কামরুন নাহার শীলা'র গল্প : দরজার ভিতর থেকে



'দরজার ভিতর থেকে' গল্পটি নিয়ে গল্পকার কামরুন নাজার শীলার সঙ্গে আলাপ। 
-------------------------------------------------------------------------
গল্পপাঠ : 
গল্পটি কখন ও কোথায় লিখেছেন।

কামরুন নাহার শীলা :
 ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের কোনও একদিনে এটি কুমিল্লার কোটবাড়িতে আমার বাসায় লেখা গল্পটি।

গল্পপাঠ : 
গল্পটি লেখার সময়ে কই কাজ করছিলেন, কই পড়াশুনা করছিলেন বা কই লিখছিলেন।
কামরুন নাহার শীলা :
২. আমি তখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করি।



গল্পপাঠ : 
গল্পটির বীজ কীভাবে পেয়েছিলেন।
কামরুন নাহার শীলা :
গল্পটির বীজ তৈরি হয় তারও আগে, সম্ভবত ২০০৩/২০০৪-এর দিকে। আমার শহর(ফেনী), আমার বিশ্ববিদ্যালয়(চট্টগ্রাম), সেখানে দেখা পরিবেশ (হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক), পাওয়া সংখ্যালঘু কিছু বন্ধুই মূলত এই গল্পের উপাদান জুগিয়েছে। 


গল্পপাঠ : 
এই বীজ নিয়ে কাজ গল্প লিখতে আগ্রহী হলেন কেন। কেন মনে হলো এই বিষয় নিয়ে গল্পটি লিখবেন?
কামরুন নাহার শীলা :
আমাদের দেশে সংখ্যালঘু সংকট বর্তমানে বৃহদাকার ধারণ করেছে, এটি অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই৷ এই সংকটের কারণে কীভাবে তারুণ্য ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, দরজার ভিতর ঢুকে যাচ্ছে সেটা লেখার প্রয়োজন অনুভব করি। মনে হয় তাদের এই সংকোচনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আগ্রাসন কীভাবে দায়ী হচ্ছে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। 


গল্পপাঠ : 
গল্পটি কতদিন ধরে লিখেছেন? কতবার কাটাকুটি করেছেন?
কামরুন নাহার শীলা :
খুব সম্ভবত দুইমাস লেগেছে গল্পটি লিখতে। প্রচুর কাটাকাটি করেছি। 


গল্পপাঠ : 
লিখতে লিখতে কি মূল ভাবনা পালটে গেছে?
কামরুন নাহার শীলা :
না, লিখতে গিয়ে মূল ভাবনা থেকে সরে যাইনি। 


গল্পপাঠ : 
গল্পটি লেখার পরে প্রথম পাঠক কে ছিলেন?
কামরুন নাহার শীলা :
আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু, কবি অঞ্জন সরকার জিমি গল্পটির প্রথম পাঠক। 


গল্পপাঠ : 
লেখার পরে কি মনে হয়েছে, যা লিখতে চেয়েছিলেন তা কি লিখতে পেরেছেন।
কামরুন নাহার শীলা :
হ্যাঁ, লেখার পর মনে হয়েছিল যা লিখতে চেয়েছিলাম, তা লিখতে পেরেছি।
দরজার ভিতর থেকে
কামরুন নাহার শীলা

বেলাল যেইদিন আমার মাসতুতো বোইনরে লইয়া পলাইল হেইদিন থেইকা পরের পনেরো দিন পর্যন্ত আমি বাসার বাইর হই নাই। এলাকা ছোডো। সবাই সবাইরে চেনে। আমারে আরও বেশি চেনে। আমি ক্রিকেট খেলতাম। ভালো বল করতাম। পূজা-পার্বণে ব্রাহ্মণের জোগালি দিতাম। আমার দুইডা মাসতুতো বোন আছিল। আর বেলাল আছিল আমার বন্ধু। 

