এই গল্পের ১ জন পাত্র, ১ জন পাত্রী। ১ অপাত্রও আছে, তার কথা পরে হবে। পাত্র আহসান হাবিব সাধারণ মানুষ নয়; কিন্তু সে কথাও যথাসময়ে আপনাদের গোচরে আসবে। আপাতত এটুকু বলা যায়, গল্পের শেষে তার বয়স, আমাদের হিসেবে, ৩৪, এবং সে অবিবাহিত। ভালুকা থানা সদরে তার একটি ওষুদের দোকান আছে। পাত্রীর নাম রেশমা। সে বলে সে অবিবাহিতা। অনুঢ়া। সে ‘অনুঢ়া’ শব্দটিই ব্যবহার করে, একটি উপন্যাসে এটি দেখে তার দারুণ ভাল লেগে যায়।
শব্দটিকে ব্যবহার করার একটি সুযোগ পাওয়ার জন্য কিনা, কে জানে, সে নিজেকে অবিবাহিত বলে দাবি করে। রেশমা ভালুকা থানার বিখ্যাত এনজিও-কর্মী - বিখ্যাত এই অর্থে, সে একবার থানার শ্রেষ্ঠ এনজিও ব্যক্তিত্ব হিসেবে একটি স্বর্ণপদক পেয়েছিল। যাক সে কথা।
শব্দটিকে ব্যবহার করার একটি সুযোগ পাওয়ার জন্য কিনা, কে জানে, সে নিজেকে অবিবাহিত বলে দাবি করে। রেশমা ভালুকা থানার বিখ্যাত এনজিও-কর্মী - বিখ্যাত এই অর্থে, সে একবার থানার শ্রেষ্ঠ এনজিও ব্যক্তিত্ব হিসেবে একটি স্বর্ণপদক পেয়েছিল। যাক সে কথা।
২.
চুরাশি সালের মে মাসের খবরের কাগগুলো যদি আপনাদের সংগ্রহে থাকে, দেখবেন, পর পর তিন অথবা চার দিন একটি সংবাদ বেশ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছিল। খবরটি মফস্বলের, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিধায় প্রথম পৃষ্ঠাতেই তা স্থান পায় । ইত্তেফাক ২৪ অথবা ২৫ তারিখ, সঠিক মনে নেই, এটি এভাবে পরিবেশন করে :
ভালুকা থানা সদর হইতে তিন মাইল দক্ষিণে লতা গ্রামে মোহাম্মদ ময়জুদ্দিনের সরিষা খেতে গত পরশু সন্ধ্যা রাত্রিতে একটি অদ্ভুতদর্শন উড়ন্ত বস্তু পতিত হয়। পতনের সময় অনেকক্ষন ধরিয়া শো শো শব্দ হয় এবং চারিদিকে ধোয়ার আচ্ছন্ন হইয়া যায় । গ্রামের মানুষ প্রথমে ধারণা করে যে, কোন বিমান বিধ্বস্ত হইয়াছেঃ কিন্তু পতিত বন্ধতে কোন আগুন জ্বলিতে দেখা যায় নাই। বরং উহা হইতে প্রচণ্ড উত্তাপ এবং লাল আভা নির্গত হইতেছিল। গ্রামের মানুষ এই উত্তাপের জন্য উহার নিকটবর্তী হইতে পারে নাই। আশ্চর্যের বিষয়, প্রায় সমস্ত রাত্রি কৃলিবার পর সকালে ঐ স্থানে অনেকটা জায়গা জুড়িয়া শুধু কালাে দাগ ছাড়া পতিত বন্ধুটির কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নাই।
পরের দিনের প্রতিবেদনে পুলিশী তদন্তের উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু রহস্যের কোনো কুলকিনারা যে করা সম্ভব নয়, একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে তা বলা হয়েছে । কোনো রাসায়নিক দ্রব্য, এমনকি সামান্য কেরোসিনের গন্ধও অকুস্থলে পাওয়া যায়নি। - রহস্যের কিনারা হয় কিভাবে? পুলিশের ধারণা, সরিষা খেতে কেউ খড় দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ময়জুদ্দিনের শত্রুর অভাব নেই, স্বচ্ছল ভূমি মালিক সে, এক ছেলে চাকুরী করে সৌদি আরবে। কিন্তু খড় পুড়লেও তো ছাই হয়, নাকি? বুঝুন এবার, আমাদের পুলিশের অবস্থা! বিষয়টা এতটাই বায়বীয় ছিল যে, কিছুদিন পর তা মানুষের উৎসাহের কক্ষপথ থেকে হারিয়ে যায় ।
৩.
