কী অদ্ভুত পোকাগুলো, অথবা পোকাটি । আসলাম নিশ্চিত নয় পোকা একটা, না অনেক কটা। কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না। শব্দ যা হয়, তা ভয়াবহ, ক্ষমাহীন, ভাড়াটে খুনির মতো পিছু লেগে থাকা। অবাক কাণ্ড, আসলাম যখন খাওয়া শেষে টিভিতে খবর শুনে এ ঘরে ঢোকে, ঘরটা থাকে সুনসান। এসি খুলে সে যখন একটা বইয়ের পাতা খুলে আরামকেদারাটাতে বসে, তখনো এসির মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ থাকে না। রাত একটা বাজে : গায়ে নৈঃশব্দ্যের চাদর জড়িয়ে পড়ে থাকে ঘরটা। দুইটা বাজে : মনে হয়, সেটি যেন মেঘনার মাঝখানে ডুবে আছে। কিন্তু বালিশে মাথা ফেলে ঘুমের রাস্তায় পোয়া মাইলও সে যেতে পারে না, কাঠপোকার করাতকলে রাত্রির কালোয়াতি শুরু হয়ে যায়- কর্র্ কর্র্ কর্র্ ।
দু-একবার আসলামের মনে হয়েছে, কাঠপোকাটা যেন কোনো অদৃশ্য কাজির হয়ে সমন জারি করতে এসেছে তার ওপর, অথবা তাকে দেওয়া শাস্তিটা বলবৎ করছে। এবং শাস্তিটা হচ্ছে তাকে ঘুমাতে না দেওয়া। ঘুমটা খুব প্রিয় আসলামের, বালিশে মাথা রাখলেই নিদ্রাদেবী এসে তাকে কোলে করে নিয়ে চলে যান। সেই ঘুম যখন পালায় চোখ থেকে, শাস্তিটা হয় যেন ফাঁসি থেকেও বেশি। কেন শাস্তি পাবে আসলাম? পাবে; কারণ সে রেহেনার সাথে প্রতারণা করেছে। আসলামের অফিসের সাজুগুজু করা মেয়েটার সঙ্গে তাকে অন্তরঙ্গ একটি ভঙ্গিমায় দেখা গেছে, এরকম খবর রেহেনার কাছে কানে পৌছাবার পর আসলামকে সে শোবার ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। সে আজ তিন রাত হলো। সেক্রেটারি মেয়েটার নাম ডানা। চেহারায় জোর করে আনা লাস্যময়ী একটা ভঙ্গি আছে। চাহনিতেও আঠা দিয়ে লাগানো পারলে-ছুঁয়ে-দেখুন ধরনের আমন্ত্রণ আছে। আসলামের নতুন অফিসে যে একবারই আমি গিয়েছি, সে আমাকে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যদিও পরিচিত হবার কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। মেয়েটি—ডানা—মাত্র এক মাস আগে চাকরি পেয়েছে। আসলাম আমাকে বলেছে, বিদেশি অনেক বায়ার আসে, একটা ভলাপচুয়াস সেক্রেটারি দরকার, যে তাদের চিত্তহরণ করবে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ভলাপচুয়াস শব্দটার বাংলা কী? আমি বলেছিলাম, লাস্যময়ী, ইন্দ্রিয়সুখকর। তবে মেয়েটির লাস্যময়তার আড়ালে দারিদ্র্য উঁকি দিচ্ছিল। কোথায় যেন একটা ত্রাস, পথে বসে যাওয়ার ভয়। সেই ভয়ের ওপর মেয়েটি লাস্যময়তার একটা মুখোশ বসিয়ে দিয়েছিল মাত্র। ফলে ইন্দ্রিয়সুখকরের চাইতে তাকে করুণই বেশি দেখাচ্ছিল আমার কাছে। এই মেয়েটির সঙ্গে কিনা অন্তরঙ্গ ভঙ্গিমায় আসলাম ধরা পড়েছে আরেক সেক্রেটারি মমতা আক্তারের কাছে, যে কিনা আবার রেহেনার সৎ বাবার প্রথম রিস্তার ছোট শালার মেয়ে?
