মোজাফ্‌ফর হোসেনের গল্প : স্পাই



বৃহস্পতিবার। হাফ স্কুল। ছুটি হয়েছে দুটোই, বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে আরও ত্রিশ মিনিট। আমাদের বৈঠকখানার সামনে তখন বিভিন্ন বয়সী মানুষের জটলা। ছোটো হওয়ার কারণে অন্যদের পায়ের ফাঁকগলিয়ে সামনের দিকে যেতে কোনো অসুবিধা হলো না। দেখি, একটা লোক থেবড়িয়ে বসে আছে মাটির উপর। চটের বস্তা শরীরে জড়ানো। বুড়ো চীনাদের মতো দাড়ি।
জটপাকানো চুল। স্মরণকালে হয়ত চুল কাটেনি, ধোয়ও নি। বয়স অমরত্ব প্রাপ্তির পর বৃদ্ধ হতে হতে কোনো একটা পর্যায়ে আটকে গেল যেমন দেখানোর কথা। তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারিনি;খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম লোকটিকে। পায়ের কাছে একটা ব্যাগ পড়ে। তলাটা ছেঁড়া, কিছু যে থাকবে না, বোঝায় যাচ্ছে। ব্যাগের এক কোণা শক্ত করে ধরে রেখেছে, সে জন্যেই কিছু না থাকা সত্ত্বেও ব্যাগটি ধরে টানাটানি করছে টোটন মামা। লোকটি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না। টোটন মামা এক টানে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল দূরে। ফেলবেই যখন নেয়ার কি দরকার? এই সামান্য প্রশ্নটুকু করবার মতো মানুষ সেখানে ছিল না। সকলে মজা দেখছে দাঁড়িয়ে। কতদিন পর যেন তারা কিছু দেখে মজা পাচ্ছে। আগে গ্রামে যাত্রাপালা হতো, অশ্লীলতার অভিযোগে এখন আর হয় না। বড়ভাইদের মুখে স্কুলমাঠে সার্কাস হওয়ার গল্প শুনেছি। সেটিও বন্ধ হয়েছে চিরকালের মতো। গ্রামের মানুষের মজা করার যে গল্প শুনেছি এতদিন, আজ দেখছি সচক্ষে।

ফকির হলি হতি পারে। ফজু চাচা বলে।

আশেপাশের দশ গাঁয়ি দেকিছি বুলি মনে হচ্ছি না। পেছন থেকে হাফি চাচার কণ্ঠ শুনি।

আজ শুক্কুরবার না। তাছাড়া ফকির হলি ভিক্ষি তুলার ঝুলা থাকতুক। এভাবে পড়ি না থেকি বাড়ি বাড়ি যাতুক। মবু ভাই ভুল বলেনি। আমাদের এখানে শুক্রবার ফকির আসে। অন্য দিনগুলোতেও দুয়েকজন আসে। এলাকার ফকিরদের নামসহ আমাদের চেনা। কিন্তু এই লোকটিকে কেউ চিনতে পারে না। হাফি চাচার মতো পুরনো মানুষও যখন কখনো দেখেনি বলে ঘোষণা দিল, অন্যরা আর কি বলবে!

এই বুড়ো, তোর নাম কি? কুতা থেকি এইচির? কুউন গাঁতে বাড়ি? একিনেচাস কি? কেমুন করি আসলি? শোয়েব ভাই হাতের কঞ্চি দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে প্রশ্নগুলো একটার পিটে আরেকটা করে যায়।

মুখ দি একটা শব্দও বের করতি পারলাম না; আর তুই খবরের লোকদেরমতোন সাক্ষাৎকার নিতি চাচ্ছিস! শোয়েব ভাইকে উদ্দেশ্য করে আমাদের অংকের মাস্টার বিলু স্যার বলে।

লোকটি কোনো কথা বলে না। কঞ্চির খোঁচাতে হাত ও পিঠে খেলেও গেছে। লোকটি চুপ করে তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে। নিজের মতো আনমনে কি যেন আঁকাআঁকি করে ধুলোয়। কিছু একটা বোঝা যায় তো পর-মুহূর্তেই অন্য একটা দাগ টেনে গুলিয়ে ফেলে।

কেউ আসতি দেকিছে?