ঘটনার পরের দিন ভোর বেলা ভালুকা বাস ষ্ট্যান্ডের পাশে একটি অস্থায়ী চায়ের খুপরিতে ঘুমন্ত অবস্থায় হাবিবকে আবিষ্কার করল খুপরি মালিক আমিন মিয়া । আমিন মিয়ার বয়স ৪০ থেকে ৪৫, স্বাস্থ্য ভাল, সাত সকালে তাকে তরতাজা দেখাচ্ছে। সে একটু অবাক হয় - হাবিবের কাপড়-চোপড়ে রাজধানীর ছাপ, তাকে এদিকে আর কখনানো দেখেওনি সে। হাবিব একটা বেঞ্চে একটা চামড়ার ব্যাগে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল। আমিন মিয়া তাকে ডেকে তুলল। তার চোখে কৌতুহল, সন্দেহ। সে জিজ্ঞেস করল, কইত্থে আইছেন, কই যাইবেন? ইত্যাদি।
হাবিব বলল, সে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, স্কুইব এন্ড কোম্পানির। এসেছে ঢাকা থেকে, গন্তব্য ভালুকা ।
আমিন মিয়ার কৌতুহল মেটে না। হাবিব তাকে বলে গত রাতে একটা বাস তাকে এইখানে নামিয়ে দিল। ' এতো রাতে আর কোথায় যাই, হোটেল-ফোটেল কোথায়। কি, কিছুই তো জানি না। তাই এখানটাতেই শুয়ে পড়লাম । আপনি রাগ। করেননিতো?' সে জিজ্ঞেস করে আমিন মিয়াকে।
এবার কিছুটা শরমিন্দা হয় আমিন মিয়া। 'আরে না না! রাগ করব কেন, মিয়া ভাই। শুইছেন, শুইয়া থাহেন, সে বলল । কিন্তু হাবিব উঠে বসে চোখ ঘসে। 'চা নাস্তা কিছু হবে, মিয়া ভাই? সে জিজ্ঞেস করে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা প্যারাসিটামল। ট্যাবলেট বের করে এক গ্লাস পানির জন্য বলল আমিন মিয়াকে। তার মাথা ধরেছে। আমিন মিয়া দিনের প্রথম খদ্দর পেয়ে আনন্দিত হয়।
৪.
এভাবেই শুরু হাবিবের, ভালুকা থানায়। দু'দিনের মধ্যেই তার সাক্ষাৎ হয় থানার ডাক্তারদের সঙ্গে। স্কুইৰ ভাল কোম্পানি, সুনাম আছে। তাছাড়া আহসান হাবিব।
সুদর্শন যুবা, তার চালচলন, কাপড়-চোপর কেতাদুরস্ত। এজন্য ডাক্তারদের কাছে সে প্রিয় হয়ে উঠল। আমিন মিয়া তার থাকার ব্যবস্থা করল। হাসান আলী পাটোয়ারির দালানের দুটো কামরা ভাড়া নিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। এখন তারা অন্যত্র চলে যাওয়ায় ওই দুটো কামরা খালি পড়ে আছে। হাবিব ভাড়া নিল এক সপ্তাহের জন্য এবং ভাড়ার পয়সা অগ্রিম গুনে দিল। ভাল পয়সা, পাটোয়ারি প্রীতই হলেন । ভালুকায় হাবিবের থাকার কথা ছিল এক সপ্তাহ, তারপর অন্যত্র। কিন্তু চতুর্থ দিনেই ঘটল অঘটন। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। রেশমা বেগমের। রেশমা বেগম এইচ.এস.সি পাস করে পড়াশোনায় ইস্তফা দেয়। - বাবামায়ের সঙ্গতি নেই তাকে পড়ায়। উপরন্তু বাবার লিভারে ধরেছে পচন, তার চিকিৎসার দরকার । সে চাকুরি নেয় একটা এনজিওতে । মন্দ কি? হাবিব দেখল রেশমাকে। রেশমা হাবিবকে। আহা! তাদের মধ্যে বিদ্যুতের একটা স্রোত বয়ে গেল। হাবিব জানল, মেয়েটি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে । সে পরের দিন আবার সেখানে গেল, তার পরের দিনও। সপ্তাহান্তে সে বলল পাটোয়ারিকে – চাচা, আরো থাকতে হবে কয়েক সপ্তাহ। এই নিন, এক মাসের ভাড়া। টাকা দেখে পাটোয়ারির চিক চিক করে উঠল।
৫.
