স্মৃতি ভদ্রের গল্পঃ পদ্মপুকুরে রাণী ভিক্টোরিয়া


কোজাগরী পূর্ণিমার আলোমাখা রাতে জন্ম মেয়েটির। শোনা যায়, বাড়ির পুকুরে সেদিন কয়েকটি লাল পদ্মও ফুটেছিলো। জন্মক্ষণের সঙ্গী বলেই কীনা মেয়েটির সাথে অদ্ভুত সখ্যতা লাল পদ্মের।

দাদু দীনেশ ভাদুরী একটি রূপোর মুদ্রা দিয়ে তার জ্বলজ্বলে মুখখানা দেখে ডেকেছিলেন ' আলোরাণী ' বলে। রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতিচ্ছবি আঁকা মুদ্রাটি দিতে দিতে দাদু প্রার্থনা করেছিলেন, 'আলো, রাণী হয়ে উঠুক।'

১৮৬৮ সালের এই রুপোর মুদ্রাটি দাদু পেয়েছিলেন পোদ্দার বাড়ির শেষ দূর্গাপুজায়। সেটা উনপঞ্চাশ সালের ঘটনা। দেশভাগের বছর দুয়েক পর।

শেরপুরের পোদ্দার বাড়িতে তখনো দেশভাগের আঁচ আসেনি। বা এভাবেও বলা যায়, দেশভাগ পোদ্দার বাড়ির জৌলুসে সেভাবে আঁচড় কাটেনি। সে বাড়ির ত্রিশ বছরের পুরাতন একচালা দূর্গাপুজায় তখনো দেবীর সাজসজ্জা আসে কোলকাতা থেকে।

শুধু সাজ-সজ্জাই নয়, সে বাড়ির পুজোর নাম আশেপাশের পাঁচ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার আরোও একটি কারণ ছিল। তা হলো, পুজোর চারদিন কলাপাতায় ভোগ খাওয়া। আতপের ভোগের সে সুবাস সত্যি সত্যিই পাঁচ গ্রামের বাতাসে উৎসব ছড়িয়ে দিতো।

সে ভোগ আর মোয়া-মুড়কির জন্য ধান গরুর গাড়িতে করে পোদ্দার বাড়িতে পৌছে দিতো সাত্তার হোসেন। পোদ্দার বাড়ির সকল আবাদি জমির দেখভালের দায়িত্ব ছিল তার।

শুধু সে দায়িত্বই নয়, পোদ্দার বাড়ির ষষ্ঠীর দিনে ঘট বসানোর সময় ঢাকে প্রথম বাড়ি দেবার দায়িত্বটাও তো ওই সাত্তার হোসেনেরই ছিল। পোদ্দার বাড়ির সাথে সাত্তার হোসেনের সম্পর্ক আত্মার।

প্রতিবারের মতো উনপঞ্চাশের পুজোতেও সাত্তার হোসেন ধান,চাল নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলো কাঠাম পুজার দিনেই। এরপর মাস ধরে খড়ের কাঠামোয় এঁটেল মাটির প্রলেপ, রঙ তুলির আচড়ে ত্রিনয়নী গড়া দেখতে দেখতে মনের ভেতর একটি ইচ্ছা পুষেছিলো সে। পরের বছর পরিবার নিয়ে আসবে। ঈদ ছাড়াও এই সংসারে আরোও কত রঙীন পরব আছে তা দেখাবে তাদেরকে।

এরপরের বছর তার পরিবার সেখানে এসেছিলো ঠিকই কিন্তু ততদিনে সেই পরব রঙ হারিয়েছে।

সে রঙ হারানোর কথায় পড়ে আসা যাবে। এখন বরং রুপোর মুদ্রাটির কথায় ফেরা যাক।

দীনেশ ভাদুরী তখন মধ্য তিরিশের। এ পাড়া ও পাড়ায় পুজা করে বেড়ান। পোদ্দার বাড়ির দূর্গাপুজা ছিল তাঁর বাবার বাঁধা।

বাবা মারা যাবার পর পুজার দায়িত্ব পান তিনি।

সেবারই পোদ্দার বাড়িতে প্রথম দূর্গাপুজা ছিল তাঁর। আগের বছরগুলোর মতোই জমজমাট সে পুজো। ধুপ, ধুনো আর আতপের গন্ধ বাতাসে ভাসিয়ে চলেছিলো সে পরব। আর পরব শেষে দক্ষিণা হিসেবে অনেকগুলো তামার মুদ্রার সাথে এই একটি রুপার মুদ্রাও দেওয়া হয়েছিলো দীনেশ ভাদুরিকে।

রুপোলী সে মুদ্রায় ঝকঝক করছিলো রাণী ভিক্টোরিয়া। আপাত তার কোনো বিনিময় মুল্য ছিল না। কিন্তু তা না থাকলেও ফুটফুটে একটা আলো ঠিকরে পড়ছিলো সে মুদ্রা থেকে। রাণী ভিক্টোরিয়ার সে আলোয় ঘোরমগ্ন হয়ে যান দীনেশ ভাদুরী। টুপ করে মুদ্রাটি তুলে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেন।

