, তাহলেই শ্রীপাল ভাবন্ত অবস্থায় ঠিক দোকানে পৌঁছে যাবেন—কাছে গিয়ে নাক দিয়ে প্রায় গোলাপের গন্ধ শুকবেন।
v. বিদ্যুৎচন্দ্র পাল দোকানে কেন দাড়ি কামান ?
কেউ জানে না। তবে মনে হয় যেদিন তিনি দাড়ি কামান সেদিন তার তাড়াতাড়িতে মাখনের লাইসেন্স আনার কথা থাকে। তবে মনে হয়, এ ব্যাপারে কারও কিছু করারও নেই। ইতিমধ্যে তাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। কেউ যেন সাইকেল চালাতে চালাতে হ্যান্ডেলের ওপর বসান হারমোনিয়ম বাজাচ্ছে---এমনি ধারায় তিনি অনায়াসে দাড়ি কামান। মুস্কিল হলো তিনি ক্ষুর ব্যবহার করেন, বাগানে জল দেওয়ার মতো মুখ-খোলা ঝারির মতো বড় একটা মগ জল থাকে আর তার সাবানে ভীষণ ফেনা হয়।
দাড়ি কামান তার কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটতে পারে না। কোনো কোনো মহল মনে করেন, দাড়ি কামাতে কামাতে তিনি অন্য সময়ের চেয়ে তাড়াতাড়ি খদ্দেরকে দেখাশুনো করতে পারেন। এ এলাকায় নতুন যারা আসবেন তারা যেন ক্ষুর আর জলের বালতি বের করতে দেখে না ভাবেন, অবিবাহিত কোনো প্রৌঢ় বড় কাঁচা পেঁপে কাটতে বসেছেন। কথাবার্তার মধ্যে তিনি যদি ফতুয়া খুলে ফেলে জলের বালতিটা টেনে নেন তাহলেও কারও ভাবার দরকার নেই যে, তিনি এখন তার হাত পায়ের পুরনো আঙুলগুলো কেটে কুটে জলে ধুয়ে কেচে নতুন করতে বসছেন। দাড়ি কামানোর ব্যাপারে তিনি আয়না ব্যবহার করতে ভালবাসেন না—ভাবখানা, এ পথে কতবার এসেছি, আলো লাগবে না। শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে—তিনি যেন কানের পাশে জমাট আইসক্রিমের মতো সাবানের ফেনা নিয়ে ঘুরে না-বেড়ান-বলতে হবে, মুছে নিন।
VI, বিদ্যুৎচন্দ্র পালের হিসেবের দেওয়াল।
গত ষোল বছরে কেউ ধার চাইলে তিনি তাকে ফেরাননি। এমন কি দোকানের কর্মচারী হওয়ার পরেও তিনি এ রীতি বজায় রেখেছেন। ফলে যে জায়গাটায় তিনি বসেন তার পেছনে মাথার ওপরের দেওয়াল যতদিন না চুনকাম করা হয় ততদিন আদ্যোপান্ত সোডা, মাখন, পান, সিগারেট, রিবন এইসব কথায় দু-মাসের মধ্যে ভর্তি হয়ে যায়। যে নেয় তার নামও থাকে। দামও থাকে। শেষ দিকে জায়গা কম পড়ার দরুন তাকে জায়গা করে নিয়ে লিখতে হয়। ফলে দেখা গেছে--কেউ শোধ করতে এসে পানের দামে মাখনের দাম দিচ্ছে—কেননা জায়গার অভাবে পালকে মাখনের পাশেই পানের কথা লিখতে হয়েছে। অবনী দত্ত পলস্ ট্রেডিং কোং-এর মালিকানা পাওয়ার আগে শ্যামলবাবু নিজেই অগ্রণী হয়ে তাকে কলি ফেরানোর রাজমিস্ত্রী যোগাড় করে দিয়েছিল। হস্তান্তরের সেই সময়টায় শ্রীপাল কিছু বিমর্ষ থাকতেন। সেইসময় রাজমিস্ত্রীরা কোং-এর সবকটা দেওয়ালেরই কলি ভালো করে ফিরিয়ে দেয়। বলা দরকার, শ্যামলবাবু যেহেতু বড় বন্ধু সেজন্যে তার ব্যাপারে দোকানের ভেতরে সবচেয়ে বড় দেওয়ালটা তার নামে বরাদ্দ ছিল।
এখন দেওয়ালের হিসেব খাতায় তুলে যোগ দেওয়ার পর অবনী দত্ত রাজমিস্ত্রী ডাকে। সেইসব দিন শ্রীপালকে চিন্তিত দেখায়। নিষেধ সত্ত্বেও দেওয়ালে হিসেব রাখায় অবনী দত্ত তার কাছে নাম, ধাম, দাম এসব জানতে চায়। কেননা, হিসেব মতো সাজাপানের দামে মাখন এবং মাখনের দামে সাজা পান বিক্রি হয়েছে—অবশ্য ক্যাশে পয়সা আসেনি। তাই সেইসব চিন্তিত অবস্থায় শ্রীপাল অবনী দত্তকে স্মৃতি থেকে সাহায্য করেন।