দু-একবার আসলামের মনে হয়েছে, কাঠপোকাটা যেন কোনো অদৃশ্য কাজির হয়ে সমন জারি করতে এসেছে তার ওপর, অথবা তাকে দেওয়া শাস্তিটা বলবৎ করছে। এবং শাস্তিটা হচ্ছে তাকে ঘুমাতে না দেওয়া। ঘুমটা খুব প্রিয় আসলামের, বালিশে মাথা রাখলেই নিদ্রাদেবী এসে তাকে কোলে করে নিয়ে চলে যান। সেই ঘুম যখন পালায় চোখ থেকে, শাস্তিটা হয় যেন ফাঁসি থেকেও বেশি। কেন শাস্তি পাবে আসলাম? পাবে; কারণ সে রেহেনার সাথে প্রতারণা করেছে। আসলামের অফিসের সাজুগুজু করা মেয়েটার সঙ্গে তাকে অন্তরঙ্গ একটি ভঙ্গিমায় দেখা গেছে, এরকম খবর রেহেনার কাছে কানে পৌছাবার পর আসলামকে সে শোবার ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। সে আজ তিন রাত হলো। সেক্রেটারি মেয়েটার নাম ডানা। চেহারায় জোর করে আনা লাস্যময়ী একটা ভঙ্গি আছে। চাহনিতেও আঠা দিয়ে লাগানো পারলে-ছুঁয়ে-দেখুন ধরনের আমন্ত্রণ আছে। আসলামের নতুন অফিসে যে একবারই আমি গিয়েছি, সে আমাকে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যদিও পরিচিত হবার কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। মেয়েটি—ডানা—মাত্র এক মাস আগে চাকরি পেয়েছে। আসলাম আমাকে বলেছে, বিদেশি অনেক বায়ার আসে, একটা ভলাপচুয়াস সেক্রেটারি দরকার, যে তাদের চিত্তহরণ করবে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ভলাপচুয়াস শব্দটার বাংলা কী? আমি বলেছিলাম, লাস্যময়ী, ইন্দ্রিয়সুখকর। তবে মেয়েটির লাস্যময়তার আড়ালে দারিদ্র্য উঁকি দিচ্ছিল। কোথায় যেন একটা ত্রাস, পথে বসে যাওয়ার ভয়। সেই ভয়ের ওপর মেয়েটি লাস্যময়তার একটা মুখোশ বসিয়ে দিয়েছিল মাত্র। ফলে ইন্দ্রিয়সুখকরের চাইতে তাকে করুণই বেশি দেখাচ্ছিল আমার কাছে। এই মেয়েটির সঙ্গে কিনা অন্তরঙ্গ ভঙ্গিমায় আসলাম ধরা পড়েছে আরেক সেক্রেটারি মমতা আক্তারের কাছে, যে কিনা আবার রেহেনার সৎ বাবার প্রথম রিস্তার ছোট শালার মেয়ে?
আসলামের না একটা বিবিএ-পড়ুয়া মেয়ে আছে, বড় দুই ছেলের কথা বাদ দিলেও?
মানবচরিত্র পাঠ একজনমের কাজ, ভাই। লালনের যুগে যেমন, আমাদের যুগেও তেমন। অথচ এই মানব, আসলাম, আমার কলেজ-জীবনের বন্ধু এবং একটা সময় পর্যন্ত, অর্থাৎ পাঁচ-সাত বছর আগে মাত্র কয়েক বছরে কোটিপতি গুণিতক পঞ্চাশ বনে যাওয়া পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, তাকে পড়তে পারি আমার হাতের তালুর মতো। হায়!
