ফাতেমা আবেদিন নাজলা'র গল্প : মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া

কোনো একটা বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হচ্ছে, প্রেসার কুকারের সিটির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মিথিলার। সিটির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঘ্রাণে মাতাল চারপাশ। হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে চশমা নিয়ে মোবাইলের লক খুলে দেখল ৪টা ১৯ বাজে। এই ভোরে কে মাংস রান্না করছে, কে জানে। গুচ্ছ অ্যাপার্টমেন্টের এই শহরে একজনের শোবার ঘরের সঙ্গে আরেকজনের বারান্দা, নইলে একজনের রান্নাঘরের সঙ্গে আরেকজনের বাথরুম ধাক্কা খাচ্ছে।

মিথিলাদের শোবার ঘরের সঙ্গে পাশের বাসার ড্রয়িংরুম। দিনের সব কাজ সেরে যখন রাত ১২টা নাগাদ গা এলিয়ে দেওয়ার সময় হয়, তখন পাশের বাড়ির উঠতি তরুণ ছেলেটার হাত পড়ে গিটারে, জ্যামিং করতে বসে সে। কিন্তু এ নিয়ে এক-দুদিন বলার পর কেবল মুখ নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু হয়নি বলে ওই উদ্দাম সংগীত-তরঙ্গ মিথিলাকে চুপচাপ সহ্য করে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিবেশীর সৃজনশীলতা নষ্ট করার অধিকারে বেশ কয়েকবার ‘গাঁইয়া-আনকালচার্ড’ বলে গালও খেতে হয়েছে। আর রান্না করতে গেলে তো আরেক হ্যাঁপা। রান্নাঘরের সঙ্গে ওপাশের বারান্দা, এতে অবশ্য রান্নাঘরে একটু-আধটু রোদ খেলে গেলেও ও-বাড়ির নতুন বউয়ের ব্রা আর সদ্য বিবাহিত পুরুষের লাল, নীল জাঙ্গিয়া দেখে ডালে ফোড়ন দিতে হয়। একটু মুখ খরচ করে যে ফোড়ন কাটবে, সে জো-ও নেই। তবে মিথিলা এতটুকু নিশ্চিত, তার বারান্দা দেখে কোনো লোক মন্তব্য করতে পারবে না। যেদিন থেকে সামর্থ্য হয়েছে, কিস্তিতে একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে মেশিনের ড্রায়ারেই সবকিছু শুকিয়ে নিয়ে শোবার ঘরে মেলে দেয়। এতে তার অন্তর্বাস অন্তত প্রদর্শনী হওয়া থেকে বাঁচে। মিথিলার এ রকম ভাবনা নিয়ে ইরা ভীষণ হাসে। বলে, মিথি নাকি বাঙালি মধ্যবিত্ত কিংবা নি¤œবিত্তের ব্রার ফিতা আর পিরিয়ডের প্যাড লুকানোর আগল থেকে এখনো বের হতে পারেনি। এসব আলাপে মিথিলার অবশ্য কিছু যায়-আসে না, কিন্তু খুব বেশি আধুনিক হওয়ার যে সুপ্ত ইচ্ছা ওর ভেতরে চাড়া দেয়, সেটা কোথায় যেন একটু খচখচ করে ওঠে। ও তো আর সবার মতো অনলাইন খুঁজে খুঁজে ব্র্যান্ডের অন্তর্বাসই পরে, তাহলে সেটা দেখালেই-বা ক্ষতি কী! আমি আমার ব্যক্তিগত বিষয় সবার সঙ্গে শেয়ার করতে আগ্রহী নই; ব্রা, প্যাডের আলাপও সবার সঙ্গে করতে ইচ্ছুক নই--এমন একটা তকমা এঁটে এসব ব্যাপারে আলাপ শেষ করে মিথিলা। এক-আধদিন আলাপ যে খুব জমে ওঠে--তা নয়, কিন্তু সেখানে ওর উপস্থিতি একেবারে দুধভাতের মতো, বড়জোর হুঁ-হাঁ কিংবা একটা হাসিতেই সীমাবদ্ধ। 