শ্যামলবাবুর নামে দেওয়াল বরাদ্দ করা বারণ।
VII, বিদ্যুৎচন্দ্র পাল ও আয়না।
দাড়ি কামানোর সময় ছাড়া অন্য সময়ে শ্রীপালকে আয়নার দিকে তাকাতে দেখা গেছে। আয়নায় তাকালেই কেবল তিনি চিন্তিত হন না, বিমর্ষ না—বিস্মিত হন। আয়নায় তিনি দেখতে পান যে, তার মুখ বিস্ময়করভাবে গতিশীল। তখন তিনি মুখের উন্নতি করার চেষ্টা করেন। দেখা গেছে, আয়নায় তাকিয়ে তিনি মিনিট-পনেরো ধরে নানারকম মুখ করে যাচ্ছেন—পছন্দমতো একখানা মুখ বেছে নিয়ে তিনি আয়না বন্ধ করছেন।
অবনী দত্তর দোকানে সব বিক্রি হয়—আয়না হয় না।
VIII. ট্রামে বিদ্যুৎচন্দ্র পাল।
যেখান থেকেই তিনি উঠুন না কেন, কোনো স্টপে কাউকে নামতে দেখলে তিনি নিজেকে ঠেকাতে পারেন না। তাঁকেও নেমে পড়তে হয়। ফলে, ট্রামে তার কোথাও যেতে হলে সবসময় তার আগে বসা উচিত। তাহলে সময়মতো জায়গায় পৌঁছোন যায়। কেননা, তাকে নেমে পড়তে দেখলে পেছন থেকে তাড়াতাড়ি টেনে ধরার সুবিধে হয় আগে বলে।
IX, বিদ্যুৎচন্দ্র পাল ও নাক-মুখ-কান।
কখনও যদি পালকে দেখা যায় যে, তিনি দুহাতে নাক-মুখ-চোখ-কান চেপে ধরে রাখবার চেষ্টা করছেন তাহলে বুঝতে হবে শ্রীপাল তার বিপদের দিনের সম্মুখীন হয়েছেন। তার বিশ্বাস—তখন তার নাক-মুখ-চোখ-কান ফাঁকি দিয়ে জায়গা বদলাচ্ছিল বা সরে সরে মুখেরই অন্যত্র গিয়ে বসবার ফিকিরে ছিল। সুখের কথা, বছরে এরকম বিপদের দিন খুব কদাচিৎই আসে। সেইসব দিনে অবনী দত্তও তাকে ছুটি দেয়।
X. বিজনেস ম্যাগনেট বিদ্যৎচন্দ্র পাল।
পলস্ ট্রেডিং কোং-এর স্বত্বাধিকারী থাকাকালীন শ্রীপাল কখনো কখনো এই ভূমিকা নিতেন। এখন যদি হঠাৎ কেউ তাকে দুপুরের দিকে টাটা কোম্পানির বিভিন্ন ব্যবসায় উদ্যোগের কথা গড় গড় করে বলতে দেখে—কিংবা কোটি কোটি টাকার অঙ্ক মুখে মুখে যোগ দিতে শোনে তবে তার ঘাবড়াবার কিছু নেই।।
শ্যামলবাবুর দেওয়া ডায়েরির যুগে ফিরে গেলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
স্বত্বাধিকারী থাকাকালীন একটি দুপুর :
১৯৫৬ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শ্রীপাল জলবিদ্যুৎ সরবরাহ ও লৌহখনিসমূহের শেয়ারের সিংহভাগের অধিকারী বলে নিজেকে মনে করতেন।
সেই সময় শ্যামলবাবু একদিন দোকানে ঢোকামাত্র শ্রীপাল বলেছিলেন, “আমি জামসেদজি টাটা। আমি গরুমহিষানি পাহাড়ে লোহা তুলতে যাচ্ছি। ঐ যে ক্রেন। এখন প্রমথ বসু কোথায় ? সেই বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার কোথায়? আপনিই শ্যামলবাবু, আপনিই প্রমথ বসু? এই জনমানবশূন্য পাহাড়ি এলাকা একদিন তিন লক্ষ লোকের শহর হয়ে উঠবে।”
শ্যামলবাবু ক্রেনের জায়গায় লজেন্সের বয়মগুলো দেখতে পেয়েছিলেন। জায়গাটা জনমানবশূন্য করার জন্যে পুরো এক র্যাক সাবান, বিস্কুট, ঘুড়ির আলমারিতে সরান হয়েছিল।
আরেকদিন
“আমি রাজস্থানের রাজা বলদেও দাস-বিড়ালাদের বাবা। এখন আমি বোম্বাই-এ তুলাপট্টিতে! ঐ যে আমার প্রথম কাপড়ের কল। এই যে আমার শত্রু ব্রিটিশ বিজনেসম্যানরা। এখন প্রশ্ন হলো যেখানে আমি আছি সেখান থেকে আমার শত্রুদের আমি দেখতে পাচ্ছি কি পাচ্ছি না?”