২
দ্বিতীয় রাতে কাঠপোকারা তার নিদ্রাভঙ্গের সমন নিয়ে এসে হাজির হলে ডিভানে উঠে বসে আসলাম ভাবল, লাস্যময়ী মেয়েটা থেকে দূরে থাকতে তাকে উপদেশ দিয়েছিল ইংরেজির অধ্যাপক তার বন্ধুটি। কেন সে থাকল না? মেয়েটির সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিমা না ছাই, তার একটা হাতও সে ধরেনি। মেয়েটিই বরং হঠাৎ তার কোমর জড়িয়ে ধরে তার দিকে টেনে নিয়ে গেছে । তাহলে কেন রেহেনা ব্যাপারটা নিয়ে পাড়া মাথায় করবে? লাস্যময়ীর ওপর ভীষণ রাগ হলো আসলামের, অধ্যাপক বন্ধুটার ওপরও। সে ফোন খুঁজে পেতে অধ্যাপকের নম্বরটা টিপল। অধ্যাপক জেগেই ছিল । অবাক! তারও রাত জাগার অভ্যাস। তাকে সে জানাল, রেহেনাকে সে ঘর থেকে বের করে দেবে। অন্যের দোষে আসলাম কেন সাজা পাবে?
অন্যটা কে? অধ্যাপক জিজ্ঞেস করল।
লাস্যময়ী ।
অনেকক্ষণ ধরে হাসল অধ্যাপক । তারপর তাকে বলল, মেয়েটা গরিব। একটা গরিব মেয়ে কিছুতেই তাকে দুহাতে টেনে ধরে নিজের বিপদ ডেকে আনবে না। তা ছাড়া, অধ্যাপক প্রশ্ন করল, নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখেছিস ইদানীং?
কেন?
এই চেহারার কাউকে অলাস্যময়ী কেউও কি ভুল করে কাছে টানবে? এক বেচারা রেহেনা ছাড়া? হলফ করে বলতো? তাহলে দোষটা রেহেনার, না শালা তোর?
প্রচণ্ড রেগে ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিল আসলাম ।
শালা অধ্যাপক! |
তার মনে পড়ল, এই শালা অধ্যাপক তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বই দিয়ে একটা ঘর বোঝাই করে কী লাভ, যেখানে মাসে একটা বই সে পড়ে কি না সন্দেহ? আসলাম বলেছিল, ফরেন বায়াররা মাঝেমধ্যে বাসায় আসে । পার্টিতে দূতরা আসে, মন্ত্রী-এমপিরা আসেন । তারা একবার পড়ার ঘরে উঁকি দেন । ইমপ্রেসড হন ।
ও।
তা ছাড়া আমি ভয়ানক পড়ুয়া । পড়তে পড়তে কত রাত ডিভানেই কাত হয়ে যাই, বলে শেষ করতে পারব না।
ও।
আসলামের মনে পড়ে, খুব দামি বাদামি-সোনালি রঙের বইয়ের আলমারিগুলোর পাশে রাখা তার বাবার তৈরি করা কালো বার্নিশ করা কবেকার মেহগনি কাঠের আলমারিটা অধ্যাপক যেদিন দেখেছিল, যাতে বাবার জমানো বইগুলো তাকে তাকে অক্ষত সাজানো ছিল, তার চোখ কপালে উঠেছিল। আসলামের বাবা পেশায় ছিলেন একটা কলেজের শিক্ষক, নেশায় ছিলেন পাঠক। অনেক দিন ধরে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে তিনি আলমারিটা বানিয়েছিলেন এবং বানানো হলে তাতে বই ভর্তি করে তার পাশে দাঁড়িয়ে ঠিক সেই তপ্তি নিয়ে ছবি তুলেছিলেন, যে তৃপ্তি নিয়ে গুন্টার গ্রাস নোবেল পুরস্কার হাতে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়েছিলেন ।
বাবা? হোয়াট ডু ইউ থিংক ইউ আর ডুয়িং?
শালা অহনা!