মিথিলাদের অফিসের মেয়েরা কী অবলীলায় ছেলেদের সামনেই পিরিয়ড আর হ্যাভিং সেক্সের গল্প বলে। ছেলেরাও বেশ আহা-উহু করে তা শুনে। পিরিয়ডের আগে পোস্ট মিনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম তথা পিএমএস নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে, তার সঙ্গে চোখের নিচের কালি বা গালের ব্রণের ছবি ঝুলিয়ে আদিখ্যেতা করতেই হবে রাকাকে। রাকার নামটা বেশ স্মার্ট। একদিন এইচআরে একটা কাগজ আনতে গিয়ে মিথিলা দেখল, ওর নাম রোকেয়া খাতুন রোকসানা। কবে কোন মফস্বলে বাবা কোন ক্ষ্যাত নাম রেখেছিল, সেটা নিয়ে তো আর ঢাকা শহরের করপোরেট হাউসে কাজ করা যায় না। তাই নাম সংস্কার, নাম পরিবর্তন; সঙ্গে গেটআপ-মেকআপও। শুধু মিথিলাকেই আজন্ম ঢাকায় বসবাস করেও চেনা মধ্যবিত্ত গণ্ডি থেকে বের না হতে পারার কারণে ‘গ্রাম থেকে আইছি’ ট্যাগ লাগিয়ে রাখতে হয়। 

মিথিলাদের অফিসের শাওন আপার বেড়ে ওঠা যশোরে। ঢাকায় এসেছেন বছর আটেক হবে। মিথিলার ইমিডিয়েট বস। বস বলেই তার সব আলাপ-আচার গিলতে হয় আর ‘জি বস, জি বস’ করতে হয়। সেদিন একটা ট্যাটু করিয়ে এসেছিলেন অফিসে। এসেই গল্প শুরু করলেন, ‘ট্যাটুটা নেপাল থেকে করিয়ে এসেছি, লাস্ট উইকএন্ডে গিয়েছিলাম।’ পুরো অফিসের সবাই তখন ভেঙে পড়েছিল গলার নিচে করা শাওন আপার ট্যাটু দেখতে। ডিজাইনের ছেলেমেয়েরা ট্যাটুর ডিজাইন, অ্যাসথেটিকস, সৌন্দর্য নিয়ে আলাপ জুড়ে দিল। মার্কেটিংয়ের মিনহাজ খরচ নিয়ে একপশলা আলাপ করল। নেপাল যাওয়ায় লস হলো, না লাভ হলো--সেটাই মেইন টপিক। শাওন আপা অবশ্য কোথাও ঠকেন না। তিনি জিততে পছন্দ করেন এবং জেতেন। খরচের আলাপ তোলায় মিনহাজকে তিনি বেশ ধাতালেন, ‘ওই মিয়া, চামে যে আমার নেপাল ঘোরা হলো।’ 

দুপুরের মিটিংয়ের ফাইল গোছাতে গোছাতে সবার আলাপ শুনছিল মিথিলা। আলাপের সময় মুখে খুব মিষ্টি একটা হাসি ধরে রাখতে হয়েছে তাকে। আফটার অল তার ইমিডিয়েট বসকে নিয়ে আদিখ্যেতা করা হচ্ছে। তাই তাকে তো হাসি ধরে রাখতেই হবে। 

ছেলেবেলায় স্কুলের বাৎসরিক নাট্যানুষ্ঠানে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা মিথিলার বেশ কাজে লাগে এখন। যখন-তখন বিন্দাস অভিনয় করে ফেলা যায়। নেহাত নানারকম সুযোগ সুবিধাসহ মাস শেষে এতগুলো বেতন, তা না হলে এই করপোরেট মার্কেটিং হাউসে কাজ করার কোনো ইচ্ছাই আর মিথিলার নেই। তিনবেলা সহকর্মীদের ফুটানি দেখতে দেখতে এখন সে ক্লান্ত। 