সেই আলোময় রুপার মুদ্রাটি ঠিক কী কারণে তিনি ওভাবে টুপ করে মুঠোয় পুরেছিলেন, তার উত্তর পাওয়া যায় অনেকদিন পর।

আলোরাণীর জন্যই তিনি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন মুদ্রাটি।

দীনেশ ভাদুরীর একমাত্র নাতনী আলোরাণী। চারপাশে আলো ছড়িয়েই আলোরাণী বড় হয়।

তবে সে আলোয় শুধু চারপাশই আলোকিত হলো, আলোরাণীর জীবন ঠিক সেভাবে উজ্জ্বল হলো না।

বেড়ে ওঠার পদে পদে মা, ঠাকুমা, বাবা আর ছোটভাইকে হারানোর অন্ধকারটুকু পোচ পোচ বিষণ্ণতা হয়ে বসত গড়লো তার জীবনে।

তবুও তার আলো ছড়ানোয় কমতি এলো না। বরং দিনে দিনে সে আলোর খবর আশেপাশের সব গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো।

ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মতো মেয়েটি আষাঢ়ে মেঘের মতো একঢাল চুল বাতাসে ভাসিয়ে যখন তখন গান ধরে,

ওরে নীল যমুনার জল
বল রে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম,
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।

লোকে বলে, আলোরাণী এই সুর তুললেই চারপাশ ভেসে যায় চন্দনের সুবাসে। আর তা হবেই বা না কেন। এই সুরই তো তার সবচেয়ে আপন। সে দুঃখ পেলেও গুনগুনিয়ে ওঠে আবার খুশি হলেও গুনগুনীয়ে ওঠে। আলোরাণীর হাসি-কান্না সব ওই সুরেই সমাহিত।

আর গলায় সুর তুললেই আলোরাণীর মুখখানা অবিকল হয়ে ওঠে রাধারানীর মতোন।

২.

হোসেন মঞ্জিলের উঠোনে আজ বড় ভীড়। পেছন বাড়িতে বড় বড় হাড়িতে রান্না হচ্ছে। খাসির মাংস, মাসকলাই ডালের খিচুড়ি আর গুড়ের পায়েস। এ সবই হোসেন সাহেবের পছন্দের খাবার।

তার ছেলে আশেপাশের সব গ্রামে থেকে অভাবী মানুষগুলোকে ডেকে আনিয়েছে। দুপুরে ভরপেট খাইয়ে আব্বার জন্য দোয়া করিয়ে নেবে।

দীনেশ ভাদুরী ছোট ছোট পা ফেলে সে বাড়ির বেলগাছটার নীচে দাঁড়ায়। তার সময়ের মানুষগুলো একে একে সব হারিয়ে যাচ্ছে। এ বাড়ির মতো হোসেনও তার বড় কাছের ছিল।

একসময় প্রতি সন্ধ্যায় এই বাড়ির বাইর উঠোনে আসতে হতো তাঁকে। হোসেনই তাঁকে ডাকিয়ে আনতো। এরপর করণীয় সব বুঝিয়ে উঠোনের একপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো। দীনেশ ভাদুরী তাঁর কাজ শেষ করতেই দু'পা এগিয়ে এসে বলতো,

' তাঁদের জন্য দোয়া করছেন তো? মানুষগুলোর সম্মানই আমার সম্মান। তারা তাগো সম্মান ফিইরা পাক।'

দীনেশ ভাদুরী মাথা ঝাঁকিয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বলতেন,

' হোসেন, আমি তোমার জন্যও দোয়া করি। তাঁদের সম্মানের সাথে সাথে তোমার সম্মানও বাড়ুক।'

এ কথা অবশ্য ষাটের দশকের। তখনো এ বাড়ির নাম 'হোসেন মঞ্জিল' হয়নি।

এক অদ্ভুত সময় তখন। দেশের ভেতরে ঘটে যাচ্ছে অনেককিছু। কিছু সরবে, কিছু নীরবে।

ততদিনে যোগেন মন্ডল পালিয়ে গেছেন ওপারে। জিন্নাহর উর্দূকে চাপিয়ে দেবার কৌশল ব্যর্থ হয়ে গেছে । আবুল কাশেম ফজলুল হক তখন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাষণের দাবী তুলেছেন।

আর ওদিকে নীরবে তৈরী হচ্ছেন আর এক নেতা। বাওরের দেশে।

ঠিক এমন সময়েই একদিন নীরবে এ বাড়ির ফটকে নামফলক বসে। হোসেন মঞ্জিল। শাদা পাথরের উপর কালো রঙে বাংলা আর উর্দূ হরফে লেখা।

আর তারপরের সন্ধ্যাতেই দীনেশ ভাদুরীকে ডেকে আনেন হোসেন সাহেব। এতদিন ধরে করে আসা কাজের বাকী পাওনাদি মিটিয়ে দেন। সাথে এ বাড়িতে আসার উপলক্ষ্যটাও দীনেশ ভাদুরীকে বুঝিয়ে দেন,