আমিন মিয়ার দোকানে চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে হাবিব, 'আচছা চাচা, একটা। মেয়েকে যদি আমার ভাল লাগে, আর তারও ভাল লেগে যায় আমাকে, তাহলে কথাটা জানাতে হয় কিভাবে?' আমিন মিয়া ভাবল, ছেলেটি হয় নিবেধি, না হয় ধূর্ত, হয় সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে গতকাল। সে বলল, 'এটা আমি কি করে কই?' কিন্তু হাবিবের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া হল । জিজ্ঞেস করল, “মেয়েটা কেঠা?' হাবিব বিবরণ দিল । শুনে আমিন মিয়া বলল 'ও! তারপর বলল, “কিন্তু মিয়া, ওই রাস্তায় যাইবা না। যে কয়েক দিন আছ, থাহ। তারপর মানে মানে কাইটা পড়।' হাবিব বলল, 'কথাটা বুঝলাম না, চাচা।' আমিন মিয়া চোখ ছোট করে বলল, বুঝবা, যদি ওর ভাইটির হাতে পড়।' রেশমার একটিই ভাই, কুখ্যাত সন্ত্রাসী বলে এলাকায় যার নাম । পরে একসময় জাগোদলের বড় নেতা হয়েছিল। বাবা তাকে ত্যাজ্য করেছিল, সেও সম্পর্ক রাখেনি অসুস্থ বাবার সঙ্গে। কিন্তু বোনটিকে সে খুবই ভালবাসত।
৬.
হাবিব সরাসরি বলল রেশমাকে, আপনাকে দেখলে আমার ভেতরটা তোলপাড় করে । কেন?' রেশমা অবাক হয়ে তাকায় হাবিবের দিকে। লোকটা পাগল-টাগল নয়তো? সে বলল, 'তা আমি কি করতে পারি? আপনি আমাকে দেখেন কেন? হাবিব বলল, 'আপনাকে ভালবাসি । এজন্য দেখি।' রেশমা চোখে আঁচল চেপে চলে গেল । সে রাতে রেশমা কথাটা বলল তার বান্ধবী মালতীকে। বলতে গিয়ে তার। মনে হ'ল, প্রতিটি কথা থেকে যেন মধু ঝরে পড়ছে, যেন বারে বারে বললেও এতটুকু কমতি হবে না সে মধুর । লোকটার কথা শুনে, বুঝলে মালতী, আমিতো একদম আকাশ থেকে পড়লাম - এমন আচানক!' বলল রেশমা। কথাটি যদি হাবিবের ক্ষেত্রে বলা হত, যে হাবিব পড়ল আকাশ থেকে, তাহলে সেটিই হত সত্য কথা । কারণ হাবিব সত্যি সত্যি আকাশ থেকে পড়েছে, একেবারে মহাকাশ থেকে । আমরা এজন্যই বলেছিলাম, হাবিব সাধারণ মানুষ নয়। কারণ সে আমাদের পৃথিবীর কেউ নয়। সে ভিন্ন একটি গ্রহ থেকে এসেছে, ৫২২৪ আলোকবর্ষ দূরে থেকে। অথচ তার আসতে লেগেছে ৫২,২৪ ঘন্টা । এবার বুঝুন মহাজগতের উন্নতিটা গেছে কোন পর্যায়ে, আর পার্থিব বিজ্ঞানের কী দৈন্যদশা! আমাদের হিসেবে আ্লোই সবচেয়ে গতিশীল, সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল বেগে সে চলে । আর আমাদের কল্পনার দৌড়ও ওই পর্যন্ত। অথচ হাবিব যে গ্রহ থেকে এসছে, সে গ্রহে স্থান ও কাল এতটাই আপেক্ষিক যে, ওই গ্রহের প্রতিটি প্রাণী নিজস্ব সময় ও স্থান তৈরি করে নিতে পারে । যদি কেউ ইচ্ছে করে, একশ' বছর সামনে বা পেছনে গিয়ে থাকতে, তা সে অনায়াসে পারে। কারো ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারে ৯০০০ কোটি আ.ৰ. দূরে। কোনো গ্রহে, তাতে আমাদের হিসেবে তার লাগবে চার দিনের কিছু কম। তার কাছে যদিও এই ঘড়ি ধরা সময়ের কোনো অর্থ নেই। সময় নিয়ে আমরাই, এই পৃথিবীবাসীরাই, সবচেয়ে বেশি হাপিত্যেশ করি। অথচ পৃথিবীটা ছেড়ে গেলেই সময় খুব তুচ্ছ হয়ে যায়! একবার গিয়ে দেখতে পারেন, যদি বিশ্বাস না হয় ।
৭.