শাওন আপার তিন বছর পরে এখানে জয়েন করেছে মিথিলা। এরপর পরপর দুবার ডাবল প্রমোশন পেয়ে প্রায় শাওন আপার চেয়ারের পথে পা বাড়িয়েছে। আরেকটা ডাবল প্রমোশন বাগাতে পারলে হয়তো আপার চেয়ারটাও টপকে যাওয়া যাবে। কিন্তু অফিস ডেকোরামে তখন বিশাল একটা ঘাপলা হবে বলেই সেটা হচ্ছে না, মিথিলাও চুপচাপ মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও আড়ালে-আবডালে প্রায়ই তাকে শুনতে হয়, বসদের সঙ্গে শুয়ে এসব প্রমোশন বাগিয়েছে। কথাগুলো মিথিলার কানে এলে সে শুধু ঠোঁটে একটা শুকনো হাসি ঝুলিয়ে রাখে, আর কিচ্ছু করে না। খোদ শাওন আপা রাতদিন ক্লান্তিহীনভাবে করে চলেন এসব আলাপ--কখনো জুনিয়র, কখনোবা সিনিয়র কলিগদের সঙ্গে। অফিসে নিষ্ঠা দিয়ে কাজ করলে তার খেসারত এভাবে দিতে হয়, এটা সে আগে জানলেও বিশ্বাস করত না। ভাবত, মফস্বলে বড় হওয়া মানুষ কখনো অসৎ হতে পারে না, তারা দায়িত্বশীল ও পরিশ্রমী হয়। তবে তিলোত্তমা নগরীতে জন্ম এবং এই নগরীর মেয়ে বলে তার নিজের ভেতর এতকাল যে একটা গর্ব ছিল, এখানে জয়েন করার পর তা বেমালুম ভুলে গেছে মিথিলা। এখন সে অন্যদের চোখে ঢাকা দেখার গল্প শোনে আর নিজের হাত নিজে কামড়ায়। হাতটা অবশ্য প্রকাশ্যে কামড়ায় না, কর্মটা চলে একান্ত সংগোপনে। নতুবা এই সব মফস্বলী আলট্রা মডার্ন নারীকুল, যাদের অধিকাংশই কুঁচি দেওয়া পাজামার ওপর গেঞ্জি পরার মাধ্যমে প্রথমে আধুনিক হতে শুরু করেছিল, তারা ঠাস ঠাস মাইন্ড করবে যে! 

শাওন আপার নেপালি ট্যাটুবিষয়ক আলাপের দিনও হাত কামড়ানো আবশ্যক হয়ে পড়েছিল মিথিলার। তার চোখের সামনে পাসপোর্ট রিনিউ করতে দিল শাওন আপা। ওর ভাই এসে মিথিলার সামনেই নিয়ে গেল সেই পাসপোর্টের স্লিপ। আর এখন গল্প দিচ্ছে নেপাল ঘুরে এল, ট্যাটু করিয়ে এল! বস না হলে ওই দিন অপমানই করে বসত এ কথা বলে যে পাসপোর্ট ছাড়া কেমন করে ঘুরে এলেন আপা? 

অফিসের সবাই অবশ্য আরেক কাঠি ওপরে, নাচুনি বুড়িকে সবসময় ঢোলের বাড়ি দিতে ওস্তাদ--ছবি দেখান, ছবি দেখান বলে শাওন আপাকে পাগল করে ফেলছিল। জবাবে আপা ফাঁদলেন নতুন এক গল্প, নেপালে যাওয়ার পর তার মোবাইল পানিতে পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়, তাই ছবি-টবি তুলতে পারেননি। শুনে সবাই একচোট আহা-উহু করল খুব। 

শাওন আপা দেড় বছর ধরে যে মোবাইল ব্যবহার করছিলেন, এখনো সেটাই করছেন। সেদিন অফিসে ঢোকার মুখেও তাকে সেই ফোনেই কথা বলতে দেখেছে মিথিলা। 

সেদিন এইচআরের সানা এসেও টিপ্পনী কেটেছিল, ‘কী শাওন আপা, কার সঙ্গে ঘুরে এলেন?’ বিনিময়ে শাওন আপা স্বভাবসুলভ রহস্যময় হাসি দিলেন, আর সেলসের সব জুনিয়র হই হই করে উঠল, ‘আরে আপা, কে কে? নিশ্চয় নতুন কেউ?’ শাওন আপা এক প্রেমিক বেশিদিন বজায় রাখতে পারেন না। অবশ্য তার গোবেচারা একজন স্বামী আছে বটে, বউয়ের এসব প্রেমিক-টেমিক, ঠাঁটবাট সম্ভবত তিনি এনজয়ই করেন। 

মিথিলা আর এত চাপা সহ্য না করতে পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেলল, ‘মোবাইলটা কোথায় পড়েছিল আপা?’ 

‘আর বলিস না, পোখারায় একটা নদী আছে না? সেই নদীতে পা ভিজিয়ে ছবি তুলতে গিয়েই টুপ করে পড়ে গেল।’ 

এবার ঢোক গিলল মিথিলা, ‘বাবাহ! আপনি দুই দিনে কাঠমাণ্ডু, পোখারা ঘুরে এলেন?’ 