' সময় বদলাইতেছে। এখন এসবকিছু এ বাড়িতে রাখা ঠিক হইবো না। আপনি যত্নে রাইখেন।'

যত্নে রাখার কথাতেই বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন দীনেশ ভাদুরী।

তবে আলোরাণী সে বিড়ম্বনা থেকে উদ্ধার করেছিলো দাদুকে। আর তা করবেই বা না কেনো?
'হোসেন মঞ্জিল' এর পরিত্যক্ত জিনিষটা এ বাড়িতে সর্বস্ব হয়ে উঠেছিলো যে। আর সর্বস্ব করে তুলেছিলো স্বয়ং আলোরাণী।

দাদু আর তার ছোট্ট নিস্তরঙ্গ সংসার। সে সংসারে অগুনতি অলস সময়। তা শুধুই হাপ ধরায়। সেই হাপধরা জীবনে ব্যস্ততার উছিলা পেলো আলোরাণী।

তবে আলোরাণীর ব্যস্ততা বাড়লেও অলস সময় বেড়েছে দীনেশ ভাদুরীর। যজমান বাড়ি কমে যাচ্ছে একের পর এক। এ পাড়া ও পাড়ায় দু'একটি বাৎসরিক পুজা দিয়েই টিকে আছেন তিনি।

এতটুকুর মধ্যেও দীনেশ ভাদুরীর যেটুকু ভাল থাকা তা ওই হোসেনের কারণেই। প্রতিমাসে নিয়ম করে কিছু টাকা দীনেশ ভাদুরীকে দিয়ে হোসেন বলতো,

' আমি যতদিন বাঁইচ্যা আছি এই নিয়মের হেরফের হইবো না। তাঁরা যে দায়িত্ব আমারে দিয়া গেছে আমি যেন শেষ শ্বাস পর্যন্ত তা পালন করতে পারি।'

পেরেছিলেন পালন করতে হোসেন সাহেব। তবে তা ঐ শেষ শ্বাস পর্যন্তই। হোসেন সাহেবের শেষ শ্বাসের সাথে সাথেই সব নিয়ম বদলে যায় 'হোসেন মঞ্জিল' এর।

তাই তো সারা দুপুর বেল গাছটার নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ এগিয়ে আসে না। এক গ্লাস গুড় আর লেবুর শরবত দিয়ে কেউ দীনেশ ভাদুরীকে বলে না,

' আপনে বাইর বাড়ি থেইক্যাই ফিইর‍্যা যান। জানি, এই ইমারতের বারান্দাখানাই আপনের পছন্দের জায়গা। তাগোও খুব পছন্দের জায়গা ছিল এইটা। সকলের লগে কাইজ্যা কইরা এই ইমারতটুকু বাঁচাইয়া রাখছি। কইয়া দিছি, আমার শ্বাস যতদিন থাকবো ইমারতখানাও এমনিই থাকবো।'

হোসেন সাহেবের কথাই সত্যি ছিল। তাঁর শ্বাস থেমেছে আজ চল্লিশ দিন। এরমধ্যেই সেই ইমারতও ভাঙা শুরু হয়ে গেছে। সেখানে একটা বড় বসার ঘর তৈরী হবে।

হোসেন সাহেবের ছেলে সোবাহান। বড় ব্যবসায়ী। করাচী থেকে তার এ পার্টনার ও পার্টনার প্রায়ই আসে। তাদের আপ্যায়নের জন্যই মূলত ঘরটির প্রয়োজন।

সেই ভাঙা ইমারত থেকে এক টুকরো ইট হাতে নিয়ে দীনেশ ভাদুরী যখন ফিরে আসছিলেন তখন মনের মধ্যে একটা কথাই বেজে চলছিলো,

' এ বাড়ির সাথে সম্পর্কের ক্ষীণ সুতোটাও আজ ছিঁড়ে গেলো।'

না, ভুল ছিলেন তিনি। হোসেন মঞ্জিলের সাথে সবকিছু চুকেবুকে যায় না দীনেশ ভাদুরীর। বরং এ বাড়ির সাথে আরোও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায় দীনেশ ভাদুরীর জীবন।

৩.

বৃদ্ধ দীনেশ ভাদুরীর অলস জীবন আরোও নিস্তরঙ্গ হতে শুরু করেছে। যজমান প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। যাও বা আছে দু'এক ঘর তাও খুব দরিদ্র।

একটি লাউ, একটি কুমড়ো, কয়েক জোড়া নারকেল আর পোয়া খানেক চালে এসে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণা।

তবে সে দারিদ্রতার মাঝেও কীভাবে যেন দিনকে দিন আলোরাণী আরোও ঐশ্বর্যময়ী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এলোচুলে আলতা মাখা পা দুটো যখন পদ্মপুকুরে ডুবিয়ে বসে থাকে, তখন ফুটে ওঠা পদ্মগুলোর সাথে তাকে কোনোভাবেই পৃথক করা যায় না।