৩
আসলামের বাবা যে বছর মারা যান, তার দুবছর আগে এই ফ্ল্যাটে উঠেছে আসলাম। তিন হাজার পাঁচ শ ফুটের ফ্ল্যাট, অথচ বাবাকে একবারও এই ফ্ল্যাটে আনতে পারেনি সে। যতবারই সে বলেছে, চল বাবা, তিনি মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে বলেছেন, এখন না বাবা, পরে যাব । সময় হোক।
সময়টা অবশ্য তার আগে তারই ফুরিয়ে গেছে। তিনি দেহরক্ষা করেছেন । তার আগে আসলামকে ডেকে বইসুদ্ধ (এবং আলমারির পাশে দাঁড়ানো তার ছবিসুদ্ধ) আলমারিটা তাকে দিয়েছেন। দিয়ে বলেছেন, যত্ন করে রাখিস । এই আলমারিতে আমি আমার স্বপ্ন বিনিয়োগ করেছি এবং বিনিয়োগটা ওই শরতের আকাশটার মতোই পরিষ্কার ।
তারপর শরতের আকাশে চোখ রেখেই তিনি সকল বিনিয়োগের বাইরে চলে গেছেন।
অধ্যাপককে গালি দিয়ে আবার বালিশে মাথা রাখতে গিয়ে তার বাবার কথা মনে হয়েছে আসলামের এবং কী কারণে, আসলাম জানে না—হয়তো বয়স হলে মানুষের মনটা নরম হয়ে যায়, হয়তো ডায়াবেটিসের প্রভাবে এমনটি হয়, অথবা হয়তো একটা দানে এক দিনেই সাড়ে পনেরো কোটি টাকা আয় হয়ে গেলে আনন্দটা হঠাৎ তরল হয়ে চোখ ভাসায়—তার কান্না এসেছে । অনেকক্ষণ কেঁদেটেদে বালিশ ভিজিয়ে সে উঠে বসেছে। এবার তার ক্রোধ হয়েছে । দেখে দেখে তার বাবার আলমারিতেই দাঁত বসিয়েছে কাঠপোকা? শালা কাঠপোকা! সে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বাতি জ্বালাল এবং আলমারিতে লাথি মারতে থাকল ।
অবাক । লাথির বাড়ি পড়লে কাঠপোকার করাত চালানো থেমে গেল । আসলাম এত রাগের মধ্যেও হাসল । একটা নিষিদ্ধ জন্তুর সন্তানের সঙ্গে কাঠপোকাটার তুলনা করে সে অতিরিক্ত বলল, যেমন কুকুর তেমন মুগুর । কিন্তু লাথি শেষ করার পাঁচ মিনিটও গেল না, আবার শুরু হলো কর্র্ কর্র্। এবার তার লাথি আরও জোরে হলো এবং লাথির শব্দে বিবিএ শিক্ষার্থী মেয়ে মঅহনা এসে দরজায় টোকা দিল এবং গলায় জোর ঢেলে বলল, কী হচ্ছে।
বাবা? হোয়াট ডু ইউ থিংক ইউ আর ডুয়িং?
আমার যা ইচ্ছা হয় করছি, তোর কী? বলল আসলাম এবং দরজা খুলে মেয়েটাকে বলল, লাইক মাদার, লাইক ডটার । ভাগ।
আহনা সোজা মেয়ে নয়। সে বাপকে বলল, তুমি একটা ক্রড মানুষ, বাবা । রুচিহীন। এখন কি মদটদ খেয়ে মাতলামি করছ?