আমি আর বেলাল একলগে পূজার চাঁদা তুলছি, মহররমের সিন্নি খাইছি, এক টিকিটে দুই ছবি দেখতে গেছি, সাকরাইন করছি, মদও খাইছি নবমীর দিন রাতে। আমগো লগে ভুট্টো আছিল, ওসমান আছিল, আলমগির আছিল, গোপাল আছিল, বশির আছিল, সেন্টু আছিল, মাঝেমাঝে বাহাউদ্দিনও আছিল। এখন গোপাল নাই। ইন্ডিয়া চইলা গেছে। 

মাসতুতো বোইন মানে খালাতো বোইন। আমার খালার মাইয়া। আমার ছোডো খালা। আপন না। মা-র খালাতো বোইন। দুইটা মাত্র মাইয়া তার। বড়োডার নাম রুমঝুম। ছোটোডার নাম কুমকুম। কুমকুম নামটা আপনাগো মনে থাকব। এই নামে একটা সিরিয়াল চলত টেলিভিশনে। হিন্দি সিরিয়াল। সনি টিভি। 

দুইডা মাইয়াই সিনেমার নায়িকাগো মতো। ফরশা, লম্বা আর পানপাতার মতো মুখ। ছোডোডা এখনও কচি, তবে বছর দুয়েক গেলে বড়োডারেও হার মানাইতে পারে হয়তো। হেরা আমার খালাতো বোইন। যদিও আপন খালা না। তবু আমি মুখ তুইলা তাকাই নাই, হেইভাবে ভাবি নাই কোনওদিন। হিন্দুগো মইধ্যে আত্মীয়-আত্মীয় বিয়া করণ নিষেধ আছে। একটু দূরের আত্মীয়গো মইধ্যে বিয়ার তেমন নিষেধ না থাকলেও আমার মা এইসব মাইনা চলত। হেরা আইলে চোখে-চোখে রাখত আমারে। আমি বিভিন্ন পূজা-পার্বণে ব্রাহ্মণ কাকার লগে জোগালি দিতাম। মা বোধহয় সন্দেহ করত আমি এইসবে জড়াইলে কাকা আমারে সাথে নিব না। 

কিছুদিন পরই বেলাল ফিইরা আইল পাড়ায়। রুমঝুমও আইল লগে। কেউই কিছু কইল না। ভাবখানা এমুন—যা হইছে ঠিকই হইছে। বেলাল একটা অনুষ্ঠান করল। ইয়ারবন্ধুগো খাওয়াইল প্যান্ডেল বাঁইন্ধা। ব্যান্ডের পোলারা সারারাইত গান গাইল। আমার ব্যান্ডের গান হুননের বহুত শখ। কিন্তু আমারে হে দাওয়াত দেয় নাই। দেওয়নের কথাও না। আমার সামনে আওনের হেঁডাম নাই খানকির পোলার। 

ভুট্টো টানছিল আমারে। মিছা কইরা কইছে, বেলাল না কি হেরে কইছে আমারে লইয়া যাইতে। আমি এই চাল বুঝি না মনে করছে মাগির পোলায়! আমি যাই নাই। কইছে, ‘তোর তো আপন বোইন না, খালাতো বোইন। তাও আপন খালা না, খালাতো খালা।’ কইয়াই হেরা হাসছে সবাই। আমার গা জ্বইলা যাইতেছিল। আমি কিছু কই নাই। শুধু কইছি, ‘মাগির পোলা বেলালরে কইছ হেঁডাম থাকলে আমারে সামনাসামনি আইসা দাওয়াত দিয়া যাইতে।’ জোরে কই নাই। মনে-মনে কইছি। হেরা সবাই মুসলমান। আমি বাসায় বইসাই ব্যান্ডের গান হুনছি। বড়ো স্পিকার লাগাইছিল। স্পষ্ট শোনা গেছে। 

এইসব কাহিনি কয়েক বছর আগের। চাইর-পাঁচ বছর তো হইবই। এহন হেগো বাচ্চাও আছে একডা। নাম রাখছে ইলিয়াস উদ্দিন। আকিকা করাইছে। হুনছি সামনে মুসলমানিও করাইব। বেলালের আম্মা আছে, বেলালের বোইনও আছে। শিরিন নাম। শিরিনরে আমি ন্যাংটা দেখছি। 

ঘটনা হুইনা বেলালরে আমার খুন করতে ইচ্ছা হইছিল হেইদিন। খানকির পোলার সাহস কত! ভট্টাচার্যের মাইয়া ভাগাইয়া নেয়! মায়ে কইত আগের দিনে ব্রাহ্মণগো মুখ দিয়া আগুন বাইরাইত। খানকির পোলা, হেইদিন থাকলে তুই তো ছাই হইয়া যাইতি! 