কে দেকিছে পয়লা?

হেঁটি এসিছে?

একটার পর একটা প্রশ্ন আসতে থাকে। আছরের আযান হয়ে যায়। কেউ কেউ নামাজও পড়ে আসে। এক মানুষ যায়, নতুন মানুষ আসে, জটলা একটি বারের জন্যও হালকা হয় না। লোকজন একবার করে খোঁচা দেয় হাতের কাছে যা থাকে তা দিয়ে, সরে আসে। খুব কাছে কেউ যায় না—অচেনা কুকুর নিয়ে খেললে আমরা এমন নিরাপদ দূরত্ব রেখে দিই। পাড়ার মোড়ের বুড়ো সজনে গাছ থেকে আমরা যে-রকম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঠা বের করি, গাছটি নড়েও না চড়েও না, এই অচেনা বৃদ্ধও সে-রকম প্রাণ থেকেও জড়ের মতো পড়ে থাকে। গাছের মতো একটিবারও নিজে থেকে জানান দেয় না তার প্রাণ থাকার কথা। একদল হতাশ হয়, অন্যদল নতুন উদ্যম নিয়ে শুরু করে। একটা পরিপূর্ণ শব্দ ওর মুখ থেকে বের করতে পারলে সে যেন গ্রামে বীরের মর্যাদা পাবে!

আমরা যখন একঘেয়ে দৃশ্যে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম, তখনই আমাদের মধ্য থেকে বোমাটা ফাটাল কেউ।
স্পাই! দেখো-গে ভারতের স্পাই। বোবা-পাগলের ছদ্মবেশে তথ্য নি’পালাচ্ছে। কেউ একজন বলল ভিড়ের ভেতর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে জনতা চঞ্চল হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। মুহূর্তে সকলে যেন নিশ্চিত হয়ে গেল, লোকটি স্পাই ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। গ্রামের পশ্চিমে মাইল ছয়েক গেলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। আমাদের গোপন কোনো তথ্য নিয়ে সীমান্ত দিয়ে পালাচ্ছে বলে আমরা ধরে নিলাম।

স্পাইদের নিয়ে গ্রামে অনেক গল্পের প্রচলন ছিল। একটা গল্পের কথা তখনই মনে পড়ল। এরা এমন কৌশলী ও দায়িত্ববান দেশপ্রেমিক হয় যেকোনো দেশে স্পাইগিরি করতে গিয়ে বিয়ে-সংসার পর্যন্ত করে, তারপর মিশন শেষ হলে বিনা বাক্যে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে স্বদেশে ফিরে যায়।এমনভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে তাদের এই ছদ্মবেশ ধরাও যায় না।

আমাদের ভেতর থেকে কেউ কেউ এরিমধ্যে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। প্রথমেই একজন কঞ্চির মাথায় চুলগুলো পেঁচিয়ে টান মারল জোরে। নকল চুল হলে উঠে আসত। কিন্তু মাত্র কয়েকটা চুল ছিঁড়ে এলো। লোকটির গায়ের রঙ আসল কিনা, মুখে মেকআপ দেয়া কিনা, পরীক্ষা করার জন্য হাবু ভাই পেছনের গর্ত থেকে এক বালতি পানি তুলে লোকটির মাথায় ঢেলে দিলো। গায়ের রঙ যেমন ছিল তেমনই থাকলমাঝখান থেকে সকলের সন্দেহটা থেকে গেল।