আসলাম মেয়ের দিকে তেড়ে গেল । মেয়ে চোখেমুখে ঘৃণা ঢেলে বলল, ডিজগাস্টিং। তারপর চলে গেল ।
মেয়ে চলে গেলে ডিভানে বসে আসলাম টের পেল, তার পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। সে পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। না, পায়ের ব্যথা নিয়ে নয়, অহনার ব্যবহার নিয়ে। অহনা এখন তাকে পজিটিভলি ঘৃণা করে। এই ঘরে সে শুধু আছে বাবার টাকার জন্য। খুব টাকার লোভ অহনার ।
৩
তৃতীয় রাতে আসলামের রাগটা শুরু থেকেই মাথায় চড়ে ছিল, রেগে থাকার বদলে যদিও খুশি থাকার কথা ছিল তার। লাস্যময়ী ডানাকে সে ছাঁটাই করে দিয়েছে, যে মেয়েটি সব কষ্টের মূল, একই সঙ্গে ছাঁটাই করেছে মমতা আক্তারকে, অথচ মমতার ছেলেটি এই মুহূর্তে রিউম্যাটিক হার্ট নিয়ে পড়ে আছে ইউনাইটেড হাসপাতালে, তার চিকিৎসার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার প্রয়োজন। আজ বিকেলেই সরকারি একটি ব্যাংক থেকে—এবং অবাক কাণ্ড, ব্যাংকটির নাম সে ভুলে গেছে, শুধু মনে হচ্ছে ব্যাংকটির নামের সঙ্গে কোন বিদেশি নায়িকার জানি চুলের রঙের মিল আছে—বেশ বিরাট অঙ্কের একটা ঋণ পেয়েছে । মমতাকে ছাঁটাইয়ের নোটিশটা দেওয়ার পর রেহেনাকে সে ফোন করে বলেছিল, তুমি যদি পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাকে ফোন করে বলো, সলু, মমতাকে তুমি রাখো, ডানাকে হেঁটে দাও, তাহলে আমি তা করব, করবো শুধু না, বেতন-ফেতন বাড়িয়ে দেব কিন্তু রেহেনা ফোন করেনি। ফোন করবে কি, অন্যমনস্কভাবে সে যে আসলাম ওরফে সলুর—বিয়ের রাতে শুধু দুজনের মধ্যে বিনিময়যোগ্য এই নামটি রেহেনা তাকে দিয়েছিল—ফোনটি ধরেছে, সেই রাগে সে নিজের হাত কামড়িয়েছে, আসলামের বেঁধে দেওয়া পনেরো মিনিটসহ আধা ঘণ্টা । আসলাম বাড়ি ফিরেছে রাত এগারোটায়। আজ বাইরেই খেয়েছে, ঘরে ফিরে টিভিও দেখেনি, সোজা গেছে পড়ার ঘরে।
একটা বই হাতে সে আরামকেদারায় বসে ভাবল, বইটই সব সে ফেলে দেবে, তার খেয়াল হলো, এই তিন রাত ধরে তার হাতে একটিমাত্র বই-ই উঠে এসেছে, অথচ এর একটা পৃষ্ঠাও তার পড়া হয়নি।। পড়া দূরে থাক বইটা যে কী বই, নভেল, নাটক না ফটকা বাজারবিষয়ক, এ বিষয়টিও সে ঠাওর করতে পারেনি। রেহেনা আক্তারকে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সে আগেই নিয়েছিল। এবার রেহেনার সঙ্গে যোগ হলো বইগুলোর। আগামীকাল হয়তো অহনাও এই তালিকায় ঢুকে যাবে ।
শালা বই!