শাওন আপা বেশ চালাক, পা দিলেন না মিথিলার ফাঁদে। ট্যাটু করাবেন শুনে কী করে তার নেপালি বন্ধু আর্টিস্ট খুঁজে এনে দিল, শোনালেন সেই গল্প। আপার ডেস্কের সামনের সবার উত্তেজনা তথা এক্সাইটমেন্ট তখন এক লাফে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের মতো বেড়ে গেল। ব্র্যান্ডের দুই জুনিয়র মুহিব আর পৃথা তো লাফ দিয়ে উঠল, ‘প্লিজ, তোমার ফ্রেন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দাও না, ফেসবুক আইডি দাও, প্লিজ।’ এই দফায়ও বেশ স্মার্টলি সামলে নিলেন শাওন আপা, বললেন তার বন্ধু ফেসবুক ব্যবহার করে না। এ সময় মিথিলার বেশ কষ্টই লাগছিল। এত মিথ্যা বলতে হচ্ছে বেচারিকে। 

শাওন আপা অবশ্য সততার পরাকাষ্ঠা-জাতীয় চরিত্রের মানুষ নন। সব আয়োজনে, সব জায়গায় নিজেকে একটু এগিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। ফলে এই উদ্ভট প্রতিযেগিতায় নেমে দিনে দিনে কীভাবে কীভাবে যেন প্যাথলজিক্যাল মিথ্যুক হয়ে উঠেছেন। পড়েছেন হোম ইকনোমিকস কলেজে। কিন্তু সারা দিন দাবি করেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অমুক স্যারের সঙ্গে তার আড্ডা ছিল, তমুক স্যার তাকে চোখে হারাতেন। তবে শাওন আপা যত মিথ্যার গাছগল্প ছড়িয়ে বসুক না কেন, ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ আচরণে তিনি এক শতে এক শ পাবেন। এই গল্পগুলো ভুলেও কোনো দিন তিনি বসদের সামনে করবেন না, পাছে তারা তাকে একটা টারমিনেশন লেটার ধরিয়ে দেয় বা তার আসল গোমর ফাঁস করে দেয়। 

ভোররাতে অফিসের শাওন আপার কথা মাথায় আসায় একটু বিরক্তই হলো মিথিলা। কে এত আয়েশ করে গরুর মাংস রান্না করছে? কেউ নিশ্চয় খুব সকালে বেরিয়ে যাবে। নিশ্চিত সে কোনো রান্নাপ্রেমী, কারও জন্য রান্না করে নিয়ে যাবে। মিথিলার ঘুমটা চটে গেছে। কিছু একটা খেতে ইচ্ছা করছে। মোবাইলে টুং করে আওয়াজ হলো। মেসেঞ্জারে এ সময় কে নক করল? 

আরিফ নক করেছে, ‘ঘুমিয়েছ মিথিলা?’ 

আজিব, এটা কি জেগে থাকার সময়? মিথিলা গত সপ্তাহেই ব্র্যান্ডের পৃথার কাছ থেকে আনসিন অবস্থায় মেসেজ দেখা শিখেছে। এখন সিন করা মানেই আরিফকে পাত্তা দেওয়া। আরিফ তাদের অফিসে শাওন আপার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। মিথিলা যেদিন সেলসে জয়েন করে, সেদিন বিকেলেই কফি খেতে নিয়ে গিয়ে শাওন আপা তাকে একগাদা বাজে কথা বলেছিলেন আরিফ সম্পর্কে। তার থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন। তবে প্রথম দিনই অমন উপদেশ পোষায়নি মিথিলার। কিন্তু জীবনে শুধু শুনবে, কিছু বলবে না--এমন শপথ নেওয়ার কারণে সবার কথা সে কেবল শুনেই গেল। আরিফ নাকি এই অফিসের টপমোস্ট ‘মাগিবাজ’। একজন পুরুষের নারীপ্রীতিকে এমন শব্দেও যে ব্যাখ্যা করা যায়, সেটা ওই দিনই শাওন আপা থেকে শিখেছিল সে। মিথিলার মধ্যবিত্ত অহংবোধে এসব স্ল্যাং আর চটুল কথাবার্তা বেশ আঘাত করলেও এখন খানিকটা মানিয়ে নিয়েছে। কথায় কথায় মুখ খারাপ করাটাই যেন তার সহকর্মীদের কালচার। মিথিলা শুধু ভাবে, কেন যে বাফায় নাচ শিখেছিল, কেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বই পড়ে অমন সুশীল হয়েছিল? ছায়ানট বা রমনা বটমূলে দৌড়ে তার কী হয়েছে? এরা এসবের কিছু না করেই তো বেশ করে-কম্মে খাচ্ছে। প্রথম কয়েক দিন শাওন আপার চোখে অফিসের সবাইকে দেখার চেষ্টা করলেও দুদিন বাদেই নিজের চোখের চশমাটা পরে নিয়েছিল মিথিলা। ফলে আরিফের ‘যারে দেখি লাগে ভালো’ রূপটা অল্প দিনেই দেখতে পেরেছিল। শাওন আপার কাছে প্রতিদিন একাধিকবার আরিফের নামে নামে কুচুটেপনা শুনে প্রথম প্রথম তার যে একটু অস্বস্তি লাগেনি, তা নয়। তবে এগুলো মিথিলা তেমন পাত্তা দেয়নি। যেমন একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আর পাত্তা দেয়নি আরিফকেও। 