হাবিবকে পাঠানো হয়েছে পৃথিবীতে, আমাদের কবিরাজি চিকিৎসায় লাগা গাছপালা, লতাপাতা নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য। বছর সাতেক এখানে থেকে সে গবেষণায় করবে এবং শেষে এসব গাছগাছড়ার একটি চালান জড়ো করে নিজ গ্রহে নিয়ে যাবে। হাবিবের গ্রহে দু' একবার অদ্ভূত কিছু অসুখ দেখা দিয়েছে, যার কোনো প্রতিকার ওই গ্রহবাসী খুঁজে পায়নি। কিন্তু সময় ভ্রমণ করে তারা, অর্থাৎ সে গ্রহের কিছু বিজ্ঞানী, দেখেছেন, পৃথিবী ও আরো ক’টি গ্রহের গাছগাছড়া ওইসব রোগের অব্যর্থ চিকিৎসা। হাবিবের মহাশূন্যযান ময়জুদ্দিনের সরিষা ক্ষেতের প্রান্তে নামার আগেই সে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে। যানটি তারপর চলে গেছে সেলফ-ডেস্ট্রাক্ট মােড-এ। অর্থাৎ ৭/৮ ঘন্টায় সেটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে, সামান্যতম কোন চিহ্ন না রেখে। বলা যায়, কপূরের মত উবে যাওয়া ও চামড়ার ব্যাগটি এখন তার সব—তার যা প্রয়োজন সব ওতেই আছে। পাটোয়ারি থেকে ভাড়া নেওয়া দু'টো কামরার একটাতে সে বসিয়েছে গবেষণাগার, অথচ যন্ত্রপাতি কিছুই চোখে পড়ে না। সে এমন অদ্ভুত এক ব্যাপার যে, বলে শেষ করা যায়না। একটি স্বচ্ছ প্রাস্টিকে মুড়ে তার গ্রহের বায়ু। মন্ডল সে বিছিয়েছে কয়েকটি ছোট টবের চারদিকে। পাটোয়ারি পুলকিত হয়ে বলেছেন হাবিবকে, 'আরে বাহ! তুমিতো দেখছি শুধু এলোপ্যাথি ওষুধই বিক্রি করো, কবিরাজি নিয়েও তোমার চিন্তা ভাবনা।'
হাবিব সলজ্জভাবে বলে, 'এটা আমার আসল নেশা, চাচা।' পৃথিবীতে আসার আগে হাবিবের মাথায় তিন মিনিটের একটা ছোট অপারেশন হয়েছিল, একটা মাইক্রোচিপ বসানোর জন্য। তাতে বাংলাদেশের ৮৪ রকম স্থানীয় ভাষা, সেসব স্থানের ভূগোল ও ইতিহাস, ১৯,৫৫০ মানুষের নাম ঠিকানা, ৩৯৪০ গান- তার ১২২ রবীন্দ্রসঙ্গীত-২০৭ কবিতা, ১৮ শহরের পথঘাট আহা! কী নেই সেই চিপটির স্মৃতিতে? ভালুকা এসে হাবিব বলেছে, তার বাড়ি বগুড়ার কাহালুতে। কাজেই তার কথায় কিছুটা টান থেকে যায়, শুনতে যা মধুর লাগে। পাটোয়ারি ভাবেন, বাহ, বেশতো ছেলেটি! পাটোয়ারিকে এক মাসের ভাড়া গুনে দিয়ে ঘরে ঢুকে ব্যাগ খুলল হাবিব এবং যোগাযোগ করল তার গ্রহের সঙ্গে। সে অনুমতি চাইছে ভালুকায় থাকার। তার যাওয়ার কথা ছিল দাকোপ, বারিপাড়া এবং বিলাইছড়িতে। ওই একই কারণে । অনুমতি মিলতে দেরি হয় না। একজন প্রাণী যখন প্রেমে পড়ে, সমগ্র প্রাণীকূল- বস্তুত সমস্ত সৃষ্টি তাতে উল্লসিত হয়ে। ওঠে। সেটাই রেওয়াজ তার গ্রহে। হাবিবের উপরঅলা বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে মহা আনন্দ প্রকাশ করলেন। প্রধান বললেন তার সহকারিকে, প্রয়োজনে অন্য কাউকে পাঠাও ওকে সহায়তা করতে । হাবিব প্রেমে পড়েছে, না তারা সবাই, বোঝা যায় না।
৮.