হালার জীবনের দুঃখই এইডা। আপনি হুনবেন, আগের দিনে আপনার বাপে এই করছে, ওই করছে। আপনার দাদা পিউর সৈয়দ বংশ, জমিদারের নায়েব। আপনার নানাই আছিল ডাকাইত-সর্দার। সবাই ভয়ে মুইতা দিত। আপনার বেলায় কিছু নাই। সবাই এহন আপনার গায়ে মোতে। 

কুমকুম দৌড়াইয়া আসে বাসায়। আমি ভাত খাইতেছিলাম। মা-র দিকে তাকাইছে আর আমতা-আমতা করছে। পরে আমারে আলাদা কইল ঘটনাডা। রুমঝুম নাই। পাওয়া যাইতেছে না। আর বেলালও নাই। আমি জিগাইলাম, ‘হে ক্যামনে জানে?’ কইল, শিরিনরে ফোন করছে। শিরিন সঠিক কইবার পারে নাই। আমার মা ঠিকই বুঝছে। আমারে কইল, ‘রুমঝুম পলাইছে, না! আমি ঠিকই জানতাম। খানকি মাইয়া একডা। পড়া শিখাইছে, গান শিখাইছে পলাইয়া যাওনের লাইগা।’ জিগাইছে, ‘পোলাডা কেডা?’ আমি কিছু কই নাই। মনে হইতাছিল মায় খুশি হইছে খুব। 

হেরা গান গাইত দল বাঁইন্ধা। একখান নাম দিছিল দলের: ‘শুভ্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’। আমার মেসো, মানে খালু আছিল গানের মাস্টর। গান শিখাইত। আর বাসায় গানের দল করত। পয়লা বৈশাখে, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ—এই দিনগুলাতে। বেলাল আমার থেইকা বছরখানেক বড়ো হইব। জাউরার হাফেজ। লাইট চুরি করত। পিনিক খাইত। পরে হালায় ফ্লেক্সির দোকান দিয়া ভালা হইয়া গেছে। আমরা জানতাম কেমুন ভালা হে। ডুবাইওলার বউগো লগে মোবাইল ফোনে লাইন মারত হারাদিন। রাইতের বেলা গার্মেন্টসের মাইয়াগোর মেসের সামনে বেহুদা ঘুরাঘুরি করত। মুঠ পাকাইয়া সিগারেটরে এমুনভাবে টানত দেইখা মনে অইত জমিদারের নাতি। 

আমার বাইর না হওনের কোনও মাজেজা নাই। হুদামিছাই। একটু শরম লাগতেছিল। পালাইয়া যাওয়া শরমের ব্যাপার। মুসলমানের লগে পালানো আরও শরম। আমার কথা হুনতে ভালা লাগতেছিল না। আগুনের মতো ছড়াইছিল কথাডা। আমার খালায় গলায় দড়ি দিতে চাইছিল। মায়ে ঠেকাইছে। আমার মেসো, মানে খালু, পরদিনই এলাকা ছাড়ছে। ভাইগ্য ভালো, নিজের বাড়ি না, ভাড়াবাড়ি। 