বইগুলোকে গাল দিয়ে একটা তৃপ্তি পেল সে, যেন অধ্যাপক শালাকে আরেকবার গাল দেওয়া হলো। কিন্তু গাল দেওয়ার তৃপ্তি গালে-ঠোঁটে চওড়া হওয়ার আগেই সে শুনল, যেন এক ভাড়া করা খুনি একটা মেশিনগান তাক করে গুলি করা শুরু করেছে—কর্র্ কর্র্।
এবার আসলামের রাগ মাথা থেকে চুল বেয়ে উঠতে থাকল। তার চুল খাড়া হয়ে গেল । তার ভেতরে বদলা নেওয়ার একটা ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল । বাবার মেহগনি কাঠের আলমারি! তাঁর স্নেহের দান! এর সামান্য ক্ষতিও সে মানতে পারে না । এটি বাবার আলমারি না হলে গতকালই একে মাঠে নিয়ে পোড়াত সে। কিন্তু না পুড়িয়েও তাকে মেশিনগান হাতে খুনি অথবা খুনিগুলোকে শায়েস্তা করা যায়। যায় কি না? তার মাথায় হঠাৎ ড. বাবুল ফকিরের নাম ভেসে এল । বাবুল প্রাণী ও পোকা বিশারদ, পড়ায় অধ্যাপকের বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক দিন কোনো যোগাযোগ নেই। খুঁজেপেতে একটা ডায়েরি থেকে সে ড. ফকিরের নম্বর উদ্ধার করে ফোন করল।
রাত কম হয়নি । কিন্তু বাবুল যখন ফোন ধরল, আসলাম পরিষ্কার শুনল, ফোনের আশপাশে টিভির শব্দ হচ্ছে। আসলাম আশ্বস্ত হলো। আমি আসলাম, দোস্তো, তোমাগো আসলাইম্যা, মনে আছে? সে বলল ।
কেন থাকবে না দোস্ত, প্রচণ্ড আওয়াজে বলল বাবুল । সে ভিডিওতে দুর্ধর্ষ ঘটনাবহুল হিন্দি ছবি কাহানি দেখছে। স্ত্রীকে সেটি কিছুক্ষণের জন্য থামাতে বলে সে বলল, কাগজে দেখলাম, এক ব্যাংক থাইক্যা পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকা মাইরা দিছ । শালা ভালোই আছ, পরের ধনে পোদ্দারি করতাছ, বলে সে প্রকাণ্ড হাসি হাসল - বাবুলকে ফোন করার জন্য আসলাম নিজের ওপর রাগল, ভাবল, ফোন শেষে এ জন্য সে নিজেকে খুন করবে। কিন্তু তার আগে কাঠপোকা অথবা কাঠপোকাগুলোকে খুন করতে হবে। বাবুল এবার তার বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দিল । কাঠপোকা, অথবা ঘুণপোকা...
ঘুণপাকা! আসলামের হাত হঠাৎ যেন অবশ হয়ে গেল। ফোন পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
হ্যা দোস্ত, কাঠপোকা যা, ঘুণপোকাও তা-ই। যাহা পদ্মলোচন, তাহাই কানা ছেলে। এটি সেরাম্বিসিডেই ফ্যামিলির পোকা...
আরে রাখো তোমার সেরামিক ফ্যামিলির গল্প । ফ্যামিলি দিয়া কী অইব? আমি কি আমার মাইয়ার বিয়া দিতাছি ওই পোকাগোর লগে? ওগো খুন করমু কেমনে, তা-ই কও।
বাবুল প্রচণ্ড হাসল। হাসতে হাসতেই জানাল, এই পোকা সাবালক হওয়া পর্যন্ত কাঠ খায় । কাঠ থাইক্যা মাইক্রোব সংগ্রহ করে। এগুলোর শরীল সাদা। কল্লাটা কালা। ম্যান্ডিবুলটা এমুন শক্ত যে পাটার ওপর ফেইল্লা পোতা দিয়া মারলেও ভাঙ্গে না।
শিউরে ওঠার মতো ব্যাপার।
তবে দোস্ত, কাঠপোকা কিন্তু ভালো কাঠ, সিজন কাঠ খায় না—সেগুনগামারি খায় না। কাঁঠাল কাঠের লাল অংশ খায় না।
আসলাম জানিয়েছিল, কাঠপোকা তার বইয়ের আলমারির পেছনে লেগেছে । প্রচণ্ড হেসে বাবুল বলল, দুই নম্বর কাঠ দিয়া আলমারি বানাইলে কাঠপাপোকাতো খাইবই । নাকি শালা দুই নম্বরি কাম করতে করতে এক নম্বর কিছু চোখে পড়ে না? তারপর আচ্ছা রাখি, এক ক্রিমিনাল আবার বিদ্যার পিছন লাগছে। দেখি কী হয়, স্বপ্না চালাও চালাও-বলে ফোন রেখে দিল । কীভাবে কাঠপোকা খুন করতে হয়, তা নিয়ে কোনো কথা বলল না। এখন বাবুলের কাছে কাঠপোকার থেকেও বিদ্যা বালান খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাটাই। বেশি গুরুত্বের।
৪
ড. বাবুল ফকিরের কথাগুলো আসলামের কান পুড়িয়ে দিল। এবার তার মাথার চুলে জমা রাগেও আগুন লাগল । সেখান থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকল । কিন্তু ধোঁয়া হয়ে তার রাগটা একসময় মিলিয়েও যেন গেল। ফোনটা হাতে ধরেই সে নিশ্চল বসে রইল। তার মনে হলো, বাবুল ফকির তার পায়ের নিচের মাটি ধরেই টান দিয়েছে।
শালা ফকির!