সেইদিন দোকানের সব কিছু স্থানচ্যুত হয়েছিল। পুরোপুরি একটা ব্যবসায় সাম্রাজ্যের উত্থানের গোড়ার দিকের কাহিনী।
তখন শ্রীপাল যদি দোকানের প্লাস্টিকের ঝোলাগুলো একত্র করতেন তাহলে তিনি তখন কয়লা শিল্পে নিয়োজিত-- ব্যাগে করে পাতাল থেকে কয়লা তুলছেন—ঝরিয়া কোলফিল্ডের প্রথম দিক্কার ইতিহাস গোড়া থেকে শুরু হতো সেদিন।
অবনী দত্ত পলস্ ট্রেডিং কোং-এর মালিক হওয়ার মুখে মুখে শ্যামলবাবুর সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করেন—এসব পরে এ্যালাউ করা হবে কি না? স্থির হয়—হবে।
তবে, ভবিষ্যতের ক্রেতাদের মুখ চেয়ে কতগুলো বাধা-নিষেধ অবনী দত্ত আরোপ করে।
A. তিন বয়ম উঁচু ক্রেন শ্রীবিদ্যুৎচন্দ্র পাল যেন আমদানী না করেন।
B. অতিরিক্ত কয়লা উত্তোলনের ফলে প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো যাতে ময়লা না হয় সেজন্যে দুটোর বেশি ব্যাগ একসঙ্গে একদিনে এ কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
C, বাণিজ্য সাম্রাজ্যের পতনের দিনে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় মেঝেতে শুয়ে দুঃখ করা যাবে না। বাড়িটা পুরনো--ড্যাম্প লেগে বুকে সর্দি বসতে পারে।
D. যেসব ডায়েরির পেছনে বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিবরণ থাকে সেসব ডায়েরি
পাল উপহার নিতে পারবেন না। কারণ, ঐসব বিবরণে অতিরিক্ত পরিমাণে টাকার অঙ্ক থাকায় শ্রীপাল নতুন কাগজের দিস্তে নামিয়ে তাতে যোগ দিতে বসতে পারেন।
আন্তর্জাতিক সাবান কোম্পানির সেলসম্যান তাকে একখানা নোটবই দিয়েছিল। তাতে এত বড় সব অঙ্ক ছিল যে শ্রীপাল কাগজ ছেড়ে শেষ অব্দি নতুন স্লেটগুলো ভর্তি করে ফেলেছিলেন যোগে যোগে।
E, বিজিনেস টাইকুনদের পাল্টা আক্রমণে, বিশেষত শেয়ার মার্কেটের যুদ্ধে দয়া করে ‘পানিহাটি জুট মিলের’ নাম অথবা অন্য কোনো লাটের শেয়ারের কথা বলবেন না। ফলে, শ্রীপাল ঐ শেয়ারটি অধিকারের জন্যে লাফ দিয়ে পড়তে পারেন। দোকানে বেশি দামের অনেক ফ্যান্সি জিনিস থাকে।
XL. বিদ্যুৎচন্দ্র পালকে দিয়ে আমরা কি করতে পারি?
পলস্ ট্রেডিং কোং-এ কারও চাকরি যাক ক্রেতাসাধারণ তা চান না। বিশেষত, কর্মচারী যখন একজন এবং সেই কর্মচারী যখন এই এলাকায় উপকথার মহিমা অঞ্জন করেছেন--তখন, তার সঙ্গে কথা বলার জন্যেও পাড়ার দু'চারজন দোকানে আসবেনই। ফলে, এই বিপণীতে বিক্রয়ের হার ন্যূন নয়। অবনী দত্তও ব্যাপারটা বোঝে।
তাছাড়া, কর্মচারী হলেও শ্রীপাল এখনও হিসেবের দেওয়াল রাখার রীতি বজায় রেখেছেন। অবশ্য শ্যামলবাবুর জন্যে আর কোনো দেওয়াল বরাদ্দ নেই।
0 মন্তব্যসমূহ