দীপেন ভট্টাচার্যের বিজ্ঞান-কল্পগল্প : ক্যামেলট – একটি দূর সময়ের কাহিনী

দীপেন ভট্টাচার্যের গল্পপাঠসেদিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে, সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছিল, তারপর হঠাৎ থেমে গিয়েছিল। মনে হয়েছিলে বৃষ্টির ফোঁটাগুলি মাটিতে পৌঁছানোর আগে থমকে গিয়েছিলো, তারপর নিচে না পড়ে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। অনুভব করলাম হাঁটার সময় ভূমি থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছিলাম, যেন পৃথিবী আমাকে ধরে রাখতে পারছে না। ভূমিকম্পটা এসেছিল বৃষ্টি থামার পরই। ভূমিকম্পটা এক জায়গায় হল না, সারা পৃথিবী জুড়ে হল। বাড়িঘর ভেঙে পড়ল, রাস্তায় আবির্ভূত হল বড় ফাটল, পাহাড়ে নামল ধ্বস, নদীর জল উছলে উঠে প্লাবিত করল পাড়, ৎসুনামির ঢেউ তছনছ করে দিল সমুদ্রতীর, বহু মানুষের জীবন গেল। তারপর আবার সব শান্ত। মাটিতে পা ফেললে শরীর আর ওপরে উঠল না।
কিন্তু আসলে সব শান্ত হল না, পৃথিবী আগের মত রইল না। শুধু পৃথিবী কেন, সৌরজগৎ, ছায়াপথ, বহু দূরের গ্যালাক্সি, মহাবিশ্ব কিছুই রইল না আগের মত। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন মহাবিশ্বের দেশ-কালের বা স্থান ও সময়ের চাদরে দেখা দিয়েছে অস্থিতি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মান কমছে, মহাকর্ষ দুর্বল হচ্ছে, তবে অন্য সব বলের মান স্থিত আছে। অর্থাৎ মহাকর্ষ ছাড়া যে তিনটি বল আছে – তড়িৎ-চুম্বকীয় এবং নিউক্লীয় সবল ও দুর্বল মিথষ্ক্রিয়া – তাদের মান বজায় আছে। পৃথিবী ধীরে ধীরে সূর্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সূর্য ছেড়ে দিচ্ছে ছায়াপথ। তবে মহাকর্ষের এই হার একদিনে হল না, হাজার হাজার বছর ধরে তার শক্তি ধীরে ধীরে কমতে লাগল।

পাঠক ভাবছেন হাজার হাজার বছরের ইতিহাস, আমি এক মরণশীল জীব মাত্র, কেমন করে জানলাম। আসলে বহুদিন হল মৃত্যু হয়েছে আমার। এই নতুন আমিতে আপনার মত প্রতিটি মানুষের শরীরের দু-একটি পরমাণু (ভয় পাবেন না, আমি যখন এই লেখা লিখছি ততদিনে আপনারা সবাই গত হয়েছেন), আপনি যে বাতাস সেবন করছেন সেখানকার কয়েকটি পরমাণু আমার এই শরীরে পাওয়া যাবে। “তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি?” হা, হা। ততদিনে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মৃতপ্রায়, সূর্য হারিয়ে গেছে ছায়াপথের কোনো এক প্রান্তে, একা পৃথিবী চলেছে ছায়াপথ ছেড়ে অসীম মহাশূন্যের অন্ধকারে। না, পৃথিবীতে প্রাণ তখনও বিলুপ্ত হয় নি, মানুষ কয়েকটি হাইড্রোজেন পরমাণু একত্র করে সৃষ্টি করতে পেরেছিল হিলিয়াম আর নক্ষত্রের শক্তি, এই পদ্ধতিকে পাঠক জানেন ফিউশান নামে যা কিনা ঘটে চলেছে নিরন্তর, সূর্যের অভ্যন্তরে। এরকম অসংখ্য ছোট ছোট কৃত্রিম সূর্য পৃথিবীপৃষ্ঠে বসিয়ে দিল মানুষ, সেগুলো থেকে পেল তাপ, উদ্ভিদ পেল আলো। কিন্তু দেশ-কালের চাদরে যে ফুটো সৃষ্টি হয়েছিল কয়েক হাজার বছর আগে তা দিয়ে মহাকর্ষের সমস্ত শক্তি বেরিয়ে যেতে থাকল, মানুষ সেটাকে আটকাতে পারল না। পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে যেতে চাইল, তাকে বখলস দিয়ে ধরে রাখতে চাইল মানুষ।