কাপড়চোপড় খুলি দেখা দরকার কুনো কাগজপত্র বা চিরকুট আছে কিনা? হাফিজুল ভাই বলে। লোকজন তার কথাই উৎসাহ পায়। কাপড়চোপড় বলতে তেলচিটচিটে চটের বস্তা। তাও শরীরের সামান্য অংশ ঢাকা। সেটুকুই খোলার জন্য কয়েকজন এমনিতেই সুযোগ খুঁজছিল; এতক্ষণে তারা জন-সম্মতি পেয়ে গেল। নারীরা একটু সরে দাঁড়াল। চটের বস্তাটা শরীর থেকে আলাদা করতে কষ্ট হল না। হাত লাগাতে হয় নি। লাঠির মাথা দিয়ে টানাটানি করতে করতে কিছুটা ছিঁড়ে কিছুটা খসে শরীরটা আলগা হয়ে গেল। আমরা চারপাশ থেকে ঘুরেফিরে দেখলাম। কাগজের ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু আমাদের মধ্যে একজন এমন একটা বিষয় আবিষ্কার করল যে তাতে বৃদ্ধের স্পাই পরিচয় নিয়ে কারো ভেতর আর কোনো সন্দেহ থাকল না। হিন্দু হলে ভারতীয় স্পাই হবে এরকম একটা বিশ্বাস বাতাসে কে বা কারা যেন কবে ভাসিয়ে দিয়েছে, আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে তা শরীরে মিশে গেছে।

যেহেতু কোনো সন্দেহ থাকল না, লোকজন মোটামুটি নিশ্চিত হলো যে, কাগজ বা চিরকুট নিশ্চয় ছিল কাছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যা করা উচিত, তাই করেছে, খেয়ে ফেলেছে। পেটটা চিরে দেখা সম্ভব হলে পাওয়া যেত। কিন্তু ততদূর করা সম্ভব নয়। কারো কারো মনে ইচ্ছা থাকলেও স্রেফ অনভ্যস্ততার কারণেই লোকটির পেট কেউ চেরার কথা ভাবতে যায় না। লোকজন চাইলে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। পেট চেরার চেয়ে গণধোলাই অনেক সহজ বিষয়। কিন্তু তাতে সে যে-তথ্য নিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো জানা যাবে না।

থানায় দিই। পুলিশের হাতে পড়লি পিটি সব তথ্য বের করি নেবে। একজন বলে।

সেই ভালো। একটা খবর হলি দেশের মানুষ জানবি আমাদের উপর হিন্দুদের স্পাইগিরির বিষয়টি। মেরি ফেলা ঠিক হবে না। অন্য একজন বলে। ততক্ষণে দিনের আলো নিভে গেছে। অন্ধকারে অনেকের মধ্যে কে কথা বলছে ঠিক মতো বোঝা যায় না। সিদ্ধান্ত যখন একরকম চূড়ান্ত হয়ে এসেছে তখনই মা এলো।

যা করার সকালে করিস। সব্বাই ফিরি যা। সারাদিন কিছু খায়নি; খাবে। পাড়ার লোকজন মাকে ভয় না সমীহ করত জানি না, মা বলাতে মৃদু প্রতিবাদ উঠলেও সেটা দানা বাঁধতে পারল না। সকালে মার কাছ থেকে বুঝে নেবে এমন শর্তে লোকজন যে যার মতো সরে গেল অন্ধকারে। লোকটিকে দু তিনজন মিলে ধরে বৈঠকখানার ভেতরে তোলা হল। খাইয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখা হবে। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও এলাম ভাত আর তরকারি নিয়ে। হারিকেনের আলোয় মা একটা থালে ভাত, পাশে দুটো বাটিতে আলাদা আলাদা করে তরকারি দিল। মাছ আর ডাল। বৃদ্ধ এখন নড়ছে। হালকা বাতাসে গাছের পাতা নড়ার মতোন।হারিকেনের আলোয় মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে প্লেটের শুধু ভাত নাড়তে লাগল। মা নিজে ডালের বাটিটা ঢেলে মাছটা দিতে গেলে ইশারা করে বারণ করল।

জিজ্ঞাসা করো তো কোথা থেকে এসেছে? মাকে বললাম। মনে হচ্ছিল মা এখন কিছু জানতে চাইলে বলবে। কিন্তু মা কোনো প্রশ্ন করল না। পাশে বসে থেকে খাওয়াল। খাওয়া শেষ হলে আমাকে নিয়ে বের হয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল। যে দুয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও আমাদের দেখাদেখি সরে গেল।