আরিফের একটাই দুঃখ, চার বছরেও মিথিলাকে তার প্রেমের বড়শিতে খেলিয়ে তুলতে পারল না। অবশ্য মিথিলা যে প্রেমে পড়ত না বা পড়ে না, এমন তো নয়, এঁটো খাওয়ার অভ্যাস নেই বলেই এড়িয়ে গেছে। তার পরও হাল ছাড়েনি আরিফ। এখনো মিথিলা বিমুগ্ধকরণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে মাঝরাতে বা এরকম ভোরবেলায় আহ্লাদের মেসেজ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। 

একই ধরনের কথোপকথন শাওন আপার সঙ্গেও আছে আরিফের। মিথিলা এটা জেনেছিল শাওন আপার সূত্রেই। আরিফকে মিথিলার চোখে নর্দমার কীট প্রমাণ করতে শাওন আপা একবার তাদের দুজনের ভালগার সব কথোপকথনের স্ক্রিনশট পাঠিয়েছিল তাকে। সেসব স্ক্রিনশটে আরিফের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শাওন আপারও অশ্লীল কথাবার্তা ছিল। সব দেখে মিথিলা একটু গুনগুন করে বলেছিল, ‘আপনিও তো কম আলাপ দেন নাই আপা।’ তখন খানিক থতমত খেয়ে তিনি বলেছিলেন, এরকম আলাপ নাকি করতে হয়। নতুবা ছেলেরা মাথায় চড়ে। তারপর ‘অফিসে এসব নিয়ে কোনো আলাপ হবে না’--এমন দিব্যি কাটিয়ে, ল্যাটের সঙ্গে ইংলিশ স্যান্ডউইচ খাইয়ে বেশ হাত করার চেষ্টা করেছিলেন মিথিলাকে। 

আসলে শিল্প-সাহিত্য-সংগীত দিয়ে কথা শুরু করে বিছানায় চলে যেতে পারে আরিফ। প্রথম দিকে মিথিলার সঙ্গে আরিফের আলাপ জমেছিল কবিতা-সাহিত্য দিয়ে। অফিসের সেলসের হেড হওয়ার রেসে আরিফ-শাওন আপা ও মিথিলা আপা প্রায় একই সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। মিথিলার কাজের অভিজ্ঞতা একটু কম বলে পিছিয়ে আছে। তবে কাজের ইনডেক্স ভালো হওয়ায় তাকে কেউ এখন উপেক্ষা করতে পারছে না। কিন্তু আরিফ আর শাওন আপার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইটা সবাই বেশ আয়েশ করেই দেখছে। 