কিছু জিনিস কিন্তু একই রইল। যেমন প্রেমের অনুভূতি। আমি ভালবেসেছিলাম একটি নারীকে। কিন্তু সে আমাকে ভালবাসে নি। তারপর যখন বখলস দিয়ে পৃথিবীর ভাঙ্গন আর রোধ করা যাচ্ছিল না সে এমন একটা টুকরোয় বাসা বাঁধল যেটা কিনা আমি যে টুকরোয় বাস করতাম তার থেকে আলাদা হয়ে যাবে। সে সেটা জানত। তার অজুহাত ছিল শেষ ভাঙ্গনের সময় তার টুকরোটা, যাকে আমি মালাবার দ্বীপ নাম দিয়েছিলাম, এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির দিকে রওনা হবে। আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম, ভেবেছিলাম তার জীবনটা সে এন্ড্রোমিডার অস্বচ্ছ ম্রিয়মান মেঘ্লা আলোতে কাটাবে, এই তার শেষ ইচ্ছা। কিন্তু যে দিন মালাবার দ্বীপ সত্যি সত্যি আমার টুকরো থেকে আলাদা হয়ে গেল, দেখলাম তার বাসা থেকে বেরিয়ে আসছে আর একটি পুরুষ, আমার কাছ থেকে এই তথ্যটা লুকিয়ে রেখেছিল সে। তার প্রতারণায় দুঃখিত হয়েছিলাম, মনটা ভার হয়ে রইল। এর একদিন বাদে, আমি দূরবীন দিয়ে আমার প্রাক্তন প্রেমিকার গ্রহাণুটা, মালাবার দ্বীপকে, দেখছিলাম, কারণ নিজেকে যতই আমি বোঝাই না কেন, তার কথা আমার মন থেকে মুছতে পারছিলাম না। (তাকে প্রেমিকা বলাটা ঠিক হবে কিনা জানি না, সে আমার সকল প্রেমাবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল) কিন্তু পাঠক – এর পরের কথাগুলো লিখতে আমি কোনোরকম আনন্দ অনুভব করি না, বরং এক ধরনের বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে যাই – আমি যা দেখলাম তাতে আতঙ্কে আমার হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল…আমার দূরবীনের অক্ষিবলয়ে দেখলাম আমার প্রেমিকার দেহ, তার পেছনে তার প্রেমিকের দেহ, তাদের বাসা, আর পুরো মালাবার দ্বীপ ধীরে ধীরে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। পাঠক, আপনারা এর কারণ বুঝতে পেরেছেন কিনা জানি না, কিন্তু আমি সাথে সাথেই বুঝলাম মহাবিশ্বে মাধ্যাকর্ষণ বল হারিয়ে যাবার পরে এবার তড়িৎ-চুম্বকের পালা, যে তড়িৎ-চুম্বকীয় বল আমাদের দেহ, আমাদের বাসস্থানকে আকার দেয়, তাদের ধরে রাখে, সেই বল এখন অন্তর্হিত হচ্ছে দ্রুত। আমার প্রেমিকাকে (আবার বলছি, তাকে প্রেমিকা বলা সঙ্গত হবে কিনা জানি না) আমি এই ব্যাপারে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সে আমার বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বাস রাখে নি। তাকে বলার চেষ্টা করেছিলাম সমস্ত মহাবিশ্বে কেউ যদি তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের মৃত্যু এড়াতে পারে সে হল আমি। না, আমি ঈশ্বর নই, কিন্তু পৃথিবীর অনিশ্চিত চলার পথে আমি সংগ্রহ করেছিলাম ছোট ছোট কৃষ্ণ গহ্বর। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিলুপ্ত হবার প্রক্রিয়ায় সেই গহ্বরগুলোর সমস্ত ভর, সম্মিলিত সমস্ত বস্তুকণা বেরিয়ে আসছিল সেগুলোর ভেতর থেকে, বলা যায় গহ্বরগুলো বিকিরণ করছিল শক্তি, সেই শক্তি দিয়ে আমি গড়ে তুলেছিলাম এক ছোট নতুন মহাবিশ্ব। সেই মহাবিশ্বের পদার্থবিদ্যার নীতি ছিল অন্যরকম, আপনার মহাবিশ্বের মত নয়। আমি জানতাম একদিন আসবে যখন শুধু মাধ্যাকর্ষণ বল নয়, তড়িৎ-চুম্বকীয় এবং নিউক্লীয় সবল ও দুর্বল মিথষ্ক্রিয়া এই মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যাবে, এক কথায় মহাবিশ্বই হারিয়ে যাবে। আমি জানতাম এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় নতুন ধরণের প্রাকৃতিক বল সৃষ্টি করা।