সেদিন শুতে গেলাম চাপা উত্তেজনা নিয়ে। থানায় খবর চলে গেছে। সকালে পুলিশ আসবে। শুক্রবার, স্কুল নেই। থাকলেও যেতাম না। এমন ঘটনার সাক্ষী হবার সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়বার আসে না। আমি নিশ্চিত গ্রামের প্রত্যেকে সেদিন উত্তেজনায় ঘুমাতে পারেনি। আমার ঘুমটা এলো বেশ দেরিতে। ভোর রাতের দিকে। তাই উঠতে পারলাম না সময় মতো। বাইরে হৈচৈ না হলে হয়ত আরও কিছুক্ষণ ঘুমতাম। তাড়াতাড়ি উঠে এসে দেখি লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা আর অসন্তোষ। লোকটিকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাইরে থেকে তালা আটকানো আছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে সে নেই। মা একবাক্যে বলে দিয়েছে, লোকজনের ছুমুতে ভেতরে রেখি তালা দি’ শুইছি। একুন কিভাবে কি হলু আমি কি জানি!

ততক্ষণে আশেপাশের গ্রামে, সীমান্তের দিকে লোকজন চলে গেছে খুঁজতে। একজন এও বলল, লোকটা মানুষ না, জিন। অন্য একজন প্রশ্ন করল, জিন হেঁদু হয় নাকি? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউ এগিয়ে এলো না। এর ভেতর রহস্য যে একটা আছে, এ নিয়ে কারও মধ্যে কোনো সন্দেহ থাকল না।

বিকাল পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সন্ধান পাওয়া গেল না। বর্ণনামতো কোনো মানুষ আশেপাশের গ্রামের কেউ দেখেছে বলেও তথ্য পাওয়া গেল না। আমি নিজে অন্যদের সঙ্গে মাঠের আখ-খেতের ভেতর লাঠি দিয়ে বাড়িয়ে বাড়িয়ে খুঁজেছি। একটা লোক কিভাবে এলো, কিভাবেগেল কেউ কিছু বলতে পারে না। রাতে একরকম হতাশা আর গা ছমছমে অনুভূতি নিয়ে শুতে গেলাম। পাশের ঘর থেকে বাবা-মায়ের চাপা কণ্ঠে কথা কাটাকাটির শব্দ আসে।

তুমি কাজটা ঠিক করলে না? বাবা বলে।

তুমরা ঠিক করছিলে তো? স্পাই বলে পুলিশের হাতে তুলে দিতে বাধছিল না? মা প্রশ্ন করে।

স্পাই কিনা সেটা পুলিশ দেখতুক। বাবার উত্তর।

তাই বুলি সব জেনিবুঝি?

এত বছর পর এসিছে কেনে?

এটা ওর দেশ। বাড়ি। জন্মভিটা। আসতিই পারে।

বুললিই তো হলু না। বাড়িঘর জমি-জায়গা আর তার আছে নাকি?

বউ আর মেয়িকে ঘরের মধ্যি আটকি রেকি পুড়ি মারলু পাকিস্তানিরা। দেশ স্বাধীন হলি একা মানুষটাকে পাগল বানি’ দেশছাড়া করলি তুমরা। একুন আবার স্পাই বুলি পুলিশের হাতে তুলি দিচ্ছ, আর কত অবিচার করবা মানুষটার উপর? মা এবার চড়া কণ্ঠে বলে।

আস্তে। ছেলিরা ঘুমাচ্ছি। বাবা ধমকের সুরে থামিয়ে দেয়। বাড়ি জুড়ে আদিম নীরবতা নেমে আসে।




লেখক পরিচিতি
মোজাফফর হোসেন
গল্পকার। অনুবাদক। প্রবন্ধকার।
কুষ্ঠিয়ায় জন্ম। ঢাকায় থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