এই মুহূর্তে মিথিলার হাতে একটা ভালো অফার আছে। তাই এদের দুজনের ইঁদুরদৌড়ে নিজেকে নামাতে ইচ্ছা করছে না। একসময় বেশ জোর করেই জীবনের নানা জটিলতায় জড়িয়ে পড়ত মিথিলা। আজকাল এগুলো কিছুই করতে ইচ্ছা করে না। মিথিলার বন্ধু তপতী বলে, ওর বয়স হয়েছে। কতই-বা বয়স? এখনো চল্লিশ হয়নি। মিডল এজ ক্রাইসিস বলে যে শব্দের ভয়ে বুড়ো হওয়ার পথে হাঁটছে, সেই পথও প্রায় শেষ। তেমন কোনো সংকট হয়নি। ঋজুর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর মিথিলা বেশ একা হয়ে গেছে। ঋজু স্বামী কম কিন্তু বন্ধু বেশি ছিল। ওর সমস্যা ছিল একটাই, অমন উচ্চাকাক্সক্ষী ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা যায় না। টার্গেট পূরণের জন্য যে কারও চাহিদা পূরণের কালচার ঋজু রপ্ত করেছিল, সেটা মিথিলার পোষায়নি। তবু ভেবেছিল মানুষটা তো তার বন্ধু, শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারবে। পারেনি। কারণ, প্রতি পদে পদে মিথ্যা কথা বলত ঋজু। তার ওপর মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে ওর অতিরিক্ত ঢলাঢলি মিথিলাকে হাঁপিয়ে তুলেছিল। তখন আতাহারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তার। ওদের সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব হলেও সেটা আসলে হালকার ওপর ঝাপসা প্রেমই ছিল। এক সম্পর্কে হাঁপিয়ে উঠে আরেক সম্পর্কে লেপ্টালেপ্টি করার মতো মারাত্মক ভুল আর নেই। সেই ভুলে মিথিলা ভুগেছেও। ঋজুর আর তার সংসারে পুনরায় এন্ট্রি নিতে গিয়ে একসময় যে ভুলটা করেছিল, সেটার মাশুল সে আজও দিচ্ছে। 

সারাজীবনের বন্ধু তুলি খালাকে মিথিলা বলেছিল তার জীবনের সব সংকটের কথা। খালারা যেমন বুদ্ধি দেয়, বাচ্চা নিয়ে নে, নিজেও সংসারে ফিরবি, ঋজুও ফিরবে, তিনিও তা-ই দিয়েছিলেন। এমনিতে মিথিলার শাশুড়ি, মানে ঋজুর মা অসংখ্যবার বাচ্চা নেওয়ার কথা বলেছেন তাদের, একটা সময় পর্যন্ত নানা অজুহাতে সেটা এড়িয়ে গেছে ঋজু। পরে আবার নতুনভাবে সংসার শুরু করার সময় মিথিলা যখন তাকে জোর করেছে, তখন ঋজু আর না করেনি। ফলাফল ফার্স্ট ইস্যু, ফার্স্ট মিসক্যারেজ। একটা সন্তানের স্বপ্ন গল্পের বইয়ে পড়া আর বাস্তবে সেই গল্পের সঙ্গে বড় হওয়ার হ্যাঁপাটা মিথিলা সে সময় বুঝে উঠতে পারেনি। তিনমাস মাত্র নিজের মধ্যে বড় করতে পেরেছিল বাচ্চাটাকে। ছোট্ট সেই পুতুলটার ছোট ছোট হাত-পা হয়েছিল। লেবাররুমের ডাক্তার সেই মৃত দেহখণ্ডের ডেলিভারি করানোর সময় বলেছিলেন, ইশ্, আর দশটা দিন টিকে থাকলে জানতে পারতেন ছেলে না মেয়ে। নাম রাখতে পারতেন। জীবনের প্রথম সন্তান হারানোর সময় নাম রাখার মতো আনন্দময় ঘটনার কথা ভাবতে পারেনি মিথিলা। 

এরপর থেকে সব কেমন পাল্টে গেল। মিথিলা ঋজুকেই সহ্য করতে পারত না। ঋজুরও এরকম আধপাগলা- খ্যাপাটে মিথিলার সঙ্গে লেনদেনে আগ্রহ কমে আসছিল। ফলাফল ডিভোর্স। গুষ্টিসুদ্ধ লোক হা হা করে তেড়ে এসেছিল। শুধু মেজ ভাই আর বাবা পাখির মতো আগলে রেখেছিলেন তাকে। মেজ ভাই সে সময় পাশে ছিলেন বলে এখন আবার কাজে ফিরতে পেরেছে মিথিলা। 

পেট চালানো, বছরে দুয়েকটা দশদিনের ট্যুর দেওয়ার মতো টাকার চাকরিই ওর দরকার। মিথিলার বাবা অনেক আগে রিটায়ার্ড করলেও একটা অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া থেকে তার হাতখরচ উঠে আসে। আর তিনি থাকেনও মেজ ভাইয়ের সঙ্গে। মেয়ে ভালো আছে--এটাই এখন বাবার কাছে অনেক। 