আমি স্বার্থপর নই, আমার আশঙ্কার কথা, আমার নতুন মহাবিশ্বের উদ্ভাবনের কথা বখলসে-আঁটা পৃথিবীর সবাইকে আমি জানাবার চেষ্টা করেছি, কেউ আমাকে বিশ্বাস করে নি, আমার প্রাক্তন প্রেমিকাসহ। তারপর যখন মহাবিশ্বের সমাপ্তি হল, আমার গড়া এক টুকরো নতুন মহাবিশ্ব, যাকে আমি নাম দিয়েছিলাম ক্যামেলট, বেঁচে রইল ‘কিছু না’র মাঝে। আমি একা বেঁচে থাকার বিপক্ষে নই, কিন্তু সে একার জন্য একটা পুরো মহাবিশ্বের প্রয়োজন, রাতের তারার আকাশ, ঝর্ণা, স্রোতস্বিনী, হিমালয়, ক্যারিব সাগর, মালাবার দ্বীপ, সাহারা, বনের হরিণ, শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি। মানুষের সঙ্গ ছাড়া বাঁচা কঠিন, কিন্তু মানুষ যদি না থাকে তাহলে অন্তত প্রকৃতিকে আমার চাই। ক্যামেলট নামটি ইতিহাসের স্রোতধারায় আমার কাছে পৌঁছেছিল, আমি শুধু জানতাম সেটি ছিল এক খুঁজে না পাওয়া দূর্গ, স্বপ্নের মধ্যে হয়ত যার বাস। কিন্তু আমার ক্যামেলটের মধ্যে যথেষ্ট শক্তি ছিল না সেই প্রকৃতি সৃষ্টি করার। অনোন্যপায় আমি ক্যামেলটে আবদ্ধ শক্তিকে ব্যবহার করলাম শেষ একটি কাজে। যেহেতু তখন স্থান ও সময় বলতে আমরা যা বুঝি তার অবসান হয়েছিল, আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল না, আমার হাতে উপায় ছিল সময়কে নতুন যদৃচ্ছায় সৃষ্টি করার। সেই যদৃচ্ছায় আমি সৃষ্টি করলাম একবিংশ শতাব্দীর, সেই যদৃচ্ছায় সৃষ্টি করলাম পাঠক আপনাকে, সেই যদৃচ্ছায় সৃষ্টি করলাম এই মুহূর্তটির যখন, পাঠক, আপনার দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে ‘এই’ কথাটির ওপর। সেই দৃষ্টি হবে এক পলকের, কিন্তু আমার ক্যামেলট সময়ের বাইরে থেকে সময় সৃষ্টি করে যাবে, সৃষ্টি করবে পলকের পর পলক।

আর আমি? আমি কি রইব ক্যামেলটে না একবিংশ শতাব্দীতে? আমি কি সৃষ্টি করতে পারতাম না আর একটি মালাবার দ্বীপ? সৃষ্টি করতে পারতাম কি সেই নারীকে যে কিনা আমার প্রেমের আবেদনে সাড়া দেবে? এসব কঠিন প্রশ্ন, এর উত্তরও সহজ নয়। তাই পাঠক, শেষাবধি আমি রয়ে গেলাম এক কোয়ান্টাম দোদুল্যমানতায়, পৃথিবী ও ক্যামেলটের মূর্ত ও অলীক বাস্তবতায়। আমি জানি এই কাহিনী, পাঠক, আপনাকে তৃপ্তি দেবে না, স্বস্তিও হয়তো দেবে না, কিন্তু আমি যা এখানে বর্ণনা করলাম তা বহু নিযুত কোটি বছরের পরের কাহিনী, বলতে পারেন সময়ের বাইরের কাহিনী, তাই তাতে অস্থির হবার কিছু নেই। তবে একটি কথা না বলে পারছি না, ডাইনোসরদের ধ্বংসের পরে সাড়ে ছ’ কোটি বছর চলে গেছে। আপনি পাঠক, জীবনের পথে, অনেক বার চোখের পলক ফেলেন; সেই কোনো একটি পলকে, বন্ধ চোখ খুললে দেখবেন আবার সাড়ে ছ’ কোটি বছর কেটে গেছে। পাঠক, আপনি ইতিমধ্যেই সময়ের বাইরেই বাস করছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