আলোরাণীর সাথে পদ্মফুলের এই যোগসূত্র তো সেই জন্মক্ষণ থেকে।

সে যোগসূত্রের সত্যতা মেলে আরোও একটি দিনের ঘটনায়। দীনেশ ভাদুরী সেইদিন থেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, আলোরাণীর সাথে এই বাড়ির পদ্মপুকুরের এক অদ্ভুত সম্পর্ক আছে।

সে বছর বর্ষা খুব রয়েসয়ে বিদায় নিয়েছিলো। পুকুর আর বাড়ির উঠোনের সীমানাটুকুও উহ্য হয়ে গিয়েছিলো কিছুদিনের জন্য।

আলোরাণীর তখন মাত্র বছর চারেকের। সুর দিয়ে চারপাশ মুখর করতে শুরু করেছে ততদিনে।

সালটা তখন উনষাট। পাক-ভারতের যুদ্ধ তখনো হয়নি। সীমান্ত খোলা। আর সেই খোলা সীমান্ত অনবরত হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে ওপাড়ে যাবার মানুষগুলোকে।

এ বাড়ির লাগোয়া নিয়োগী বাড়ি একরাতে আচমকা ফাঁকা হয়ে যায়। ফাঁকা সে ভিটে দেখে দীনেশ ভাদুরী বিরক্ত হয়ে গলার রগ ফুলিয়ে বলেছিলেন,

' দীনেশ ভাদুরীর শেষ কাজ এই মাটিতেই হবে। মাটির মায়া কী সকলের থাকে?'

মাটির মায়া কী তা বোঝার বয়স আলোরাণীর তখনো হয়নি। তবে জলের সাথে ততদিনে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তার।

দু'একবার সকলের চোখের আড়াল দিয়ে সে পৌছেও গিয়েছে পদ্মপুকুরের পাড়ে। সারাবাড়িতে কোথায় পাওয়া না গেলে পদ্মপুকুরের জল ঘেঁষেই তাকে বসে থাকতে দেখা যাবে, তা ততদিনে চাউর হয়ে গেছে।

তবে প্রথমদিন দীনেশ ভাদুরী চমকে গিয়েছিলেন। অতটুকুন মেয়ে ঘাটের শেষ সিঁড়িতে বসে পা জলে ডুবিয়ে চুপচাপ পদ্মফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। নিঃশ্বাস আটকে সেদিন পদ্মপুকুরের ঘাট থেকে আলোরাণীকে তুলে এনেছিলেন দীনেশ ভাদুরী।

এরপর প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটতে থাকলো।

যে পদ্মপুকুরের টান আলোরাণীকে বারবার জলের কাছে নিয়ে যায় সেই পুকুরই যখন বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হয়, তখন সে কী করতে পারে তা অবশ্য ভেবে উঠতে পারেনি ভাদুরী বাড়ির কেউ।

সেদিন আলোরাণী বারান্দাতেই ছিল। বাড়ির সকলে এ কাজে ও কাজে ব্যস্ত। একটু আগেও আলোরাণীর হাতের রুপার বালাগুলোর ঝুনঝুন শব্দ বাতাসে ভাসছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই শব্দ থেমে গেছে সবার অগোচরে।

খানিক সময় পর যখন সবার খেয়াল হলো তখন কোথাও নেই আলোরাণী। এ বাড়ি ও বাড়ি খুঁজে সবাইকে অবাক করে আলোরাণীকে পাওয়া গেলো পদ্মপুকুরের মাঝখানে। কয়েকটি লাল পদ্মের মাঝে রাণীর মতো ভেসে আছে সে। হাতের মুঠোয় একটি লালপদ্ম। জলে ভাসছে আলোরাণী।

দীনেশ ভাদুরী সাঁতরে গিয়ে যখন আলোকে নিয়ে ফিরছিলো তখনও তার মুঠোয় ধরা লাল পদ্ম। আলোরাণীর হাতের রূপোর বালাগুলোর ঝুনঝুন সুরের সাথে পদ্মগুলোও সেদিন নেচে নেচে উঠছিলো।

আলোরাণীকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতেই দীনেশ ভাদুরীর খেয়াল হলো, সকাল অব্দি এই পুকুরে একটিও পদ্ম ছিল না। চিন্তার ভাঁজ কপালে ফেলে সেদিন দীনেশ ভাদুরী বলেছিলেন,

' মেয়েকে এই পদ্মপুকুর থেকে সাবধানে রেখো, বৌমা।'

আলোরাণীর মা অবশ্য সাবধানে রাখার দায়িত্ব বেশিদিন পালন করতে পারেননি। এর বছর সাতেক পরেই তিনি আলোরাণীকে নিজের ছোট ছেলের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।

সাল তখন ছেষট্টি। পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে ততদিনে। পাশের নিয়োগী বাড়ি তখন শত্রু সম্পত্তির তালিকায়।

তবে শত্রু বা মিত্র নিয়ে মাথা ঘামানোর আগেই আলোরাণীকে দায়মুক্ত করে সেই ছোটভাইও চলে গেলো। নিয়োগী বাড়ির কামিনীর ঝাড়ের পাশে ভাইয়ের নীল শরীরখানা আলোরাণীকে কতটুকু হতবাক করেছিলো তা কেউ না জানলেও সেদিন রাতে আলোরাণীর গলার সুর সবাইকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিলো।