আরিফের পাঠানো মোসেজের দিকে চেয়ে লতায়-পাতায় একাকার হয়ে কত কী মনে পড়ল! মাংস রান্নার ঘ্রাণ এ মুহূর্তে আর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু মিথিলার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, একটু আগে কে মাংস রান্না করছিল? কার জন্য রান্না করছিল? বিশেষ সম্পর্কের কেউ? আদতে মিথিলা এ জীবনে সম্পর্কের এত এত গলি-ঘুপচি ঘুরে এসেছে যে কেবল প্রমোশন বা অফিসে নিজের গুরুত্ব, পলিটিকস ইত্যাদি ঠিক রাখার জন্য এসব প্রেমের বাতাস-মার্কা মেসেজ ওকে আর টানে না; এগুলোতে বরং ও বিরক্তই হয়, মনের মধ্যে কেমন যেন বিবমিষা জাগে। 

মিথিলা বিছানা থেকে উঠল, কিছু একটা খাবে, খুব ক্ষুধা লেগেছে। খুব ইচ্ছা করছে মাংসের গন্ধ ধরে সেই বাসায় চলে যেতে। একটা ছোট বাটি নিয়ে গেলে কি ফিরিয়ে দেবে? নিশ্চয় ফেরাবে না। ঋজুর কথা খুব মনে পড়ছে, সে একবার এমন একটা কা- করেছিল। দুই ফ্লাট নিচে কেউ শুঁটকি রান্না করছিল। ঋজুর শুঁটকিপ্রেম আর বউপ্রেম ছিল সমার্থক। বাটি হাতে ঠিক ফ্ল্যাট খুঁজে চেয়ে একটু শুঁটকি নিয়ে তবেই ঘরে ফিরে এসেছিল ঋজু। 

চার বছর ধরে মিথিলা নেই ঋজুর সঙ্গে, তবু ক্ষণে ক্ষণে আলোকপ্রক্ষেপণ যন্ত্রের মতো স্মৃতিগুলো উঁকি দেয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কি ভোলা যায়? এই শহর কি ভুলিয়ে দিতে পারে? 

গত বছর এক বন্ধুর বিয়েতে দেখা হয়ে গিয়েছিল। কেমন আছ, কী করছ--এটুকু বলে সরে এসেছিল দুজনেই। সেদিন রাতে ঋজু মেসেজ দিয়েছিল, ‘শুধু মিথ্যা না বলেই তোমাকে বলা হলো না ভালোবাসি! মিথ্যা হলে ঠিক বলা যেত কতটা ভালোবাসি।’ 

এক বছর ধরে প্রতিদিন রাতে মিথিলার একবার করে পড়ে ঋজুকে। মনে মনে ভাবে, ঋজু একবার তাকে ফিরতে বলুক, ফিরে যাবে। এই শহরকে মিথ্যা প্রমাণ করে সে ফিরে যাবে। কিন্তু না ঘরকা, না ঘাটকার মতো শহরের আধাখেষ্টা করপোরেট সংস্কৃতিই হয়তো ঋজুদের ঘরে ফিরতে দেয় না। আর মিথিলাদের পাশে মিথ্যাগুলো দশ পিঁপড়া থেকে হাজার পিঁপড়া হয়ে ক্রমাগত ঘুরে বেড়ায়, শুধুই ঘুরে বেড়ায়...।



লেখক পরিচিতি
ফাতেমা আবেদীন নাজলা
জন্মস্থান: বাগরাকশা, শেরপুর জেলা
থাকেন ঢাকায়। 
সাংবাদিক। গল্পকার।

প্রকাশিত বই: সেই সকালের গল্প (উপন্যাস)
ছায়া খুঁজে ফিরি (গল্প সংকলন)
প্রকাশনী: জাগৃতি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. বন্ধু, তেমার সহাসের প্রশংশা করতে হয়। অসাধারণ গল্প লিখ। কি সুন্দর, সাবলীল ভাষায় আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা একটা গল্প বলে গেলে। সাহসের প্রশংশা করতে হয় বলছিলাম এইজন্যে যে গল্পটা পড়ে অনেকেই হয়তো তোমার উপর বিরাগভাজন হবে কারণ এই গল্পের অনেক কিছুই অনেকর সাথে মিলে যাবে, যা তাদের মোটেও ভাল লাগবে না।

    উত্তরমুছুন