রুমঝুমরে আমার ভালা লাগত। মনে হইত, হেয় যদি আমার বউ হইত তয় ভালা হইত খুব। লেখাপড়া জানে, গান জানে, ফরশা, লম্বা আর সোন্দর মুখ। আমার দিকে আড়চোখে তাকাইছে কয়েকবার। মনে হয়, কইতে চাইছে হেয় ভালোবাসে আমারে। আমিও ‘শুভ্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’ করছি কয়েকদিন। পিছনের লাইনে বইসা কোরাস গাইতাম, ‘আজ যত যুদ্ধবাজ, দেয় হানা হামলাবাজ।’ বালছাল অর্থও বুঝতাম না তেমন। তবু সবার লগে গাইতাম, ‘পৃথিবী, তোমায় আসামির মতো জবাব দিতে হবে।’ তারপর ছাইড়া দিছি। নটির পোলা মুনিরের লাইগা। আমার খালু হেরে সব দায়িত্ব দিয়া রাখছিল। হালায় আমারে আমার খালার কোলে বসাইছিল একবার। তহন আমি অলরেডি কেলাস টেনে পড়ি। এক প্রোগ্রামে যাইতেছিলাম। টেম্পু ভাড়া করছে হেই। টেম্পুর ভিতর জায়গা নাই। আমারে কইছে, ‘বিনয়, তুমি তোমার মাসির কোলে বসো।’ দেখছেন কী কারবার! রুমঝুম আমার দিকে তাকাইয়া হাসছিল। হেরপর থেইকা ওই বালের গোষ্ঠী ছাইড়া দিছি। 

মায় একদিন কইল, ‘বেলাল তো রুমুর উপর অইত্যাচার করতেছে। তুই গিয়া কথা কস না। হেই তো তোর বন্ধু।’ ততদিনে বছর দুয়েক হইয়া গেছে। ইলিয়াস পয়দা হইছে। ট্যাঁ-ট্যাঁ কইরা কাঁদে আর রুমুর মাই চোষে। আমি মারে কইলাম, ‘বন্ধুর মায়েরে চুদি। হেই একটা খানকির পোলা। আমার পরানের ধনরে চুরি করছে।’ এইসব কথা মনে-মনে কইলাম। হিন্দুরা মা-বাপের সামনে গালাগালি দেয় না। 

মা-র কথা সত্যি। বেলাল সত্যিই মাইরধর শুরু করছে হের উপর। আমিও হুনছি। অসিত কাকা একদিন আমারে কলপাড়ে ডাইকা কইছিল। কইছিল, ‘বাবা, একবার কথা কইয়া দেখো। তোমরা ছাড়াতো হের কেউ নাই এই পাড়ায়।’ হুইনা মন খারাপ হইছে। মাসিরা তো ঘটনার পরপরই ভাগছে ইন্ডিয়ায়। হুনছি গেরামের ভিটাবাড়িও বেইচা দিয়া গেছে রাতারাতি। আমগোরেও কয় নাই। কুমকুমরেও লগে লইয়া গেছে। কুমকুম এতদিনে বহুত বড়ো হইয়া গেছে নিশ্চয়ই। দেখতে সোন্দর হইছে আরও। হে তো হের বড়ো বোইনের চাইতে কিউট আছিল দেখতে। 

বেলাল হাসতে হাসতে আমারে কইল, ‘হম্মন্দির পো, এতদিনে বোইনের খবর নিতে আইছ! তোমার বোইন তো চোপা করে আম্মার লগে। মালাউনগো মতোই বেয়াদব হইছে। পোলাডারেও মালাউন বানাইতেছে।’ শিরিন ভিতরের ঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া হাসছে। আমি কিছু কই নাই। শরবত খাইয়া চইলা আসছি হেগো বাসা থেইকা। বেলাল আমার বন্ধু হইলেও ছোডোবেলা থেইকায় ডরাইতাম হেরে। ওসমানরেও ডরাইতাম। ভুট্টোরেও ডরাইতাম। এমনকী সবচেয়ে ভালা যে বাহাউদ্দিন, আমার পরানের বন্ধু, হেরেও ডরাইতাম মনে-মনে। 