বছর চারেক কাটল হাবিবের। ইতিমধ্যে একটা ওষুধের দোকান দিয়ে সে পাকাপোক্ত বাসিন্দা হয়েছে ভালুকার এবং পাটোয়ারি সাহেবের বহির্দালানের। কিন্তু তার জীবন দুঃখভারাক্রান্ত। রেশমাকে সে নাগালের মধ্যে পায় না। রেশমার ভাই হঠাৎ যে। কোথায় তাকে গুম করে ফেলল, বছর খানেকের মাথায়, কেউ জানল না। হাবিব দাকোপ যায়, ছাগলনাইয়া যায়, বড়লেখা যায়, আবার ফিরে আসে। পাটোয়ারির দালানের লাগোয়া জমিতে জমতে থাকে বাংলাদেশের ভেষজ উদ্ভিদের নমুনা। তার কাজ বাধাগ্রস্ত হয় না। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে রেশমার জন্য। রেশমা, তুমি কোথায়? আমিন মিয়া বলল ও হাবিব, রেশমা কিন্তু বিয়া কইরা কাইটা পড়ছে। আগেই কইছিলাম না?' হাবিব বিশ্বাস করতে চায় না। রেশমা যে আমাকে ভালবাসে!' একটা উপন্যাস থেকে ধার করে কথাগুলো সে বলে । তার গলায় কষ্ট । কিন্তু চার বছরের মাথায় হঠাৎ এসে হাজির রেশমা । এবার প্রশিকায় চাকরি নিয়ে।
হাবিব হাতে চাঁদ ফিরে পেল । হাবিবের কাছে বাংলা ভাষায় এসব উপমা দারুন লাগে । তার ধারণা, অতীতে এদেশের লোক নিশ্চয় মহাজগতে ভ্রমন করেছে। হাতে চাদ পাওয়া" ওই মহাজাগতিক ভ্রমণেরই অভিজ্ঞতাসঞ্জত একটি বর্ণনা।
৯.
হাবিব বাংলাদেশের নানা স্থানে যাচ্ছে আসছে - তার দেখা হচ্ছে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা হচ্ছে প্রশাসক, পুলিশ, শিক্ষক, বিডিআর, লঞ্চ, মালিক, পরিবহন শ্রমিক, রাস্তার মানুষজন, কুলিমজুর, ভিক্ষুক, চা দোকানদারদের সঙ্গে। সে হাঁফিয়ে উঠেছে। এক রাতে সে আপন গ্রহে সম্প্রচার শেষে এরকম একটি মন্তব্য জুড়ে দেয়, 'এই দেশ থেকে কবে মুক্তি পাবো? এটি হতাশার কথা। অন্য গ্রহের প্রাণী তো দূরের কথা, আমাদেরও সে রকম মনে হয়। হয় না? রোগী নিয়ে হাসপাতালে যান, জেলে বন্দি স্বামীকে দেখতে আসেন গ্রাম থেকে, আমলাদের টেবিলে ফাইলের সন্ধানে যান, থানা পুলিশ করেন – এরকম হতাশা আপনাদেরও গ্রাস করবে। এর থেকে অনেক বেশি হতাশা। আর হাবিব এসেছে এমন এক গ্রহ থেকে, যে গ্রহের একটি মানুষের প্রেম নিয়ে গোটা সৃষ্টিতে নাচন লেগে যায়! কিন্তু হাবিবের হতাশার কথাটা চাপা পড়ে যায় রেশমার দিকে তাকালে ।
১০.