এত শোকের সময়েও কেউ কীভাবে গাইতে পারে,

ওরে নীল যমুনার জল
বল রে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম,
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।

আর সে শোক স্তিমিত হতে না হতেই শীতে হারিয়ে যায় আলোরাণীর বাবাও।

এরপর ভাদুরী বাড়িতে যেটুকু গুঞ্জরন তা ওই আলোরাণীর সুর আর দীনেশ ভাদুরীর উচ্চারিত মন্ত্রের।

তবে ভাদুরী বাড়ি নিরুত্তাপ হলেও আশেপাশের গ্রামে যত শোরগোল কিন্তু এ বাড়িকে নিয়েই। আর তা শুধুমাত্র আলোরাণীর জন্য। আলোরাণীর সুন্দর মুখখানার জন্য। আলোরাণীর সুরের জন্য।

তবে দেশ ততদিনে বেসুরো হতে শুরু করেছে পুরোপুরি।

সালটি একাত্তর। ততদিনে বাওরের দেশের নেতার নাম ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।

আর এদিকে দাদু দীনেশ ভাদুরী যতই আশীর্বাদ করে থাকুন না কেন, আলোরাণীর কিন্তু রাণী হয়ে ওঠা হয় না।

বরং সে পরী হয়ে ওঠে। চন্দনের সুবাস ছড়িয়ে পদ্মপুকুরের পাশে বসে আলোরাণী আলো ছড়ায়। সে আলো অবশ্য রূপার মুদ্রার সেই রাণী ভিক্টোরিয়ার মতোই ফুটফুটে।

৪.

দেশ দ্রুত পালটে যাচ্ছে। আর তার মানুষগুলোও।

সেদিন বাজারে হোসেন সাহেবের ছেলের সাথে দেখা হয়েছিলো দীনেশ ভাদুরীর। তবে তা হঠাৎ করে নয়। সোবাহানই খুঁজে বের করেছিলো তাঁকে।

---কাকা, আপনার কাছে আব্বা যে জিনিষটা রাইখ্যা গেছে, ঐটা লাগবো আমার।

---কোন জিনিষ?

--- পাথরের মূর্তিটা

--- তুমি কী করবে তা দিয়ে, আমি তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছি। নিয়মিত পূজা করি।

---ওই বাড়ির সবজিনিষে আমাগো হক। এতদিন দেইখ্যা-শুইন্যা রাখছি। কথা বাড়ায়েন না। আমি ওইটার বদলে পিতলের মূর্তি কিইন্যা দিমু আপনারে।

সোবাহান আর দাঁড়ায় না। সামনের বৃহস্পতিবারের মধ্যে মূর্তি দিয়ে দিতে হবে জানিয়ে, হনহন করে হেঁটে চলে যায়।

সে আদেশ অবশ্য দীনেশ ভাদুরীর কান অব্দি পৌঁছায় না।

তিনি ততক্ষণে ওই বাড়ির সকল জিনিষ কীভাবে সোবাহানের হয়ে উঠলো সে ভাবনায় মত্ত।

১৯৫০ সাল তখন। পোদ্দার বাড়ির নামডাক তখনো একইরকম। গ্রামের সকলেই খুব মান্য করে সে বাড়ির মানুষগুলোকে।

সে মান খুব সহসাই হারিয়ে যাবে, তা তখনো অজানা পোদ্দার বাড়ির মানুষগুলোর।

মাঘ পেরিয়ে ফাগুন এসেছে সবে। সরস্বতী পূজার জন্য মূর্তি তৈরী হচ্ছে। সাদা রঙের শেষ প্রলেপ পড়ছে তখন দেবীর বাহন হাঁসে। দুপুর পুরোপুরি মধ্য হয়নি। পোদ্দার বাড়ির উনুনে দুপুরের রান্না উঠেছে সবে।

এমন সময় সাত্তার হোসেন হন্তদন্ত এসে উপস্থিত হয়।

---বাড়ির বাবুরা কই? তাড়াতাড়ি আপনেগো এ বাড়ি ছাড়তে হইবো। জুমপুরের সাহা বাড়িতে হামলা হইছে। তিনবাবুরে মাইর‍্যা বাড়ির লগে পোড়াইয়া দিছে।

এসব ঘটনা সেই দেশভাগের আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তাই বড় বাবু যোগেশ্বর পোদ্দার গলায় সাহস ঢেলে বলেন,

---সাত্তার, শেরপুরের কেউ পোদ্দার বাড়ির দিকে কুনজরে তাকায় না।

সাত্তার হোসেন অসহায়ের মতো ডুকরে কেঁদে ওঠে,

--- বড় বাবু, এসময় কাউরে বিশ্বাস নাই। আপনেগো মান আমার নিজের মান। সবকিছু ঠিক হইয়া গ্যালে আমি নিজে আপনেগো খবর করুম। আমার কাছে খবর আছে, আজ রাতেই ওরা আপনেগো বাড়িত হামলা করবো।