পরশু রাইতে রুমু মারা গেছে। ফাঁস খাইছে ফ্যানের লগে। বেলাল আর হের মারে ধইরা নিয়া গেছে পুলিশ। হেরা না কি সুরতহালে রুমুর শরীলে খুন্তি-পোড়া দাগ পাইছে। গলায় আঙ্গুলের ছাপ পাইছে। লন্ড্রির দোকানদার তৈয়ব মিয়া কইল, মার্ডার কেইসের চার্জ পড়ছে দুইজনের উপর। কমপক্ষে চোইদ্দ বছর। 

রুমু বিয়ার পর মাঝেমাঝে আসত আমগো বাসায়। মা-র লগে কথা কইত। বাচ্চাটা ট্যাঁ-ট্যাঁ কইরা কাঁদত কোলের মইধ্যে। রুমু কথা কইতে আমার দিকে একটু ঘুইরা বইসা মাই ঢুকাইয়া দিত বাচ্চাটার মুখে। আমি আমার ঘরের দরজা দিয়া দেখতে পাইতাম। হেও বুঝতে পারত আমি আছি ঘরের ভিতর। ঘুইরা বইসা আমারে বুঝাইয়া দিত। বাচ্চাডার কান্না থাইমা গেলে আমি টিভিতে রেসলিঙের সাউন্ডটা কমাইয়া দিতাম। 

এই রুমুরে আমি চিনি নাই কখনও। দেখতে আগের মতোই, চোখগুলা হালকা বইসা গেছিল কেবল। আমার ঘরের দরজায় আইসা দাঁড়াইত। জিগাইত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইতে হইলে কী-কী করণ লাগে। আমি না তাকাইয়াই কইতাম, ‘আমি খবর নিমু।’ আমার চোখে তখন হারমোনিয়াম-বাজানো রুমঝুম ঘুরত। একবার ওই আমার কবজিতে ধরছিল। বহুত আগে। কোনও এক ফাংশানে। স্টেইজে উঠবার আগে জুতা খুলতে খুলতে বামহাত দিয়া আমার কবজি চাইপা ধরছিল। আমি কবজির হেই জায়গাটা নিজেই অন্য হাত দিয়া ছুঁইয়া দেখতাম মাঝেমাঝে। হেই রুমঝুমরে আমি চিনতাম। এই রুমুরে আমি চিনি নাই কোনওদিন। 

আমার খুব অভিমান হইছিল। আমি কীসে কম আছিলাম! আমি তো বেলালের চাইতে কোনও অংশে কম না! হিন্দুগো মইধ্যে আত্মীয়-আত্মীয় বিয়া হয় না। হয়তো হেই কারণেই হে কোনওদিন আগ্রহ দেখায় নাই আমার উপর। আমিও দেখায় নাই। নিজেরে এই বইলা সান্ত্বনা দিতাম। তবু হে তো আমারে একবার বইলা দেখতে পারত। নিজের উপর রাগও হয় মাঝেমাঝে। আমিও তো পারতাম। কী হইত! হে না করত বড়োজোর। না করলে আমি তো জোরও করতে পারতাম। হেই আত্মীয়তার দোহাই দিত হয়তো। কী এমুন বালের আত্মীয়তা! রক্ত তো এক না। এইরকম বিয়া হিন্দুধর্মে জায়েজ আছে। হেরা অবশ্য আমগো আত্মার আত্মীয় হইয়া উঠছিল। আমার মা-ই তাগোরে এই পাড়ায় ডাইকা আনছিল। পাশে বড়ো কলোনি। হেই কলোনির বড়োলোকের মাইয়ারা গান শিখতে চায়। এই অজুহাত দিয়া বাসা ভাড়া নিয়া দিছিল। ছাত্রছাত্রীও তেমুন কম পাই নাই আমার মেসোয়। কলোনির হেরা ভালো টাকা দিত। 

‘শুভ্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’তে হের লাইগাই যাইতাম। মাদারচোদ মুনিরের লাইগা ভিড়তে পারি নাই কাছে। কিন্তু দূর থেইকা চোখাচোখি হইছে। হের চোখে মায়া আছিল আমার লাইগা। হয়তো আমিই বুঝি নাই। বুঝি নাই বেলালের মতো পোলার লগে হেই ভাইগা যাইতে পারে! বুঝলে আগে থেইকাই আমি হেরে প্রস্তাব দিতাম। বেলাল নিশ্চয়ই ফুসলাইছে হেরে। মাইয়াডা জন্মের ধরা খাইছে। 