হাবিবের দোকানের ভেতর দিকে পার্টিশান দিয়ে একটা ছোট্ট মত ঘর করা হয়েছে, যেখানে সে মাঝে মধ্যে বিশ্রাম নেয়, দুপুরের খাবার খায় । একটা চিকন খাট আছে। ঘরটাতে। রেশমা একদিন তার দোকানে এসে বলল, 'হাবিব, আমার মাথা ধরেছে। একটু বিশ্রাম নেবো।' হাবিব রেশমাকে একটি প্যারাসিটামল দিল। বলল, “ভেতরে কুঁজোয় পানি আছে। খেয়ে খাটে শুয়ে বিশ্রাম নাও।' পার্টিশানের দরোজাটা নিজেই খুলে ধরল হাবিব। রেশমার দোকানে আসার বিষয়টি নতুন। হাবিবের মনে পড়ে, রেশমা তাকে কিছুদিন আগেই বলেছে, তাদের বিয়ের সম্ভাবনার কথা। রেশমা বিয়ে কথাটি ব্যবহার করেনি, সে বলেছে, আমরা তো এখন ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারি, হাবিব? তার বাক্যে হাবিব শব্দটি ছাড়া বাকি সবই রেশমা মেরে দিয়েছে একটা উপন্যাস থেকে । ঘর বাঁধা কথাটায় যেমন একটা মাধুর্য আছে, তেমনি একটা কাজ কাজ ভাবও আছে। এবং রেশমা নিজেকে কর্মী ভাবতে ভালবাসে। ঘণ্টাখানেক পর, কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে, ভেতরে উকি দেয় হাবিব। ভেতরটা অন্ধকার । সে বাইরে তাকায় । চারিদিকে অন্ধকার করে বৃষ্টি নেমেছে। ছোট যে ছেলেটি দোকানে বসে, চা-টা আনে, টাকার ভাংতি যোগাড় করে, সে টুলে বসে ঝিমোচ্ছে । হাবিব আস্তে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। চিকন খাটটিতে একটি বিছানা পাতা, তাতে শুয়ে আছে রেশমা। তার কেমন লাগছে এখন, কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্য নিচু হতেই দুটি সাদা হাত প্রবল বেগে তাকে জড়িয়ে ধরল এবং প্রবল বেগে তাকে আকর্ষণ করতে থাকল নিচের দিকে। হাবিব টাল সামলাতে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল রেশমার উপর । তারপর, কিছু বুঝে উঠার আগেই, তার সারা গায়ে একটা ঝড়ের মত আছড়ে পড়ল রেশমা । হাবিবের মহাজাগতিক সত্তা হতচকিত হয়ে যায় । কিন্তু সে অসহায়, বন্দি। দরোজাটা বন্ধ করার সময় পর্যন্ত সময় পায় না সে। সে রাতে অন্যরকম একটি হতাশার কথা প্রকাশ পায় হাবীবের, গ্রহে পাঠানো সম্প্রচার শেষে জুড়ে দেওয়া মন্তব্য, 'এ দেশ থেকে কবে পালাতে পারবো?' যে বিজ্ঞানীরা এতদিন ভারি পুলকিত ছিলেন হাবিবের বিষয়টি নিয়ে, তাদের কপালে হান্ধা চিন্তার রেখা ভেসে ওঠে । একটা মনিটরের পর্দায় তারা দেখলেন, হাবিব অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢেলে গোসল করল। অনেকক্ষণ, যেন এক পুকুর পানি সে শেষ করে ফেলবে। তার নিজেকে অপরিষ্কার মনে হচ্ছে আজ রাতে।
১১.
হাবিব ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার কাজ নিয়ে। আমিন মিয়াকে পার্টনার করেছে হাবিব, তার অনুপস্থিতিতে দোকানটা সে-ই চালায় । আমিন মিয়া একদিন বলল হাবিবকে, তোমার জন্য চিন্তার শেষ নাই, হাবিব মিয়া।' হাবিব জিজ্ঞেস করল না, কেন তার এই চিন্তা । আমিন মিয়া আবার বলল, আমি মেয়েটাকে চিনি। ও তোমারে শেষ। করবে।' হাবিবের জন্য আমিন মিয়ার ভালবাসা তাকে অবাক করে, বিপর্যস্ত করে। তার মহাজাগতিক হিসেবে একটা ফাঁক রেখে দেয়। রেশমা আবার হাওয়া হয়ে। গেছে, হাবিব জানে না কোথায়।
১২.
হাবিব বার্তা পাঠায়, 'কবে দেশে ফিরবো? মনে হয় জ্যান্ত বসে আছি নিজের কবরে।'
১৩.
এবার গল্পের শেষ । দেড় বছর পর শোনা গেল নারী সাহায্য সংস্থায় চাকরি নিয়ে। ভালুকায় প্রত্যাবর্তন করেছে রেশমা। হাবিবের সঙ্গে দেখা হল। হাবিব বলল, 'কোথায় ছিলে?' রেশমা চোখের মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরিয়ে বলল, 'তোমাকে ভুলতে গিয়েছিলাম গো, অনেক দূরে। কিন্তু ভুলতে পারলাম কই?' সে অনেক' শব্দটি বলল এভাবে: অ-নে-ক । হাবিব তবুও বলে, কিন্তু গিয়েছিলে কোথায়? রেশমা বলে, সে কথা জিজ্ঞেস করে না।
১৪.