সাত্তারের আকুতিতে কিছু একটা ছিল।

সেদিন বেলা পড়ে আসার আগেই পোদ্দার বাড়ির সকলে প্রায় এক কাপড়েই ছেড়ে চলে যায় সে বাড়ি, এ দেশ।

তবে যাবার আগে বাড়ির কষ্টিপাথরের রাধা গোবিন্দের নিত্য পূজার দায়িত্ব দিয়ে যায় দীনেশ ভাদুরীকে।

আর বাড়ি দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব পায় সাত্তার হোসেন।

পোদ্দারদের গরুর গাড়ি গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেলেও বড়বাবুর কন্ঠস্বর ভেসে আসা বন্ধ হয় না,

' সাত্তার, পুকুরের চারপাশের আগাছাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করিস। বাগানের নারকেল গাছগুলো ছাটানোর সময় হয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরে আরতির সময় সন্দেশ ভোগ দিতে হয়।'

দীনেশ ভাদুরীর দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে গেলো সাত্তারের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলোর কাছে,

' কিচ্ছু ভাইবেন না বাবু, সব ঠিক হইলেই খবর পাঠামু। ঢাক বাজাইয়া আপনেগো গ্রামে ফিরাইয়া আনমু।'

সবকিছু ঠিক হবার অপেক্ষায় সত্যিই ছিল সাত্তার হোসেন। এমনকি পোদ্দার বাড়ির গাছের খবর, পুকুরের খবর, গরুগুলোরও খবর নিয়ম করে পাঠাতো বড়বাবুর কাছে,

বাবু, এবছর ৫০জোড়া নারকেল পাড়িয়েছি। পুকুরের চারপাশ সাফ করিয়েছি। লাল গরুটার বাছুর হয়েছে।

এরপর......

বাবু, এবার বাইর বাড়ির গাছে মিষ্টি কাঁঠাল কম এসেছে।

তারপর......

বাবু, মন্দিরে দীনেশ ভাদুরীকে দিয়ে আপনাদের সুস্বাস্থ্য কামনায় ভোগ দিয়েছি।

আর সাত্তারের একদম শেষ চিঠি বড়বাবুর কাছে.....

বাবু, বাড়ির সব খবর ভাল।

বিস্তারিত কথার পরিমাণের সাথে কমে আসে সাত্তারের অপেক্ষাও। তবে বাবুদের প্রতি সম্মান কিন্তু কমেনি মোটেও। বরং ওপারে চিরস্থায়ী হয়ে যাওয়া বাবুদের সম্মানের কথা ভেবে আকুল হয়ে উঠতেন ততদিনে হয়ে ওঠা 'হোসেন সাহেব'।

তাই তো প্রতি সন্ধ্যায় দীনেশ ভাদুরী মন্দিরে আরতি করতে এলে, বাবুদের হৃত সম্মানের জন্য বারবার প্রার্থনা করিয়ে নিতেন।

সাত্তার হোসেন ততদিনে জেনে গিয়েছেন সবকিছু আর কখনই আগের মতো হবে না। তাই নিজের বংশধরের জন্য আবাস ও ভবিষ্যৎ পোক্ত করতে পোদ্দার বাড়ির নাম পালটে রাখেন ' হোসেন মঞ্জিল'।

'হোসেন মঞ্জিল'-এ আর যাইহোক রাধাগোবিন্দের পূজা সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে, বাবুদের গৃহদেবতাকে হেলাও সে করতে পারবে না। তাই দীনেশ ভাদুরীর হাতে তা বুঝিয়ে দিয়ে মাসে মাসে কিছু টাকা দিয়ে দিতেন তিনি।

আর ঠিক এই একই আবেগ থেকে শেষ শ্বাস অব্দি রক্ষা করেছিলেন বাইর বাড়ির মন্দির টাও।

তবে পোদ্দার বাড়িকে ঘিরে হোসেন সাহেবের সে আবেগ প্রবাহিত হয়নি সোবাহান পর্যন্ত। সাত্তার হোসেনের সাথে সাথেই সে আবেগ মিলিয়ে গেছে পঞ্চভূতে।

সোবাহানের সে আবেগ না থাকলেও অধিকার আছে। সে বিশ্বাস করে এ বাড়ির সবকিছুই তার। তাই তো আজ ফিরিয়ে নিতে চাইছে কষ্টিপাথরের মূর্তিটা। এক মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীর সাথে কথা হয়েছে তার। বেশ মোটা ক্যাশ দিয়ে কিনতে চাইছে মূর্তিটা। তা থেকে অবশ্য কিছু টাকা দিয়ে পিতলের মূর্তি কিনে দেবে দীনেশ ভাদুরীকে।

যত লোভই দেখানো হোক না কেন দীনেশ ভাদুরী মন কিছুতেই সায় দেয় না। আরোও অপারগ হয়ে ওঠেন আলোরাণীকে দেখলে।