আমার অবশ্য রুমুর লাইগা মায়া হয় না এখন আর। হে তো মাঝেমাঝেই আইসা খাড়ায় আমার ঘরের দরজার সামনে। একদিন কইছে, ‘বিনয়দা, আমারে একটা চাকরি জোগার কইরা দাও। আমি ছাইড়া দিমু ইলিয়াসের বাপেরে।’ আমি কইছি, ‘দিমু।’ আমি ওর দিকে একবার তাকাইয়াই চোখ সরাইয়া নিছি। এই রুমুরে আমার চিনতে ইচ্ছা করে না। 

হেরা যহন আগে আইত আমি চোখ-কান খোলা রাখতাম। হেরা মা-র ঘরে গিয়া বইত। মা-র লগে গল্প পাড়ত হেরা মায়ে-ঝিয়ে তিনজন। আমি খালি ভাবতাম রুমঝুম-কুমকুম আইসা দাঁড়াইব আমার দরজার সামনে। কুমকুমের কথা কম ভাবতাম, রুমঝুমের কথাই ভাবতাম বেশি। কুমকুম তখনও ডাগর হয় নাই। রুমঝুমরে নিয়া কত কী যে ভাবতাম! ভাবতাম, এক দুপুরে রুমঝুম দরজায় আইসা দাঁড়াইব। মাও ঘরে থাকব না। হয়তো মা হেগো ঘরেই বেড়াইতে গেছে। এই ফাঁকে রুমঝুম আইসা দাঁড়াইছে আমার দরজায়, হাসছে আমারে দেইখা। আমি হেরে ঘরে টাইনা নিয়া দরজা আটকাইয়া দিছি। 

রুমু মারা গেছে গতপরশু। মাইরা ফেলছে হেরে। আমার তেমন দুঃখ লাগতেছে না। মেয়েডা বাঁচছে মইরা গিয়া। হে কি চাইছিল আমি হেরে উদ্ধার করি? একদিন কইছিল, ‘পোলাডারে নিয়া ভাইগা যামু আমি। যেদিকে দুচোখ যায়। যে লইয়া যাইতে চায় তার লগেই যামু।’ আমি হাসছি। পাগলামি করতে মানা করছি। হে কইছে, ‘নিজে পাগল হইতে পারো না, তাই অন্যরেও মানা করতে চাও।’ বইলা চইলা গেছে। আস্তে-আস্তে। মনে হইতেছিল যাওয়ার কোনও ইচ্ছা নাই তার। আমি উইঠা দরজা বন্ধ কইরা দিছি। এর বেশি আর পারতাম না আমি। 

অসিত কাকা আসছিল একটু আগে। কইল, ‘যাবি না?’ তোরা ছাড়া তো আর কোনও আত্মীয় নাই হের এইখানে। একটু পরে কবর দিতে নিয়া যাইব।’ আমি বলছি, ‘যামু।’ অসিত কাকা চইলা গেছে। আমি উইঠা দরজা বন্ধ কইরা দিছি। তার কিছুক্ষণ পর পাড়ার রাস্তায় ‘আল্লাহু আকবর’ আওয়াজ করতে করতে কারা যেন ট্রাকে কইরা রুমুরে লইয়া চইলা গেল। আমি দরজার ভিতর থেইকাই স্পষ্ট শুনলাম। রুমঝুম ভট্টাচার্যরে কবর দিতে নিয়া যাইতেছে মহল্লাবাসী। 



লেখক পরিচিতি
কামরুন নাহার শীলা 
জন্ম ২৯ জুন, সোনাগাজী, ফেনী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। পেশায় শিক্ষক।
প্রকাশিত বই— লালবেজি [গল্প; বাতিঘর, ফেব্রুয়ারি ২০১৯] 
শালবনের গান [কবিতা সংকলন; কবিতাভবন, আগস্ট, ২০১৯]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