হাবিব দোকান বন্ধ করে হেঁটে হেঁটে ফিরছে বাসায়। রাত আটটার মত বাড়ে। এক প্রকান্ড চাদ মহাজাগতিক জোস্না ছড়াচ্ছে আকাশে। হাবিবের গ্রহে এগারোটি চাঁদ। বীভংস ব্যাপার। তার রাত দীর্ঘ দিন দীর্ঘতর । সে আকাশে তাকিয়ে দেখে একটি মাত্র চাঁদ, কিন্তু কি অবলীলায় দখল করে রেখেছে ভালুকার সমগ্র আকাশ-মাটি, গাছপালা। তার কেবলি মনে হয় ওই একটি চাঁদ থেকে লাবণ্যের বন্যা বইছে যেন: এত সুন্দর চারিদিকে – কিন্তু মানুষলোর ভেতর তার কোনো স্পর্শ লাগে না কেন? সে আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে। তার গ্রহে এটাই রেওয়াজ। অতঃপর সে হতাশায় ডুবে যায় । চাঁদের দিকে আবার তার চোখ পড়ে। এবার তার মনে হয়, আজ রাতে কোথায় যেন তার যেতে হবে, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে, চাঁদের আলোয় ভিজে ভিজে দু'টি কথা বলতে হবে, হাতে হাত রেখে কিছুটা সময় যেন নির্জনে বসে থাকতে হবে। তার ইন্দ্রিয়গুলিতে রক্তের সকল লৌহকণিকা আঘাত করতে থাকে। এখন তাকে ওদিকেই যেতে হবে।
১৫.
রেশমা থাকে চৌরাস্তার পাশে একটা মাঠের ধার ঘেষে নারিকেল সুপারিগাছ লাগানো বাড়িতে। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন নার্সের সঙ্গে বাসাটা সে ভাড়া নিয়েছে । উঁচু বাঁশের বেড়া, তারপর টিনের চাল দেয়া টানা ঘর। তিনটে কামরা। শেষটিতে থাকে রেশমা। সে যেতে যেতে দেখে, দুজন নার্স বেরিয়ে এল ওই বাড়ি থেকে। তাদের অ্যাপ্রোন চাঁদের আলোয় কড়া সাদা হয়ে ভেসে উঠল। সে চকিতে সরে যায়। সে চায় না তারা দেখুক হাবিব যাচ্ছে রেশমার কাছে। বাড়ির সামনে গিয়েও কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক পায়চারি করে হাবিব । তার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়, যাকে লজ্জা বলা যায়, শঙ্কা বলা যায়। তার বুকটাও, কী আশ্চর্য, কাঁপে! এক সময় শক্তি সঞ্চয় করে ঘরের বারান্দায় পা রাখে হাবিব । দরজায় গিয়ে আস্তে টোকা দেয় । এত আস্তে, সে টোকায় কোনো শব্দ হয় না। কিন্তু হাবিবের মাথার ভিতর স্নায়ুগুলো হঠাৎ তীক হয়ে ওঠে, তাদের মধ্যে একটা ঠোকাঠুকি লাগে। তার মাথা ঘুরতে থাকে - কারণ ঘরের ভেতর নিঃশ্বাসের ওঠানামা শোনা যায়। শুধু নিঃশ্বাস - তীব্র, অনিয়ন্ত্রিত, আবেগমথিত। কিন্তু কার? হাবিবের চোখের সামনে একটা পর্দা হঠাৎ দুলে উঠে। সে পর্দায় ছায়া পড়ে। সে সব দেখতে পায়। সবচেয়ে না দেখার মত দৃশ্যও সে দেখে। সবচেয়ে ক্ষীণ শব্দটিও সে শুনতে পায়। এবার একটা কাণ্ড করে হাবিব - ডান হাতের আঙ্গুলগুলো সামনে মেলে ধরে ঘরের দেয়ালের দিকে। হঠাৎ সাদা আলোয় ভরে যায় চারদিক। তারপর দেখা যায়, ঘরের কোনো দেয়াল নেই; ঘরের মাথায় যে চাল ছিল, সেটিও অদৃশ্য। কিছু ধোয়া ওঠে, কিন্তু মিলিয়ে যায় । ঘরের জায়গায় দেখতে না দেখতে ছাই জমে