সেদিনের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে দীনেশ ভাদুরীর। পোদ্দার বাড়ির গৃহদেবতাকে যেদিন নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন তিনি। কী অস্বস্তিতেই না পড়েছিলেন। যে দেবতা এতদিন বিরাজ করেছে নঁকশা কাটা ইটের মন্দিরে। সেগুন কাঠের আসনে লাল ঝালরের মখমলি কাপড়ে যে দেবতা অধিষ্ঠিত ছিল, তাঁকে তিনি কোথায় রাখবেন।

এই দ্বিধা আর অস্বস্তি থেকে সেদিন তাঁকে মুক্তি দিয়েছিলো রাধারাণী।

এমনিতে আনমনা মেয়ে। কিন্তু সেদিন খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁর হাতের মূর্তিটি দেখছিল। এরপর পরই কী মনে করে দৌঁড়ে চলে যায় কাঠটগর গাছের নীচে। কোঁচড়ে ফুল আর নিজের বসার কাঁঠাল কাঠের পিড়ি দিয়ে আসন সাজায় রাধাগোবিন্দের।

অতটুকুন মেয়ে মুখে কিছু না বলেও বুঝিয়ে দেয়, দেবতারা আড়ম্বর নয় আন্তরিকতা চায়।

তবে আলোরাণীর এই আন্তরিকতা শুরুতে বেশ পীড়ারও উদ্রেক করেছিলো দীনেশ ভাদুরীর জন্য। দিন নেই রাত নেই শুদ্ধ হওয়ার বালাই নেই আলোরাণী রাধাগোবিন্দকে ছুঁয়ে বসে থাকে। প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত হতেন দীনেশ ভাদুরী। রাগ করতেন, ধমকাতেন, গঙ্গাজলে শুদ্ধ করতেন মূর্তি। এতে কাজ না হলে রাধাগোবিন্দের আসন সরিয়ে রাখতেন। এখানে, ওখানে, আলোরাণীর নাগালের বাইরে। এতেও লাভ না হওয়ায় তিনি বোঝাতেন,

' দিদি রে, এ পোদ্দার বাড়ির গৃহদেবতা। কত যত্নের দেবতা তাঁদের। অনিয়ম করলে দেবতা রুষ্ট হবেন। পোদ্দারদের অমঙ্গল হবে।'

এতেও খুব যে একটা কাজ হলো তা নয়। তবে শুদ্ধ হওয়ার নিয়মটুকু আলোরাণী মন দিয়ে শিখে নিলো দাদুর কাছ থেকে। এরপর ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যে, আলোরাণীকে ঘরের কাজে তখনই পাওয়া যেতো যখন রাধাগোবিন্দের কাছ থেকে সে ফুরসত পেতো।

এখন আলোরাণীর দিন কাটে এই রাধাগোবিন্দের সাথে। ভোরের আলোয় কাঠটগরে আঁচল ভরা হোক বা লাল চন্দনের সুবাসে ঘর ভাসানো হোক, সবকিছুতেই তার যত্নের ছাপ। ছোট্ট সংসারে সে মেতে থাকে রাধাগোবিন্দকে নিয়েই। এই রাধাই স্বয়ং ভর করে প্রতি সন্ধ্যায় আলোরাণীর উপর।

সন্ধ্যায় আরতীর সময় সুর ভাজতে ভাজতে আলোরাণী অবিকল রাধার মতো হয়ে ওঠে।

যতই বলুক সোবাহান কিছুতেই পারবে না দীনেশ ভাদুরী এই মূর্তি তাকে দিতে। আলোরাণীকে এই রাধাগোবিন্দ থেকে বিছিন্ন করা অসম্ভব।

দীনেশ ভাদুরীর এই নাকচ মেনে নিতে পারে না সোবাহান।

' বুড়ার সাহস বাড়ছে খুব। ক্যামনে মূর্তি নিতে হয়, তা জানা আছে সোবাহানের।'

সত্যি কথা বলতে, সে সময়টাই আরোও সাহসী করে তুলেছে সোবাহানকে। সময়টাই এমন। মধ্য একাত্তর।

ঢাকা শহর থেকে যুদ্ধের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে দেশময়। প্রায় প্রতিটি ঘর থেকেই তৈরী হচ্ছে জয় বাংলার লোক।

তবে মুদ্রার ওপিঠের চিত্রও আছে।

পিস কমিটির নামে দ্রুত অচেনা হয়ে যাচ্ছে কাছের মানুষজন।

তেমনই এক সময়ের ঘোর সন্ধ্যায় সোবাহান তার দু'জন কর্মচারী নিয়ে দীনেশ ভাদুরীর ভিটেয় আসেন।

'আপনে বুড়া মানুষ। আমাগো বাড়ির লগে বহুদিনের সম্বন্ধ আপনের। পরিস্থিতি ভাল না। আপনার গায়ে হাত দেওয়া সহ্য করতে পারুম না। তয় আলোরাণীর কথা কিছু কইতে পারি না। পাশের গ্রামে ক্যাম্প হইছে। আলোরাণীর কথা তাগো কানে গ্যালে আমার কিছু করার থাকবো না। ব্যবসার কারণে আমার হাত-পা বাঁধা। একখান বুদ্ধি আছে অবশ্য। মূর্তির লগে আলোরাণীরেও কিছু সময় হোসেন মঞ্জিলে রাখতে পারেন।'