কিন্তু বাবুলকে গালি দিতে দিতেই সে হঠাৎ চোখের সামনে আলমারির কাচে যেন কাঠপোকাগুলোকে বসে থাকতে দেখল । একটা নয়, অনেকগুলো।
সাদা শরীর, কালো মাথা, শুঁড়টা শরীরের থেক বেশী দীর্ঘ। পোকাগুলো, অবাক, তার দিকেই তাকিয়ে আছে এবং হাসছে।
উঠে দাঁড়িয়ে আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়াল আসলাম । পোকাগুলো নড়ল না, উড়ল না, তেমনি বসে রইল। জন্মের কুড়ি দিন পর বাষ্প আর মাইক্রোবে এখন তাদের শরীর পুরুষ্ট। পোকাগুলোকে এড়িয়ে আস্তে আলমারির গায়ে হাত রাখল সে। এসির হিমে আলমারির গা'টা শীতল । তার হাতে একটা কেমন শিরশির অনুভূতি হলো। সেটি মন পর্যন্ত পৌছাল। কিন্তু সেখানে পৌছেই হঠাৎ সেটি উষ্ণ হতে শুরু করল । আসলাম বুঝল, তার রক্ত গরম হচ্ছে। এই রক্ত এখন মাথায় উঠবে।
রক্ত গরম হওয়ার কারণ কি কাঠপোকা? অথবা কাঠপোকাগুলো? না, আসলামের রক্ত গরম হচ্ছে, কারণ, তার হঠাৎ এই জ্ঞান হয়েছে যে তার বাবা আলমারিটা বানাতে গিয়ে ঠকেছেন। বাবাকে মেহগনি বলে দুই নম্বরি কাঠ গছিয়ে দিয়েছে আলমারি ব্যবসায়ী।
বাবাকে ঠকিয়েছে? বাবাকে?
ব্যাপারটা নিয়ে যত সে ভাবতে থাকল, ততই ক্রোধে উন্মাদ হলো। সে সিদ্ধান্ত নিল, বাবাকে ঠকিয়েছে যে লোকটা, সে যদি বেঁচে থাকে, তবে যেখানেই সে থাক না কেন, মানুষ লাগিয়ে তাকে সে ধরবে। তারপর তার সামনে হাজির করাবে । তারপর দেখা যাবে ।
এটি ভেবে একটু শান্তি পেল সে । ডিভানে ফিরে বসতে গিয়ে সে বাবাকে বলল, আপনার লগে যে দুই নম্বরি করেছে, তারে আমি ছাড়মু না। হুহ! দুই নম্বরি!
তার কথায় হাততালি দেওয়ার মতো এবার কর্র্ কর্র্ শব্দ করতে লাগলো কাঠপোকাগুলো এবং এবং তাদের শক্ত চোয়াল নেড়ে হাসতে থাকল এবং কিছু যেন একটা বলতেও থাকল । আসলাম দেখল, কাঠপোকাগুলোর সঙ্গে বাবার হাসি হাসি-হাসি মুখটাও যেন হঠাৎ আলমারির কাচে ভেসে উঠল এবং তিনিও তাদের কর্র্ কর্র্ কালোয়াতির সঙ্গে গলা মিলিয়ে কিছু একটা বললেন।
পোকাগুলো কি বলছে দুই নামবারররই? বাবাও কি বলছেন? কাকে বলছেন?
শালা...
0 মন্তব্যসমূহ