যায়। সে ছাইয়ের উপর দিয়ে হেঁটে যায় রেশমার বিছানার কাছে। ছাই জমা চারকোণা মেঝেটি একটি দ্বীপের মত জেগে ওঠে চাঁদের আলোয় । চারিদিকে সাদা চাঁদের আলো। আর হু হু করা হাওয়া। সেই দ্বীপের মাঝখানে রেশমার বিছানা, যেন দ্বীপের ভেতরে আরেকটি দ্বীপ এবং সে বিছানায় শুয়ে আছে রেশমা । তার শাড়িটি জড়ো হয়ে আছে বিছানার এক পাশে। চাঁদের আলোয় তাকে ভাদ্রের নদীর মত দেখায়। তার পাশে, ভয়ে বিস্ফারিত চোখে, চিৎ হয়ে শুয়ে আছে একজন পুরুষ। উর্ধ্বাঙ্গে তার শুধু ঘামে লেপ্টে থাকা একটি সাদা গেঞ্জি। রেশমার বালিশের নিচে দু'টি একশ' টাকার নোট । পুরুষটি দিয়েছে আজ সন্ধ্যায় হাবিবের দৃষ্টিতে ওই টাকাগুলোই ধরা পড়ে প্রথমে, সেদিকেই তার চোখ যায়, রেশমার নদীর মত শরীরকে পাশ কাটিয়ে। কিছুক্ষণ আগে, হয়তো যখন হাবিব পা রেখেছিল বারান্দায়, সেই পুরুষের তীব্র নিঃশ্বাসটি তরল হতে শুরু করেছিল, যদিও তার উঠানামায় ছিল তুমুল কোলাহল । আর রেশমা বালিশের নিচে একটি হাত রেখে ভেবেছিল, যাওয়ার আগে আরেকটি একশ' টাকার কথা বললে কেমন হয়, এ পরিতৃপ্ত মানুষটিকে? তারা দুজনই হাবীবের দিকে তাকায়, যেন, দুই ফুট দূরে তাদের মৃত্যুকেই তারা দেখছে। কিন্তু হাবিব শান্ত এবং নিরুত্তাপ। সে দু'টি একশ’ টাকার নোট এগিয়ে দেয় রেশমার দিকে, এবং বলে, 'সেদিন দুপুরের পাওনাটা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।' সে পুরুষটি কে? আর বলবেন না, একটা চার বছরের শিশুও সেটা বলে দিতে পারে । সে আর কেউ নয়, আমাদের আমিন মিয়া।
১৬.
সে রাতে আরেকটা দৃশ্য দেখা গেল ভালুকার আকাশে। প্রায় ভোরের দিকে। তবে রাত আটটার ওই ঘরপোড়ার ঘটনার উত্তেজনা নিয়ে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত জেগে। থেকে যারা ঘুমিয়েছে, অত ভােরে সে দৃশ্য তাদের দেখার কথা নয়। তবুও দেখল কেউ কেউ। এবং যথারীতি ইত্তেফাক-এ খবর বেরুল যে, একটি আলোকিত বস্তু নেমেছিল ভালুকা স্কুলের মাঠে, মিনিট তিনেক থেকে আবার যা আকাশে উড়ে যায় । বস্তুটি থেকেশো শো শব্দের সঙ্গে আলো বেরুচ্ছিল। কিন্তু, লিখেছে নিজস্ব প্রতিবেদক, 'যে স্থানে বস্তুটি নামিয়াছিল বলিয়া ধারণা করা হয়,ভোরে সেই স্থানে তন্ন তন্ন করিয়া খুজিয়াও উহার কোনো চিহ্ন দেখা যায় নাই।'
১৭.
হাবিব আকাশযানে উঠে দেখল, তার ছয় বছরের গাছগাছড়ার সংগ্রহ সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পেছনের খোলে। আশ্চর্য, সে ভুলেই গিয়েছিল। অথচ তাকে নিতে তার গ্রহের যারা এসেছে, কাছাকাছি একটা স্পেস-স্টেশন থেকে, তারা ভোলেনি। তারা তাকে প্রবোধ দেয়। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তার মাথা থেকে সম্পূর্ণ। উবে যায় কিভাবে? সে নিজেকে প্রশ্ন করে। এই অমার্জনীয় বিষয়টিতে তার কান্না পায়। সে কাঁদতে থাকে।
0 মন্তব্যসমূহ