আর বেশী সময় দাঁড়ায় না সোবাহান। মুখভর্তি পানের পিকটুকু ভাদুরী বাড়ির উঠোনে ফেলেই বেরিয়ে গেলো সে।

সে সন্ধ্যায় দীনেশ ভাদুরী রাধাগোবিন্দের সামনেই বসে থাকলেন। এরপর মধ্যরাতে গিয়ে বসলেন ঘুমন্ত আলোরাণীর মাথার কাছে।

ভরা পুর্ণিমা। তবে জ্যোৎস্না বড় ফ্যাকাশে। আলোরাণীকেও ফ্যাকাশে লাগছে আজ। শুধু গলায় কালো সুতোয় লকেটের মতো বাঁধা রূপার মুদ্রাটি আলো ছড়াচ্ছে তখন।

কী ভেবে দীনেশ ভাদুরী খুলে নেন সেই রূপার মুদ্রাটি।

এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভাসিয়ে খুব আস্তে আলোরাণীকে ডাকেন,

' দিদি, যেতে হবে ওঠো।'

কোথায় যেতে হবে, কীভাবে যেতে হবে সে প্রশ্ন করে না আলোরাণী।

দীনেশ ভাদুরী সে সুযোগই দেয় না তাকে। শুধু রাধাগোবিন্দের মূর্তিটা হাতে নিয়ে আগে আগে হেঁটে চলেন।

আলোরাণী জানে রাধাগোবিন্দ তার প্রাণের ছন্দ। রাধাগোবিন্দের পথই তার পথ।

এরপর চারপাশের নিস্তব্ধতায় নিজেকে মুড়ে দীনেশ ভাদুরী এসে দাঁড়ান পদ্মপুকুরের পাড়ে। পিছু পিছু আলোরাণী।

শুনশান সময়ের পরতে পরতে তখন কেবলই তাঁদের শ্বাসের শব্দ। দীনেশ ভাদুরী একঝলক ফিরে দেখেন নিজের ভিটে। কিছু একটা ভাবেন। এরপর হঠাতই গতি বাড়িয়ে দেন। দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন তিনি।

আশি ঊর্ধ মানুষটি নিজের দ্রুততায় নিজেই খেই হারান। হাত ফস্কে পড়ে যায় রাধাগোবিন্দের মূর্তিটি পদ্মপুকুরে। নীরবতা বিসর্জন হয় জলের শব্দে।

আলোরাণী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পদ্মপুকুরের দিকে। ডুবে যাওয়া মূর্তিটির চারপাশে তখনো জলের আলোড়ন।

এ রাতের পর ভাদুরী বাড়িতে ভোরের কাঠটগরের জন্য আর কেউ আঁচল পেতে দাঁড়ায় না। চন্দনের সুবাস ছড়িয়ে কেউ গেয়ে ওঠে না,

ওরে নীল যমুনার জল
বল রে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম,
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।

এক রাতের ভেতর বুড়া কীভাবে কষ্টিপাথরের মূর্তি আর আলোরাণীকে বর্ডার পার করালো তা ভেবেই সোবাহান গোলকধাঁধায় পড়ে যায়। তবে বুড়ার সাহস আছে। সবকিছু ওপাড়ে পাঠিয়ে নিজে ঠিকই মাটি ধরে পড়ে আছে।

বুড়ার সামনে নিজেকে হেরে যাওয়া শিয়াল মনে হয় সোবাহানের।

বাড়িতে দীনেশ ভাদুরী একা। বড় মাটির মায়া তাঁর। এই মাটিতেই তাঁর শেষ কাজ হবে।

মাঝেমাঝেই বের করছেন রূপার মুদ্রাটি। রাণী ভিক্টোরিয়াকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তিনি।

এখন পড়ন্ত দুপুরের মরা রোদে বের করেছেন তিনি মুদ্রাটি। রাণী ভিক্টোরিয়াকে একদম আলোরাণীর মতো লাগছে।

বুকটা হু হু করে ওঠে। বাতাস শনশন করে কিছু বলে যায়।

দীনেশ ভাদুরী এক পা দু পা করে পদ্মপুকুরের পাড়ে আসেন। কিছুসময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মুঠোয় ভরা ১৮৬৮ সালের রূপার মুদ্রাটি। শক্ত মুঠো আরোও শক্ত করেন। আস্তে আস্তে চোয়ালও শক্ত হয়ে ওঠে তাঁর।

এরপর হঠাতই জলের মাঝে ছুড়ে দেন এতদিনের যত্নে রাখা রূপার মুদ্রাটি। রাণী ভিক্টোরিয়ার মুদ্রাটি নিমিষে তলিয়ে যায় পদ্মপুকুরে।

আর হ্যাঁ,পুকুরটি সেদিন ভোর থেকেই ভরে গেছে লাল পদ্মে। যে ভোরে আলোরাণী ভিটে ছেড়েছে।

লোকে বলে, এরপর পদ্মপুকুরকে আর কোনোদিন পদ্ম ছাড়া দেখা যায়নি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